আল্লামা ইকবাল বলেছিলেন, “হে ভাই! যদি ভালো একজন ইব্রাহীম হতে চাও, তাহলে যুগের নমরুদদের ভালো করে চিনে নাও।” তাঁর এ কথাটি ব্যাখ্যার প্রয়োজন হয় না, কারণ এটি নিজেই একটি ব্যাখ্যা।
হযরত ওমর (রাঃ) বলেছিলেন, “যে জাহেলিয়াত সম্পর্কে জানে না, সে ইসলাম সম্পর্কেও জানে না।”
এক্ষেত্রে নবী-রাসূলদের সংগ্রামকে পর্যালোচনা করে যদি আমরা প্রশ্ন রাখি, হযরত ইব্রাহীম (আঃ) এর শত্রু বলতে এখানে কী বোঝানো হয়েছে? শুধুই কি কোন রাষ্ট্রনায়ক বা শাসকগোষ্ঠীকে বোঝানো হয়েছে? নাকি তৎকালীন সময়ের কোন মানবতার শত্রু মানব বিধ্বংসী শক্তিকে বোঝানো হয়েছে?
হযরত মুসা (আঃ) এর সংগ্রামকে ব্যাখ্যা করতে গেলে ফেরাউনের জুলুমকে সামনে রাখতে হয়। কিন্তু এক্ষেত্রে যদি আমরা শুধু শাসকগোষ্ঠী বা রাষ্ট্রনায়ককে শত্রু হিসেবে সংজ্ঞা দেই, তবে সম্ভবত ব্যাপারটা সঠিক নাও হতে পারে। কারণ তৎকালীন অর্থনৈতিক জুলুমের পৃষ্ঠপোষক কারূনও মূসা (আঃ) এর সংগ্রামের ক্ষেত্রে সমানভাবে প্রাসঙ্গিক, সেই সাথে প্রাসঙ্গিক ধর্মীয় গুরু বালাবুরিও। মুসা (আঃ) কে ফেরাউনের বিরুদ্ধে তথা শুধু রাজনৈতিক দিক থেকেই সংগ্রাম করতে হয়নি, একই সাথে সংগ্রাম করতে হয়েছে অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় দিক থেকে জুলুমকারীদের বিরুদ্ধে; যারা ছিল মানব বিধ্বংসী শক্তির প্রকৃষ্ট উদাহরণ। আবার এমন অনেক নবী-রাসূল এসেছেন, যাদের সংগ্রামের ক্ষেত্র শাসকগণ নয়, বরং ভিন্ন কোন শক্তি বা জুলুম। ।
রাসূল (সাঃ) এর জীবনের দিকে লক্ষ্য করলেও দেখবো, মাদানী যুগের চ্যালেঞ্জগুলো ছিল রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি এবং প্রশাসনকেন্দ্রিক; অর্থাৎ ব্যবস্থাগত চ্যালেঞ্জ, যা সমাধানের জন্য মানব সভ্যতার সামনে নতুন ন্যায়ভিত্তিক ব্যবস্থার মডেল তুলে ধরা হয়েছিল।
মোদ্দাকথা হলো, নবী-রাসূলদের সংগ্রামের ক্ষেত্র ছিল ভিন্ন ভিন্ন, যা আবর্তিত হতো তাঁদের সময়কালীন চ্যালেঞ্জ, যুগের প্রেক্ষাপটকে ঘিরে। আর এর মধ্য দিয়েই জন্ম নিতো ভবিষ্যৎ সভ্যতার বিকল্প রূপরেখা। এক্ষেত্রে যদি আমরা মূল পয়েন্ট নির্ণয় করতে চাই, তবে একটি বিষয় স্পষ্টভাবে বুঝতে পারব ‘তাঁদের সংগ্রাম ছিল তৎকালীন সময়ে শান্তি বিনষ্টকারী, জুলুমকারী, শোষণকারী শক্তির বিরুদ্ধে’। আর এই সংগ্রামের মধ্যে দিয়েই রাসূল(সা) পরবর্তী ইসলামী সভ্যতার সকল চ্যালেঞ্জকে মোকাবেলা করে উপহার দিয়েছিলেন একটি নতুন পৃথিবী, একটি আদালতপূর্ণ ব্যবস্থা; যা হাজার বছর স্থায়ী হয়েছে।
কিন্তু ১৬৮৩ সালের পর থেকে অর্থনৈতিক শক্তি এবং আঠারো শতকের পরে গোটা বিশ্বব্যবস্থা বর্ণবাদী, সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠীর হাতে অর্পিত হয়। অতঃপর সংঘটিত হলো প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, যার অন্যতম উদ্দেশ্য মুসলিম সালতানাতকে ধ্বংস করা, যার ফলে মুসলমানদের বিভক্ত ও নিঃশেষ করার কার্যক্রম সফলতার মুখ দেখে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর শোষিত অঞ্চলগুলো স্বাধীনতা লাভ করতে শুরু করলেও নয়া মোড়কের সাম্রাজ্যবাদী শক্তির নিকট নতুনভাবে আটকা পড়ে। মুসলমানরাও ক্রমেই নাজুক অবস্থায় নিপতিত হয়, যা বর্তমানে আরও বেগবান হয়েই চলেছে।
ফলশ্রুতিতে বিশ্বব্যবস্থা আজ গোলামীর জিঞ্জিরে আবদ্ধ। গোটা মানবতা এক কঠিন ও গুরুত্বপূর্ণ সময়ের মধ্য দিয়ে দিন অতিবাহিত করছে। ইতিহাসের এই যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত গ্রহণের মাহেন্দ্রক্ষণে এসে আমাদের সামনে প্রশ্ন হলো, দুনিয়ার শাসনভার কি বর্ণবাদী, সাম্রাজ্যবাদীদের হাতেই থাকবে? নাকি মানবতা একটি ন্যায়ভিত্তিক সমাজে পুনঃপ্রত্যাবর্তন করবে? দুনিয়া এভাবেই বসবাসের অযোগ্য হতে হতে ধ্বংসের দিকে ধাবিত হবে, নাকি নতুন সভ্যতার পুনর্জাগরণের মাধ্যমে একটি নতুন বসবাসযোগ্য দুনিয়া আমরা গড়ে তুলবো?
সুতরাং আমরা, উম্মাহর সন্তানেরা কি সেই মানব বিধ্বংসী এ যুগের ফেরাউনদের চিনি ও জানি? তাদের কর্মপন্থার পর্যালোচনা করতে পারি? কিভাবে নতুন সভ্যতা আসবে সে পরিকল্পনা করি? কেউ করলেও সেটা কি বুঝতে পারি?
অথচ আমরা সবাই লক্ষ্য করছি, কতিপয় গোষ্ঠী সমগ্র মানবতাকে দুর্বিষহ যন্ত্রণার দিকে ঠেলে দিয়েছে! বঞ্চিত ও শোষিত মানুষের সংখ্যা গাণিতিক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে! পৃথিবীর ৬০% মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছে, তিনশো কোটি মানুষ স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত। প্রতিদিন প্রায় দুই লক্ষ মানুষ মারা যাচ্ছে খাদ্য ও চিকিৎসার অভাবে! একশো কোটির বেশি মানুষকে প্রতি রাতে না খেয়ে ঘুমাতে হয়। আর এভাবে চলতে থাকলে ৯০% মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাবে, খাদ্য ও স্বাস্থ্যনীতির কারণে গড় আয়ু চল্লিশের কোঠায় নেমে আসবে, যা ভয়াবহ অশনি সংকেত বহন করছে। খাদ্যের অভাবে আফ্রিকার শিশুরা বেহিসেবে মারা যাচ্ছে! উপমহাদেশে বেকারত্বের অভিশাপে যুবকেরা আত্মহত্যা করছে!
আর উল্টো দিকে পাশ্চাত্যের ছয়টি দেশে কুকুর-বিড়ালের খাবারের জন্য এক সপ্তাহে ব্যয় হচ্ছে ৭০০ মিলিয়ন ডলার! নারীদের প্রসাধনী ও মেকআপের জন্য প্রতিবছর ব্যয় হয় ৬৬ মিলিয়ন ডলার। দুনিয়ার সবচেয়ে বড় দশ জন ধনীর সম্পদের পরিমাণ ১৩৩ বিলিয়ন ডলার, অপরদিকে সবচেয়ে দরিদ্র দেশের মোট ঋণের পরিমাণ ৬ বিলিয়ন ডলার! যেখানে গোটা পৃথিবীর দরিদ্রতা বিমোচনের জন্য প্রয়োজন ১০০ বিলিয়ন ডলার, সেখানে এক আমেরিকা প্রতি বছর ফুটবলের পেছনে ব্যয় করে ৬০০ বিলিয়ন ডলার।
সামগ্রিকভাবে বলতে গেলে এই বৈষম্যমূলক অবস্থা শুধু অর্থনীতিতে নয়; সকল খাতে, সকল ব্যবস্থায় বিদ্যমান। সকল অঞ্চলের মানুষ তাদের অধিকার, চাহিদা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, নির্যাতিত হচ্ছে, শোষিত হচ্ছে। কিন্তু এ ভারসাম্যহীন পরিস্থিতি কাদের কারণে সৃষ্টি হচ্ছে? কারা সেই মানব বিধ্বংসী শক্তি?
প্রথমেই উত্তর হিসেবে আসবে ‘বর্তমান পাশ্চাত্য সভ্যতা, জায়নবাদী শক্তি’, যা ফেরাউনী সভ্যতার আধুনিক ভার্সন। কিন্তু শুধু এ উত্তরই কি শত্রু-মিত্র নির্ণয়ের যথেষ্ট? দায়ভার আর কারো উপর বর্তায় না?
গোটা মানবতা যখন এমন কঠিন, ভারসাম্যহীন পরিস্থিতির স্বীকার হচ্ছে, তখন একটি বিষয় তীব্রভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে, তা হলো বিশ্বব্যবস্থার কেন্দ্রস্থল মুসলিম উম্মাহর সন্তানদের দুর্দশা, বর্তমানে তাদের অবস্থানগত সঙ্কট। মুসলিম উম্মাহর প্রধান ভিত্তি ইসলামী সভ্যতার প্রত্যেকটি সঙ্কটকালকে পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, সে সময় হাল ধরা প্রত্যেক ব্যক্তিত্ব বা নেতৃত্ব যুগকে বিশ্লেষণ করেছিলেন, পর্যালোচনা করেছিলেন, এককেন্দ্রীক না হয়ে সব ধরণের চ্যালেঞ্জকে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে বুঝে তা মোকাবেলায় নতুন প্রস্তাবনা তৈরি করেছিলেন। মোঙ্গল পরবর্তী সময়ে ইবনে খালদুন, ইমাম গাজ্জালীদের কর্মকান্ড তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ।
‘যুগকে বুঝা ব্যতীত অতীতকে বিশ্লেষণ করা সম্ভব নয়, আর অতীতকে বিশ্লেষণ ব্যতীত ভবিষ্যত বিনির্মাণও সম্ভব নয়’।
কিন্তু আমরা কি সেভাবে যুগকে বিশ্লেষণ করতে পারছি? পাশ্চাত্য জায়নবাদীদের (ফেরাউনী সভ্যতার) দখলে থাকা ইতিহাসের এই ভয়ানক টার্নিং পয়েন্টে দাঁড়িয়ে আমাদের নিকট অতীত ও বর্তমানকে খুব ভালোভাবে বুঝে সর্বদা মস্তিষ্কে জাগ্রত রাখতে পারছি?
এছাড়া কিভাবেই-বা বর্তমান দুনিয়ার শত্রু-মিত্র চিহ্নিত করা সম্ভব হবে? কিভাবে সম্ভব হবে রাজনৈতিক বোঝাপড়ায় নিজেদের স্বচ্ছতায় আবৃত্ত করে রাখা? যুগকে ব্যাখ্যা করা এবং শত্রু-মিত্র নির্ণয়ে অতীত ও বর্তমানের যে সকল প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করার কোন বিকল্প নেই তা হলো-
- ইসলামী সোনালী সভ্যতার স্বরূপ কেমন ছিল?
- পাশ্চাত্যের উত্থানকালীন সময়ে বিভিন্ন মৌলিক বিষয়ের আলোকায়ন কোন কেন্দ্রিক ছিল?
- পাশ্চাত্যের উত্থান প্রক্রিয়া ও পর্যায়গুলো কী? এবং তাদের গৃহীত পদক্ষেপগুলো কী ছিল?
- পাশ্চাত্যের ক্ষমতায়ন পরবর্তী বিশ্বব্যবস্থা কেমন ছিল এবং কিভাবে তা ধাপে ধাপে জুলুমপূর্ণ অবস্থার মধ্যে নিপতিত হল? মুসলিম উম্মাহর ক্ষমতা হারানোর প্রক্রিয়া কেমন ছিল?
- সমগ্র দুনিয়ায় শোষন পরিচালনার নিমিত্তে পাশ্চাত্য তাদের প্রতিষ্ঠানগুলো কিভাবে প্রতিষ্ঠা করেছে? সে প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রম কিভাবে আমাদের সমাজে প্রভাব সৃষ্টি করছে?
- সমগ্র দুনিয়াকে পাশ্চাত্য তাদের শাসনের আওতায় আনতে কী কী কলাকৌশল গ্রহণ করেছে?
- মুসলিম উম্মাহকে দমিয়ে রাখতে পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদীদের গৃহীত লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ও কর্মপদ্ধতিগুলো কেমন?
আমরা এসব প্রশ্ন পর্যালোচনা করি না, উত্তর জানার চেষ্টা করি না। যার ফলে আমাদের অবস্থা দৈন্যতার মধ্য দিয়ে প্রতিফলিত হচ্ছে। সভ্যতার বিনির্মাণের প্রশ্নে রাজনৈতিক প্রশ্নসমূহকে এড়িয়ে, ব্যবস্থাগত সঙ্কটের সমাধানের প্রস্তাবনা না দিয়ে যে কোন কার্যক্রম পরিচালনা করা নিতান্তই অদূরদর্শী চিন্তার ফসল।
এজন্য উপরোক্ত সকল প্রশ্নের সারাংশ কাজ হল:
- প্রথমত, আমাদের শত্রুদে চিহ্নিত করা।
- দ্বিতীয়ত, তাদের কর্ম-পরিকল্পনা সম্পর্কে খুব ভালভাবে অবগত থাকা।
এবার এ সকল মূলনীতির আলোকে আমরা যদি বাংলাদেশের সাধারণ জনগণ, মানুষের কল্পনা, যুব মননের অবস্থা দেখি, তবে বুঝতে পারবোঃ
- অধিকাংশই তাদের আত্মপরিচয় ভুলে গেছে। তারা জানে না তারা কোন সভ্যতার সন্তান।
- আরেকটি শ্রেণি আছে, যারা নির্দিষ্ট কোন ইতিহাসের ফ্যান্টাসি বা ইতিহাসের নির্দিষ্ট একটি পয়েন্টে গিয়ে নিজেদের ডুবিয়ে রেখেছে (যেমন- এক শ্রেণির ঘোড়দৌড়ে আন্দালুসিয়া বিজয়, আরেক শ্রেণির লুঙ্গি-গামছা বেঁধে দেশ বিজয় ইত্যাদি)। আবেগ প্রকাশ করছে উপন্যাস-কবিতার মাধ্যমে। সর্বোচ্চ কিছু কাজ, মিছিল, মিটিংসহ বিভিন্ন ধরণের কর্ম তৎপরতা লক্ষ্য করা যায়।
- প্রায় সব কিছুর মূলেই রয়েছে কোন না কোন ইস্যু। অর্থাৎ ইস্যুকেন্দ্রিক চিন্তা থেকেই এসব সাময়িক কাজের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু স্থায়ী সমাধানের জন্য ধারাবাহিক কোন কাজ খুব বেশি লক্ষ্য করা যায় না।
এসবের পেছনে দায়ী কারণসমূহ:
১. আমাদের নিজস্ব কোন ভিশন নেই।
২. শত্রুর মোকাবেলায় সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নেই।
৩. কিছু সংখ্যক মানুষ শত্রুর মোকাবেলায় কিছু কাজ করলেও সে কাজগুলো মূলত ডিফেন্সিভ, যার দ্বারা নিজস্ব ভিত্তি দাঁড় করানো অসম্ভব।
আমরা যদি একটু পেছনে তাকাই, তাহলে দেখবো ইসলামী সভ্যতার পতনের অন্যতম কারণ ছিল,
– শত্রু-মিত্র চিহ্নিত করতে ব্যর্থতার পরিচয় দেওয়া।
– নেতৃত্বে ফাটল তৈরি, অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ফাসাদ তৈরি।
– অযোগ্য নেতৃত্বের কারণে জ্ঞানরাজ্যে দুরবস্থার সৃষ্টি।
– জ্ঞানের মৃত্যুর পর শুরু হওয়া ঔপনিবেশিক শাসনের ভয়াবহতা।
তারপরেই অপর প্রান্তে ইউরোপের উত্থান ঘটতে শুরু করে, সূচনা হয় শিল্প বিপ্লব, ফরাসি বিপ্লবের; যার মাধ্যমে পাল্টাতে শুরু করে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পটভূমি। প্রতিটি পরিভাষা থেকে শুরু করে রাজনৈতিক এজেন্ডাসমূহকে নতুনভাবে বিশ্ববাসীর সামনে হাজির করা হয়। রচিত হয় কথিত ইউরোপিয়ান রেনেসাঁ। পরবর্তীতে প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, এ দুইয়ের মাঝামাঝিতে জন্ম নেওয়া বেশ কিছু ঘটনা পরিস্থিতির মোড় ঘুরিয়ে দেয়।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে সংঘটিত হয় রুশ বিপ্লব, যা স্পষ্টতই একটি জায়নবাদী প্রজেক্ট। তাদের লিখিত ও ঘোষিত পরিকল্পনার অংশ হিসেবে জায়নিস্ট লেলিনরা নেতৃত্ব দিয়ে এ বিপ্লবকে বাস্তবায়িত করে। আদর্শের নাম ভিন্ন হলেও ঘুরে ফিরে সে জায়নবাদের সহায়তা ও পরিকল্পনাতেই নতুন আরেক জুলুমপূর্ণ ব্যবস্থার সৃষ্টি হয়।
ব্রেটনউড চুক্তি, ইয়াল্টা কনফারেন্স, ব্রেটনউট চুক্তি, ইয়াল্টা কনফারেন্স এবং জাতিসংঘের মাধ্যমে নতুন দুনিয়া গঠিত হয়। পুঁজিবাদ পৌঁছে গেছে পৃথিবীর প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে, রন্ধ্রে রন্ধ্রে।
পরবর্তীতে ইসরাইল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা, ন্যাটো জোট গঠন থেকে শুরু করে গোটা দুনিয়ার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, সামরিক ব্যবস্থা, ইন্টিলিজেন্স এজেন্সি– সব কিছুকেই পাশ্চাত্য তাদের নিজস্ব কাঠামোর মধ্যে নিয়ে আসে এবং গোটা পৃথিবীকে গোলামীর বন্দীশালায় পরিণত করে।
এভাবে গোটা উম্মাহর অবস্থাই নাজুকতা, সঙ্কটে নিপতিত হয়েছে।
স্থবির হয়ে পড়ছে গোটা মানবসত্তা, অর্থাৎ পরিণত হয়েছে একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর বুদ্ধিবৃত্তিক দাসে!
যুদ্ধ-গণহত্যায় পৃথিবী ছেয়ে গেছে!
প্রতিটি অঞ্চল, দেশ দরিদ্রতায় জর্জরিত! আখলাকহীনতা চরম রূপ ধারণ করছে!
সমাজ-সংস্কৃতি বিরূপতায় সয়লাব হয়ে যাচ্ছে!
এ অবস্থায় যদি আমরা শত্রু-মিত্র নির্ণয়ের বোঝাপড়ার জায়গায় ভুল করি, অতীতকে পর্যালোচনা করে ভবিষ্যতের কর্মপন্থা ঠিক না করি, বর্তমান জাহেলিয়াতকে চিনতে না পারি, নিজস্ব ভিত্তি সৃষ্টি না করি, বিকল্প প্রস্তাবনা হাজির না করি, পাশ্চাত্য সভ্যতার উত্থানকে পর্যালোচনা না করতে পারি, তবে আমাদের মুক্তি অসম্ভব।
কিন্তু আমরা কী করি?
- এক শ্রেণি ওই পাশ্চাত্যের সব কিছুকে গ্রহণ করার মধ্যেই সমাধান খুঁজি।
- দ্বিতীয় শ্রেণি ‘দুনিয়া মুমিনের কারাগার’ বুলি ছড়িয়ে আধুনিক বৈরাগ্যবাদের আশ্রয় গ্রহণ করি।
- আরেক শ্রেণি সমাধান চাই, কিন্তু সঠিকভাবে চাইতে পারি না। যেমন- পুঁজিবাদী অর্থনীতির বিপরীতে নতুন মডেল দাঁড় করাতে গেলে আমরা হাজির করি ১০০০ বছর আগের ইমাম আবু হানিফার কিতাবের উদাহরণকে। কিন্তু আমরা ভুলে যাই যে, প্রথমে মহান ইমামের মূলনীতিকে গ্রহণ করতে হবে, তারপর সেটিকে বর্তমান সময়ের আলোকে পর্যালোচনা করে যুগের আলোকে উদাহরণ তৈরি করতে হবে, অন্যথায় সমাধান মিলবে না। কারণ তৎকালীন সময়ে তৎকালীন সময়ে অর্থনীতি মানুষের জীবনের ৫% নিয়ন্ত্রণ করত। আর এখন করছে ৮০%। অর্থাৎ পুঁজিবাদ একটি বড় অংশ দখল করে আছে। তাই দ্বীনের মূলনীতিগুলোকে বর্তমান সময়ের আলোকে পর্যালোচনা করে তবেই সামগ্রিক চ্যালেঞ্জকে মোকাবেলা করতে হবে ও শত্রুদের চিহ্নিত করে বিকল্প অর্থনৈতিক প্রস্তাবনা হাজির করতে হবে।
এভাবে প্রত্যেক ক্ষেত্রে যুগকে পর্যালোচনা করে, সময়ের ফেরাউনী কর্মসূচিকে চিহ্নিত করে আমাদের প্রস্তাবনা ও সংগ্রাম হাজির করতে হবে। কেননা সকল স্তরেই আমরা এভাবে বন্দী!
এজন্য প্রফেসর ড. নাজমুদ্দিন এরবাকান বলেছিলেন, ‘সমগ্র পৃথিবীটাই একটি বন্দী শিবির, আর আমরা হলাম সেই বন্দী শিবিরের অবাধ্য কিছু কয়েদী’। একই ধরণের পাশ্চাত্য বিরোধী কথা সাইয়্যেদ কুতুব শহীদও বলেছিলেন। কিন্তু বিকল্প মডেল, সমাধান প্রস্তাবনায় উস্তাদ এরবাকান ছিলেন সবচেয়ে বেশি দূরদর্শী, কেননা তিনি শত্রুদের সবচেয়ে ভালভাবে চিনতে পেরেছিলেন। এজন্য তিনি যে বিকল্প প্রস্তাবনা দিয়েছিলেন, তার মাঝে এখনো নিহিত আছে আমাদের আত্মবিশ্বাস, সংগ্রাম ও বিজয়।
তবে কথা হচ্ছে, নাজমুদ্দিন এরবাকান এ বিকল্প প্রস্তাবনাগুলো কেন দিয়েছিলেন? প্রস্তাবনার পেছনের যৌক্তিকতা, কারণ, গভীরতা আমরা আদৌ উপলব্ধি করতে পারছি?
না, পারছি না।
কারণ, বিষয়গুলো তো আমরা তখনি বুঝবো, যখন আমরা আমাদের শত্রুদের ভালভাবে চিহ্নিত করতে পারবো।
তিনি মুসলমানদের একক মুদ্রাব্যবস্থা বা ইসলামী দিনার, বাজারব্যবস্থা, প্রযুক্তিব্যবস্থা, মুসলিম সাংস্কৃতিক সংগঠনসহ সকল ক্ষেত্রে রূপরেখা তুলে ধরেছিলেন। শত্রু চিহ্নিত করতে পারা ও তাদের প্রজেক্টগুলোকে বুঝতে পারার দরুন সে আলোকে সমাধানের প্রস্তাবনা দিয়েছিলেন। আর আমরা জাহেলিয়াতকে না বুঝে, যুগের নমরূদদের না চিনে নিজেদের নেতার প্রস্তাবনার গভীরতাও উপলব্ধি করতে পারছি না!
আমরা ভাবতে পারছি না, কেন পৃথিবীর গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলসমূহ তথা জ্বালানী, খনিজ সম্পদ, কৃষিজ সম্পদসমৃদ্ধ জায়গাগুলোর বেশিরভাগই মুসলিম অধ্যুষিত দেশে অবস্থিত হওয়া সত্ত্বেও এগুলোর নিয়ন্ত্রণ আজ মুসলমানদের হাতে নেই?
কেন এত সম্পদ থাকার পরেও বেকারত্ব, দারিদ্র্য, অর্থনৈতিক সঙ্কট প্রকট থেকে প্রকটতর হচ্ছে?
আমরা এসবের কারণ তো উপলব্ধি করতে পারিই না, বরং যখন কোন সমাধানের প্রসঙ্গ আসে, সাম্রাজ্যবাদীদের তৈরি করা আইডিওলজি, নিয়মনীতির মধ্যেই তার সমাধান খুঁজে ফিরি!
আমরা যখন আমাদের শত্রুদের, তাদের কার্যক্রমকে চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছি, ঠিক তখনি আমাদের অভ্যন্তরীণ জাতিগত দ্বন্দ্ব, মাজহাবী দ্বন্দ্ব ইত্যাদিকে উসকে দিচ্ছে তাদেরই সৃষ্ট মিডিয়া। এ ষড়যন্ত্রকেও আমরা ঠিকভাবে পর্যালোচনা করতে পারছি না! ওই যে শত্রু ও তার কাজ সম্পর্কে জানি না!
আবার অনান্য অঞ্চলের তুলনায় উপমহাদেশের প্রেক্ষাপটে আমাদের ব্যর্থতার অন্যতম একটি কারণ হল দীর্ঘ দুইশো বছরের বৃটিশ আগ্রাসনের ফলস্বরূপ সৃষ্ট হীনম্মন্যতা, আত্মবিশ্বাসহীনতা। আর এর থেকে উত্তরণ ঘটানো যখন আমাদের সবচেয়ে বড় কাজ, ঠিক তখন ‘৪৭ এর দেশ ভাগ, ব্রাহ্মণ্যবাদের ভয়াবহ উত্থান, সেক্যুলারিজমের ঢেউ, কমিউনিজমের উত্থান– এ সকল বিষয়ের মধ্য দিয়ে সৃষ্ট বড় ধরণের গ্যাপগুলোকেই আমরা উপলব্ধি করতে পারছি না! সুতরাং আমরা বুঝবো না এ ঘটনাগুলো কেন ঘটেছে বা কারা ঘটিয়েছে, কাদের কারণে আমরা এ দুর্দশায় নিপতিত হয়েছি, কেন আমাদের অর্থনীতির ৭০-৮০% ক্ষেত্র অন্যদের হাতে (কোন সেই গোষ্ঠী, যারা এভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে প্রিয় জন্মভূমির সকল কিছু?)।
শত্রুদের চিনতে পারলে, বুঝতে পারলে আমাদের সবচেয়ে বড় লাভ হল আমরা নিজেদের চিনতে পারবো, আমাদের সম্ভাবনাগুলো বুঝতে পারবো। অতঃপর আমরা যদি আমাদের সম্ভাবনাগুলোকে তুলে ধরতে পারি, কাজে লাগানোর জন্য সংগ্রাম করতে পারি, তবে আবারো সেই স্বর্ণালী সভ্যতার বিনির্মাণ সম্ভব; এবং এটি অতি বাস্তবিক একটি প্রত্যাশা। কেননা,
- প্রথমত, ইসলামের উন্নত মূল্যবোধ ও অন্তর্নিহিত আধ্যাত্মিক শক্তি, গতিশীল ইতিহাস ও কৌশলগত অবস্থান সবচেয়ে বেশি শক্তিশালী।
- দ্বিতীয়ত, মরক্কো থেকে ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত এক বিশাল সমৃদ্ধ অঞ্চল আমাদের।
- তৃতীয়ত, পৃথিবীর ভূগর্ভস্থ খনিজ সম্পদের ৭০ ভাগই মুসলিম ভূখন্ডে অবস্থিত।
- চতুর্থত, মুসলিম জনসংখ্যা প্রায় দুইশো কোটি। সবচেয়ে বেশি যুবক সংখ্যা মুসলমানদেরই। মধ্য এশিয়াতে বিশাল সংখ্যক মুসলিম জনসংখ্যা বিদ্যমান; চীন, রাশিয়া ও ভারতেও এর সংখ্যা যথেষ্ট; পাশ্চাত্যেও মুসলমানদের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
এভাবে প্রতিটি খাতেই রয়েছে বিপুল সম্ভাবনা।
তাই শত্রু-মিত্র চিহ্নিত করে আমাদের সবচেয়ে বড় সংগ্রাম হল একটি বসবাসযোগ্য, নিরাপদ, প্রভাবশালী দেশ গঠন করা; ন্যায়ভিত্তিক নতুন দুনিয়ার জন্য আমাদের আন্দোলনসমূহকে পরিচালনা করা।
সর্বশেষ আল্লামা ইকবালের কথানুযায়ী যুগের নমরূদদের চিহ্নিত করে, অতীত ইতিহাস পর্যালোচনা করে সম্ভাবনাসমূহকে তুলে ধরতে হবে। বিজয় আসবেই ইনশাআল্লাহ্, প্রয়োজন–
- আত্মবিশ্বাস নিয়ে সংগ্রাম করে যাওয়া।
- উপমহাদেশীয় সকল ঘটনাপ্রবাহকে পর্যালোচনা করে বাংলায় ইসলামী সভ্যতার বিজয়ের জন্য আমৃত্যু কাজ করে যাওয়া।
- ডি-৮ এর প্রস্তাবনাগুলোকে বাস্তবায়নের জন্য পরিকল্পনা গ্রহণ করা।
- জীবনের একমাত্র লক্ষ্য-উদ্দেশ্য হিসেবে ইসলামের ইউনিয়ন বাস্তবায়নের জন্য দীর্ঘ ও কঠিন পথ ধৈর্যের সাথে পাড়ি দেওয়া।
- অর্থনীতি, সংস্কৃতি এবং শিক্ষাক্ষেত্রকে আরো বেশি এগিয়ে নিতে সর্বাত্মক সংগ্রাম পরিচালনা করা।
অন্যথায় শুধু বিশ্বব্যবস্থা নয়, বাংলাদেশের ভাগ্যও পরিবর্তন করা সম্ভব নয়।