আজ প্রাচ্য পাশ্চাত্য ও মুসলিম অমুসলিম নির্বিশেষে সবাই একই বিপদে জড়িয়ে পড়েছে। তাহলো, নিরেট বস্তুতান্ত্রিকতার ক্রোড়ে লালিত এক সভ্যতা ও সংস্কৃতি এসে সবার ওপর চেপে বসেছে। তাই সভ্যতার চিন্তা-পদ্ধতি ও কর্মকৌশল উভয়েরই ইমারত গড়ে উঠেছে ভ্রান্ত বুনিয়াদের ওপর। এর দর্শন, বিজ্ঞান, নৈতিকতা, সামাজিকতা, রাজনীতি, আইন কানুন ইত্যাদি প্রত্যেকটি জিনিসই এক ভ্রান্ত জায়গা থেকে যাত্রা করে এক ভ্রান্ত পথে উৎকর্ষ লাভ করে এসেছে। আর বর্তমানে সে এমন পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে যে, তার ধ্বংসের শেষ প্রান্ত খুবই নিকটবর্তী হয়ে পড়েছে।

এই সভ্যতার সূত্রপাত হয়েছে এমন লোকদের মধ্যে, যাদের কাছে প্রকৃতপক্ষে খোদায়ী জ্ঞান-বিজ্ঞানের কোনো স্পষ্ট ও পবিত্র উৎসই বর্তমান ছিলোনা। সেখানে ধর্মগুরু বা পুরোহিতদের অস্তিত্ব অবশ্যি ছিলো; কিন্তু তাদের কাছে বুদ্ধিমক্তা,জ্ঞান-বিজ্ঞান, খোদায়ী কানুন-এর কোনোটাই বর্তমান ছিলোনা। তাদের কাছে যে বিকৃত ধর্মীয় মতবাদটি ছিলো, তা মানবজাতিকে চিন্তা ও কর্মের ক্ষেত্রে সোজা পথ প্রদর্শন করতে চাইলেও তা করতে মোটেই সক্ষম ছিলোনা। বরং তা শুধু পারতো জ্ঞান বিজ্ঞানের উন্নতি ও সমৃদ্ধির পথে বাধা সৃষ্টি করতে। আর কার্যত সে তা-ই করলো। তার এই প্রতিবন্ধকতার ফলে যারা উন্নতি ও তরক্কীর জন্যে উৎসুক ছিলো, তারা ধর্ম ও ধার্মিকতার উপর আঘাত হেনে এক ভিন্ন পথে যাত্রা করলো। এ পথে অভিজ্ঞতা, পর্যবেক্ষণ এবং অনুমান ও অন্বেষণ ছাড়া আর কোনোই দিশারী ছিলোনা। এ দিশারীটি ছিলো সম্পূর্ণ অনির্ভরযোগ্য এবং নিজেই দিশারী ও আলোর মুখাপেক্ষী। তবু এটিই তাদের প্রধান নির্ভর হয়ে দাঁড়ালো। এর সাহায্যে তারা চিন্তা ভাবনা, গবেষণা, অনুশীলন ও সংগঠন পুণর্গঠনের পথে অনেক চেষ্টা সাধনা করলো। কিন্তু প্রতিটি ক্ষেত্রেই তারা ভ্রান্তির সূচনা করে বসলো এর ফলে তাদের সমস্ত উন্নতির গতিধারাই এক ভ্রান্ত লক্ষ্যস্থলের দিকে নিবদ্ধ হলো। তারা ধর্মহীনতা ও বস্তুতান্ত্রিকতার কেন্দ্রবিন্দু থেকে যাত্রা শুরু করলো। তারা বিশ্ব প্রকৃতিকে এভাবে দেখলো যে, তার কোনো স্রষ্টা ও নিয়ন্তা (খোদা) নেই। বিশ্বজগত ও প্রাণীজগতের প্রতি এভাবে তাকালো যে, সত্যতা রয়েছে শুধু পর্যবেক্ষণ ও ইন্দ্রিয়ানুভূতির। এই দৃশ্যমান পর্দার আড়ালে আর কোনো বস্তুর অস্তিত্ব নেই। এভাবে অভিজ্ঞতা ও অনুমানের সাহায্যে তারা প্রাকৃতিক নিয়মকে জানতে ও বুঝতে সক্ষম হলো বটে, কিন্তু প্রকৃতির স্রষ্টা অবধি পৌঁছাতে পারলোনা।

অনুরূপভাবে তারা বিশ্বের ব্যবহারযোগ্য বস্তুনিচয়কে নিজেদের কর্তৃত্বাধীনে পেলো এবং প্রয়োজন অনুযায়ী সেগুলো ব্যবহারও করলো। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তারা যে ঐ গুলোর মালিক ও নিয়ামক নয়; বরং আসল মালিকের প্রতিনিধি মাত্র- এই ধারণা থেকেই তাদের মন মগজ একেবারে শূণ্য ছিলো। এই অজ্ঞতা ও অচেতনা তাদেরকে দায়িত্ববোধ ও জবাবদিহির মৌলিক ধারণা সম্পর্কে অচেতন করে দিয়েছিলো। এর ফলে তাদের গোটা কৃষ্টি ও সভ্যতাই ভ্রান্ত ভিত্তির ওপর গড়ে উঠে। তারা আল্লাহকে ছেড়ে ‘আত্মা’র পূজারী হয়ে দাঁড়ায় এবং ‘আত্মার’ আল্লাহ্‌র স্থান দখল করে তাদেরকে কঠিন ফিত্না ও বিভ্রান্তিতে নিক্ষেপ করে দেয়। সেই মিথ্যা খোদার বন্দেগীই আজ তাদেরকে চিন্তা ও কর্মের প্রতিটি ক্ষেত্রে এক মারাত্মক পথে টেনে নিয়ে চলছে। এ পথের মধ্যকার পর্যায়গুলো নেহাত ভীতিপ্রদ ও চোখ ধাঁধানো হলেও তার শেষ পরিণতি ধ্বংস ছাড়া আর কিছুই নয়। সেই ভূয়া খোদাই বিজ্ঞানকে মানুষের ধ্বংসের হাতিয়ারে পরিণত করেছে। নৈতিকতাকে আত্মপূজা, প্রদর্শনেচ্ছা, অবাধ্যতা ও উচ্ছৃঙ্খলতার ছাঁচে ঢালাই করে নিয়েছে। অর্থ ব্যবস্থার ওপর স্বার্থপরতার ও ভ্রাতৃহত্যার শয়তান চাপিয়ে দিয়েছে। সামাজিকতার শিরা উপশিরায় আত্মপূজা, বিলাসপ্রিয়তা ও আত্মকেন্দ্রীকতার হলাহল ঢেলে দিয়েছে। রাজনীতিকে জাতীয়তাবাদ, স্বদেশিকতা, বর্ণ ও গোত্রের পার্থক্য এবং শক্তি পূজার দ্বারা দুষিত করে মানবতার পক্ষে এক নিকৃষ্টতম অভিশাপ বানিয়ে দিয়েছে। ফলকথা পাশ্চাত্যের রেনেসাঁ আসলে যে বিষবৃক্ষের বীজ রোপন করে, কয়েক শতকের মধ্যেই তা কৃষ্টি ও সভ্যতার এক বিরাট মহীরূহে পরিণত হয়। সে বৃক্ষের ফল সুমিষ্ট হলেও আসলে তা বিষদুষ্ট, তার ফুল দেখতে সুন্দর ও সুদৃশ্য হলেও আদতে কাঁটাযুক্ত, তার শাখা প্রশাখায় বসন্তের শোভা খাকলেও তার থেকে প্রবাহিত বিষাক্ত বায়ু ভেতরে ভেতরে গোটা মানবতাকেই বিষাক্ত করে চলছে।

যে পাশ্চাত্যবাসিগণ এই বিষবৃক্ষকে সহস্তে রোপন করেছিল, তারা আজ নিজেরাই তার প্রতি বীতশ্রদ্ধ। কারণ সে বৃক্ষ জীবনের প্রতিটি দিক ও বিভাগে এমন বিভ্রান্তি, জটিলতা ও পেরেশানির সৃষ্টি করেছে যে, তার যে কোনো প্রচেষ্টাই অসংখ্য জটিলতা ডেকে নিয়ে আসে। তার যে কোনো ডালই তারা কেটে ফেলে দেয়, সেখান থেকে, অসংখ্য কাঁটাযুক্ত ডাল ফুটে বেরোয়। দৃষ্টান্তস্বরূপ তারা পুঁজিবাদের ওপর করাত চালালো, সংগে সংগে কম্যুনিজমের অভ্যুদয় ঘটলো। গণতন্ত্রের ওপর আঘাত হানলো অমনি ডিক্টেটরবাদ আত্মপ্রকাশ করলো। সামাজিক সমস্যাবলীর সমাধান করতে গেলো, সংগে সংগে নারীত্ববাদ ও জন্মনিয়ন্ত্রণের আর্বিভাব হলো। নৈতিক উচ্ছৃঙ্খলতার প্রতিকারের জন্যে আইন প্রয়োগের চেষ্টা করলো, তার ফলে আইন লংঘন ও অপরাধ প্রবণতা মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো। ফলকথা, কৃষ্টি ও সভ্যতার এই বিষবৃক্ষ থেকে বিকৃতি ও বিচ্ছৃংখলার এক অন্তহীন ধারা বেরিয়ে আসছে এবং তা পাশ্চাত্য জীবনকে আপাদমস্তক দুঃখ কষ্ট ও ক্লেশের এক বিরাট ফোঁড়ার জ্বালা-যন্ত্রণা প্রতিটি শিরা উপশিরা ও স্নায়ুকেন্দ্রে অনুভুত হচ্ছে।

পাশ্চাত্য জাতিগুলো আজ সে ফোঁড়ার তীব্র যাতনায় আর্তনাদ করে উঠছে। তাদের হৃদয় মন উদ্বেলিত হয়ে উঠেছে। তাদের আত্মা কোনো অমৃত রসের জন্যে ছটফট করছে। কিন্তু অমৃতরস কোথায় পাওয়া যাবে, সে খবরই তাদের জানা নেই। তাদের অধিকাংশ লোক এখনো ভ্রান্তিতে লিপ্ত রয়েছে যে সমস্যার আসল উৎস হচ্ছে ঐ বিষবৃক্ষের শাখা প্রশাখা মাত্র। তাই ডালপালা কাটবার কাজেই তারা নিজেদের সমস্ত সময় ও মেহনত নিয়োজিত করছে। কিন্তু তবু তারা বুঝতে পারেনা যে, বিকৃতিটা ডাল পালায় নয়; বরং গাছের মূল শিকড়ে অবস্থিত। আর অসৎ বৃক্ষমূল থেকে সৎ ডালপালা বেরুনোর প্রত্যাশা করা নির্বুদ্ধিতা বৈ কিছুই নয়।

পক্ষান্তরে আপন সভ্যতা বৃক্ষের মূলগত খারাপীকে উপলব্ধি করতে পেরেছে, এমন একটি ক্ষুদ্র দলও সেখানে রয়েছে। কিন্তু যেহেতু তারা কয়েক শতক ধরে ঐ বৃক্ষের ছায়ায় প্রতিপালিত হচ্ছে এবং তারই ফল-ফলারি থেকে তাদের অস্থি-গোস্ত গঠিত হয়েছে, তাই এর মূল ছাড়া অন্য কোনো মূল থেকে সৎ ডালপালা বিস্তৃত হতে পারে, তাদের মনমানস এ কথা উপলব্ধিই করতে অক্ষম। ফলে উভয় দলেরই অবস্থা দাঁড়িয়েছে এক রকম। তারা অত্যন্ত ব্যাকুলতার সাথে তাদের যন্ত্রণা উপশমকারী কোনো জিনিস সন্ধান করে ফিরছে; কিন্তু তাদের অভীষ্ট বস্তুটি কি এবং তা কোথায় পাওয়া যাবে, এ খবরই তাদের জানা নেই।

বস্তুত পাশ্চাত্য জাতিগুলোর সামনে কুরআন ও মুহাম্মদ সা.-এর আদর্শ ও কর্মনীতি পেশ করার এটাই উপযুক্ত সময়। আজ তাদের বলা দরকার, তোমাদের হৃদয় মন যে ইপ্সিত বস্তুটির জন্যে উদ্বেলিত, তা হচ্ছে এই। যে অমৃতরসের জন্যে তোমরা চাতকের ন্যায় পিপাসার্ত, তা হচ্ছে এই। এ হচ্ছে এমন পূত পবিত্র মহীরুহ, যার মূল কান্ড এবং ডালপালা উভয়টাই সৎ। এর ফুল যেমন খুশবুদার, তেমনি কাঁটামুক্ত। এর ফল যেমন সুস্বাদু তেমনি প্রাণসঞ্চারক। এর হাওয়া যেমন আরামদায়ক, তেমনি হৃদয়-মন শীতলকারী। এখানে তোমরা বাস্তব বিচার বুদ্ধির সন্ধান পাবে, চিন্তা ও দৃষ্টির একটি নির্ভুল কেন্দ্রবিন্দু খুঁজে পাবে এবং সর্বোত্তম মানবীয় চরিত্র গঠনের উপযোগী জ্ঞানের সাক্ষাত পাবে। তোমরা এখানে এমন আধ্যাত্মিকের সন্ধান পাবে, যা সন্যাসী ও সংসার বৈরাগীদের জন্যে নয়; বরং দুনিয়ার কর্মক্ষেত্রে সংগ্রামকারীদের জন্যে আত্মিক শান্তি ও মানসিক স্বস্তির একমাত্র উৎস। এখনে তোমরা নৈতিকতা ও আইন কানুনের এমন উন্নত ও সুদৃঢ় বিধি ব্যবস্থা দেখতে পাবে, যা মানব প্রকৃত সংক্রন্ত পূর্ণাঙ্গ জ্ঞানের ওপর প্রতিষ্ঠিত এবং যা কখনো প্রবৃত্তির তাড়নায় বদলে যেতে পারেনা। এখানে তোমরা কৃষ্টি সভ্যতার এমন নির্ভুল মূলনীতির সন্ধান পাবে, যা অবৈধ শ্রেণী-বৈষম্যও কৃত্রিম জাতি-বিভেদকে নিশ্চিহ্ন করে মানব সমাজকে খালেস যুক্তিসম্মত ভিত্তির ওপর সংগঠিত করে। সে মূলনীতি সাম্য, সুবিচার, উদারতা, দানশীলতা ও সদাচরণের এমন এক শক্তিময় ও সুসংগত পরিবেশ সৃষ্টি করে, যাতে ব্যক্তি, শ্রেণী ও সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে স্বার্থ, অধিকার ও প্রয়োজনের খাতিরে দ্বন্দ্ব, সংঘাত ও লড়াই বাধবার কোনোই অবকাশ নেই; বরং সবাই এখানে পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে ব্যক্তিক ও সামাজিক কল্যাণের জন্যে সানন্দেও সন্তুষ্ট চিত্তে কাজ করতে পারে। কাজেই তোমরা যদি ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পেতে চাও, তাহলে এক প্রচন্ড আঘাত এসে তোমাদের কৃষ্টি সভ্যতাকে চূর্ণবিচূর্ণ করে ইতিহাসের ধ্বংসপ্রাপ্ত কৃষ্টি সভ্যতাগুলোর শামিল করে দেবার আগেই ইসলামের বিরুদ্ধে তামাম বিদ্বেষকে তোমাদের মন থেকে মুছে ফেলে দাও। তোমরা মধ্যযুগের ধর্মীয় উন্মাদদের কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে যে বিদ্বেষ লাভ করেছ এবং সেই অন্ধকার যুগের তামাম জিনিসের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করার পরও যাকে তোমরা আজ পর্যন্ত আঁকড়ে ধরে রয়েছ, তাকে পরিহার করো এবং উদার মনে কুরআন ও মুহাম্মদ সা.-এর মহান শিক্ষা সম্পর্কে অবহিত হও, তাকে গ্রহণ করো।

মুসলিম জাতিগুলোর অবস্থা পাশ্চাত্য জাতিগুলো থেকে কিছুটা ভিন্ন ধরনের। এদের রোগ যেমন আলাদা, রোগের কারণও ভিন্ন। কিন্তু তাদের চিকিৎসা পাশ্চাত্য বাসীদেরই অনুরূপ। অর্থাৎ আল্লাহ তাঁর শেষ কিতাব ও শেষ নবীর মাধ্যমে যে জ্ঞান ও হেদায়াত পাঠিয়েছেন, তার দিকে প্রত্যাবর্তন করাই তাদের চিকিংসা।

যে পরিস্থিতিতে ইসলামের সাথে পাশ্চাত্য সভ্যতার সংঘাত বেধেছে, তা ইসলাম ও অন্যান্য সভ্যতার মধ্যকার পূর্ববর্তী সংঘাত থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের। রোমক, পারসিক, ভারতীয় ও চৈনিক সভ্যতার সংগে যখন ইসলামের সংঘর্ষ বাধে, তখন ইসলাম তার অনুবর্তীদের চিন্তা ও কর্মশক্তির উপর পূর্ণ মাত্রায় কর্তৃত্বশীল ছিলো। তাদের ভিতরে জিহাদ ও ইজতিহাদের প্রচন্ড ভাবধারা ক্রিয়াশিল ছিলো। আধ্যাত্মিক ও বস্তুতান্ত্রিক উভয় দিক থেকেই তারা দুনিয়ায় এক বিজয়ী জাতির গৌরব অর্জন করেছিলো এবং অন্য সব জাতির উপর নেতৃত্বের মর্যাদায় অভিষিক্ত হয়েছিলো। তখন দুনিয়ার কোনো কৃষ্টি সভ্যতাই তাদের কৃষ্টি সভ্যতার মোকাবিলায় দাঁড়াতে পারেনি। তারা যেদিকে এবং যে জাতির কাছেই পৌঁছেছে, তার চিন্তাদর্শ, মতাদর্শ, জ্ঞান বিজ্ঞান, স্বভাব চরিত্র ও সমাজ ব্যবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধন করেছে। তাদের মধ্যে বাইরের প্রভাব গ্রহণের যোগ্যতার চেয়ে প্রভাব বিস্তারের শক্তি ছিলো অনেক বেশি। নিঃসন্দেহে তারা অন্যদের কাছ থেকেও অনেক কিছু গ্রহণ করেছে; কিন্তু তাদের সভ্যতার মেজাজ এতোখানি সুদৃঢ় ও শক্তিশালী ছিলো যে, বাহির থেকে এসে যা কিছুই তাতে যুক্ত হয়েছে, তা তার প্রকৃতির সঙ্গে একেবারে খাপ খেয়ে গিয়েছে এবং বাইরের কোনো প্রভাবেই তার মেজাজে এতটুকু পার্থক্য সুচিত হয়নি। পক্ষান্তরে সে অন্যদের ওপর যে প্রভাব বিস্তার করেছে, তা একেবারে বিপ্লবাত্মক বলে প্রমাণিত হয়েছে। এর ফলে কোনো কোনো অমুসলিম সভ্যতা তো ইসলামের মধ্যে বিলীন হয়ে নিজের স্বাতন্ত্র্যই বিলিয়ে দিয়েছে। আর যেগুলোর মধ্যে জীবনী শক্তি প্রবল ছিলো, সেগুলোও ইসলামের দ্বারা এতোটা প্রভাবিত হয়েছে যে, তাদের মুলনীতিতে অনেক পরিবর্তন ঘটে গিয়েছে। কিন্তু এ হচ্ছে তখনকার কথা, যখন মুসলমানদের ভেতর আদর্শের দীপশিখা অম্লান ও অনির্বাণ ছিলো।

মুসলমানরা কয়েক শতক ধরে লেখনী ও তরবারির সাহায্যে রাজত্ব চালিয়ে শেষ পর্যন্ত অবসন্ন হয়ে পড়লো। তাদের জিহাদী প্রাণশক্তি নিস্তেজ হয়ে পড়লো। ইজতিহাদী শক্তি নিষ্প্রভ হয়ে গেলো। যে মহাগ্রন্থ তাদেরকে জ্ঞানের রৌশনি ও কর্মের শক্তি যুগিয়েছিলো, তাকে তারা নিছক একটি পবিত্র স্মৃতিশাস্ত্র বানিয়ে গেলাফবন্দী করে রেখেছে। যে মহান নায়কের অনুসৃত নীতি তাদের কৃষ্টি ও সভ্যতাকে এক পূর্ণাঙ্গ বুদ্ধিবৃত্তিক ও বাস্তবধর্মী জীবনাদর্শের রূপদান করেছিল, তাঁর অনুসৃতিকে তারা বর্জন করলো। তার ফলে তাদের উন্নতি ও তরক্কীর গতি স্তব্ধ হয়ে গেলো। প্রবহমান স্রোতস্বিনী হঠাৎ নিশ্চল উপত্যকায় এসে গতিরুদ্ধ হয়ে ক্ষুদ্র সরোবরে পরিণত হলো। নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বের আসন থেকে মুসলমানরা অপসারিত হলো। তাদের চিন্তাধারা জ্ঞান বিজ্ঞান, শিল্প সভ্যতা ও রাজনৈতিক ক্ষমতা দুনিয়ার অন্যজাতির ওপর যে আধিপত্য বিস্তার করেছিলো, তার বাঁধন শিথিল হয়ে গেলো। পরন্তু ইসলামের মোকাবিলায় পাশ্চাত্যে এক ভিন্ন সভ্যতার অভ্যুদয় হলো। মুসলমানেরা জিহাদ ও ইজতিহাদের যে ঝান্ডাকে দুরে নিক্ষেপ করেছিলো, পাশ্চাত্য জাতিগুলো তাকে নিজ হাতে তুলে নিলো। মুসলমানরা আরামে শুয়ে রইলো আর পাশ্চাত্যবাসী তাদের পরিত্যক্ত ঝান্ডা নিয়ে জ্ঞান ও কর্মের ক্ষেত্রে এগিয়ে চললো। এমনকি যে নেতৃত্বের আসন থেকে তারা অপসারিত হয়েছিলো সেই আসনই এরা লাভ করলো। তাদের তরবারি দুনিয়ার অধিকাংশ এলাকাই জয় করলো। তাদের চিন্তাধারা, মতাদর্শ, জ্ঞান বিজ্ঞান, শিল্পকলা এবং কৃষ্টি ও সভ্যতার মূলনীতি সারা দুনিয়ার ওপর ছড়িয়ে পড়লো। তাদের শাসন কর্তৃত্ব শুধু মানুষের দেহকেই নয়, তার দিল-দেমাগকেও অধিকারভুক্ত করে নিলো। অবশেষে কয়েক শতকের নিদ্রা থেকে জেগে উঠে মুসলমানরা চোখ মেলেই দেখতে পেলো, ময়দান সম্পূর্ণই তাদের হাতছাড়া হয়ে গিয়েছে এবং অন্য লোকেরা এসে তার ওপর জেঁকে বসেছে। এখন জ্ঞান বিজ্ঞান, কৃষ্টি সভ্যতা, আইন কানুন ও রাষ্ট্রক্ষমতা বলতে যা কিছুই আছে, সবই তাদের (মুসলমানদের) হাতে কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। তাদের কাছে রয়েছে শুধু দীপ্তিহীন এক আলোক বর্তিকা।

আজকে ইসলাম ও পাশ্চাত্য সভ্যতার মধ্যে দ্বন্দ্ব চলছে এক নতুন ধারায়। নিসন্দেহে পাশ্চাত্য সভ্যতা কোনো দিক দিয়েই ইসলামী সভ্যতার মোকাবিলা করতে সমর্থ নয়। এমনকি ইসলামের সঙ্গে যদি সংঘর্ষ বাধে, তবে দুনিয়ার কোনো শক্তিই তার সামনে টিকে থাকতে পারেনা। কিন্তু প্রশ্ন হলো, ইসলাম কোথায়? আজকের মুসলমানদের মধ্যে যেমন ইসলামী স্বভাব প্রকৃতি ও নৈতিক চরিত্রের বালাই নেই, তেমনি নেই ইসলামী চিন্তাধারা ও কর্ম প্রেরণা। তাদের মসজিদ, মাদ্রাসা, খানকাহ কোথাও সত্যিকার ইসলামী প্রাণ চেতনা নেই। তদের বাস্তব জীবনের সঙ্গে ইসলামের কোনো সম্পর্ক নেই। তাদের ব্যক্তিগত জীবনে যেমন ইসলামী আইন কার্যকর নয়, তেমনি নয় তাদের সামাজিক জীবনেও। তাদের সভ্যতা ও সংস্কৃতির কোন একটি শাখার ব্যবস্থাপনা প্রকৃত ইসলামী প্রণালীর উপর ভিত্তিশীল নয়। এমতাবস্থায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা ইসলাম ও পাশ্চাত্য সভ্যতার মধ্যে নয়; বরং প্রতিদ্বন্দ্বিতা হচ্ছে এক প্রাণবান, গতিশীল, জ্ঞানদীপ্ত ও কর্মচঞ্চল সভ্যতার সাথে মুসলমানদের নিশ্চল, জরাজীর্ণ ও অনগ্রসর সভ্যতার। আর এমনি অসম প্রতিযোগিতার ফলাফল যা হবার কথা, তাই হচ্ছে। মুসলমানরা ক্রমাগত পিছু হটছে। তাদের সভ্যতা পরাভূত হচ্ছে। ধীরে ধীরে তারা পাশ্চাত্য কৃষ্টির মধ্যে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। তাদের মনমগজে দিন দিন পাশ্চাত্যপনা চেপে বসছে। পাশ্চাত্য ছাঁচে তাদের মানসিক কাঠামো গড়ে উঠছে। পাশ্চাত্যনীতির প্রেক্ষিতে তাদের চিন্তা ও দৃষ্টিশক্তির পরিশীলন হচ্ছে। তাদের ধ্যানধারণা, নৈতিকতা, অর্থনীতি, সামাজিকতা, রাজনীতি ইত্যাদি প্রতিটি জিনিসই পাশ্চাত্যের রঙে রঞ্জিত হচ্ছে। তাদের নব্য বংশধরগণের মনমানসে এই ধারণা বদ্ধমূল হচ্ছে যে, পাশ্চাত্য থেকে প্রাপ্ত বিধানই হচ্ছে সত্যিকার জীবন বিধান। সুতরাং এ পরাজয় হচ্ছে আসলে মুসলামানদের পরাজয় ইসলামের পরাজয় নয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত একে ইসলামের পরাভব বলে বিবেচনা করা হচ্ছে!

এই কঠিন বিপদে শুধু একটি দেশই পরিবেষ্টিত নয়। কেবল একটি জাতিই এ সংকটের মুখোমুখি নয়। আজ গোটা মুসলিম জাহানই এই ভয়াবহ বিপ্লবের পর্যায় অতিক্রম করে চলছে। প্রকৃতপক্ষে এই বিপ্লবের যখন সূত্রপাত হচ্ছিল, ঠিক তখন থেকেই সচেতন ভূমিকা গ্রহণ করা, আসন্ন সভ্যতার নীতি ও ভিত্তিমূলকে উপলদ্ধি করা এবং পাশ্চাত্য দেশসমূহ পরিভ্রমণ করে এর বুনিয়াদী জ্ঞানবিজ্ঞান অধ্যয়ন করা ছিলো আলিম সমাজের কর্তব্য। তাঁদের উচিত ছিলো, যেসব কার্যকরী বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার ও বাস্তব প্রক্রিয়ার ভিত্তিতে পাশ্চাত্য জাতিগুলো উন্নতি লাভ করছে, ইজতিহাদী শক্তির দ্বারা সেগুলোকে আয়ত্বাধীন করে নিয়ে ইসলামী নীতির আলোকে মুসলমানদের শিক্ষা ও সমাজ জীবনে তা যথাযথভাবে প্রয়োগ করা। এতে করে যেমন শত শত বছরের নিষ্ক্রয়তাজনিত ক্ষতি পূর্ণ হয়ে যেতো, তেমনি ইসলামের গাড়ীও আবার যুগের গতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে সক্ষম হতো। কিন্তু আক্ষেপের ব্যাপার হলো, খোদ আলিম সমাজই (ব্যতিক্রম ছাড়া) তখন ইসলামের সত্যিকার প্রাণচেতনা থেকে দূরে সরে গিয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে না ছিলো ইজতিহাদী শক্তি, না চিন্তা গবেষণার ক্ষমতা। তাঁদের বুদ্ধিমত্তা ও কর্ম শক্তিও লোপ পেয়েছিলো। খোদার কিতাব ও রসূলে খোদার আদর্শিক ও বাস্তব হেদায়াত থেকে ইসলামের সনাতন ও গতিশীল নীতি নির্ধারণ করে যুগের পরিবর্তির্ত অবস্থায় তাকে প্রয়োগ করার কোনো যোগ্যতাই তাঁদের মধ্যে ছিলোনা। তাদের মধ্যে পূর্ব পূরুষদের অন্ধ ও অনড় তাকলিদের ব্যাধি পুরোপুরি সংক্রমিত হয়েছিল। এর ফলে প্রতিটি জিনিসই তাঁরা এমন কিতাবাদিতে খোঁজ করতেন, যা কোনো কালোত্তীর্ণ খোদায়ী কিতাব ছিলোনা। তাঁরা প্রতিটি ব্যাপারেই এমন লোকদের মুখাপেক্ষী হতেন, যাদের মধ্যে নবীদের মতো সময় ও পরিবেশের বন্ধনমুক্ত উদার দূরদৃষ্টি ছিলোনা। কাজেই সম্পূর্ণ পরিবর্তিত অবস্থায় মুসলমানদের সাফল্যজনক নেতৃত্ব দান করা তাঁদের পক্ষে কি করে সম্ভব ছিলো? তখন তো জ্ঞানবিজ্ঞান ও কর্মসাধনার ক্ষেত্রে এমন বিপ্লবাত্মক পরিবর্তন সূচিত হয়েছিল, যার প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করা কেবল খোদার পক্ষেই সম্ভবপর ছিলো। কিন্তু যুগ যুগান্তকালের আবরণ ভেদ করে সে পর্যন্ত পৌঁছবার মতো দৃষ্টিশক্তি কোন সাধারণ মানুষের ছিলোনা।

 

একথা নিসন্দেহ যে, আলিম সমাজ নয়া সভ্যতা ও সংস্কৃতির মোকাবিলা করার জন্যে যথেষ্ট প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। কিন্তু মোকাবিলার জন্য প্রয়োজনীয় উপায় উপকরণ ও সাজ সরঞ্জাম তাঁদের কাছে ছিলোনা। কারণ স্থবিরতার দ্বারা গতিশীলতার মোকাবিলা করা যায়না। তর্কশাস্ত্রের বলে যুগের গতিকে বদলানো যেতে পারেনা। নয়া অস্ত্রপাতির সামনে অকেজো মরচে ধরা হাতিয়ার কোনো কাজেই লাগতে পারেনা। আলিম সমাজ যেসব পন্থায় জাতির নেতৃত্ব প্রদান করতে চাইছিলেন, তাতে সাফল্যের কোনো সম্ভাবনাই ছিলোনা। যে জাতি পাশ্চাত্য সভ্যতার বন্যা প্রবাহে বেষ্টিত হয়ে পড়েছিলো, সে চোখের ওপর ঠুলি বেঁধে এবং ইন্দ্রিয়ানুভূতিকে নিষ্ক্রিয় করে বন্যার অস্তিত্বকে কতোক্ষণ অস্বীকার করতে এবং তার প্রভাব থেকে নিরাপদ থাকতে পারতো? যে জাতির ওপর আধুনিক সভ্যতা ও সংস্কৃতি রাষ্ট্রশক্তিসহ চেপে বসেছিলো, পরাভূত ও পদানত অবস্থায় সে তার বাস্তব জীবনকে ওই সভ্যতার প্রভাব প্রতিপত্তি থেকে কিভাবে রক্ষা করতে পারতো? বস্তুত এমনি পরিস্থিতিতে যা হবার শেষ পর্যন্ত তা-ই হলো। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে পরাজয় বরণের পর মুসলমানরা জ্ঞান বিজ্ঞান ও তাহযীব তমদ্দুনের ক্ষেত্রেও শোচনীয়ভাবে পরাজিত হলো। আজ আমরা দেখতে পাচ্ছি, মুসলিম জাহানের প্রতিটি দেশেই পাশ্চাত্যপনার তুফান মহামারীর বেগে ছড়িয়ে পড়েছে। আর তা বন্যা প্রবাহে ভাসতে ভাসতে মুসলমানদের নব্য বংশধরগণ ইসলামের কেন্দ্রবিন্দু থেকে দূর থেকে দূরান্তরে চলে যাচ্ছে।

দুর্ভাগ্যের বিষয় এই যে, আমাদের আলিম সমাজ আজ পর্যন্ত তাঁদের ভ্রান্তি উপলদ্ধি করতে পারেননি। যে নীতি ও দৃষ্টিভঙ্গির কারণে প্রথমদিকে আলিম সমাজ ব্যর্থতার গ্লানি বরণ করে নিয়েছিলেন, আজো প্রায় প্রতিটি মুসলিম দেশেই তাঁরা সেই একই দৃষ্টিভঙ্গির ওপরই অবিচল রয়েছেন। কতিপয় ব্যক্তিক্রম ব্যক্তিত্বকে বাদ দিলে আলিম সমাজের সাধারণ অবস্থা হচ্ছে এই যে, যুগের বর্তমান গতি-প্রকৃতি ও মানসিকতার নতুন গড়নকে উপলদ্ধি করার কোনো চেষ্টাই তাঁরা করেননা। যেসব বিষয় মুসলমানদের নব্য বংশধরগণকে ইসলাম থেকে দুরে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, সেগুলোর প্রতি তাঁরা যতো খুশি ঘৃণা প্রকাশ করতে প্রস্তুত; কিন্তু সে হলাহলের প্রতিকার করার মতো ঝুঁকি গ্রহণ করতে তাঁরা অসমর্থ। আধুনিক পরিস্থিতি মুসলমানদের জন্যে যে জটিল বৈজ্ঞানিক ও বাস্তব সমস্যাবলীর সৃষ্টি করেছে, সেগুলোর সমাধান করতে তারা হামেশাই অপারগ। এর কারণ হলো, ইজতিহাদ ছাড়া ঐ সমস্যাগুলোর সমাধান সম্ভবপর নয়। অথচ ইজতিহাদকে এঁরা নিজেদের জন্যে হারাম করে নিয়েছেন। বস্তুত আজকে আমাদের আলিম সমাজ ইসলামের শিক্ষা ও তার বিধিব্যবস্থা প্রচার করার জন্যে যে পন্থা অবলম্বন করছেন তা আধুনিক শিক্ষিত লোকদেরকে ইসলামের সাথে পরিচিত করানোর পরিবর্তে উল্টো তাদেরকে বীতশ্রদ্ধ করে দেয়। এমনকি কখনো কখনো তাদের ওয়াজ নসীহত শুনে কিংবা তাদের রচনাবলী পড়ে স্বতস্ফূর্তভাবেই মন থেকে বলে উঠে, খোদা যেনো কোনো অমুসলিম বা পথভ্রষ্ট মুসলিমের কান পর্যন্ত এইসব অর্থহীন প্রলাপ না পৌছান! মোটকথা, আমাদের আলিম সমাজ তাঁদের চারদিকে দু’শ বছরের পুরনো পরিবেশ সৃষ্টি করে রেখেছেন। সেই পরিবেশেই তাঁরা চিন্তা ভাবনা করেন, তার ভেতরেই তারা বাস করেন এবং তার উপযোগী কথাবার্তা তাঁরা বলেন। একথা নিসন্দেহ যে, এই সম্মানিত ব্যক্তিদের কল্যাণেই আজও দুনিয়ার ইসলামী জ্ঞান ভান্ডারের অমূল্য। রত্নরাজি সংরক্ষিত রয়েছে এবং তাদের প্রচেষ্টার ফলেই আজ ইসলামী শিক্ষা যা কিছু বিস্তার লাভ করেছে। কিন্তু তাঁরা নিজেদের এবং সমসাময়িক যুগের মধ্যে যে বিশাল ব্যবধান দাঁড় করিয়ে রেখেছেন, তা-ই ইসলাম ও আধুনিক দুনিয়ার মধ্যে কোনোরূপ সম্পর্ক স্থাপনে বাধার সৃষ্টি করছে। এর ফলে যারা ইসলামী শিক্ষার দিকে অগ্রসর হয়, তারা আর দুনিয়ার কোনো কাজের উপযোগী থাকেনা। আর যে দুনিয়ার কাজের যোগ্য হতে চায়, সে ইসলামী শিক্ষার সাথে সম্পূর্ণ অপরিচিত থেকে যায়। এই কারণেই আজ মুসলিম জাহানের সর্বত্র দু’টি সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী দলের অস্তিত্ব দেখা যায়। একদল ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞান ও ইসলামী সভ্যতার নিশানবর্দার, কিন্তু জীবনের সর্বত্র মুসলমানদের নেতৃত্ব দানে অক্ষম। আর দ্বিতীয় দল মুলসমানদের জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্প-সাহিত্য ও রাজনীতির গাড়িকে চালিত করছে বটে কিন্তু ইসলামের নীতি ও ভিত্তি, ইসলামী সভ্যতার প্রাণবস্তু এবং ইসলামের সমাজ পদ্ধতি ও তামাদ্দুনিক বিধি ব্যবস্থা সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ, অপরিচিত ও অনবহিত। এদের হৃদয়ের কোণে ঈমানের কিছুটা আলো রয়েছে বটে; অন্যান্য সবদিক থেকে এদের এবং অমুসলমানের মধ্যে কোনোই পার্থক্য নেই। কিন্তু যেহেতু জ্ঞান-বিজ্ঞান ও বাস্তব কর্মশক্তি এই দলটিরই করায়ত্ব রয়েছে এবং এদের বাহুতেই গাড়ি চালানোর মতো শক্তি রয়েছে, এজন্যই তারা মিল্লাতের গোটা গাড়িটি নিয়ে ভ্রান্তি ও গুমরাহীর পথে দ্রুত এগিয়ে চলছে। সে পথ থেকে তাদের ফিরিয়ে রাখা এবং সঠিক পথ প্রদর্শন করার মতোও আজ আর কেউ নেই।

আমি এই পরিস্থিতি লক্ষ্য করছি এবং এর ভয়ঙ্কর পরিণতিও নিজ চোখে দেখতে পাচ্ছি। যদিও নেতৃত্ব দান করার জন্যে প্রয়োজনীয় জ্ঞান-বুদ্ধি, অভিজ্ঞতা ও যোগ্যতা আমার নেই এবং এমনি বিকৃত পরিবেশে, এতো বড় একটি জাতির সংশোধন করার মতো শক্তিও আমার নেই, তবু আল্লাহ আমার হৃদয়ে একটি ব্যথা দিয়েছেন। আজ যে সামান্য জ্ঞান ও বিচক্ষণতা তিনি আমায় দান করেছেন, তার সাহায্যে মুসলমানদের ঐ দু’টি দলকে ইসলামী শিক্ষা, সংস্কৃতির আসল ও প্রকৃত উৎসের দিকে মনোযোগী হবার আহ্বান জানানো এবং সাফল্য ও ব্যর্থতার কোনো তোয়াক্কা না করে নিজের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবার জন্যে সেই ব্যথাই আমায় বাধ্য করছে। কাজের শ্রেষ্ঠত্ব এবং নিজের দুর্বলতা দেখে আমার এই প্রচেষ্টাকে নিজের কাছেই তুচ্ছ বলে মনে হয়; কিন্তু সাফল্য বা ব্যর্থতা সবকিছুই হচ্ছে সর্বশক্তিমান আল্লাহর হাতে। আমার কাজ শুধু চেষ্টা করে যাওয়া। তাই সাধ্যানুযায়ী আমি আমার চেষ্টার পরিধিকে বিস্তৃত করতে চাই।

(তরজমানুল কুরআন: অক্টোবর ১৯৩৫ ইং)

২৮৪ বার পঠিত

শেয়ার করুন

Picture of সাইয়েদ আবুল আলা মওদুদী

সাইয়েদ আবুল আলা মওদুদী

আবুল আ'লা মওদুদী (২৫ সেপ্টেম্বর ১৯০৩ – ২২ সেপ্টেম্বের ১৯৭৯), যিনি মাওলানা মওদুদী, বা শাইখ সাইয়েদ আবুল আ'লা মওদুদী নামেও পরিচিত, ছিলেন একজন মুসলিম গবেষক, আইনবিদ, ইতিহাসবিদ, সাংবাদিক, রাজনৈতিক নেতা এবং বিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ ও দার্শনিক। উইলফ্রেড ক্যান্টওয়েল স্মিথ তাকে "আধুনিক ইসলামের সবচেয়ে নিয়মতান্ত্রিক চিন্তাবিদ" হিসাবে বর্ণনা করেছেন। মওদুদী কুরআনের ব্যাখ্যা, হাদিস, আইন, দর্শন এবং ইতিহাসের মতো বিভিন্ন শাখায় প্রচুর কাজ করেছেন। তার লেখাগুলো মূলত উর্দুতে । পরে তার লেখাগুলো ইংরেজী, আরবি, হিন্দি, বাংলা, তামিল, তেলুগু, কন্নড়, বর্মি, মালায়ালাম এবং অন্যান্য অনেক ভাষায় অনুবাদ করা হয়। তিনি মুসলিম মিল্লাতের কাছে ইসলামের আসল রুপ তুলে ধরার চেষ্টা করেন। দ্বীনী জ্ঞান নেয়ার ক্ষেত্রে তিনি অত্যন্ত সচেতন ছিলেন, এ ব্যাপারে মাওলানা মওদুদী বলেন, "আমি অতীত ও বর্তমানের কারো কাছ থেকে দ্বীনকে বুঝবার চেষ্টা না করে সর্বদা কোরআন ও সুন্নাহ থেকে বুঝবার চেষ্টা করেছি। অতএব খোদার দ্বীন আমার ও প্রত্যেক মুমিনের কাছ থেকে কি দাবি করে, এ কথা জানার জন্যে আমি দেখার চেষ্টা করি না যে, অমুক বুযুর্গ কি বলেন ও কি করেন। বরঞ্চ শুধু দেখার চেষ্টা করি যে, কোরআন কি বলে এবং তার রাসূল (সাঃ) কি করেছেন।" তিনি বিশ্বাস করতেন যে, মুসলিমদের রাজনীতির জন্য ইসলাম অপরিহার্য। শরিয়া এবং ইসলামী সংস্কৃতি সংরক্ষণ করা প্রয়োজন খিলাফতে রাশিদুনের শাসনের মতো এবং অনৈতিকতা ত্যাগ করা প্রয়োজন। তিনি পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের কুফল হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষতা, জাতীয়তাবাদ এবং সমাজতন্ত্রকে দেখতেন। তিনি নিজ দেশ পাকিস্তানের একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বও ছিলেন। তিনি এশিয়ার তৎকালীন বৃহত্তম ইসলামী সংগঠন জামায়াতে ইসলামী-র প্রতিষ্ঠাতা। তিনি ছিলেন ২০ শতাব্দীর আলোচিত ও একইসাথে বিতর্কিত মুসলিম আলেমদের মধ্যে একজন। ইসলাম ধর্মে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তাকে ১৯৭৯ সালে কিং ফয়সাল ফাউন্ডেশন কর্তৃক বাদশাহ ফয়সাল পুরস্কারটি প্রদান করা হয়।
Picture of সাইয়েদ আবুল আলা মওদুদী

সাইয়েদ আবুল আলা মওদুদী

আবুল আ'লা মওদুদী (২৫ সেপ্টেম্বর ১৯০৩ – ২২ সেপ্টেম্বের ১৯৭৯), যিনি মাওলানা মওদুদী, বা শাইখ সাইয়েদ আবুল আ'লা মওদুদী নামেও পরিচিত, ছিলেন একজন মুসলিম গবেষক, আইনবিদ, ইতিহাসবিদ, সাংবাদিক, রাজনৈতিক নেতা এবং বিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ ও দার্শনিক। উইলফ্রেড ক্যান্টওয়েল স্মিথ তাকে "আধুনিক ইসলামের সবচেয়ে নিয়মতান্ত্রিক চিন্তাবিদ" হিসাবে বর্ণনা করেছেন। মওদুদী কুরআনের ব্যাখ্যা, হাদিস, আইন, দর্শন এবং ইতিহাসের মতো বিভিন্ন শাখায় প্রচুর কাজ করেছেন। তার লেখাগুলো মূলত উর্দুতে । পরে তার লেখাগুলো ইংরেজী, আরবি, হিন্দি, বাংলা, তামিল, তেলুগু, কন্নড়, বর্মি, মালায়ালাম এবং অন্যান্য অনেক ভাষায় অনুবাদ করা হয়। তিনি মুসলিম মিল্লাতের কাছে ইসলামের আসল রুপ তুলে ধরার চেষ্টা করেন। দ্বীনী জ্ঞান নেয়ার ক্ষেত্রে তিনি অত্যন্ত সচেতন ছিলেন, এ ব্যাপারে মাওলানা মওদুদী বলেন, "আমি অতীত ও বর্তমানের কারো কাছ থেকে দ্বীনকে বুঝবার চেষ্টা না করে সর্বদা কোরআন ও সুন্নাহ থেকে বুঝবার চেষ্টা করেছি। অতএব খোদার দ্বীন আমার ও প্রত্যেক মুমিনের কাছ থেকে কি দাবি করে, এ কথা জানার জন্যে আমি দেখার চেষ্টা করি না যে, অমুক বুযুর্গ কি বলেন ও কি করেন। বরঞ্চ শুধু দেখার চেষ্টা করি যে, কোরআন কি বলে এবং তার রাসূল (সাঃ) কি করেছেন।" তিনি বিশ্বাস করতেন যে, মুসলিমদের রাজনীতির জন্য ইসলাম অপরিহার্য। শরিয়া এবং ইসলামী সংস্কৃতি সংরক্ষণ করা প্রয়োজন খিলাফতে রাশিদুনের শাসনের মতো এবং অনৈতিকতা ত্যাগ করা প্রয়োজন। তিনি পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের কুফল হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষতা, জাতীয়তাবাদ এবং সমাজতন্ত্রকে দেখতেন। তিনি নিজ দেশ পাকিস্তানের একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বও ছিলেন। তিনি এশিয়ার তৎকালীন বৃহত্তম ইসলামী সংগঠন জামায়াতে ইসলামী-র প্রতিষ্ঠাতা। তিনি ছিলেন ২০ শতাব্দীর আলোচিত ও একইসাথে বিতর্কিত মুসলিম আলেমদের মধ্যে একজন। ইসলাম ধর্মে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তাকে ১৯৭৯ সালে কিং ফয়সাল ফাউন্ডেশন কর্তৃক বাদশাহ ফয়সাল পুরস্কারটি প্রদান করা হয়।

মতামত প্রকাশ করুন

Scroll to Top