মূল্যবোধ
জীবনে ও জীবন-যাপন পর্যায়ে মূল্যবোধের অর্থ বা তাৎপর্য কি? দৈনন্দিন জীবনের লেনদেন উপলক্ষ করে মানুষের ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত চাল-চলনে যে আদর্শ বা উদ্দেশ্য ফুটে ওঠে, তাতেই রয়েছে তার মূল্যবোধের পরিচিতি। শ্রেষ্ঠমূল্যবোধ মানব-প্রকৃতির সমধর্মী, অতএব স্বাভাবিক ঊর্ধ্বতন মানুষের জন্যে সহায়ক; অপরপক্ষে হীন মূল্যবোধ ও ধারণাবলী থেকে মানব-প্রকৃতির স্বাভাবিক স্ফুরণ হয় বাধাপ্রাপ্ত। অজ্ঞতা, বল্লাহীন অহংকার, খামখেয়ালি ও গোঁয়ার্তুমি থেকে এসবের উদ্ভব, আবার এসব থেকেই সূত্রপাত হয় ‘যুগ্ম’ বা সীমালংঘন-প্রবৃত্তির। প্রতিটি জীবনদর্শন নিজ নিজ ছাপে মানব-সমাজ গড়ে চলেছে; প্রতিটি দর্শনে অন্তর্নিহিত যে মূল্যবোধ, তা প্রকট হয় তার অনুসারীদের চরিত্র-বৈশিষ্ট্যে। ইসলাম সম্বন্ধেও এর ব্যতিক্রম কিছু নেই। ইসলামও নিজস্ব মূল্যবোধ দিয়ে তার অনুসারীদের চরিত্র–বৈশিষ্ট্য গড়ে তোলে, তাদের সত্ত্বা ও সম্ভাবনার সংজ্ঞায়ন করে। চারদিকে একবার তাকিয়ে দেখলে অনায়াস-দৃষ্টিতেও এ সত্য ধরা পড়ে যে, বিশ্ব-প্রকৃতি তার বিধৃত বস্তুরাজি নিয়ে নিরুদ্দেশের পথে ভেসে চলছে না; বরং এ গতিশীল মহাবিশ্বে সবই সুনিয়ন্ত্রিত এবং পরস্পর সুসামঞ্জস্য। এ থেকে বোঝা যায় যে, এ গতিশীলতার সংগে রয়েছে কোনো মহান উদ্দেশ্য সাধনের প্রেরণা। বিশ্ব সৃষ্টির এবং সাথে সাথে নিজ সৃষ্টির এই উদ্দেশ্যকে জানাই হলো মূল্যবোধের প্রথম পদক্ষেপ।
জীবনের উদ্দেশ্য
কোন কিছুকে আমরা বলতে পারি, কিংবা তার অস্তিত্ব সমর্থন করতে পারি, যদি তাতে এই সৃষ্টির উদ্দেশ্য সার্থক হয়। মানুষের সম্বন্ধেও একথা সত্য আল-কুরআনের মতে, প্রকৃতির বিবর্তনক্রমে ধরাপৃষ্ঠে মানুষের আবির্ভাব অহেতুক বা আকস্মিক কোনো ব্যাপার নয়। মানব-সৃষ্টি একটি সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্যমূলক কর্ম। যে জীব পরস্পরের রক্তপাত করবে এবং ধরাপৃষ্ঠে শত রকম অন্যায়াচরণ করবে, তাকে কেন সৃষ্টি করা – এ নিয়ে ফিরিশতারা বিস্ময় বোধ করেছিলেন। আল কুরআনে রয়েছে-
وَإِذْ قَالَ رَبُّكَ لِلْمَلَئِكَةِ إِنِّي جَاعِلٌ فِي الْأَرْضِ خَلِيفَةً
“তোমাদের রব ফিরিশিতাদের বললেন, আমি পৃথিবীতে আমার খলীফা প্রেরণ করছি।” এই খলীফা সম্পর্কীয় ধারণাই ইসলামের সর্বশ্রেষ্ঠ আধ্যাত্মিক মূল্যমান। এটাই সর্বপ্রকার ইসলামী মূল্যবোধের উৎস এবং ইসলামী নীতি-অনুসারী মানব-অস্তিত্বের চারিত্রিক রূপের চাবিকাঠি।
আল্লাহর গুণাবলী
কুরআনীয় আরাধ্যের ‘ইসমে জাত’ বা ব্যক্তিক (personal) নাম হলো ‘আল্লাহ’। বিশ্ব-প্রকৃতি এবং তাতে যা কিছু রয়েছে, সবই সসীম, কিন্তু আল্লাহ্ অসীম। আল্লাহর এ অসীমত্ব স্থান-কাল সূত্রে নয়; তিনি অসীম তাঁর অসীম সম্ভাবনায়; তিনি ইচ্ছামত নিজের জন্যে যে কোনো গুণ সৃষ্টি করতে পারেন। সসীম জীব কখনো অসীমের কল্পনা বা ধারণা করতে পারে না। আল্-কুরআনে রয়েছে: “তুমি কখনো আমাকে দেখতে পাবে না”। আল্লাহ্ কখনো নিজের ব্যক্তিক রূপ মানুষের কাছে প্রতিভাত করেন না; কিন্তু সৃষ্টিতে পরিব্যাপ্ত তাঁর এমন কতকগুলি গুণের মাধ্যমে তিনি নিজেকে মানুষের জ্ঞান-গোচর করেন, যেগুলো বিশ্ব-প্রকৃতির সৃষ্টি, পালন ও বিবর্তনের প্রয়োজনে আসে। সৃষ্টিতেই আল্লাহর অস্তিত্বের নিদর্শন বিরাজমান। এ প্রসংগে আমি আল- কুরআনের রূপ-সুষমার অতুলনীয় এবং চিন্তাশীল মানুষের মনে স্বর্গীয় অনুভূতি সৃষ্টিকারী কাব্যিক বর্ণনাপূর্ণ আয়াতাংশের উদ্ধৃতি দেয়ার লোভ সংবরণ করতে পারছি না।
إِنَّ فِي خَلْقِ السَّمَوَاتِ وَالْأَرْضِ وَاخْتِلَافِ الَّيْلِ وَالنَّهَارِ وَالْفُلْكِ التي تَجْرِي فِي الْبَحْرِ بِمَا يَنْفَعُ النَّاسِ وَمَا أَنْزَلَ اللَّهُ مِنَ السَّمَاءِ من ماءٍ فَأَحْيَابِهِ الْأَرْضَ بَعْدَ مَوْتِهَا وَبَثَّ فِيهَا مِنْ كُلِّ دَابَّةٍ . وَتَصْرِيفِ الرِّيَاحِ وَالسَّحَابِ الْمُسَخَّرِ بَيْنَ السَّمَاءِ وَالْأَرْضِ لَآيَاتٌ لقَوْمٍ يَعْقِلُونَ –
“দেখ, আকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টিতে, রাত্রি ও দিবসের পরিবর্তের মধ্যে, মানবের লাভ-লভ্যের জন্যে অর্ণবপোতাবলীর সমুদ্রাভিসারে, আসমান হতে আল্লাহ যে বারি বর্ষণ করেন ও তা দ্বারা তিনি মৃত মৃত্তিকাতে যে প্রাণের সঞ্চার করেন, তার মধ্যে। ভূ-পৃষ্ঠে পরিব্যাপ্ত তাঁর সৃষ্ট জীবজন্তুদের মধ্যে এবং বায়ুপ্রবাহের গতি পরিবর্তনে যা মেঘমালাকে আকাশ ও পৃথিবীর মধ্যে অনুগত ভৃত্যের ন্যায় টেনে নিয়ে বেড়ায়, নিশ্চয়ই জ্ঞানী ব্যক্তিদের জন্যে নিদর্শনাবলী রয়েছে।” (২:১৬৪)
ভাবুক মন চারিদিকে তাকিয়ে দেখলেই আল্লাহর গুণাবলী এবং প্রকৃতিতে তাঁর ইচ্ছার অভিব্যক্তি দেখতে পায়। এ যে শুধু ফুলে-ফলে বা বৃক্ষশাখায় নিবদ্ধ, তা নয়, মানুষের জীবনে, কার্যে, জাতিসমূহের আবির্ভাবে, উত্থান-পতনেও তা সমভাবে প্রতিভাত। আল-কুরআনে আল্লাহর নিরানব্বইটি গুণবাচক নাম বা পরিচিতি রয়েছে। এই সব গুণ তাঁর সৃষ্টিতে প্রতিফলিত এবং মানুষের মধ্যে যখন এই সব গুণ প্রতিফলিত হয়, তখন সে আল্লাহর গুণে গুণান্বিত হয়। এ গুণাবলীর প্রত্যেকটি এক একটি মূল্যমান স্বরূপ যা অবলম্বন করে মানুষের নিয়তি গড়ে ওঠে এবং যার অস্বীকৃতিতে মানুষের সম্ভাবনা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। আল্লাহ মানুষকে শ্রেষ্ঠতম ছাপে ও অপরিসীম সম্ভবানা দিয়ে সৃষ্টি করেছেন; তিনি তাকে নিজ গুণাবলীতে অভিষিক্ত করেছেন। রাসূল (সা) নির্দেশ দিয়েছেন-
تَخَلَّقُوا بِأَخْلاقِ اللَّهِ
“আল্লাহর গুণাবলীতে গুণান্বিত হও।”
আল্লাহর নিরানব্বই গুণের মধ্যে মৌলিক হলো ‘আর-রব’ এবং অন্যগুলো হলো এর আবশ্যিক পরিপূরক। ‘আল-ফাতিহা’ অধ্যায়ের প্রারম্ভিক বাক্যে আল্লাহ্ তাঁর সৃষ্ট জগতের কাছে নিজের পরিচয় দিচ্ছেন বিশ্ব-প্রকৃতির ‘রব’ বলে।
আর–রব
আরবী ‘আর্-রব্’ কথাটির সমার্থক কোন ইংরেজী শব্দ নেই। ইংরেজী Lord শব্দটি এর প্রতিশব্দ হতে পারে না। ‘রব‘-এর অন্তর্নিহিত অর্থ রয়েছে বিশ্বজগতের সৃজন, প্রতিপালন এবং বিবর্তনের কর্তৃত্ব। অতএব ‘আর্-রব’ হচ্ছেন মহাবিশ্বের একক স্রষ্টা, পালক ও বিবর্তক। মানুষও এক অর্থে স্রষ্টা বটে; কিন্তু যেখানে ‘কিছুনা’ থেকে ‘কিছু’ সৃষ্টির প্রশ্ন, সেখানে তার কোনো হাত নেই। সে নিজের জীবনযাপন, আত্মরক্ষা এবং আত্মোন্নয়নের রীতি নির্ধারণ ও উপায় অবলম্বন করতে পারে মাত্র। প্রত্যেকটি জীবন-দর্শনই মানুষের আত্মরক্ষা ও আত্মোন্নয়নের সমস্যাদি সমাধানের ব্যাপারে নিজ বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী সমাধান দিয়ে থাকে। অবশ্য খাদ্য, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের সমস্যা পৃথিবীর সব মানুষের সর্বকালের সাধারণ সমস্যা। বিভিন্ন জাতির বা সম্প্রদায়ের দর্শনে, মতবাদে এবং বিভিন্ন জীবন-যাপন পদ্ধতিতে যে বিরোধ বা সংঘাত দেখা দেয়, তা এসব মৌলিক প্রয়োজনের স্বীকৃতি বা অস্বীকৃতি নিয়ে নয়, বরং এসব মৌলিক সমস্যাদির সমাধানের পন্থা নিয়ে। অন্যান্য বিশিষ্ট মতবাদের মতো ইসলামেরও এসব জীবন-সমস্যা সমাধানের নিজস্ব রীতি-নীতি রয়েছে। ‘আর্-রব্’-এর পথ-পদ্ধতি তথা ইসলামী নীতি-বিধান বিশ্ব-প্রকৃতির বিকাশধারায় বিধৃত রয়েছে এবং আল-কুরআন মারফত অবতীর্ণ হয়েছে। ইসলামী পরিভাষায় একেই বলা হয়েছে ‘রাব্বিয়াত’।
রাব্বিয়াত
‘রাব্বিয়াত‘ বা বিশ্ব–প্রকৃতির পালন ও বিবর্তন সংক্রান্ত ঐশী রীতি–নীতির পাঁচটি মৌলিক বৈশিষ্ট্য রয়েছে–
প্রথম- আল্লাহ্ কোনো প্রতিদানের প্রত্যাশা না করেই তাঁর সৃষ্ট জীবের মঙ্গল সাধন করেন। এমন অনেক বিজ্ঞ ব্যক্তি আছেন, যাঁরা মুখে যা-ই বলুন না কেন, অবচেতন মনে আল্লাহকে মানবীয় চরিত্রে কল্পনা করে থাকেন। তাঁরা মনে করেন যে, সৃষ্ট-জীবের কৃতজ্ঞতা বা অকৃতজ্ঞতার দরুন আল্লাহ তুষ্ট বা অসন্তুষ্ট হয়ে থাকেন। কিন্তু আল-কুরআনে আমরা পাই যে, আল্লাহ্ সর্বপ্রকার অভাবের ঊর্ধ্বে এবং তিনি মানুষকে যা নির্দেশ দিয়েছেন, তা মানুষেরই শ্রেষ্ঠতম কল্যাণের জন্যে। আল্লাহর নির্দেশ মান্য করে মানুষ নিজেরই কল্যাণ সাধন করে এবং অমান্য করলে তার নিজেরই অপকার সাধিত হয়।
দ্বিতীয়– সৃষ্ট জীবের বেঁচে থাকার জন্যে যা প্রয়োজন, প্রকৃতপক্ষে জীবন-ধারনের জন্যে প্রতি মুহূর্তে সে যা কিছুর উপর নির্ভরশীল এবং যা সে নিজের প্রচেষ্টায় উৎপন্ন করতে অপারগ আল্লাহ তা’আলা তা মুক্ত হস্তে এবং বিনা শর্তে দান করেন। অর্থশাস্ত্রের পরিভাষায় এ সবের নাম ‘প্রকৃতির দান’ (free gifts of Nature) আলো-হাওয়া-পানির মতো ‘অবতীর্ণ জ্ঞান’ (revealed knowledge)-ও এ পর্যায়ের একটি দান বিশেষ।
তৃতীয়– আল্লাহ সৃষ্ট-জীবের প্রয়োজনাবলী পূর্ব থেকেই পরিজ্ঞাত এবং প্রকৃতপক্ষে জীবের প্রয়োজনে আসবার আগে থেকেই তিনি এসব বস্তু সরবরাহ করেন। সন্তান জন্মের পূর্ব থেকেই প্রসূতির স্তন্যে তার আহার্য সঞ্চিত হয়।
চতুর্থ– আল্লাহর এসব স্বতঃপ্রবৃত্ত দান সার্বজনীন। এ ক্ষেত্রে আল্লাহ্ ভাল এবং মন্দ, পুণ্যশীল এবং পাপী, বিশ্বাসী এবং অবিশ্বাসীর মধ্যে কোনো তারতম্য করেন না।
রাব্বিয়াত–এর এই চারিটি বৈশিষ্ট্য অন্তর্নিহিত রয়েছে আল্লাহর গুণবাচক নাম ‘আর্–রহমান‘-এ।
পঞ্চম– আর-রাহীম হিসেবে আল্লাহ ন্যায়বিচার করেন, কিন্তু সে ক্ষেত্রেও তাঁর বিচার হয় করুণানিষিক্ত। যে আল্লাহর দানের যথার্থ সদ্ব্যবহার করবে, সে পুরষ্কৃত হবে, আর যে তা করবে না, সে শাস্তি পাবে। পুরস্কারের অর্থ নিজের কল্যাণ এবং শাস্তির অর্থ নিজের ক্ষতি। ‘রাব্বিয়াত’-এর এই নীতি অনুসারে প্রত্যেক ব্যক্তিই তাঁর প্রচেষ্টার ফল লাভ করেন। সৃষ্ট জগত সম্বন্ধে বলা যায় যে, ‘আর–রব‘-এর সৃজনবিধি সম্পূর্ণ নিখুঁত এবং সেমতে প্রত্যেক সৃষ্ট জীবের রয়েছে তার সার্থকতম নিয়তিতে পৌছাবার সম্ভাবনা। ‘রাব্বিয়াত‘ বা সৃজন, পালন ও বিবর্তনের ঐশী নীতিই হলো ‘খিলাফত‘-এর মূল কথা।
খিলাফত
কেউ কেউ মনে করেন যে, মানুষ ‘খলীফাতুল্লাহ’ বা আল্লাহর প্রতিভূ। ‘খিলাফত’ সম্বন্ধে এই ভুল ধারণা জন্মলাভ করেছে আল্-কুরআনের নিম্নোক্ত বাক্যের নির্জলা অপব্যাখ্যা থেকে-
وَ إِذْ قَالَ رَبُّكَ لِلْمَلَئِكَةِ إِنِّي جَاعِلٌ فِي الْأَرْضِ خَلِيفَةً
“তোমাদের ‘রব’ তাঁর ফিরিশতাদের বললেন, আমি পৃথিবীতে আমার প্রতিভূ খলীফা প্রেরণ করছি।” (২:৩০)
এঁরা আল্লাহর একটি ‘ইসম-ই-সিফাত’ বা গুণবাচক নামকে তাঁর ‘ইসম্-ই-জাত’ এ ব্যক্তিবাচক নামের সাথে সমার্থক বলে মনে করেন। মানুষ ‘আল্লাহ’র প্রতিভূ নয়; সে হলো আল্লাহ্বর সিফাত রাব্বিয়াত-সংক্রান্ত গুণাবলীর প্রতিচ্ছবি। তোমাদের প্রভু বললেন, “আমি পৃথিবীতে আমার প্রতিভূ প্রেরণ করছি।” এ বাক্যে আল্লাহর নিজের ব্যক্তিবাচক নামের পরিবর্তে গুণবাচক নাম ‘আর-রব’ ব্যবহারের এটাই তাৎপর্য। অর্থাৎ আল্লাহ্ মানুষকে সৃষ্টি করেছেন তাঁর ‘রাব্বিয়াত’-এর প্রতিভূ করে এবং এই ‘রাব্বিয়াতের’ নীতি অনুযায়ী বিশ্বস্ততার সাথে নিজের ও চারপাশের সৃষ্ট জীবের লালন-পালনের দায়িত্ব দিয়ে। এই মহান কর্তব্যের যথাযথ সম্পাদনাই হলো সত্যিকারের ‘ইবাদত’ বা আল্লাহর দাসত্ব। এই-ই ‘ইসলাম’-এর প্রকৃত অর্থ ও তাৎপর্য – যাকে বলা হয়েছে আল্লাহর ইচ্ছার প্রতি বিনাশর্তে ও দ্বিধাহীন আত্মসমর্পণ। ব্যক্তিগত জীবনেই হোক বা জাতীয় জীবনেই হোক, মানুষের মহত্ত্ব নির্ভর করে তার ব্যবহারের উপর। তাই খিলাফতের এ নীতির সাথে যার ব্যবহারিক জীবন সুসামঞ্জস্য, সে-ই মহৎ। অন্যপক্ষে, শ্রেষ্ঠতম অবয়ব ও সীমাহীন সম্ভাবনার অধিকারী মানুষ যদি অন্যের প্রতি কর্তব্যের চিন্তা বিসর্জন দিয়ে কেবল আত্মপূজায় বিভোর থাকে, আল- কুরআনের ভাষায় সে তখন হয়ে দাঁড়ায় ‘আস্ফালুস্-সাফেলীন’ বা নিকৃষ্টের নিকৃষ্টতম। জাতির উত্থান-পতনের রহস্যও এতেই প্রচ্ছন্ন। আর-রব’-এর ন্যায়-বিচারের এই অমোঘ নীতির উল্লেখ করে আল-কুরআনে বলা হয়েছে-
“আমি পৃথিবীতে তাদের পর তোমাদেরকে আমার প্রতিভূ করে পাঠিয়েছি। দেখতে যে তোমরা কিরূপ ব্যবহার করো।”
হক্কুল ইবাদ
‘রাব্বিয়াত’-এর ‘খলীফা’ হিসেবে মানুষের কর্তব্য ও দায়িত্ব দ্বিবিধ। তা হলো- নিজের প্রতি কর্তব্য ও অপরের প্রতি কর্তব্য। সাধারণ ভাষায় প্রথমটিকে বলা হয় হক্কুল্লাহ বা আল্লাহর প্রাপ্য (হক্ক) এবং দ্বিতীয়টিকে বলা হয় ‘হক্কুল ইবাদ’ বা আল্লাহ্র দাসদের প্রাপ্য। ‘হক্কুল্লাহ্’ আসলে হলো ‘হক্কুন-নফসের’ অর্থাৎ নিজের জন্যে প্রাপ্য; কেননা আল্লাহ সকল অভাব-অনটনের ঊর্ধ্বে এবং তাঁর নিজ উপকারের জন্যে তিনি সৃষ্ট জীবের উপর নির্ভরশীল নন। বিশ্বাসী বান্দা ‘সালাত’-এ তাঁর সামনে ভূলুণ্ঠিত হয়ে বা রমজানের উপবাসব্রত পালন করে তাঁর কোনো উপকার সাধন করে না, নিজেরই কল্যাণ হাসিল করে। আল্লাহর ‘হক্ক’ (হক্কুল্লাহ) সম্পর্কীয় প্রচলিত ধারণাও স্রষ্টার মানবীয়তা আরোপমূলক আরেকটি ধারণা এবং সেহেতু ইসলামের শিক্ষার বিকৃতি মাত্র। মানুষের এমন কোনো কাজ করবার অধিকার নেই, যা তার নিজের বা অপরের পক্ষে ক্ষতিকর। নিজের, নিজ পরিবার-পরিজন, আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশীর মঙ্গল সাধন প্রত্যেক মুসলিমেরই কর্তব্য। বিশ্বস্ততার সাথে এ কর্তব্য সম্পাদন কোনো দাক্ষিণ্যমূলক কাজ নয়, বরং দৈনন্দিন দায়িত্বের ব্যাপার- যা পালন না করা পাপ এবং অপরাধের শামিল। ইসলামে দাক্ষিণ্য বলে কিছু নেই। দাক্ষিণ্য ধনিকের পুঁজি বিলাস। ইসলামে ‘হক্কুল ইবাদ’ তথা অপরের প্রতি কর্তব্যের গুরুত্ব অতিরঞ্জনের অতীত। বিশ্বস্ততার সাথে ‘হক্কুল ইবাদ’ পালন ইসলামী সমাজ জীবন-যাপনের অপরিহার্য শর্ত। এ ক্ষেত্রে ইসলামী নির্দেশ এত দৃঢ় যে, গৃহদ্বারে একটি কুকুরকে উপবাসী রেখেও পূর্ণ আহার গ্রহণ মুসলিমের জন্যে নাজায়েয। নিজের সম্পত্তি শুধু নিজ ভোগ-সুখ বা নিজ পরিবারের আরাম-আয়েশের জন্যে ব্যয়ের অধিকার কোন মুসলমানকে দেওয়া হয়নি। বরং তার প্রতিবেশীদের হক রয়েছে তার সম্পদ থেকে ফায়দা গ্রহণের। আল-কুরআনে বলা হয়েছে যে, যারা ইয়াতীমদের প্রতি বিরূপ ভাবাপন্ন, যারা ক্ষুধার্তকে অন্নদানে বিমুখ এবং যারা প্রতিবেশীর উপকারের প্রতি উদাসীন, সে সকল উপাসনাকারী অভিশপ্ত। আরও বলা হয়েছে।
لَيْسَ الْبِرَّ أَنْ تُوَلُّوا وُجُوهَكُمْ قِبَلَ الْمَشْرِقِ وَالْمَغْرِبِ – وَلَكِنَّ الْبِرَّ مَنْ آمَنَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ وَالْمَلئِكَةِ وَالنَّبِيِّنَ ، وَآتَى المال على حُبِّهِ ذَوِي الْقُرْبَى وَالْيَتَمَى وَالْمَسَاكِينِ وَابْنِ السَّبِيلِ وفي الرقاب
“পুণ্যকর্ম পূর্ব বা পশ্চিম দিকে মুখ ফেরানোর মধ্যে নেই, বরং তা রয়েছে আল্লাহ্, শেষ বিচারদিন, ফেরেশতাগণ, আসমানী কিতাব ও নবীদের উপর বিশ্বাসে এবং আল্লাহর প্রেমে আত্মীয়-স্বজন, ইয়াতীম, অভাবগ্রস্ত, গৃহহীন ও প্রার্থীজনের সাহায্যার্থে আপন সম্পদ বিতরণে, দাসত্ব মোচনে ব্যয়ে”।
সার্বভৌমত্ব
খিলাফতের ধারণার স্বাভাবিক অনুসিদ্ধান্ত হলো আল্লাহই সার্বভৌম এবং আল্লাহই সকল পার্থিব সম্পদের মালিক-এই মত। সার্বভৌম ক্ষমতা এবং সম্পদের মালিকানা কিছুই মানুষের ব্যক্তিগত বা জাতিগত আয়ত্তে নয়। আল-কুরআনে বলা হয়েছে, ‘আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর আধিপত্য আল্লাহর।’ এ বাক্যের ব্যাখ্যাচ্ছলে বলা যায়- আল্লাহর সার্বভৌমত্বের মানবীয় বুদ্ধিগ্রাহ্য তাৎপর্য হচ্ছে- সার্বভৌমত্ব বা মানব-নিয়তি গঠনের এবং মানবীয় সম্পর্ক নির্ধারণের নিরংকুশ ক্ষমতা মানুষের করায়ত্ত নয়। লব্ধ ক্ষমতাকে এমনভাবে ব্যবহার করবার অনুমতি সে পায়নি, যা তার নিজের জন্যে, তার জাতির জন্যে বা আল্লাহর সৃষ্ট জীব-জগতের জন্যে অনিষ্টকর হতে পারে। ইসলামের মতে, লব্ধ ক্ষমতাকে ব্যক্তিগত বা জাতীয় অহং-সত্তার পরিতৃপ্ত সাধনের উদ্দেশ্যে অসামাজিক বা মানবতা-বিরোধী কার্যে নিয়োগ করা আল্লাহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার শামিল। জ্ঞানবৃদ্ধ আবু বকর (রা) খলীফা বা রাব্বিয়াতের প্রতিনিধিরূপে স্বজাতির ভাগ্য নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বভার গ্রহণকালে তাঁর উদ্বোধনী ভাষণে বলেছিলেন যে, তিনি মাত্র ততক্ষণ জনসাধারণের আনুগত্যের অধিকারী, যতক্ষণ তিনি নিজে আল্লাহ্ এবং রাসূলের অনুগত থাকবেন। অন্য কথায়, ক্ষমতাসীন ব্যক্তির প্রতি আনুগত্য মাত্র ততক্ষণ বাধ্যতামূলক, যতক্ষণ তিনি নিজে রাব্বিয়াত-এর খলীফা হিসেবে নিজ ক্ষমতাপ্রয়োগ-নীতির প্রতি বিশ্বস্ত থাকবেন। আল-কুরআনে রয়েছে-
أَطِيعُوا اللَّهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَأُولِي الْأَمْرِ مِنْكُمْ
“হে বিশ্বাসীগণ! আল্লাহর অনুগত হও, তাঁর রাসূলের অনুগত হও এবং তোমাদের মধ্যে যাঁরা ক্ষমতাসীন, তাঁদের অনুগত থাক।”
ব্যক্তিগত রাজতন্ত্রের সপক্ষে বাগদাদের খলীফা নামধারী সুলতানদের আমলে ধর্মীয় সমর্থন আদায়ের জন্যে কুরআনুল করীমের এই আয়াতের এবং সুপ্রসিদ্ধ হাদীসের বাক্য (السلطان ظل الله) “সুলতান আল্লাহর ছায়া স্বরূপ”-এর ইচ্ছাকৃত অপব্যাখ্যা করে ইসলামে রাজপুরুষেরা ঐশী মর্যাদার অধিকারী-এ তত্ত্বও খাড়া করা হয়। আল্-কুরআনের উপরোক্ত বাণী ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ‘তোমাদের মধ্যে যারা ক্ষমতাসীন’ কথাটি বোঝাবার বেলায় সাধারণত উদ্দেশ্যমূলকভাবেই তার আগেকার শর্ত ‘হে বিশ্বাসীগণ!’ কথাটি চাপা দেওয়া হয়; যাতে যে কেউ ক্ষমতাসীন হোক না কেন, বিনা শর্তে তাকেই মানতে হবে-এ মনোভাব জন্মায়। ‘সুলতান আল্লাহর ছায়া‘ কথাটি এই অর্থে সত্য যে, কোনো বস্তুর ছায়া যেমন তার সদৃশ হতে বাধ্য, তেমনই সুলতানকেও আল্লাহর রাব্বিয়াত–এর বিশ্বস্ত অনুসারী হতে হবে। আল্লাহর সার্বভৌমত্বের বিশ্বাস তথা মানুষের সার্বভৌমত্বের অস্বীকৃতিই হলো ইসলামী রাজনৈতিক দর্শনের প্রথম সোপান। এই ‘আল্লাহ্র সার্বভৌমত্ব‘ মতবাদ থেকে স্বভাবতঃই দু‘টি সিদ্ধান্তের উৎপত্তি হয়। একটি হলো আইনের সম্মুখে সকলের সমমর্যাদা বা আইনের শাসন; অন্যটি আইন প্রণয়ন ব্যাপারে মানুষের সীমিত অধিকারের নীতি।
আইনের শাসন
গ্রীক ও রোমান জাতি মানব সমাজে আইনের প্রবর্তন করে। কিন্তু ইসলাম শুধু আইনই প্রবর্তন করেনি, আইনের শাসনও প্রবর্তন করেছে। প্রাকৃতিক আইন কোনো ব্যক্তির বিশেষ মর্যাদা মানে না। আগুন দহন করে; আগুনে হাত দিলে একজন দীন-দরিদ্রের হাত যেমন পুড়বে; একজন রাজ-পুরুষের হাতও তেমনই পুড়বে। ইসলামের মতে, কোন অপরাধী ব্যক্তিই রাষ্ট্রের মর্যাদা বা জনস্বার্থের অজুহাতে আইনের শাস্তি থেকে নিষ্কৃতি পেতে পারে না। কথিত আছে, হযরত রাসূলুল্লাহ (সা) ঘোষণা করেছিলেন যে, চৌর্য-অপরাধে ধরা পড়লে তিনি তাঁর প্রিয় নন্দিনী ফাতিমার হাত কাটার হুকুম দিতেও দ্বিধাবোধ করবেন না। খিলাফত-এর সাধারণ নাগরিকদের অভিযোগের জওয়াব দেবার জন্যে মহান উমর (রা) এবং মহানুভব আলী (রা)-কেও বিচারকের এজলাসে হাযির হতে হয়েছিল। আইনের শাসন-নীতি মুসলিম সমাজে এত অধিক দৃঢ়মূল হয়েছিল যে, রাজতন্ত্রের যুগেও বাগদাদের উদ্ধত আব্বাসীয় সুলতান আল-মনসূরকে সামান্য একজন উষ্ট্রচালকের নালিশের জওয়াব দেবার জন্যে তাঁর নিজেরই প্রতিষ্ঠিত বিচারালয়ে আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়েছিল। আইনের শাসনের এ আদর্শ ইসলামী বিচার-ব্যবস্থার ভিত্তিমূল।
আইন প্রণয়ন
ইসলামে মানুষের জৈবিক, নৈতিক ও আধ্যাত্মিক সত্তা ও সম্ভাবনার পরিপ্রেক্ষিতে তার আইন প্রণয়ন-ক্ষমতাকে ‘খিলাফত’-ধারণার দ্বারা সীমিত করা হয়েছে। রাব্বিয়াত–এর প্রতিভূ হিসেবে মানুষকে সৃজনী–প্রতিভার অধিকারী করা হয়েছে। মানুষ সৃষ্টি করে; কিন্তু সে ‘কিছুনা‘ থেকে ‘কিছু‘ সৃষ্টি করতে পারে না। সে পূর্বাবস্থিত উপাদানসমূহের সাহায্যে নতুন নতুন আকার ও প্রকারের দ্রব্য বা বস্তু উৎপাদন করে। পক্ষী বিশেষজ্ঞদের মতে, ভারতীয় জংলী মোরগজাতি থেকেই পৃথিবীর সর্ব প্রকার মোরগের উৎপত্তি ঘটেছে। মানুষ কৃত্রিম পন্থায় খাদ্য, প্রজনন ও পালনবিধি নিয়ন্ত্রণ করে অর্পিংটন জাতীয় বিলাতী মোরগ উৎপাদন করেছে। কিন্তু মানুষের চোখে যতই আকর্ষণীয় হোক না কেন, এই সুদৃশ্য মোরগটি আদতে একটি অতি দুর্ভাগ্য জীব। অনবরত পরিচর্যা ছাড়া এ একদিনও বেঁচে থাকতে পারে না। অথচ জংলী মোরগ-মুরগী পক্ষী-বিশেষজ্ঞদের দৃষ্টি বা পরিচর্যা ছাড়াই যুগ-যুগান্তর ধরে নিজ নিজ আহার্য সংগ্রহ করছে, শত্রুর বিরুদ্ধে আত্মরক্ষা করছে এবং বংশ রক্ষা করে চলেছে। মানুষ আজ যে শুধু বিশেষ বিশেষ প্রকারের পক্ষী, কুকুর ও ঘোড়া উৎপাদন করে ক্ষান্ত হয়েছে, তা নয়, আপন ঔদ্ধত্যে সে বিশেষ ধরনের মানুষও তৈরি করে চলেছে। নীটশের দর্শন হিটলার-মুসোলিনীরূপ ফ্যাসিষ্ট মানবের জন্মদান করেছিল; কার্ল মার্কস্-এর দর্শন রুশীয় ও চৈনিক লাল মানব-গোষ্ঠী তৈরি করেছে। এ ধরনের মানবীয় প্রচেষ্টার ফলাফল আজ সর্বজনবিদিত। রাস্তার ডান পাশ বা বাঁ পাশ দিয়ে চলার নির্দেশ সম্বলিত আইন প্রণয়ন করাতে বড় একটা আসে যায় না; কিন্তু মানুষের জৈবিক-নৈতিক-আধ্যাত্মিক সত্তার উপর ক্রিয়াশীল কানুনাদি প্রণয়নের বেলায় একবারে ঐশী নির্দেশ ও বিচক্ষণ বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের অধিকারী হওয়া একান্ত প্রয়োজন। এ সকল ক্ষেত্রে আইন-পরিষদে সদস্যদের নাক-গোনা সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে আইন-প্রণয়নের ফল মারাত্মক হতে বাধ্য। আপন অজ্ঞতার জ্ঞানই হলো সত্যিকার জ্ঞান। বিজ্ঞানের সাফল্য সম্পর্কিত ফাঁকা গৌরবের মোকাবেলায় নিউটনের সুপ্রসিদ্ধ বানীটি আজো উদ্ধৃত করে বলা চলে যে, ‘জ্ঞান সমুদ্র তটের উপলখণ্ড কুড়িয়ে চলেছি; জ্ঞানের বিশাল ভাণ্ডার আজও আমাদের সামনে অনাবিষ্কৃত রয়েছে।” রুশ বিজ্ঞানীরা সদন্তে ঘোষণা করেছিলেন যে, অগম্যাগমন (incest)-বিরোধ মনোভাব বুর্জোয়া ভাববিলাস ছাড়া আর কিছু নয়; আর সেমতে রুশীয় আইন মাতা-পুত্রে বিবাহ পর্যন্ত বৈধ ঘোষণা করেছিল। স্বল্পজ্ঞান ভয়ংকরী। দু’দশকের তিজ অভিজ্ঞতার পর তাদের আবার সে আইন নাকচ করতে হয়েছে। এখন রুশীয় আইনের এ ক্ষেত্রে আটটি ধাপে নিষেধাজ্ঞা পুর্নবহাল করা হয়েছে। ইসলামে নৈতিকতা ও কানুন অতি নিকট–সংবদ্ধ। কোনো কাজ যদি কর্তার নিজের জন্যে বা অপরের জন্যে ক্ষতিকর হয়, তবে তা নৈতিকতা–বিরোধী; আইন–প্রণয়ন ক্ষেত্রেও এ নীতি সর্বাগ্রে অনুসরণীয়।
সম্পদের মালিকানা
‘মালিকানা’ একটি আইন-বিষয়ক শব্দ। এর অর্থ হলো নিজের বিষয়-সম্পত্তি ভোগ বা বিলি-ব্যবস্থা করবার অবাধ অধিকার। কুরআনে বলা হয়েছে-
فِي السَّمَوَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ له مَا
“আকাশমণ্ডলী এবং পৃথিবীতে যা কিছু রয়েছে সবই আল্লাহর”।
এতেই ব্যক্তিগত বা জাতিগতভাবে সম্পদের উপর মানুষের মালিকানা অস্বীকার করা হয়েছে। মানুষ সম্পদের অধিকারী হবে মালিক হিসেবে নয়, বরং নিজের ও পারিপার্শ্বিক সমাজের উপকারার্থে অছি স্বরূপ। মুসলমানকে তার বিষয়-সম্পদ থেকে আহৃত সুখ-সুবিধা ভোগ করবার অনুমতি দেওয়া হয়েছে; কিন্তু তার প্রতি আসক্ত হতে নিষেধ করা হয়েছে। পাশ্চাত্যের প্রিয় Laissez-faire (let alone) বা অবাধ ব্যক্তিতন্ত্রী মতবাদ নিরঙ্কুশ ব্যক্তিগত মালিকানা স্বীকার করে নিয়েছে এবং যোগ্যতা ও চুক্তির স্বাধীনতার অজুহাতে মালিককে অবাধ অর্জন ও যদৃচ্ছ ব্যয়ের লাগামহীন অধিকার দিয়েছে। এ সত্য উপলব্ধি করতে তেমন কোনো দিব্য জ্ঞানের প্রয়োজন নেই যে, ক্ষমতা ও সম্পদের এই সমাজ ও মানবতা-বিরোধী ব্যবহারই বর্তমান জগতের সর্বপ্রকার দুঃখ-বেদনার উৎসস্থল। ইসলাম মানব জীবন গঠনে ব্যক্তির ভূমিকা অস্বীকার করে না; কিন্তু সমাজ ও মানবতা-বিরোধী কার্যে স্বাধীনতা ও যোগ্যতার অপব্যবহারকে বাধা দান করতে সদা সচেষ্ট রয়েছে। ইসলামে স্বাধীনতার স্বীকৃতি রয়েছে, যথেচ্ছাচারিতার নয়। এভাবে ইসলাম ব্যক্তির প্রচেষ্টাকে উৎসাহ দান করে; কিন্তু ঠিক ততদূর পর্যন্ত, যতদূর তা সাধারণ কল্যাণের সহিত সামঞ্জস্যপূর্ণ থাকে।
ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ
অর্থশাস্ত্রের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের (Individualism) অর্থ হলো ব্যক্তির নিজস্ব মালিকানা। ১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দে বাংলার মহা–মন্বন্তরের আমলে দেখা গেল, ধনিকের প্রাসাদ–দুয়ারে ক্ষুধার্ত নর–নারীরা চারিদিকে অসহায় দৃষ্টি বুলাতে বুলাতে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে, অথচ প্রাসাদাভ্যন্তরে সুস্বাদু খাদ্যসম্ভারের চাপে ডাইনিং টেবিল ত্রাহি ত্রাহি ডাক ছাড়ছে। এ রকম একটি বীভৎস ব্যাপার সম্ভব হলো কি করে? জওয়াব অত্যন্ত সোজা, ব্যক্তিক মালিকানার অবশ্যম্ভাবী ফল। প্রাসাদবাসীরা মনে করতেন, নিজ নিজ আয়ত্ত বিত্ত অন্যদেরকে বঞ্চিত করে আত্ম-কল্যাণে যদৃচ্ছা ব্যবহারের সর্ব প্রকার অধিকার তাঁদের রয়েছে। সম্পদের প্রতি এই মনোভাব থেকেই সমাজবাদ (Socialism) জন্মলাভ করেছে। অতএব সমাজবাদ হলো এই ব্যক্তি-মালিকানা-নীতির একটি ঐতিহাসিক অন্বয় (Anti-thesis) মাত্র।
সমাজবাদ
ইসলামে ‘সমাজবাদ’ বলে কিছু নেই। ইসলামী সমাজবাদ কথাটি একটি আত্ম-বিরোধী উক্তি। ব্যক্তিগত মালিকানা দ্বারা যেমন ব্যক্তির নিজস্ব সম্পদ যদৃচ্ছ ব্যবহারের অধিকার বোঝায়, সমাজবাদ দ্বারাও তেমনি বোঝায় সামাজিক ও জাতীয় সম্পদে সমাজের যদৃচ্ছ অধিকার। এ ক্ষেত্রে ব্যক্তির বদলে সমাজ একটি ব্যক্তিরূপ নেয় মাত্র। তাছাড়া, বিশ্বের জাতিপুঞ্জের মাঝে প্রত্যেকটি জাতিই এক একটি ব্যক্তি বিশেষ। সে হিসেবে সমাজবাদকে বলা যায় বৃহত্তর ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ; এবং ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের যা দোষ-ত্রুটি, তার সব কিছুই এতে শোচনীয়তর রূপে প্রচ্ছন্ন রয়েছে। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের শোষণ ব্যক্তি বা শ্রেণীতেই নিবন্ধ; কিন্তু শক্তিশালী জাতিদের হাতে সমাজবাদ পৃথিবীর দুর্বলতর জাতিসমূহকে শোষণ ও নিষ্পেষণের চূড়ান্ত নির্মম অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়। বংগীয় মহাদুর্ভিক্ষে মানুষ হাজারে হাজারে মৃত্যু বরণ করে, ক্ষুধার জ্বালায় পিতা-মাতা সন্তানদের বিক্রি করে দেয়, এক মুঠো অন্নের বিনিময়ে নারী ইজ্জত বিসর্জন দেয়। অথচ সে সময়েই আমেরিকা ও রাশিয়ায় গমের একটি অতিরিক্ত ফলন হয়। কিন্তু সে অতিরিক্ত ফসল বাজারে এসে শস্য-মূল্যের ঊর্ধ্বগতি বোধ করবে এবং তাতে শস্যাধিপতিদের উচ্চতর মুনাফার উপর অসুবিধাজনক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হবে- এই আশংকায় আমেরিকা লক্ষ লক্ষ টন খাদ্যশস্য আটলান্টিকের অতল গভীরে বিসর্জন দেয় এবং রাশিয়া তার জ্বালানী সম্পদ বাঁচাবার অজুহাতে এই অতিরিক্ত খাদ্যশস্য চুলায় জ্বালিয়ে খতম করে দেয়। শুধু বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ ক্ষুধার্তের কথা বাদ দিলেও, আল্লাহর রাজ্যের পশু-পক্ষী, কীট-পতঙ্গাদি পর্যন্ত সুন্দর ধরণীর এ দান ভোগ করার প্রকৃতিদত্ত অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। আবার জিজ্ঞাস্যঃ কেন এ সম্ভব হলো। এর উত্তরও অত্যন্ত সোজা সমাজবাদের ইহা স্বাভাবিক পরিণতি। আমেরিকা ও রাশিয়া মনে করেছিল যে, তাদের নিজ নিজ সম্পদ স্বজাতির স্বার্থ রক্ষার্থে যে কোনোভাবে ব্যবহার করার অবাধ অধিকার তাদের রয়েছে। ইসলাম এ ক্ষেত্রে দু’ধারী তলোয়ারের মতো ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ ও সমাজবাদ দু’য়েরই সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করে উভয়ের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধানের চেষ্টা করেছে। ইসলামী অর্থনীতির মূল কথা হলো বিশ্বমানবতাবাদ।
বিশ্বমানবতাবাদ
অর্থনীতির ক্ষেত্রে বিশ্বমানবতাবাদ বলতে বোঝায়- (১) আকাশ-রাজি ও পৃথিবীর এই সম্পদের মালিকানা আল্লাহর হাতে ন্যস্ত, এবং (২) সমগ্র মানব জাতি এক বিশ্বভ্রাতৃত্ব বন্ধনে আবদ্ধ। দৈনন্দিন জীবনে এ দুই ধারণাসঞ্জাত মূল্যবোধের কার্যত প্রয়োগের দ্বারা এটাই বোঝায় যে, আল্লাহর প্রত্যেকটি সৃষ্ট-জীবের প্রকৃতিদত্ত অধিকার রয়েছে ধরণীমাতার বুক থেকে আহার্য ও পানীয়ের সংস্থান করে নেয়ার। আল-কুরআনে রয়েছে-
وَالْأَرْضَ وَضَعَهَا لِلأَنَامِ ، فِيهَا فَاكِهَةٌ وَالنَّخْلُ ذات الأكمام وَالحُبُّ ذُو الْعَصْفِ وَالرَّيْحَانُ فَبِأَيِّ آلَاءِ رَبِّكُمَا تُكَذِّبَانِ
“এবং তিনিই তাঁর সমস্ত সৃষ্ট জীবের জন্যে পৃথিবীকে বিছিয়ে দিয়েছেন; তাতে রয়েছে ফলসম্ভার, বোঁটায় বোঁটায় সুকৌশলে ধৃত খেজুর, শীষভর্তি সুঘ্রাণ শস্যাদি; তোমাদের রবের কোন বদান্যতাকে তোমরা অস্বীকার করবে?” (৫৫:১০-১৩)
অতএব, গুটিকতক সৌভাগ্যবান ব্যক্তির ভোগের জন্যে সমাজ ও মানবতা-বিরোধী পন্থায় ব্যবহার করাতো দূরের কথা, আল্লাহর অন্যান্য সৃষ্ট জীবকে বঞ্চিত করে কেবল মানুষের একক ভোগের জন্যেও এই ধরনীকে সৃষ্টি করা হয়নি। প্রত্যেকটি প্রাণীর জীবন ধারনের জন্যে একটি পরিমিত স্থানের প্রয়োজন এবং একে বলা যেতে পারে ‘স্থান-মান’ (Space-ratio)। মানুষের বেলায় এই স্থান-মান সভ্যতার অগ্রগতির সংগে সংগে সংকুচিত হয়ে চলেছে। আদিম পৃথিবীর গুহা-মানব বা মুক্ত মানবের জন্যে প্রকৃতি থেকে নিজ খাদ্য আহরণের প্রয়োজনে হয়ত দশ বর্গমাইল এলাকার প্রয়োজন হতো, আর আজ বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে সভ্য মানুষের জন্যে দশ বর্গগজই যথেষ্ট। যা হোক, সময় ও সামাজিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে প্রত্যেক ব্যক্তির জন্যেই একটি নির্দিষ্ট ‘স্থান-মান’ থাকে। জনসংখ্যা স্থান-মানকে অতিক্রম করে গেলে সংশ্লিষ্ট ভূমির পক্ষে তাদের খাদ্য পরিবেশন সম্ভব হয় না এবং অতিরিক্ত জনসংখ্যাকে সে প্রত্যাখ্যান করে। এই অতিরিক্ত জন বা জীবসংখ্যা যদি অন্য কোথাও গিয়ে দাঁড়াবার মতো স্থান ও অবস্থার সুযোগ পায়, তবে তারা বেঁচে যায়; আর তা না হলে তাদের ধ্বংস অনিবার্য। ধ্বংসের প্রকার ভেদ সম্বন্ধে বলা যায়, উদ্বৃত্ত জনসংখ্যার জন্মভূমি যদি জার্মানীর মতো কোন শক্তিশালী দেশ হয়, তবে তারা যুদ্ধ-যজ্ঞে ধ্বংস হয়, আর যদি তা ১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দের বাংলাদেশের মতো দুর্বল ও অনগ্রসর হয়, তবে তারা শিকার হয় মন্বন্তর ও মহামারীর। প্রকৃতির অর্থশাস্ত্রের এটাই অমোঘ সূত্র। যতদিন পৃথিবীতে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ ও সমাজবাদের অর্থনীতির পরিবর্তে ইসলামী বিশ্বমানবতাবাদের অর্থনীতি কায়েম না হবে, ততদিন যুদ্ধ–বিগ্রহ কিছুতেই বন্ধ হবে না। মানুষের সমাজে স্থায়ী শান্তি, সমৃদ্ধি ও প্রগতির সিলসিলা প্রতিষ্ঠিত করতে হলে পৃথিবীর সব দেশকে সকলের জন্যে উন্মুক্ত করে দিতে হবে এবং পৃথিবীর যে কোন অংশে যে কারুর জন্যে মেহনতের বদলে রুটি-রুজী সংগ্রহের অধিকারের নীতিতে আইনত স্বীকৃতি দিতে হবে। বিজ্ঞান মানুষের দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজন মেটানোর জন্যে স্থান ও কালের ব্যবধানকে প্রায় জয় করেছে। ফলে এই পৃথিবীর জন-সমুদ্রের মধ্যে কোনো জাতি আজ আর নিজেকে একটি আলাদা দ্বীপ বলে কল্পনা করতে পারে না। পৃথিবীর এক অংশে আগুন জ্বললে অন্য অংশ নিরুদ্বেগে বাঁশি বাজিয়ে কাল ক্ষেপণ করবে তা আর সম্ভব নয়। এই আধুনিক সুউন্নত বৈজ্ঞানিক যুগে মানুষকে অবশ্যই একই তরণীর যাত্রীর মতো এক সাথেই হয় ভাসতে নয় ডুবতে হবে। যুদ্ধোত্তর কালের তিক্ত অভিজ্ঞতা আমাদেরকে শিখিয়েছে যে, সাংসারিক জীবনে যেমন, আন্তর্জাতিক জীবনেরও তেমনি আইনের শাসনকে সকলের জন্যে স্বাভাবিক বিধান বলে স্বীকার করে নিতে হবে এবং অন্যত্র দারিদ্র্য বিরাজমান থাকা অবস্থায় ভোগের অধিকার কোন জাতির নেই। এই-ই বিশ্বমানবতাবাদ। আমাদের শতাব্দীর গৌরব-মুকুট সেই জাতির বা জাতিজোটের শিরে শোভা পাবে, যারা ইসলামের এই বিশ্বমানবতাবাদ ও বিশ্বভ্রাতৃত্বের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে তা কার্যকরী করার জন্যে আন্তরিক ও আত্যন্তিক প্রচেষ্টায় আত্মনিয়োগ করবে।
সাম্য
ইসলামের মৌলিক সামাজিক মূল্যবোধ মানুষে মানুষে সাম্যের নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত। ইসলামের বিচারে মানুষের সামাজিক মর্যাদা তার নিজ অর্জিত উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্য ক্ষমতা বা সম্পদের উপর নির্ভর করে না, তার নিজ চারিত্রিক গুণ ও সমাজের উপকারার্থে তার অবদানের উপর নির্ভর করে। ইসলামের মতে, একজন কুশলী ও চরিত্রবান মুচির স্থান একজন অযোগ্য ও চরিত্রহীন সুলতানের উপরে। আল-কুরআনে বলা হয়েছে-
إِنَّ أَكْرَمَكُمْ عِنْدَ اللَّهِ أَتْقَكُمْ
“নিশ্চয়ই আল্লাহর সামনে তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে সম্মানিত সেই ব্যক্তি, যিনি তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে ধর্মপরায়ণ।” (৪৯:১৩)
সাম্য কথার দ্বারা অবশ্য কর্মক্ষমতার সমতা বোঝায় না, বোঝায় সুযোগের সমতা। তানসেন বা বিথোফেন–এর প্রতিভা যাঁর অন্তরে প্রচ্ছন্ন, তাঁকে নিজ ক্ষেত্রে সুযোগ দিলেই তিনি বিশ্বব্যাপী অমরত্ব লাভ করতে পারেন; কিন্তু তাঁকে কোন ইস্পাত কারখানায় কাস্তে–হাতুড়ি তৈরির কাজ করতে বাধ্য করলে, আর কয়জন মিস্ত্রির মতো তিনিও তা তৈরি করতে পারবেন বটে; কিন্তু পৃথিবীর ইতিহাসে আবর্জনার সাথেই তাঁর স্থান হবে। এই দিক থেকে বিচার করলে পুরুষ ও নারীর সমান আসন। সৃষ্টি-ব্যবস্থায় পুরুষ ও নারীর কর্তব্য-কার্য এক নয়। তাদের দেহ-মন ও হৃদয় সৃষ্টি করা হয়েছে নিজ নিজ কর্তব্যের উপযুক্ত করে। কোনো পুরুষ নারীর কর্তব্য পছন্দ করে নিলে বা কোনো নারী পুরুষের কর্মক্ষেত্রে অনধিকার প্রবেশ করলে তাতে দু’জনেরই বিধি-নির্দিষ্ট স্বাভাবিক সীমালংঘন করা হবে। দু’জনকেই তখন নামতে হবে নিজ প্রকৃতির সাথে দ্বন্দ্বে এবং তাতে দু’জনেরই হবে চরম অধঃগতি।
সংস্কৃতি
ললিত-কলা ও সাহিত্য বলতেই সংস্কৃতি বোঝায় না। এসব হলো সংস্কৃতির বাহন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা সাহিত্যের মাধ্যমে উপনিষদের দর্শন প্রচার করেছেন। অন্যপক্ষে বাংলার সাম্যবাদীরা সেই একই সাহিত্যের মাধ্যমে কমিউনিজম প্রচার করেছেন। প্রখ্যাত ভারতীয় নৃত্যশিল্পী উদয়শংকর নৃত্যের মাধ্যমে প্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃতির রূপ দিয়েছেন, আবার পূর্ব বাংলার প্রখ্যাত নৃত্যশিল্পী বুলবুল সেই একই মাধ্যমের সাহায্যে ইরানের সূফীবাদ অভিব্যক্ত করেছেন। সংস্কৃতি হলো মানুষের চারিত্রিক বৃত্তিসমূহের চর্চা, এ রূপ নেয় তার চালচলন ও পারিপার্শ্বিকতা অবলম্বন করে। তা হলে, ইসলামী সংস্কৃতিতে ইসলামী মূল্যবোধের প্রতিফলন থাকতেই হবে। সংস্কৃতির নামে ইসলাম অশ্লীল গান-বাদ্য ও নৃত্যশিল্প তথা যা কিছুই মানুষের চারিত্রিক উন্নয়নের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে, তার কিছুই সমর্থন করে না।
সামাজিক পুনর্গঠন
প্রতিটি আইন-পদ্ধতি কার্যকরীকরণের জন্যে প্রয়োজন হয় তার অনুকূল একটা সমাজ-ব্যবস্থা। নৈর্ব্যক্তিক চিন্তার কাছে যতই সুষ্ঠু ও প্রগতিশীল প্রতিভাত হোক না কেন, কোনো কানুন, কোনো প্রথা বা কোনো মূল্যবোধ বিরোধী পরিবেশে সামাজিক জীবন প্রয়োগ করা সম্ভব হয় না বা তাতে যথার্থ কৃতকার্যতা লাভ করা যায় না। উদাহরণত আধুনিক জগতের শ্রেষ্ঠতম আইন-পদ্ধতি বলে স্বীকৃত বৃটিশ আইনের শাসন সোভিয়েত রাশিয়ায় প্রয়োগ করা চলে না। অন্য পক্ষে রুশীয় সম্পত্তি-আইনও ধনবাদী ইংল্যান্ডে প্রয়োগ করা অসম্ভব। ইসলামী ব্যবস্থাবলী সম্পর্কেও একথা সমভাবে খাটে। সমাজের ইসলামীকরণ সম্পন্ন করতে হলে, এখানে সেখানে জোড়াতালি দিয়ে চলবে না, চিন্তা-ভাবনা ও কর্মের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ বিপ্লব আনতে হবে। এ কাজ সাধনে রাষ্ট্রের ভূমিকা সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। রাষ্ট্রকে সমস্ত শক্তি-সামর্থ ও আয়োজন নিয়ে সুশৃংখল সৈন্যদলের মতো দৃঢ়পদে এ দ্বন্দ্ববহুল পথে এগিয়ে আসতে হবে। ইসলামের আলোকে ব্যক্তিকে তার রীতি-নীতি সুসংহত করে তুলতে হবে; সমাজকে অনবরত সজাগদৃষ্টি রাখতে হবে তার রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানাবলীর কার্যক্রমের প্রতি এবং রাষ্ট্রকে তার আদর্শ রূপায়িত করতে হবে বিধি-ব্যবস্থা ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে; আর এভাবেই সৃষ্টি হবে দারুল ইসলাম- ইসলামের অনুকূল পরিবেশ, যেখানে ইসলামী মূল্যমানের উত্তরোত্তর বিকাশ ও উন্নয়ন হবে সহজ, স্বাভাবিক ও স্বচ্ছল-গতি।
(অনুবাদ: কামাল উদ্দিন খান)