কার্লমার্কস ঊনবিংশ শতকের (১৮১৮-১৮৮৩) একজন মস্তবড় দার্শনিক চিন্তানায়ক। বর্তমান দুনিয়ার চিন্তাদর্শন, অর্থনীতি, সমাজনীতি, শিক্ষা, সভ্যতা ও সংস্কৃতি এবং রাষ্ট্রদর্শনের ওপর তাঁর চিন্তাধারার প্রভাব অত্যন্ত বেশি। কিছুটা সচেতনভাবে আর কিছুটা অচেতনভাবে আজকের মানুষ তার চিন্তাদর্শন দ্বারা প্রভাবান্বিত। মার্কস মানব জীবনের প্রায় সর্ব দিক সম্পর্কে দার্শনিক তত্ত্বমূলক ও বাস্তুব কর্ম সম্পর্কিত চিন্তাধারা পেশ করেছেন। তার এই চিন্তাধারার সমষ্টিরই নাম হলো মার্কসবাদ এবং তার দর্শনকেই বলা হয় মার্কসীয় দর্শন। কার্লমার্কস তার সমস্ত দার্শনিক মতবাদ গড়ে তুলেছেন- তার পূর্ববর্তী দার্শনিক চিন্তাবিদদের চিন্তাধারা ও মতবাদকে ভিত্তি করে। তবে তিনি সবচেয়ে বেশি প্রভাবান্বিত হয়েছেন উপাদান গ্রহণ করেছেন G WE Hegel এর চিন্তা ও মতবাদ থেকে। এক কথায় বলা চলে, হেগেলের কাছ থেকে মূল প্রেরণা নিয়েই মার্কস তার নিজের দর্শন গড়ে তুলেছেন। মার্কসের ওপর অপর কোনো দার্শনিকের কোনো প্রভাব পড়েনি, একথা বলা হচ্ছে না। তার ওপর সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়েছে হেগেলীয় দর্শনের এটাই বক্তব্য, অতএব মার্কসীয় দর্শনের আগে হেগেলীয় দর্শনের আলোচনা আবশ্যক। 

ডায়ালেকটিক বাদ

হেগেলের দর্শনকে এক কথায় বলা যায় Philosophy of Opposites বিপরীত জিনিসমূহের দর্শন’। মানবীয় চিন্তা-গবেষণার শুরু থেকেই একথা সর্ববাদী সমর্থিত যে, প্রতিটি জিনিসই তার বিপরীত দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। প্রত্যেক অস্তিত্বের জন্য অস্তিত্বহীনতা, স্থিতির জন্য ধ্বংস অবধারিত দুঃখ কষ্টই যদি না হলো তবে আনন্দ ও সন্তোষের ফুল কখনো প্রস্ফুটিত হতে পারে না। ক্লান্তি না আসলে বিশ্রাম কিসের? যেখানের ফুল ফুটেছে, তার পাশেই দাঁড়িয়ে রয়েছে কাটা। এই সবই স্বাভাবিক ব্যাপার, সকলেরই জানা কথা এবং সকলেই এর সত্যতা অনুভব করতে পারে।

কিন্তু এর ভিত্তিতে স্বতন্ত্র ও সম্পূর্ণ এক চিন্তা পদ্ধতি গড়ে তোলা, সে এক সম্পূর্ণ ভিন্ন কাজ। দার্শনিক হেগেল এ সত্যকেই এক ব্যাপক ও পরিপূর্ণ দর্শন হিসেবে পেশ করেছেন। এর ভিত্তিতে দাঁড় করিয়েছেন এক নবতর দার্শনিক মত। ফলে ধারণা ও চিন্তা কল্পনার ক্ষেত্রে এক আলোড়নের সৃষ্টি হয়েছে। মানুষের কর্মজীবনের চিন্তাধারার ক্ষেত্রে এর এক সিদ্ধান্তমূলক প্রভাব পড়েছে। হেগেল বলেছেন, “প্রতিটি জিনিস তার বিপরীত জিনিসের দ্বারা কেবল কায়েমই নয়, দুনিয়ায় আজ পর্যন্ত যা কিছু উন্নতি ও উৎকর্ষ সাধিত হয়েছে, ইতিহাসের ক্ষেত্রে মানবতা যতটুকু অগ্রসর হতে পেয়েছে, তার সব কিছুরই মূল কারণ হচ্ছে পরস্পর বিপরীত জিনিসগুলোর দ্বন্দ্ব ও সংঘর্ষ।” প্রত্যেকটি ধারণা বা বিশ্বাস যখন একটি বিশেষ সীমা পর্যন্ত এগিয়ে যায়, তখনি তার মাঝ থেকে তার বিপরীত ধারণার সৃষ্টি হয় এবং দুটোর পারস্পরিক দ্বন্দ্বের ফলে এক নবতর ধারণা বা বিশ্বাস অস্তিত্ব লাভ করে। অন্য কথায় বলা যায়, মানুষ যখন কোনো ধারণা সম্পর্কে পূর্ণ চিন্তা ও গবেষণা করে এবং ‘লজিকের’ দিক দিয়ে তাকে পূর্ণ পরিণত করে নেয়, তখনি এমন এক অবস্থা সম্মুখে আসে, যখন সে অনুভব করে যে, যে ধারণা থেকে সে যাত্রা শুরু করেছিল তা এখন আর বর্তমান নেই। সেখানে এমন এক নতুন ধারণা এসে স্থান দখল করেছে, যা পূর্বের ধারণার সম্পূর্ণ বিপরীত। হেগেল এর দৃষ্টান্ত নিয়েছেন এই ভাবে যে, গরীবদের সাহায্য করা, দান-খয়রাত করা সকল সামর্থ্যবান ব্যক্তিরই কর্তব্য। একথাটি সাধারণ নৈতিক শিক্ষা হিসেবে সব ধর্মেই স্বীকৃত। এখন যদি এ কথানুযায়ী সকলেই দান-খয়রাত উদার হস্তে করতে থাকে, তাহলে সেখানে গরীব থাকবে না। এতে করে গরীবকে সাহায্য দেয়া কর্তব্য- এ ধারণাটি নিজেই চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে বাতিল হয়ে যাবে।কেননা যখন গরীবই কেউ থাকবে না, তখন আর তাদের সাহায্য করার কোনো কাজই থাকতে পারে না।

মায়ের স্নেহ সন্তানের জন্য অপরিহার্য। তা নাহলে সন্তানের ব্যক্তিত্ব ও জীবন অসম্পূর্ণ থেকে যায়। কিন্তু মা যদি সন্তানকে স্নেহ করতে গিয়ে তার যে কোনো আবদার মেনে নেয়, তাহলে সন্তানের চরিত্র ও ব্যক্তিত্ব নষ্ট হবার সম্ভাবনা থাকে। ফলে মায়ের স্নেহ এক সীমা পর্যন্ত পৌঁছে গিয়ে ভয়ের উদ্রেক হতে থাকে। অর্থাৎ নিজেই চরম পর্যায়ে পৌঁছে তার বিপরীত ভয় সৃষ্টি করবে। হেগেলের মতে এর কারণ হচ্ছে এই যে, প্রতিটি ধারণাই সীমাবদ্ধ অসম্পূর্ণ। এ কারণেই তা থেকে তার বিপরীত জিনিসের সৃষ্টি হয়। তার ফলে প্রথমটির অস্তিত্ব মুছে যায়। এর পরে নতুন ধারণার সৃষ্টি; তা পূর্বতন ধারণার সবগুলো দিককেই বাতিল করে না, বাতিল করে দুর্বল ও অসম্পূর্ণ দিকগুলোকে। তারপরে যেহেতু বাতিলকৃত ধারণার সম্পর্কেই পরবর্তী ধারণা নির্দিষ্ট হয়, এই জন্য তাতে পরবর্তী ধারণার স্মৃতি জামা থেকে যায়। আর এটি হয় পূর্বতন ধারণার তুলনায় অধিক প্রশস্ত। এই কারণে বিপরীতধর্মী ধারণাসমূহের সংযোজনায় এক নবতর Unit সৃষ্টি হয়, যা পূর্বের ধারণা দুটো অপেক্ষা অনেকখানি প্রশস্ত হয়ে থাকে। কিন্তু এই নতুন প্রশস্ততর ধারণাও বাতিল হওয়ার সময় আসে, এই প্রশস্ততর ধারণারও বিপরীত ধারণার জন্ম হয়। আর এরূপ অব্যাহত ভাবেই চলতে থাকে ধারণার পর ধারণা সৃষ্টির কাজ। ক্রমবিকাশের এই কর্মধারাকে হেগেল নাম দিয়েছেন Dialectical Process বা দ্বান্দ্বিক পদ্ধতি। তার মতে যুগ ও সময়ের ময়দানে এরূপ ভাঙাগড়া অব্যাহত ভাবে চলছে। প্রথমে একটি দাবি সামনে আসে, একে বলা হয় Thesis। তার পরেই তার বিপরীত দাবি মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে. একে বলা হয় Antitshesis। তারপরে এক দীর্ঘকালীন দ্বন্দ্বের পর এ দুইয়ের মাঝখানে এক সমঝোতার সৃষ্টির হয় অর্থাৎ প্রথম দাবিরও কিছু কথা মেনে নেয়া হয়, পরবর্তী বিপরীত দাবিরও কিছু কথা তার সঙ্গে স্বীকৃত হয়। এই দুইয়ের সংযোজনায় সৃষ্টি হয় তৃতীয় এক দাবি, যাকে বলে Synthesis; পরে এই সিনথিসিই একটি দাবি হয়ে দাঁড়ায়। তারপরে তার বিপরীত দাবিও উঠতে থাকে।

হেগেলের মতে এই দ্বান্দ্বিক পদ্ধতি হচ্ছে এক সর্বাত্মক সামগ্রিক সামাজিক কর্মধারা। ইতিহাসের একটি অধ্যায়ের গোটা মানবীয় সভ্যতা যেমন একটি পূর্ণাঙ্গ মানব দেহ-এক জীবন্ত সত্তা। ব্যক্তি ও দলসমূহ যেন এই দেহের অংশ ও অঙ্গ, হেগেলের মতে এই দ্বান্দ্বিক পদ্ধতি থেকে দুনিয়ার কোনো কিছুই কোনো নাম করা ব্যক্তিই নিষ্কৃিতি পেতে পারে না। এবং এরা যেন সব দাবার গুটি। মানব সভ্যতা ও সমাজের আসল জিনিস হচ্ছে World reason, World spirit, Absolute Spirit.

মার্কসবাদ ও ডায়ালেকটিকবাদ

মার্কসীয় দর্শনের মূল কথা হচ্ছে এই ডায়ালেকটিক পদ্ধতি Dialectic Principles. ডায়ালেকটিক কথাটি গ্রীক দর্শন থেকে গৃহীত, গ্রীক ভাষায় শুরুতে এ শব্দের অর্থ ছিল কথাবার্তা-পরবর্তীকালে বিতর্ক ও আলোচনার এক বিশেষ টেকনিকরূপে পরিচিত হয় ডায়ালেকটিক পদ্ধতি। এই পদ্ধতি চিন্তার দুটো অংশের সমন্বয়ে গড়ে ওঠে। তার একটিকেও বাদ দিলে এই গোটা পদ্ধতিই অর্থহীন হয়ে যায়। অংশ দুটোর অর্থ হচ্ছে এই যে, সৃষ্টি জগতের মৌলিক ও প্রকৃত সত্য বাইরের জিনিস নয়; বরং চিন্তা ও বিশ্বাসই হচ্ছে মূল। আর দ্বিতীয় এই যে, এই ধারণা বিশ্বাসগুলো স্থবির ও নিশ্চল নয়, বরং প্রবাহমান, গতিশীল, অব্যাহত ধারায় তা বয়ে চলে এবং প্রবাহিত হয়েই ক্রমবিকাশের বিভিন্ন স্তর ও পর্যায়ে অতিক্রম করে অগ্রসর হয়ে যায়। প্লেটোও এ কথা স্বীকার করতেন। তবে পার্থক্য এই যে, প্লেটো চিন্তা ও বিশ্বাসগুলোকে অপরিবর্তনশীল ও নিস্পন্দ বলে মনে করেছেন। এবং বলেছেন যে, দ্বান্দ্বিক পদ্ধতিতেই এগুলো লাভ করা যেতে পারে অর্থাৎ এমন উপায়ে, যাতে বিপরীত চিন্তাকে প্রথমে মেনে নেয়া হবে, তারপরে তার প্রতিবাদ করা হবে এবং শেষ পর্যন্ত তার মাঝে সামঞ্জস্য ও ঐক্য সৃষ্টি করা হবে।

হেগেল এর বিপরীত মত পোষণ করেন। তিনি বলেছেন যে, ধারণা বিশ্বাসগুলো নিজেরাই এই তিন পর্যায়ের কাজ অর্থাৎ প্রমাণ, প্রতিবাদ ও সামঞ্জস্য বিধান সম্পন্ন করেছে। অন্য কথায়, নিখিল সৃষ্টিলোকের সমগ্র সত্য মূলত এক ঐকিক ধারণার স্বল্পমূলক বিতর্কের প্রতিচ্ছায়া। যাতে এই ধারণা তার বিভিন্ন ও বিপরীত দিকসমূহকে প্রকাশ করে এবং কেবল বিশেষ কোনো সত্যই নয়, সমগ্র সৃষ্টিলোক এক ব্যাপক ধারণা বিশেষ যা তার বিপরীতগুলোর প্রমাণ করে আর করে তার প্রতিবাদ। এবং শেষ পর্যন্ত সেগুলোর মাঝে সামঞ্জস্য সৃষ্টি করে এক উচ্চতর ইউনিট কায়েম করে। এভাবে এই ধারণা ক্রমশঃ স্বীয় অভ্যন্তরকে বিকশিত করে তোলে। বিশ্ব জগতে সে খোদায়ী মন’ (Divine mind) Logical Necessity অনুযায়ী ক্রমবিকাশের স্তর অতিক্রম করে দ্বান্দ্বিক পদ্ধতিতে স্বীয় পূর্ণতা বিধান করছে। হেগেলের আবিষ্কৃত চিন্তার দ্বান্দ্বিক পদ্ধতি যেন চিরন্তন জিনিস-অনন্তকাল থেকেই তা কায়েম রয়েছে। আর কাল ও স্থানের বুকে বস্তুজগত হচ্ছে এই চিন্তা পদ্ধতির বাহ্যিক অভিব্যক্তি-বহির্বিকাশ।

ফয়েরবাখ্, মার্কস ও এঞ্জেলস-এর সম্পূর্ণ বিপরীত মত পোষণ করেন। তার মতে প্রাকৃতিক জগতে এই নীতি ও পদ্ধতি পূর্ব থেকেই কার্যকর হয়ে আছে, চিন্তা জগতে এর কার্যক্রম শুরু হয়েছে পরে। মার্কস একথাও বলেছেন যে, মানবীয় চিন্তা মূলত বস্তু জগতেই প্রতিবিম্বিত এবং তা-ই মানব মনের দর্পণে প্রতিফলিত হয় এবং তার হাড়ের সঙ্গে মিলে-মিশে যায়। এজ্ঞেলসতো হেগেলের দ্বান্দ্বিক পদ্ধতি সম্পর্কে এ মত প্রকাশ করেছেন যে, মূলতঃ তা থেকে বস্তুর বৈশিষ্ট্য বিশেষত্ব এবং তার গতির নিয়ম-কানুন প্রকাশিত হয়, চিন্তার নিয়ম-পদ্ধতি তা থেকে উদ্ভাবিত হয় গৌণতঃ। তার দাবি হচ্ছে হেগেল চিন্তা জগতের জন্য যে পদ্ধতি রচনা করেছেন, তা বস্তুর অবস্থা ও বাস্তব ঘটনাবলীর ওপরও প্রযোজ্য হতে পারে। তা সমাজ বিজ্ঞানই হোক আর সামাজিক জীবনযাপন সম্পর্কিত জ্ঞানই হোক। অথবা তা জীব বিজ্ঞান সম্পর্কিত জ্ঞানই হোক কিংবা তা প্রকৃতি বিজ্ঞান আর ভূগোল বিজ্ঞানই ভূগোল-বিজ্ঞানই হোকনা কেন।

মার্কসবাদ ও বস্তুবাদ

মার্কসবাদের দাবি হচ্ছে এই যে, মানবীয় মন (Human Mind) বস্তুর উদ্ভাবিত – এর বিপরীত নয়। হেগেলীয় দর্শনে ধারণা, চিন্তা ও বিশ্বাসকে বিশ্ব জাহানের মৌলিক সত্য বলে অভিহিত করা হয়েছে। এর সম্পূর্ণ বিপরীত মার্কসীয় মতবাদ হচ্ছে প্রকৃত ও মৌলিক সত্তা কেবল বস্তুরই রয়েছে। মানুষের মন, তার চেতনা, তার ধারণা-বিশ্বাস সব কিছুই প্রকৃত পক্ষে বস্তুর উদ্ভাবন মাত্র। Engeles বলেছেন: “Matter is not aproduct of mind but itself is merely the highest product of matter.”

লেনিন লিখেছেন : “Natural science positively asserts that the earth once existed in a state in which woman or any other living creative existed or could have existed… Hence matters primery and mind, consciousness, sensation are product of a very high development.”

মার্কসবাদের দৃষ্টিতে প্রকৃতি বা বস্তু চিরন্তন, মন ও চেতনা গৌণ। বস্তই জীবনের রূপ পরিগ্রহ করছে। জীবন থেকেই চেতনা জেগেছে এবং এ চেতনা থেকেই মনের সভা গড়ে উঠেছে। মার্কস এজন্য প্রমাণ হিসেবে ভূ-বিজ্ঞানের Goology নবতর আবিষ্কারের কথা পেশ করেছেন। বলেছেন এ থেকে এ কথা প্রমাণিত হয়েছে যে, গোটা ভূমণ্ডল মানুষের পূর্বেই অস্তিত্ব লাভ করেছে। (ফসিল সম্পর্কিত গবেষণা ও আধুনিক আবিষ্কারসমূহ তারা পেশ করেন এর প্রমাণ হিসেবে)

মার্কসবাদ ও ক্রমবিকাশবাদ (Theory of Evolution)

মার্কসবাদ ডারউইন এবং তাঁর অনুসারীদের রচিত ক্রমবিকাশ থিওরীকে সমর্থন করেছে, সত্য বলে মেনে নিয়েছে। দুনিয়ার ঘটনাবলীর ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণের জন্য এই থিওরীকে ব্যবহার করেছে। তবে এতদুভয়ের একটি জায়গায় কিছুটা মতবিরোধ রয়েছে ডারউইন এবং তাঁর মতাবলম্বী বিজ্ঞানীদের দাবি হচ্ছে :  প্রকৃতির বুকে ক্রমবিকাশমান পরিবর্তন সূচিত হয় এবং প্রকৃতির ধারাবাহিকতা কোথাও ব্যাহত হচ্ছে না। প্রকৃতির বুকে কখনও কোনো আকস্মিক পরিবর্তন সংঘটিত হয় না। মার্কসবাদ একথা স্বীকার করেনি। তার মতে, প্রকৃতির ধারাবাহিকতা কখনও ব্যাহত হতে পারে। কখনও কখনও প্রকৃতির ঘটনাবলীর ধারাবাহিকতা পরিহার করে লাফ দিয়ে বহুদূরে এগিয়ে যায় এবং পূর্ব থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন রূপের একটি জিনিসকে সৃষ্টি করে। অর্থাৎ মার্কসীয় দর্শনে ক্রমবিকাশ (Theory of Evolution) Envergence Theory এর অনুরূপ। অর্থাৎ মানবজগৎ ও প্রাকৃতিক জগতে এখন নতুন নতুন গুণ বৈশিষ্ট্য প্রমাণিত হয়ে পড়ে, যা সম্পূর্ণ অভাবিতপূর্ব। পূর্ববর্তী অবস্থার সঙ্গে এ গুণ বৈশিষ্ট্যগুলোর কি বাহ্যতঃ কোনো সামঞ্জস্য খুঁজে পাওয়া যায় না? যেমন-দুরকমের রঙ মিলে এক নবতর রঙ সৃষ্টি করে। এ রঙ মৌলিক উপাদানের দিক দিয়ে সম্পূর্ণ আলাদা ধরণের। অথবা হাইড্রোজেন ও অক্সিজেনের মাত্রানুজনিক সংমিশ্রণে পানির সৃষ্টি হয়। এই পানিতে তার মৌলিক উপাদান থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন রকমের বৈশিষ্ট্য ও গুণ থাকে। হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন সম্পর্কে গবেষণা করে একথা কেউ বলতে পারে না যে, এ থেকে পানির মত কোনো জিনিস তৈরি হতে পারে। কেননা পানির বৈশিষ্ট্যের সাথে হাইড্রোজেন ও অক্সিজেনের বৈশিষ্ট্যের কোনো মিল নেই। মার্কসবাদে মানবীয় মন ও চেতনার বিশ্লেষণ ঠিক এমনিভাবে হয়ে থাকে। অর্থাৎ দেহের অংশসমূহের সংযোজক এক উন্নততর জিনিস অস্তিত্ব লাভ করল, যা সম্পূর্ণতঃ নতুন অভিনযব এবং এর মৌলিক উপাদানগুলো সম্পর্কে চিন্তা-গবেষণা করে এ সম্পর্কে কেউ ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারে না।

 

মার্কসীয় দর্শনে প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক নিয়ম (Nature and Natural Laws)

চিন্তা এবং চেতনা সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে এঞ্জেলস তাঁর Anti During গ্রন্থে লিখেছেন “But if the further question is rise. What then are thought and consciousness and whence they come it becomes apparent that they are products of the human brain and that man himself is the product of nature: Which has been developed in and along with environment whence it is self evident that the products of the human brain being in the last analysis also products of nature do not contradict the rest of nature but are in correspondence with it.”

এখানে এঞ্জেলস স্বীকার করেছেন যে, মানুষের চিন্তা ও চেতনা সবকিছুই মানুষের মস্তিষ্কের কাজ, আর মানুষ তার গোটা দেহসত্তা ও মস্তিষ্ক সহ স্বয়ং প্রকৃতির উৎপাদন। এবং মানুষের পরিবেশের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে তা অস্তিত্বলাভ করেছে। এখানে প্রকৃতিকে বস্তু ও বস্তুনিষ্ঠ পদ্ধতির সমান পর্যায়ে দাঁড় করানো হয়েছে। মার্কসবাদ কোনো উচ্চতর ইচ্ছাশক্তি বা উদ্দেশ্য সম্পন্ন কোনো বুদ্ধি বছর উর্ধ্বে থাকতে পারে বলে স্বীকার করে না। Historical Materialism গ্রন্থে লেখা রয়েছে “The entire natural world is governed by law absolutely excludes the intervention of action from outside. আর এক জায়গায়  “But now a days in our evolutionary conception of the universe there is absolutely no room for either a creator or ruler and to take of a supreme being shut us from the whole existing world implies a contradiction in terms.

লেনিন তাঁর এক চিঠিতে লিখেছেন ‘খোদার সত্তা অত্যন্ত দুরূহ ও জটিল চিন্তা কল্পনার ফল, প্রাকৃতিক নিয়ম বিধান সম্পর্কে অনবহিতই তা সৃষ্টি হয়েছে। মোট কথা, মার্কসবাদ একটি Purposive Regulating Intelligence স্বীকার করে বটে; কিন্তু বস্তুজগতের বাইরে তার অবস্থানকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করে। অর্থাৎ মার্কসবাদ খোলা-বিশ্বাসের কথাটিকে অতটা অস্বীকার করছেনা, যতটা অস্বীকার করছে খোদার সৃষ্টিলোক বহির্ভূত এক সত্তা হওয়ার কথাটিকে। অন্যথায় মার্কসবাদ বস্তুর অন্তর্নিহিত শক্তিকেই সর্ব শক্তিমান সত্তারূপে মেনে নিচ্ছে। মার্কসবাদের খোদা বস্তুর বা জুড়ে অন্তর্নিহিত জিনিস, তার বাইরের নয়।

মার্কসবাদ ও নৈতিকতা (Theory of Morality) 

কাল মার্কস লিখেছেন:

“The mode of production in material life determines the social political and intellectual life process in general.

 অর্থাৎ মার্কসের মতে মানবীয় নৈতিকতা উৎপাদনের ধরণ ও পদ্ধতির দ্বারা নির্ণিত ও বিধিবন্ধ হয়। অন্যকথায় নৈতিকতার ব্যাপারে মানুষের ইচ্ছার কোনো দখল নেই। কেননা মানুষ এ সব কিছুই পূর্ব থেকে তৈরিকৃত হিসেবে লাভ করেছে। মার্কসের এই নৈতিকতা থিওরির সমর্থনে এঞ্জেলসও কথা

বলেছেন। তিনি তার Anti during লিখেছেন

 “We maintain on the contrary that all former moral theories are the products in the last analaysiss of the economic stage which society had reached at that particular eproch, and as society has hither to moved in class antagonistic morality it has either justified the domination and interests of the ruling class or as soon as oppressed class has become powerful enough it has represented the revolt against this domination and the future interests of oppressed.

মার্কসবাদ ও ধর্ম

এঞ্জেলস তার Anti during গ্রন্থে লিখেছেন All religion however is nothing but the fanatic reflection in men’s minds of these external forces which control their daily life, a reflection in which the terrestrial forces assume the form of supernatural forces অর্থাৎ ধর্মকে মনে করা হচ্ছে শুধুমাত্র বাহ্যিক প্রতিকূল অবস্থা সমূহের প্রতিবিম্ব। এর নিজস্ব কোনো যৌক্তিকতা বা মৌলিকতা যেমন নেই, তেমনি নেই এর কোনো স্থায়িত্ব। মার্কসের ভাষায় ধর্ম হচ্ছে ‘Oplain of the people-Lenin on religion’ গ্রন্থের ২১ পৃষ্ঠায় লেখা আছে ‘মার্কসবাদের অপর নাম হচ্ছে বস্তুবাদী। এজন্য তা ধর্মের তেমনি দুশমন যতখানি দুশমন অষ্টাদশ শতকের সাধারণ বস্তুবাদ বা ফয়েরবাখের বক্তবাদ। কিন্তু মার্কস ও এঙ্গেলসের ডায়ালেকটিক বস্তুবাদ ফয়েরবাখ ও অষ্টাদশ শতকের অপরাপর বস্তুবাদীদের থেকেও অগ্রসর। এতে বস্তুবাদী দর্শনকে ইতিহাস ও সমাজবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়েছে।

মার্কসবাদ ও চিরস্থায়ী সত্য (Eternal Truths)

মার্কসবাদ কোন চিরস্থায়ী সত্য বিশ্বাস করে না। কেননা মার্কসবাদের দৃষ্টিতে ইতিহাস প্রকৃতির পরিবর্তন বিবর্তন, ক্রমবিকাশ ও ক্রয় উন্নতির অসংখ্য নিদর্শন ও পর্যবেক্ষণে ভরপুর। এই কারণে এক্ষেত্রে কোনো স্থায়ী সত্য স্থান লাভ করতে পারে না। কমিউনিস্ট মেনিফেস্টোতে বলা হয়েছে। Communism repudiates eternal truth and morality instead of refashioning them. এঞ্জেলস লেখেছেন: মানবীয় চিন্তার নেতৃত্ব ও নিরংকুশতা স্বতন্ত্র ব্যক্তিসমূহের সীমাবদ্ধ ও অনিরংকুশ চিন্তার ভিত্তিতে স্থাপিত হয়। যে জ্ঞান শর্তহীন অর্থাৎ নিরংকুশ সত্যের ধারক, ভুল-ভ্রান্তি ও পদস্খলনের এক সুদীর্ঘ ধারাবাহিকতার পরই তা ভাল করা যেতে পারে। কিন্তু তা লাভ করার জন্য মানুষের জীবন সীমাহীন ও অশেষ হওয়া দরকার। অন্যথায় মানুষ তার এই সীমাবদ্ধ জীবন দ্বারা সীমাহীন সময়ব্যাপী সুদীর্ঘ সাধনা ও ভুল-ভ্রান্তির অভিজ্ঞতার পর সত্য জ্ঞান-চিরস্থায়ী সত্য লাভ করতে পারে না, তখন আর এখানে চিরস্থায়ী সত্য বলতে কিছু থাকতে পারে না।

মার্কসবাদ ও ওহী

মার্কসবাদের সকল প্রকার জ্ঞানভিত্তিক ধারণা বিশ্বাস লাভের একমাত্র উৎস রূপে গৃহীত হয়েছে মানুষের অভিজ্ঞতা, যা মানুষ লাভ করে বাহ্য জগত থেকে। তাই মানবীয় ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জ্ঞান ব্যতীত অপর কোনো জ্ঞান বা ঊর্ধ্বজগতের কোনো প্রকৃত জ্ঞানকে সমর্থন করে না। অধ্যাপক দাসগুপ্ত তাঁর Materialism. Determinism and Dialectics নামক গ্রন্থে লিখেছেন: “জ্ঞানের সমস্ত তথ্য বস্তু জগতের অভিজ্ঞতার মাধ্যমেই আমরা লাভ করে থাকি। বিভিন্ন অভিজ্ঞতার পারস্পরিক কার্যক্রমের সাহায্যে নবতর চিন্তা ও ধারণা লাভ করতে পারি। আমাদের বাহ্য জগত থেকে শত জ্ঞানের সাথে তার সম্পর্ক আমরা না-ও জানতে পারি। কিন্তু এই চিন্তা ও ধারণা সমূহের গভীর তলদেশে যদি পৌঁছাতে চেষ্টা করা হয় তাহলে জানা যাবে যে, আমাদের পূর্বতন অভিজ্ঞতাসমূহের কোনো না কোনো অভিজ্ঞতাই সে অভিজ্ঞতার উৎস। খোদায়ী ওহী খালেস চিন্তা ও জ্ঞান লাভ করার মাধ্যম হতে পারেনা। কেননা এ নিছক কল্পনা ও কিংবদন্তি ছাড়া আর কিছু নয়।”

ইতিহাসের মার্কসীয় দর্শন

কার্ল মার্কস তাঁর ইতিহাস দর্শন হেগেলীয় দ্বান্দ্বিক পদ্ধতিতে গড়েছেন। হেগেল বলেন, ইতিহাসের ক্রমবিকাশ, ক্রম উন্নতির গতিধারা এবং মানব জীবনের বিপ্লনসমূহ বিপরীত জিনিসমমূহের দ্বন্দের প্রত্যক্ষ ফল। জীবনের কোনো একটি ব্যবস্থা যখন উন্নতি-উৎকর্ষের চরমতম পর্যায়ে উন্নীত হয়, তখন তারই গর্ভ থেকে কতক বিরোধী শক্তি জন্ম নেয় এবং প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থার সাথে দ্বন্ধ করতে শুরু করে দেয়। শেষ পর্যন্ত এই নবতর শক্তি ও পূর্বতন ব্যবস্থার সংমিশ্রণে এক নতুনতম ব্যবস্থা অস্তিত্ব লাভ করে, যাতে পুরানো ব্যবস্থার উত্তম অংশগুলো অবশিষ্ট থেকে যায়-যদিও তাকে অপরাপর অংশ থেকে আলাদা করে দেয়া যায় না। তারপর এই নবতর ব্যবস্থাও যখন একটি পর্যায় বা স্তর পর্যন্ত পৌছে যায় তখন তারই মধ্য থেকে তার বিপরীত জিনিসের উদ্ভব হয় ও তার সাথে লড়াইয়ে লিপ্ত হয়। এই দ্বন্দ্বের ফলে আবার এক ব্যবস্থা গড়ে ওঠে, যা গড়ে ওঠে পূর্ববর্তী ব্যবস্থা ও তার বিপরীতের সংযোজনায়। পুরোনো ব্যবস্থা নির্মূল হয়ে যায়, সেখানে নবতর ব্যবস্থার পর্যায় শুরু হয়। এ ব্যবস্থায় পূর্বতন ব্যবস্থার সারাংশ থেকে যায়। এ ব্যবস্থা পূর্ব ব্যবস্থার তুলনায় অধিকতর প্রশস্ত ও অতিশয় ব্যাপক হয়ে থাকে। এভাবে জীবন হচ্ছে এক নিরবচ্ছিন্ন উন্নতি ও ক্রমবিকাশের ধারাবাহিকতা। তার প্রত্যেকটি নবতর পর্যায় পূর্ববর্তী পর্যায়ের তুলনায় উন্নত হয় এ দৃষ্টিতে যে, তাতে পূর্ববর্তী অধ্যায়সমূহের উচ্চতর বৈশিষ্ট্য-বিশেষত্ব, তার উত্তম অংশগুলো-যা তার যার নির্যাস-যথারীতি সুরক্ষিত থাকে। মানবীয় ক্রমবিকাশের ধারায় Conservation of values মূল্যমানের সংরক্ষণ মার্কা স্বীকার করেন। এ পর্যন্ত মার্কস হেগেলের সাথে একমত। কিন্তু এর পর উভয়ের পথ চিন্তাধারা আলাদা হয়ে যায়। মার্কস হেগেলীয় “ডায়ালেকটিকেল প্রসেসের মূল তরুটুকু তো লুফে নিয়েছেন; কিন্তু তাকে জীবনের ঘটনাবলীর ওপর এমনভাবে প্রযুক্ত করেছেন যে, হেগেলের সময় দর্শন প্রাসাদ ধুলিস্যাৎ হয়ে গেছে। তাই হেগেলীয় ডায়ালেকটিকস ও মার্কসীয় ডায়ালেকটিকস-এ তফাত অনেক। কারণ মার্কস শুধু ডায়ালেকটিসিয়ানই নন, তিনি ডায়ালেকটিভ মেটারিয়ালিস্ট জড়বাদী, বস্তুবাদী ।

হেগেলের দৃষ্টিতে বিপরীত জিনিস সমূহের পারস্পরিক দ্বন্ধ সংগ্রামের ক্ষেত্র ছিল Realm of ideas ‘চিন্তার জগত। জীবনের বাস্তব ক্ষেত্রের সাথে তার কোনো সম্পর্ক নেই থাকলেও শুধু এতটুকু যে, দ্বন্দ্বের ফলে যে পক্ষ জয়ী হয়, বাইরের গোটা পরিবেশ তারই অধীন হয়ে যায়। ফলে মানুষের সমাজ সভ্যতা, জীবন ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পরিবর্তনের আসল কারণ হচ্ছে চিন্তাজগতের বিপ্লব, যা সৃষ্টি হয় ডায়ালেকটিবাদ থেকে। এক কথায় হেগেলের মতে মানবেতিহাসের আসল প্রভাবশালী শক্তি হচ্ছে চিন্তা ও বিশ্বাসের দ্বান্দ্বিক পদ্ধতি, স্বয়ং মানুষের নয়। তার জীবন ও তামাদ্দুনের বহিঃপ্রকাশও নয়।

মার্কস হেগেলের এ দর্শনকে উল্টিয়ে দিয়েছেন, তাঁর মতে ইতিহাসের গতিধারায় উত্থান-পতন ও ভাঙ্গা-গড়ায় আসল জিনিস মানুষের চিন্তা ও বিশ্বাস নয়, আসল হচ্ছে মানুষের বাস্তব ও বাহ্যিক জীবন-Actual world of human affairs, তাঁর মতে মানবীয় ধারণা-বিশ্বাস হচ্ছে বস্তুনিষ্ঠ অর্থনৈতিক পরিবেশের ফল, এদের নিজস্ব ও স্বয়ংসম্পূর্ণ কোনো সত্তা নেই। বিপরীতসমূহের দ্বন্দ্ব চিন্তার জগতে বাস করে না, মানুষের প্রকৃত জীবন ক্ষেত্রেই তা দিনরাত ঘটছে এবং সমাজের অর্থনৈতিক কাঠামোর পরিবর্তনের মাধ্যমে Through change in the economic structure of society কেননা মানুষের চিন্তা ও বিশ্বাস জগতের পরিবর্তন আর তো কিছুই নয়, তা হচ্ছে শুধু Reflection of social and economic changes.

মার্কস তার Contribution to the Critique of political Economy’ গ্রন্থের ভূমিকায় লিখেছেন: The mode of production in material life determine the social political and intellectual life-process- in general- it is not the consciousness of men that determines their beings. but, on the contrary, their social being that determines their consciousness.

 

মার্কসের মতে ইতিহাসের ভিত্তি হচ্ছে বাস্তব। কোনো অলৌকিক শক্তির ইঙ্গিত ইতিহাসের গতি নির্দেশ করে না। ইতিহাসের গতি নির্দেশ করে সমাজের Mode of production. তাই তিনি বলেছেন: The conditions goveming the relation among men are dependent upon the means of production. মানুষে মানুষে যে পরস্পর সম্বন্ধ তা সম্পূর্ণ নির্ভর করে যুগের উৎপাদন প্রধা বা ব্যবস্থার ওপর। তাই When the letter changes, there comes about also a change in the relation among the producers. এ ভাবেই সমাজে উৎপাদকদের মাঝের সম্পর্কও পরিবর্তিত হয় এবং পরিবর্তনের ভিত্তিতেই বিভিন্ন রকমের সমাজ গড়ে ওঠে, সমাজিক জীবন ও সভ্যতার চেহারা রীতিমত বদলে যায়। আরও পরিষ্কার করে বললেন, মানুষ অর্থনৈতিক প্রয়োজনে সম্পদ উৎপাদনের সামাজিক প্রচেষ্টায় কর্ম বন্টনের নীতিতে শরীক হয়, সমাজের লোক বিভিন্ন শ্রেণিতে বিভক্ত হয়ে যায়। ফলে সমাজে Class divisions গড়ে ওঠে। প্রত্যেক শ্রেণির স্বার্থ অপর শ্রেণির স্বার্থ থেকে ভিন্নতর হয়ে দাঁড়ায়। সামাজিক উৎপাদনের বণ্টন ব্যবস্থাও কার্যকর হয় বেশি স্বার্থের ভিত্তিতে। এর ফলে সৃষ্টি হয় Property system এবং জনগণের মধ্যে Property relation নির্দিষ্ট হয়। সমাজের আইন, মালিকানা ও শ্রেণি পার্থক্যের সংরক্ষক হয়ে পড়ে। এই সমস্ত আইনগত ও সামাজিক গঠন, এই শ্রেণি পার্থক্য ও মালিকানা ব্যবস্থাকে মার্কসের ভাষায় বলা হয়েছে-Condition of production মার্কস বলেন এই উৎপাদন ব্যবস্থা ও উৎপাদক শক্তির মাঝে এক স্বাভাবিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। প্রচলিত উৎপাদক শক্তি হয় যে স্তরের উৎপাদন ব্যবস্থাও সে পর্যন্ত উন্নীত হয়। কিন্তু কোনো অর্থনৈতিক ব্যবস্থা নিজের আয়ু পর্যন্ত পূর্ণ করে নিলেই তার মধ্য থেকে নতুন উৎপানক শক্তির আবির্ভাব ঘটে, যার সাথে উৎপাদন ব্যবস্থা নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারে না। ফলে উৎপাদক অবস্থা ও নতুন উৎপাদক শক্তির মাঝে সৃষ্টি হয় সংঘর্ষের। যেমনঃ

  • ১. ভারবহন ও চাষকার্যে যন্ত্রের ব্যবহার, পূর্বে তা ছিল না পরে জানা গেছে। এতে করে প্রচলিত উৎপাদন পদ্ধতিতে পরিবর্তন সূচিত হলো। আইনও তাকে মেনে নিলো।
  • ২. পাম্প ব্যবহার: পূর্বে মানুষ জানতো না, পরে জানতে পেরেছে। এতে এক নতুন উৎপাদক শক্তির আবিষ্কার হলো। এ ভাবে নতুন উৎপাদন যন্ত্র Instruments of production হাতে পাওয়ার দরুন অর্থনৈতিক সংস্থারও পরিবর্তন সাধিত হয়। অর্থাৎ Form and methods of modes of production বদলে যাওয়ার কারণে পূর্ব থেকে প্রচলিত উৎপাদন ব্যবস্থা ও উৎপাদন প্রথার মাঝে সংঘর্ষের সৃষ্টি হয় এবং এই ডায়ালেকটিক পন্থায় পুরানো অর্থব্যবস্থা ভেঙ্গে যায় ও নতুন অর্থ ব্যবস্থা গড়ে ওঠে। অন্য কথায় পুরাতন সমাজ ভেঙ্গে যায়, নতুন সমাজ গড়ে ওঠে। সমাজের অর্থনৈতিক ভিত্তি বদলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চিন্তা-বিশ্বাস, ধারণা, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সভ্যতা-সংস্কৃতির প্রতিষ্ঠিত প্রাসাদ পূর্ণ হয়ে যায়। সংক্ষেপে ও মোটামুটিভাবে এই হচ্ছে মার্কসের অর্থনৈতিক দর্শন। একটু চিন্তা করলেই বুঝতে পারা যায় যে, এতে একই সঙ্গে তিনটি জিনিস রয়েছে। যেমন:
      • ১. ইতিহাস দর্শন, যাকে বলা হয় Material conception of history অথবা Historical materialism
      • ২.শ্রেণী সংগ্রাম এবং
      • ৩. চিন্তা-বিশ্বাস সম্পর্কে মার্কসের মত।

১.ইতিহাস দর্শন

মার্কস ইতিহাসের ব্যাখ্যা করেছেন বস্তুবাদী দৃষ্টিতে। তাঁর মতে সামাজিক তথ্য ঐতিহাসিক অংগতির Determining Factor বা কার্যকারণ সম্বন্ধের যথার্থ বা অনিবার্য কারণ হচ্ছে Economics (অর্থনীতি) এন্ডোস এ কথার প্রতিধ্বনি করে তার বই inti During-এ খোলাখুলি বলেছেন যে, ইতিহাসের বাস্তব ব্যাখ্যা তখনি সম্ভব যখন আমরা মেনে নেবো , The production and together with production the change of the finished products form the foundation of social order. অর্থাৎ মার্কসীয় দৃষ্টিতে ইতিহাসের ব্যাখ্যা করতে হলে Productive force গুলোর মাঝে কি পরিবর্তন হলো আর সঙ্গে সঙ্গে পণ্য দ্রব্যের Social utilities এর বিনিময় ব্যবস্থাতেই বা কি পরিবর্তন হলো তা দেখতে হবে। সহজ কথনঃ The underlying cause of all social phenomena are to be found not in the pilosophy but in the economics of every generation, অর্থাৎ অর্থনীতিই হচ্ছে সমাজের মূল দর্শন। মার্কস তাই বলেছেন। “I am convinced that the relation among men under the existing laws and the present forms industrial life. Express themselves neither in their own nature or in the development of the human spirit, but that they are deeply rooted in the material conditions of life (that productive forces).

 

২. শ্রেণী সংগ্রাম (Class struggle)

মার্কসের মতে প্রতিষ্ঠিত উৎপাদন প্রথা ও উৎপাদন ব্যবস্থায় নতুন উৎপাদক শক্তির আবির্ভাব সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির মধ্যে দ্বন্দ্ব ও সংঘর্ষের সৃষ্টি হয়। মালিক পক্ষ চিরন্তন নিয়মে বঞ্চিতদের শোষণ করতে ও তাদের বঞ্চিতই রাখতে চায়। ফলে পরস্পরের মধ্যে সমর অনিবার্য হয়ে ওঠে। এই শ্রেণি সংগ্রামের মৃল সূত্রের পরিচয় দিতে গিয়ে Communist Manifesto-তে মার্কা এঞ্জেলস লিখেছেন 

“Since the establishment of private property society has been divided into two hostile economic classes. Just as in the ancient world the interest of slave owners was opposed it that of the slaves and in medieval Europe, the interest of the feudal lords was opposed to that of the serfs. So in our times the interest of the capitalist class, which drives its income mainly from the ownership of property. antagonistic to the interest of the proletariat class, depends for its livelihood chiefly upon the sale of its labour power.”

তাই মার্কস অন্যত্র বলেছেন:

“All social changes has been determined chiefly but the economic class struggles that have pervaded history since the break up of tribal community organization.”

এবং কমিউনিস্ট মেনিফেস্টোর শুরুতেই লিখেছেন :

“The history of hitherto existing society is the history of class struggles” মার্কসের মতে এই শ্রেণি সংগ্রামই হচ্ছে সমাজ বিবর্তনের এক অমোঘ হাতিয়ার। সব সময়ই সকল সমাজেই এ সংগ্রাম চলতে থাকবে। অতএব Socialism must come. Because historical necessity. The objective of human history, the forces of production are bringing us everyday and closer to it.

এই শ্রেণি সংগ্রামের মূলে যে জিনিসটি কাজ করছে, তা হলো Theory of surplus value বাড়তি মূল্য থিওরী। মার্কসীয় দর্শনের দৃষ্টিতে একটি জিনিসের আসল মূল্য হচ্ছে শ্রম, যে শ্রম দিয়ে তা তৈরি করা হয়েছে, তা তৈরির ব্যাপারে যে শ্রম বিনিয়োগ করা হয়েছে। মার্কসের পূর্বে অ্যাডাম স্মীথ এবং রিকার্ডো এই নীতি রচনা করেছিলেন যে, পণ্যের বিনিময়ে মূল্যের আসল মানদণ্ড হচ্ছে শ্রমিক-মজুরদের দাম। ‘লোক’ ‘লেবার ক্যান মেইক ভ্যালু কথাটিকে অমোঘ সত্য মনে করে ব্যাক্তিগত মালিকানা অধিকারের প্রবল সমর্থন দিয়েছেন।

মার্কস তার ‘থিওরী অফ ভ্যালু এদের কাছ থেকেই ধার করেছেন। কিন্তু তিনি তা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন মতলব হাসিল করতে চেয়েছেন। তিনি যখন দেখলেন যে, দুনিয়ায় অসমর্থ ও অসহায় মজুররা পুঁজিবাদীদের নিরবচ্ছিন্ন জুলুম-শোষণের বিরুদ্ধে বিক্ষুদ্ধ হয়ে রয়েছে, কেবল প্রকাশের ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না, তখন মার্কস এই তত্ত্ব আবিষ্কার করে তাদের সামনে তুলে ধরলেন যে, পণ্যের উৎপাদন কেবলমাত্র তাদের শ্রমেরই ফল, পুঁজিদার কেবল তার সামাজিক মর্যাদা ও জোরের বলে শ্রমিকদের ন্যায্য, সংগত অংশ লুটে নিচ্ছে। অতএব তাদের অধিকার ও ন্যায্য অংশ লাভের জন্য মালিক পুঁজিপতিদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। মার্কস তার থিওরীকে একটি দৃষ্টান্ত দিয়ে বোঝাতে চেষ্টা করেছেন। বলেছেন, মনে কর, একজন মজুর দৈনিক একটাকা মজুরির বিনিময়ে কারখানায় কাজ করছে দৈনিক আট ঘন্টা করে। প্রশ্ন হচ্ছে, যে আট ঘন্টা কাজ করে মাত্র এক টাকা মূল্যে পণ্য উৎপাদন করে, না তার চেয়ে বেশি করে? আসলে মজুরীর এ হার এ জন্য নির্দিষ্ট করা হয়নি যে, সে আট ঘন্টা কাজ করে এক টাকা মূল্যের পণ্যই উৎপাদন করে। বরং এ জন্য যে, সে তার শ্রমের মূল্য আদায় করে নিতে পারে না, কেননা সে দুর্বল ক্ষুধায় কাতর অসহায়। আসলে সে দৈনিক আট ঘণ্টা কাজ করে-এক টাকার চেয়ে অনেক বেশি মূল্যের পণ্য উৎপাদন করে থাকে, কিন্তু তার দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে তাকে দেয়া হয় মাত্র এক টাকা, আর বাকী সবটাই লুটে নেয় পুঁজিদার, কারখানা মালিক, আর এটাই হচ্ছে Surplus value.

 

৩. চিন্তা, বিশ্বাস, ধারণার পদ্ধতি (Thought process)

পূর্বতন জার্মান দার্শনিকদের মত ছিল যে, মানুষের সামাজিক ও তামাদ্দুনিক বিবর্তনে সবচেয়ে বেশি প্রভাবশালী শক্তি হচ্ছে স্বয়ং মানুষের চিন্তা ও ধারণা-বিশ্বাসের শক্তি। আর এ শক্তি তার বাইরের জীবন ও বৈষয়িক প্রয়োজন বাসনা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা থেকেই কাজ করে। অর্থাৎ ইতিহাসের অগ্রগতির ধারা নির্দিষ্ট হয় নিছক চিন্তা ও ধারণা-বিশ্বাসের শক্তির সাহয্যে মার্কস এ থেকে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছেন। তার মতে এই ধারণা, চিন্তা বিশ্বাসেরও জন্য হয় মানুষের বাস্তব জীবনের পটভূমিতে ও সমসাময়িক বাহ্যিক পারিপার্শ্বিকতার প্রভাবেও। আর তা হচ্ছে তদানীন্তন অর্থব্যবস্থা।

মার্কসীয় দর্শনে রাষ্ট্র (Theory of state)

রাষ্ট্র সম্বন্ধে মার্কসীয় দর্শনের দৃষ্টি হচ্ছে এই যে, ব্যক্তিগত সম্পত্তি (Private property) থেকে রাষ্ট্রের উৎপত্তি। সমাজে যখন ব্যক্তিগত সম্পত্তির প্রচলন শুরু হলো, তখন সমাজের শক্তিশালী ও নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের হাতেই প্রায় সমস্ত সম্পত্তি চলে গেল। তারাই হলো সম্পত্তির মালিক। ফলে অবশিষ্ট সকল লোকই হলো বিত্তহীন। এখন এই দু’দলের সম্পত্তির মালিকদল সম্পত্তি নিরাপদে ভোগ করার জন্য রাষ্ট্র নামক যন্ত্রটির উদ্ভাবন করলো। সমাজের প্রচলিত ব্যবস্থা বজায় রাখাই হলো রাষ্ট্রের কাজ। এজন্য জুলুম নির্যাতন যা কিছুই করা প্রয়োজন বোধহয়, তা সবকিছুই করা হয় দ্বিধাহীনভাবে। মার্কস ও এন্ডেলস বিরচিত কমিউনিস্ট মেনিফেস্টোতে রাষ্ট্র সম্পর্কে বলা হয়েছে- ‘রাষ্ট্র হচ্ছে একটি শ্রেণিকে ধ্বংস করার বাহনাস্ত্র। ইহা একটি দলকে বিনাশ ও তার ওপর জুলুম-নির্যাতনের স্রোত চালানোর জন্য একটি সংগঠন তবে সমাজতান্ত্রিক যুগের সমাজ হবে Classless society- শ্রেণিহীন সমাজ সেখানে Domination class এরও অবসান হবে। ফলে রাষ্ট্র নামক যন্ত্রটির আর কোনো প্রয়োজনই থাকবে না। সেখানে মার্কসের ভাষায়, State will wither away- রাষ্ট্র আপনার থেকেই লোপ পেয়ে যাবে। অবশ্য তার আগে শ্রেণি সংগ্রাম সাফল্যের মাধ্যমে রাষ্ট্র গঠিত হবে।

মার্কসীয় দর্শনে পরিবার

মার্কসীয় দর্শনে রাষ্ট্রের মতো বিবাহ ও পরিবার প্রদত্ত Private property system-এরই পরিণতি। স্ত্রী সেখানে অন্যান্য সম্পত্তির মতোই পুরুষের সম্পতি, মার্কসের ভাষায় Instrument of production এবং ব্যক্তিগত সম্পত্তি প্রথা বন্ধ হয়ে গেলেই শ্রেণিহীন সমাজে পরিবার বিলুপ্ত হবে। সংক্ষেপে মার্কসীয় চিন্তাধারার পরিচয় পেশ করা হলো। এ চিন্তাধারাই হচ্ছে কমিউনিজমের দার্শনিক ভিত্তি। বর্তমান সময় বিশেষ করে পাশ্চাত্য শিক্ষাপ্রাপ্ত ও পাশ্চাত্য ধরণের মন মগজের লোকদের চিন্তায় দৃষ্টিভঙ্গিতে এর প্রভাব তীব্রভাবে বিদ্যমান। কাজেই যতদিন এ চিন্তাধারা সমাজ মনে বদ্ধমূল হয়ে থাকবে ততদিন সেখানে ইসলামের প্রতি বিশ্বাসের স্থান লাভ করতে পারে না। তাই এর সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম সমালোচনা করে এর অন্তঃসারশূন্যতা সমাজ সম্মুখে উজ্জ্বল করে ধরতে হবে। মানবমনকে মুক্ত করতে হবে মার্কসবাদের কুজ্বটিকা থেকে।

সমালোচনা

মার্কসীয় দর্শনের প্রায় সবকটি দিকই আমি সংক্ষেপে পেশ করলাম। এ সবের সমন্বয়েই গড়ে উঠেছে মার্কসবাদ। মার্কসীয় দর্শনের গোড়ার কথাই এই। এ দিকগুলোকে সামনে রেখে চিন্তা করলেই স্পষ্ট বুঝতে পারা যায়, মার্কসীয় দর্শনানুসারী জীবন, সমাজ ও রাষ্ট্র কিরূপ হতে পারে। কিন্তু তবু এ সম্পর্কে বিস্তারিত বিশ্লেষণ করা আবশ্যক। তাই এবারে আমি এর সমালোচনা শুরু করবো।

সমালোচনার লক্ষ্য

মূল সমালোচনা শুরু করার পূর্বে দুটো কথা বলা দরকার। পয়লা কথা এই যে, এ সমালোচনার মূলে আমার মনে কোনো অন্ধবিদ্বেষ নেই, নিতান্ত সত্যানুসন্ধিত্সা ও সত্য লাভের ঐকান্তিক অগ্রহই আমাকে এ কাজে উদ্বুদ্ধ করছে। একেতো জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে অন্ধবিদ্বেষ মূলতঃই অবাঞ্ছনীয়, দ্বিতীয়ত প্রকৃত সত্যকে পেতে হলে অন্ধবিশ্বাসকে পরিহার করতে হবে। এ ব্যাপারে একান্ত প্রয়োজন মার্কসের শুধু মার্কসেরই নয়, সম্ভব মতো সকল প্রকার জ্ঞান-বিজ্ঞানকেই যুক্তির মানদণ্ডে যাচাই করে, বাস্তবতার নিক্তিতে ওজন করে প্রত্যেকটি কথাই গ্রহণ করা কিংবা বর্জন করা। ঠিক এই দৃষ্টিতেই আমি মার্কসের দার্শনিক মতবাসসমূহের বিচার ও যাচাই করবো।

মার্কসের পরিবেশ

আর দ্বিতীয় কথা হচ্ছে, মার্কসের চিন্তাধারার সঠিক বিচার তখনি হতে পারে, যদি তাকে তার পরিবেশ-পরিস্থিতিকে সম্মুখে রেখে যাচাই করা হয়। অন্যথায় না তার চিন্তাধারাকে সঠিকরূপে উপলব্ধি করা যাবে আর না হবে তার প্রতি সুবিচার। এ জন্য আমি মার্কসের পরিবেশ এবং তার মনস্তত্ত্ব সম্পর্কে সংক্ষেপে কয়েকটি কথা প্রথমেই পেশ করবো। মার্কস বাহনল্যান্ড-এর এক ইয়াহুদা পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ইয়াহুদী বংশজাত হওয়ার কারণে খৃস্টান ধর্মের প্রতি অন্ধবিদ্বেষ ছিল তার বংশানুক্রমিক ও মজ্জাগত। এই কারণেই মার্কস শুরু থেকেই ধর্মকে বাদ দিয়ে ধর্ম থেকে সম্পূর্ণ বিপরীত দিকে দৃষ্টি নিবন্ধ রেখে চিন্তা-গবেষণা শুরু করেছিলেন। স্বচ্ছল পরিবারের সন্তান হিসেবে তিনি শিক্ষা দীক্ষার বিপুল সুযোগ পেয়েছিলেন। জার্মান বিশ্ববিদ্যালয়েই তার চিন্তার বীজ উপ্ত হয়। তখন হেগেলের দার্শনিক চিন্তাই ছিল একমাত্র প্রভাবশালী চিন্তা মত মার্কস তার চিন্তাধারা আকণ্ঠ পান করেছিলেন। পরে তিনি সাংবাদিকতা শুরু করেন। এ সময়েই সেকালের অপরাপর দার্শনিকদের দার্শনিক অবস্থাবলী গভীরভাবে অধ্যয়ন করার সুযোগ পান। শুধু অধ্যয়নই নয়, তিনি তাদের চিন্তাধারা থেকে রীতিমত মাল-মশলা গ্রহণ করে নিজস্ব দার্শনিক মত রচনা করেন। জাতীয় রাষ্ট্রীয় মালিকানা মাত্র গ্রহণ করেন Mamly & Hazani থেকে। ইতিহাসের বস্তুতান্ত্রিক ব্যাখ্যা ফয়েরবাখ্, Feuer Spinor-এর কাছ থেকে গ্রহণ করেন। শ্রেণি সংগ্রাম সম্পর্কিত ধারণা তিনি লাভ করেন St.simon, Thierry & Mignet-এর গ্রন্থাবলী থেকে। শ্রমিকদের ডিকটেটরশিপ এর ধারণা গ্রহণ করেন অষ্টাদশ শতকের শেষ ভাগের চিন্তাবিদ Babeue থেকে। সমাজের অর্থনৈতিক শোষণ এবং তা দূর করার জন্য সমগ্র উপায় উৎপাদন রাষ্ট্রায়ত করণের পরিকল্পনা মার্কসের পূর্বে পেশ করেছিলেন Fouier, Bary এবং Thompson প্রমুখ চিন্তাবিদগণ।

ঠিক এ কারণেই মার্কসের চিন্তাধারায় রয়েছে গোজামিল। এক কথায় তার চিন্তাধারা হচ্ছে অর্থদর্শন ও রাষ্ট্র বিজ্ঞানের সংমিশ্রণ। তার রচিত জীবন পন্থায়  ডারউইনের ক্রম-বিকাশবাদ, মেকিয়াভেলীর রাষ্ট্রদর্শন, রবার্ট উয়েন-এর তীব্রতিক্ত সমূহবাদ ও বক্তৃতান্ত্রিকতার গভীর চাপ রয়েছে বলে স্পষ্ট মনে হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে একথাও আমাদের মনে রাখা বোধহয় আবশ্যক যে, মার্কসীয় দর্শনে স্রষ্টা সম্পর্কিত মনস্তত্ত্বই ছিল অত্যন্ত হিংস, জিঘাংসু ও প্রতিশোধ আক্রোশে উচ্ছ্বসিত। কাজেই তার রচিত চিন্তাধারায়ও যে ঠিক সে ভাবধারাই হবে, তাতে আর সন্দেহ কি এসব বলার মূলে উদ্দেশ্য এই যে, মার্কসের মতবাদ অনুধাবন ও সত্যাসত্য বিচারের সময় এসব কথা সকলেরই স্মৃতিপটে জাগরুক থাকা আমি দরকার বলে মনে করি। এবারে একটি একটি করে মার্কসের মতবাদ সম্পর্কে আমার বক্তব্য পেশ করছি।

১. ডায়ালেকটিকবাদ

“ডায়ালেকটিক্যাল প্রসেস“-এর নিগূঢ় তত্ত্ব অনুধাবন করার ব্যাপারে হেগেল মার্কস দু’জনই ধোঁকা খেয়ে গেছেন। “Conflict of opposins ‘বিপরীতসমূহের দ্বন্দ্ব’ সম্পর্কে হোসেলের মূল কথাটির সত্যতা অবশ্য অস্বীকার করা হচ্ছে না। সেই সঙ্গে একথাও অস্বীকার করা হচ্ছে না যে, প্রত্যেকটি ব্যবস্থা যখন এক বিশেষ স্তর পর্যন্ত পৌঁছায়, তখন তারই মাঝ থেকে বিপরীত শক্তি বের হয়ে এক নবতর ব্যবস্থা গড়ে তোলে। এ ব্যবস্থা পূর্ববর্তী ব্যবস্থার বিপরীত হয় এবং পূর্ব ব্যবস্থার ওপর জয়ী হয় এ পর্যন্ত হেগেলের দাবি ঠিকই আছে। কিন্তু পরবর্তী কথা- এই দাবি যে, প্রত্যেক নবতর ধারণা বাতিলকৃত ধারণার সাথে মিলে এক নবতর Unit রচনা করে এবং নতুন Unit বাতিলকৃত ধারণার তুলনায় এই হিসেবে প্রশস্ততর হয় যে, শেষেরটিতে পূর্বটির অংশ ও মুক্তি অবশিষ্ট থাকে-এ দাবি স্বীকার করা যায় না। কেননা এই দাবিটি Logical contradiction ছাড়া আর কিছুই নয়। প্রথমে বলা হয়েছে যে, প্রত্যেক প্রতিষ্ঠিত ধারণার মাঝ থেকে তার বিপরীত আত্মপ্রকাশ করে। পরে বলা হয়েছে যে, এই বিপরীতটি পূর্ববর্তীর সাথে মিলে মিশে এক নবতর Unit সৃষ্টি করে। এখানে প্রথম প্রশ্ন হচ্ছে। পরবর্তী জিনিসকে প্রথমের ‘বিপরীত’ বলা হবে কেন? কেবল এই জন্যই কি যে, তা পূর্ববর্তী ধারণাকে বাতিল করে? কেননা তাকে বিপরীত বলার অর্থ হবে যে, মূল ধারণা এবং তার বিপরীতের মাঝে ঐক্য ও সাদৃশ্য মিলনের কোনো সূত্রই পাওয়া যায় না। তাহলে এ দুয়ের মিলনে এক তৃতীয় নবতর Unit-এর উদ্ভব কি করে হতে পারে? আরা যদি স্বীকার করা হয় যে, উভয়ের মাঝে কোনো প্রচ্ছন্ন সাদৃশ্য ও মিলন সূত্র বর্তমান রয়েছে, তাহলে শেষেরটিকে প্রথমটির ‘বিপরীত’ ধরে নেয়া কি করে সম্ভব? …..তাতো সুস্পষ্ট রূপে ভুল হবে। কেননা এ ‘বিপরীতের” মাঝে বিরোধ ও পূর্ণমাত্রার বৈপরিত্য থাকাই স্বাভাবিক। তা হলে কোনো স্তরেই উত্তরের সংমিশ্রণে কোনো Unit গড়ে উঠতে পারে না। আর যদি গড়ে ওঠে বলেই ধরা হয়, তাহলে মনে করতে হবে যে, উভয়ের মাঝে কোনো বিরোধ বা বৈপরিত্য নেই, আছে গভীর বন্ধুতৃতা, সামঞ্জশ্য, ঐক্য ও সাদৃশ্য। তাহলে এদের পরস্পর বিপরীত’ বলা সুস্পষ্টরূপে ভুল।

হেগেলের দৃষ্টান্ত বীজ ও গাছ এ ব্যাপারে মোটেই খাপ খায় না। আর যদি বলা হয় যে, শেষের বিপরীতটি প্রথমের সর্বদিক ও সব অংশের সাথে দ্বন্দ্ব করে না, করে কোনো কোনটির সাথে, তাহলে মানতে হবে যে, বিপরীতসমূহের দ্বন্দ লজিকের ভিত্তিতে চলে-চিন্তা-ধারণা ব্যবস্থা সমূহের পারস্পরিক দ্বন্দ খুব বুঝে শুনে বিজ্ঞতা ও সতর্কতা সহ চলে। এ কথার না আছে কোনো যৌক্তিকতা, না আছে বৈজ্ঞানিক ভিত্তি। একটা দৃষ্টান্ত দেয়া যাক : ক ধারণাঃ এর বিপরীত হচ্ছে খ, হেগেলের শেষ জবাবের দৃষ্টিতে ক-এর কয়েকটি দিক রয়েছে মনে করা যেতে পারে, তাদের ক(১),ক (২), ক (৩), ক (৪) ক(৫)। এর মধ্যে প্রথম তিনটি দুর্বল, খ তার Negation(বিপরীত) করে, কিন্তু ‘ক’র শেষ দুটি দিক দুর্বল নয়, তাই ‘খ’ তার Negation করে না কিছু দিন দ্বন্দ্ব করার পর ‘খ’ এদেরকে নিজের মধ্যে হজম করে নেয়। এ হিসেবে ক-এর প্রথম তিন দিক যার Negation(বিপরীত) করে। আর ক (৪) ও.ক (৫) কে নিজের মধ্যে Absorb করে নেয় তবে হজম করে নেয়, কাজেই খ-এর সাথে ক(৪) ও ক(৫)-এর কোনো দ্বন্দ্ব নেই বরং কিছু বন্ধুতা আছে। এখন হেগেলের মতে বিষয়টা এরকম দাঁড়ায় যে খ……ক এর বিপরীত। 

কিন্তু যুক্তির মানদন্ডে খ- ক(১),ক(২),ক(৩) – এর বিপরীত, কেননা খ এদের Negation করে কিন্তু ‘খ’- ক(8), ও ক(৫)-এর বিপরীত নয়, কেননা ‘খ’ এদের Negation করে না। ফলে ‘ক (১)’ ‘ক (২)’ ও ‘ক(৩)’ – ‘ক(৪)’  ও ‘ক(৫)-এর সম্পূর্ণ বিপরীত ও উল্টা হবে। তাহলে দেখ যাচ্ছে ক-ই হবে ক-এর বিপরীত। আর তাহলে মেনে নিতে হয় যে, দুই পরস্পর বিপরীত বা বিরোধী অংশ একই ধারণার Unit-এ একত্রিত হতে পারে। অথচ দুই বিপরীতের সমন্বয় তো চিরকালই অসম্ভব বলে বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে চূড়ান্তরূপে স্বীকৃত হয়ে আসছে। কাজেই হেগেলের এ Philosophy of opposits যুক্তির মানদন্ডে ভুল বলে প্রতীয়মান হয়।

অন্যদিকে মার্কস হেগেলেরই Dialectical process গ্রহণ করে সেই ভুলেরই পুনরাবৃত্তি ঘটিয়েছেন। অর্থাৎ ভুল ডায়ালেকটিক পদ্ধতির ওপরই স্থাপিত হয়েছে কার্ল মার্কসের ডায়ালেকটিক বস্তুবাদের স্বপ্ন প্রাসাদ। মার্কস প্রমাণ করতে চেয়েছেন যে, কোনো অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মাঝ থেকে যেমন বিপরীত শক্তি আত্মপ্রকাশ করে তা কিছু দিনের মধ্যে দ্বন্দ্ব সংঘর্ষের পর এক নবতর অর্থব্যবস্থা গঠন করে, যা পূর্বতন ব্যবস্থার ওপর জন্ম হয়, তাকে নির্মূল করে- নিঃশেষ করে দেয়। কিন্তু তার উত্তম ও উৎকৃষ্ট অংশগুলো নিজের মধ্যে শুষে নেয়। কাজেই এই নবতর অর্থব্যবস্থা পূর্ববর্তী ব্যবস্থা থেকে এই হিসেবে উন্নত যে, পূর্ববর্তী উচ্চ বৈশিষ্ট্যগুলো এই শেষেরটির মধ্যে বর্তমান থেকে যায়। Russell এই দর্শনের সমালোচনা প্রসঙ্গে বলেছেন। সুস্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, হেগেলের মতে জীবন ‘লজিকের’ অধীন। কিন্তু বাস্তবিকই কি জীবন ও লজিকের মাঝে কোনো অনিবার্য সম্পর্ক রয়েছে?

রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের ফল স্বরূপ কোনো উন্নত ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হওয়া কি সকল সময়ই জরুরী ? …. রোমান সাম্রাজ্যের উপর বর্বর উপজাতিদের আক্রমণে কোনো কল্যাণময় অর্থব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি, আন্দালুসিয়া থেকে মুসলিমদের বহিষ্কারের ফলে কোনো উন্নত ব্যবস্থা সেখানে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। অর্থাৎ ইতিহাস মার্কসের পক্ষে নয়-ইতিহাসের ভিত্তিতেই জিজ্ঞেস করা যায়, জায়গীরদারী (Fcudal) ব্যবস্থার পর যখন পুঁজিবাদী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হলো, তখন তাতে জায়গীরদারী ব্যবস্থার কোনো উচ্চতর বৈশিষ্ট্য সুরক্ষিত থাকলো কিছু কিংবা গোলামী ব্যবস্থার অবসানের পর যখন জায়গীরদারী ব্যবস্থা কায়েম হয়েছিল, তাতেই বা গোলামী যুগের কোনো বৈশিষ্ট্য অবশিষ্ট ছিল? চিন্তা করলেই বুঝা যায় যে এর কোনো পরবর্তী ব্যবস্থাই তার পূর্ববর্তী ব্যবস্থার কোনো বৈশিষ্ট্যই বাকী থাকে নি। কেননা কোনো চিন্তা বা কর্মমুখর আন্দোলনের লজিক্যাল পূর্ণতার পর তার বিপরীত ভাবধারা যখন ফুটে বের হয়, তখন নতুন ভাবধারা পূর্বতন আন্দোলনের সাথে মিলে কোনো উন্নততর ও নবতর সংযোজন সৃষ্টি করে না। বরং প্রায়শই দেখা যায়, পরবর্তীটি পূর্ববর্তীর মূলোৎপাটন করে দিয়ে সম্পূর্ণ নতুন আন্দোলনের ভিত্তি স্থাপন করে, সেখানে পূর্ববর্তী আন্দোলনের সকল দিকই নিঃশেষ হয়ে যায়।

মার্কসের ডায়ালেকটিক্যাল ম্যাটেরিয়ালিজম সম্পর্কে আরও প্রশ্ন ওঠে। মার্কসের মতে ঐতিহাসিক ক্রমবিকাশ ও অগ্রতির মূলে প্রকৃত কারণ ও উদ্গাতা (Factor) হচ্ছে অর্থনৈতিক শ্রেণিগুলোর পারস্পরিক দ্বন্দ্ব ও সংগ্রামে। শ্রেণি সংগ্রাম না হলে দ্বান্দ্বিক পদ্ধতিও কোনো কাজ করে না। অথচ সকল প্রকার গতি ও উন্নতিমূলক ভিত্তি স্থাপিত হচ্ছে দ্বান্দ্বিক পদ্ধতির ওপর। মার্কস সেকথা বলেন নি। শ্রেণি সংগ্রামের চূড়ান্ত পর্যায়ে এই ঘাদিক পদ্ধতির পরিণাম কি হবে? কেননা মার্কসের মতে কমিউনিস্ট সমাজে শ্রেণি পার্থক্য বলতে কিছুই থাকবে না এটা Classless society হবে, অতএব Class war বলতেও সেখানে কিছু থাকবে না। তা হলে কমিউনিস্ট সমাজে যে উন্নতি ও অগ্রগতি সম্পূর্ণরূপে স্থগিত হয়ে যাবে সে কথা কি মার্কসবাদীরা একবারও ভেবে দেখছেন? আসলে এর কোনো জবাব মার্কসের নিকট নেই। যা তিনি বলতে চেয়েছেন, তা গোজামিল ছাড়া কিছুই নয়, কোনো চিন্তাশীল মানুষই তাতে প্রভাবিত হতে পারে না।

২. অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণবাদ

মার্কসীয় দর্শনে সকল প্রকার সামাজিক পরিবর্তন বিবর্তনের মূল কারণ হচ্ছে অর্থনীতি- Economic Factor: আর একেই বলে Economics Determinisum; কিন্তু মুশকিল এই যে; Economic Factor বলতে মার্কস কি বোঝাতে চান, যে সম্পর্কে সব মার্কসবাদীই একমত নন। সে যাই হোক এ ব্যাপারে যত মতভেদহ হোক না কেন এবং মার্কসবাদীদের এ ব্যাপারে যত অজুহাত থাক না কেন, সবকিছুই পরিবর্তন বিবর্তনের মূলে অর্থনীতিহ যে মূল, এতে তাদের মাঝে কোনো মতভেদ নেই। অথচ সমাজ-বিপ্লবের ইতিহাস যারা অধ্যয়ন করেছেন তাদের এ কথায় কোনো দ্বিমত নেই যে, সামাজিক পরিবর্তন বিবর্তনের বিবিধ কারণ থাকতে পারে এবং থাকেও। তন্মধ্যে মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা বা ব্যবস্থাও যে একটা কারণ অনেক সময় অন্যতম প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়ায়, তাতেও কোনো সন্দেহ নেই। তাই মার্কসের এই আর্থিক ব্যাখ্যাও সম্পূর্ণ সত্যি নয়- আংশিক সত্য, তাও মেনে নিতে কোনো দ্বিধা নেই। অর্থাৎ সমাজ বিপ্লবের ক্ষেত্রে অর্থনীতিও The factor – Out of the factors মাত্র। অতএব মার্কসের ইতিহাস ব্যাখ্যা একদেশদর্শী, বহুবিধ শক্তির পারস্পরিক গাত-প্রতিঘাতেই সামাজিক পরিবর্তন সূচিত হয়। তাই মার্কসের Monistic Interpretation of History রীতিমত ভুল Pluralistic Interpretation of History-ই অধিকতর বিজ্ঞান সম্মত।

কিন্তু তবুও প্রশ্ন থেকে যায়। অর্থনীতি সবকিছুর মূলে এবং অর্থনীতিতে পরিবর্তন ঘটলে তবেই অন্যান্য ক্ষেত্রে পরিবর্তন ঘটে, এ কথা না হয় কিছু সময়ের জন্য ধরে নেয়া গেল। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, অর্থনীতিতেই কেন অন্যান্য সব কিছুর আগে পরিবর্তন ঘটে? এ প্রশ্নের কোনো উত্তরই মার্কসবাদীরা দিতে পারেন নি। অর্থনীতিকে যদি স্বয়ংক্রিয়াশীল-Self-starter-ও ধরে নেয়া হয়, তবুও অর্থনীতির সে অজেয় রহস্যময় রূপ, রহস্যই থেকে যায়। Sorokin-এর ভাষায় বলতে হয়, The hypothesis of the self-starter amounts to the worst kind of mysticisen where the economic factor economics a kind of god. 

৩. সমাজ বিপ্লব ও শ্রেণি সংগ্রাম

মার্কসের মতে কেবল শ্রেণি সংগ্রাম হচ্ছে সমাজ বিবর্তনের একমাত্র নিয়ামক। তিনি ইতিহাসে কেবল শ্রেণি সংগ্রামই দেখতে পেয়েছেন। তাই সংগ্রাম এবং সংঘর্ষ ছাড়াও যে সমাজে কোনো পরিবর্তন আসতে পারে তা মার্কসের চোখে ধরা পড়েনি। তাই এ হচ্ছে An inadequate explanation । কিন্তু বাস্তবিক সংঘর্ষই একমাত্র শক্তি নয়। সমাজে সদিচ্ছা ও সহযোগিতাও বিবর্তনের জন্য বহু কাজ করে। কোপার্টিন-এর মতে “The law of organic evolution is primarily a law of mutual aid, not of conflict.”

কেবল সহযোগিতা ও বিবর্তনের পারস্পরিক সদিচ্ছার ফলেই সমাজে পরিবর্তন এসেছে এ কথা বলাও যেমন অভিরঞ্জন, তেমনি কেবল সংঘর্ষই হচ্ছে পরিবর্তনের একমাত্র নিয়ামক, একথা বলাও আরো একটি অতি বড় অতিরঞ্জন। তবে শেষের অতিরঞ্জণ অপেক্ষা প্রথমোল্লেখিত অতিরঞ্জণই যুক্তিসঙ্গত। অতএব শুধু Conflict বা সংঘর্ষের চশমায় মার্কসবাদ রীতিমত একপেশী হয়ে দাঁড়িয়েছে।

Sorokin-এর ভাষায় : “They have taken only one side of the coin and forgetten the other”. তারপর এ Conflict-কে মার্কস কেবল অর্থনীতির ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ করতে চান। তার মানে, সমাজে যত সংঘর্ষ হচ্ছে তা কেবল অর্থনীতির জন্যই, অন্য কিছুর কারণে নয়। কিন্তু একথা রীতিমত স্থূল। সামাজিক সংঘর্ষের ইতিহাসে অর্থনীতিই একমাত্র কারণ নয়, তার মাঝে আদর্শবাদও যে একটা প্রধান কারণ, তা ইতিহাসবিদ মাত্রই স্বীকার করতে বাধ্য। ফরাসী বিপ্লবই তার বড় দৃষ্টান্ত। মার্কসের মতে এ বিপ্লব হয়েছিল কেবলমাত্র অর্থনৈতিক কারণে। কিন্তু আমরা দেখছি তার বিপরীত। ফ্রান্সের তদানীন্তন সরকারের বিরুদ্ধে সর্বপ্রথম যারা আওয়াজ তুলেছিলেন তাঁরা ছিলেন সে দেশের চিন্তাশীল শিক্ষিত সমাজ- সমাজের Intelligentsia, তারা কোনো অর্থনৈতিক শ্রেণির মধ্যেই গণ্য হতে পারেন না এবং সে কারণও ছিল না সেখানে। সংগ্রামীদের মধ্যে যেমন ছিল গরীব লোক, তেমনি ছিল বিপুল সংখ্যক স্বঞ্চল অর্থশালী লোকও। ইউরোপের ধর্মীয় যুদ্ধসমূহও এইরূপ। কাজেই সমাজ বিবর্তনের ইতিহাস কেবল Economic Determinism- বলতে সমাজ বিপ্লবের ইতিহাসের কোনো জিনিসই নেই।

৪. জড়বাদ বা বস্তুবাদ

মার্কসীয় দর্শনের মূলকথা হচ্ছে জড়বাদ। এ দুনিয়ায় ‘হাড়ই’ হলো আদি ও অকৃত্রিম ।  ক্রমঅভিব্যক্তির পথে এ ‘জুড়’ থেকেই প্রাণ, চেতনা বা মনের সৃষ্টি। অর্থাৎ মার্কসীয় মতে বস্তুই জীবনের রূপে পরিগ্রহ করেছে, সে জীবন থেকেই চেতনা এবং সেই চেতনা থেকেই মনের সত্তা গড়ে উঠেছে। খোদা বলতে তাদের মনে কোনো কিছু নেই।

(* এই পর্যায়ে ইমাম খোমেনীর নেতৃত্বে আধুনিক ইরানে যে সর্বাত্মক ইসলামী বিপ্লব সাধিত হয়েছে, মার্কসীয় দর্শনের ভ্রান্তি প্রমাণের জন্য তা অকাট্য সাক্ষ্য। বিপ্লবীরা মার্কসকে চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলেছিল তোমার মত কেবল অর্থনৈতিক কারণেই বিপ্লব হয়। তুমি কবর থেকে বের হয়ে এসে দেখে যাও আমরা কোনো অর্থনৈতিক কারণে বিপ্লব করিনি, বিপ্লব করেছি কেবলমাত্র ঈমান ও ইসলামের জন্য।)

কিন্তু এ মতের পিছনে যথার্থ কোনো বৈজ্ঞানিক সমর্থন আছে কি? আঠারো শতকের বিজ্ঞান নয়, ঊনবিংশ অথবা বিংশ শতকের বিজ্ঞান-আধুনিক বিজ্ঞান এ বস্তুবাদ স্বীকার করে কি? তা এ জন্য বলছি যে, আঠারো শতকের বিজ্ঞান ছিল নেহাতেই যান্ত্রিক, হস্তবিজ্ঞানের যুগ, জড় বিজ্ঞানের যুগ। সে যুগে ‘জড়’ নিয়েই ছিল বিজ্ঞানের কারবার। উদ্ভিদ থেকে মানুষ-সবই ছিল যন্ত্রের মাঝে সীমাবদ্ধ। মন বা প্রাণকে যে দিন বলা হতো ‘ও কিছু নয়, ও শুধু কতগুলো জড়কোষের সমবায়ের ফল মাত্র। দৃষ্টান্ত হিসেবে গলিত মাংসের মাঝে নিজ থেকেই অসংখ্য জীবকণা সৃষ্টি হওয়ার কথা উল্লেখ করা হতো। কিন্তু পরের যুগে-লুই পাস্তর-এর জীবাণু বা  Bacteria  আবিষ্কারের পর এ ধারণা তাদের বদলাতে হয়েছে। এখন প্রমাণিত হয়েছে যে, জীৰ তথা জীবন থেকেই জীবনের সৃষ্টি, আপনা থেকে এ হতে পারে না। কিন্তু যে জীব তথা জীবন থেকে সৃষ্টিধারা শুরু হলো তার মূল কোথায়? প্রথম জীব কণাটির স্রষ্টা কে? আর এই জড় পৃথিবীতেই বা জীবনের উদ্গম হলো কী করে? জড়বাদীরা এ প্রশ্নের উত্তর দিতে অক্ষম। …..অন্ততঃ সত্যিকার বিজ্ঞানসম্মত কোনো উত্তরই আজ পর্যন্ত দেয়া সম্ভব হয় নি। আমরা দেখতে পাচ্ছি, স্থূল দেহতে আশ্রয় না করলে প্রাণ কখনো আত্মপ্রকাশ করে না। তাই যদি বলি প্রাণশক্তি চিরকালই ছিল, শুধু যোগ্য আধার পাওয়ার অপেক্ষায় বসেছিল। যখন প্রাণ সে পাত্র পেল তখনই সে প্রাণ আত্মপ্রকাশ করলো। এই প্রাণেরই স্রষ্টা হচ্ছে আল্লাহ-দেহেরও যেমন তেমনিভাবে জড়েরও স্রষ্টা তিনি। তাহলে বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে একথাটা অযৌক্তিক হবে কিন্তু বস্তুবাদ বা জড়বাদ যে আজ বাতিল হয়ে আছে, তা আমরা আরেক দিক থেকেও দেখতে পাচ্ছি। বস্তু কী, বস্তুর শেষ কোথায়?

ঊনবিংশ শতকেও এর শেষ কথা ছিল Atom অণু। কিন্তু বিজ্ঞানের অগ্রগতিতে একথা মিথ্যা হয়ে গেছে। এখন ইলেক্ট্রন ও প্রোটন আবিষ্কৃত হয়েছে। প্রমাণিত হয়েছে যে, জড়বস্তু আর জড় নয় বরং নেহাতই সূক্ষ্ম শক্তির পুঞ্জীভূত বাহারূপ মাত্র। তাই বলতে হয়, জড়বাদীদের জড়ই আজ জড়ত্ব হারিছে ফেলেছে-Matter বা বস্তু নয়। বস্তুর এই অবস্থা দেখে Russell বলেছিলেন, “জড়বাদ বেঁচে নেই, তার মৃত্যু ঘটেছে” Matter এবং Mind-54 ব্যাখ্যায় তাই বলতে হবে : বিশ্বসংসারের সব কিছুর আড়ালে সর্বব্যাপী এমন এক মহান মন-রয়েছেন, যাঁর ইচ্ছাশক্তিই কাজ করেছে সবকিছুর ঊর্ধ্বে। বর্তমান প্রকৃতি ও পদার্থ বিজ্ঞান তার বস্তুভিত্তি ত্যাগ করেছে মোড় ঘুরিয়ে নিয়েছে। জিগ-এর ভাষায় Modern physics moving in the direction of philosophical idealism. অতএব জড়বাদ বস্তুবাদের ওপর ভিত্তি করে কোনো জীবন দর্শন দাঁড় করানো একেবারেই অর্থহীন। এজন্য যে Scientific materialism is may more scientific today. তাই রুশ বিপ্লব যেমন যুক্তিহীন, তেমনি ভিত্তিহীন রাশিয়ান রাষ্ট্রের অবস্থিতি। এখনো আরও দুটো কথা রয়ে যায়। দ্বন্ধ যে চিরন্তন চিরকাল থেকেই এর অস্তিত্ব, একথার প্রমাণ কোথায়? ‘দ্বন্ধ’ কে তো মানুষই অনুভব করতে পেরেছে। মানুষের চেতনা ও মন সৃষ্টির পূর্বে এ দুনিয়ায় কী ছিল, আর কী ছিল না, সে জ্ঞান লাভ করার জন্য তখন কে উপস্থিত ছিল? জড়বাদ বা বস্তুবিজ্ঞান তা কী করে জানতে পারে?

এর জবাবে মার্কসবাদীরা Fossils-কে নিদর্শন স্বরূপ পেশ করেন। কিন্তু তাতে বরং একথাই প্রমাণিত হয় যে, সরাসরি ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে জ্ঞান অর্জনই মানুষের পক্ষে জ্ঞান লাভের একমাত্র উপায় না। বরং কোনো জিনিসের নিদর্শন-Sign-দেখেও অপর কোনো জিনিসের অস্তিত্বের সন্ধান মেলে এবং তা নিঃসন্দেহে বিশ্বাস করা যায়। আধুনিক দর্শনের ভাষায় তাকে বলা হবে Inference, তাহলে আল্লাহর অস্তিত্ব অস্বীকার করার যৌক্তিকতা কি হতে পারে, যখন তার অস্তিত্বের প্রমাণ করছে আকাশ বাতাস পৃথিবী-গোটা দৃশ্যমান জগৎ এবং প্রতিটি অণু-পরমাণু?

দ্বিতীয়ত ‘বস্তু’ নিজে নিজেই কি করে অস্তিত্ব লাভ করলো? মার্কসবাদীরা কি প্রমাণ করতে পারেন যে, “বস্তু সৃষ্টির আদিকাল থেকেই বর্তমান ছিল। নিজে নিজেই কি তা অস্তিত্বমান হয়েছিল? তা দাবি করা হলে বলতে হয়, কেবল মাত্র ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জ্ঞান ছাড়া আর কোনো জ্ঞানকেই যারা কোনো জ্ঞান বলে বিশ্বাস করে না, তাদের পক্ষে এটা নিতান্ত গোঁড়ামী ছাড়া আর কিছু নয়। আর ‘বস্তুতেই যদি এভাবে স্বীকার করা যেতে পারে, তাহলে আল্লাহকে স্বীকার করতে বাধে কোথায়? ‘দ্বন্ধ’ যদি Self existent হতে পারে, তবে আল্লাহ তা হতে পারবেন না কেন? প্রশ্ন হতে পারে যে, আল্লাহই যদি বিশ্ব নিখিলের স্রষ্টা হবেন, তাহলে আমরা তাঁকে দেখতে পারছি না কেন? এর উত্তর খুবই সহজ এবং সোজা। আমাদের প্রাত্যহিক অভিজ্ঞতা সাক্ষ্য দেখে যে, যে জিনিসের অস্তিত্ব যত স্থূল, তা তত সহজেই দেখা যায়, অনুভব করা যায়। আর যে জিনিসের সত্তা যত সূক্ষ্ম, তা দেখা ও অনুভব করা ততই কঠিন। তাছাড়া অস্তিত্বের মর্যাদা ও স্তর বা পর্যায়ের দৃষ্টিতে যে জিনিস যত বেশী উচ্চ ও উন্নত, সে জিনিস সে হিসেবেই ততো সূক্ষ্ম-ইন্দ্রিয় ও অনুভূতির নাগালের তত বাইরে। মানুষের বাহ্যদেহ আকার আকৃতি রূপ স্থূল তা সহজেই দৃষ্টিগ্রাহ্য। কিন্তু গুণ ও মেধা তা কি একজনকে দেখলেই বুঝতে পারা যায়- বা অনুভব করা যায়?

আরও দেখুন। মানুষের বাহ্য দেহের তুলনায় তার ভিতরকার প্রাণ-রূহ কত সুক্ষ্ম। তাই মানুষের স্থূল দেহ অঙ্গ ও প্রত্যঙ্গ ধরা-ছোঁয়া গেলেও তার রূহকে না ধরা যায় না দেখা যায়। শুধু মাত্র তার ক্রিয়াকাণ্ডের সাহায্যে তার অস্তিত্বই অনুভব করা যায় মাত্র। পৃথিবীতে সদা প্রবাহমান বাড়াসও কি সেরূপ তাই আল্লাহ কোনো স্থূল জিনিসের নাম নয়। সূক্ষ্মতায় তিনি তুলনাহীন। এ কারণে ইন্দ্রিয় শক্তির সাহায্যে তাঁকে দেখা সম্ভব নয়। আর অস্তিত্ব ও সত্তার মর্যাদা এবং মাত্রার বিচারেও তিনি সর্বোচ্চ, তাই তাঁকে অনুভব করা ততই কঠিন। আরও একটি বলা আছে। মানুষের দেহের অস্তিত্ব অনুভবের জন্য স্থূলবর আবশ্যক, যেমন-চোষ, হাত ইত্যাদি; কিন্তু এই স্কুল ইন্দ্রিয় শক্তি দ্বারা মানুষের মেধা ও প্রতিভাকে ধরা যায় না, বোঝা যায় না। আল্লাহকে দেখার জন্য যে দৃষ্টিশক্তির দরকার, তা এই বস্তুজগতে সম্ভব নয়। বস্তুজগত শেষ হয়ে গেলে আল্লাহকেও দেখা যাবে বৈকি।

৫. জ্ঞান আহরণের ক্ষেত্রে সূত্র এবং চিরস্থায়ী সত্য

External Experiment বাহ্যিক অভিজ্ঞতা ছাড়া মানবীয় দর্শনে জ্ঞান লাভের আর কোনো উৎসই স্বীকৃত নয়। তাই ওহী, ইলহাম বা চিরস্থায়ী সত্যকে মার্কসীয় দর্শন স্বীকার করে না।

এ সম্পর্কে প্রশ্ন দাঁড়ায়, মানুষ তার যাবতীয় চিন্তা ও জ্ঞানসম্পদ বাহ্যজগত থেকে গ্রহণ করে, একথা না হয় মেনে নিলাম। কিন্তু যে মানবীয় মন এই জ্ঞান আহরণ করে, সেই জ্ঞানের রূপায়ণে ও সুসংবদ্ধকরণে তার নিজের অর্থাৎ মনের কী ভূমিকা থাকে? তাতে স্বয়ং মনের কি কোনো অংশই থাকে না? …..এমন কী জ্ঞান আহরণ করে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষভাবে? মন নিজ থেকে তাতে কোনরূপ রদবদল না করেই কি তা গ্রহণ করে? অন্যথায়, বাহ্যজগত থেকে জ্ঞান আহরণে মনের ভূমিকা কি নিছক একটি ক্যামরার মতো Rocciving-এর কাজ করার; নাকি অন্য কিছুর? তা-ই যদি হবে তাহলে তো একই সময়ে লালিত-পালিত সকল লোকের চিন্তা ও মতবাদ সর্বতোভাবে একই রকমের হওয়া আবশ্যক। কেননা সকলের অভিজ্ঞতাই সমানভাবে এক ও অভিন্ন হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু বাস্তবক্ষেত্রে তা সত্য মনে হয় না। মন এক স্বাধীন ও স্বয়ং সম্পূর্ণ রূপায়ণ শক্তি, জ্ঞানের সম্পদ ও তথ্য বাহির থেকে গ্রহণ করলেও মন তাকে হবহু গ্রহণ করেন না, যেমন-ক্যামেরা গ্রহণ করে। বরং মন তাতে নিজের ইচ্ছামত ঢেলে দেয়। এ কারণেই মানুষের চিন্তা ও মতাদর্শ রচনাকারী শক্তি হচ্ছে মানুষের মন। নিছক বাহা অভিজ্ঞতাই শুধু নয়, এই মন বিভিন্ন-এই মনের শক্তিও বিভিন্ন নবী রাসূলগণের মন ও দার্শনিক বিজ্ঞানীদের মনের মাঝে আসমান জমিনের শুরুতে রয়েছে। সকলেই বাহাজগত থেকে জ্ঞান আহরণ করে। তবে বাহাজগত সকলের এক নয়। চিন্তাবিদ দার্শনিকগণ যেখানে এই দুনিয়ার চলচলন গতিধারা ও অবস্থার মধ্যে থেকে জ্ঞান আহরণ করেন, নবী রাসূলগণ জ্ঞান গ্রহণ করেন আল্লাহর নিকট থেকে। চিন্তাশীল দার্শনিক বৈজ্ঞানিকদের আহরিত জ্ঞান যদি মানুষের জৈর জীবনের জন্যে প্রয়োজন, তাহলে মানুষের মানবিক তথা নৈতিক জীবনের জন্য প্রয়োজন নবী রাসুলগণ কর্তৃক আহরিত জ্ঞান। মার্কসীয় দর্শনে কোনো চিরস্থায়ী সত্যও স্বীকৃত নয়। সম্পর্কে আমার বক্তব্য শুধু এতটুকু যে, সত্য যদি কেবল সময়, কাল ও পারিপার্শ্বিক অবস্থা-ভিত্তিকই হয়- হয় আপেক্ষিক, এবং সময় কল ও অবস্থায় পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সে সত্যও যদি বদলে যায়, আর সত্যের এই পরিবর্তন যদি হয় এই করণে যে, যে নিয়মকে ভিত্তি করে এ সত্য দাঁড়িয়েছিল, সে আইন ও নিয়মেরই পরিবর্তন হয়ে গেছে, তা হলে বলতে হয় এ বিশ্বজগতই এক দুফো রহস্য ছাড়া আর কিছু নয়। আর বিজ্ঞানীগণ যত মত, চিন্তা ও আদর্শের কথা বলেছেন, পেশ করেছেন যত তত্ত্ব ও তথ্য, তা সবই ভুলে ভরা, বিশ্বাসের অযোগ্য। কেননা বিশ্ব-নিখিলকে আমরা কেবল সাধারণ আইন (General laws)-এর দ্বারাই বুঝতে পারি। কিন্তু এই আইন যদি পরিবর্তনশীলই হয়, তাহলে দুনিয়ার ঘটনাবলীর নির্ভরযোগ্যভাবে ব্যাখ্যা করা কখনোই সম্ভব হতে পারে না। আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতাবাদ ধরুন, বর্তমানে এ এক সর্বসম্মত মত। কিন্তু প্রাকৃতিক আইনকে যতি নিত্য পরিবর্তশীলই ধরে নেয়া হয়, তাহলে এই আপেক্ষিকতাবাদ কেই বা আমরা কীভাবে নির্ভরযোগ্য মনে করতে পারি? আইনস্টাইনের এ মত রচনার পর বর্তমানে প্রকৃতি কোনো নতুন নিয়মে চলতে শুরু করেনি, তা কি নিশ্চিতভাবে বলা যায়? আর আপেক্ষিকতাবাদ-Law of Relativity-র স্থানে নতুন যে নিয়মে এসে দাঁড়িয়েছে, তাকে ভিত্তি করে আজ গবেষণা শুরু করলে সেই গবেষণা শেষ হবার পূর্বেই হয়তো সে নিয়ম বদলে গেছে এবং আবার এক নতুন নিয়ম এসে সেখানে জায়গা দখল করে বসেছে। আর প্রকৃতির অবস্থা যদি এরূপ হয়, তা হলে বাহ্য জগত থেকে কোনো জ্ঞান আহরণ এবং সে জ্ঞানকে ‘জ্ঞান’ বলে মনে করে তার ওপর নির্ভর করা কিছুতেই এবং কখনই মুক্তিসংগত বা বুদ্ধিমানের হতে পারেনা। আর তা হচ্ছে এক চরম অনিশ্চিত অবস্থাও। কিন্তু মানুষ এই অনিশ্চিত অবস্থায় কিছুতেই স্থিতি ও স্বস্তি পেতে পারে না। মানুষের জন্য চাই স্থির নিশ্চিত জ্ঞান- চাই চিরস্থায়ী অপরিবর্তনীয় সত্য। আর প্রকৃতি যে সেরূপ জ্ঞানই দেয়-দিতে পারে, তাতে কোনো সুস্থ মস্তিষ্ক লোকেরই সন্দেহ থাকতে পারে না।

৬. রাষ্ট্র

মার্কসীয় মতে রাষ্ট্র সব সময়ই জুলুম শোষণের সাহায্যকারী হয়েছে। কেননা এর উৎপত্তিই হয়েছে ব্যক্তিগত মালিকানা রক্ষার জন্য নিতান্ত অর্থনীতির কারণে। কাজেই এ ধরনের রাষ্ট্রে যে শ্রেণী সংগ্রামের উদ্ভব হবে তা-ই Leads to the dictatorship of the proletariat এবং This dictatorship itself only constitutes The ransition of all classless society এবং সেখানে কোনো রাষ্ট্রের প্রয়োজন হবে না। রাষ্ট্র সম্পর্কে মার্কসীয় মত স্বীকার্য কিনা, তার বিচার করার জন্য আমাদের একটু ভাবতে হবে।

রাষ্ট্র মানুষের জীবনে ঠিক কখন কীভাবে উদ্ভূত হয়েছিল সে চিন্তা অবান্তর। তবে রাষ্ট্র যে মানুষের জীবনে অপরিহার্য তাতে কারো সন্দেহ থাকতে পারে না। কেননা, মানুষ স্বভাবতই সামাজিক জীব, দলবদ্ধ হয়ে থাকার চেষ্টা মানুষের জন্মগতই। তাই রাষ্ট্র যে বিভিন্ন দিক দিয়ে Common interest-কে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছিল, সে সম্পর্কে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের দ্বিমত নেই। আর সে সমস্বার্থ যে অর্থনীতিভিত্তিক ছিল তা কিছুতেই বলা যেতে পারে না। রাষ্ট্র গঠনের মূলে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে-Force of state building হিসেবে কাজ করে রক্ত (Kinship), জাতিত্ব, ধর্ম-Religion industry ও যুদ্ধ। আর এ সব কিছুর মূলে রয়েছে The focling of unity and solidarity এ কারণে রাষ্ট্র শুধু গঠিতই হচ্ছে না, দিন দিন তার শ্রী বৃদ্ধিও হচ্ছে। আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে শান্তি, শৃংখলা স্থাপন ও অত্যাচার-অনাচারের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার আশ্রয়ের প্রয়োজনেই বহুরকমের শক্তি ঘাত-প্রতিঘাতের ভিতর দিয়ে রাষ্ট্রের উদ্ভব- R. C. Gottell তার Polotical Science-এ লিখেছেন। came into existence gradually as the natural result of many and diverse forces resulting from the need of men for order and protection.”রাষ্ট্রের উদ্ভব যেভাবেই হোক না কেন, রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রশক্তির ব্যবহার Sate and Government এক নয়-এ দুটো জিনিস আলাদা এবং আলাদাভাবেই তার যাচাই ও বিচার হওয়া উচিত। তাই রাষ্ট্র ঠিক থাকলেও হতে পারে যে, গভর্নমেন্ট খারাপ লোকের হাতে গড়ে তার অপব্যবহার হচ্ছে। কিন্তু তাই বলে রাষ্ট্রটি তো আর খারাপ হয়ে যায়নি। ইতিহাসে রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রশক্তি অত্যাচার ও নিপীড়নের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে যেমন, তেমনি Human consolidation and wellbeing-এর কাজেও তার অবদান কোনো অংশে কম নয়।

কাজেই সমাজ জীবনে ব্যক্তিগত মালিকানা কখনো যদি লোপ পায় , যদিও পাওয়া সম্ভব নয় অবশ্য তা হলেও রাষ্ট্রের প্রয়োজন কখনো ফুরাবে না, ফুরাতে পারে না। কেননা রাষ্ট্র কেবল ব্যক্তিগত মালিকানার কারণে ও তাকে ভিত্তি করেই গড়ে ওঠেনি। আমরা দেখছি, মার্কসবাদ Proletariat-দের ডিকটেটরশিপের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রকে Fascist রূপে একান্ত অপরিহার্য হিসেবে মেনে নিচ্ছে; কিন্তু তাদের দ্বারা বুর্জোয়া নিধন কার্য সম্পন্ন হবার পর যখন Social unit- Levelling বা সমতাবিধানের কাজ সম্পন্ন হয়ে যাবে, তখনি হবে মার্কসবাদী রাষ্ট্র বিলুপ্তির মাহেন্দ্রক্ষণ। কিন্তু মানুষ রাষ্ট্রের প্রয়োজন থেকে কখনো নিষ্কৃতি পেতে পারে না।

 

মানুষের জীবন কেবল শ্রেণি স্বার্থেই সীমাবদ্ধ নয়, তাদের জীবনের আরও অনেক দিক আছে, আছে অনেক দায়-দায়িত্ব। সেগুলোকে নিয়ন্ত্রিত ও সঠিকভাবে পরিচালিত করার জন্য রাষ্ট্রের প্রয়োজন থাকবে ততদিন, যতদিন ধরিত্রীর বুকে মানুষ নামক জীব বাস করতে থাকবে। অধ্যাপক লাঙ্কির ভাষায়: “To live with others is the condition of rational existence. There is in implied the necessity of government, Since the activities of a civilized community are too numerous and too complex to be left unregulated.” তাই মানুষের জীবনের শেষদিন পর্যন্ত State-এর প্রয়োজন আছে এবং থাকবে। তার থাকার উদ্দেশ্য হবে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের ভাষায় Only to enable the mass of men to realize social and on the largest possible scale. শেষ কথা, শুধু অর্থনৈতিক স্বার্থের খাতিরেই যে রাষ্ট্রের উৎপত্তি এবং স্বার্থের অবসান হলেই যে রাষ্ট্রের অবসান হবে, মার্কসবাদীদের এ বিশ্বাস একান্তই অন্ধবিশ্বাস, এক অলীক কল্পনাবিলাস। কারণ রাষ্ট্রের উদ্ভব শুধু একটি কারণেই ঘটেনি, বহু কারণই তার রয়েছে। আর মানুষের  জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সে কারণগুলো কোনো না কোনো রূপে (Form) এ অবশ্যই বর্তমান থকবে।

৭. মানুষ ও ধর্ম

ধর্মের প্রয়োজন আছে কি? এ প্রশ্নের জবাব মার্কসীয় দর্শনে নির্ভুল জবাব মিলতে পারে না। কেননা Man is a spiritual being’ বলতে মানুষের যে দিকের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে, তার কোনো চর্চা বা গবেষণা করেনি সে বিজ্ঞান-যার ওপর মার্কসীয় দর্শনের ভিত্তি। বিজ্ঞানের এত দিনকার যা কিছু শিক্ষা তাতে যান্ত্রিক বিবর্তনের নেহাৎই একটি যান্ত্রিক উৎপাদন হিসেবেই মানুষের বিচার, মানুষের পরিচয়। একদিকে অন্ধ ডারউইনীয় জীবন-সংগ্রাম আর অপরদিকে ওয়াটসনের আচরণবাদ Behaviourism-এদুয়ের মাঝে জড়জগতের ফর্মুলা ছাড়া আর কিছুর জায়গা নেই সেখানে। কিন্তু বিজ্ঞানের অগ্রগতির ফলে আজ এ ধারণার পরিবর্তন ঘটেছে। এখনকার বিজ্ঞান বলে “Science cannot deny that man recognize and acclaims truth goodness and beauty in all their forms, means higher activities are promoted and sustained by spiritual ideas by his aspirations towards truth Goodness and beauty” (Religion and the science of lift by M.C, Dougali)

বস্তুত জড়বিজ্ঞানের ফর্মুলা যে জীববিজ্ঞানে চলে না, একথা আজ বিজ্ঞান জগতেই স্বীকৃত। স্বয়ং J. H. Halane এ বিষয়ে বলেছেন “Physical science cannot express or describe biological phenomena so that its claim to represent objective reality cannot be admitted. আর ধর্মকে নিছক কু-সংস্কার বলে জড়িয়ে দেয়াও কোনো যুক্তিসংগত কাজ নয়। প্রকৃতির ভয় আতংক থেকে রক্ষা পাওয়ার ইচ্ছা এবং বুর্জোয়াদের শোষণ পীড়নের যথার্থতা প্রমাণই যে ধর্মের উদ্ভবের কারণ, একথা কেবল গায়ের জোরেই বলা যেতে পারে। ধর্মের মূলত যে কাজ, তা মানুষের সহস্রাত ধারারই অভিব্যক্তি। মানুষ এই বিশ্বপ্রকৃতি দেখে কেবল ভয়ই পায় না, অসংখ্য ও অফুরন্ত নিয়ামত পেয়ে মানুষ আল্লাহর নিকট আত্মসমর্পণও করে তাই মানুষের জীবনের Higher values ধর্মকে মানা আল্লাহর সমীপে নিজেকে সোপর্দ করে দেয়া যে তার একটি বিশেষ অঙ্গ, একথা অস্বীকার করবার কোনো উপায় নেই।

ধর্ম যদি শাসক শ্রেণির শোষণ ও নিষ্পেষণের হাতিয়ার হয়েও থাকে, তবে তা খৃষ্টানধর্ম, হিন্দু ধর্ম … ইসলাম নয়। কেননা ইসলাম সে রকম কোনো ধর্মই নয়, যা মানুষের হাতের শোষণ পীড়নের হাতিয়ার হয়ে থাকে, ইসলাম হচ্ছে একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন পদ্ধতি, যা শাসক ও শাসিত নির্বিশেষে সকলেই ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগতভাবে পালন করে চলতে বাধ্য। মূলত রাষ্ট্র ও সরকারকেই গঠিত হতে হয় চলতে হয়-দায়িত্ব পালন করতে হয় ইসলামের বিধান অনুযায়ী। তাই তা কারোর হাতিয়ার হয় না।

৮. পারিবারিক জীবন

মার্কসীয় দর্শন মতে ব্যক্তিগত সম্পত্তি প্রথার কারণেই পরিবার গড়ে উঠেছে এবং এই প্রথার বিলোপ হলেই পরিবার খতম হয়ে যাবে। কিন্তু ব্যক্তিগত সম্পত্তি বিলুপ্তির সঙ্গে সঙ্গে পরিবার প্রথারও বিলুপ্তি কি সম্ভব? পরিবার ব্যবস্থা কি এতটাই ঠুনকো? এ সম্পর্কে যত চিন্তা করা হবে প্রমাণিত হবে যে, পরিবার প্রথার উৎপত্তি সম্পর্কে মার্কসীয় দর্শন সম্পূর্ণ ভুল মত পোষণ করে। অতএব তার ভবিষ্যদ্বাণীও ভিত্তিহীন। কেননা কেবল ব্যক্তিগত সম্পত্তির কারণেই পরিবার হয়নি। মানুষের যৌনবৃত্তি, যৌবনের তাগিদ, তার সঙ্গীর সক্রিয় অনুভূতিপ্রবণ মন এগুলোও মানুষের পারিবারিক জীবনের ভিত্তিভূমি। ভাই”Being the result of plural forces the family will not get abolished by the abolition of private property” তবু জোর করেই যদি পরিবার প্রথা খতম করা হয়, তাহলে তার বিনিময়ে আমরা কী পাব? মানুষের প্রকৃতিতে তার ব্যক্তি জীবনে সে এমন একটা জায়গা চায়, যেখানে নিজের খুশীমত হাত পা ছড়িয়ে সে বলতে পারবে ‘এটা আমার পরিবারই হচ্ছে মানুষের ব্যক্তিত্ববোধ তথা তার স্বাধীন বিচরণের ক্ষেত্র। এখানে সে তার মায়ের ছেলে, স্ত্রীর-স্বামী, বোনের ভাই, সন্তানের পিতা। এরা তার সম্পত্তি নয়, এদের মায়ার বন্ধনে সে বাঁধা এবং এতেই তার পরম তৃপ্তি। এখানেই তার নিজস্ব সঞ্চরণ সম্ভব হতে পারে। কিন্তু পরিবারকে লুপ্ত করে দিলে ব্যক্তির এ বিকাশের ক্ষেত্রটাকেই একেবারে শিকড় ধরে টান দিয়ে উপড়ে ফেলা হবে। ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন মানুষের ব্যক্তিত্বটাই দমবন্ধ হয়ে মারা পড়বে। কেননা ব্যক্তির জন্যই পরিবার প্রয়োজন একথা ঠিক নয়। মানুষের সামাজিক জীবনেও প্রেম, প্রীতি ও ভালোবাসায় আবদ্ধ এ সুখনীড় একান্তই জরুরী।

সহজ কথায়, মানুষের মিলিত জীবনের সৌন্দর্য সমন্বয় ও কল্যাণের সাধনায় পারিবারিক জীবনের সেই প্রীতি ভালোবাসার শিক্ষাই হয় তার প্রধানতম ভিত্তিভূমি। তাই পরিবারকে বিচার করতে হবে মানুষের সমাজ জীবনের প্রথম Unit হিসেবে। পারিবারিক জীবনের ছোট্ট গণ্ডিতেই মানুষ শিখতে পারে পরার্থে নিজের সুখ-সুবিধা কী করে বিসর্জন দিতে হয়। কেননা The highest developments of altruism have owed muone to the family and the home than to any other influence The home and the family have fostered and developed love in the human race গত মহাযুদ্ধের সময়ে ও পরে অসংখ্য মা-বাপহাৱা শিশুর পালন কেন্দ্র খোলা হয়। এতে লালিত-পালিত শিশুদের পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে, যেসব শিশুকে বহু ধাত্রী লালন করেছে তাদের ব্যক্তিত্ব সঠিকভাবে গড়ে উঠতে পারেনি। বড় অস্থির, চঞ্চল, চরিত্রহীন হয়ে উঠেছে তারা। তাদের মধ্যে সহ ভালোবাসার কোনো লক্ষণই দেখা যায়নি। অবৈধ সন্তানদের মাঝেও দেখা গেছে হীনমন্যতা। পরিবারহীন সমাজের লক্ষ কোটি শিশু সঠিকভাবে মানুষ হয়ে গড়ে উঠতে পারে না।

শেষ কথা

আমার এই দীর্ঘ আলোচনা এখানেই শেষ করছি। আলোচনাটি দীর্ঘ হলেও মার্কসীয় দর্শনের ভ্রান্তি আমাকে খুব সংক্ষেপেই দেখাতে হয়েছে। কেননা এর ভ্রান্তি এত বেশি, এত বহুমুখী যে, তার সর্বদিক নিয়ে আলোচনা করতে গেলে দু’চারদিনের প্রয়োজন। তবে মোটামুটি ভাবে যা কিছু আলোচনা করা হলো, তার ভিত্তিতে এ কথা জোর করে বলা চলে যে, মার্কসীয় দর্শন একটা সুস্পষ্ট প্রতারণা মাত্র। মানুষকে তার মনুষ্যত্বের মহান মর্যাদা থেকে বিচ্যুত ও মানবীয় গুণ ও বৈশিষ্ট্য থেকে চিরতরে বঞ্চিত করার উদ্দেশ্যেই এ দর্শন রচিত হয়েছে। যারা এ আলোচনা গভীর দৃষ্টিতে পাঠ করবেন, আমি আশা করি, মার্কসীয় দর্শনের বিভ্রান্তি থেকে তাঁরা নিশ্চয়ই মুক্তিলাভ করবেন। একজন লোকও যদি এ থেকে সে কল্যাণ লাভ করতে পারেন, তবে আমি বুঝবো, আমার আলোচনা স্বার্থক হয়েছে।

(“প্রবন্ধটি মূলতঃ ১৯৬১ সনে তদানীন্তন ঢাকাস্থ তা’মীরে মিল্লাত সংস্থার উদ্যোগে আয়োজিত ১০ দিন ব্যাপী ইসলামী সেমিনারে প্রদত্ত একটি ভাষণ। পরে ‘চিন্তাধারা’ নামক সেমিনার সংকলনে এটি প্রকাশিত হয়। ১৯৭৬ সনে চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত একটি বিশেষ প্রবন্ধ সংকলনেও তা মুদ্রিত ও প্রকাশিত হয়েছিল।)

 

১৮৮১ বার পঠিত

শেয়ার করুন

Picture of মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম

মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম

মাওলানা মুহাম্মদ আবদুর রহীম (রহ) বর্তমান শতকের এক অনন্যসাধারণ ইসলামী প্রতিভা ! এ শতকে যে ক'জন খ্যাতনামা মনীষী ইসলামী জীবন-ব্যবস্থা কায়েমের জিহাদে নেতৃত্ব দানের পাশাপাশি লেখনীর সাহায্যে ইসলামকে একটি কালজয়ী জীবন-দর্শন রূপে তুলে ধরতে পেরেছেন, তিনি তাদের অন্যতম । এই ক্ষণজন্ম পুরুষ ১৩২৫ সনের ৬ মাঘ (১৯১৮ সালের ১৯ জানুয়ারী) সোমবার, বর্তমান পিরোজপুর জিলার কাউখালী থানার অন্তর্গত শিয়ালকাঠি গ্রামের এক সম্রােন্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন । ১৯৩৮ সালে তিনি শীর্ষীনা আলিয়া মাদ্রাসা থেকে আলিম এবং ১৯৪০ ও ১৯৪২ সালে কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসা থেকে যথাক্রমে ফাযিল ও কামিল ডিগ্ৰী লাভ করেন। ছাত্রজীবন থেকেই ইসলামের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে তার জ্ঞানগর্ভ রচনাবলি পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হতে থাকে। ১৯৪৩ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত তিনি কলিকাতা আলীয়া মাদ্রাসায় কুরআন ও হাদীস সম্পর্কে উচ্চতর গবেষণায় নিরত থাকেন। ১৯৪৬ সালে তিনি এ ভূখণ্ডে ইসলামী জীবন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার আন্দােলন শুরু করেন এবং সুদীর্ঘ চার দশক ধরে নিরলসভাবে এর নেতৃত্ব দেন ।বাংলা ভাষায় ইসলামী জ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে মওলানা মুহাম্মদ আবদুর রহীম (রহ) শুধু পথিকৃতই ছিলেন না, ইসলামী জীবন দর্শনের বিভিন্ন দিক ও বিভাগ সম্পর্কে এ পর্যন্ত তীর প্রায় ৬০টিরও বেশি। অতুলনীয় গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। তার কালেমা তাইয়েবা, ইসলামী রাজনীতির ভূমিকা', 'মহাসত্যের সন্ধানে', 'বিজ্ঞান ও জীবন বিধান', 'বিবর্তনবাদ ও সৃষ্টিতত্ত্ব, "আজকের চিন্তাধারা', "পাশ্চাত্য সভ্যতার দার্শনিক ভিত্তি’, ‘সুন্নাত ও বিদয়াত", "ইসলামের অর্থনীতি’, ‘ইসলামী অর্থনীতি বাস্তবায়ন', 'সূদমুক্ত। অর্থনীতি’, ‘ইসলামে অর্থনৈতিক নিরাপত্তা ও বীমা’, ‘কমিউনিজম ও ইসলাম', 'নারী', 'পরিবার ও শিরক ও তাওহীদ”, “আল-কুরআনের আলোকে নবুয়্যাত ও রিসালাত', "আল-কুরআনে রাষ্ট্র ও সরকারী', ইসলাম ও মানবাধিকার’, ‘ইকবালের রাজনৈতিক চিন্তাধারা’, ‘রাসূলুল্লাহর বিপ্লবী দাওয়াত’, ‘ইসলামী শরীয়াতের উৎস', 'অপরাধ প্রতিরোধে ইসলাম’, ‘অন্যায় ও অসত্যের বিরুদ্ধে ইসলাম’, ‘শিক্ষা সাহিত্য ও সংস্কৃতি’, ‘ইসলামে জিহাদ', 'হাদীস শরীফ (তিন খণ্ড) ইত্যাকার গ্রন্থ দেশের সুধীমহলে প্রচণ্ড আলোড়ন তুলেছে। এছাড়া অপ্রকাশিত রয়েছে তার অনেক মূল্যবান পাণ্ডুলিপি। মৌলিক ও গবেষণামূলক রচনার পাশাপাশি বিশ্বের খ্যাতনামা ইসলামী মনীষীদের রচনাবলি বাংলায় অনুবাদ করার ব্যাপারেও তার কোনো জুড়ি নেই। এসব অনুবাদের মধ্যে রয়েছে মওলানা মওদূদী। (রহ:)-এর বিখ্যাত তফসীর তাফহীমুল কুরআন', আল্লামা ইউসুফ আল-কারযাভী'-কৃত ‘ইসলামের যাকাত বিধান (দুই খণ্ড) ও ইসলামে হালাল হারামের বিধান', মুহাম্মদ কুতুবের বিংশ শতাব্দীর জাহিলিয়াত' এবং ইমাম আবু বকর আল-জাসসাসের ঐতিহাসিক তফসীর ‘আহকামুল কুরআন' । তার অনূদিত গ্রন্থের সংখ্যাও ৬০টিরও উর্ধে। মওলানা মুহাম্মদ আবদুর রহীম (রহ) বাংলাদেশ সহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে ইসলামী সম্মেলন সংস্থা (ওআইসি)-র অন্তর্গত। ফিকহ একাডেমীর একমাত্র সদস্য ছিলেন। তিনি ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ সূচিত “আল-কুরআনে অর্থনীতি' এবং ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর ইতিহাস’ শীর্ষক দুটি গবেষণা প্রকল্পেরও সদস্য ছিলেন। প্রথমোক্ত প্রকল্পের অধীনে প্রকাশিত দুটি গ্রন্থের অধিকাংশ প্রবন্ধ৷ তাঁরই রচিত। শেষোক্ত প্রকল্পের অধীনে তাঁর রচিত সৃষ্টিতত্ত্ব ও ইতিহাস দর্শন' নামক গ্রন্থটি এখনও প্রকাশের অপেক্ষায় । মওলানা মুহাম্মদ আবদুর রহীম (রহ) ১৯৭৭ সালে মক্কায় অনুষ্ঠিত প্রথম বিশ্ব ইসলামী শিক্ষা সম্মেলন ও রাবেতা আলমে ইসলামীর সম্মেলন, ১৯৭৮ সালে কুয়ালালামপুরে অনুষ্ঠিত প্রথম দক্ষিণ-পূর্ণ। এশীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় ইসলামী দাওয়াত সম্মেলন, একই বছর করাচীতে অনুষ্ঠিত প্রথম এশী। ইসলামী মহাসম্মেলন, ১৯৮০ সালে কলম্বোতে অনুষ্ঠিত আন্তঃপার্লামেন্টারী সম্মেলন এবং ১৯৮২ সালে তেহরানে অনুষ্ঠিত ইসলামী বিপ্লবের তৃতীয় বার্ষিক উৎসবে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন। এই যুগস্রষ্টা মনীষী ১৩৯৪ সনের ১৪ আশ্বিন (১৯৮৭ সালের ১ অক্টোবর) a দুনিয়া ছেড়ে মহান আল্লাহর সন্নিধ্যে চলে গেছেন। (ইন্না-লিল্লা-হি ওয়া ইন্না-ইলাইহি রাজিউন)
Picture of মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম

মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম

মাওলানা মুহাম্মদ আবদুর রহীম (রহ) বর্তমান শতকের এক অনন্যসাধারণ ইসলামী প্রতিভা ! এ শতকে যে ক'জন খ্যাতনামা মনীষী ইসলামী জীবন-ব্যবস্থা কায়েমের জিহাদে নেতৃত্ব দানের পাশাপাশি লেখনীর সাহায্যে ইসলামকে একটি কালজয়ী জীবন-দর্শন রূপে তুলে ধরতে পেরেছেন, তিনি তাদের অন্যতম । এই ক্ষণজন্ম পুরুষ ১৩২৫ সনের ৬ মাঘ (১৯১৮ সালের ১৯ জানুয়ারী) সোমবার, বর্তমান পিরোজপুর জিলার কাউখালী থানার অন্তর্গত শিয়ালকাঠি গ্রামের এক সম্রােন্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন । ১৯৩৮ সালে তিনি শীর্ষীনা আলিয়া মাদ্রাসা থেকে আলিম এবং ১৯৪০ ও ১৯৪২ সালে কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসা থেকে যথাক্রমে ফাযিল ও কামিল ডিগ্ৰী লাভ করেন। ছাত্রজীবন থেকেই ইসলামের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে তার জ্ঞানগর্ভ রচনাবলি পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হতে থাকে। ১৯৪৩ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত তিনি কলিকাতা আলীয়া মাদ্রাসায় কুরআন ও হাদীস সম্পর্কে উচ্চতর গবেষণায় নিরত থাকেন। ১৯৪৬ সালে তিনি এ ভূখণ্ডে ইসলামী জীবন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার আন্দােলন শুরু করেন এবং সুদীর্ঘ চার দশক ধরে নিরলসভাবে এর নেতৃত্ব দেন ।বাংলা ভাষায় ইসলামী জ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে মওলানা মুহাম্মদ আবদুর রহীম (রহ) শুধু পথিকৃতই ছিলেন না, ইসলামী জীবন দর্শনের বিভিন্ন দিক ও বিভাগ সম্পর্কে এ পর্যন্ত তীর প্রায় ৬০টিরও বেশি। অতুলনীয় গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। তার কালেমা তাইয়েবা, ইসলামী রাজনীতির ভূমিকা', 'মহাসত্যের সন্ধানে', 'বিজ্ঞান ও জীবন বিধান', 'বিবর্তনবাদ ও সৃষ্টিতত্ত্ব, "আজকের চিন্তাধারা', "পাশ্চাত্য সভ্যতার দার্শনিক ভিত্তি’, ‘সুন্নাত ও বিদয়াত", "ইসলামের অর্থনীতি’, ‘ইসলামী অর্থনীতি বাস্তবায়ন', 'সূদমুক্ত। অর্থনীতি’, ‘ইসলামে অর্থনৈতিক নিরাপত্তা ও বীমা’, ‘কমিউনিজম ও ইসলাম', 'নারী', 'পরিবার ও শিরক ও তাওহীদ”, “আল-কুরআনের আলোকে নবুয়্যাত ও রিসালাত', "আল-কুরআনে রাষ্ট্র ও সরকারী', ইসলাম ও মানবাধিকার’, ‘ইকবালের রাজনৈতিক চিন্তাধারা’, ‘রাসূলুল্লাহর বিপ্লবী দাওয়াত’, ‘ইসলামী শরীয়াতের উৎস', 'অপরাধ প্রতিরোধে ইসলাম’, ‘অন্যায় ও অসত্যের বিরুদ্ধে ইসলাম’, ‘শিক্ষা সাহিত্য ও সংস্কৃতি’, ‘ইসলামে জিহাদ', 'হাদীস শরীফ (তিন খণ্ড) ইত্যাকার গ্রন্থ দেশের সুধীমহলে প্রচণ্ড আলোড়ন তুলেছে। এছাড়া অপ্রকাশিত রয়েছে তার অনেক মূল্যবান পাণ্ডুলিপি। মৌলিক ও গবেষণামূলক রচনার পাশাপাশি বিশ্বের খ্যাতনামা ইসলামী মনীষীদের রচনাবলি বাংলায় অনুবাদ করার ব্যাপারেও তার কোনো জুড়ি নেই। এসব অনুবাদের মধ্যে রয়েছে মওলানা মওদূদী। (রহ:)-এর বিখ্যাত তফসীর তাফহীমুল কুরআন', আল্লামা ইউসুফ আল-কারযাভী'-কৃত ‘ইসলামের যাকাত বিধান (দুই খণ্ড) ও ইসলামে হালাল হারামের বিধান', মুহাম্মদ কুতুবের বিংশ শতাব্দীর জাহিলিয়াত' এবং ইমাম আবু বকর আল-জাসসাসের ঐতিহাসিক তফসীর ‘আহকামুল কুরআন' । তার অনূদিত গ্রন্থের সংখ্যাও ৬০টিরও উর্ধে। মওলানা মুহাম্মদ আবদুর রহীম (রহ) বাংলাদেশ সহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে ইসলামী সম্মেলন সংস্থা (ওআইসি)-র অন্তর্গত। ফিকহ একাডেমীর একমাত্র সদস্য ছিলেন। তিনি ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ সূচিত “আল-কুরআনে অর্থনীতি' এবং ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর ইতিহাস’ শীর্ষক দুটি গবেষণা প্রকল্পেরও সদস্য ছিলেন। প্রথমোক্ত প্রকল্পের অধীনে প্রকাশিত দুটি গ্রন্থের অধিকাংশ প্রবন্ধ৷ তাঁরই রচিত। শেষোক্ত প্রকল্পের অধীনে তাঁর রচিত সৃষ্টিতত্ত্ব ও ইতিহাস দর্শন' নামক গ্রন্থটি এখনও প্রকাশের অপেক্ষায় । মওলানা মুহাম্মদ আবদুর রহীম (রহ) ১৯৭৭ সালে মক্কায় অনুষ্ঠিত প্রথম বিশ্ব ইসলামী শিক্ষা সম্মেলন ও রাবেতা আলমে ইসলামীর সম্মেলন, ১৯৭৮ সালে কুয়ালালামপুরে অনুষ্ঠিত প্রথম দক্ষিণ-পূর্ণ। এশীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় ইসলামী দাওয়াত সম্মেলন, একই বছর করাচীতে অনুষ্ঠিত প্রথম এশী। ইসলামী মহাসম্মেলন, ১৯৮০ সালে কলম্বোতে অনুষ্ঠিত আন্তঃপার্লামেন্টারী সম্মেলন এবং ১৯৮২ সালে তেহরানে অনুষ্ঠিত ইসলামী বিপ্লবের তৃতীয় বার্ষিক উৎসবে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন। এই যুগস্রষ্টা মনীষী ১৩৯৪ সনের ১৪ আশ্বিন (১৯৮৭ সালের ১ অক্টোবর) a দুনিয়া ছেড়ে মহান আল্লাহর সন্নিধ্যে চলে গেছেন। (ইন্না-লিল্লা-হি ওয়া ইন্না-ইলাইহি রাজিউন)

মতামত প্রকাশ করুন

Scroll to Top