বিংশ শতাব্দী জুড়ে হাজারো দুঃখ কষ্ট সহ্য করা সত্ত্বেও মানবতা তার প্রত্যাশিত শান্তি, সমৃদ্ধি, কল্যাণ ও সৌভাগ্য অর্জন করতে পারেনি। না ইয়াল্টা কনফারেন্স এর প্রথমার্ধে আর না দ্বিতীয়ার্ধে। বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে ১৯৪৫ এ অনুষ্ঠিত ১ম ইয়াল্টা কনফারেন্সের আগে বিশ্ব মানবতা দুটি ভয়াবহ বিশ্বযুদ্ধের করুণ অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়। ১ম বিশ্বযুদ্ধ উসমানী খিলাফত, রাশিয়ার রাজতন্ত্র, ব্রিটিশ সাম্রাজ্য এবং অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি সাম্রাজ্যের মতো সাম্রাজ্যগুলোর অবসান ঘটানোর বিনিময়ে ফ্যাসিবাদী স্বৈরশাসনকে গ্রহণ করে। অতঃপর ২য় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয় স্ট্যালিন, হিটলার, মুসোলিনি, ফ্রাঙ্কোর মতো স্বৈরশাসকদেরকে নির্মূল করার জন্য । এই নোংরা যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলা মানবতাকে কঠিন মরণ যন্ত্রণা উপহার দিয়েছিলো।

বিশ্ব মানবতা যখন স্বাধীনতা, মানবাধিকার এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা করেছিলো তখন এই লক্ষ্যকে অনুধাবন করে ইয়াল্টা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় । কিন্তু  ৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে বহু সংগ্রামের পরেও বিশ্ব মানবতার পক্ষে এখনো সেই লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি।

এই ব্যর্থতার পিছনে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ রয়েছে :

১. ইয়াল্টা সম্মেলন; স্বাধীনতা, মানবাধিকার, প্রকৃত গণতন্ত্র এবং ন্যায়বিচারের মূলনীতি অনুসরণ করে নতুন বিশ্ব ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেনি।

২. ২য় বিশ্বযুদ্ধের পরে সকল একনায়কদের বরখাস্ত করা হয়নি। স্ট্যালিন যুদ্ধের পরেও তার স্বৈরশাসকের পদে দীর্ঘদিন বহাল ছিল এবং এই কারণে ১৯৪৫ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত পৃথিবী “শীতল যুদ্ধের” অভিজ্ঞতা লাভ করে।

৩. ১৯৯০ সালের “শীতল যুদ্ধ” পরবর্তী সময়ে D-8 প্রতিষ্ঠার পূর্ব পর্যন্ত বর্ণবাদী সাম্রাজ্যবাদী পশ্চিমা নেতাদের পরিচালনায় পৃথিবী  শান্তির পথ থেকে বিচ্যুত হয় এবং পশ্চিমা নেতারা শান্তির পরিবর্তে বিদ্বেষ ও শত্রুতার উপর নির্ভর করে- এমন একটি বিশ্ব ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে পছন্দ করে। সত্যের প্রকৃত বোঝা-পড়ার ভিত্তিতে শান্তিপূর্ণ বিশ্ব ব্যবস্থা গঠনের পরিবর্তে তারা সংঘাতময় বিশ্ব ব্যবস্থাকেই বেছে নেয়।

এর সবচেয়ে বড় ও সুস্পষ্ট প্রমাণ হলো, ১৯৯০ এর দশকের গোড়ার দিকে স্কটল্যান্ডে ন্যাটোর সভায় ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচারের ভাষণ (এই ভাষণে বলা হয় সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন হলেও ন্যাটোর প্রয়োজনীয়তা এখনও শেষ হয়নি। ন্যাটোর প্রত্যেকটি দেশের পরবর্তী শত্রু হলো ইসলাম এবং এর অনুসারী মুসলমানরা)।

যেমনটা উপরে বলা হয়েছে, শান্তি এবং ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে একটি নতুন বিশ্ব ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা বিংশ শতাব্দীর শেষে একটি অনিবার্য প্রয়োজনীয়তা হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। D-8 গঠনের ধারণাটি ইস্তাম্বুলের ইরান প্রাসাদে ১৯৯৬ সালের অক্টোবরে অনুষ্ঠিত “উন্নয়নের জন্য সহযোগিতা” বিষয়ক সম্মেলন চলাকালীন সময়ে হয়েছিলো। ১৫ই জুন ১৯৯৭ তারিখে মাত্র ৮ মাসের মধ্যে অত্যন্ত দ্রুততার সাথে সুচারুরূপে কমিশনগুলো তাদের উপর অর্পিত কাজ সম্পন্ন করে। সংস্থার চার্ট এবং D-8 এর কার্যবিধি  শীর্ষ দেশগুলির রাষ্ট্র প্রধানগণের উপস্থিতিতে  D-8 এর ইস্তাম্বুল ঘোষণার মধ্য দিয়ে সমগ্র বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরা হয়। সদস্য দেশের প্রতিনিধিবৃন্দ সংস্থার এমন উদ্যোগের ভূয়সী প্রশংসা করেন এবং এই উদ্যোগকে স্বাগত জানান। ফলে খুব দ্রুতই D-8 অঞ্চলে নতুন প্রাণের সঞ্চার ঘটে।

যে দেশসমূহ নিয়ে D-8 গঠিত হয়েছিলঃ ১) তুরস্ক, ২) ইরান, ৩) মিশর, ৪) মালয়েশিয়া, ৫) ইন্দোনেশিয়া,৬) নাইজেরিয়া, ৭) বাংলাদেশ, এবং ৮) পাকিস্তান (পারমাণবিক)। ভৌগলিক দিক দিয়ে এই ৮ দেশের অবস্থান বিবেচনা করলে ডি-৮ এর অর্থনৈতিক গুরুত্ব কতটুকু তা বুঝা কোন কষ্টসাধ্য ব্যাপার নয়। অর্থনৈতিক রুটগুলোর উপর একটু চোখ বুলিয়ে আসি-

তুরস্কঃ ইউরোপ এবং এশিয়ার সংযোগস্থল। চানাক্কালের এবং বসফরাস প্রণালী দুটো তুরস্কের সীমানায়। তুরস্কের অধীনেই দু-দুটি প্রণালী। একই সাথে কেরচ প্রণালী তুরস্কের এই দুই প্রণালী ছাড়া অচল। অর্থাৎ তুরস্কের যদি চায় তাহলে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ৩ টি প্রণালী নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম। রাশিয়াকে এ পথেই বাণিজ্য করতে হয়।

মিশর ও ইরানঃ সুয়েজ ক্যানেল, বাব-আল মান্দেব এবং হরমুজ প্রণালী পাশাপাশি তিনটি প্রণালী। ইউরোপ থেকে এশিয়ার বাণিজ্য জাহাজের রুট একমাত্র এটিই।

মালেশিয়া ও ইন্দোনেশিয়াঃ মালাক্কা প্রণালী হচ্ছে এই দুই দেশের অধীনে। জাপান, চীন, ও কোরিয়া উপদ্বীপের সকল বাণিজ্য এ প্রণালী দিয়েই করতে হয়।

পাকিস্তান-নাইজেরিয়া-বাংলাদেশঃ তিন দেশের সামর্থ্য সম্পর্কে সকলেই জানি। তেলসমৃদ্ধ দেশ নাইজেরিয়া, পারমাণবিক শক্তিসম্পন্ন পাকিস্তান এবং উৎপাদনশীল বাংলাদেশ মুসলিম বিশ্বের অমূল্য সম্পদ। D-8 প্রতিষ্ঠার পরপরই ৮ টি দেশ নিজেদের মধ্যে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করে। প্রথম পদক্ষেপ ছিল, ১৯৯৭ তে তুরস্কে উৎপন্ন হেলিকপ্টার পাকিস্তানে বিক্রি করা। ৮ টি দেশের মধ্যে ৬ টি দেশ ভিসা চুক্তি স্বাক্ষর করে। পাকিস্তানের ইসলামাবাদে ইসলামিক রিসার্চ সেন্টার প্রতিষ্ঠা করা হয় D-8 এর অধীনে। টেক্সটাইল, গার্মেন্টস, লোহা, স্টীল, ফার্মাসিটিক্যাল এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করে খুব দ্রুতই। সেই সাথে Shipping and Maritime Service এর ক্ষেত্রে সকল দেশ চুক্তিবদ্ধ হয়। D-8 বর্তমানে নিষ্ক্রিয় হলেও কাজ থেমে নেই। তুরস্ক থেকেই যেহেতু এর উৎপত্তি, তাই তুরস্ককেই ভূমিকা পালন করতে হবে D-8 কে সক্রিয় করার ক্ষেত্রে।

এই “নতুন বিশ্ব ব্যবস্থা” এমন একটি প্রকল্প যা ৩ ধাপে বাস্তবায়ন করা হবে । যথাঃ-

  • D-8 নিউক্লিয়াস ইনস্টলেশন।
  • ডি-৬০, ডি-১৬০ এবং ১০ টি বিশ্ব সংস্থার অংশগ্রহণ এর মাধ্যমে বর্ণবাদী সাম্রাজ্যবাদীদের শোষণ থেকে বাঁচতে এবং সত্য ও ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে একটি নতুন বিশ্ব প্রতিষ্ঠার জন্য ৬০০ কোটি নিপীড়িত মানুষ একত্রিত হবে।
  • দ্বিতীয় ইয়াল্টা সম্মেলন, D-8 এবং ডি-১৬০ একত্রে সত্য ও ইনসাফের ভিত্তিতে নতুন বিশ্ব ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য একত্রিত হবে। এই নতুন বিশ্ব প্রতিষ্ঠার মূল শর্ত হলো সত্য ও ন্যায়ের সৌধের উপর দাঁড়িয়ে শান্তিময় বিশ্ব গড়ার লক্ষ্যে মজলুমের হক্ব নিশ্চিত করা। এই কারণে D-8 কে এই শান্তিময় পৃথিবীর মূল ভিত্তি হিসাবে বিবেচনা করা হয়েছে এবং D-8 লোগোতে থাকা ৬ টি তারকা এই মূলনীতি গুলোকেই ব্যক্ত করে ।

৬০ কোটিরও বেশি জনসংখ্যার ৮ টি দেশের অংশগ্রহণে D-8 তার আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করে। ৮ টি দেশ নিয়ে গঠিত D-8 এর পরিসংখ্যান এটি দেখায় যে, সারা বিশ্বের জনসংখ্যার ১৬% D-8 এর আওতাধীন রয়েছে। বিশ্বে এখন পর্যন্ত স্বীকৃত তেলের মজুদগুলির ১৪ শতাংশই এই দেশগুলিতে এবং বিশ্বের বার্ষিক তেল উৎপাদনের ১০% এই দেশগুলো উৎপাদন করে, এই দেশগুলো বিশ্বের তেল ব্যবহারের হার ৬.৭%  এবং বিশ্বের  প্রাকৃতিক গ্যাস মজুদের ২৩.২% এই দেশগুলিতে রয়েছে। বিশ্বের বার্ষিক উৎপাদিত প্রাকৃতিক গ্যাসের ১৩.২ % এই দেশগুলো উৎপাদন করে এবং বিশ্বের প্রাকৃতিক গ্যাসের ১১.২% খরচ করে। কেবল তা-ই নয় এই অঞ্চলে বোরন ও ক্রোমের মতো কৌশলগত খনিজগুলির বড় মজুদ রয়েছে।

D-8 অঞ্চল তুলা রফতানির প্রধান অংশ সরবরাহ করে। D-8 পৃথিবীর কেন্দ্রে বিশাল ব্যাপ্ত অঞ্চল নিয়ে গঠিত এবং এই অঞ্চলে  শ্রমের মূল্যে অনেক কম এবং প্রশিক্ষিত কর্মীসহ সবই রয়েছে। এই সকল পরিসংখ্যান D-8 এর উজ্জ্বল সম্ভাবনার বহিঃপ্রকাশ। আবার ৬০ সদস্য বিশিষ্ট ওয়াইসি ভুক্ত দেশগুলোর ৬০% জিডিপি এবং ৬৫% জনগণ ডি -৮ এর আওতাধীন, এছাড়াও মুসলিম দেশগুলির বিদেশী বাণিজ্যের ৫৮% D-8 এর আটটি দেশ থেকেই আসে।

৬ তারকা বিশিষ্ট পতাকা, D-8 এর মূলনীতিগুলোকে প্রকাশ করে। প্রতিটা মূলনীতিই সত্যকে (হাকীকতকে) পুনরুদ্ধারের প্রয়োজনীয়তা ব্যক্ত করে। যেহেতু বিশ শতক সবসময়ই জেদের উপর টিকে ছিল এবং এই জেদ কোন ভালো কিছু বয়ে আনেনি, তাই বাস্তবতার নিরিখে এই পর্যায়ে এসে নতুন করে পথে চলা আব্যশক হয়ে পড়েছে এবং এই পথের সন্ধান পেতে হলে আবারো সত্যের কাছে ফিরে যেতে হবে; যদি আমরা একটা সুন্দর শান্তিময় নতুন দুনিয়া গড়তে চাই তবে ।

D-8 এর পতাকায় থাকা ৬ টি তারকা , D-8 এর প্রয়োজনীয় মূলনীতিগুলির প্রতীক, সেই নীতিগুলো হলো :

১) যুদ্ধ নয়, শান্তি।

২) সংঘাত নয়, সংলাপ।

৩) দ্বৈতনীতি নয়, আদালত।

৪) অহংকার নয়, ইনসাফ।

৫) শোষণ নয়, সহযোগিতা।

৬) নিপীড়ন ও আধিপত্য নয়, মানবাধিকার, স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র।

এই নীতিগুলি শুধুমাত্র D-8 এর নিজস্ব নীতি নয়, একই সাথে এগুলি একটি নতুন বিশ্ব ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজনীয় নীতিও বটে।

D-8 এর প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি হলো:

১. D-8 একটি উচ্চ পর্যায়ের আন্তর্জাতিক সংস্থা।

২. D-8 সকলকে নিয়ে একসাথে একটি নতুন বিশ্ব প্রতিষ্ঠার জন্য গঠিত হয়েছে।

৩.D-8 এর প্রতিষ্ঠা হয়েছিল সমস্ত উন্নয়নশীল দেশ এবং নিপীড়িত মানুষকে মুক্ত করার জন্য। একই সাথে D-8 এর একটি গতিশীল কাঠামো রয়েছে যাতে দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যায় ।

৪. সদস্য দেশগুলির আভ্যন্তরীণ বিষয়াদিতে খবরদারি না করা এবং তাদের আঞ্চলিক চুক্তিতে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ ও অধিকারের ক্ষতি না করার নীতিতে D-8  প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো।

৫. সদস্য দেশগুলির জনগণের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন করা এবং আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় অংশ নেওয়ার জন্য শক্তি বৃদ্ধি করা যাতে আমরা আরো বেশি উন্নতি করতে পারি সেই লক্ষ্যে  D-8 প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো।

৬. D-8 এর প্রতিষ্ঠার পরপরই দ্রুততার সাথে সদস্য দেশগুলোকে গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পগুলোর প্রয়োজনীয়তা উপলদ্ধি করাতে সক্রিয় করে তোলা হয়।

D-8 এমন একটি সংস্থা যা বড় বড় কথা বলার  পরিবর্তে কাজ করার নীতি গ্রহণ করে। বিশেষজ্ঞদের দ্বারা গবেষণা পরিচালনার মাধ্যমে প্রাথমিক কাজের সূচনা করেছে এবং উপসংহারে এসেছে প্রতিটি দেশের পরিকল্পনা এবং কর্মসূচী ঠিক করার মাধ্যমে। কোন দেশ কোন পরিকল্পনা পরিচালনা করবে এবং কোন কাজে কে অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে সে পরিকল্পনাও সদস্য দেশগুলার মাঝে বিতরণ করা হয়েছে।

এই পরিকল্পনা প্রক্রিয়া চলাকালীন তুরস্ককে শিল্প ক্ষেত্রের প্রকল্পগুলির নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য নিয়োগ করা হয়েছিলো। অন্যান্য সকল দেশের ন্যায় তুরস্কও বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনার সাথে D-8 প্রকল্পে অংশ নেয়। এই ক্ষেত্রে তুরস্কের ৫৪ তম সরকারের ক্ষমতার সময় বড় বড় পদক্ষেপ গ্রহণ করে। তুরস্কের ৫৪ তম সরকারের কৃষিজ ওষুধের উৎপাদন প্রকল্পটি এই সময়ে সমাপ্তকৃত প্রকল্পগুলির মধ্যে অন্যতম।

D-8 গৃহীত প্রতিটি প্রকল্প এর সদস্য দেশগুলোর উন্নয়নে বিরাট অবদান রাখতে সক্ষম। এই  বিষয়গুলি অবিলম্বে উপলব্ধি করা সদস্য দেশগুলির জনগণ এবং মানবতা উভয়ের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ।

তাই, স্বপ্ন দেখি একটি শক্তিশালী উম্মাহর…

সায়েম মুহাইমিন

১১১১ বার পঠিত

শেয়ার করুন

Picture of প্রফেসর ড. নাজমুদ্দিন এরবাকান

প্রফেসর ড. নাজমুদ্দিন এরবাকান

জন্ম
প্রফেসর ড. নাজমুদ্দিন এরবাকান ১৯২৬ সালের ২৬ অক্টোবর তুরস্কের সিনপ শহরের সম্ভ্রান্ত এক মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম মেহমেদ সাবরি এরবাকান। তিনি ছিলেন তুরস্ক সরকারের একজন বিচারপতি। সরকারি কর্মকর্তা হওয়ায় তিনি বিভিন্ন শহরে বদলি হন। ফলে প্রফেসর ড. নাজমুদ্দিন এরবাকানকেও বিভিন্ন শহরে পরিবারের সাথে বসবাস করতে হয়।

শিক্ষা জীবন
প্রফেসর এরবাকান কায়সেরি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক শিক্ষা শুরু করেন। পাশাপাশি গৃহশিক্ষকদের তত্ত্বাবধানে ইসলামী শিক্ষাও গ্রহণ করতে থাকেন। প্রাথমিক শিক্ষা লাভের পর ইস্তাম্বুলে তার মাধ্যমিক শিক্ষা শুরু করেন। প্রখর মেধা ও অসীম প্রতিভা দেখে শিক্ষকগণ তাকে 'দরিয়ায়ে নাজমুদ্দিন' (জ্ঞানের সাগর) উপাধিতে ভূষিত করেন। ভালো ফলাফলধারী ছাত্র-ছাত্রীরা কোনো প্রকার ভর্তি পরীক্ষা ছাড়াই তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেতো। কিন্তু প্রফেসর ড. নাজমুদ্দিন এরবাকান ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে সমগ্র তুরস্কে প্রথম স্থান অর্জন করেন। ইস্তাম্বুল টেকনিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ দ্বিতীয় বর্ষ থেকে তার পড়াশোনা শুরু করেন। তদানীন্তন সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের জন্য নামাজের কোনো ব্যবস্থা ছিলো না।
তিনি ছাত্রদের নিয়ে আন্দোলন করে সেখানে একটি মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৪৮ সালে রেকর্ড সংখ্যক নম্বর পেয়ে তিনি প্রথম স্থান অর্জন করার মধ্যদিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যয়ন সমাপ্ত করেন। অতঃপর তিনি একই বিশ্ববিদ্যালয়ে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন। শুধুমাত্র PhD. ডিগ্রিধারী ব্যতীত অন্য কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নেয়ার সুযোগ পেতো না, কিন্তু প্রফেসর ড. নাজমুদ্দিন এরবাকানকে ক্লাস নেয়ার সুযোগ দেওয়া হয়। শিক্ষকতাকালীন এ সময়েই তিনি তার PhD'র থিসিস তৈরি করেন। উচ্চতর গবেষণার উদ্দেশ্যে ১৯৫১ সালে তিনি জার্মানির Aachen Technical University-তে গিয়ে পৌঁছেন। সেখানকার প্রখ্যাত জার্মানবিজ্ঞানী স্কিমিদ-এর সাথে বৈজ্ঞানিক গবেষণায় কাজও করেন। মাত্র দু'বছরের ব্যবধানে ৩টি থিসিস পেপার তৈরি করে PhD ডিগ্রি লাভ করেন। তার থিসিসের বিষয় ছিলো 'কীভাবে কম জ্বালানি ব্যয় সম্পন্ন ইঞ্জিন উদ্ভাবন করা যায়'। তিনি তার গবেষণায় সফল হন। তার থিসিস পেপার কটি গুরুত্বপূর্ণ জার্নালে প্রকাশিত হয়। জার্মানির বিখ্যাত ইঞ্জিন গবেষণা প্রতিষ্ঠান DEUTZ-এর ডিরেক্টর প্রখ্যাত বিজ্ঞানী প্রফেসর ডক্টর ফ্ল্যাটস তাকে Leopard Tank-এর গবেষণার জন্য আহ্বান জানান। তিনি তার ডাকে সাড়া দিয়ে Leopard Tank- কে এক অনন্যসাধারণ Tank-এ পরিণত করেন। জার্মানিতে বিভিন্ন গবেষণা এবং কর্মব্যস্ত সময় পার করে পুনরায় তুরস্কে ফিরে আসেন। আবারও তিনি ইস্তাম্বুল টেকনিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে সহকারী প্রফেসর হিসেবে যোগদান করেন। মাত্র ২৭ বছর বয়সেই তিনি এই পদ লাভের গৌরব অর্জন করেন। ১৯৫৪ থেকে ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত বাধ্যতামূলক সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করার জন্য তিনি সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। সেকেন্ড লেফটেনেন্ট হিসেবে প্রথম ৬ মাস এবং লেফটেনেন্ট হিসেবে পরবর্তী ৬ মাস কাজ করেন। প্রশিক্ষণ গ্রহণের পাশাপাশি নিয়মিত একটি সেনাবাহিনীর কেমন অস্ত্রের প্রয়োজন, এমন একটি তালিকাও প্রস্তুত করেন। আমেরিকার জনৈক ক্যাপ্টেন তালিকাটি দেখে এরবাকানের সাথে দেখা করতে চান। ক্যাপ্টেন তাকে প্রশ্ন করেন, "কেন আপনি এমন অস্ত্র তৈরির কথা ভাবছেন? এসব অস্ত্রের ব্যাপারে তুরস্ক সরকার আমেরিকার সাথে আগে থেকেই চুক্তিবদ্ধ।" জবাবে এরবাকান বলেন, "এসব অস্ত্র উৎপাদন করার ক্ষমতা আমেরিকার থাকলে আমাদের থাকবে না কেন?"
তখন তুরস্কে ইসলামী শিক্ষা নিষিদ্ধ ছিলো। ফলে, এরবাকানের পিতা গৃহশিক্ষক রেখে শিশুকাল থেকেই তাকে ইসলামী ভাবধারায় গড়ে তোলেন। পরবর্তীকালে ইস্তাম্বুলের প্রখ্যাত আলেম মেহমেদ জাহিদ কতকুর সান্নিধ্যে ইসলামী শিক্ষায় ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন। এরবাকানের বক্তব্য জুড়ে থাকতো কোরআন-হাদীসের জ্ঞান ও ইসলামের সোনালী ইতিহাস।

কর্মজীবন
সামরিক প্রশিক্ষণ শেষে তিনি পুনরায় বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেন। তিনি 'গুমুশ মোটর' নামে একটি ইঞ্জিন কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন। তুরস্কের ইতিহাসে এটিই ছিলো সর্বপ্রথম দেশীয় কোনো ইঞ্জিন কোম্পানি। তার জীবনের বড় একটি সংগ্রাম ছিলো এটি। কোম্পানি প্রতিষ্ঠায় তিনি অভ্যন্তরীণ ইহুদী লবির ষড়যন্ত্রের শিকার হন। অনেক চড়াই-উত্রাই- এর মধ্যে দিয়ে এ কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন। কোনো এক প্রোগ্রামে এত বাধা-বিপত্তির কথা শুনে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী আদনান মেন্দরেস আবেগাপ্লুত কণ্ঠে বলেন, "আগে এ সম্পর্কে জানতে পারলে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায়ই এটি করে দিতাম।" সে প্রোগ্রামে এরবাকান শিল্পায়নের উপর একটি যুক্তিপূর্ণ বক্তব্য পেশ করেন। তার এই বক্তব্যে অনুপ্রাণিত হয়ে আদনান মেন্দরেস তাঁকে Automobile ফ্যাক্টরি প্রতিষ্ঠা করতে বলেন। তিনি অল্পদিনের মধ্যেই দেভরিম নামে একটি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন। এর ক'দিন পরই এক সামরিক অভ্যুত্থানে আদনান মেন্দরেসকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। সামরিক সরকার তাকে ফাঁসি দিয়ে হত্যা করে।
ইঞ্জিন কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করার সময় এরবাকান দেখতে পান-দেশীয় শিল্প উদ্যোক্তাগণ যেন কোনোভাবেই অগ্রসর হতে না পারে সেজন্য The Union of Chambers and Commodity Exchange of Turkey এক অদৃশ্য হাতের ইশারায় দেশীয় উদ্যোক্তাদের সাথে পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ করে যাচ্ছে। এটি অবসানের জন্য তিনি এই প্রতিষ্ঠানে যোগ দেন। অল্প সময়ের ব্যবধানে প্রতিষ্ঠানটির সভাপতি নির্বাচিত হন। সভাপতি হওয়ার পরপরই সেখানে সাম্য প্রতিষ্ঠার দিকে নজর দেন। ফলে, অল্প সময়ের ব্যবধানে রাজনৈতিক শক্তির জোরে তাঁকে সেখান থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। অতঃপর তিনি প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে আসার ঘোষণা দেন।

রাজনৈতিক জীবন
১৯৬৯ সালে প্রফেসর ড. নাজমুদ্দিন এরবাকান কোনিয়া থেকে স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচন করে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি অসাধারণ এক বক্তা ছিলেন। তার বক্তব্যে সবাই বিমোহিত হতো। অল্প সময়েই তিনি একজন সুবক্তা হিসেবে সবার মনে জায়গা করে নেন। সমগ্র তুরস্কে 'ইসলাম ও বিজ্ঞান' শিরোনামে তিনি কনফারেন্স করতে শুরু করেন। (তার এ বক্তব্য বাংলা ভাষায় 'ইসলাম ও জ্ঞান' শিরোনামে অনূদিত হয়েছে)। তার শিক্ষক প্রখ্যাত আলেম মেহমেদ জাহিদ কতকু এবং অন্যান্য যুগশ্রেষ্ঠ আলেমদের পরামর্শে গঠন করেন 'মিল্লি গরুশ'। এর মাধ্যমেই তুরস্কে আনুষ্ঠানিকভাবে ইসলামী আন্দোলনের দুর্নিবার যাত্রা শুরু হয়।

মিল্লি গরুশ
তুরস্কে ইসলামের নামে যেকোনো ধরনের সংগঠন করা ছিলো নিষিদ্ধ। এ কারণে তিনি প্রতীকী শব্দ ব্যবহার করে মানুষকে ইসলাম বোঝাতেন। 'মিল্লি গরুশ' তেমনিই একটি বাক্যাংশ। 'মিল্লি গরুশ' অর্থ-জাতীয় ভিশন। অবশ্য, তিনি মিল্লি গরুশ দ্বারা মুসলিম মিল্লাতের ভিশনকেই বুঝিয়েছেন।

মিল্লি গরুশের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য:
• আধ্যাত্মিক উন্নতি। ইসলাম থেকে দূরে সরে যাওয়া জাতিকে পুনরায় ইসলামের দিকে আহ্বান এবং তাদেরকে যোগ্য মুসলিম রূপে গড়ে তোলা। বিশেষ করে যুবকদের মাঝে ইসলামের প্রচার ও প্রসার বৃদ্ধি করা।
• অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতা। আমেরিকা ও রাশিয়ার অনুকরণ না করে স্বতন্ত্রভাবে শিল্পায়ন ও প্রযুক্তিগত উন্নতি করে এক নতুন তুরস্ক গঠন। • ইসলামী ইউনিয়ন গড়ে তোলা এবং সব মুসলিমকে একই প্ল্যাটফর্মে নিয়ে এসে সাম্রাজ্যবাদীদের কালো হাত থেকে রক্ষা করা।
'মিল্লি গরুশ' প্রতিষ্ঠার পর তার রাজনৈতিক শাখা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন 'মিল্লি নিজাম পার্টি'। কিন্তু এ দলটিকে মাত্র ১ বছরের ব্যবধানে নিষিদ্ধ করা হয়। অতঃপর তিনি গঠন করেন 'মিল্লি সালামেত পার্টি'। এই দলটি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে ৪৮টি আসন লাভ করে এবং কোয়ালিশন করে শর্তভিত্তিক সরকার গঠন করে। এরবাকান সরকারের উপ-প্রধানমন্ত্রীনির্বাচিত হন (অর্থনীতি বিষয়ক)। এছাড়া তার দল থেকে মন্ত্রীসভায় শিল্পমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীও মনোনীত হয়।
এ কোয়ালিশন সরকারের সময় ইসলামী অনুশাসন মেনে চলার অপরাধে বন্দি হওয়া ৬ হাজার মুসলিমকে মুক্ত করে দেওয়া হয়। সাইপ্রাসকে গ্রীস থেকে মুক্ত করে তার্কিশ সাইপ্রাস গঠন করা ও মুসলিমদেরকে জুলুমমুক্ত করা, নতুন করে মাদ্রাসা শিক্ষার দ্বার উন্মোচন করা, হাজার হাজার কোরআন কোর্স চালু করা, মাদ্রাসার ছাত্রদের উচ্চ শিক্ষার সুযোগ দেওয়া, বদিউজ্জামান সাঈদ নুরসির রিসালা-ই-নূরের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা, সেনানিবাসসহ সব সরকারি অফিস-আদালতে মসজিদ প্রতিষ্ঠা করা-সহ ইসলামী বই-পুস্তক প্রকাশের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়। অশ্লীলতা-বেহায়াপনা দূর করার লক্ষ্যে আইন করা হয়। এছাড়া ১৯৭৪ থেকে ১৯৭৮ সালের মধ্যে তিনি ২৭০টি ভারী শিল্প কারখানা প্রতিষ্ঠা করেন। এর মধ্যে বিমান তৈরির কারখানা থেকে শুরু করে অনেক কিছুই অন্তর্ভুক্ত ছিলো। তার এই উদ্যম দেখে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি তার সাথে কোয়ালিশনে থাকা অন্য দলকে কোয়ালিশন ছিন্ন করতে বাধ্য করে।
৬ সেপ্টেম্বর ১৯৮০ সালে তুরস্কের কোনিয়াতে কুদস দিবসের সমাবেশ পালনের অভিযোগে ১২ সেপ্টেম্বর ১৯৮০ সালে সামরিক শাসকরা ক্যু করে এই পার্টিকেও নিষিদ্ধ করে। সে সাথে সব রাজনৈতিক দলকেও নিষিদ্ধ করা হয়। এরবাকানকে রাজনীতিতে নিষিদ্ধ এবং গ্রেফতার করে জেল-হাজতে প্রেরণ করা হয়।
তার ওপর এসব জুলুম-নির্যাতন এবং রাজনীতিতে তাকে নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর ১৯৮৩ সালে তিনি জেল থেকে মুক্তি লাভ করেন। মুক্তিলাভের পর দলের অন্য নেতৃবৃন্দদের দিয়ে তিনি রেফাহ পার্টি প্রতিষ্ঠা করান। এ পার্টি স্বল্প সময়েই জনপ্রিয়তা লাভ করে। ১৯৮৭ সালে গণভোটের মাধ্যমে ড. নাজমুদ্দিন এরবাকানের ওপর রাজনৈতিক নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ায় তিনি আবারও রাজনীতিতে আসেন। রেফাহ পার্টির সভাপতি নির্বাচিত হন। তিনি সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার পর পরই রেফাহ পার্টি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। এরই ধারাবাহিকতায়১৯৯৪ সালের স্থানীয় মেয়র নির্বাচনে ইস্তাম্বুল ও আঙ্কারাসহ অনেক সিটি কর্পোরেশনে তার দল বিজয় লাভ করে। এ জয়ের ধারাবাহিকতায় নতুন উদ্যোমে কাজ করে 'ন্যায়ভিত্তিক ব্যবস্থা' এই স্লোগান নিয়ে ১৯৯৬ সালে জাতীয় নির্বাচনে জয়লাভ করে সরকার গঠন করেন। কিন্তু ১১ মাস সরকার পরিচালনার পর এক সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়।
প্রফেসর ড. নাজমুদ্দিন এরবাকান তার ১১ মাসের শাসনামলে D-8 প্রতিষ্ঠা করেন। সুদের হার কমিয়ে আনেন। মাত্র ১১ মাসের শাসনামলে তিনি দেশকে ৩৩ বিলিয়ন ডলার ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করেন। সরকারি কর্মচারীদের বেতন ১০০ ভাগ বৃদ্ধি করেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ১৫০ ভাগ পর্যন্ত বৃদ্ধি করেন। জনগণের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করার দিকে মনোযোগী হন। তুরস্কে শিল্পায়নের গতি ফিরিয়ে এনে ৫ বছরের মধ্যে তুরস্কের শিল্পায়ন জাপান ও জার্মানির শিল্পায়নকে ছাড়িয়ে যাবে বলে ঘোষণা দেন।
মুসলিম দেশগুলোকে নিয়ে কমন মার্কেট চালু করেন। তার উত্তরোত্তর সফলতায় আতঙ্কিত হয়ে ইহুদীরা রেফাহ পার্টিকে নিষিদ্ধ করার লক্ষ্যে সব ধরনের প্রোপাগাণ্ডা চালায়। তার পার্টি 'শরীয়ত কায়েম করবে' এই অভিযোগে তাকে অপসারণের জন্য সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপ কামনা করে। এ অবস্থায় প্রফেসর এরবাকান এ শর্তে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তফা দেন যে, তার কোয়ালিশন পার্টির নেত্রী তানসুকে প্রধানমন্ত্রী করা হবে। কিন্তু ফ্রি ম্যাসন ও ইহুদীদের ধারক-বাহক সোলাইমান দেমিরেল বিশ্বাসঘাতকতা করে মেসুদ ইলমাজকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ঘোষণা দেয়। এভাবে রেফাহ পার্টিকে নিষিদ্ধ করার পাশাপাশি প্রফেসর এরবাকানকেও রাজনীতিতে নিষিদ্ধ করা হয়। এরপর মিল্লি গরুশের অপর নেতা রেজাই কুতানের মাধ্যমে ফজিলত পার্টি গঠন করা হয়। এই পার্টিকেও খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে নিষিদ্ধ করা হয়।
২০০১ সালের ২০ জুলাই সাদেত পার্টি তার যাত্রা শুরু করে। কতিপয় নেতা মিল্লি গরুশে তরুণ প্রজন্মের নেতৃত্ব দাবি করে। তারা মূল আন্দোলনেও লিবারেল সেক্যুলারিজম প্রতিস্থাপনের চেষ্টা চালায়। সে চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে পরবর্তীতে মিল্লি গরুশকে ভেঙ্গে তারা গঠন করেএকে পার্টি। মিল্লি গরুশ দু'ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। সা'দাত পার্টি রয়ে যায় মূলধারার ইসলামী আন্দোলন হিসেবে। সাদেত পার্টিতে নেতৃত্ব নিয়ে অনেক সমস্যার সৃষ্টি হয়। ৮৪ বছর বয়সে ২০১০ সালে প্রফেসর এরবাকানকে পুনরায় সাদেত পার্টির সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। শত প্রতিকূলতার সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও সাদেত পার্টি এখনও তাদের এ কর্মস্পৃহা ধরে রেখে এগিয়ে চলছে। বর্তমানে দলটি তুরস্কের ৪র্থ বৃহত্তম রাজনৈতিক শক্তি।

মৃত্যু
৮৫ বছর বয়সে ২০১১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি সবাইকে কাঁদিয়ে মহান প্রভুর সান্নিধ্যে পাড়ি জমান মহান এ নেতা। তার জানাযায় এত পরিমাণ লোকের সমাগম হয়েছিলো, ইস্তাম্বুলের ৩০০০ বছরের ইতিহাসে এর আগে এত লোকের সমাগম হয়নি। বিশ্বের প্রায় সব দেশ থেকেই মানুষ তার জানাযায় অংশগ্রহণ করে। মিডিয়ার ভাষ্য মতে, তার জানাযায় ৩৫-৪০ লাখ লোকের সমাগম হয়েছিলো। মৃত্যুর আগে তিনি বলে গিয়েছিলেন, মৃত্যুর পর সরকার যেন তাকে বিশেষ কোনো সম্মানে দাফন না করে।
Picture of প্রফেসর ড. নাজমুদ্দিন এরবাকান

প্রফেসর ড. নাজমুদ্দিন এরবাকান

জন্ম
প্রফেসর ড. নাজমুদ্দিন এরবাকান ১৯২৬ সালের ২৬ অক্টোবর তুরস্কের সিনপ শহরের সম্ভ্রান্ত এক মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম মেহমেদ সাবরি এরবাকান। তিনি ছিলেন তুরস্ক সরকারের একজন বিচারপতি। সরকারি কর্মকর্তা হওয়ায় তিনি বিভিন্ন শহরে বদলি হন। ফলে প্রফেসর ড. নাজমুদ্দিন এরবাকানকেও বিভিন্ন শহরে পরিবারের সাথে বসবাস করতে হয়।

শিক্ষা জীবন
প্রফেসর এরবাকান কায়সেরি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক শিক্ষা শুরু করেন। পাশাপাশি গৃহশিক্ষকদের তত্ত্বাবধানে ইসলামী শিক্ষাও গ্রহণ করতে থাকেন। প্রাথমিক শিক্ষা লাভের পর ইস্তাম্বুলে তার মাধ্যমিক শিক্ষা শুরু করেন। প্রখর মেধা ও অসীম প্রতিভা দেখে শিক্ষকগণ তাকে 'দরিয়ায়ে নাজমুদ্দিন' (জ্ঞানের সাগর) উপাধিতে ভূষিত করেন। ভালো ফলাফলধারী ছাত্র-ছাত্রীরা কোনো প্রকার ভর্তি পরীক্ষা ছাড়াই তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেতো। কিন্তু প্রফেসর ড. নাজমুদ্দিন এরবাকান ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে সমগ্র তুরস্কে প্রথম স্থান অর্জন করেন। ইস্তাম্বুল টেকনিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ দ্বিতীয় বর্ষ থেকে তার পড়াশোনা শুরু করেন। তদানীন্তন সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের জন্য নামাজের কোনো ব্যবস্থা ছিলো না।
তিনি ছাত্রদের নিয়ে আন্দোলন করে সেখানে একটি মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৪৮ সালে রেকর্ড সংখ্যক নম্বর পেয়ে তিনি প্রথম স্থান অর্জন করার মধ্যদিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যয়ন সমাপ্ত করেন। অতঃপর তিনি একই বিশ্ববিদ্যালয়ে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন। শুধুমাত্র PhD. ডিগ্রিধারী ব্যতীত অন্য কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নেয়ার সুযোগ পেতো না, কিন্তু প্রফেসর ড. নাজমুদ্দিন এরবাকানকে ক্লাস নেয়ার সুযোগ দেওয়া হয়। শিক্ষকতাকালীন এ সময়েই তিনি তার PhD'র থিসিস তৈরি করেন। উচ্চতর গবেষণার উদ্দেশ্যে ১৯৫১ সালে তিনি জার্মানির Aachen Technical University-তে গিয়ে পৌঁছেন। সেখানকার প্রখ্যাত জার্মানবিজ্ঞানী স্কিমিদ-এর সাথে বৈজ্ঞানিক গবেষণায় কাজও করেন। মাত্র দু'বছরের ব্যবধানে ৩টি থিসিস পেপার তৈরি করে PhD ডিগ্রি লাভ করেন। তার থিসিসের বিষয় ছিলো 'কীভাবে কম জ্বালানি ব্যয় সম্পন্ন ইঞ্জিন উদ্ভাবন করা যায়'। তিনি তার গবেষণায় সফল হন। তার থিসিস পেপার কটি গুরুত্বপূর্ণ জার্নালে প্রকাশিত হয়। জার্মানির বিখ্যাত ইঞ্জিন গবেষণা প্রতিষ্ঠান DEUTZ-এর ডিরেক্টর প্রখ্যাত বিজ্ঞানী প্রফেসর ডক্টর ফ্ল্যাটস তাকে Leopard Tank-এর গবেষণার জন্য আহ্বান জানান। তিনি তার ডাকে সাড়া দিয়ে Leopard Tank- কে এক অনন্যসাধারণ Tank-এ পরিণত করেন। জার্মানিতে বিভিন্ন গবেষণা এবং কর্মব্যস্ত সময় পার করে পুনরায় তুরস্কে ফিরে আসেন। আবারও তিনি ইস্তাম্বুল টেকনিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে সহকারী প্রফেসর হিসেবে যোগদান করেন। মাত্র ২৭ বছর বয়সেই তিনি এই পদ লাভের গৌরব অর্জন করেন। ১৯৫৪ থেকে ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত বাধ্যতামূলক সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করার জন্য তিনি সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। সেকেন্ড লেফটেনেন্ট হিসেবে প্রথম ৬ মাস এবং লেফটেনেন্ট হিসেবে পরবর্তী ৬ মাস কাজ করেন। প্রশিক্ষণ গ্রহণের পাশাপাশি নিয়মিত একটি সেনাবাহিনীর কেমন অস্ত্রের প্রয়োজন, এমন একটি তালিকাও প্রস্তুত করেন। আমেরিকার জনৈক ক্যাপ্টেন তালিকাটি দেখে এরবাকানের সাথে দেখা করতে চান। ক্যাপ্টেন তাকে প্রশ্ন করেন, "কেন আপনি এমন অস্ত্র তৈরির কথা ভাবছেন? এসব অস্ত্রের ব্যাপারে তুরস্ক সরকার আমেরিকার সাথে আগে থেকেই চুক্তিবদ্ধ।" জবাবে এরবাকান বলেন, "এসব অস্ত্র উৎপাদন করার ক্ষমতা আমেরিকার থাকলে আমাদের থাকবে না কেন?"
তখন তুরস্কে ইসলামী শিক্ষা নিষিদ্ধ ছিলো। ফলে, এরবাকানের পিতা গৃহশিক্ষক রেখে শিশুকাল থেকেই তাকে ইসলামী ভাবধারায় গড়ে তোলেন। পরবর্তীকালে ইস্তাম্বুলের প্রখ্যাত আলেম মেহমেদ জাহিদ কতকুর সান্নিধ্যে ইসলামী শিক্ষায় ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন। এরবাকানের বক্তব্য জুড়ে থাকতো কোরআন-হাদীসের জ্ঞান ও ইসলামের সোনালী ইতিহাস।

কর্মজীবন
সামরিক প্রশিক্ষণ শেষে তিনি পুনরায় বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেন। তিনি 'গুমুশ মোটর' নামে একটি ইঞ্জিন কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন। তুরস্কের ইতিহাসে এটিই ছিলো সর্বপ্রথম দেশীয় কোনো ইঞ্জিন কোম্পানি। তার জীবনের বড় একটি সংগ্রাম ছিলো এটি। কোম্পানি প্রতিষ্ঠায় তিনি অভ্যন্তরীণ ইহুদী লবির ষড়যন্ত্রের শিকার হন। অনেক চড়াই-উত্রাই- এর মধ্যে দিয়ে এ কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন। কোনো এক প্রোগ্রামে এত বাধা-বিপত্তির কথা শুনে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী আদনান মেন্দরেস আবেগাপ্লুত কণ্ঠে বলেন, "আগে এ সম্পর্কে জানতে পারলে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায়ই এটি করে দিতাম।" সে প্রোগ্রামে এরবাকান শিল্পায়নের উপর একটি যুক্তিপূর্ণ বক্তব্য পেশ করেন। তার এই বক্তব্যে অনুপ্রাণিত হয়ে আদনান মেন্দরেস তাঁকে Automobile ফ্যাক্টরি প্রতিষ্ঠা করতে বলেন। তিনি অল্পদিনের মধ্যেই দেভরিম নামে একটি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন। এর ক'দিন পরই এক সামরিক অভ্যুত্থানে আদনান মেন্দরেসকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। সামরিক সরকার তাকে ফাঁসি দিয়ে হত্যা করে।
ইঞ্জিন কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করার সময় এরবাকান দেখতে পান-দেশীয় শিল্প উদ্যোক্তাগণ যেন কোনোভাবেই অগ্রসর হতে না পারে সেজন্য The Union of Chambers and Commodity Exchange of Turkey এক অদৃশ্য হাতের ইশারায় দেশীয় উদ্যোক্তাদের সাথে পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ করে যাচ্ছে। এটি অবসানের জন্য তিনি এই প্রতিষ্ঠানে যোগ দেন। অল্প সময়ের ব্যবধানে প্রতিষ্ঠানটির সভাপতি নির্বাচিত হন। সভাপতি হওয়ার পরপরই সেখানে সাম্য প্রতিষ্ঠার দিকে নজর দেন। ফলে, অল্প সময়ের ব্যবধানে রাজনৈতিক শক্তির জোরে তাঁকে সেখান থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। অতঃপর তিনি প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে আসার ঘোষণা দেন।

রাজনৈতিক জীবন
১৯৬৯ সালে প্রফেসর ড. নাজমুদ্দিন এরবাকান কোনিয়া থেকে স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচন করে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি অসাধারণ এক বক্তা ছিলেন। তার বক্তব্যে সবাই বিমোহিত হতো। অল্প সময়েই তিনি একজন সুবক্তা হিসেবে সবার মনে জায়গা করে নেন। সমগ্র তুরস্কে 'ইসলাম ও বিজ্ঞান' শিরোনামে তিনি কনফারেন্স করতে শুরু করেন। (তার এ বক্তব্য বাংলা ভাষায় 'ইসলাম ও জ্ঞান' শিরোনামে অনূদিত হয়েছে)। তার শিক্ষক প্রখ্যাত আলেম মেহমেদ জাহিদ কতকু এবং অন্যান্য যুগশ্রেষ্ঠ আলেমদের পরামর্শে গঠন করেন 'মিল্লি গরুশ'। এর মাধ্যমেই তুরস্কে আনুষ্ঠানিকভাবে ইসলামী আন্দোলনের দুর্নিবার যাত্রা শুরু হয়।

মিল্লি গরুশ
তুরস্কে ইসলামের নামে যেকোনো ধরনের সংগঠন করা ছিলো নিষিদ্ধ। এ কারণে তিনি প্রতীকী শব্দ ব্যবহার করে মানুষকে ইসলাম বোঝাতেন। 'মিল্লি গরুশ' তেমনিই একটি বাক্যাংশ। 'মিল্লি গরুশ' অর্থ-জাতীয় ভিশন। অবশ্য, তিনি মিল্লি গরুশ দ্বারা মুসলিম মিল্লাতের ভিশনকেই বুঝিয়েছেন।

মিল্লি গরুশের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য:
• আধ্যাত্মিক উন্নতি। ইসলাম থেকে দূরে সরে যাওয়া জাতিকে পুনরায় ইসলামের দিকে আহ্বান এবং তাদেরকে যোগ্য মুসলিম রূপে গড়ে তোলা। বিশেষ করে যুবকদের মাঝে ইসলামের প্রচার ও প্রসার বৃদ্ধি করা।
• অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতা। আমেরিকা ও রাশিয়ার অনুকরণ না করে স্বতন্ত্রভাবে শিল্পায়ন ও প্রযুক্তিগত উন্নতি করে এক নতুন তুরস্ক গঠন। • ইসলামী ইউনিয়ন গড়ে তোলা এবং সব মুসলিমকে একই প্ল্যাটফর্মে নিয়ে এসে সাম্রাজ্যবাদীদের কালো হাত থেকে রক্ষা করা।
'মিল্লি গরুশ' প্রতিষ্ঠার পর তার রাজনৈতিক শাখা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন 'মিল্লি নিজাম পার্টি'। কিন্তু এ দলটিকে মাত্র ১ বছরের ব্যবধানে নিষিদ্ধ করা হয়। অতঃপর তিনি গঠন করেন 'মিল্লি সালামেত পার্টি'। এই দলটি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে ৪৮টি আসন লাভ করে এবং কোয়ালিশন করে শর্তভিত্তিক সরকার গঠন করে। এরবাকান সরকারের উপ-প্রধানমন্ত্রীনির্বাচিত হন (অর্থনীতি বিষয়ক)। এছাড়া তার দল থেকে মন্ত্রীসভায় শিল্পমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীও মনোনীত হয়।
এ কোয়ালিশন সরকারের সময় ইসলামী অনুশাসন মেনে চলার অপরাধে বন্দি হওয়া ৬ হাজার মুসলিমকে মুক্ত করে দেওয়া হয়। সাইপ্রাসকে গ্রীস থেকে মুক্ত করে তার্কিশ সাইপ্রাস গঠন করা ও মুসলিমদেরকে জুলুমমুক্ত করা, নতুন করে মাদ্রাসা শিক্ষার দ্বার উন্মোচন করা, হাজার হাজার কোরআন কোর্স চালু করা, মাদ্রাসার ছাত্রদের উচ্চ শিক্ষার সুযোগ দেওয়া, বদিউজ্জামান সাঈদ নুরসির রিসালা-ই-নূরের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা, সেনানিবাসসহ সব সরকারি অফিস-আদালতে মসজিদ প্রতিষ্ঠা করা-সহ ইসলামী বই-পুস্তক প্রকাশের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়। অশ্লীলতা-বেহায়াপনা দূর করার লক্ষ্যে আইন করা হয়। এছাড়া ১৯৭৪ থেকে ১৯৭৮ সালের মধ্যে তিনি ২৭০টি ভারী শিল্প কারখানা প্রতিষ্ঠা করেন। এর মধ্যে বিমান তৈরির কারখানা থেকে শুরু করে অনেক কিছুই অন্তর্ভুক্ত ছিলো। তার এই উদ্যম দেখে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি তার সাথে কোয়ালিশনে থাকা অন্য দলকে কোয়ালিশন ছিন্ন করতে বাধ্য করে।
৬ সেপ্টেম্বর ১৯৮০ সালে তুরস্কের কোনিয়াতে কুদস দিবসের সমাবেশ পালনের অভিযোগে ১২ সেপ্টেম্বর ১৯৮০ সালে সামরিক শাসকরা ক্যু করে এই পার্টিকেও নিষিদ্ধ করে। সে সাথে সব রাজনৈতিক দলকেও নিষিদ্ধ করা হয়। এরবাকানকে রাজনীতিতে নিষিদ্ধ এবং গ্রেফতার করে জেল-হাজতে প্রেরণ করা হয়।
তার ওপর এসব জুলুম-নির্যাতন এবং রাজনীতিতে তাকে নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর ১৯৮৩ সালে তিনি জেল থেকে মুক্তি লাভ করেন। মুক্তিলাভের পর দলের অন্য নেতৃবৃন্দদের দিয়ে তিনি রেফাহ পার্টি প্রতিষ্ঠা করান। এ পার্টি স্বল্প সময়েই জনপ্রিয়তা লাভ করে। ১৯৮৭ সালে গণভোটের মাধ্যমে ড. নাজমুদ্দিন এরবাকানের ওপর রাজনৈতিক নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ায় তিনি আবারও রাজনীতিতে আসেন। রেফাহ পার্টির সভাপতি নির্বাচিত হন। তিনি সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার পর পরই রেফাহ পার্টি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। এরই ধারাবাহিকতায়১৯৯৪ সালের স্থানীয় মেয়র নির্বাচনে ইস্তাম্বুল ও আঙ্কারাসহ অনেক সিটি কর্পোরেশনে তার দল বিজয় লাভ করে। এ জয়ের ধারাবাহিকতায় নতুন উদ্যোমে কাজ করে 'ন্যায়ভিত্তিক ব্যবস্থা' এই স্লোগান নিয়ে ১৯৯৬ সালে জাতীয় নির্বাচনে জয়লাভ করে সরকার গঠন করেন। কিন্তু ১১ মাস সরকার পরিচালনার পর এক সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়।
প্রফেসর ড. নাজমুদ্দিন এরবাকান তার ১১ মাসের শাসনামলে D-8 প্রতিষ্ঠা করেন। সুদের হার কমিয়ে আনেন। মাত্র ১১ মাসের শাসনামলে তিনি দেশকে ৩৩ বিলিয়ন ডলার ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করেন। সরকারি কর্মচারীদের বেতন ১০০ ভাগ বৃদ্ধি করেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ১৫০ ভাগ পর্যন্ত বৃদ্ধি করেন। জনগণের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করার দিকে মনোযোগী হন। তুরস্কে শিল্পায়নের গতি ফিরিয়ে এনে ৫ বছরের মধ্যে তুরস্কের শিল্পায়ন জাপান ও জার্মানির শিল্পায়নকে ছাড়িয়ে যাবে বলে ঘোষণা দেন।
মুসলিম দেশগুলোকে নিয়ে কমন মার্কেট চালু করেন। তার উত্তরোত্তর সফলতায় আতঙ্কিত হয়ে ইহুদীরা রেফাহ পার্টিকে নিষিদ্ধ করার লক্ষ্যে সব ধরনের প্রোপাগাণ্ডা চালায়। তার পার্টি 'শরীয়ত কায়েম করবে' এই অভিযোগে তাকে অপসারণের জন্য সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপ কামনা করে। এ অবস্থায় প্রফেসর এরবাকান এ শর্তে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তফা দেন যে, তার কোয়ালিশন পার্টির নেত্রী তানসুকে প্রধানমন্ত্রী করা হবে। কিন্তু ফ্রি ম্যাসন ও ইহুদীদের ধারক-বাহক সোলাইমান দেমিরেল বিশ্বাসঘাতকতা করে মেসুদ ইলমাজকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ঘোষণা দেয়। এভাবে রেফাহ পার্টিকে নিষিদ্ধ করার পাশাপাশি প্রফেসর এরবাকানকেও রাজনীতিতে নিষিদ্ধ করা হয়। এরপর মিল্লি গরুশের অপর নেতা রেজাই কুতানের মাধ্যমে ফজিলত পার্টি গঠন করা হয়। এই পার্টিকেও খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে নিষিদ্ধ করা হয়।
২০০১ সালের ২০ জুলাই সাদেত পার্টি তার যাত্রা শুরু করে। কতিপয় নেতা মিল্লি গরুশে তরুণ প্রজন্মের নেতৃত্ব দাবি করে। তারা মূল আন্দোলনেও লিবারেল সেক্যুলারিজম প্রতিস্থাপনের চেষ্টা চালায়। সে চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে পরবর্তীতে মিল্লি গরুশকে ভেঙ্গে তারা গঠন করেএকে পার্টি। মিল্লি গরুশ দু'ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। সা'দাত পার্টি রয়ে যায় মূলধারার ইসলামী আন্দোলন হিসেবে। সাদেত পার্টিতে নেতৃত্ব নিয়ে অনেক সমস্যার সৃষ্টি হয়। ৮৪ বছর বয়সে ২০১০ সালে প্রফেসর এরবাকানকে পুনরায় সাদেত পার্টির সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। শত প্রতিকূলতার সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও সাদেত পার্টি এখনও তাদের এ কর্মস্পৃহা ধরে রেখে এগিয়ে চলছে। বর্তমানে দলটি তুরস্কের ৪র্থ বৃহত্তম রাজনৈতিক শক্তি।

মৃত্যু
৮৫ বছর বয়সে ২০১১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি সবাইকে কাঁদিয়ে মহান প্রভুর সান্নিধ্যে পাড়ি জমান মহান এ নেতা। তার জানাযায় এত পরিমাণ লোকের সমাগম হয়েছিলো, ইস্তাম্বুলের ৩০০০ বছরের ইতিহাসে এর আগে এত লোকের সমাগম হয়নি। বিশ্বের প্রায় সব দেশ থেকেই মানুষ তার জানাযায় অংশগ্রহণ করে। মিডিয়ার ভাষ্য মতে, তার জানাযায় ৩৫-৪০ লাখ লোকের সমাগম হয়েছিলো। মৃত্যুর আগে তিনি বলে গিয়েছিলেন, মৃত্যুর পর সরকার যেন তাকে বিশেষ কোনো সম্মানে দাফন না করে।

মতামত প্রকাশ করুন

Scroll to Top