‘আমেরিকা’ শব্দটি শুনলেই আমাদের কল্পনায় ভেসে উঠে পাশ্চাত্যের সুখী সমৃদ্ধ এক সোনালী দেশের চিত্র, যেখানে রয়েছে সুখ, শান্তি, নিরাপদ সমাজ ব্যাবস্থা, শক্তিশালী গণতন্ত্র আরো কত কি! বর্তমান দুনিয়ার এই পরাশক্তি নিজেদের বিশ্বের সবচেয়ে সভ্য দেশ হিসেবে দাবি করে থাকে। তবে আমরা জানি আমেরিকা কতটুকু সভ্য। কেননা বর্ণবাদ নামক মানব বিধ্বংসী চিন্তা চেতনার বাস্তবিক প্রয়োগ যেন খোদ আমেরিকাই ৷ একবিংশ শতাব্দীর আধুনিক দুনিয়ায়ও যে দেশ থেকে “ব্ল্যাক লিভস ম্যাটার” স্লোগান উঠে আসে সে দেশটির নাম যে আমেরিকা!
আজ আমরা আমেরিকার মাটিতে সত্যিকারের মানবতার মুক্তির সংগ্রামে নেতৃত্ব দানকারী, আমেরিকাকে নতুন করে ভাবতে বাধ্যকারী এবং আমেরিকায় বীর দর্পে মুক্তি সংগ্রামের বীজ বপনকারী বর্ণবাদী সাম্রাজ্যবাদী পাশ্চাত্য সভ্যতার বিরুদ্ধে বিপ্লবী স্লোগান তোলা ম্যালকম এক্সকে আপনাদের নিকট তুলে ধরছি। যদিও ম্যালকম আমাদের কাছে অনেকটাই অচেনা, অজানা, অপরিচিত একটি নাম। আর এই অপরিচিত থাকার পিছনের মূল কারণ অপর একটি বর্ণবাদী চিন্তার ফলাফল যা মিডিয়ার মাধ্যমে প্রয়োগ করা হয়ে থাকে। মিডিয়াকে নিয়ে ম্যালকমের এই বিখ্যাত উক্তিটি যথার্খ, ম্যালকম বলেনঃ
“মিডিয়া হচ্ছে বর্তমান দুনিয়ার সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ার। মিডিয়ার মাধ্যমে তারা একজন নিরাপরাধ মানুষকে অপরাধী হিসেবে দেখাতে পারে আবার একজন অপরাধী কে নিরাপরাধ বানাতে পারে এটাই তাদের শক্তি, কারণ তারা মানুষের মন ও মগজ নিয়ন্ত্রণ করে”
ম্যালকম এক্স তথা আলহাজ্ব মালিক আশ-শাহবাজের জন্ম ১৯২৫ সালের ১৯ শে মে আমেরিকার নেব্রাস্কা অঙ্গরাজ্যের ওহামা শহরে, তাঁর পারিবারিক নাম ছিলো ম্যালকম লিটল । ইসলাম গ্রহণের পর তার নাম হয় ম্যালকম এক্স, নামের শেষে এক্স ব্যবহারের কারণ ম্যালকম তাঁর আত্মজীবনী মূলক গ্রন্থে উল্লেখ করেন, তাতে তিনি লিখেছেন মূলত তাঁর পূর্ব পুরুষ প্রকৃত আফ্রিকানদের বুঝানোর জন্য নামের শেষে এক্স লাগিয়েছিলেন । বাবা আর্ল লিটল ও মা লুইস লিটলের সাত সন্তানের মধ্যে ম্যালকম চতুর্থ। ম্যালকমের বাবা মা ছিলেন প্যান আফ্রিকান activist মার্কাস গার্ভের অনুসারি।
এ কারণে ম্যালকমের পরিবার ক্লু ক্লাক্স ক্ল্যান নামক শ্বেতাঙ্গ সন্ত্রাসী সংগঠনের দ্বারা নির্যাতনের শিকার হয়। ম্যালকমের বয়স যখন চার তখন সন্ত্রাসীরা তাদের বাড়ীঘর আগুনে জ্বালিয়ে দেয়, যার ফলে ম্যালকমের পরিবার মিশিগানে স্থানান্তরিত হয় ৷ সেখানে গিয়ে তারা মুখোমখি হয় ক্লু ক্লাক্স ক্ল্যানের শাখা ব্ল্যাক রিজিওনের। ম্যালকমের বাবা ছিলেন কৃষ্ণাঙ্গদের অধিকার রক্ষার সংগঠন Universal Negro Improvement Association (UNIA) এর স্থানীয় নেতা ৷
ম্যালকমের বয়স যখন মাত্র ছয় বছর তখন তাঁর বাবা সড়ক দূর্ঘটনায় মারা যান, যদিও তারা খবর পান তার বাবা সড়ক দূর্ঘটনায় মারা গেছে। কিন্তু ম্যালকমের মা তা বিশ্বাস করেনি, ম্যালকমের মায়ের বিশ্বাস তার বাবাকে ক্লু ক্লাক্স ক্ল্যানের লোকেরাই হত্যা করেছে, তাঁর মা পরবর্তীতে একজন শ্বেতাঙ্গ পুরুষের সাথে প্রেমের সম্পর্কে জড়ান যিনি ম্যালকমের মাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলেন কিন্তু যখন ম্যালকমের মায়ের গর্ভে সন্তান আসে তখন ওই শ্বেতাঙ্গ পুরুষ ম্যালকমের মাকে ছেড়ে চলে যায়, ম্যালকমের মা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। আর এদিকে ম্যালকমের স্থান হয় অনাথ আশ্রমে। এখানেই ম্যালকম বড় হতে লাগলেন।
ম্যালকম ছিলেন তুখোড় মেধাবী ছাত্র, ছিলেন ক্লাসের ফার্স্ট বয়, একদিন একজন শ্বেতাঙ্গ শিক্ষক ম্যালকমকে জিজ্ঞেস করেন ‘তুমি বড় হয়ে কি হতে চাও?’ উত্তরে ম্যালকম বলেন ‘আমি আইনজীবি হতে চাই’ম্যালকমের এই উত্তর শুনে ওই শিক্ষক তাকে তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলেন ‘মনে রেখো তুমি কালো, আর কালোদের এত বড় স্বপ্ন দেখতে নেই ‘
পরদিন থেকে ম্যালকম স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দেন, আর জড়িয়ে পড়েন নানা অপরাধ কর্মে। ম্যালকমের বয়স যখন একুশ, তখন বোস্টনের একটি রাস্তায় ডাকাতির সময় পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন ম্যালকম ৷ অপরাধের দায়ে আদালত ১৯৪৬ সালে ম্যালকমকে ১০ বছরের জন্য কারাদন্ড দেয়. কারাগারে থাকা অবস্থায়ই ম্যালকম ‘নেশন অব ইসলাম’ নামক একটি সংগঠনের সাথে পরিচিত হন এবং তার নেতা এলিজা মোহাম্মদকে চিঠি লিখেন, (১) এই সংগঠনটি আমেরিকার বর্ণ বৈষম্য নিয়ে কাজ করতো এবং তারা শ্বেতাঙ্গদের শ্রেষ্ঠত্বের ধারণাকে প্রত্যাখ্যান করতো । এই সংগঠনের মাধ্যমেই ইসলামের ছায়াতলে আসেন ম্যালকম। জেল থেকে বের হওয়ার পর দেখা করেন নেশন অব ইসলামের নেতা এলিজা মোহাম্মদের সাথে এবং কাজ শুরু করেন নেশনের হয়ে। ম্যালকম ছিলেন একজন অসাধারণ বক্তা। তার শব্দচয়ন ও কথা বলার ধরণ ছিলো অনন্য। আর এইসকল গুণ ম্যালকমকে খুব দ্রুত জনপ্রিয় করে তুলে আফ্রো_আমেরিকানদের মাঝে, সাধারণ আফ্রো_আমেরিকানরা নেশনের যোগ দিতে থাকে, তাই এলিজা মুহাম্মদ ম্যালকমকে ডেট্রয়েটে অবস্থিত নেশন অব ইসলামের প্রধান মসজিদের মন্ত্রী হিসেবে ঘোষণা করেন।
একদিকে যেমন খুব দ্রুত ম্যালকমের জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকলো অন্যদিকে তিনি নতুন নতুন মসজিদের দায়িত্ব নিতে লাগলেন এবং তিনটি মসজিদও নির্মাণ করে ফেলেন ৷
১৯৫৭ সালের একটি ঘটনা ম্যালকমকে পুরো আমেরিকার সামনে পরিচিত করে তোলে,
১৯৫৭ সালের ২৬ এপ্রিল ‘হিল্টন জনসন’ নামে নেশনের একজন সমর্থক নিউইয়র্কের রাস্তায় দেখতে পেলেন দুইজন পুলিশ একজন আফ্রিকানকে পিটুনি দিচ্ছে, জনসন সমস্যাটি সমাধান করতে গেলে পুলিশ উল্টো জনসনকে মেরে মারাত্মক আহত করে এবং তাকে চিকিৎসা না দিয়ে থানায় প্রেরণ করে। ম্যালকম যখনি এ সংবাদ শুনতে পেলেন তিনি সাথে সাথে থানায় আসলেন এবং তার সাথে ছিলো প্রায় চার শতাধিক মানুষ। পরিস্থিতি বিবেচনায় পুলিশ জনসনকে ম্যালকমের সাথে দেখা করার এবং প্রাথমিক চিকিৎসার সুযোগ দেয়। কিন্তু চিকিৎসা শেষে জনসনকে আবার থানায় প্রেরণ করে, অপরদিকে থানার বাহিরে ম্যালকমের সমর্থকরা জড়ো হতে লাগলো এবং ম্যালকমকে নিয়ে স্লোগান দিতে লাগলো, কিন্তু পুলিশের পক্ষ জানানো হলো পরদিন আইনজীবী না আসা পর্যন্ত জনসনকে ছাড়া হচ্ছে না, সময় বাড়ার সাথে সাথে থানার বাহিরে জটলাও বাড়তে থাকে, সেখানে প্রায় হাজার চারেক মানুষ জড়ো হয়, ম্যালকম দেখতে পেলেন সড়ক বন্ধ হয়ে যাওয়ায় শহরে অচল অবস্থা সৃষ্টি হচ্ছে, ম্যালকম থানার বাহিরে গিয়ে হাত নাড়িয়ে সমর্থকদের সরে যেতে বললেন।
অল্প কিছু সময়ের মধ্যেই পুরো রাস্তা ফাঁকা হয়ে গেছে, এই ঘটনার পর থেকে আমেরিকান পুলিশ ম্যালকমকে নজরে রাখতে শুরু করে। ১৯৬০ সালের দিকে এসে ম্যালকমের জনপ্রিয়তা আমেরিকা ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এসে পৌঁছে , বিভিন্ন গণমাধ্যম, পত্র-পত্রিকা এবং রেডিও তে নিয়মিত স্থান পেতেন গুরুত্ব সহকারে, এমনকি জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে আমন্ত্রণ পেয়েছিলেন বিশেষ অতিথি হিসেবে।
১৯৬২ সালের দিকে এসে ম্যালকম আর এলিজার সম্পর্কের যে উষ্ণতা তা হারাতে শুরু করে, যার সূচনা হয়েছিলো ১৯৬২ সালের এপ্রিলে লস এঞ্জেলস এ নেশনের আওতাধীন একটি মসজিদে বিনা কারণে পুলিশ কয়েকজন মুসল্লিকে প্রহার করলে।দ্রুতই এই ঘটনা রূপ নেয় সংঘর্ষে, এই সংঘর্ষে প্রাণ হারায় একজন এবং আহত হয় বেশ কয়েকজন, উক্ত ঘটনার রেশ ধরে পুলিশ নেশনের প্রায় অর্ধশতাধিক লোককে গ্রেপ্তার করে। এই ঘটনায় উত্তেজিত হয়ে উঠেন ম্যালকম। তিনি নেশনের কর্মীদেরকে ঢাকেন এবং একত্রিত করেন, সাথে মনস্থ করেন পুলিশকে উচিত শিক্ষা দেওয়ার, আর এজন্য অনুমিতি চান এলিজা মুহাম্মদের কাছে, কিন্তু এলিজা তাকে অনুমতি দেয়নি।
বিকল্প হিসেবে ম্যালকম চেয়েছিলেন মানবাধিকার সংগঠন গুলোকে নিয়ে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করতে, কিন্তু কোন এক অজানা কারনে এখানেও এলিজার অনুমতি মিললোনা, ১৯৬৩ সালের ২২ নভেম্বর যখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি কে হত্যা করা হয় এলিজা মুহাম্মদ এবং নেশন অব ইসলামের পক্ষ থেকে শোক প্রকাশ করা হয় কিন্তু ম্যালকম এই বিষয়ে সাংবাদিকদের বলেন “পূর্বের অপকর্ম সমধিক নেতিবাচক উপায়েই ফিরে আসে”
আর এই উক্তির ধরুন ম্যালকমকে ৯০ দিনের জন্য মিডিয়ায় কথা বলা নিষিদ্ধ করা হয়, সবকিছু মিলিয়ে ১৯৬৪ সালে ম্যালকম নেশন ত্যাগ করেন। ‘নেশন অব ইসলাম’ নামের সাথে ইসলাম থাকলেও নেশন ছিলো মূল ইসলাম থেকে অনেক দূরে, তারা যা প্রচার করতো তার সাথে ইসলামের কোন সম্পর্ক ছিলোনা, তারা রোজা রাখতোনা, হজ্ব করতোনা, এমনকি নামাজও পড়তোনা, নেশনের নেতা এলিজার বিরুদ্ধে ছিলো নারী কেন্দ্রীক অপকর্মের (অবৈধ যৌন সম্পর্ক,ধর্ষন…) বিস্তর অভিযোগ। অনেকেই ম্যালকমকে এইসব বিষয় নিয়ে বুঝানোর চেষ্টা করেন এবং মূল ইসলামে ফিরে আসার দাওয়াত দেন, কিন্তু তা কিভাবে সম্ভব? যে এলিজা মুহাম্মদের সান্নিধ্যে ম্যালকম ফিরে আসেন অন্ধকারের গলিপথ থেকে আলোর পথে সেই এলিজা মুহাম্মদ কে ছেড়ে আসার তো কোন প্রশ্নই উঠেনা !
১৯৬৪ সাল, ম্যালকমের জীবনে আসে আরেক নাটকীয় পরিবর্তন, তিনি হজ্ব করার মনস্থ করেন, অবশেষে ১৯৬৪ সালে হজ্বে গমন করে তিনি সরাসরি ইসলামের বর্ণবাদ বিরোধী চেতনাকে দেখার অভিজ্ঞতা লাভ করেন। সেই বাস্তবতায়, বর্ণবাদের মোকাবেলায় ইসলামের শিক্ষা সম্পর্কে তার উপলব্ধি তুলে ধরে তার স্ত্রীর নিকট একটি পত্র লিখেন। চিঠিটি তার বিখ্যাত আত্মজীবনীমুলক গ্রন্থ ‘দ্যা অটোবায়োগ্রাফি অব ম্যালকম এক্স’ বইটিতে পাওয়া যায়। চিঠির ভাষাটি ছিল অনেকটা এমন…
মক্কা থেকে চিঠি….
“এত আন্তরিক আতিথেয়তা এবং ভ্রাতৃত্ববোধের নমুনা আমি আর কখনো দেখিনি। অথচ মানবতাবোধ আর ভ্রাতৃত্ববোধের এই অনুপম দৃষ্টান্ত বছরের পর বছর হযরত ইবরাহীম (আ.), হযরত মুহাম্মদ (সা.) ও পবিত্র কিতাবের অধিকারী অন্যান্য নবীদের আবাসস্থল প্রাচীন এই পবিত্র ভূমি মক্কাতে পালিত হয়ে আসছে। গত কয়েক সপ্তাহে আমাকে চারপাশের প্রতিটি মানুষ যে পরিমাণ মহত্ব ও উদারতা প্রদর্শন করেছেন তাতে আমি গভীরভাবে অভিভূত। পবিত্র নগরী মক্কা নগরীতে আসতে পেরে আমি ধন্য হয়েছি। এক তরুণ মুতাওয়াফ, মুহাম্মদের নেতৃত্বে আমি কাবায় সাত চক্কর (তাওয়াফ) সম্পূর্ণ করেছি। এরপর জমজম কুপের পানি পান করেছি। সাফা ও মারওয়া পাহাড়ের মাঝে সাতবার দৌঁড়েছি, মিনায়, এবং আরাফাতের ময়দানে দাঁড়িয়ে আমি বার বার মুনাজাত করেছি।
বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা হাজার হাজার হাজীর সমাবেশ হয়েছিল এখানে। আমাদের সাথে নীল চোখের মানুষ যেমন ছিলেন, তেমনি ছিলেন সোনালী চুলের অধিকারী মানুষেরা আবার ছিলো আমার মত কালো চামড়ার আফ্রিকান সহ বিভিন্ন বর্ণের মানুষ। কিন্তু আমরা সকলেই হজ্বের একই আনুষ্ঠানিকতা পালন করছিলাম, যা ছিল একতা ও ভ্রাতৃত্ববোধের অনুপম নিদর্শন। আমি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কখনোই কৃষ্ণাঙ্গ ও শ্বেতাঙ্গদের এরূপ পাশাপাশি অবস্থান করে একই কাজ করতে দেখিনি। আমাদের মার্কিন সমাজে এই চিত্র কল্পনাও করা যায় না।
এই বাস্তবতায় আমি মনে করি, আমেরিকার নতুন করে ইসলামকে অনুধাবন করা প্রয়োজন। কেননা কেবলমাত্র ইসলামই সমাজ থেকে জাতিগত বিভেদ ও বৈষম্য দূর করতে পারে। মুসলিম উম্মাহর ভূমিগুলোয় সফরের সময় আমি এমন অনেক লোকের সাথে মিশেছি, একসাথে থেকেছি, খাবার খেয়েছি, যারা মার্কিনীদের চোখে শেতাঙ্গ বর্ণের। কিন্তু ইসলাম পালন করার কারণে তাদের মধ্যে বর্ণবাদের কোন প্রভাবই আর অবশিষ্ট নেই। আমি এর আগে কখনোই এই ধরণের কোন দৃশ্য দেখিনি।
হজ্জ্বের এই যাত্রায়, আমি যা দেখেছি এবং যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি, তা আমাকে নতুন করে চিন্তা করতে বাধ্য করেছে। এটি আমার জন্য অবশ্য খুব নতুন কিছু নয়। কেননা আমি সবসমই প্রকৃত ঘটনার মুখোমুখি হওয়ার চেষ্টা করেছি এবং নতুন অভিজ্ঞতা ও নতুন জ্ঞানের মাধ্যমে জীবনের বাস্তবতাকে সবসময় মেনে নিয়েছি। নিজের মনকে আমি সবসময় উন্মুক্ত রেখেছি, যা সত্যের বুদ্ধিবৃত্তিক অনুসন্ধান করতে আমায় সাহায্য করেছে।
গত এগারো দিনে মুসলিম বিশ্বে অবস্থানের সময়, আমি শ্বেতাঙ্গ মুসলমানদের কাছ থেকে কথা ও কাজে আমি যে ধরনের আন্তরিকতাপূর্ণ আচরণ পেয়েছি, ঠিক যেমনটা আমি নাইজেরিয়া, সুদান ও ঘানার আফ্রিকান কালো মুসলমানদের কাছ থেকে পেয়েছি। প্রকৃতপক্ষে আমরা সকলেই এক। এক আল্লাহর প্রতি তাদের বিশ্বাস তাদের মন থেকে শেতাঙ্গ বা কৃষ্ণাঙ্গের বর্ণবাদী ধারণাটিকেই বিলুপ্ত করে দিয়েছে।
আমার ধারণা, যদি শ্বেতাঙ্গ আমেরিকানরাও একইভাবে এক আল্লাহর প্রতি ঈমান আনতে পারে তাহলে তারাও হয়তো সব মানুষকে একই চোখে দেখার মত মানসিকতা অর্জন করতে পারবে। সেই সাথে কথিত বর্ণগত পার্থক্যের ভিত্তিতে অন্যদেরকে বিচার করা, হেয় করা ও ক্ষতি করার চর্চা থেকেও তারা বেরিয়ে আসতে পারবে না। হয়তো ইসলামই একমাত্র উপায় যা আমেরিকাকে আসন্ন বিপর্যয় থেকে সময়মত রক্ষা করতে পারে। কেননা এর আগে জাতিগত বিদ্বেষের পরিণামে জার্মানিরাও ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে চলে গিয়েছিল।
পবিত্র মক্কায় অবস্থান কালে আমি যা দেখছি, এই সব ঘটনা আমাকে আমেরিকার বর্ণবাদ বিষয়ে নতুন করে ভাবতে সাহায্য করছে। আমেরিকার কৃষ্ণাঙ্গদেরকে কখনোই অভিযুক্ত করা যায় না। তারা বিগত ৪ শতাব্দী ধরে শেতাঙ্গদের দ্বারা যেভাবে নির্যাতিত হচ্ছে, তারই প্রতিক্রিয়া হিসেবে মাঝে মাঝে কিছু নেতিবাচক কাজে সম্পৃক্ত হচ্ছে। এগুলো শতাব্দীকাল নিপীড়নের কিছু প্রতিক্রিয়া ছাড়া আর কিছুই নয়। তবে যেহেতু জাতিগত বিদ্বেষ আমেরিকাকে আত্মহননের পথে পরিচালিত করছে, তাই আমাদের এই ইস্যুতে নতুন করে চিন্তা করা প্রয়োজন।
আমি মক্কায় বর্ণবাদের যে আধ্যাত্মিক সমাধান পেয়েছি, আমেরিকার কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে তার প্রচলন ঘটানো উচিত। তাহলে এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়ুয়া নতুন প্রজন্মের শ্বেতাঙ্গ তরুণেরা তার বাস্তবায়ন দেখতে পারবে এবং তাতে অনুপ্রাণিত হয়ে সত্যের পথে ফিরে আসবে। হয়তো এটাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বাঁচানোর একমাত্র উপায়।
আমি এর আগে কখনোই এত সম্মান পাইনি। আবার নিজেকে কখনোই এতটা বিনয়ী ও তুচ্ছও মনে হয়নি। আমেরিকান একজন নিগ্রো এই পবিত্র ভুমিতে এসে যে সম্মান পেয়েছে তা হয়তো অনেকেই বিশ্বাস করবে না। এই তো কয়েকদিন আগেই, আমেরিকার ভাষায় ‘শ্বেতাঙ্গ’ একজন ব্যক্তি, জাতিসংঘে নিযুক্ত কূটনৈতিক, একজন রাষ্ট্রদূত, বাদশাহর একজন সহযোগী তাদের হোটেল কক্ষে তার বিছানায় আমাকে জায়গা দিয়েছিলেন। আমরা কখনো স্বপ্নেও আমেরিকাতে এই ধরনের সম্মান পাওয়ার কথা ভাবতেও পারিনা। আমেরিকায় এই ধরণের সম্মান একজন রাজার উপর বর্ষণ করা হয়, সাধারণ কোন নিগ্রো এই আচরণ পাওয়ার কথা কল্পনাও করতে পারেনা। অথচ ইসলাম আমাকে এই বিরল সম্মানটুকু দান করেছে।
আলহামদুলিল্লাহি রাব্বিল আলামীন। সকল প্রশংসাই আল্লাহর, যিনি সমগ্র বিশ্বের অধিপতি।
——-একান্তই,
(ম্যালকম এক্স)
হজ্বে যাওয়ার মাধ্যমে ম্যালকম ইসলামকে পরিপূর্ণ রূপে উপলব্ধি করেন, তিনি ফিরে আসেন পূর্বের ভ্রান্ত পথ থেকে, নিজের নাম বদলে রাখেন ‘আলহাজ্ব মালিক আশ-শাহবাজ’,
নতুন পরিচয়ে আসার পর ম্যালকম এক্স হাভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বক্তবে তার পূর্বের ওস্তাদ এলিজা মুহাম্মদ সম্পর্কে বলেন
“আমি ছিলাম এলিজার মতাদর্শের কবুতর, আর এখন সেই কবুতরটা খাঁচা থেকে বের হয়ে গেলো “
ম্যালকম লিখে গেছেন তার আত্মজীবনী মুলক গ্রন্থ “দ্যা অটোবায়োগ্রাফি অফ ম্যালকম এক্স” যেখানে তিনি লিখেছেন তার জীবনের ঘটে যাওয়া উত্থান-পতনের আদ্যোপান্ত, ম্যালকম তার আত্মজীবনী মূলক গ্রন্থ নিয়ে বলেনঃ
“বইটি যখন প্রকাশ হবে আমি যদি তখন বেঁচে থাকি তাহলে এটি হবে একটি আশ্চার্য জনক ঘটনা”
আশ্চর্যজনক হলে ও সত্য যে, বইটি প্রকাশ হওয়ার পূর্বেই ১৯৬৫ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারী হাড়কাপানো এক শীতের সকালে ম্যানহাটন এর অডুবন বলরুমে গুলি করে হত্যা করা হয় ম্যালকমকে। ‘অর্গানাইজেশন ফর আফ্রো _আমেরিকান ইউনিটির’ একটি সমাবেশে বক্তৃতা দেওয়ার জন্য তিনি সেখানে গিয়েছিলেন। আর এভাবেই সমাপ্ত হয় একজন ক্ষণজন্মা বিপ্লবীর বৈপ্লবিক ইতিহাসের।