বাংলা অঞ্চলে ইসলামী সভ্যতার পতন ও পরবর্তী প্রায় দুই শতাব্দীকালব্যাপী বৃটিশ শোষণের ফলে এ অঞ্চলের মুসলমানদের ভাবজগত ও মানসক্ষেত্র যেরূপ বিধ্বস্ত ও বিকৃত হয়েছে, পূর্বাপর কোনো অভিজ্ঞতায়-ই মুসলিম সমাজের এরূপ সামগ্রিক অধঃপতন পরিলক্ষিত হয় না। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ও হিন্দুত্ববাদী ব্রাক্ষ্মণ্যবাদের যুগপৎ প্রভাবে মুসলমানরা তাদের পথচ্যুত হয়ে পড়ে, সেই সাথে এর প্রবল প্রভাবে খেই হারিয়ে এক ধরনের অনিবার্য স্থবিরতার মুখোমুখি হয়।
বাংলা অঞ্চলের প্রেক্ষিতে এ স্থবিরতার বিপরীতে প্রথম অমোঘ আওয়াজ তুলেন মাওলানা আকরম খাঁ। তাঁর গভীর প্রজ্ঞা, তীক্ষ্ম জ্ঞান, পাশাপাশি রাজনীতি ও সাংবাদিকতায় তাঁর অনবদ্য অবদানের ফলশ্রুতিতে বাংলা অঞ্চলে মুসলিম জাগরণের প্রভাবকদের তালিকায় তাঁর নাম স্বমহিমায় উপস্থিত। এজন্যই মুসলিম বাংলার আরেক যশস্বী ব্যক্তিত্ব আবুল মনসুর আহমদ মাওলানা আকরম খাঁর জীবনব্যাপী সাধনার মূল্যায়ন করতে গিয়ে বলেছিলেন,
“বস্তুত মাওলানা আকরম খাঁর জীবন ইতিহাস মুসলিম বাংলা, তথা মুসলিম ভারতের সামগ্রিক পুনর্জাগরণের পরিপূর্ণ রেনেসাঁরই ইতিহাস।”
সাংবাদিকতা থেকে রাজনীতি, সাহিত্য থেকে ইতিহাস প্রতিটি ময়দানেই বাংলার মুসলমানদের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক আজাদীর সন্ধান চষে বেড়িয়েছেন তিনি। তিনি যে একালে বাংলার মুসলমানদের সাংস্কৃতিক উজ্জীবনের অন্যতম তূর্যবাদক ছিলেন, এ কথা নিঃসন্দেহেই বলা যায়।
তাঁর জীবনব্যাপী কর্মসাধনায় আমরা তিনটি মৌলিক অবদান চিহ্নিত করতে পারি–
- সাংবাদিকতায় অবদান
- রাজনীতির ময়দানে অবদান
- বুদ্ধিবৃত্তিক অবদান
সাংবাদিকতায় অবদান:
শতাব্দীকালব্যাপী বিস্তৃত বর্ণাঢ্য জীবনে মাওলানা আকরম খাঁ সবচেয়ে বেশি অবদান রেখেছিলেন সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে। মুসলমানদের রাজনৈতিক পতনের পর শিক্ষাব্যবস্থার ভাষা পরিবর্তন, শিক্ষাক্রম পরিবর্তনসহ ব্রিটিশদের ক্রমাগত বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণের ফলে মুসলমানদের পরিসর সংকুচিত হয়ে আসে। বিশেষত বুদ্ধিবৃত্তিক পরিসরে প্রতিনিধিত্বকারী ব্যক্তিত্বের সংকটের ফলে মুসলমানদের দাবি-দাওয়া তুলে ধরবে বা হৃদয়ের চাওয়ার প্রতিনিধিত্ব করবে এমন মাধ্যম বা সুযোগ খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। ইংরেজিকে প্রশাসনিক ভাষা হিসেবে নির্বাচিত করার ফলে বহু বছর ধরে সমৃদ্ধ ঐতিহ্যবাহী মুসলমানী ভাষাগুলো, তথা বাংলা, ফারসি, উর্দুর মতো ভাষাগুলো অচ্ছ্যুৎ বিষয়ে পরিণত হয়। এ নানামুখী চাপে মুসলমানরা একেবারেই কোণঠাসা হয়ে পড়ে।
এমন সময়ে নিজ উদ্যোগে “মাসিক মোহাম্মদী”র মতো পত্রিকা ছাপানো কওমের প্রতি মাওলানার আকরাম খাঁর অকৃত্রিম ভালোবাসারই বহিঃপ্রকাশ। মাত্র ৫১ টাকা আর মুসলমানদের মুক্তির প্রতি দায়বদ্ধতাকে পুঁজি করে তিনি সাংবাদিকতা ও প্রকাশনার ক্ষেত্রে কত অগ্নিসেতু পাড়ি দিয়েছেন, তা লিখলে এক সুবিশাল উপাখ্যান হয়ে যাবে। মাসিক মোহাম্মদীর পরে জামানা, আজাদ, সেবক, সাপ্তাহিক কমরেডের মতো পত্রিকাগুলো তাঁর উদ্যোগেরই ফসল। পাশাপাশি আবুল মনসুর আহমদ, আবুল কালাম শামসুদ্দীন, কাজী নজরুল ইসলাম থেকে শুরু করে তৎকালীন বাংলার সকল বিদগ্ধ তরুণ-পণ্ডিতের লেখা একত্রিত করে এ পত্রিকাগুলোকে মুসলমানদের হৃদয়ের আওয়াজের প্রতিনিধিত্বকারীর পর্যায়ে উন্নীত করা তাঁরই কৃতিত্ব।
একটি পত্রিকা নিয়মিত প্রকাশ করে যাওয়া কতটা দুঃসাধ্য তা বর্তমানেও অনুভূত হয়, অথচ ১৯০৩ সালে স্বল্প টাকা পুঁজি করে তাঁর উদ্যোগ গ্রহণ, অতঃপর সুদীর্ঘকালব্যাপী তা পরিচালনা করা এবং মাসিক মোহাম্মদীর পরে ক্রমাগত জামানা, আজাদ, সেবক, কমরেডের মতো পত্রিকার প্রকাশ তাঁর বৈদগ্ধ্য ও দূরদৃষ্টিরই সাক্ষ্য দেয়।
রাজনীতির ময়দানে অবদান:
সময়ের প্রয়োজনে এক সময় হিন্দু-মুসলিম সকলেই একই প্লাটফর্মে রাজনীতির কথা ভেবে কংগ্রেসে যোগদান করলেও অল্পকাল পরেই মাওলানা আকরম খাঁর সামনে কংগ্রেসের দ্বিচারিতা ও দ্বিমুখী চরিত্র স্পষ্ট হয়ে ফুটে ওঠে। এরপর তিনি তাঁর রাজনৈতিক ভিশনই বদলে ফেলেন। পরবর্তীতে তিনি যেখানেই রাজনীতি করেন না কেন, তাঁর রাজনীতির মূল লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায় মজলুমের অধিকার আদায় ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। মুসলিম লীগসহ যে সকল অঙ্গনেই তিনি রাজনৈতিক প্রয়োজনে গিয়েছেন, এক মুহুর্তের জন্যও তাঁর মূল ভিশন থেকে বিচ্যুত হননি।
বুদ্ধিবৃত্তিক অবদান:
জরাগ্রস্ত ও স্থবির মুসলিম মানসকে পুনরায় উদ্ভাবনী ও সৃজনশীল চেতনায় স্বকীয় করে তুলতে মাওলানা আকরম খাঁ তাঁর শতাব্দীকাল ব্যাপ্ত জীবনে অবিরাম লিখে গিয়েছেন। তাঁর দীর্ঘ জীবনকালের প্রতিটি মুহুর্তই তিনি ব্যয় করেছেন বাঙ্গালী মুসলমানদের পুনর্জাগরণের স্বার্থে। তাঁর প্রজ্ঞাসমৃদ্ধ লেখনী বাঙ্গালী মুসলমানদের জাগরণের অন্যতম প্রধান উদ্দীপক হয়েছিলো এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই।
মাওলানা আকরম খাঁর সাহিত্য কর্মের মধ্যে রয়েছে–
১. সমস্যা ও সমাধান। এটি মূলত তাঁর প্রবন্ধ গ্রন্থ।
২. আমপারার বাংলা অনুবাদ। পরবর্তীতে তিনি সম্পূর্ণ কোরআনের বাংলা অনুবাদও সম্পন্ন করেন।
৩. মোস্তফা-চরিত। এটি তাঁর ম্যাগনাম-ওপাস। এ গ্রন্থ শুধুমাত্র রাসূলের (স.) জীবনের গতানুগতিক বর্ণনা নয়। তাঁর মনে হয়েছিলো, পতনকালীন সময়ে এসে মুসলমানদের হীনম্মন্যতার আরেকটি বড় কারণ হলো তারা এর বাস্তবিক সমাধানের পরিবর্তে কাল্পনিক সমাধান অন্বেষণে ব্যস্ত হয়ে গিয়েছে। এ কারণে তাদের মধ্যে প্রচুর কুসংস্কার, কাল্পনিকতা প্রবেশ করেছে যা তাদের অগ্রসরতার পথে শক্ত প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে। ফলে মুসলমানরা রাসূল (স.) এর মানবিক চরিত্রকে হারিয়ে ফেলে তাকে এমন একটা পর্যায়ে উন্নীত করেছে, যার অনুসরণ অসম্ভব ও দুঃসাধ্য। রাসূল (স.) এর এ ধরনের অতিপ্রাকৃত চিত্রায়ন তাঁর সুমহান মানবিক আদর্শগুলোকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে, যার ফলশ্রুতিতে তাঁকে অনুসরণ করা আমাদের জন্য অবাস্তব বলে প্রতীয়মান হয়ে ওঠে। মাওলানা আকরম খাঁ তাঁর এ গ্রন্থে রাসূল (স.) এর জীবনীকে যুক্তির ভাষায় তুলে ধরার ক্ষেত্রে প্রয়াসী হয়েছেন।
৪. বাইবেলের নির্দেশ ও প্রচলিত খ্রীষ্টান ধর্ম। খ্রিস্টানদের ধর্মগ্রন্থের বিকৃতি, পরিবর্তন ও পরিবর্ধনের ফলশ্রুতিতে কীভাবে খ্রিস্টান ধর্মের মূল সারবত্তা হারিয়ে গিয়েছে, কীভাবে খ্রিস্টান ধর্ম তার মূলধারা থেকে বিচ্যুত হয়ে গিয়েছে তা এ গ্রন্থের মূল প্রতিপাদ্য।
৫. মোছলেম বঙ্গের সামাজিক ইতিহাস। এটি মাওলানা আকরাম খাঁর অন্যতম সেরা কাজ। বাংলার মুসলমানদের সামাজিক ইতিহাসের পাশাপাশি এটি একটি মূল্যবান সমাজতাত্ত্বিক গবেষণাও। পরবর্তীতে এ বিষয়ে যতগুলো বই-ই রচিত হয়েছে, এ বইটি সবগুলো বইয়ের পূর্বসুরী হিসেবে কাজ করেছে।
৬. তাফসীরুল কোরআন (১-৫ খন্ড)। এটি মাওলানা আকরম খাঁর সুবৃহৎ কাজ যা যৌক্তিক ও সামগ্রিক পন্থায় কোরআনের ব্যাখ্যা সংক্রান্ত।
কীভাবে এক শতাব্দীকালব্যাপী নিজ জাতির জন্য নিজেকে বিলিয়ে দিতে হয়, প্রতিদানের আশা না করে নিজের জীবন উৎসর্গ করতে হয় তার সার্থক প্রতিরূপ বাঙ্গালী মুসলমানদের তামাদ্দুনিক আজাদীর তূর্যবাদক মাওলানা আকরম খাঁ।