যে সকল পরিভাষা ইসলামী জ্ঞানের ধারা ও সংস্কৃতিকে প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এবং প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে ‘তাফাক্কুর’ (চিন্তা) হলো সেগুলোর মধ্যে অন্যতম। কোরআনের আয়াতসমূহকে নিয়ে গবেষণার ফলে, তাফসীর, ফিকহ, ইলমূল কালামের মত জ্ঞানের গুরুত্ত্বপূর্ণ শাখাসমূহ উদ্ভাবিত হয়েছে এবং অনুপম এক ইলমী (জ্ঞানগত) জগৎ গড়ে উঠেছে। মহাগ্রন্থ আল কোরআনের আয়াত সমূহ আমাদেরকে মহাবিশ্ব নিয়ে চিন্তা (তাফাক্কুর) করার জন্য অনুপ্রেরণা দিয়েছে। কোরআনের এই প্রেরণায় অনুপ্রাণিত হয়ে মুসলমানগন প্রাকৃতিক বিজ্ঞানসমূহ (Natural Sciences) নিয়ে ব্যাপকভিত্তিক গবেষণা এবং এই সম্পর্কিত অনেক গ্রন্থ রচনা করে এই অঙ্গনকে অনেক বেশি সমৃদ্ধ করে তুলেছে।
আনফুসী জগতে (মানুষের অভ্যন্তরীণ) বাস্তবায়িত তাফাক্কুর (চিন্তা) মনোবিজ্ঞান (সাইকোলজি) এবং আখলাকের মতো বিভিন্ন ধরণের জ্ঞানের পাশাপাশি আমাদের অন্তর্জগতকে সমৃদ্ধকারী এক ইরফানের ধারা সৃষ্টিতে সাহায্য করে। মহাগ্রন্থ আল কোরআনে উল্লেখিত চিন্তা সম্পর্কিত পরিভাষার দিকে যদি তাকাই তাহলে দেখতে পাই যে, এই চিন্তারধারা তায়াক্কুল (التعقل ),তাফাক্কুর ( التفكر) , তাদাব্বুর (التدبر) , তাজাক্কুর (التذكر) , তায়াম্মুল (التأمل), নাজার (النظر), বাসার (البصر) এবং ইতিবার (الاعتبار ) এই সকল পরিভাষার সমন্বয়ে গঠিত হয়েছে।
তায়াক্কুল হলো, যে সকল অংশসমূহ চিন্তা করে, সে সকল কিছুকে সব সময় চিন্তা করার দিকে ধাবমান রাখা এবং চিন্তাকে ইস্তিকামাতের উপর রাখার চেষ্টা করা। তায়াক্কুলের ফল হলো তাফাক্কুর। এজন্য আলাদা কোনো সময় নেই। সর্বাবস্থায় সকল বিষয়ে চিন্তা করার নাম তাফাক্কুর।
‘জিকরা’ ذكري এবং ‘জাকির’ ذاكر থেকে উদগত তাজাক্কুর (التذكر) হলো অতীত নিয়ে চিন্তা করা।
‘দাবার’ বা ‘তাদবীর’ থেকে উদগত তাদাব্বুর (التدبر) হলো আকিবাত, ফলাফল, পরিণামের ব্যাপারে চিন্তা করা।
তায়াম্মুল (التأمل) শব্দটি উদগত হয়েছে أمل শব্দ থেকে। এর অর্থ হলো ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করা।
নাজার (النظر ) হলো আমরা যেটা দেখি বা অবলোকোন করি সেটা নিয়ে চিন্তা করা। মহাবিশ্ব ও সৃষ্টি জগতকে আকলের মাধ্যমে অবলোকন করা।
বাসার (البصر) হলো, ‘আকল ও কালব’ এর মধ্যে সমন্বয় সাধন বা এই দুটিকে একে অপরের সাথে একীভূত করা। মহাবিশ্ব ও সৃষ্টি জগতকে অন্তর দিয়ে দেখা। কথা ও চিন্তার মাধ্যমে আমরা অর্থ (মা’না) ও হাকীকতে পৌঁছাতে পারি । আর তাফাক্কুর ( التفكر), ইবরাত ( العبرة ) এর মাধ্যমে ই’তিবারে পৌঁছা যায়।
“হে দৃষ্টিশক্তির অধিকারীরা শিক্ষাগ্রহণ করো।” (সূরা হাশরঃ ০২)
আমরা যদি উসূলের কিতাব সমূহের দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাই যে, ফকীহগণ এই আয়াতটিকে ইজতিহাদের দলীল হিসেবে উল্লেখ করেছেন। আর মুজতাহিদ হলেন তিনি, যিনি এই সকল চিন্তা পদ্ধতিকে একত্রিত করে দ্বীনকে সঠিক ভাবে বুঝার জন্য আমাদের জন্য পদ্ধতি ও পন্থা উদ্ভাবন করেন।
বর্তমান যুগে ইসলামী চিন্তা ও বিশ্বাসকে নতুন করে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য, ইসলামী চিন্তার মূলধারা এবং মূলনীতি সমূহকে এই সকল পরিভাষার আলোকে নতুন করে পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। একটি নব সভ্যতা প্রতিষ্ঠা করার জন্য কিংবা একটি সভ্যতাকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য প্রথমে আমাদেরকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, আমরা এই ব্যাপারে কোন উৎসকে মূল ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করবো এবং এই সকল উৎসের সাথে আমরা কেমন সম্পর্ক স্থাপন করবো?
এর সঙ্গে অন্য যে কাজটি আমাদের করতে হবে তা হলো, এর সাথে সঙ্গতিপূর্ণ একটি উসূল ও মেথডোলজি দাঁড় করাতে হবে। এই ক্ষেত্রে সর্বপ্রথম যে কাজটি করতে হবে তা হলো, ইসলামী চিন্তার ইতিহাসের মৌলিক বিষয়সমূহ গঠনকারী মৌলিক বিষয়াবলীকে নির্ধারণ করতে হবে। এই সকল বিষয়কে নির্ধারণ করার সময় আংশিক নয়, সামগ্রিক একটি অধ্যয়ন অতীব জরুরী। আংশিক অধ্যয়ন কখনোই সঠিক সমাধান বয়ে আনতে পারে না। তাই সামগ্রিক অধ্যয়নের কোন বিকল্প নেই। কেননা ইসলামী চিন্তার ইতিহাস সামগ্রিকভাবে একে অপরের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত।
ইসলামী সভ্যতার ধারণাকে যদি আমরা সকলের মানসপটে অঙ্কন করে দিতে চাই, তাহলে আমাদেরকে আমাদের অতীত চিন্তা, অভিজ্ঞতা ও জ্ঞানকে গভীরভাবে অধ্যয়ন করতে হবে এবং সেগুলোকে আধুনিকায়ন করে মুসলিম উম্মাহর সামনে পেশ করতে হবে। এটা করা ছাড়া ইসলামী সভ্যতার ইহইয়ার (রেনেসাঁ) চিন্তা গড়ে উঠা অসম্ভব। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আজ মুসলমানরা ইসলামী চিন্তার মৌলিক উৎস (গ্রন্থ) সমূহকে অধ্যয়ন করেনা। শুধু তাই নয়, এই সকল বই অধ্যয়ন ও বুঝার ক্ষেত্রে একটি পদ্ধতিগত (মেথডোলজিক্যাল) সমস্যা বোধ করে থাকে।
ইসলামী চিন্তার এই সকল মৌলিক গ্রন্থ সমূহকে অনেকেই সাধারণ বই ভেবে যেনতেনভাবে পাঠ করে থাকে। যার ফলে তারা এই সকল বইকে বুঝতে সক্ষম না, আর না বুঝার ফলে এই সকল মৌলিক গ্রন্থকে গুরুত্বহীন মনে করে ফেলে রাখে। অনেক সময় এমন হয় যে, এই সকল মৌলিক বইয়ে ব্যবহৃত পরিভাষা সমূহকে না বুঝার কারণে ঐ সকল বইকে ব্যাখা বিশ্লেষণ করতে পারে না এবং সমৃদ্ধ ও আধুনিকায়ন করে তার রূহকে বর্তমান সময় পর্যন্ত পৌঁছাতে সক্ষম হয় না।
তবে একটি বিষয় এখানে খেয়াল রাখতে হবে, অতীতের ঐসকল মৌলিক বই সমূহ অধ্যয়ন করার সময় অতীতকে যেন পুনরাবৃত্তির জন্য না পড়ি, অতীতকে যেন সমালোচনার ঊর্ধ্বে মনে করে সেগুলোর অন্ধ অনুকরণ শুরু করে না দেই। এখানে একটি বিষয় আমাদেরকে খুব ভালোভাবে বুঝতে হবে তাকলীদ (Imitation, অন্ধ অনুকরণ) ও তাকিব (অনুসরণ, follow) করার মধ্যে মৌলিক কিছু পার্থক্য রয়েছে, এই পার্থক্যকে ভুলে গেলে চলবে না। অতীতে লেখা মৌলিক বই সমূহের মাধ্যমে অতীতের তাকলীদ নয় বরং ঐ সকল মৌলিক উৎস সমূহ চিন্তার ক্ষেত্রে যে প্রবাহমানতা ও গতিপথ দেখিয়ে গিয়েছে সে গুলোর অনুসরণ করা। যে সকল বই-পুস্তক বর্তমানের সমস্যাকে সমাধান করে না, বর্তমানকে মূল ভিত্তি হিসেবে নেয় না, বর্তমানকে বুঝতে সাহায্য করে না, সে সকল বই পড়ার মধ্যে কোন ফায়দা নেই।
এজন্য আমরা যখন ইসলামী চিন্তার মৌলিক গ্রন্থ সমূহকে পড়ার কথা বলি তখন যেন কেউ এই কথা না বলে যে, আমরা বর্তমানকে বাদ দিয়ে অতীতে নিয়ে যেতে চাই। আমাদের উচিত হলো অতীত,বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ এই তিনের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করে সামনের দিকে অগ্রসর হওয়া। বর্তমানকে সঠিকভাবে বুঝতে হলে বর্তমানকে জন্মদানকারী গতকালকে ভালোভাবে বুঝতে হবে, আবার আগামীকালকে বিনির্মাণ করতে হলে বর্তমানকে ভালোভাবে বুঝতে হবে।
ওরিয়েন্টালিস্টদের দ্বারা লিখিত সিস্টেমেটিক ইসলামী চিন্তার ইতিহাস এবং এই সকল লেখা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে বেড়ে উঠা অনেক ইসলামী চিন্তাবিদগণ, ইসলামের ছায়াতলে গড়ে উঠা ভিন্ন মাযহাব সমূহের মধ্যকার ‘ঐক্যমতপূর্ণ ’ বিষয় সমূহকে চিহ্নিত করা ও সামনে আনার পরিবর্তে ভিন্নতা ও ইখতিলাফী বিষয় সমূহকে সামনে নিয়ে এসেছে। ফলশ্রুতিতে ইসলামী চিন্তার যে এক বিশাল অভিজ্ঞতা রয়েছে, এর মধ্যকার অভ্যন্তরীণ সামগ্রিকতা ( internal integrity), সঙ্গতি এবং প্রবাহমানতা থেকে তারা দূরে সরে গিয়েছে। ভিন্ন ভিন্ন মাযহাবের অনুসারীদের মধ্যে অধিকতর কম গুরত্ত্বপূর্ণ বিষয় সমূহ নিয়ে বিতর্ক তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব সংঘাত সৃষ্টি করেছে।
পাশ্চাত্য দর্শনের থিওলোজিক ধারার মধ্যে ক্যাটাগরিক্যাল পার্থক্যসমূহকে বিশ্বজনীন করে ফেলার ফলে, এই ক্যাটাগরিক্যাল পার্থক্য সমূহকে সকল ধর্মের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য বলে ধরে নিয়ে বিতর্কের ঊর্ধ্বে রাখা হয় এবং সকলে এগুলোকেই সত্য বলে ধরে নেয়। থিওলোজি, ফিলোসফি এবং মিসটিসিজম (সুফিবাদ) এই ক্যাটাগরিক্যালি পার্থক্যকে ইসলামী চিন্তার ইতিহাসের উপর প্রয়োগ করলে আমরা দেখতে পাই যে, ইসলামী চিন্তা-দর্শনে এগুলো কালাম, ফিলোসফি এবং তাসাউউফ ( বায়ান, বুরহান এবং ইরফান) এই নামে ছিল এবং এই চিন্তা পাশ্চাত্যের চিন্তা দর্শনের চেয়ে অনেক উচ্চে অবস্থিত। এই সকল উচ্চ চিন্তা সমূহের উপস্থিতিই মুসলমানদেরকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিল।
অনুবাদঃ বুরহান উদ্দিন আজাদ


