মানব ইতিহাসে হক ও বাতিল সভ্যতা সমূহের একটি চিত্র

এক অর্থে বলতে গেলে, মানব জাতির ইতিহাস সত্য এবং মিথ্যার দ্বন্দ্বের ইতিহাস। মানব ইতিহাসে যখন ‘হক্ব’ বা সত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তখন পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো। মানুষ সুখে শান্তিতে বসবাস করার সুযোগ পেয়েছিলো। কিন্তু যখন অসত্য ও বাতিল পৃথিবীকে শাসন করার সুযোগ পেয়েছিল সেই সময়ে পৃথিবী যেন এক অশান্তির স্থানে পরিণত হয়েছিলো। বাতিল যখন পৃথিবীর ক্ষমতার মসনদে আসীন হয়, তখন মানুষের দুঃখ-দুর্দশা বাড়তে থাকে। মানুষের উপর চালানো হয় নির্যাতনের স্টীমরোলার। যুদ্ধ ও সংঘাত ছড়িয়ে পড়ে পৃথিবীর সকল স্থানে। যখন হক্ব পৃথিবীকে শাসন করেছে আমরা সেই সময়কে ❝সত্যকে সর্বোচ্চ তুলে ধরার সময়❞ বলে আখ্যায়িত করে থাকি। আর যখন বাতিল বা মিথ্যা পৃথিবীকে শাসন করে সে সময়কে আমরা ❝শক্তিকে সর্বোচ্চে স্থানে প্রতিস্থাপনকারী ব্যক্তিদের শাসন❞ বলে গণ্য করে থাকি। এই দুইটি দৃষ্টিভঙ্গি ইতিহাসে কত সময় ধরে মানবতাকে শাসন করেছে তার একটি চিত্র দেখানো হয়েছে।

পাশ্চাত্যের ঐতিহাসিকগণ বলে থাকেন, ইতিহাস লেখার মাধ্যমে শুরু হয়েছে। তারা বলেন, সর্বপ্রথম মেসোপটেমিয়াতে লেখার সন্ধান পাওয়া গিয়েছে। এই জন্য আমরা যখন মেসোপটেমিয়ার দিকে যাই তখন দেখতে পাই, খ্রিষ্টপূর্ব ২৫০০ বছর পূর্বে সেখানে বিভিন্ন ধরণের গোত্র ছিল। তারা ধীরে ধীরে ঐক্যবদ্ধ হয়ে একটি শক্তিশালী জাতিতে রূপান্তরিত হয়। এদের মধ্য থেকে ফেরাউন ও নমরুদদের জন্ম হয়। এই নমরুদরা যখন পৃথিবীতে সবচেয়ে শক্তিশালী অবস্থানে তখন মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তার রহমান নামের উসিলায় হযরত ইব্রাহীম (আঃ) কে পৃথিবীতে প্রেরণ করেন এবং তার নেতৃত্বে পৃথিবীতে ন্যায়ভিত্তিক একটি সমাজ প্রতিষ্ঠা হয়। মানুষ তার সত্যিকারের অধিকার ফিরে পায় এবং সুখে শান্তিতে বসবাস শুরু করে। চিত্রে এ সবুজ অংশ হল হক্ব কেন্দ্রীক সভ্যতাসমূহের সময়কাল; আর লাল অংশ হল বাতিল কেন্দ্রীক সভ্যতাসমূহের সময়কাল।

এইভাবে হযরত ইব্রাহীম (আঃ) এর মাধ্যমে ন্যায়ভিত্তিক ও সত্যকে সর্বোচ্চে স্থান দানকারী একটি সময় মানুষ পায়। কিন্তু এই সময়কাল যখন চলছিল তখন মিশরে ধীরে ধীরে ফেরাউনরা শক্তিশালী হতে শুরু করে। আপনারা আমাদের চিত্রে দেখতে পাচ্ছেন, ফেরাউনরা যখন শক্তিশালী হচ্ছে তখন এই পয়েন্টে এসে একজন আরেকজনের সাথে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ছে। এখানে কাদেশ যুদ্ধ (Battle of Qadesh) সংগঠিত হয়।এই যুদ্ধে মিশরের ফেরাউনরা বিজয় লাভ করে।

ফেরাউনদের যুদ্ধে জয়ের কারণ ছিল, তারা তৎকালীন সময়ের প্রযুক্তিগত দিক থেকে উন্নত অবস্থানে ছিল। প্রযুক্তিগত দিক থেকে তাদের ভালো অবস্থান তাদেরকে বিজয়ের জন্য সামনে এগিয়ে দেয়। মিশরীয়দের যুদ্ধের গাড়ি সমূহ ছিল লোহার চাকার এবং ঘোড়া এই গাড়িকে টেনে নিয়ে যেত। তাদের লোহার চাকার এই ঘোড়ার গাড়ির দুই জন করে সৈন্য থাকতো।

আর মেসোপটেমিয়ানদের (হিতিতদের) গাড়ি চাকা ছিল পাথরের তৈরি। এটা টেনে নিত একটি ঘোড়া আর এই পাথরের চাকার গাড়িতে মাত্র একজন সৈন্য উঠতে পারত। এই একজন মাত্র লোককে একই সাথে গাড়ি চালাতে হতো আবার তীরও মারতে হত।

অপরদিকে মিশরীয়রা গাড়িতে ২ জন থাকার কারণে একজন গাড়ি চালাত আর অপরজন তীর নিক্ষেপ করতো। এ কারণে মিশরীয়রা বিজয় লাভ করে। এভাবে শক্তিকে সর্বোচ্চে স্থানদানকারী এবং বাতিল একটি চিন্তা বা সভ্যতা মিশরে অনেক বড় একটি বিজয়ী শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।

ফেরাউনরা যখন মিশরে তাদের শক্তিমত্তার সর্বোচ্চ শিখরে উপনীত হয় তখন মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মুসা (আঃ) কে দুনিয়াতে পাঠান এবং তার মাধ্যমে পুনরায় পৃথিবীতে সত্য প্রতিষ্ঠা পাওয়া শুরু করে। মুসা (আঃ) এর হক্বের উপরে প্রতিষ্ঠিত সভ্যতাকে চিত্রে সবুজ রঙে দেখানো হয়েছে। মুসা (আঃ) এর প্রতিষ্ঠিত সভ্যতা যখন পৃথিবীতে শাসন ক্ষমতায় ছিল, তখন শক্তিকে উচ্চে স্থানদানকারী অর্থাৎ বাতিলকে প্রতিনিধিত্বকারী গ্রীক সভ্যতা ধীরে ধীরে শক্তি অর্জন করে এবং সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যকে দখল করে নেয়।

গ্রীক সভ্যতা যখন শক্তিমত্তার দিক থেকে চূড়ান্ত অবস্থানে পৌঁছে তখন মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন পৃথিবীতে পুনরায় হক্বের উপর ভিত্তি করে একটি সভ্যতা প্রতিষ্ঠা করার জন্য হযরত ঈসা (আঃ) কে পাঠান এবং তিনি পৃথিবীতে সত্যের উপর ভিত্তি করে নতুন একটি সভ্যতা প্রতিষ্ঠা করেন। হযরত ঈসা (আঃ) এর প্রতিষ্ঠিত সভ্যতা যখন পৃথিবীতে সত্যের পতাকাবাহী হিসেবে কাজ করে যাচ্ছিল তখন রোমকরা ধীরে ধীরে শক্তিশালী হওয়া শুরু করে এবং ৬২২ সালে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাদের সকল শক্তির বিপরীতে হযরত মুহাম্মাদ (সঃ) কে নবুওয়াত দান করেন।

চিত্রঃ ১ এ আপনারা যেমন দেখতে পাচ্ছেন ৬২২ সালে ইসলামের জন্ম লগ্ন থেকে ইসলামী সভ্যতা কিয়ামত পর্যন্ত স্থায়ী হয়ে থাকবে। সবুজ অংশ চলতেই থাকবে।

এখন ৩৫০ বছর ধরে অর্থাৎ ১৬৮৩ সাল থেকে বর্ণবাদী সাম্রাজ্যবাদীরা জাগতিক শক্তিকে তাদের দখলে নিয়েছে, সারা পৃথিবীতে তাদের শাসন কায়েম করেছে। এই বাতিল সভ্যতা যখন থেকে দুনিয়াকে শাসন করছে সেই অংশটিকে আমাদের চিত্রে লাল রঙে দেখানো হয়েছে।

আজ আমরা বর্ণবাদী সাম্রাজ্যবাদীদের প্রতিষ্ঠিত একটি দুনিয়ায় বসবাস করছি। আজকের দুনিয়া তাদের মূলনীতির আলোকে গড়ে উঠেছে। এ পয়েন্টটি আমাদের চিত্রে দেখানো হয়েছে।

বাতিল শক্তির উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা পাশ্চাত্য সভ্যতা যে সময়কাল ধরে দুনিয়াকে শাসন করছে সে সময়কাল এবং বৃত্তের ভেতরে যে বিন্দু রয়েছে সেই বিন্দুটি একবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকের সময়কে বুঝাচ্ছে। এই জন্য আজ আমরা ইতিহাসের এক সন্ধিক্ষণে অবস্থান করছি।

প্রশ্ন হলো, বর্ণবাদী সাম্রাজ্যবাদীরা কি তাদের শাসন ব্যবস্থা চালিয়ে যাবে? নাকি ন্যয়ভিত্তিক ব্যবস্থা আসবে? নাকি মিল্লি গুরুশ (ইসলাম) আসবে? বিশ্বমানবতা কি তাদের বহুল প্রতীক্ষিত সুখ ও শান্তির একটি দুনিয়া ফিরে পাবে? আজ আমারা যে সময়ে এসে পৌঁছেছি তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি সময়। আমরাই এ প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবো। কারণ ইতিহাসের এক মাহেন্দ্রক্ষণে আজ আমরা দাঁড়িয়ে।

অনুবাদকঃ বুরহান উদ্দিন আজাদ

 

১২৮৬ বার পঠিত

শেয়ার করুন

Picture of প্রফেসর ড. নাজমুদ্দিন এরবাকান

প্রফেসর ড. নাজমুদ্দিন এরবাকান

জন্ম
প্রফেসর ড. নাজমুদ্দিন এরবাকান ১৯২৬ সালের ২৬ অক্টোবর তুরস্কের সিনপ শহরের সম্ভ্রান্ত এক মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম মেহমেদ সাবরি এরবাকান। তিনি ছিলেন তুরস্ক সরকারের একজন বিচারপতি। সরকারি কর্মকর্তা হওয়ায় তিনি বিভিন্ন শহরে বদলি হন। ফলে প্রফেসর ড. নাজমুদ্দিন এরবাকানকেও বিভিন্ন শহরে পরিবারের সাথে বসবাস করতে হয়।

শিক্ষা জীবন
প্রফেসর এরবাকান কায়সেরি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক শিক্ষা শুরু করেন। পাশাপাশি গৃহশিক্ষকদের তত্ত্বাবধানে ইসলামী শিক্ষাও গ্রহণ করতে থাকেন। প্রাথমিক শিক্ষা লাভের পর ইস্তাম্বুলে তার মাধ্যমিক শিক্ষা শুরু করেন। প্রখর মেধা ও অসীম প্রতিভা দেখে শিক্ষকগণ তাকে 'দরিয়ায়ে নাজমুদ্দিন' (জ্ঞানের সাগর) উপাধিতে ভূষিত করেন। ভালো ফলাফলধারী ছাত্র-ছাত্রীরা কোনো প্রকার ভর্তি পরীক্ষা ছাড়াই তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেতো। কিন্তু প্রফেসর ড. নাজমুদ্দিন এরবাকান ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে সমগ্র তুরস্কে প্রথম স্থান অর্জন করেন। ইস্তাম্বুল টেকনিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ দ্বিতীয় বর্ষ থেকে তার পড়াশোনা শুরু করেন। তদানীন্তন সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের জন্য নামাজের কোনো ব্যবস্থা ছিলো না।
তিনি ছাত্রদের নিয়ে আন্দোলন করে সেখানে একটি মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৪৮ সালে রেকর্ড সংখ্যক নম্বর পেয়ে তিনি প্রথম স্থান অর্জন করার মধ্যদিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যয়ন সমাপ্ত করেন। অতঃপর তিনি একই বিশ্ববিদ্যালয়ে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন। শুধুমাত্র PhD. ডিগ্রিধারী ব্যতীত অন্য কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নেয়ার সুযোগ পেতো না, কিন্তু প্রফেসর ড. নাজমুদ্দিন এরবাকানকে ক্লাস নেয়ার সুযোগ দেওয়া হয়। শিক্ষকতাকালীন এ সময়েই তিনি তার PhD'র থিসিস তৈরি করেন। উচ্চতর গবেষণার উদ্দেশ্যে ১৯৫১ সালে তিনি জার্মানির Aachen Technical University-তে গিয়ে পৌঁছেন। সেখানকার প্রখ্যাত জার্মানবিজ্ঞানী স্কিমিদ-এর সাথে বৈজ্ঞানিক গবেষণায় কাজও করেন। মাত্র দু'বছরের ব্যবধানে ৩টি থিসিস পেপার তৈরি করে PhD ডিগ্রি লাভ করেন। তার থিসিসের বিষয় ছিলো 'কীভাবে কম জ্বালানি ব্যয় সম্পন্ন ইঞ্জিন উদ্ভাবন করা যায়'। তিনি তার গবেষণায় সফল হন। তার থিসিস পেপার কটি গুরুত্বপূর্ণ জার্নালে প্রকাশিত হয়। জার্মানির বিখ্যাত ইঞ্জিন গবেষণা প্রতিষ্ঠান DEUTZ-এর ডিরেক্টর প্রখ্যাত বিজ্ঞানী প্রফেসর ডক্টর ফ্ল্যাটস তাকে Leopard Tank-এর গবেষণার জন্য আহ্বান জানান। তিনি তার ডাকে সাড়া দিয়ে Leopard Tank- কে এক অনন্যসাধারণ Tank-এ পরিণত করেন। জার্মানিতে বিভিন্ন গবেষণা এবং কর্মব্যস্ত সময় পার করে পুনরায় তুরস্কে ফিরে আসেন। আবারও তিনি ইস্তাম্বুল টেকনিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে সহকারী প্রফেসর হিসেবে যোগদান করেন। মাত্র ২৭ বছর বয়সেই তিনি এই পদ লাভের গৌরব অর্জন করেন। ১৯৫৪ থেকে ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত বাধ্যতামূলক সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করার জন্য তিনি সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। সেকেন্ড লেফটেনেন্ট হিসেবে প্রথম ৬ মাস এবং লেফটেনেন্ট হিসেবে পরবর্তী ৬ মাস কাজ করেন। প্রশিক্ষণ গ্রহণের পাশাপাশি নিয়মিত একটি সেনাবাহিনীর কেমন অস্ত্রের প্রয়োজন, এমন একটি তালিকাও প্রস্তুত করেন। আমেরিকার জনৈক ক্যাপ্টেন তালিকাটি দেখে এরবাকানের সাথে দেখা করতে চান। ক্যাপ্টেন তাকে প্রশ্ন করেন, "কেন আপনি এমন অস্ত্র তৈরির কথা ভাবছেন? এসব অস্ত্রের ব্যাপারে তুরস্ক সরকার আমেরিকার সাথে আগে থেকেই চুক্তিবদ্ধ।" জবাবে এরবাকান বলেন, "এসব অস্ত্র উৎপাদন করার ক্ষমতা আমেরিকার থাকলে আমাদের থাকবে না কেন?"
তখন তুরস্কে ইসলামী শিক্ষা নিষিদ্ধ ছিলো। ফলে, এরবাকানের পিতা গৃহশিক্ষক রেখে শিশুকাল থেকেই তাকে ইসলামী ভাবধারায় গড়ে তোলেন। পরবর্তীকালে ইস্তাম্বুলের প্রখ্যাত আলেম মেহমেদ জাহিদ কতকুর সান্নিধ্যে ইসলামী শিক্ষায় ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন। এরবাকানের বক্তব্য জুড়ে থাকতো কোরআন-হাদীসের জ্ঞান ও ইসলামের সোনালী ইতিহাস।

কর্মজীবন
সামরিক প্রশিক্ষণ শেষে তিনি পুনরায় বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেন। তিনি 'গুমুশ মোটর' নামে একটি ইঞ্জিন কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন। তুরস্কের ইতিহাসে এটিই ছিলো সর্বপ্রথম দেশীয় কোনো ইঞ্জিন কোম্পানি। তার জীবনের বড় একটি সংগ্রাম ছিলো এটি। কোম্পানি প্রতিষ্ঠায় তিনি অভ্যন্তরীণ ইহুদী লবির ষড়যন্ত্রের শিকার হন। অনেক চড়াই-উত্রাই- এর মধ্যে দিয়ে এ কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন। কোনো এক প্রোগ্রামে এত বাধা-বিপত্তির কথা শুনে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী আদনান মেন্দরেস আবেগাপ্লুত কণ্ঠে বলেন, "আগে এ সম্পর্কে জানতে পারলে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায়ই এটি করে দিতাম।" সে প্রোগ্রামে এরবাকান শিল্পায়নের উপর একটি যুক্তিপূর্ণ বক্তব্য পেশ করেন। তার এই বক্তব্যে অনুপ্রাণিত হয়ে আদনান মেন্দরেস তাঁকে Automobile ফ্যাক্টরি প্রতিষ্ঠা করতে বলেন। তিনি অল্পদিনের মধ্যেই দেভরিম নামে একটি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন। এর ক'দিন পরই এক সামরিক অভ্যুত্থানে আদনান মেন্দরেসকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। সামরিক সরকার তাকে ফাঁসি দিয়ে হত্যা করে।
ইঞ্জিন কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করার সময় এরবাকান দেখতে পান-দেশীয় শিল্প উদ্যোক্তাগণ যেন কোনোভাবেই অগ্রসর হতে না পারে সেজন্য The Union of Chambers and Commodity Exchange of Turkey এক অদৃশ্য হাতের ইশারায় দেশীয় উদ্যোক্তাদের সাথে পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ করে যাচ্ছে। এটি অবসানের জন্য তিনি এই প্রতিষ্ঠানে যোগ দেন। অল্প সময়ের ব্যবধানে প্রতিষ্ঠানটির সভাপতি নির্বাচিত হন। সভাপতি হওয়ার পরপরই সেখানে সাম্য প্রতিষ্ঠার দিকে নজর দেন। ফলে, অল্প সময়ের ব্যবধানে রাজনৈতিক শক্তির জোরে তাঁকে সেখান থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। অতঃপর তিনি প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে আসার ঘোষণা দেন।

রাজনৈতিক জীবন
১৯৬৯ সালে প্রফেসর ড. নাজমুদ্দিন এরবাকান কোনিয়া থেকে স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচন করে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি অসাধারণ এক বক্তা ছিলেন। তার বক্তব্যে সবাই বিমোহিত হতো। অল্প সময়েই তিনি একজন সুবক্তা হিসেবে সবার মনে জায়গা করে নেন। সমগ্র তুরস্কে 'ইসলাম ও বিজ্ঞান' শিরোনামে তিনি কনফারেন্স করতে শুরু করেন। (তার এ বক্তব্য বাংলা ভাষায় 'ইসলাম ও জ্ঞান' শিরোনামে অনূদিত হয়েছে)। তার শিক্ষক প্রখ্যাত আলেম মেহমেদ জাহিদ কতকু এবং অন্যান্য যুগশ্রেষ্ঠ আলেমদের পরামর্শে গঠন করেন 'মিল্লি গরুশ'। এর মাধ্যমেই তুরস্কে আনুষ্ঠানিকভাবে ইসলামী আন্দোলনের দুর্নিবার যাত্রা শুরু হয়।

মিল্লি গরুশ
তুরস্কে ইসলামের নামে যেকোনো ধরনের সংগঠন করা ছিলো নিষিদ্ধ। এ কারণে তিনি প্রতীকী শব্দ ব্যবহার করে মানুষকে ইসলাম বোঝাতেন। 'মিল্লি গরুশ' তেমনিই একটি বাক্যাংশ। 'মিল্লি গরুশ' অর্থ-জাতীয় ভিশন। অবশ্য, তিনি মিল্লি গরুশ দ্বারা মুসলিম মিল্লাতের ভিশনকেই বুঝিয়েছেন।

মিল্লি গরুশের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য:
• আধ্যাত্মিক উন্নতি। ইসলাম থেকে দূরে সরে যাওয়া জাতিকে পুনরায় ইসলামের দিকে আহ্বান এবং তাদেরকে যোগ্য মুসলিম রূপে গড়ে তোলা। বিশেষ করে যুবকদের মাঝে ইসলামের প্রচার ও প্রসার বৃদ্ধি করা।
• অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতা। আমেরিকা ও রাশিয়ার অনুকরণ না করে স্বতন্ত্রভাবে শিল্পায়ন ও প্রযুক্তিগত উন্নতি করে এক নতুন তুরস্ক গঠন। • ইসলামী ইউনিয়ন গড়ে তোলা এবং সব মুসলিমকে একই প্ল্যাটফর্মে নিয়ে এসে সাম্রাজ্যবাদীদের কালো হাত থেকে রক্ষা করা।
'মিল্লি গরুশ' প্রতিষ্ঠার পর তার রাজনৈতিক শাখা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন 'মিল্লি নিজাম পার্টি'। কিন্তু এ দলটিকে মাত্র ১ বছরের ব্যবধানে নিষিদ্ধ করা হয়। অতঃপর তিনি গঠন করেন 'মিল্লি সালামেত পার্টি'। এই দলটি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে ৪৮টি আসন লাভ করে এবং কোয়ালিশন করে শর্তভিত্তিক সরকার গঠন করে। এরবাকান সরকারের উপ-প্রধানমন্ত্রীনির্বাচিত হন (অর্থনীতি বিষয়ক)। এছাড়া তার দল থেকে মন্ত্রীসভায় শিল্পমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীও মনোনীত হয়।
এ কোয়ালিশন সরকারের সময় ইসলামী অনুশাসন মেনে চলার অপরাধে বন্দি হওয়া ৬ হাজার মুসলিমকে মুক্ত করে দেওয়া হয়। সাইপ্রাসকে গ্রীস থেকে মুক্ত করে তার্কিশ সাইপ্রাস গঠন করা ও মুসলিমদেরকে জুলুমমুক্ত করা, নতুন করে মাদ্রাসা শিক্ষার দ্বার উন্মোচন করা, হাজার হাজার কোরআন কোর্স চালু করা, মাদ্রাসার ছাত্রদের উচ্চ শিক্ষার সুযোগ দেওয়া, বদিউজ্জামান সাঈদ নুরসির রিসালা-ই-নূরের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা, সেনানিবাসসহ সব সরকারি অফিস-আদালতে মসজিদ প্রতিষ্ঠা করা-সহ ইসলামী বই-পুস্তক প্রকাশের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়। অশ্লীলতা-বেহায়াপনা দূর করার লক্ষ্যে আইন করা হয়। এছাড়া ১৯৭৪ থেকে ১৯৭৮ সালের মধ্যে তিনি ২৭০টি ভারী শিল্প কারখানা প্রতিষ্ঠা করেন। এর মধ্যে বিমান তৈরির কারখানা থেকে শুরু করে অনেক কিছুই অন্তর্ভুক্ত ছিলো। তার এই উদ্যম দেখে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি তার সাথে কোয়ালিশনে থাকা অন্য দলকে কোয়ালিশন ছিন্ন করতে বাধ্য করে।
৬ সেপ্টেম্বর ১৯৮০ সালে তুরস্কের কোনিয়াতে কুদস দিবসের সমাবেশ পালনের অভিযোগে ১২ সেপ্টেম্বর ১৯৮০ সালে সামরিক শাসকরা ক্যু করে এই পার্টিকেও নিষিদ্ধ করে। সে সাথে সব রাজনৈতিক দলকেও নিষিদ্ধ করা হয়। এরবাকানকে রাজনীতিতে নিষিদ্ধ এবং গ্রেফতার করে জেল-হাজতে প্রেরণ করা হয়।
তার ওপর এসব জুলুম-নির্যাতন এবং রাজনীতিতে তাকে নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর ১৯৮৩ সালে তিনি জেল থেকে মুক্তি লাভ করেন। মুক্তিলাভের পর দলের অন্য নেতৃবৃন্দদের দিয়ে তিনি রেফাহ পার্টি প্রতিষ্ঠা করান। এ পার্টি স্বল্প সময়েই জনপ্রিয়তা লাভ করে। ১৯৮৭ সালে গণভোটের মাধ্যমে ড. নাজমুদ্দিন এরবাকানের ওপর রাজনৈতিক নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ায় তিনি আবারও রাজনীতিতে আসেন। রেফাহ পার্টির সভাপতি নির্বাচিত হন। তিনি সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার পর পরই রেফাহ পার্টি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। এরই ধারাবাহিকতায়১৯৯৪ সালের স্থানীয় মেয়র নির্বাচনে ইস্তাম্বুল ও আঙ্কারাসহ অনেক সিটি কর্পোরেশনে তার দল বিজয় লাভ করে। এ জয়ের ধারাবাহিকতায় নতুন উদ্যোমে কাজ করে 'ন্যায়ভিত্তিক ব্যবস্থা' এই স্লোগান নিয়ে ১৯৯৬ সালে জাতীয় নির্বাচনে জয়লাভ করে সরকার গঠন করেন। কিন্তু ১১ মাস সরকার পরিচালনার পর এক সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়।
প্রফেসর ড. নাজমুদ্দিন এরবাকান তার ১১ মাসের শাসনামলে D-8 প্রতিষ্ঠা করেন। সুদের হার কমিয়ে আনেন। মাত্র ১১ মাসের শাসনামলে তিনি দেশকে ৩৩ বিলিয়ন ডলার ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করেন। সরকারি কর্মচারীদের বেতন ১০০ ভাগ বৃদ্ধি করেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ১৫০ ভাগ পর্যন্ত বৃদ্ধি করেন। জনগণের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করার দিকে মনোযোগী হন। তুরস্কে শিল্পায়নের গতি ফিরিয়ে এনে ৫ বছরের মধ্যে তুরস্কের শিল্পায়ন জাপান ও জার্মানির শিল্পায়নকে ছাড়িয়ে যাবে বলে ঘোষণা দেন।
মুসলিম দেশগুলোকে নিয়ে কমন মার্কেট চালু করেন। তার উত্তরোত্তর সফলতায় আতঙ্কিত হয়ে ইহুদীরা রেফাহ পার্টিকে নিষিদ্ধ করার লক্ষ্যে সব ধরনের প্রোপাগাণ্ডা চালায়। তার পার্টি 'শরীয়ত কায়েম করবে' এই অভিযোগে তাকে অপসারণের জন্য সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপ কামনা করে। এ অবস্থায় প্রফেসর এরবাকান এ শর্তে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তফা দেন যে, তার কোয়ালিশন পার্টির নেত্রী তানসুকে প্রধানমন্ত্রী করা হবে। কিন্তু ফ্রি ম্যাসন ও ইহুদীদের ধারক-বাহক সোলাইমান দেমিরেল বিশ্বাসঘাতকতা করে মেসুদ ইলমাজকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ঘোষণা দেয়। এভাবে রেফাহ পার্টিকে নিষিদ্ধ করার পাশাপাশি প্রফেসর এরবাকানকেও রাজনীতিতে নিষিদ্ধ করা হয়। এরপর মিল্লি গরুশের অপর নেতা রেজাই কুতানের মাধ্যমে ফজিলত পার্টি গঠন করা হয়। এই পার্টিকেও খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে নিষিদ্ধ করা হয়।
২০০১ সালের ২০ জুলাই সাদেত পার্টি তার যাত্রা শুরু করে। কতিপয় নেতা মিল্লি গরুশে তরুণ প্রজন্মের নেতৃত্ব দাবি করে। তারা মূল আন্দোলনেও লিবারেল সেক্যুলারিজম প্রতিস্থাপনের চেষ্টা চালায়। সে চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে পরবর্তীতে মিল্লি গরুশকে ভেঙ্গে তারা গঠন করেএকে পার্টি। মিল্লি গরুশ দু'ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। সা'দাত পার্টি রয়ে যায় মূলধারার ইসলামী আন্দোলন হিসেবে। সাদেত পার্টিতে নেতৃত্ব নিয়ে অনেক সমস্যার সৃষ্টি হয়। ৮৪ বছর বয়সে ২০১০ সালে প্রফেসর এরবাকানকে পুনরায় সাদেত পার্টির সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। শত প্রতিকূলতার সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও সাদেত পার্টি এখনও তাদের এ কর্মস্পৃহা ধরে রেখে এগিয়ে চলছে। বর্তমানে দলটি তুরস্কের ৪র্থ বৃহত্তম রাজনৈতিক শক্তি।

মৃত্যু
৮৫ বছর বয়সে ২০১১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি সবাইকে কাঁদিয়ে মহান প্রভুর সান্নিধ্যে পাড়ি জমান মহান এ নেতা। তার জানাযায় এত পরিমাণ লোকের সমাগম হয়েছিলো, ইস্তাম্বুলের ৩০০০ বছরের ইতিহাসে এর আগে এত লোকের সমাগম হয়নি। বিশ্বের প্রায় সব দেশ থেকেই মানুষ তার জানাযায় অংশগ্রহণ করে। মিডিয়ার ভাষ্য মতে, তার জানাযায় ৩৫-৪০ লাখ লোকের সমাগম হয়েছিলো। মৃত্যুর আগে তিনি বলে গিয়েছিলেন, মৃত্যুর পর সরকার যেন তাকে বিশেষ কোনো সম্মানে দাফন না করে।
Picture of প্রফেসর ড. নাজমুদ্দিন এরবাকান

প্রফেসর ড. নাজমুদ্দিন এরবাকান

জন্ম
প্রফেসর ড. নাজমুদ্দিন এরবাকান ১৯২৬ সালের ২৬ অক্টোবর তুরস্কের সিনপ শহরের সম্ভ্রান্ত এক মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম মেহমেদ সাবরি এরবাকান। তিনি ছিলেন তুরস্ক সরকারের একজন বিচারপতি। সরকারি কর্মকর্তা হওয়ায় তিনি বিভিন্ন শহরে বদলি হন। ফলে প্রফেসর ড. নাজমুদ্দিন এরবাকানকেও বিভিন্ন শহরে পরিবারের সাথে বসবাস করতে হয়।

শিক্ষা জীবন
প্রফেসর এরবাকান কায়সেরি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক শিক্ষা শুরু করেন। পাশাপাশি গৃহশিক্ষকদের তত্ত্বাবধানে ইসলামী শিক্ষাও গ্রহণ করতে থাকেন। প্রাথমিক শিক্ষা লাভের পর ইস্তাম্বুলে তার মাধ্যমিক শিক্ষা শুরু করেন। প্রখর মেধা ও অসীম প্রতিভা দেখে শিক্ষকগণ তাকে 'দরিয়ায়ে নাজমুদ্দিন' (জ্ঞানের সাগর) উপাধিতে ভূষিত করেন। ভালো ফলাফলধারী ছাত্র-ছাত্রীরা কোনো প্রকার ভর্তি পরীক্ষা ছাড়াই তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেতো। কিন্তু প্রফেসর ড. নাজমুদ্দিন এরবাকান ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে সমগ্র তুরস্কে প্রথম স্থান অর্জন করেন। ইস্তাম্বুল টেকনিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ দ্বিতীয় বর্ষ থেকে তার পড়াশোনা শুরু করেন। তদানীন্তন সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের জন্য নামাজের কোনো ব্যবস্থা ছিলো না।
তিনি ছাত্রদের নিয়ে আন্দোলন করে সেখানে একটি মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৪৮ সালে রেকর্ড সংখ্যক নম্বর পেয়ে তিনি প্রথম স্থান অর্জন করার মধ্যদিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যয়ন সমাপ্ত করেন। অতঃপর তিনি একই বিশ্ববিদ্যালয়ে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন। শুধুমাত্র PhD. ডিগ্রিধারী ব্যতীত অন্য কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নেয়ার সুযোগ পেতো না, কিন্তু প্রফেসর ড. নাজমুদ্দিন এরবাকানকে ক্লাস নেয়ার সুযোগ দেওয়া হয়। শিক্ষকতাকালীন এ সময়েই তিনি তার PhD'র থিসিস তৈরি করেন। উচ্চতর গবেষণার উদ্দেশ্যে ১৯৫১ সালে তিনি জার্মানির Aachen Technical University-তে গিয়ে পৌঁছেন। সেখানকার প্রখ্যাত জার্মানবিজ্ঞানী স্কিমিদ-এর সাথে বৈজ্ঞানিক গবেষণায় কাজও করেন। মাত্র দু'বছরের ব্যবধানে ৩টি থিসিস পেপার তৈরি করে PhD ডিগ্রি লাভ করেন। তার থিসিসের বিষয় ছিলো 'কীভাবে কম জ্বালানি ব্যয় সম্পন্ন ইঞ্জিন উদ্ভাবন করা যায়'। তিনি তার গবেষণায় সফল হন। তার থিসিস পেপার কটি গুরুত্বপূর্ণ জার্নালে প্রকাশিত হয়। জার্মানির বিখ্যাত ইঞ্জিন গবেষণা প্রতিষ্ঠান DEUTZ-এর ডিরেক্টর প্রখ্যাত বিজ্ঞানী প্রফেসর ডক্টর ফ্ল্যাটস তাকে Leopard Tank-এর গবেষণার জন্য আহ্বান জানান। তিনি তার ডাকে সাড়া দিয়ে Leopard Tank- কে এক অনন্যসাধারণ Tank-এ পরিণত করেন। জার্মানিতে বিভিন্ন গবেষণা এবং কর্মব্যস্ত সময় পার করে পুনরায় তুরস্কে ফিরে আসেন। আবারও তিনি ইস্তাম্বুল টেকনিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে সহকারী প্রফেসর হিসেবে যোগদান করেন। মাত্র ২৭ বছর বয়সেই তিনি এই পদ লাভের গৌরব অর্জন করেন। ১৯৫৪ থেকে ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত বাধ্যতামূলক সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করার জন্য তিনি সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। সেকেন্ড লেফটেনেন্ট হিসেবে প্রথম ৬ মাস এবং লেফটেনেন্ট হিসেবে পরবর্তী ৬ মাস কাজ করেন। প্রশিক্ষণ গ্রহণের পাশাপাশি নিয়মিত একটি সেনাবাহিনীর কেমন অস্ত্রের প্রয়োজন, এমন একটি তালিকাও প্রস্তুত করেন। আমেরিকার জনৈক ক্যাপ্টেন তালিকাটি দেখে এরবাকানের সাথে দেখা করতে চান। ক্যাপ্টেন তাকে প্রশ্ন করেন, "কেন আপনি এমন অস্ত্র তৈরির কথা ভাবছেন? এসব অস্ত্রের ব্যাপারে তুরস্ক সরকার আমেরিকার সাথে আগে থেকেই চুক্তিবদ্ধ।" জবাবে এরবাকান বলেন, "এসব অস্ত্র উৎপাদন করার ক্ষমতা আমেরিকার থাকলে আমাদের থাকবে না কেন?"
তখন তুরস্কে ইসলামী শিক্ষা নিষিদ্ধ ছিলো। ফলে, এরবাকানের পিতা গৃহশিক্ষক রেখে শিশুকাল থেকেই তাকে ইসলামী ভাবধারায় গড়ে তোলেন। পরবর্তীকালে ইস্তাম্বুলের প্রখ্যাত আলেম মেহমেদ জাহিদ কতকুর সান্নিধ্যে ইসলামী শিক্ষায় ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন। এরবাকানের বক্তব্য জুড়ে থাকতো কোরআন-হাদীসের জ্ঞান ও ইসলামের সোনালী ইতিহাস।

কর্মজীবন
সামরিক প্রশিক্ষণ শেষে তিনি পুনরায় বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেন। তিনি 'গুমুশ মোটর' নামে একটি ইঞ্জিন কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন। তুরস্কের ইতিহাসে এটিই ছিলো সর্বপ্রথম দেশীয় কোনো ইঞ্জিন কোম্পানি। তার জীবনের বড় একটি সংগ্রাম ছিলো এটি। কোম্পানি প্রতিষ্ঠায় তিনি অভ্যন্তরীণ ইহুদী লবির ষড়যন্ত্রের শিকার হন। অনেক চড়াই-উত্রাই- এর মধ্যে দিয়ে এ কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন। কোনো এক প্রোগ্রামে এত বাধা-বিপত্তির কথা শুনে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী আদনান মেন্দরেস আবেগাপ্লুত কণ্ঠে বলেন, "আগে এ সম্পর্কে জানতে পারলে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায়ই এটি করে দিতাম।" সে প্রোগ্রামে এরবাকান শিল্পায়নের উপর একটি যুক্তিপূর্ণ বক্তব্য পেশ করেন। তার এই বক্তব্যে অনুপ্রাণিত হয়ে আদনান মেন্দরেস তাঁকে Automobile ফ্যাক্টরি প্রতিষ্ঠা করতে বলেন। তিনি অল্পদিনের মধ্যেই দেভরিম নামে একটি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন। এর ক'দিন পরই এক সামরিক অভ্যুত্থানে আদনান মেন্দরেসকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। সামরিক সরকার তাকে ফাঁসি দিয়ে হত্যা করে।
ইঞ্জিন কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করার সময় এরবাকান দেখতে পান-দেশীয় শিল্প উদ্যোক্তাগণ যেন কোনোভাবেই অগ্রসর হতে না পারে সেজন্য The Union of Chambers and Commodity Exchange of Turkey এক অদৃশ্য হাতের ইশারায় দেশীয় উদ্যোক্তাদের সাথে পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ করে যাচ্ছে। এটি অবসানের জন্য তিনি এই প্রতিষ্ঠানে যোগ দেন। অল্প সময়ের ব্যবধানে প্রতিষ্ঠানটির সভাপতি নির্বাচিত হন। সভাপতি হওয়ার পরপরই সেখানে সাম্য প্রতিষ্ঠার দিকে নজর দেন। ফলে, অল্প সময়ের ব্যবধানে রাজনৈতিক শক্তির জোরে তাঁকে সেখান থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। অতঃপর তিনি প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে আসার ঘোষণা দেন।

রাজনৈতিক জীবন
১৯৬৯ সালে প্রফেসর ড. নাজমুদ্দিন এরবাকান কোনিয়া থেকে স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচন করে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি অসাধারণ এক বক্তা ছিলেন। তার বক্তব্যে সবাই বিমোহিত হতো। অল্প সময়েই তিনি একজন সুবক্তা হিসেবে সবার মনে জায়গা করে নেন। সমগ্র তুরস্কে 'ইসলাম ও বিজ্ঞান' শিরোনামে তিনি কনফারেন্স করতে শুরু করেন। (তার এ বক্তব্য বাংলা ভাষায় 'ইসলাম ও জ্ঞান' শিরোনামে অনূদিত হয়েছে)। তার শিক্ষক প্রখ্যাত আলেম মেহমেদ জাহিদ কতকু এবং অন্যান্য যুগশ্রেষ্ঠ আলেমদের পরামর্শে গঠন করেন 'মিল্লি গরুশ'। এর মাধ্যমেই তুরস্কে আনুষ্ঠানিকভাবে ইসলামী আন্দোলনের দুর্নিবার যাত্রা শুরু হয়।

মিল্লি গরুশ
তুরস্কে ইসলামের নামে যেকোনো ধরনের সংগঠন করা ছিলো নিষিদ্ধ। এ কারণে তিনি প্রতীকী শব্দ ব্যবহার করে মানুষকে ইসলাম বোঝাতেন। 'মিল্লি গরুশ' তেমনিই একটি বাক্যাংশ। 'মিল্লি গরুশ' অর্থ-জাতীয় ভিশন। অবশ্য, তিনি মিল্লি গরুশ দ্বারা মুসলিম মিল্লাতের ভিশনকেই বুঝিয়েছেন।

মিল্লি গরুশের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য:
• আধ্যাত্মিক উন্নতি। ইসলাম থেকে দূরে সরে যাওয়া জাতিকে পুনরায় ইসলামের দিকে আহ্বান এবং তাদেরকে যোগ্য মুসলিম রূপে গড়ে তোলা। বিশেষ করে যুবকদের মাঝে ইসলামের প্রচার ও প্রসার বৃদ্ধি করা।
• অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতা। আমেরিকা ও রাশিয়ার অনুকরণ না করে স্বতন্ত্রভাবে শিল্পায়ন ও প্রযুক্তিগত উন্নতি করে এক নতুন তুরস্ক গঠন। • ইসলামী ইউনিয়ন গড়ে তোলা এবং সব মুসলিমকে একই প্ল্যাটফর্মে নিয়ে এসে সাম্রাজ্যবাদীদের কালো হাত থেকে রক্ষা করা।
'মিল্লি গরুশ' প্রতিষ্ঠার পর তার রাজনৈতিক শাখা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন 'মিল্লি নিজাম পার্টি'। কিন্তু এ দলটিকে মাত্র ১ বছরের ব্যবধানে নিষিদ্ধ করা হয়। অতঃপর তিনি গঠন করেন 'মিল্লি সালামেত পার্টি'। এই দলটি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে ৪৮টি আসন লাভ করে এবং কোয়ালিশন করে শর্তভিত্তিক সরকার গঠন করে। এরবাকান সরকারের উপ-প্রধানমন্ত্রীনির্বাচিত হন (অর্থনীতি বিষয়ক)। এছাড়া তার দল থেকে মন্ত্রীসভায় শিল্পমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীও মনোনীত হয়।
এ কোয়ালিশন সরকারের সময় ইসলামী অনুশাসন মেনে চলার অপরাধে বন্দি হওয়া ৬ হাজার মুসলিমকে মুক্ত করে দেওয়া হয়। সাইপ্রাসকে গ্রীস থেকে মুক্ত করে তার্কিশ সাইপ্রাস গঠন করা ও মুসলিমদেরকে জুলুমমুক্ত করা, নতুন করে মাদ্রাসা শিক্ষার দ্বার উন্মোচন করা, হাজার হাজার কোরআন কোর্স চালু করা, মাদ্রাসার ছাত্রদের উচ্চ শিক্ষার সুযোগ দেওয়া, বদিউজ্জামান সাঈদ নুরসির রিসালা-ই-নূরের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা, সেনানিবাসসহ সব সরকারি অফিস-আদালতে মসজিদ প্রতিষ্ঠা করা-সহ ইসলামী বই-পুস্তক প্রকাশের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়। অশ্লীলতা-বেহায়াপনা দূর করার লক্ষ্যে আইন করা হয়। এছাড়া ১৯৭৪ থেকে ১৯৭৮ সালের মধ্যে তিনি ২৭০টি ভারী শিল্প কারখানা প্রতিষ্ঠা করেন। এর মধ্যে বিমান তৈরির কারখানা থেকে শুরু করে অনেক কিছুই অন্তর্ভুক্ত ছিলো। তার এই উদ্যম দেখে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি তার সাথে কোয়ালিশনে থাকা অন্য দলকে কোয়ালিশন ছিন্ন করতে বাধ্য করে।
৬ সেপ্টেম্বর ১৯৮০ সালে তুরস্কের কোনিয়াতে কুদস দিবসের সমাবেশ পালনের অভিযোগে ১২ সেপ্টেম্বর ১৯৮০ সালে সামরিক শাসকরা ক্যু করে এই পার্টিকেও নিষিদ্ধ করে। সে সাথে সব রাজনৈতিক দলকেও নিষিদ্ধ করা হয়। এরবাকানকে রাজনীতিতে নিষিদ্ধ এবং গ্রেফতার করে জেল-হাজতে প্রেরণ করা হয়।
তার ওপর এসব জুলুম-নির্যাতন এবং রাজনীতিতে তাকে নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর ১৯৮৩ সালে তিনি জেল থেকে মুক্তি লাভ করেন। মুক্তিলাভের পর দলের অন্য নেতৃবৃন্দদের দিয়ে তিনি রেফাহ পার্টি প্রতিষ্ঠা করান। এ পার্টি স্বল্প সময়েই জনপ্রিয়তা লাভ করে। ১৯৮৭ সালে গণভোটের মাধ্যমে ড. নাজমুদ্দিন এরবাকানের ওপর রাজনৈতিক নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ায় তিনি আবারও রাজনীতিতে আসেন। রেফাহ পার্টির সভাপতি নির্বাচিত হন। তিনি সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার পর পরই রেফাহ পার্টি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। এরই ধারাবাহিকতায়১৯৯৪ সালের স্থানীয় মেয়র নির্বাচনে ইস্তাম্বুল ও আঙ্কারাসহ অনেক সিটি কর্পোরেশনে তার দল বিজয় লাভ করে। এ জয়ের ধারাবাহিকতায় নতুন উদ্যোমে কাজ করে 'ন্যায়ভিত্তিক ব্যবস্থা' এই স্লোগান নিয়ে ১৯৯৬ সালে জাতীয় নির্বাচনে জয়লাভ করে সরকার গঠন করেন। কিন্তু ১১ মাস সরকার পরিচালনার পর এক সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়।
প্রফেসর ড. নাজমুদ্দিন এরবাকান তার ১১ মাসের শাসনামলে D-8 প্রতিষ্ঠা করেন। সুদের হার কমিয়ে আনেন। মাত্র ১১ মাসের শাসনামলে তিনি দেশকে ৩৩ বিলিয়ন ডলার ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করেন। সরকারি কর্মচারীদের বেতন ১০০ ভাগ বৃদ্ধি করেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ১৫০ ভাগ পর্যন্ত বৃদ্ধি করেন। জনগণের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করার দিকে মনোযোগী হন। তুরস্কে শিল্পায়নের গতি ফিরিয়ে এনে ৫ বছরের মধ্যে তুরস্কের শিল্পায়ন জাপান ও জার্মানির শিল্পায়নকে ছাড়িয়ে যাবে বলে ঘোষণা দেন।
মুসলিম দেশগুলোকে নিয়ে কমন মার্কেট চালু করেন। তার উত্তরোত্তর সফলতায় আতঙ্কিত হয়ে ইহুদীরা রেফাহ পার্টিকে নিষিদ্ধ করার লক্ষ্যে সব ধরনের প্রোপাগাণ্ডা চালায়। তার পার্টি 'শরীয়ত কায়েম করবে' এই অভিযোগে তাকে অপসারণের জন্য সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপ কামনা করে। এ অবস্থায় প্রফেসর এরবাকান এ শর্তে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তফা দেন যে, তার কোয়ালিশন পার্টির নেত্রী তানসুকে প্রধানমন্ত্রী করা হবে। কিন্তু ফ্রি ম্যাসন ও ইহুদীদের ধারক-বাহক সোলাইমান দেমিরেল বিশ্বাসঘাতকতা করে মেসুদ ইলমাজকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ঘোষণা দেয়। এভাবে রেফাহ পার্টিকে নিষিদ্ধ করার পাশাপাশি প্রফেসর এরবাকানকেও রাজনীতিতে নিষিদ্ধ করা হয়। এরপর মিল্লি গরুশের অপর নেতা রেজাই কুতানের মাধ্যমে ফজিলত পার্টি গঠন করা হয়। এই পার্টিকেও খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে নিষিদ্ধ করা হয়।
২০০১ সালের ২০ জুলাই সাদেত পার্টি তার যাত্রা শুরু করে। কতিপয় নেতা মিল্লি গরুশে তরুণ প্রজন্মের নেতৃত্ব দাবি করে। তারা মূল আন্দোলনেও লিবারেল সেক্যুলারিজম প্রতিস্থাপনের চেষ্টা চালায়। সে চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে পরবর্তীতে মিল্লি গরুশকে ভেঙ্গে তারা গঠন করেএকে পার্টি। মিল্লি গরুশ দু'ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। সা'দাত পার্টি রয়ে যায় মূলধারার ইসলামী আন্দোলন হিসেবে। সাদেত পার্টিতে নেতৃত্ব নিয়ে অনেক সমস্যার সৃষ্টি হয়। ৮৪ বছর বয়সে ২০১০ সালে প্রফেসর এরবাকানকে পুনরায় সাদেত পার্টির সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। শত প্রতিকূলতার সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও সাদেত পার্টি এখনও তাদের এ কর্মস্পৃহা ধরে রেখে এগিয়ে চলছে। বর্তমানে দলটি তুরস্কের ৪র্থ বৃহত্তম রাজনৈতিক শক্তি।

মৃত্যু
৮৫ বছর বয়সে ২০১১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি সবাইকে কাঁদিয়ে মহান প্রভুর সান্নিধ্যে পাড়ি জমান মহান এ নেতা। তার জানাযায় এত পরিমাণ লোকের সমাগম হয়েছিলো, ইস্তাম্বুলের ৩০০০ বছরের ইতিহাসে এর আগে এত লোকের সমাগম হয়নি। বিশ্বের প্রায় সব দেশ থেকেই মানুষ তার জানাযায় অংশগ্রহণ করে। মিডিয়ার ভাষ্য মতে, তার জানাযায় ৩৫-৪০ লাখ লোকের সমাগম হয়েছিলো। মৃত্যুর আগে তিনি বলে গিয়েছিলেন, মৃত্যুর পর সরকার যেন তাকে বিশেষ কোনো সম্মানে দাফন না করে।

মতামত প্রকাশ করুন

Scroll to Top