ইসলামী সভ্যতা জ্ঞানকে যে পরিমাণ গুরুত্ব দিয়েছে এবং যে উচ্চ মর্যাদার আসনে সমাসীন করেছে, অন্য কোন সভ্যতা এত গুরুত্ব কখনো দেয়নি, এত উচ্চ মর্যাদাও প্রদান করেনি। ইসলাম অন্য সকল সভ্যতার মাঝে নিজেকে একটি জ্ঞানভিত্তিক সভ্যতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। জ্ঞানের মাধ্যমে ইসলাম নিজেকে অন্য সভ্যতাসমূহ থেকে আলাদা করে থাকে। এ জন্য ইসলাম তার পূর্বের সমস্ত সময়কে আইয়্যামে জাহেলিয়াত (মূর্খতার যুগ) বলে উল্লেখ করেছে।
রাসূলে আকরাম (স.) একটি হাদীসে ইরশাদ করেছেন;
“যারা জ্ঞান অর্জন করে, ফেরেশতারা তাদের জন্য নিজেদের পাখাকে বিছিয়ে দেয়। আসমান-জমিনের মাঝে যা কিছু আছে, সবই যারা জ্ঞানার্জন করে তাদের জন্য দোয়া করে। এমনকি সাগরের মাছ পর্যন্ত তাদের জন্য দোয়া ও ইস্তেগফার করে।”
আলেমরা নবীগণের উত্তরাধিকারী। মহাগ্রন্থ আল কুরআন আলেমদেরকে হাদীসের চেয়ে বেশি উচ্চ মর্যাদায় আসীন করেছে।
شَهِدَ اللَّهُ أَنَّهُ لَا إِلَٰهَ إِلَّا هُوَ وَالْمَلَائِكَةُ وَأُولُو الْعِلْمِ قَائِمً بِالْقِسْطِ ۚ لَا إِلَٰهَ إِلَّا هُوَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ
“আল্লাহ রব্বুল আলামীন ফেরেশতাদের সাথে সাথে আলেমদেরও তাঁর অস্তিত্বের সাক্ষী করেছেন।”
অন্য একটি আয়াতে বলা হয়েছেঃ
قُلْ هَلْ يَسْتَوِي الَّذِينَ يَعْلَمُونَ وَالَّذِينَ لَا يَعْلَمُونَ ۗ إِنَّمَا يَتَذَكَّرُ أُولُو الْأَلْبَابِ
“যারা জানে আর যারা জানে না, তারা উভয়ে কি কখনো এক হতে পারে?”
অন্য আরেকটি আয়াতে বলা হয়েছেঃ
انما يخشى الله من عباده العلماء
“কেবলমাত্র যারা জ্ঞানী, তারাই আল্লাহকে সবচেয়ে বেশি ভয় করে।”
এখন প্রশ্ন হল আলেম কে?
- আল্লাহ এবং রাসূল (স.) যে আলেমের প্রশংসা করছেন, সে আলেম কে?
- কীভাবে আলেম হওয়া যায়?
- কোন জ্ঞান অর্জন করলে সত্যিকারের আলেম হওয়া যায়?
- শুধুমাত্র কিছু তথ্য উপাত্ত জানলেই কি আলেম হওয়া যায়?
যেমনঃ উইকিপিডিয়ায় সকল তথ্য রয়েছে, তার মানে উইকিপিডয়া আলেম?
গুগল! এমন কোন তথ্য নেই যা সে জানে না। সকল তথ্যকে সে নিজের মাঝে সংরক্ষণ করে রেখেছে। এ কারণে কি আমরা গুগলকে আলেম বলবো?
ইলম কি শুধুমাত্র তাফসীর এবং হাদিস? কিংবা শুধু কালাম এবং তাসাউফ? পদার্থ বিজ্ঞান, রসায়নসহ আরো যে সকল জ্ঞান রয়েছে, যা মহান আল্লাহ রব্বুল আলামীনের সৃষ্টিতত্ত্বকে বুঝতে সহায়তা করে, এগুলো কি ইলম বা জ্ঞান নয়? যারা এ জ্ঞান অর্জন করে আমরা কি তাদের আলেম বলবো না? তাহলে আমরা কি বলবো ইমাম গাজ্জালী আলেম আর ইবনে সিনা আলেম নন? আমরা কি বলবো ইবনে তাইমিয়্যাহ আলেম কিন্তু আল ফারাবী আলেম নন?
অনেক জ্ঞানার্জন করার পরেও যদি একজন মানুষ তার কর্মে জ্ঞানের প্রতিফলন না ঘটান, তবে কি আমরা তাকে আলেম বলতে পারবো?
আমল কি আলেম হওয়ার জন্য শর্ত?
কোন মানুষের মধ্যে যদি ইখলাস না থাকে, তবে তাকে কি আলেম বলা যাবে? আমরা যদি এ সকল প্রশ্নের সঠিক জবাব দিতে পারি, তাহলেই একজন মানুষ সত্যিকারার্থে কীভাবে আলেম হতে পারেন এবং আলেম কাকে বলে– এ প্রশ্নের উত্তর পেতে পারি।
প্রথমত ইলম শব্দকে বুঝতে হবে। ইলমের উদ্দেশ্য কী? শুধু কুরআনের আয়াতসমূহকে বুঝানোর ক্ষেত্রে গঠিত ইলমুত তাফসীরই ইলম, নাকি সমগ্র সৃষ্টিতত্ত্বকে বুঝানোর ক্ষেত্রে যে জ্ঞান রয়েছে সেগুলোও ইলম?
এ বিষয়কে আমরা কীভাবে বুঝবো? ইসলামী সভ্যতার সবচেয়ে ভঙ্গুর পয়েন্ট হল জ্ঞানকে দ্বীনি এবং দ্বীনি নয় (দুনিয়াবী)– এভাবে বিভাজন করা। এটিই সবচেয়ে বিপজ্জনক পয়েন্ট। কারণ এটি একটি সেক্যুলার বিভাজন। মহান রব্বুল আলামীনের আয়াতসমূহকে ব্যাখ্যাকারী তাফসীরসমূহ যে রকম ইলম, তেমনি মহান আল্লাহ রব্বুল আলামীনের এই পৃথিবীকে ব্যাখ্যাকারী যত জ্ঞান রয়েছে সেগুলোও ইলম।
তাকবীনী আয়াতসমূহ তথা এই পৃথিবী, সৃষ্টিজগতের সাথে সম্পর্কিত আয়াতসমূহ এবং তানজীলী তথা কুরআনের আয়াতসমূহকে আমরা একটি অন্যটির থেকে পৃথক করতে পারবো না।
কারণ আমরা যখন কুরআন পড়ি, তখন কুরআন আমাদের তাকবীনী আয়াতসমূহ তথা সৃষ্টির দিকে নিয়ে যায়।
الذين يتفكرون في خلق السموات والأرض
এই আয়াতে সৃষ্টিতত্ত্ব নিয়ে, আকাশ ও জমিনের সৃষ্টি নিয়ে গবেষণা করতে বলা হয়েছে।
إِنَّ فِي خَلْقِ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَاخْتِلَافِ اللَّيْلِ وَالنَّهَارِ لَآيَاتٍ لِّأُولِي الْأَلْبَابِ
وَمِنْ آيَاتِهِ خَلْقُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَاخْتِلَافُ أَلْسِنَتِكُمْ وَأَلْوَانِكُمْ ۚ إِنَّ فِي ذَٰلِكَ لَآيَاتٍ لِّلْعَالِمِينَ
وَمِنْ آيَاتِهِ خَلْقُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَاخْتِلَافُ أَلْسِنَتِكُمْ وَأَلْوَانِكُمْ ۚ إِنَّ فِي ذَٰلِكَ لَآيَاتٍ لِّلْعَالِمِينَ
এখানে যে আয়াতগুলো তিলাওয়াত করা হয়েছে, এগুলোতে শুধুমাত্র কুরআনের আয়াতসমূহ নয়, একই সাথে সৃষ্টিতত্ত্ব নিয়েও বলা হয়েছে। পৃথিবীতে যে আয়াতসমূহ রয়েছে, সেগুলোর কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। এ জন্য এ আয়াতসমূহের মাঝে কখনোই বিভাজন সৃষ্টি করা যাবে না। তাওহীদুল উলুম তথা জ্ঞানের মধ্যকার তাওহীদ, তাওহীদুর রবুবিয়্যাত তথা স্রষ্টার তাওহীদের মতই গুরুত্বপূর্ণ।
আমরা জ্ঞানকে দ্বীনি-অদ্বীনি, ইসলামিক-অনৈসলামিক, শরয়ী-গায়রে শরয়ী এভাবে পার্থক্য করতে পারবো না। আমরা জ্ঞানকে শুধু উপকারী এবং অপকারী হিসেবেই পার্থক্য করতে পারি। এ জন্য রাসূল (স.) এরশাদ করেছেন, “আমি সে জ্ঞান থেকে পানাহ চাই, যে জ্ঞান কোন ধরণের উপকার করে না।”
অনুবাদঃ বুরহান উদ্দিন আজাদ


