পাশ্চাত্যের দার্শনিকদের ধর্ম সম্বন্ধে সংশয়ের ভাব সৃষ্টি হলেও মুসলমানদের সন্দেহের কোন কারণ থাকতে পারে না। খ্রীষ্টধর্ম যেখানে শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়েছে, ইসলাম সেখানে নির্বিঘ্নে কৃতকার্য হয়েছে।

প্রথমতঃ ইসলাম মানুষের জীবনকে পার্থিব ও আধ্যাত্মিক ভাগে পৃথক করেনি। ধর্ম একটা নিছক আধ্যাত্মিক বিশ্বাস নয়। আমাদের নবী ২৩ বছর ধরে যে মতবাদের জয়গান গেয়েছেন, তা শুধু মানুষের আধ্যাত্মিক জগতেই সীমাবদ্ধ ছিল না। তিনি শুধু ব্যক্তির মঙ্গলের জন্যই পথনির্দেশ করেননি। তিনি সমগ্র সমাজের মুক্তির গান গেয়েছেন। জীবনের সকল সমস্যা কি ইন্দ্রিয়গত, কি নীতিগত, কি ধর্মবোধ, কি সৌন্দর্যবোধ সকল প্রশ্নেরই সমাধান এতে নিহিত আছে। তিনি আমাদেরকে বহু-আকাঙ্ক্ষিত এমন এক মতবাদের সন্ধান দিয়েছেন, যা সাম্যের উপর প্রতিষ্ঠিত। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক রূপরেখাও এতে অতি সুষ্ঠুভাবে নির্দেশিত হয়েছে। ব্যক্তির আশা-আকাঙ্ক্ষা ও সামাজিক দায়িত্বের এমন অপূর্ব প্রতিফলন অপর কোন ধর্মে দেখা যায় না। যেহেতু ইসলাম মানুষের পার্থিব ও আধ্যাত্মিক জগতকে পৃথক করে না, সেহেতু এতে জীবনের প্রাকৃতিক ও অতিপ্রাকৃতিক এই দুই ভাগে বিভক্ত হবার সম্ভাবনা নেই। একজন মুসলমানের নিকট যা কিছুই হোক কেন, প্রাকৃতিক জগতের মধ্যেই তা সীমাবদ্ধ আর এই প্রকৃতি হচ্ছে দৃশ্য-অদৃশ্য, মূর্ত-অমূর্ত সকল সৃষ্টির প্রতীক। প্রকৃতি আল্লাহর ইচ্ছায় নিয়ন্ত্রিত। এই জাতীয় সুষ্ঠু মতবাদে মানুষের পার্থিব ও আধ্যাত্মিক সত্তার কোন বিরোধই থাকতে পারে না। তারা অখন্ড – তারা সমান গুরুত্বপূর্ণ।

দ্বিতীয়তঃ ইউরোপের ইতিহাসে খ্রীষ্টান পাদ্রীগণ যে ঘৃণ্য ভূমিকা পালন করেছেন, ইসলামে তার কোন নজির খুঁজে পাওয়া যাবে না। যুগে যুগে ইসলামের কর্ণধারগণ মানুষের অধিকার অত্যন্ত প্রশংসার সঙ্গে রক্ষা করে গিয়েছেন। এমনকি মানুষের অধিকার রক্ষার জন্য তারা অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে শহীদ হয়েছেন – ব্যর্থ করে দিয়েছেন ক্ষমতাসীনদের সব চক্রান্ত।

তৃতীয়তঃ লাগামহীন চিন্তা এবং খ্রীষ্টান পাদ্রীদের চক্রান্তের ফলে সবসময়ই বিজ্ঞান ও খ্রীষ্টান ধর্মের মধ্যে বিরোধ বর্তমান ছিল। কিন্তু উলামাদের চিন্তায় কিংবা ধর্মের ভাবধারায় কোথাও আমরা ইসলামের সঙ্গে বিজ্ঞানের সংঘাত লক্ষ্য করি না।

এই তৃতীয় বক্তব্যটি আমাদের আলোচনার গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারণ এই সংঘাত পারলৌকিক প্রবণতা ও বিজ্ঞানের জয়যাত্রা বিরোধী মনোভাব থেকে সৃষ্টি হয়েছে, তা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। আমরা যদি আর একটু গভীরভাবে ব্যাপারটি পর্যালোচনা করি, তাহলে দেখতে পাব, বর্তমান কালে অতি আলোচিত কথা হচ্ছে “ধর্ম বিজ্ঞান বিরোধী”। এ মূলতঃ ধর্মযাজকদের তথাকথিত স্বাধীন চিন্তার ফল। কিন্তু পাশ্চাত্যের চিন্তানায়কগণ কোনদিন চিন্তা করে দেখেননি যে, খ্রীষ্টানদের এই জাতীয় মনোভাব প্রত্যেক ধর্মের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য কিনা।

যে অহং বিশ্বাসে তারা পাশ্চাত্য সভ্যতাকে সকল সভ্যতার শ্রেষ্ঠ বলে দাবী করে, ঠিক একইভাবে ভায়া পাশ্চাত্য সভ্যতাকে তারা সকল ধর্মের শ্রেষ্ঠ বলে প্রচার করার চেষ্টা করেছে। খ্রীষ্টান পাদ্রীরা ভালো-মন্দ যা-ই করুক না কেন, তা-ই ধর্মের মানদণ্ড বলে প্রচার করা হয়েছে।

এতদিন বিরোধিতা করে আসলেও আজ খ্রীষ্টান পাদ্রীগণ বলতে বাধ্য হচ্ছেন যে, ধর্মের সঙ্গে বিজ্ঞানের কোন বিরোধ নাই। কিন্তু এ সাধারণ সত্যকথা অপরাপর ধর্ম তো বহু প্রত্যুষকাল থেকেই প্রচার করে আসছে। একথা তাই আমরা জোর দিয়ে বলতে পারি যে, অপরাপর ধর্মের সঙ্গে বিজ্ঞানের কোন বিরোধ নাই।

আমি অপরাপর ধর্ম বলতে অবশ্য ইসলামের কথাই বলছি। বস্তুতঃ ইসলামের ইতিহাস বিজ্ঞানের প্রতি যে সম্মান দেখিয়েছে, খ্রীষ্টধর্মের কোথাও তা পাওয়া যাবে না। ইসলাম বিজ্ঞানকে শুধু শ্রদ্ধার চোখেই দেখেনি, তা বিজ্ঞান ও বুদ্ধিগত প্রচেষ্টার উপর সেবার ঐশীবাণী বর্ষণ করেছে। খ্রীষ্টধর্মে মনীষীদের উপর অসীম অত্যাচার নেমে এসেছে – বিজ্ঞানের অগণিত কীর্তি ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে – সকল প্রকার স্বাধীন চিন্তার প্রকাশকে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। কিন্তু ইসলামের ইতিহাসে এই জাতীয় কাজের চিহ্নও খুঁজে পাওয়া যাবে না। যে সমস্ত খ্রীষ্টান মনীষী তদানীন্তন গোঁড়ামি মতবাদ থেকে মুক্তি পাবার চেষ্টা করেছেন, তাঁদের উপর অমানুষিক উৎপীড়ন চালানো হয়েছে। কিন্তু ইসলাম এর সম্পূর্ণ বিপরীত। সেখানে জ্ঞানার্জনকে সকল মানুষের জন্য পবিত্র কর্তব্য বলে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সুতরাং, এটা কোন আকস্মিক ঘটনা নয় – মুসলিম বিজ্ঞানীগণ আজ পৃথিবীর ঘরে ঘরে অতি পরিচিত নাম। তাঁদের দেয়া বিজ্ঞানের অগণিত মতবাদ আজ পৃথিবীর সর্বত্র গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হয়।

জ্ঞানার্জনের মধ্যেই যে আল্লাহর ইবাদত নিহিত আছে সেই শিক্ষা তাঁরা কোরআন ও হাদীস থেকেই পেয়েছিলেন। নবীজীর সেই মহান বাণী “আল্লাহ ঔষধ ছাড়া কোন রোগ পৃথিবীতে পাঠাননি” পাঠ করে তারা বুঝতে পেরেছিলেন যে, কোন রোগের ঔষধ বের করার গবেষণা মূলতঃ আল্লাহরই ইবাদত। এই জন্যই মানব কল্যাণের জন্য কাজ করাকে এক পবিত্র ধর্মীয় দায়িত্ব বলে মনে করা হয়। আল্লাহ বলেন- “আমি সবকিছু পানি থেকে সৃষ্টি করেছি।” এই মহাসত্যের গভীরতা অনুধাবন করার জন্য মুসলিম বিজ্ঞানীগণ জীবিত প্রাণী পরীক্ষা করতে শুরু করলেন। ফলে জীব-বিজ্ঞান জন্মলাভ করল। কোরআনের মতে নক্ষত্ররাজির সুশৃঙ্খল গতিপ্রকৃতি আল্লাহরই মহিমা প্রকাশ করছে। এর ফলে মুসলমানগণ জ্যোতির্বিজ্ঞান বিজ্ঞান ও অঙ্কশাস্ত্র সম্বন্ধে বহু জটিল সমস্যার সমাধান উদ্ঘাটন করেন। এইভাবেই একের পর এক দেহবিজ্ঞান, রসায়ন ও প্রাণী- বিজ্ঞানের জন্ম হয়। বিজ্ঞানের এই সময় ব্যায় মুসলিম বিজ্ঞানীদের কীর্তি ভাস্বর হয়ে আছে।

তৎকালীন মুসলমানদের এই ধারণা বদ্ধমূল ছিল যে, বিজ্ঞানীগণ মূলত আল্লাহরই সেবা করছেন। নবী করীম (সাঃ)ও এটা বলেছেন। মুসলিম সুলতানগণ কর্তৃক বিজ্ঞানীদের সর্বোচ্চ সম্মান প্রদর্শনের অসংখ্য ঘটনা ইসলামের ইতিহাসকে সমুজ্জ্বল করে রেখেছে। হিজরীর পর প্রথম ৫ শতাব্দী ইসলামী সভ্যতা বিজ্ঞানের প্রতি অকুন্ঠ সমর্থন জানিয়ে এসেছে। জ্ঞানের এমন সমাদর কোথাও দেখা যায়নি। মানুষের কীর্তির প্রতি ইসলামের এই স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন সমগ্র মানব জাতির ইতিহাসকে গৌরবজ্জ্বল করে রেখেছে। যুগে যুগে ইসলাম জ্ঞান ও মেধাকে স্বাগত জানিয়েছে,  কিন্তু সন্যাস ও অলসতাকে নিরুৎসাহিত করেছে।

এখন সমসামধিক পাশ্চাত্য চিন্তানায়কদের ধর্ম সম্বন্ধে কি ধারণা, সেটি দেখা যাক। তাদের মতে “এটা অবশ্যই স্বীকার করতে হবে, বর্তমানের শ্রেষ্ঠ ধর্মগুলির সমালোচনা মোটেই অমূলক নয়। তাদের বুদ্ধির একগুয়েমি এবং সর্বেশ্বরবাদের ধারণা মানুষের মনকে পার্থিব ও সমাজিক জগত থেকে বহুদূরে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে। পারলৌকিক জগৎ সম্বন্ধে তাঁদের ধারণা, বর্তমান মানসিকতার প্রকৃতিবিরুদ্ধ এবং এর ফলে বিজ্ঞান ও মানুষের জ্ঞানার্জন ধ্বংসের সম্মুখীন হয়েছে বর্তমান সভ্যতা এমন এক ধর্মের জন্য উদগ্রীব হয়ে আছে, যা মানুষের পার্থিব ও সামাজিক উন্নতি নিশ্চিত করতে পারে। (খ্রীষ্টান ডসন এর ‘প্রগ্রেস এন্ড রিলিজিয়ন’ হতে, পৃঃ ২১, ১৯৩৮ সাল)

এখন আমরা যদি এই বক্তব্যের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচার-বিশ্লেষণ করি, তাহলে দেখতে পাব, এ ধারণা অপরাপর ধর্মের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হতে পারে, কিন্তু ইসলামের ক্ষেত্রে না। খৃষ্টধর্মে চিন্তার স্বেচ্ছাচারী স্বাধীনতা থাকলেও ইসলামে তা নাই। অপরপক্ষে, ইসলামের মূল্যবোধ যুক্তি ও সাধারণ জ্ঞানের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে, তাই দুর্বোধ্য উচ্ছ্বাসের কোন স্থান ইসলামে নেই। আল্লাহই হচ্ছেন সব বিষয়ের অধিকর্তা, ইসলাম সর্বেশ্বরবাদে বিশ্বাস করে না। অপর পক্ষে সর্বশক্তিমান, মহাপরাক্রমশালী, দয়ালু, এক এবং অদ্বিতীয় আল্লাহর সৃষ্টি মাহাত্ম্য প্রচার করে । তার জ্ঞান-গরিমা সম্বন্ধে অন্য যে কোন মতবাদ গ্রহণযোগ্য নয়। ইসলামের প্রকৃত শিক্ষার সঙ্গে এদের কোন সম্পর্ক নেই। আমরা আরও জানি, ইসলাম মানুষের মনকে পার্থিব ও সামাজিক দায়িত্ব উপেক্ষা করতে উপদেশ দেয় না। পার্থিব জগৎ সৃষ্টির এক বিস্তৃত রাজ্যে এখানকার কর্তব্যকর্ম ও জীবনের উন্নতিসাধন ধর্মের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। একপাক্ষিক পারলৌকিক প্রভাবে প্রভাবিত না হয়ে ইসলাম মানবজীবনের জ্ঞানার্জনের প্রতি বিশেষ জোর দিয়ে থাকে হয় এইভাবে পার্থিব ও সামাজিক দায়িত্ববোধকে উৎসাহিত করে। সামাজিক দায়িত্ববোধের এই উৎসাহ বর্তমান সভ্যতার সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন।

মোটকথা, কোন কালেই বিজ্ঞানের সঙ্গে ইসলামের বিরোধ ছিল না এবং এখনও নেই। এর কারণ, মানব প্রকৃতির সঙ্গে ইসলাম একাত্ম হয়ে আছে। ইসলামের শিক্ষা হলো হৃদয়, জীবন ও সমাজের শিক্ষা। এ কারণেই সত্যের প্রতি আকৃষ্ট হবার জন্য ইসলাম এত সহজে মানুষকে অনুপ্রাণিত করতে পেরেছে।

‘ধর্ম অতীতের বস্তু’ এ চিৎকার মূলত পাশ্চাত্য দেশীয়, মুসলিম জগতে এর কোন স্থান নাই। যে সমস্ত অদূরদর্শী ব্যক্তির পাশ্চাত্য সভ্যতার প্রতি দুর্বলতা আছে, তারাই কেবল ধর্মের এই সমালোচনাকে যথার্থ বলে স্বীকার করে নিতে পারে – কিন্তু আমরা পারিনা। কারণ,  আমাদের জীবনবিধান কালজয়ী। মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও তার রাজনীতি, সমাজনীতি এবং অর্থনীতির এমন নির্ভীক প্রতিফলন অপর কোন ধর্মে নেই। ইসলাম এক পরিপূর্ণ ধর্ম, এক পরিপূর্ণ জীবন-দর্শন।

সূত্রঃ (সংঘাতের মুখে ইসলাম, মুহাম্মদ আসাদ; মক্কার পথ, মুহম্মদ আসাদ)

 

১৪৩৮ বার পঠিত

শেয়ার করুন

মতামত প্রকাশ করুন

Scroll to Top