সাহিত্যের সঙ্গে যে মানব-জীবনের অবিচ্ছেদ্য সম্বন্ধ রয়েছে তাতে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। প্রশ্ন হচ্ছে সে সম্বন্ধের রূপ নিয়ে। নানাভাবে এ সম্বন্ধের নির্ণয় হতে পারে। মানব-জীবন যেমন ব্যাপক তেমনি সাহিত্যের মধ্যেও রয়েছে ব্যাপকতা। কাজেই বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে এদের সম্বন্ধ নির্ণয়ের চেষ্টা হতে পারে। সাধারণত বলা হয়, সাহিত্য হচ্ছে মানব-জীবনের অভিব্যক্তি। মানব-জীবনে যেসব সুখ-দুঃখ ও হাসি-কান্না দেখা দেয়, তারই শিল্পসম্মত অভিব্যক্তি হলো সাহিত্য।
সাহিত্যের মাঝে সমাজ তার নিজের ছবি দেখতে পায়। সে ছবি সুখেরও হতে পারে, ব্যথা-বেদনারও হতে পারে। তবে এতেও একটি ত্রুটি থেকে যায়। কেননা, তখন আবার সাহিত্যকে মনে করা হয় নিছক Recreational বা অবসর-বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে। মানুষের হাতে যখন কোনো কাজ থাকে না তখন মানুষ একখানা নাটক, উপন্যাস বা কবিতার বই নিয়ে বসে এবং চিত্তবিনোদনের জন্য তা পাঠ করে। একথাটিও সত্যি। তবে চিত্তবিনোদন ব্যতীত সাহিত্যের অপর একটি রূপ রয়েছে-তাকে বলা হয় Recreative বা পুনঃসৃষ্টিকারী। পাঠক-পাঠিকার মনে নতুন একটা ভাব বা নতুন একটা চিন্তা গেঁথে দেওয়াও প্রকৃত সাহিত্যের কাজ। শুধু শুধু মানস-বিনোদনই যদি সাহিত্যের লক্ষ্য হতো, তাহলে এ জাতীয় পুস্তক-পুস্তিকাতেই সাহিত্য সীমাবদ্ধ হয়ে পড়তো। বাস্তবে কিন্তু সাহিত্যের অমোঘ কার্যকারিতা দেখা যায়। একখান ডিটেকটিভ উপন্যাস ও একখানা যুগান্তকারী উপন্যাস পাশাপাশি পাঠ করলেই তাদের তারতম্য স্পষ্ট উপলব্ধি করা যায়।
রোমাঞ্চকর কাহিনী কল্পনার দুয়ার খুলে দিয়ে মনকে অত্যাশ্চর্য জগতে নিয়ে যেতে পারে, কিন্তু পুস্তকখানা পাঠ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই এক অবাস্তবতা হাসির উদ্রেক করে। অপর পক্ষে প্রকৃত সাহিত্য মনের সামনে এমন এক জগতের সন্ধান দেয়, যাকে বাস্তবায়িত করা অবশ্য কর্তব্য বলেই মনে হয়। স্যার আর্থার কেনান ডয়েলের ‘এ্যাডভেঞ্চারাস অব শার্লক হোমস’র মধ্যে ডিটেকটিভ শার্লক হোমসের প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব ও গবেষণাকৌশল পাঠককে মুগ্ধ করে নিঃসন্দেহেই। তবে বাস্তব জীবনে তার প্রত্যক্ষ কোনো প্রভাব নেই। অপরদিকে, যোয়ান বোয়ারের ‘গ্রেট হাজার’ অথবা টলস্টয়ের ‘রিজারেকশন’ বা ‘আনাকারেনিনা’ কেবল সমাজ-জীবনের চিত্রাঙ্কনের মাঝেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং সুস্থ ও ন্যায়বিচারপূর্ণ সমাজ-জীবনের রূপায়ণের তাগিদের ইশারাও বহন করে। এ হিসাবে বিচার করলে Recreational and Recreative- এদুটিকেই সাহিত্যের দু’টি অবিচ্ছেদ্য অংশে হিসেবে উপস্থাপন করা যায়।
সাম্যবাদী মহলে আর্টের সংজ্ঞা নির্দেশ করে বলা হয়,
“আর্ট হচ্ছে সমাজ-জীবনের অন্তর্গত সত্তার যথার্থ প্রতিফলন। অর্থাৎ সমাজ-জীবনের যা কিছু আশা-আকাঙক্ষা সুখ-দুঃখ-সবকিছুই আর্টে প্রতিফলিত হয়।”
তবে আর্টের অপর একটি সংজ্ঞায় বলা হয়,
“আর্ট হচ্ছে শ্রেণী-সংগ্রামের একটি ধারালো অস্ত্র।”
বলা বাহুল্য, শেষোক্ত সংজ্ঞার আলোকে বিচার করলে এ দুনিয়ার বহু আর্টই এ নামের মর্যাদা থেকে বঞ্চিত হতে বাধ্য। শ্রেণিবিভাজন সকল দেশে, সকল সমাজেই রয়েছে। কেবল বিত্তবান (Haves) ও বিত্তহারা (Have nots) নিয়েই সমাজ গঠিত নয়। একই ব্যক্তি, মননের দিক দিয়ে বিত্তহারার এক পর্যায়ভুক্ত হতে পারে, আবার অন্যদিক দিয়ে অন্য শ্রেণীভুক্তও হতে পারে। টলস্টয় ছিলেন বিত্তহারার দরদী বন্ধু এবং এজন্য নিজে বিত্ত ত্যাগ করে সাধারণ কৃষকের জীবন যাপন করতে তাঁর দেশবাসীকে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। তাঁর মানসে কিন্তু এ রূপায়ণ ছিলো ধর্মীয় সাধনারই এক অঙ্গ। কাজেই তাঁকে একদিকে যেমন বিত্তহীন শ্রেণীর প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন সাধনায় মগ্ন লোকেদের শ্রেণীভুক্তও বলা যায়, তেমনি বলা যায় তাঁর সৃষ্ট সমগ্র সাহিত্যে রয়েছে ব্যষ্টিজীবনের যথার্থ স্বীকৃতি। এ ব্যষ্টি জীবন একদিকে যেমন কোথাও বা নিবিত্ত/বিত্তহারা আবার কোথাও বা বিত্তবান হয়েও মানসের দিক থেকে সর্বহারা। কাজেই আর্ট কেবল যে শ্রেণীসংগ্রামের ধারালো অস্ত্রই হবে তার কোনো অর্থ হয় না।
আর্ট কোথাও বা শ্রেণীসংগ্রামের ধারালো অস্ত্ররূপে দেখা দিতে পারে। তার উদাহরণ রয়েছে ম্যাকসিম গোর্কির ‘মা’ নামক উপন্যাসে। তবে সর্বত্র আর্ট এই একই উদ্দেশ্যে নিয়োজিত হবে বলে পূর্বস্বীকৃতি সম্পূর্ণ বাস্তবতা বর্জিত। আর্ট সম্বন্ধে এমন ধারণা পোষণ করার ফলেই সাহিত্য সম্বন্ধেও অন্য ধারণার সৃষ্টি হওয়া খুবই স্বাভাবিক, তবে এক্ষেত্রে বিশেষ প্রণিধানযোগ্য বিষয় হচ্ছে সাহিত্যের রূপ।
সমগ্র জীবনের অন্তর্ভুক্ত একটি সত্তার যথার্থ প্রতিফলন রূপেই হোক অথবা শ্রেণী-সংগ্রামের ধারালো অস্ত্রের রূপেই হোক, সাহিত্যকে পুনঃসৃষ্টিকারী (Recreative) বা অবসর-বিনোদনের সহায়ক (Recreational) হিসেবে ধারণা করাটাও বিচারযোগ্য। শ্রেণীসংগ্রামের ধারালো অস্ত্রের মন্ত্র নিয়ে দেখা দিলেও ম্যাক্সিম গোর্কির ‘মা’ Recreative বা পুনঃসৃষ্টকারী সাহিত্যরূপে সর্বত্র স্বীকৃত। কাজেই আর্টের সাহিত্যিক রূপের মধ্যে সবচেয়ে প্রণিধানযোগ্য বিষয় হচ্ছে তার কার্যকারিতা এবং মানব ও মানব-মানসের উপর তার প্রতিক্রিয়া।
এজন্যই বোধহয় ইকবাল উদাত্ত স্বরে ঘোষণা করেছিলেন: There is no opium eating in Art- অর্থাৎ আর্ট বা শিল্পের রাজ্যে আফিমের জুড়ি নেই। অর্থাং শিল্প বা সাহিত্য সম্বন্ধে পূর্ববর্তী যে সব ধারণা সাহিত্যিক মহলে প্রচলিত ছিলো এবং ইংরেজ কবি অস্কার ওয়াইল্ডের (Oscar Wilde) একটি বচনের দোহাই দিয়ে যারা বলতেন-Art for Art’s sake-শিল্পের জন্যই শিল্প—তার তীব্র প্রতিবাদ স্বরূপই ইকবাল সপ্তম সুরে বলেছিলেন-শিল্প জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন কোন মতবাদ নয়।
এ বাণী আজ সর্বত্রই স্বীকৃত। অস্কার ওয়াইল্ডের ধারণাটি আজ সাহিত্যিক মহলেও এতোটা প্রচলিত নেই। তবে ওস্কার ওয়াইল্ডের মন্তব্যের মধ্যেও একটি বিষয় প্রণিধানযোগ্য। আর্ট জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন কোন মানস-বিলাস নয়, জীবনের সঙ্গে তার অচ্ছেদ্য যোগাযোগ রয়েছে। তবে আর্ট আবার সেবাদাসীও নয়, আর্টের রাজ্যে তার স্বকীয়তা-স্বাধীনতাও রয়েছে। কোনো বিশেষ শ্রেণি, বিশেষ মানুষ বা বিশেষ গোত্রের স্বপক্ষে বা বিপক্ষে প্রচারণা আর্টের কাম্য হতে পারে না। সমগ্র মানব-জীবনই আর্টের পটভূমি। এজন্যই যে ক্ষেত্রে কোনো বিশেষ দলের প্রচারণার মাধ্যম হয়ে আর্ট দেখা দেয়, তখন স্বস্থান বিচ্যুতির ফলে আর্ট খেলো হয়ে পড়ে।
সাহিত্যের মূল বিচারে আরও একটি দিক বিশেষভাবেই বিবেচনার যোগ্য। মানব-জীবন অখণ্ড ও সামগ্রিক হলেও তাতে রয়েছে বিভিন্ন বৃত্তি ও প্রবৃত্তি। সেগুলোর ধরণ অনুযায়ী পূর্বোল্লেখিত চিত্তবিনোদনকারী সাহিত্য সৃষ্টি হতে পারে। জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ের সন্তোষদান একই জাতীয় সাহিত্যের মাধ্যমে সম্ভব না। ‘ঠাকুরমার ঝুলির’ গল্প অবোধ শিশুদের মনে আগ্রহ ও চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করতে পারে, তবে প্রাপ্তবয়স্ক লোকের কাছে তা’ সর্বদাই হাসির খোরাক জোগাবে। অপরদিকে পরিণত বয়স্ক লোকেরাও Thrillers পাঠে মনের মধ্যে অভূতপূর্ব সংবেদন অনুভব করে। তেমনি পুনঃসৃষ্টকারী (Recreative) সাহিত্যের নানাদিক থাকতে পারে। মানব-মানসে নব চিন্তার উন্মেষ, নব ভাবের প্রেরণা দানে বা নব ইচ্ছাশক্তি বলে বলীয়ান করাতে এজাতীয় সাহিত্য সক্ষম হ’তে পারে। মোদ্দাকথা, মানব-মানসের প্রতিটি স্তরের সাথে সম্পর্কিত বিষয়াবলি যদি সাহিত্যের মূল বিষয়বস্তু হয়, তাতেই আসে সাহিত্যের সার্থকতা আর এটাই সাহিত্যের চরম উৎকর্ষতা। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, স্পিনোজার সারবস্তু (Substance) মননশীল জগতে যে ভাবনা-চিন্তার উদ্রেকে সফল হয়েছে, জোকোবির (Jacobi) প্রার্থনা ঠিক তেমনিই ভক্তদের কাছে এক নতুন জগতের সন্ধান দিয়েছে। ওয়ালট হুইটম্যানের (Walt Whitman) আহ্বান তেমনি মানব মনের ইচ্ছাশক্তিকে এক অভিনব দোল দিয়েছে।
ব্যষ্টির দিক থেকে হোক অথবা সমষ্টির দিক থেকে হোক, সাহিত্যের সঙ্গে সমাজের রয়েছে অঙ্গাঙ্গী সম্বন্ধ। সাহিত্য ব্যষ্টি বা শ্রেণীতে আনন্দ পরিবেশন করে। সাহিত্য আবার কোনো একটি বিশেষ ভাবাদর্শে মানব-জীবনকে উদ্বুদ্ধ করে। মানব-জীবন ব্যাপক হওয়ায় তার সাহিত্যেও রয়েছে ব্যাপকতা। কোথাও বা আনন্দদানকারীরূপে সে মানব-জীবনের একটি বিশেষ দিককে আনন্দ পরিবেশন করে আবার কোথাও একটি বিশেষ দিকের আদর্শের প্রতি সমাজ-মানসকে উদ্বেলিত করে।