ইসলাম ও সংস্কৃতি- এ দুটি শব্দ পাশাপাশি উচ্চারণের মধ্যে সন্দেহ সংঘাতের একটা প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিতের সন্ধান পাওয়া যায়। ভাবটা এই রকমঃ ধর্ম আর সংস্কৃতির মধ্যে তো হামেশা সামঞ্জস্য দেখা যায় না; এখন বল তো, ইসলাম আর সংস্কৃতির মধ্যে সম্বন্ধটা কেমন?
এমন সন্দেহের সঙ্গত কারণ আছে। অতীতের কোন ধর্ম সংস্কৃতির সাথে সঙ্গতি রক্ষা করে চলে নাই। ইংল্যান্ডে কোন কোন বিশিষ্ট শিক্ষিত ব্যক্তি ধর্মীয় জীবন-যাপন করতে গিয়ে গায় চাম উকুনের চাষ করেছেন। হয়তো-বা সকালে-বিকালে নিজ হাতে গায়ে বেত মেরে মেরে রক্ত সঞ্চার করেছেন। স্পেনের ইতিহাস লেখক লেইনপুল তাঁর ‘মুস ইন-স্পেন’ নামক বইয়ে লিখেছেনঃ তৎকালীন স্পেনে এমন খ্রিস্টান-সাধিকা ছিলেন, যাঁরা গর্ব করে বলতেন: ‘আমার বয়স সত্তর পার হয়ে গেছে; এর মধ্যে জর্দন নদীর পানি ছাড়া আর কোন পানিতে আমার আঙ্গুলের ডগা ডুবাই নাই।’ এঁদের সমসাময়িক সমাজ এঁদের অকাতরে শ্রদ্ধা অর্ঘ্য দান করেছে; কিন্তু সংস্কৃতি এঁদের জীবন থেকে সভয়ে দূর-দূরান্তে পালিয়ে গেছে।
অথচ মানুষের দেহ, মন ও সমাজের সংস্কারের জন্যই ধর্মের উত্তর। দেহে যাতে ময়লা জমে না থাকতে পারে, তার জন্য ব্যবস্থা হল- ওজু-গোসলের। দেহ সাফ থাকলে মনের পক্ষে সাফ থাকা সহজ হয়। তাই ওজু-গোসল দেহ-মন উভয়ই সাফ রাখার সহায়ক। দেহ-মন সাফ থাকলে দেহ মনের স্বাস্থ্য অটুট থাকে- ভালো ভাবনা-চিন্তার দিকে দিল সহজে রুজু হয়। এ জন্য আরবরা বলত: ‘সাফ সাফাই খোদায়ী গুণের শামিল।’ ইসলামের এই কথাই ‘Cleanliness is next to Godliness’ প্রবাদরূপে সেকালে ইউরোপময় ছড়িয়ে পড়েছিল।
ওজু-গোছল ধর্মের অঙ্গ। আর Cleanliness is next to Godliness- ধর্ম ও সংস্কৃতি উভয়ের অঙ্গ। অতএব, এখানে ইসলামের সঙ্গে সংস্কৃতির বিরোধ নাই, বন্ধুত্ব আছে। সংস্কৃতি সংস্কারের ফল। কোন বস্তু বা মনোভাবকে ঘসে মেজে সুন্দর করার কাজকে আমরা সংস্কৃতায়ন বলতে পারি। সংস্কৃতিকে আরবীতে বলে ‘তমাদ্দুন’। তমাদ্দুন শব্দ ‘মদীনা’ শব্দ থেকে উন্নত; মদীনা মানে শহর। তমাদ্দুন মানে শহর সুলভ সুন্দর মার্জিত রূপায়ণ। সেকালে শিক্ষা-সভ্যতা শহরে আবদ্ধ থাকত; পল্লী সাধারণত থাকত সে শিক্ষা-সভ্যতার প্রভাবের বাইরে। কাজেই পল্লীবাসীদের পক্ষে অমার্জিত থাকা স্বাভাবিক ছিল। শহুরে লোকেরা তাই গাঁয়ের মানুষকে অবজ্ঞার চোখে বলত, ‘ওরা গাওয়ার’- আমরা বলি গোঁয়ার। গোঁয়ারের আচার-ব্যবহার, চিন্তা-ভাবনার সংস্কার বা সংস্কৃতি সমিতির যেমন কাজ, ধর্মেরও তেমনি কাজ। দুনিয়ার সকল ধর্ম মূলত মানুষের কল্যাণ বিধানের জন্যই এসেছে। সে কল্যাণের দুয়ার সকল ধর্ম সমানভাবে খুলে দিতে পেরেছে- এ আমরা বলি না। কোন কোন ধর্ম মানুষের কল্যাণ যত করেছে, আখেরে অকল্যাণ করেছে তার চেয়ে বেশী। অবশ্য তা ইচ্ছাকৃত নয়, বুঝবার ভুল। মোট কথা, নীতিগতভাবে ধর্ম ও সংস্কৃতির মধ্যে বিরোধ থাকার কথা নয়; অথচ কার্যক্ষেত্রের কোন কোন অঙ্গনে এমন বিরোধ অতীতে ঘটেছে এবং বর্তমানেও ঘটছে।
এ বিরোধের কারণ সম্বন্ধে আমাদের যা মনে হয়েছে, তা বলি।
(ধর্ম সুনির্দিষ্ট আইন-কানুনের কাঠামোতে আবদ্ধ। সংস্কৃতির এমন বাঁধা-ধরা আইন-কানুন নাই) অজু-গোসল ধর্মের অঙ্গ। ওজু-গোসল করার সুনির্দিষ্ট তরতীব আছে। নাকে ময়লা না থাকলেও অজুর সময় তিনবার নাকে পানি দিতে হয়; দুইবার পানি দিলে মনে হয়, ওজু ঠিক মত করা হল না। সংস্কৃতিবাদীরা বলবেন, অত বাঁধা ধরা নিয়মের বেড়ী কেন? নাকে ময়লা না থাকলে দুইবার পানি দিলেই তো যথেষ্ট। আর গোসলের সময় শরীরের সমস্ত অঙ্গই যখন ধোয়া হয়, তখন গোসলের পর নামাজের জন্য ফের আলাদা ওজু করার দরকার কি?
সনাতন শাস্ত্রবাদী বলেন: না, সংস্কৃতিবাদীকে এতো স্বাধীনতা দেওয়া চলে না। ওজুর উদ্দেশ্য দেহের ‘তাহারাত’- মানে শূচিতা বিধান। বেশী স্বাধীনতা দিলে শেষ পর্যন্ত ওরা বলে বসবে, আমার দেহে অপবিত্রজনক কোন ক্লেদ-গলিজ নাই; কাজেই আমার ওজু-গোসলের দরকার কি? ক্রমে ক্রমে ওজু-গোসল উঠে যাবে। এমনিভাবে ধর্ম ও সংস্কৃতিতে বিরোধ বেঁধে ওঠে। মাটির কোন কোন স্তরের হাড় হাজার হাজার বছর থেকে তা অবশেষে পাথরের মত শক্ত হয়ে দাঁড়ায়। ইংরেজীতে একে বলে ফসিল। ফসিলের গায়ে জোর আছে, কিন্তু ভিতরে মজ্জা প্রাণ কিছুই নাই। কোন কোন ধর্মের ব্যাপারেও যেন এমনটি ঘটে থাকে। ধর্মের আচার-অনুষ্ঠান পুরান হতে হতে ফসিল হয়ে দাঁড়ায়। সে আচার-অনুষ্ঠানের বেড়া ভাঙ্গা অত্যন্ত কঠিন, অথচ তা পালন করেও বিশেষ ফায়দা নাই। এমন অবস্থায় সংস্কৃতি অমন আচারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে বসে ।
ইসলামে আচার-অনুষ্ঠান যাতে ফসিলের মত অনমনীয় না হয়ে ওঠে, তার জন্য ইসলামেই ব্যবস্থা আছে। যা ফরজ না, তাকে ফরজ মনে করা ইসলামে নিষিদ্ধ। যা কোন নির্দিষ্ট তারিখে করণীয় নয়, তাকে নির্দিষ্ট করণীয় বা মনে করা নিষিদ্ধ। মিলাদ-শরীফ পড়ানো ধর্মের কাজ; কিন্তু মিলাদ ধর্মের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ নয়। কাজেই মিলাদ কেবল রবিউল আউয়ালের চাঁদে পড়ানো চলে। রবিউল আউয়ালের চাঁদেই মিলাদ পড়াতে হবে, অথবা ওই চাঁদে মিলাদ পড়ালে বেশী সওয়াব এমন মনে করা ধর্মের নীতি মোতাবেক নিষিদ্ধ।
কোরবানী করা সম্পদশালী মুসলমানের ধর্মীয় কর্তব্য। কিন্তু কোরবানী যাতে প্রাণহীন আচারে অথবা ঐশ্বর্যের প্রদর্শনীতে পরিণত না হয়, সে জন্য হুঁশিয়ার করে বলা হয়েছে:
আল্লাহর কাছে কোরবানীর পশুর রক্তও পৌঁছে না; গোশতও পৌঁছে না- তিনি দেখেন তোমাদের ঈমান।
নামাজ ইসলামে ফরজ; কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে সাবধান করে দেওয়া হয়েছে, ‘কেবল পূর্ব বা পশ্চিম দিকে মাথা নত করলে কোন ফায়দা নাই, যদি না তার পেছনে থাকে উপাসনা উন্মুখ সত্য সরল মন। অন্য কথায়, ইসলামের আচারগত পীড়নে বুদ্ধি-বিবেকের শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মরার আশংকা নাই । ভালো খাদ্য, ভালো পোশাক ব্যবহার সংগতিসম্পন্ন মানুষের লক্ষণ। কোন কোন ধর্মে এমন বিধান আছে যে, না খেয়ে খেয়ে শরীরকে কষ্ট দেওয়া ধর্মের পরিপোষক। ইসলাম বলে, খাও, দাও, পান কর- শুধু অপচয় করো না। মানুষ পেট ভরে ভালো জিনিস খেয়ে তৃপ্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে, ইসলামে তাও এক রকম ইবাদত।
ভালো পোশাক সম্বন্ধেও একই কথা। উলঙ্গ বা অর্ধ উলঙ্গ থেকে সাধু-সন্ন্যাসী হওয়ার বিধান ইসলামে নাই; বরং মসজিদে মজলিসে ভালো পোশাকে যাওয়ার তাকীদ আছে। মুসলমানদের কেউ কেউ চোখে সুরমা দিয়ে, দাড়িতে মেহেদী মেখে পোশাকে আতর গোলাপ লাগিয়ে মাথায় পাগড়ী পরে মসজিদে যাওয়া সওয়াবের কাজ মনে করেন। এসব কে বিলাসীর জঅলুস বলে কেউ তাকে নিন্দা করে না।
ইছলাম তার অনুসারীকে মুখভার করে থাকতে উৎসাহ দেয় না। অন্যের সঙ্গে হেসে কথা বলা ইছলামে ছওয়াবের কাজ। অন্যের সাথে ব্যবহারে এই মনোরম ঔদার্যের উপর ইছলাম বার বার তাকিদ দিয়েছে। অন্যের উপাস্য দেব-দেবীর নিন্দা ইছলামে নিষিদ্ধ। কোন মানুষকে ছোট বলে ঘৃণা করা ইছলামে পাপ। অন্যকে ভাই বলে আহবান ইছলামে পুণ্য। ইছলামের এই উদার বিশ্বভ্রাতৃত্ব তার সংস্কৃতির এক মস্ত স্তম্ভ।
পশুদের মধ্যে যারা শক্তিমান, তারা দুর্বলদের তাড়িয়ে দিয়ে একা খেতে চায় । মানুষের মধ্যে পশুর পর্যায় থেকে যারা বেশী উপরে উঠতে পারে নাই, তারা প্রতিবেশীর সঙ্গে অনুরূপ ব্যবহার করে থাকে। কিন্তু ইছলাম বলে, প্রতিবেশী মুছলমান অমুছলমান যাই হোক, জানা সত্ত্বেও তাকে ভুখা রেখে যে পেট ভরে খায়, সে মুছলমান নয়।
সংস্কৃতি অর্জনের এক বড় পথ হচ্ছে বিদ্যা শিক্ষা। বিদ্যা শিক্ষা সম্বন্ধে ইছলাম যে গভীর অনুপ্রেরণা দান করেছে, জগতের ধর্মের ইতিহাসে তা কেবল দুর্লভ নয়, অনুপম। ৬০/৭০ বছর আগেও কোন কোন ধর্মের অনুসারী বিদ্যাশিক্ষার জন্য সাগর পার হয়ে ম্লেচ্ছ দেশে গিয়েছে বলে দেশে ফিরে এসে আপন সমাজে ঠাঁই পায় নাই। অমন ধর্মে কেবল ম্লেচ্ছ দেশে যাওয়া নিষিদ্ধ ছিল না, ম্লেচ্ছ জ্ঞান অর্জনও নিষেধ ছিল। এদিকে প্রায় চৌদ্দশ বছর আগে ইছলামের পয়গম্বর বলে গেছেন, বিদ্যার জন্য দরকার হলে সুদূর চীন দেশেও যেয়ো। অথচ ভাষা, ধর্ম, আচার-অনুষ্ঠান, খাদ্য, পোশাক সর্ব বিষয়েই চীন আরব থেকে আলাদা ছিল। সেখানে যেতে হত সাত সমুদ্র তের নদী পার হয়ে। জ্ঞান অর্জন ব্যাপারে দুনিয়ার কোন রকম বাধা-বিপত্তিকেই ইছলাম সামনে দাঁড়াতে দেয় নাই। ইছলাম বলে জ্ঞান মুছলমানের হারানো মানিক- যেখানে পাও সেখান থেকে তুলে নাও ।
নারীর আত্মা আছে কি-না, সে সম্বন্ধে মধ্যযুগীয় ইউরোপের কোন কোন ধর্ম-ধ্বজের দল মাঝে মাঝে গভীরভাবে আলোচনা করত। তাদের মধ্যে কেউ বলত, ‘না, নারীর আত্মা নাই। কাজেই পরপারের প্রস্তুতির জন্য তাদের পক্ষে ধর্মাচরণ ও বিদ্যা অর্জনের কোন দরকার নাই।’ ইসলাম বিদ্যা অর্জনকে নর-নারী উভয়ের জন্য ফরজ করেছে। সংস্কৃতি অর্জনের দুয়ারে সে জামানায় এমন উদার অবারিতভাবে উন্মুক্ত আর কোথাও ছিল না। সংস্কৃতির একটা বিশেষ লক্ষণ হচ্ছে দুনিয়ার প্রচলিত জ্ঞান-বিজ্ঞানের সাথে যথাসম্ভব পরিচয়। নিউটন ‘প্যারাডাইস লস্ট’ পড়ে নাকি বলেছিলেন, বইটি ভালো; কিন্তু ওতে মধ্যাকর্ষণ সম্বন্ধে কোন আলোচনা নাই । মহামহোপাধ্যায় পণ্ডিত, বহুকাল পর কার্যস্থল থেকে বাড়ী চলেছেন। পথে একজন বলল: বড় দুঃসংবাদ কর্তা, আপনার স্ত্রী বিধবা হয়েছেন। এমনি তিনি কাঁদতে শুরু করলেন। সংস্কৃতিবাদীরা এমন একরোখা পাণ্ডিত্যকে যথেষ্ট দাম দিতে নারাজ। মুসলমান পণ্ডিতেরা তাঁদের জ্ঞানকে কেবল কোরাআন-হাদীসে আবদ্ধ রাখেন নাই। তাঁরা আরো বেশী জ্ঞানলাভের জন্য গ্রীস, মিসর, সিরিয়া, ইরানে ছুটে গিয়েছেন; ভারত থেকে বড় বড় পণ্ডিতকে ইসলামী সভ্যতার খলিফারা দাওয়াত করে নিয়ে তাঁদের জ্ঞান নিজ সমাজে প্রচারের ব্যবস্থা করেছেন। বিশ্লেষক সন্ন্যাসীর মত মুসলমান পণ্ডিত সাধকেরা জীবনের প্রতি মুখ ফিরিয়ে দাঁড়ান নাই । বার মাসের মধ্যে দশ মাস রোজা রাখেন, সংসারের কর্মসূচীর বাইরের সময়টুকুর বেশীরভাগ তসবী-তাহলীল নিয়ে থাকেন, এমন সূফীও পাপের মহিমা কীর্তনে লিখেছেন :
বেগুনাহী কা মরজ থা যব না আদম খোলদ- ছে
আয়ে ঘাবরাকার ছুয়ে দারুশশাফায়ে মা’ছিয়াত
পাপহীনতার আধি-ব্যাধি ভুগি অধীর আদম হায়,
পাপের পরম ঔষধ লাগি মর্ত্য পানে বেকারার ধায়।
ইনি আবার বলেন:
মুঝকো এসিয়া কি বদৌলত দৌলতে তওবা মিলী
কেঁউ না ম্যায় দিলসে বনো মাদহাত হারায়ে ম’ছিয়াত।
হে পাপ, তুমিই মোরে দানিয়াছ তওবার গৌরব,
আজিকে মুখর কণ্ঠে তাই তব মহিমার স্তব।
নামাজ, রোজা ইত্যাদি খুব উপকারী- খুব মূল্যবান বস্তু; কিন্তু তবু শেষ পর্যন্ত তা আচার-অনুষ্ঠান। এই কথাটার জোর দিয়ে মীর্জা গালিব বলেছেন, কেয়ামতের দিন সকলে তাদের নামাজ রোজা প্রভৃতি ধর্ম কাজের ফিরিস্তি নিয়ে আল্লাহর কাছে হাজির হবেন কিন্তু আমি কি করব?
রোজে কিয়ামত হর কছে দরদস্ত গিরূদ নামা, মন নিজু হাজের মিশত্তম, তছবীর-এ জানা দর্ বগল
রোজ হাশরে সবাই হাতে রাখবে আমলনামা মোর বগলে থাকবে শুধু বঁধুর ছবিখানা সত্যিকার মুসলমান দুনিয়ায় সংস্কৃতিময়, দরদময়, প্রেমময় জীবন যাপন করতে চায়।
আল্লামা ইকবাল বলেন:
দিলে আশেকী বেমিরদ ব-বেহেশতে জাবেদানী, না নাওয়ায়ে দরদমন্দী না গমে, না গমসারী।
বেহেশত অনস্ত হোক, তবু তায় মরে যায় আশিকের দিল সেথায় দরদ নাই, প্রেম নাই, শোক নাই, নাহি দুঃখ এক তিল।
উপরের আলোচনা থেকে দেখা যাচ্ছে, ইসলাম ও সংস্কৃতিতে মূলত কোন বিরোধ নাই; বরং ইসলাম সংস্কৃতির অনুশীলন ও উৎকর্ষ বিধানের যথেষ্ট প্রেরণা দান করেছে। এসব সত্ত্বেও ইতিহাসের বিভিন্ন স্তরে গান, বাজনা ও চিত্র অঙ্গনে ইসলামের নামে যথেষ্ট বিরোধিতা হয়েছে। এ বিরোধিতার ফলে মুসলিম জগতে চিত্র-শিল্পের যথেষ্ট বিকাশ ঘটতে পারে নাই। ইসলাম প্রচারের আগে জগতের বিভিন্ন স্থানে মানুষ গরু, বাঘ, সাপ ইত্যাদি প্রাণীর পূজার চলন ছিল। প্রাণীর চিত্র অবলম্বনে ফের প্রাণী পূজার চলন না হয়, এই ছিল প্রাণীর চিত্র অঙ্কনে বাধা দেওয়ার মূল কারণ। সেইজন্যে ইসলামের ইতিহাসের প্রথম দিকে চিত্র শিল্পের প্রেরণা লিপি শিল্পে পুষ্টিলাভ করে। নানা রকম লতা ও ফুলের মাঝে মাঝে লীলায়িত আরবী হরফের সে কালের চিত্রশিল্পে প্রায়শ দেখা যায়।
এর পরের জামানায় মানুষ ভাবতে শুরু করল- মানুষ বা অন্য কোন প্রাণীর ছবি দেখলেই তার পূজা শুরু হয়ে যাবে, এমন আশঙ্কার যুগ চলে গেছে। কাজেই তখন থেকে প্রাণীর ছবি আঁকায় আগের মত আর বাধা রইল না।
সঙ্গীতের অবিচ্ছিন্ন চর্চায় মনপ্রাণ ষোল আনা ঢেলে দেওয়ার ফলে জাতি কম জোর হয়ে পড়েছে, ইতিহাসে তার নজির আছে। শক্তিমান মুসলমান জাতিও বা ফের সঙ্গীতের ফেরেবে পড়ে দুর্বল হয়ে পড়ে, প্রধানত এই আশঙ্কায় কোন কোন আলেম সঙ্গীতকে নিষিদ্ধ বলে ফতোয়া দেন। অর্থাৎ সঙ্গীত-অভিসারীরা যখন উত্তর মেরুতে গিয়ে বসল, সঙ্গীত বিরোধীরা তখন দক্ষিণ মেরুতে ঘাঁটি গাড়ল। মাঝখানে দুনিয়ায় সঙ্গীত চর্চা অব্যাহত চলতে লাগল । আরব জাতির উন্নতির যুগে সঙ্গীত সম্বন্ধে জগতের শ্রেষ্ঠতম বই লেখা হল আরবী ভাষায়। ইমাম গাজ্জালী তাঁর সুবিখ্যাত ‘এহীয়া উল-উলুম’ বা ‘জ্ঞানের পুনর্জাগরণ’ নামক গ্রন্থে সঙ্গীত বিষয়ে একটি মস্ত অধ্যায় যোগ করলেন। তাতে কোরাআন, হাদীস, ফিকাহ, উসূল ও ইতিহাসের নানা যুক্তি ও নজীর দিয়ে তিনি ফতোয়া দিলেন যে, সদ্ভাবমূলক সঙ্গীত জায়েজ। বিভাগ-পূর্ব ভারতে সঙ্গীত চর্চায় সবচেয়ে বেশী উৎসাহ ও সাহায্য এসেছে মুসলিম শাসকদের কাছ থেকে। পাক-ভারতের সঙ্গীত সাধনায় আজও মুসলমান ওস্তাদরাই সর্বশ্রেষ্ঠ আসনগুলির অধিকাংশ অধিকার করে আছেন।
মাওলানা রুমী কেবল কবি ছিলেন না- মস্ত বড় সূফীও ছিলেন। এহেন ধর্মগতপ্রাণ সূফী একদিন দেখেন, পথ দিয়ে একটা লোক বীণা বাজিয়ে যাচ্ছে। তিনি তাকে লক্ষ্য করে বললেন:
আয় মোতরেব, আল্লা আল্লা, মন বেরাহম তুবর রাহ্ বর গীর চড় ও মীজন বর তার তওবা করদম।
‘হে বীণা বাদক, আল্লার কসম করে বলছি, আমি পথ-ভ্রান্ত, তুমিই ঠিক পথে আছ। তোমার বীণাটি হাতে নিয়ে তারে আঘাত কর; ওরই ঝঙ্কারের মূর্ছনার সাথে আমার তওবা উপরে উঠবে।’
যেন সূফীর তওবা উপরে যেতে না পেরে তার হুজরার আশপাশে কেঁদে ফিরছে; ওই বীণার ঝঙ্কারের রথে ছুফী তাঁর তওবাকে আল্লাহর আরশ পানে পাঠাতে চান । কেউ এর আক্ষরিক মানে করে এমন না বোঝেন যে, সঙ্গীত ছাড়া ইবাদত সম্ভব নয়; সঙ্গীত ছাড়া ইবাদত নিশ্চয়ই সম্ভব। তবে কোন কোন স্থলে সঙ্গীত যে উপাসনার সহায়ক, উদ্ধৃত – কবিতার তাৎপর্য তাই।
উপরের আলোচনা থেকে এ কথাটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, ইছলামের কোন কোন আলেম সঙ্গীত ও চিত্র শিল্পকে অবাঞ্ছিত বলে বাধা দেওয়া সত্ত্বেও আলেমদের মধ্যেই অনেকে এ দুটিকে জায়েজ মনে করেছেন এবং সংস্কৃতির এ দুটি বাহন বাধা পেলেও অগ্রগমনের পথ রুদ্ধ হয় নাই।
— প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ
→ বাংলা একাডেমী প্রকাশিত “ইবরাহীম খাঁ রচনাবলী- ১” থেকে সংকলিত।