ওয়ায়িল হাল্লাকের সাথে দুই পর্বের সাক্ষাতকারের এটি হচ্ছে ২য় পর্ব। সাক্ষাতকারটি নিয়েছেন হাসান আজাদ। এখানে তিনি মুসলিম উম্মাহর বর্তমান জ্ঞানের ধারা এবং পাশ্চাত্যের জ্ঞান উৎপাদনের ধারার মধ্যে যে সংঘর্ষ দেখছেন, তার ব্যাখ্যা করেছেন। বিশেষ করে, তিনি “বুদ্ধিবৃত্তিক দাসত্ব” এর দ্বারা পাশ্চাত্যের বুদ্ধিবৃত্তিক জগত এবং জ্ঞান পরিচালন প্রক্রিয়াগুলোর আনক্রিটিক্যাল (Uncritical) বিকাশকে নির্দেশ করেছেন। তিনি বলছেন, এরকম বিষয়ের সুদূরপ্রসারী সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। বিশেষ করে ধ্বংস হয়ে যাওয়া ইতিহাস থেকে (যেমন “বায়তুল হিকমাহ”) বহুমাত্রিকতা ও মুক্তচিন্তাকে অস্বীকার করার সময় (যা পূর্ববর্তী যুগকে চিহ্নিত করেছিল) শক্তিশালী বুদ্ধিবৃত্তিক হায়ারার্কি (ক্রমোচ্চধারা) রক্ষার ক্ষেত্রে মুল্যবোধ নির্ধারণ পর্যন্ত এর প্রভাব রয়েছে। ১ম পর্বে হাল্লাকের সমালোচনা ছিল এর নিজস্ব অভ্যন্তরীণ লজিক ব্যবহার করে এর সবচাইতে বড় বৈপরীত্ব সমাধানের জন্য প্রস্তাবনা হাজির করার পরিবর্তে এর পূর্ব ব্যবস্থাপনার শিকড়কে চ্যালেঞ্জ করার উপর।

হাসান আজাদঃ আপনি আধুনিক যুগে ক্ষমতা ও জ্ঞানের মধ্যকার পরিবর্তনশীল সম্পর্ককে মেনে নিতে মুসলিম উম্মাহর বুদ্ধিবৃত্তিক ব্যর্থতার বিষয়টি সামনে এনেছেন। এক্ষেত্রে পাশ্চাত্যের বুদ্ধিবৃত্তির কি কোনো দায় নেই?

ওয়াইল হাল্লাকঃ অবশ্যই আছে। পাশ্চাত্যের বুদ্ধিজীবিদের যদি কোন ভূমিকা থেকেও থাকে তবে তা খুবই অল্প। (যদিও আমরা জানি যে, পাশ্চাত্যের অনেকে বুদ্ধিজীবি ইসলামকে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার উর্বর ভূমি হিসেবে উপস্থাপন করে থাকেন) কিন্তু উনবিংশ শতাব্দীর হাতেগোনা যেকজন নেতৃস্থানীয় বুদ্ধিজীবি এধরণের কাজ করেছেন তারা বৃহদার্থে আমরা যে ইউরোপ-আমেরিকাকে বুঝে থাকি সে ইউরোপ আমেরিকার নন । আর বিশ্বে এখন মূলধারা বলতে ইউরোপ-আমেরিকাকেই বুঝানো হয় ফলে বাদবাকি গোটা বিশ্বই প্রান্তিক পর্যায়ের হিসেবে বিবেচ্য। আমাদের এটা ভুলে গেলে বোকামী হবে যে, পাশ্চাত্যের লিবারেল দুনিয়া সতেরো শতাব্দী থেকে অবিচ্ছিন্যভাবে একই চিন্তাগত ভিত্তির উপর কাজ করে যাচ্ছে। সবচেয়ে আশ্চার্যজনক বিষয় হচ্ছে, ইউরোপ ও আমেরিকানরা শুধুমাত্র ব্যক্তি স্বাধীনতার  জন্য নিয়ে  শত শত বক্তব্য বিবৃতি থেকে  শুরু করে সামান্ত প্রভুদের সাথে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে লিপ্ত হলেও একই সময়ে তারা পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে তাদের স্থাপিত উপনিবেশে এমনকি আপন গৃহের কৃতদাসদের উপর যে জৃলুম নির্যাতনের স্টিম রোলার চালাতে ( এক্ষেত্রে হিপোক্রিট জনলক এবং – নব্য রোমান বিচারপতিরা)  তারা একবারও ভেবে দেখেনি। এদিকে তাদের যেন কোন ভ্রুক্ষেপই নেই। এক্ষেত্রে তাদের ব্যক্তি স্বাধীনতা, মুক্তির থিওরী যেন একেবারেই নির্বিকার। জনলক একদিকে দ্বিধাহীনচিত্তে দাস ব্যবসায় নিজের সম্পদ বিনিয়োগ করে যাচ্ছিলো, অন্যদিকে জোড়ালোভাবে স্বাধীনতার কথা বলে যাচ্ছিলো! সত্যি বলতে কি আমেরিকার প্রতিষ্ঠাতাদের অধিকাংশই এরকম ছিলো! দুয়েকজন ছাড়া প্রায় সবার কর্মকান্ড দেখলে মনে হবে এনলাইটেনমেন্ট চিন্তাবিদদের  তেমন কেউই মানবাধিকার ও রাজনৈতিক স্বাধীনতা বুঝতো না। তাদের নির্যাতন ধরন দেখলে তারা যে মানুষ তা মনেই হবে! তারা এতোটাই বর্বর। দুঃখজনকভাবে এই বর্বরতা এখনো ভিন্ন রুপে, ভিন্ন কায়দায় বহাল তবিয়তে চলমান।

এটাতো ভূমিকা মাত্র। এই ভুমিকার আরেকটা দিক হচ্ছে পাশ্চাত্যের বুদ্ধিজীবীদের “আয়নায় শত্রু দেখা”র নীতি – সম্ভবত এটা একধরণের অক্ষমতা – যেমনটা Roxanne Euben অসাধারণভাবে বলেছেন। বিগত তিন শতাব্দী ধরে  পাশ্চাত্য  ‘ধর্ম’, ‘ধর্মীয়’ ‘ম্যাটাফিজিক্স’ এরকম কিছু নিশ্চল ধারণার মধ্যে ঘুরপাঁক খাচ্ছে। আর এইধারণাগুলো এতটোই নিশ্চল যে এগুলো তারা নিজেদের কোন সংশ্লিষ্টতাও খুঁজে  পাচ্ছে না, ফলে মেটাফিজিক্সের ক্ষেত্রে পাশ্চাত্য একেবারেই হতাশ।েএমন হতাশায় ঢুবে থাকলেও পাশ্চাত্য  ইসলামের ব্যাপারে একেবারেই নির্বিকার (পাশ্চাত্য ইসলামকে কেবল “ঐতিহাসিক” ঘটনা হিসেবে ধার্তব্যে আনে মেটফিজিক্যাল সত্ত্বা হিসেবে নয়)  যার ফলে ইসলাম পাশ্চাত্যে কেবল “অন্য জগত”এর সত্তা হিসেবে দেখা হয় , যা (বুদ্ধিদীপ্ত) মানুষের আত্নিক অবস্থান থেকে দূরে ;তাদের চিন্তাগত অক্ষমতা কেবল এতটুকুতেই সীমাবদ্ধ নয় তাদের অক্ষমতা এতটাই প্রকট যে এমনকি তারা তাদের উদ্ভাবিত জ্ঞানের সাথে নিজস্ব বাস্তব জগতের সম্পর্ক  অনুমান করতেও অক্ষম। যেমন তারা নিজস্ব একটা  অনুমানের ভিত্তিতে বিশ্লেষণের মেশিনে রেথে পরিচিত ও অভ্যাসগত প্রতিটি কাজকে এনালিটিক্যাল আর্কাইভের একটি অংশ করে তুলেছে। যেমনঃ নিজস্ব একটি অনুমান থেকে একটি ঘটনাকে বিশ্লেষণ করা এবং সে আলোকে এমন ফলাফল আনা যেন মন হয় পূর্বানুমিত ধারণাটিই সেই ঘটনা তৈরি করেছে। অথচ ঘটনাটি ঘটার আসল কারণ  অন্যকিছুও হতে পারে। এই ত্রুটিপূর্ণ পন্থায় সত্য উদঘাটিত হয় না। তাদের এধরণের বিশ্লেষণমূলক ত্রুটিগুলো আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে যখন আমরা বুঝতে পারি যে তারা পশ্চিমা ট্রাডিশনে একই প্রশ্নগুলো কিভাবে মোকাবেলা করে আর একই বিষয়ে অন্যদের ক্ষেত্রে কিভাবে দেখে। মূলত বিশ্লেষণমূলক এই পন্থাটা একটা দ্বৈতনীতির (ডাবল স্ট্যান্ডার্ড)  উপর প্রতিষ্ঠিত । এক্ষেত্রে আধুনিক রাষ্ট্র ও সেক্যুলারিজম – এ দুটি বাধ্যতামূলক বিষয়।

আসলে এই বিষয়ে অনেক কিছুই বলা যায়। সংক্ষেপে বলতে গেলে, উদাহরণস্বরুপ, পাশ্চাত্যের বুদ্ধিবৃত্তিক ধারা অন্য ধারার সাথে আদৌতে কখনো মিলিত হয় নি, বিশেষ করে ইসলামের সাথে, সিরিয়াস কিংবা তুলনামূলক কম কোনো বিষয়ে কোথাও ইসলামের সাথে মিলিত হয় নি। তার পরিবর্তে, এই তিন শতাব্দীর জার্নিতে যখনই বাধ্য হয়ে মোকাবেলা করতে হয়েছে তখন একটি নিন্দামূলক রায় পেশ করে  এরকম সম্পর্ককে বাতিল করে দিয়েছে। ইসলামের প্রতি প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন সম্পূর্ণরুপে অযৌক্তিক – এক্ষেত্রে তাদের বিশ্লেষণমূলক পন্থার অবশ্যই এর ভূমিকা আছে। অথচ ব্যাপারটা অত্যন্ত বিদ্রুপাত্মক যে, পাশ্চাত্য সংস্কৃতি নিজেকে ব্যাখ্যা করেছে যুক্তি ও যুক্তিবাদী অনুসন্ধানের শ্রেষ্ঠ আবাসস্থল হিসেবে।

হাসান আজাদঃ কেউ কেউ বলেন যে, আধুনিক মুসলিম চিন্তাভাবনায় মৌলিকত্বের যে অভাব রয়েছে, সেটা মুসলিম বিশ্বের সাথে সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে পাশ্চাত্যের বুদ্ধিজীবীদের অবমাননার বিষয়টির সত্যতা প্রমাণ করা যেতে পারে। এ ব্যাপারে আপনি কী বলবেন?

ওয়াইল হাল্লাকঃ এই ব্যাপারে আমি সংক্ষেপে জবাব দিতে চাই। “মুসলিম বিশ্ব” আধুনিক মুসলিম বুদ্ধিজীবীদের চাইতে অনেক বড়। এটা অনেক উন্নত এবং আমরা যাকে “আধুনিক ইসলাম” বলি, তার চাইতে অনেক জটিল। আমি বলতে চাই আমার লেখা Impossible State বইটি পড়লেই আপনি বুঝবেন আমি কী বুঝাতে চাচ্ছি।

হাসান আজাদঃ তার মানে অবশ্যই উভয় পক্ষেরই করার অনেক কিছু আছে যদি তারা মূল আলোচনায় আসতে চায়, কিন্তু এ কাজের জন্য কি উভয়েই সমানভাবে দায়ী?

ওয়াইল হাল্লাকঃ বিষয়টা সংখ্যা দিয়ে সমান সমানভাবে পরিমাপ করা যায় কিনা, এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত নই। তবে আমি বলব যে, পাশ্চাত্য সভ্যতাকে একটি বিরাট নৈতিক দায়িত্ব পালন করতে হবে, যা তারা শোচনীয়ভাবে এড়িয়ে গেছে (যেগুলো লিখলে অনেক পৃষ্ঠা হয়ে যাবে)। অন্যদিকে, মুসলিম বুদ্ধিজীবীরা বিশ্বে তাদের নিজেদের পরিচয় ও কন্ঠস্বরকে খুঁজে পেতে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে। এবং আমাদের পৃথিবী আজকাল আগের চেয়ে ছোটো মনে হচ্ছে। এখনকার মুসলিম চিন্তাবিদেরা (এবং অচিন্তাবিদেরা) যারা আকলী ও সৃজনশীল চিন্তাভাবনার অভাবে ইসলামের ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে ভয়ানকভাবে আক্রমণ করছে, তারা কি পরিমাণ মাযহাবী দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েছে, এ ব্যাপারে নিজেরা খুবই কম সচেতন। আমি এটাকে বিদ্রুপাত্মক মনে করি যে, তারা নাকি “মধ্যযুগীয় আকল” বা “আকলের অভাব” এর সমালোচনা করবে যেখানে তারা অন্যের অনুকরণের চাইতে ভালো কিছু করতে পারে না। যেমনটা পাশ্চাত্যের বুদ্ধিজীবীদের প্রতি তাদের মনোভাব দেখা যায় যে যেকোনো সময় ফুকো, দেরিদা, বা অন্যরা তাদের মাঝে ফ্যাশনেবল হয়ে উঠে। কিন্তু সবচাইতে বাজে দেখায়, যখন তারা কোনো সুক্ষ প্রমাণাদি বা গভীর পর্যালোচনা ছাড়াই লিবারেলিজমের সমালোচনা করে। তারা যে চিন্তাকে অন্ধভাবে অনুকরণ করছে, সেটা যৌক্তিক কিনা, এ ব্যাপারে তারা যাচাই বাছাই করে না। তারা জিগ্যেস করেনি তারা যে চিন্তা পদ্ধতিকে অনুসরণ করে যাচ্ছে, সেটা ভিন্ন পরিবেশে বিশেষ করে তাদের পরিবেশে ফাংশনাল কিনা বা উপকারী কিনা। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যে আমাদের জীবন যাত্রায় এই সিস্টেমগুলো প্রভাব ফেলছে কিনা, এ ব্যাপারে তারা প্রশ্ন করেনি। তারা নিজেদেরকে সেই অবস্থানে রেখেছে, যেখানে গত শতাব্দীর মুসলিম বুদ্ধিজীবীদেরকে অন্যায়ভাবে রাখা হয়েছে। এটি চরম বিড়ম্বনার দিক।

কিছু বিড়ম্বনা নিয়ে বাঁচা যায় কিন্তু গোটা জীবনটাই বিড়ম্বনাপূর্ণ হবে, এটা কিভাবে হয়? আমাদের চারপাশে এমন অনেকে আছে, যাদের কারোরই তাদের সবচাইতে নির্দোষ ব্যক্তিকে উপেক্ষা করা ছাড়া কোনো উপায় নেই। তবে কিছু বিড়ম্বনা ক্ষতিকর হতে পারে। অতীতের মুসলিম বুদ্ধিজীবীরা বিভিন্ন বিষয়ে বর্তমান যুগের মুসলিম বুদ্ধিজীবী এবং পশ্চিমা বুদ্ধিজীবীদের চাইতে অধিক জ্ঞান রাখতেন এবং বিভিন্ন বিষয়ের খুঁটিনাটি অনেক বেশি জানতেন। উদাহরণস্বরুপ, মুসলমানদের ফিকহী ধারা এবং অন্যান্য বুদ্ধিবৃত্তিক ধারা বারবার, কয়েক শতাব্দী ধরে, এমন এক ভয়ংকর প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছে যা মানব সমাজকে হাজার বছর ধরে মোকাবেলা করতে হয়েছে। আর সেটা হচ্ছে হুসুন কুবহুনের সমস্যা (অর্থ্যাৎ ভালো-খারাপ, মানুষ হিসেবে মানুষের তাকলিফ বা নৈতিক দায়িত্ব কি এসম্পর্কিত প্রশ্ন)

যা স্বাভাবিক মানুষ বহন করতে পারে এবং অবশ্য বহন করা উচিত ! প্রতিটি ক্ষেত্রে, মুসলিম ফকীহ এবং তাদের ফকীহ নন এমন  সহকর্মী বুদ্ধিজীবীরা এমন একটি দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি ওয়াদাবদ্ধ ছিলেন যা ব্যক্তিকে তার তাকলিফ তথা নৈতিক দায়িত্ব পরিত্যাগ করতে বাধা দেয়। যদি প্রতিটি মানুষ তার জীবনের চুড়ান্ত দায়িত্ব কাধে তুলে নেয়, তাকে তার পরিণতির দায়ভার বহন করতে হবে। পশ্চিমা বিশ্বে এই সম্পর্ক বিচ্ছিন্নকরণের নিদারুণ ফলাফল আজ পাশ্চাত্য সমাজকে এক নিষ্ঠুর পরিণতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে । যেমনঃ আজ বহুজাতিক কোম্পানিগুলো আমাদের জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করছে। এমন নয় যে, প্রাচীন বৃটিশ পার্লামেন্ট সীমিত পরিসরে দায়ভার গ্রহণে সক্ষম কোম্পানীগুলোর এধরণের অনৈতিক কর্মকান্ড পুরোপুরি বুঝতে পারে নি। বরং বুঝতে পেরেছে। আসলে এটা মানব ইতিহাসে প্রথম কোন ঘটনা যেখানে বিচারিক ব্যক্তিত্বকে বৈধকরণের পর তারা তাদের আইনকে উল্টোদিকে ঘুরিয়ে দিয়েেএর মূল উদ্দ্যেশের বাস্তবায়নে বাঁধা দেয়। এর মূল কারণ ছিল অনৈতিক চরিত্র ও তার স্বাভাবিক পরিণতি। কিন্তু তখন এটা বিশ্বকে শাসন এবং ধ্বংস করার জন্য বেশ জোরেশোরেই পুনরায় বৈধতার রাজ্য ‘লন্ডন’এ আনা হয়। কিন্তু মূলত ছিল দেলাওয়ারে (আমেরিকারর একটা রাজ্য)। কিন্তু ফকীহগণ সর্বদাই নৈতিক (হুসুন কুবহুন) দায়দায়িত্ব ও মানুষের নৈতিক জবাবদিহিতার দিকে জোর দিয়েছেন, যদিও তাদের প্রায়োগিক জ্ঞান স্বতন্ত্র একটি যৌথ আইন দাঁড় করাতে পারতো (যেমন তাদের এই প্রায়োগিক চিন্তাগুলোর উপর ভর করেই ওয়াকফ ব্যবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।) এখন কিছু মানুষ অনুভব করতে পারছে হাজার বছর আগে আকলী বৈধতার শরয়ী পদ্ধতি ঠিক ততোটাই বাস্তবসম্মত ছিল যতটা আমরা বর্তমানে দেখে থাকি। আর বৃটিশ পালার্মান্টের এই ঘটনাই মূলত বিভিন্ন বড় বড় প্রতিষ্ঠান ও করপোরেশনকে মিথ্যা কাল্পনিক বিষয়ের আড়ালে নৈতিক দায় এড়ানোর সুযোগ করে দেওয়ার প্রথম ব্যবস্থাপনা করে দিয়েছে। একে নৈতিক দায় এড়ানোর প্রাক ভ্রুণ পর্যায় হিসেবে চিহ্নিত করা যায়।

বর্তমানে পাশ্চাত্য পরিমন্ডল কিংবা ইসলামী বুদ্ধিবৃত্তিক জগত – উভয় ক্ষেত্রেই এই দুরদর্শিতার অভাব রয়েছে। অবশ্য, আমি বলতে দ্বিধাবোধ করবো না যে, বৃহদার্থে, অদুরদর্শিতা হচ্ছে মডার্ণিটির অপর নাম। সুতরাং, সম্ভবত আমরা ভুলে যাবো আলী হারবের মতো শিক্ষিত ব্যক্তিকে, যিনি “প্রতিক্রিয়ামূলক দৃষ্টিভঙ্গি”র জন্য পিয়েরে বোর্দিওকে (Pierre Bourdieu) সমালোচনা করছেন। বোর্দিও কেন কিছু আধুনিক চর্চা ও প্রতিষ্ঠানের সমালোচনা করেছেন, হার্ব শুধু এটি বুঝার সুযোগই হারাননি, বরং আমরা যাকে “বিজ্ঞান” বলতে চাই এবিষয়েও হার্ব বোর্দিওর ক্রিটিক্যাল দৃষ্টিভঙ্গিকে গভীরভাবে অনুধাবন করার সুযোগও হারান। প্রায় ষাট বছর আগে সাইয়েদ কুতুব যেমন ছিলেন, তেমনি হারবও বুঝতে চান না যে, আপনি কোনো মুল্যবোধকে তার উৎস থেকে আলাদা করতে পারবেন না এবং একটিকে গ্রহণ করলে অন্যটিকেও গ্রহণ করতে হবে। কেননা মূল্যবোধ তার উৎস থেকে উদগত হয়, এটাকে আলাদা ভাবে গ্রহণ বা আরোপ করা যায় না।

প্রযুক্তিকে গ্রহণ করা ,বাহ বাহ দেওয়ার মানেই যে মূল্যবোধকে নিন্দা করা এমনটা ভাবা ফালতু কথা ছাড়া আর কিছুই নয়। এই অনর্থক কাজটাই সাইয়েদ কুতুব করেছিলেন। এরচেয়েও গুরুতর সমস্যা হচ্ছে, এই ধরণের দূরদর্শি চিন্তাভাবনার অভাব হার্বের মতো লেখকদের যন্ত্রণা দেয়। আর এধরণের লেখকের সংখ্যাও অনেক। মুসলিম বুদ্ধিজীবিরা পাশ্চাত্য থেকে যেসব মূল্যবোধ গ্রহণ করবেন ভাবছেন, সেগুলোর সঠিক ধারণা কোথাও পাওয়া যায় না। আমি যতদুর জানি, স্বাধীনতার ধারণাকে, বিশেষ করে এর নেতিবাচক দিক নিয়ে, যেমন (ক) একটি টেকসই জীবন যাপনের অসম্ভাব্যতা; (খ) অনিয়ন্ত্রিত ও ধ্বংসাত্মক বিকাশের জন্য এর অপরিহার্যতা; (গ) সাম্প্রদায়িক ও পারিবারিক কাঠামোর ভাঙনে এর ভূমিকা এবং (ঘ) একটি নৈতিকভাবে অন্তসারশূন্য ব্যক্তি সৃষ্টি ইত্যাদি ইত্যাদি – এ বিষয়গুলো কেউ অতো গভীরভাবে যাচাই বাছাই করে দেখেনি। অবশ্য, এই বিষয়গুলো পাশ্চাত্যের মন-মানসের মধ্যে নেই, সর্বোচ্চ আছে এখানে সেখানে কিছু সংস্কার কার্য। কিন্তু মুসলিম বুদ্ধিজীবীদেরকে এক্ষেত্রে অবশ্যই এধরণের বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দেওয়ার জন্য সমানভাবে দায়ী করা উচিত। মূলত, তাদের পাশ্চাত্য সমকক্ষদের করা কাঠামোগত প্রতারণাগুলো এবং কেন্দ্রিয় লিবার‍্যাল ধারণা ও চর্চার ধ্বংসাত্মক দিকগুলো প্রদর্শনে নেতৃত্ব দেওয়া উচিত। এগুলোর কোনোটাই বুদ্ধিবৃত্তিক দেউলিয়াত্বের প্রমাণ নয়, যা এখন পর্যন্ত আরব ও মুসলিম বিশ্বে অপ্রকাশিত রয়ে গেছে এবং যা পাশ্চাত্যের মুলধারার চিন্তাকে প্রভাবিত করে চলেছে। প্রশ্নবিদ্ধ এবং আধিপত্যবাদী উদারনৈতিক চিন্তা এবং সেগুলোর চর্চা শত বছরের পুরনো দাসত্বকে ফিরিয়ে এনেছে, আর তাদের নেতৃত্ব মেনে নিয়েই মুসলিম চিন্তাবিদরা এগিয়ে চলেছে।

অবশেষে দুটি বিষয় এখানে বলা প্রয়োজন। প্রথমত হচ্ছে, অবশ্যই বিজ্ঞান চর্চার নিজস্ব মুল্য রয়েছে, এবং আধুনিক বিশ্বের ক্রিটিক্যাল সংকটগুলো বিবেচনা করে এটি (আমি বিশ্বাস করি) সকল বুদ্ধিজীবীদের উপর বাধ্যতামূলক একটি নৈতিক দায়িত্বে পরিণত হয়েছে। বিজ্ঞান কী? বিজ্ঞান হলো যা অধ্যয়ন করে, সমালোচনা করে, ক্ষুদ্র ঘটনা ও মহাজাগতিক কার্যক্রমের মধ্যে লুকানো বিষয়গুলোকে উন্মুক্ত করে, যা একটি ক্ষণস্থায়ী মানবিক ক্রিয়া ও মহাজাগতিক কাঠামোর স্থায়িত্বের মধ্যে সম্পর্ককে বেধে রাখে এবং বোধগম্য করে তোলে যা কখনোই আমাদের নিয়ন্ত্রণে আসবে না, এবং এটি এমন একটি বিষয় শেলার যাকে পাশ্চাত্যের সহজাত চালক এবং আধিপত্য ও নিয়ন্ত্রণের সুত্রবিন্দু বলে অবিহিত করেছেন, তা সর্বদা এড়িয়ে যাবে।

এই পরম শক্তিশালী, শতবর্ষের পুরনো বুদ্ধিবৃত্তিক ধারাকে মুসলিম চিন্তাবিদদের হজম করা উচিত এবং আধুনিক যুগের চর্চিত বিষয়গুলোকে যাচাই বাছাই করা উচিত। তারা অন্যদের মতো এই বিশ্বের কাছে ঋণী। এবং এক্ষেত্রে সবচাইতে অগ্রগন্য উদাহরণ হচ্ছে ড. ত্বহা আব্দুর রহমান, উনাকে দিয়ে এই জ্ঞানের জার্নি শুরু করা যেতে পারে।

দ্বিতীয়ত, তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক উপস্থিতিকে প্রমাণ করতে এবং প্রথম পয়েন্টে বলা বিষয়গুলোকে বাস্তবায়ন করতে চাইলে মুসলিম বুদ্ধিজীবীদেরকে বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় নিরন্তর প্রচেষ্ঠা চালিয়ে যেতে হবে এবং সঠিক সময়ের অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু প্রায়ই দেখা যায় তারা ইউরোপ-আমেরিকার সুরে হারিয়ে যাচ্ছে। নিজেদের এবং অন্যদের আরো প্রতিশ্রুতিশীল ভবিষ্যতের দিকে পরিচালিত করার জন্য, সমগ্র বিশ্বের মনোযোগ আকর্ষণ করতে তাদের প্রয়োজন একটি  শক্তিশালী বুদ্ধিবৃত্তিক প্রচেষ্ঠা যার মাধ্যমে প্রথম পয়েন্টে বলা শর্তগুলোকে একীভূত করা সম্ভব হবে। এর মধ্যে অন্যতম একটি শর্ত হচ্ছে এনলাইটেনমেন্টের গভীর ভিত্তিগুলোকের দিকে নজর দেওয়া এবং কিভাবে এই ভিত্তিগুলো সুক্ষ ভাঙনের (যদিও ব্যাপকভাবে ধ্বংসাত্মক নয়) দিকে পৃথিবীকে ধাবিত করেছিল। এখানে সবচাইতে অবাক করা বিষয় হচ্ছে, দুয়েকটা ব্যতিক্রম বাদে (যেমন ত্বহা আব্দুর রহমান) মুসলিম ঐতিহ্যের মুল্যায়ন প্রায় সম্পূর্ণরুপে খারিজ করা হয়েছে। আধুনিক মুসলিমদের তাকলিদ প্রায় সীমাহীন নতুন অর্থ দাঁড় করিয়েছে।

হাসান আজাদঃ পাশ্চাত্য বুদ্ধিজীবীদের ব্যাপারে কী বলবেন?

ওয়াইল হাল্লাকঃ আমার মনে হয় না যে তারা কোথাও পর্যাপ্ত কিছু করেছে। উপনিবেশবাদী ধারার অংশগ্রহণকারী হিসেবে এবং উপনিবেশবাদীদের উত্তরাধিকারী হিসেবে তারা যে উপনিবেশ গুলো ধ্বংস করেছিল, সেগুলোর পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে একটি নৈতিক দায়িত্ব পালন করে। নৈতিক বোঝা এখনো স্বীকৃতি দেওয়ার বাকি, কিন্তু স্বীকৃতির দ্বারা এই ব্যর্থতার ক্ষুদ্র অংশের  বোঝাও হ্রাস পাবে না। একটি জ্ঞানের সমষ্টি হিসেবে এবং জ্ঞান/ক্ষমতা পদ্ধতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে (যা বিশ্বের অনেক কিছু ধ্বংস করেছে) তাদের অবশ্যই এমন একটি নৈতিক বোঝা বহন করতে হবে। তারা মনোযোগের সাথে শোনার, বিনয় ও চিন্তার সাথে যুক্ত থাকার স্বতন্ত্র নৈতিক দায়িত্ব বহন করে। কিছুটা নম্রতার সাথে একটা লম্বা পথ তাদেরকে পাড়ি দিতে হবে এই চিন্তা করে যে, তাদের স্বাভাবিকের চেয়েও অতিরিক্ত কিছু করতে হবে। সম্ভবত আমি খুব বেশি আশা করছি।

হাসান আজাদঃ আমি নিশ্চিত যে, এই বুদ্ধিজীবীদের অনেকেই তাদের উপনিবেশবাদী প্রজেক্টের ক্ষেত্রে নিষ্পাপ্যতার ঘোষণা দেবে, এবং আপনাকে এটা বলবে যে, তারা সরকারী কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে খুবই সুক্ষ্ম ইত্যাদি। তারা আপনাকে বলবে যে, তারা নির্যাতিত ও দুর্বলদের প্রতি সহানুভূতিশীল, হোক সে মুসলিম বা অন্য কেউ।

ওয়াইল হাল্লাকঃ হ্যা, এটা খুবই সত্য কথা কিন্তু আমার আর্গুমেন্টকে কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত করে। বিষয়টা জটিল, এবং আমি আপনাকে একটি লম্বা লেখা পড়তে বলবো যা আমি আমার একজন সমালোচকের জবাবে লিখেছিলাম এই বিষয়ের উপর। এটা ২০১১ সালে Islamic Law and Society তে প্রকাশিত হয়।

হাসান আজাদঃ ইসলামী চিন্তার উপর আধুনিক যুগে পাশ্চাত্যে কোন ধরনের নিষেধাজ্ঞা আরেরাপ করেছে?

ওয়াইল হাল্লাকঃ চিন্তা ও গবেষণার রাজ্যে কোন বুদ্ধিবৃত্তি মূলত ততক্ষণ পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকে, যতক্ষণ আমরা তাদেরকে বেঁচে থাকার অনুমতি দেই। লৌহ শিকল ভেঙে দেওয়া হচ্ছে একটি বাহ্যিক কাজ, এবং এটা স্পষ্ট যে শক্তিশালী প্রতিপক্ষ আপনার বিরুদ্ধে বিধ্বংসী অস্ত্র চালাতে পারে। কিন্তু সে কি আপনার মনস্তত্ত্বের উপরও আক্রমণ করতে সক্ষম! মোটেও না সেগুলো মানুষের মনস্তত্ত্ব অন্যের ধরা ছোঁয়ার বাহিরে। কাউকে শারীরিকভাবে রুদ্ধ করা যেতে পারে, কিন্তু মানসিকভাবে তো সে মুক্ত হতে পারে। অর্থাৎ, স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে এবং নিজের ইচ্ছেমতো পৃথিবীকে সাজাতে পারেন। সুতরাং আপনার প্রশ্নের সংক্ষেপে জবাব হচ্ছে, অন্যদের উপর পাশ্চাত্যের বুদ্ধিবৃত্তিক আধিপত্যবাদের তেমন কোনো যৌক্তিকতা নেই। আমি একটি বিরাট উপনিবেশবাদী শক্তির বাহ্যিক সীমাবদ্ধতা থেকে মুক্তির প্রতিবন্ধকতাগুলো বুঝতে পারি, যেমন আফগানিস্তানে মার্কিন হামলা বা গাজায় ইজরায়েলী আক্রমণ, কিন্তু আমি মানসিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক দাসত্বটা বুঝতে পারি না। ইউরোপ-আমেরিকানরা কতটা কঠিন পরিশ্রম করছে এবং মুসলমান, আফ্রিকান এবং বাদবাকি পৃথিবীকে মানসিকভাবে কিভাবে দাসে পরিণত করছে এগুলো আলোচনা করার মতো কোনো বিষয় না এমনকি  এগুলো অজুহাত দেখানোর মতোও কোনো বিষয় নয়। যেমনটা আমি ইতোমধ্যেই বলেছি, দুয়েকটা কন্ঠস্বর ছাড়া মুসলিম লেখকরা এখন পর্যন্ত বুদ্ধিবৃত্তিক দাসত্বের পথটাই বেছে নিয়েছে। এ প্রসঙ্গে একটা পুরনো সংঘা এখানে  স্মরণ করছি তা হচ্ছে, একজন ব্যক্তি তখনই একটি দাসে পরিণত হয় যখন সে আরেকজনের ইচ্ছার উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। যদি কাউকে ইচ্ছার বিবরণ, কাজ, কাঠামো, নেতৃত্বের শিক্ষা ও পরিচালনার দৃষ্টান্ত শেখাতে হয়, তাহলে সে কিভাবে স্বাধীন সত্ত্বা হিসেবে বিদ্যমান থাকে ? সে তো একটা দাসমাত্র। আর আমার কাছে এমন কোনো প্রমাণ নেই যে, মুসলিম বুদ্ধিবৃত্তিক জগত সার্বিকভাবে এবিষয়গুলোকে অনুধাবন করে নিজস্ব বুদ্ধিবৃত্তি নিয়ে কাজ করছে। (অর্থ্যাৎ দিনশেষে মুসলমানরা নিজেদের বুদ্ধিবৃত্তিক শক্তিমত্তা প্রয়োগ ও প্রদর্শন করার পরিবর্তে অনুকরণ ও দাসত্বই করে যাচ্ছে কেবল।)

হাসান আজাদঃ ঐ ব্যাপারে আপনার মতামত কী, যারা আব্বাসী খলিফা আল মামুন এবং তার প্রতিষ্ঠিত বায়তুল হিকমাহর উদাহরণ দেয়, এবং এর গ্রীক টেক্সটের অনুবাদের ক্ষেত্রে এর ভূমিকা নিয়ে কথা বলে, এবং ইসলামের দর্শন, অধিবিদ্যা, ইত্যাদির বিকাশের ক্ষেত্রে এর ভূমিকা, এবং এসব ক্ষেত্রে এরকম উদাহরণ দেয় যে কিভাবে অতীতে মুসলিম চিন্তাবিদেরা নিজস্ব চিন্তা বিকাশের ক্ষেত্রে বিদেশী জ্ঞানের উৎসগুলোকে ব্যবহার করেছেন। আর তা করতে গিয়ে যে যুক্তিটা দাঁড় করানো হয় তা হচ্ছে, আধুনিক পাশ্চাত্য চিন্তা দর্শনের ক্ষেত্রে মুসলিম চিন্তাবিদদেরও একই কাজ করা উচিত?

ওয়াইল হাল্লাকঃ এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন, যা আমাকে প্রায়ই করা হয়। আমি শুরু করতে চাই এভাবে, উনিশ ও বিশ শতাব্দীর আলোচনায় বায়তুল হিকমার বর্ণনাটি মূলত একটি অরিয়েন্টালিস্ট  কেন্দ্রীক অবস্থান, যা অনেকবার বিভিন্ন উপায়ে পুনরাবৃত্তি হয়েছে। আমি প্রকৃত ঘটনা কী বা বায়তুল হিকমার বিষয়টা ঠিক কী, সেগুলো নিয়ে প্রশ্ন করছি না। বরং এটা কিভাবে ইতিহাসের নতুন ব্যাখ্যা হয়ে দাড়ালো এবং বিশেষ একটি আইডেন্টিটিতে রুপ নিল, সেটা বলতে চাই। এই বর্ণনাটির আরো অনেক সমান্তরাল বিষয় আছে, যার সবগুলোই একই অর্থে যায়, “সাংস্কৃতিক ধার-গ্রহণ” এর একটি আলোচনা গঠন করে যা একটি স্বাধীন ও অউপনৈবেশিক পরিচয়ের প্রকাশ ঘটায়। উদাহরণস্বরুপ, জোসেফ স্কট আইনের ক্ষেত্রে একই কথা বলেছেন। তিনি যুক্তি দেখান, ইসলামী আইন ধার করা হয়েছে রোমান, বাইজান্টাইন এবং ইহুদী আইন থেকে, যা তাদেরকে সামগ্রিকভাবে একটি পশ্চিমা পণ্য হিসেবে দেখায়। অন্যকথায়, ইসলাম গঠিত হয়েছে অন্যদের থেকে (যেমন ইউরোপ) “শিখে” বা এর বৈধ সংস্কৃতিকে ধার করে, (যা তার ভাষায়, সভ্যতার মূল বা ভিত্তি)। বর্তমানে আলোচনাটি এগিয়ে চলছে, মডার্ণিটির সাথে আবার অনেক কিছু বদলেও যাচ্ছে, এবং সেই “পুরনো” ইসলাম এখন আর আধুনিক বিশ্বের সাথে খাপ খাওয়াতে পারছে না। তাই মুসলমানদের উচিৎ আবার পাশ্চাত্যের দিকে তাকানো এবং তাদের থেকে শেখা, যেমনটা তারা বারো কিংবা তের শতাব্দীর পূরবর্তী সময়কালে খুব ভালোভাবে করেছিল । সুপ্ত চৈতন্যগত অরিয়েন্টালিস্ট জ্ঞান হচ্ছে, মুসলমানরা সর্বদাই পাশ্চাত্য থেকে শিখেছে, তাহলে এখন কেন শিখছে না? সুতরাং বায়তুল হিকমার আলোচনাটি হচ্ছে একই সঙ্গীত ভিন্ন সুরে বাজানোর মতো আর কি।

কিন্তু এখানেই শেষ নয়। এ ব্যাপারে অস্বীকার করার কিছুই নেই যে, মুসলমানরা প্রায় ৮ম শতাব্দী থেকে অন্যদের ব্যাপারে গভীরভাবে আগ্রহী ছিল। হোক সেটা ভারতীয়, প্রাচীন ইরান বা গ্রীকদের প্রতি। অবশ্যই মুসলমানরা তখন তাদের কাজগুলো অনুবাদ করেছিল, এবং তাদের বুদ্ধিবৃত্তির সাথে একীভূত করেছিল, সেগুলোর যতটুকু তারা উপকারী মনে করেছিল। এই মিলটা এতটাই বাস্তবিক ছিল যে, এটা আলাদা করা প্রায় অসম্ভব যে ইসলামের থেকে গ্রীকদের কোনো উপাদানগুলো আলাদা। কিন্তু আমি অতোটা গুরুত্বারোপ করছি না যে, এই মিলটি করা হয়েছিল নিজস্ব (Native) জ্ঞান পদ্ধতির মাধ্যমে। যা গ্রহণ করার মত ছিল তা গ্রহণ করা হয় তবে এর পরিমাণ অতো বেশি নয়, তেমনি প্রত্যাখানও করা হয়েছিল। ইবনে হাজমের ধারা, ইমাম গাজালী ধারা, ইবনে তাইমিয়া ধারা, কিংবা অন্যান্য – এরকম জ্ঞানের বিভিন্ন ধারাগুলোই হচ্ছে এর শক্তিশালী প্রমাণ। এবং এটা আমার উসুলে ফিকহের সাথে দীর্ঘ ৩০ বছরের অভিজ্ঞতারও নির্যাস। এই উসুলে ফিকহের বিষয়টি বুদ্ধিবৃত্তিক উৎকর্ষে পরিপূর্ণ, যার প্রমাণও অসংখ্য। এটি বিশ্বের অনন্য একটি বিজ্ঞান, যার সাথে অন্য কোনো কালচারের বা বুদ্ধিবৃত্তিক গঠন কাঠামোর কোনো সাদৃশ্যতা নেই। উসুলে ফিকহ অবশ্যই কতিপয় বিষয়ে অন্যদের কাছ থেকে উপকৃত হয়েছে, তবে আমি মনে করি না যে কোনও  নেতৃত্ব স্থানীয় বুদ্ধিজীবি বলবেন যে, উসূলে ফিকহের নির্দিষ্ট ইসলামী আইডেন্টিটি নেই, যেখানে উসূলে ফিকহ মুসলমানদের একেবারে নিজস্ব প্রয়োজনে বিকশিত একটি জ্ঞান।

এখানে আমার কথা হচ্ছে, মুসলিম বুদ্ধিজীবীদের যেমন ইউরোপ-আমেরিকা এবং এর এনলাইটেনমেন্টের তাকলিদ (অনুসরণ) পরিত্যাগ করতে হবে, তেমনি অবশ্যই তাদের নিজস্ব ঐতিহ্যকে ধারণ করে বুদ্ধিমত্তার সাথে নিজেদের ইতিহাস ঐতিহ্যকে অধ্যয়ন করতে হবে। কারণ শুধু নিজেদের মধ্যে আবদ্ধ না থেকে অন্যদের দিকে, অন্য সংস্কৃতির দিকেও নজর দেওয়া উচিৎ, সেসবও যাচাই বাছাই করা উচিৎ। বিশেষ করে এশিয়ার (বৌদ্ধ, হিন্দু) দিকে। তবে এটি স্পষ্টভাবেই তর্কের বিষয় যে, ইউরোপ আমেরিকার চাইতে দক্ষিন-পূর্ব এশিয়ারও দেওয়ার অনেক কিছু আছে। বায়তুল হিকমাকে অবশ্যই একটি বিরাট জগত হতে হবে, এমন একটি জগত যেটা শুরু হয় একজনের মানসপটে এবং ক্রিটিক্যাল চিন্তার মধ্যে। আর এর শেষ কোথায়, তার ভবিষ্যৎবাণী করা যায় না এবং করা উচিতও নয়। তবুও, এই সকল কাজ শুরু করার জন্য তাদেরকে অবশ্যই চিন্তার সর্বোচ্চ শক্তিমত্তা ব্যয় করতে হবে। এখানে মূল বিষয় হচ্ছে তাদের নিজস্ব ও স্বাধীন চিন্তার জগত সৃষ্টি করা।

অনুবাদক: রিয়াজ আহমেদ

১৫৫৫ বার পঠিত

শেয়ার করুন

মতামত প্রকাশ করুন

Scroll to Top