খোলাফায়ে রাশেদার শাসনকাল পরবর্তী মাত্র একশো বছরের ব্যবধানে ইসলামের দাওয়াত গোটা দুনিয়ায় পৌঁছে যায় এবং সকল কিছুর উর্ধ্বে নিজস্ব অবস্থান সৃষ্টি করে নিতে সক্ষম হয়। কিছুকাল পরেই রোমান সভ্যতা, পারস্য সভ্যতা, বাইজেন্টাইন সভ্যতা, চাইনিজ সভ্যতা, সিন্ধু সভ্যতাসহ প্রতিটি সভ্যতার উপরেই তার শ্রেষ্ঠত্ব এবং প্রভাব বিস্তার করতে থাকে। এ শ্রেষ্ঠত্ব এবং প্রভাব শুধুমাত্র ভৌগলিক ক্ষমতা দখলের নয়, বরং এ প্রভাব আদালত ও ন্যায়ভিত্তিক অর্থনীতি প্রতিষ্ঠার। এ প্রভাব বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার, উন্নত কৃষি ও খাদ্যনীতি এবং সর্বশ্রেষ্ঠ আখলাকী ভিত্তির।
অপরদিকে এ প্রভাব ছিল নতুনত্বের, উন্নত চিন্তা এবং সবচেয়ে আধুনিক ও গতিশীল মেথডোলজির। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, এর প্রভাব গোটা দুনিয়াকে হাজার বছরের চেয়েও বেশি সময় ধরে আলোকিত করেছে, সকল দিক থেকে প্রস্ফুটিত করেছে। জ্ঞানের ধারায় নতুন বিপ্লব সৃষ্টিসহ মানবতার কল্যাণকামী শত শত যোগ্য মানুষ তৈরি করেছে এবং তৈরি করেছে সুন্দর সমাজ ও সুস্থ সংস্কৃতি।
এ সুমহান স্বর্ণালী সভ্যতা তথা প্রায় ১২০০ বছর ন্যায়ভিত্তিক দুনিয়া পরিচালনাকারী ইসলামী সভ্যতার পতনের পর নতুনভাবে উত্থান হয় আজকের পাশ্চাত্য সভ্যতার। পাশ্চাত্য সভ্যতার উত্থান পরবর্তী ধাপ ছিলো দুনিয়াজোড়া ঔপনিবেশিক শাসনকার্য পরিচালনা এবং শাসনাধীন অঞ্চল থেকে ধারাবাহিক লুণ্ঠন। আর তাদের এ দীর্ঘ সময়ের ঔপনিবেশিক শাসনকালে গণহত্যা, ভয়ঙ্কর শোষণ ও নিপীড়নের শিকার হবার পর নব্য আরেক শোষন শুরু হয়! তারই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে এশিয়া, আফ্রিকাসহ বিভিন্ন অঞ্চলে ছোট ছোট মুসলিম যে রাষ্ট্রগুলো গড়ে উঠেছিলো, তন্মধ্যে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য। রাষ্ট্রগুলোর বর্তমান অবস্থা যদি পর্যবেক্ষণ করি, তাহলে দেখবো এ রাষ্ট্রগুলো একেকটি আধুনিক ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে! এ অঞ্চলে বসবাসরত আমাদের অর্থাৎ মুসলিম যুব মননের সবচেয়ে বড় সংকট হলো গোলামীর জিঞ্জিরে আবদ্ধ হয়ে হীনমন্যতা, আত্মবিশ্বাসহীনতা নিয়ে পথ চলা। আর যেকোন গোলাম জাতির মূল বৈশিষ্ট্যই হলো এই হীনমন্যতা ও আত্মবিশ্বাহীনতা।
পাশ্চাত্য সভ্যতা আজ দুনিয়াকে যেভাবে শোষণ করছে, প্রতিটি সেক্টরকে যেভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে! তাতে এটিই সুস্পষ্ট হয় যে, নিয়ন্ত্রণাধীন দুনিয়ার নিয়ন্ত্রণাধীন শিক্ষাব্যবস্থা ও সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে একটি যুব সম্প্রদায় কখনোই পূর্ণ আত্মবিশ্বাস নিয়ে নতুন সভ্যতা বিনির্মাণের স্বপ্ন দেখতে পারে না। ফলশ্রুতিতে হারানো সেই সুমহান সভ্যতা থেকে শিক্ষা গ্রহণ না করে, তা পুনঃনির্মাণের বদলে আমাদের যুব সম্প্রদায় মানসিক প্রশান্তির জন্য সর্বোচ্চ কিছু গতানুগতিক জ্ঞান অন্বেষণ করে অথবা বিভিন্ন আকস্মিক সমাধান কিংবা কাল্পনিক ব্যক্তিত্ব নিয়ে মাতামাতি করে। অথচ একটি সভ্যতার পুনর্জাগরণের জন্য সে সভ্যতার পূর্ববর্তী স্বর্ণালী ইতিহাসকে, ইতিহাসের সামগ্রিক বয়ানকে সুস্পষ্টরূপে জাতির সামনে হাজির করা এবং সে ইতিহাসকে কেন্দ্র করে নতুনভাবে উজ্জীবিত হয়ে ওঠা প্রতিটি যুব সম্প্রদায়ের জন্যই অত্যাবশ্যকীয় বিষয়।
মানবতার ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতা ইসলামী সভ্যতার সন্তানদের আত্মবিশ্বাসী হওয়া, সংগ্রাম করা, সম্মুখপানে এগিয়ে চলার জন্য শুধু একটি বিষয়ই যথেষ্ট, সেটি হলো ইসলামী সভ্যতার স্বর্ণালী ইতিহাসকে সঠিকভাবে তুলে ধরা এবং সে আলোকে নিজেদের চিন্তা-চেতনাকে নতুনভাবে বিনির্মাণ করা। কেননা, এর দ্বারাই উম্মাহর যুবকগণকে নতুনভাবে জাগ্রত করা সম্ভবপর হবে, অন্যথায় শুধুমাত্র গতানুগতিক গোলামী আর নির্দিষ্ট ব্যবস্থার আওতাধীন কিছু সৃজনশীল কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করার মাধ্যমে সভ্যতার মুক্তি আনয়ন সম্ভব নয়।
আমরা জানি, মহাগ্রন্থ আল কোরআন কোনো ইতিহাসের গ্রন্থ নয়। ইতিহাসের গ্রন্থ না হওয়া সত্ত্বেও তার দুই তৃতীয়াংশ জুড়েই ঐতিহাসিক ঘটনাসমূহ বর্ণিত। কেনো? কারণ ইতিহাসকে ভালোভাবে জেনে-বুঝে এবং তার পর্যালোচনার ভিত্তিতে ভবিষ্যতের দিকে যাত্রা করতে হয়, নতুবা সভ্যতা বিনির্মাণের জন্য সঠিক রূপরেখা অঙ্কন করা, চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে মুক্তির জন্য সংগ্রাম করা এবং মুক্তি আনয়ন করা কখনোই সম্ভবপর হয়ে উঠবে না। কোরআনের শিক্ষার আলোকে যদি আমরা আমাদের ভবিষ্যতকে বিনির্মাণ করতে চাই, তাহলে অবশ্যই ইসলামী সভ্যতার ইতিহাসকে, ইতিহাসের সঠিক বয়ান ও সঠিক শিক্ষাকে সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরতেই হবে।
এ অবস্থান থেকে বর্তমানে আমাদের ইতিহাস চর্চা মোটেই যথার্থ নয়, আবার যেটুকুও চর্চা রয়েছে, তাতেও বড় বড় সংকট বিদ্যমান। এর মাঝে সবচেয়ে বড় দু’টি সংকট হলো–
• আমরা ইতিহাসকে পাঠ করি সংকট কেন্দ্রিকতা থেকে।
• আমরা সঠিক সংজ্ঞায়ন এবং মূল মেথডোলজির আলোকে ইতিহাস চর্চা করি না।
প্রথমটি, অর্থাৎ ইতিহাসকে সংকট কেন্দ্রিকতা থেকে পাঠ করার বিষয়টা ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে কিছু গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ হলো–
০১. সীরাত:
আল্লাহর রাসূল (সা.) এর জীবনের অধিকাংশ সময় কেটেছে মানুষের মধ্যে আখলাক প্রতিষ্ঠা; রাজনীতি, আদালত, অর্থনীতি, সভ্যতা ও সমাজ বিনির্মাণের কাজে। ব্যক্তি জীবন, সমাজ ও রাষ্ট্রসহ সকল ক্ষেত্রেই তিনি বড় বড় ত্যাগ ও ধারাবাহিক কষ্টের মধ্য দিয়ে একটি শক্তিশালী প্রজন্ম গড়ে তুলেছেন। কিন্তু এ বিষয়গুলোর সঠিক পর্যালোচনা, সঠিক শিক্ষা আমাদের সামনে খুবই কমই তুলে ধরা হয়। আমাদের সামনে যে বিষয়গুলোকে অতি গুরুত্বের সাথে হাজির করা হয়, সেগুলো হলো রাসূল (সা.) তার জীবনের অধিকাংশ সময়ই মুশরিকদের সাথে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়ে বা মুনাফিকদের ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে অথবা বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে নানান শাস্তির বিধান শুনিয়ে কাটিয়ে দিয়েছেন। সমাজে প্রচলিত সীরাত পাঠ করলে মনে হয় রাসূল (সা.) সারাটা জীবনই যুদ্ধের ময়দানে অতিবাহিত করেছেন। সীরাত সংশ্লিষ্ট ইতিহাস, সিনেমা, ডকুমেন্টারিসহ যা কিছু আমাদের সামনে উপস্থাপন করা হয়, সবকিছুই যুদ্ধ,মাগাজি ও দ্বন্দ্ব দিয়ে ভরপুর। অথচ রাসূল (সা.) তাঁর জীবনের সর্বমোট ৫৩ দিন যুদ্ধের ময়দানে কাটিয়েছেন। তার দীর্ঘ সময়ের অনান্য সংগ্রামগুলো, প্রচেষ্টাগুলোর ইতিহাস আজ আমাদের সামনে নেই; তাই সে আলোকে আমরা আমাদের শিক্ষাকেও কাজে লাগাতে পারছি না। যার ফলে অর্থনীতি, সমাজ, সভ্যতা, যোগ্য প্রজন্ম তৈরি, যোগ্য মানুষ তৈরি, আখলাক প্রতিষ্ঠার মতো অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো আমাদের মাঝে সম্পূর্ণভাবেই অনুপস্থিত।
০২. উমর (রা.):
হযরত উমর (রা.) ছিলেন সংগ্রামী জীবনের মূর্ত প্রতীক। তিনি রাসূল (সা.)-কে অনুসরণ করে তাঁর একজন যোগ্য ছাত্র হিসেবে জীবন অতিবাহিত করেছেন। এরই ধারাবাহিকতায় তিনি তার শাসনামলে সভ্যতা ও সমাজ বিনির্মাণ কেন্দ্রিক, আখলাক প্রতিষ্ঠা কেন্দ্রিক যে বিশাল বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছেন, তা মানবতার ইতিহাসে বিরল। একইভাবে তিনি অর্থনৈতিক যে বিপ্লব সাধন করেন, তা গোটা পৃথিবীর মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিলো। তার প্রচেষ্টায় কৃষি, প্রতিরক্ষা, সামাজিক নিরাপত্তা, নগরায়ন ও শিক্ষাব্যবস্থায় এক নতুন দিগন্তের দ্বার উন্মোচন হয়।
তিনি ছিলেন একজন বড় প্রজ্ঞাবান আলেম। তার শত শত আবিষ্কার, নতুন নতুন চিন্তা ও দূরদর্শী সিদ্ধান্ত আজ অব্দি আমাদের সামনে গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতি হিসেবে বিদ্যমান। তিনি কত বড় মুজতাহিদ ও বিজ্ঞানী ছিলেন তা তার সময়কার আইন, অর্থনীতি, কৃষি ও নগরায়ন বিষয়ে গৃহীত উদ্যোগগুলো পর্যালোচনা করলেই উপলব্ধি করা যায়।
কিন্তু সেই উমর (রা.)-কে আমরা কীভাবে পড়ি, কীভাবে জানি? আমাদের সামনে তাকে তুলে ধরা হয় এভাবে যে, তিনি বেশ লম্বা ছিলেন, রাগী স্বভাবের ছিলেন, রাসূল (সা.) এর শ্বশুর ছিলেন, এছাড়াও আরো কিছু কাহিনী-কাব্য। আমরা শুধু তার ক্রোধ, যুদ্ধ আর আইনি শাস্তির ঘটনাগুলোই পড়ি। ফলশ্রুতিতে মনে হয় তিনি ছিলেন যুদ্ধবাজ, অথচ উমর (রা.) খলিফা থাকাকালীন সময়ে রাষ্ট্রের বিভিন্ন দিক বিবেচনায় একদিনও যুদ্ধে যাননি, আলী (রা.)-কে পর্যন্ত যেতে দেননি। উমর (রা.)-কে এভাবে উপস্থাপন করার ফলস্বরূপ তার বড় বড় ইজতেহাদ, আবিষ্কার ও অবদানসমূহ, যেগুলো এই মুহূর্তে আমাদের জন্য শিক্ষণীয় এবং নতুন সভ্যতার পুনর্জাগরণের জন্য চেতনাদীপ্ত বিষয়, সেগুলোই অনুপস্থিত রয়ে যাচ্ছে।
০৩. উসমান (রা.):
উসমান (রা.) এর শাসনামলের প্রথম ছয় বছর ছিলো এক উর্বর সময়কাল। সফলতার সাথে তিনি বিশাল সালতানাত পরিচালনা করেছিলেন, কোথাও কোনো বিশৃঙ্খলা তো দূরের কথা, টু শব্দও হয়নি। সেটি নিয়ে আমাদের মাঝে কোনো রকমের পর্যালোচনা নেই। অথচ তার শাসনামল পর্যালোচনার ক্ষেত্রে পরবর্তীতে সৃষ্ট কিছু সমস্যাকে এমনভাবে সামনে নিয়ে আসা হয়, যা দেখলে মনে হয় উসমান (রা.) এর শাসনকালের পুরো বারোটি বছরই যুদ্ধ, অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও সংঘাতের মধ্য দিয়ে অতিক্রান্ত হয়েছে।
০৪. আলী (রা.):
আলী (রা.) তার সময়কালে অর্থনীতি, কৃষি, প্রতিরক্ষা, সামাজিক নিরাপত্তা, সাংস্কৃতিক ভিত্তি নির্মাণ এবং আখলাকের ক্ষেত্রে যে যুগান্তকারী সিদ্ধান্তসমূহ নিয়েছিলেন ও প্রয়োগ করেছিলেন, তার প্রত্যেকটিই পরবর্তী প্রজন্মের জন্য শ্রেষ্ঠ ইশতেহার। অথচ সেগুলো নিয়ে আমাদের মাঝে কোনো সঠিক পর্যালোচনা নেই। তার সময়কালের দুটি যুদ্ধকেই আমরা সব সময় সামনে নিয়ে আসি এবং এগুলোকে কেন্দ্র করে মানবিক দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করে থাকি। খলিফা হওয়ার পূর্বে তিনি পূর্ববর্তী খলিফাদের ২৪ বছরের খেলাফতে যে বিশাল অবদান রেখেছেন, সেটিও আমাদের চোখে পড়ে না। তিনি ছিলেন উসমান (রা.) এর প্রধান উপদেষ্টা, উমর (রা.) এর চিফ জাস্টিস। তারা সার্বক্ষণিক তাকে পাশে রাখতেন, কোনো যুদ্ধে পর্যন্ত যেতে দিতেন না, কারণ তার দেওয়া পরামর্শ এবং মূলনীতিগুলো ছিলো অত্যন্ত মূল্যবান, যার আলোকে ইসলামী সভ্যতা এতদূর পর্যন্ত পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছে। তার এ সকল গুরুত্বপূর্ণ অবদান এবং কার্যক্রম নিয়ে আজ আমাদের মাঝে কোনো পর্যালোচনা হয় না, বিষয়গুলোর মূল শিক্ষা বোঝার মানসিকতাও পরিলক্ষিত হয় না।
০৫. মুয়াবিয়া (রা.):
মুয়াবিয়া (রা.) এর ২২ বছরের শাসনামলে ছিলো না কোনো বিদ্রোহ, কোনো অর্থনৈতিক সংকট। স্পেন থেকে ফ্রান্স, ইন্দোনেশিয়া থেকে ভারতসহ বিশাল অঞ্চলে (অর্ধ জাহান) তার প্রভাব ছিলো। তিনি উপহার দিয়েছিলেন এক সেরা প্রশাসনিক ব্যবস্থা। একইভাবে তিনি সামাজিক নিরাপত্তা, শান্তিপূর্ণ সমাজ এবং সাংস্কৃতিক সহাবস্থান প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এ সকল বিষয়কে কেন্দ্র করে কোনো সঠিক পর্যালোচনা নেই! যাও কিছু রয়েছে, তার সবগুলোই দ্বন্দ্ব এবং যুদ্ধ কেন্দ্রিক।
যুদ্ধ ও দ্বন্দ্ব কেন্দ্রিক বিষয়গুলোকেও আমরা পর্যালোচনা করবো, সেগুলো থেকেও শিক্ষা নিবো; কিন্তু তার মানে এই নয় যে এসব ব্যাপারকেই বেশি গুরুত্ব দিতে গিয়ে এ মহান ব্যক্তিদের মূল অবদানগুলোকে এড়িয়ে যাবো, ইসলামী সভ্যতার শ্রেষ্ঠত্বকে ভুলে যাবো। আর আমাদের লক্ষ্য যেহেতু ইসলামী সভ্যতাকে ভালোভাবে পড়ে, বুঝে তার শিক্ষাকে বর্তমান প্রেক্ষাপটের আলোকে কাজে লাগিয়ে নতুনরূপে সভ্যতার দিগন্ত উন্মোচন করা, তাই ইতিহাসের সামগ্রিক পর্যালোচনা আমাদের জন্য শতভাগ আবশ্যকীয় ব্যাপার।
অথচ আজ আমরা ইসলামকে পড়ার সময় পড়ি যুদ্ধের ইতিহাস, শাসনের ইতিহাস, আর নিজেরাও অবাস্তব যুদ্ধের ফ্যান্টাসিতে ভুগী। যেমন– দিরিলিস আর্তুগ্রুল এমনভাবে বানানো হয়েছে, মনে হয় আর্তুগ্রুলের জীবনে শুধু যুদ্ধ আর যুদ্ধ, তার সকল সংগ্রাম ঘোড়া আর তরবারি পর্যন্তই সীমাবদ্ধ। অথচ কত ত্যাগ, চিন্তা ও জ্ঞানের সফর ছিল তাদের, পাশাপাশি যোগ্যতা অর্জন, তারবিয়্যা, ব্যবসা-বাণিজ্য, পরিবারসহ বিশাল এক সংগ্রামী জীবন-পথ তারা পাড়ি দিয়েছেন। একপেশে উপস্থাপনার কারণে আমরা তার জীবন থেকে সঠিক শিক্ষাগুলোকে গ্রহণ করতে পারছি না এবং তা বর্তমান প্রেক্ষাপটের আলোকে কাজে লাগাতে পারছি না। এমনকি সে শিক্ষার আলোকে বর্তমান যুগের সাথে সমন্বয় করে নতুন আঙ্গিকে সভ্যতা বিনির্মাণের কোনো রূপরেখাও দিতে পারছি না।
দ্বিতীয় বিষয়টি, অর্থাৎ ইতিহাসকে তার সঠিক সংজ্ঞা ও মেথডোলজির আলোকে পাঠ না করার ফলশ্রুতিতে আমরা বিভিন্ন কল্পকাহিনী, আজগুবি ইতিহাস চর্চা করছি এবং ভুল শিক্ষা অর্থাৎ যে শিক্ষা গ্রহণ করা দরকার, সে শিক্ষা গ্রহণ না করে ভিন্ন শিক্ষা গ্রহণ করছি! ইতিহাসের উদ্দেশ্য না বুঝে তৎকালীন সময়ের আলোকে যে ঘটনাটি ঘটার কথা ছিলো সেটিকে বর্তমান সময়ের সাথে মিলিয়ে ভিন্ন দিকে ধাবিত করছি! যার ফলে নানা ধরনের সমস্যার উদ্ভব হয়।
এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় উদাহরণ ইতিহাস ও সমাজবিজ্ঞানী ইবনে খালদুনের সংজ্ঞায়ন। ইবনে খালদুন তার সময়ে চলতে থাকা প্রচলিত বয়ানকে খন্ডিয়ে নতুনভাবে ইতিহাসের বিজ্ঞান দাঁড় করান। তার মতে ইতিহাস দুই প্রকার। যথাঃ
১. জাহেরী
দৈনন্দিন ঘটনা, রাষ্ট্রীয় কার্যক্রম, যা ঘটে, বাহ্যিকভাবে দেখায় ইত্যাদি। বর্তমানে যে কাজসমূহ ভবিষ্যতে জাহেরী ইতিহাস হবে তা হলো পত্র-পত্রিকা, মিডিয়া, খবর, চামচামি বা তেলবাজি, কার পরে কে ক্ষমতায় ইত্যাদির ইতিহাস।
২. বাতেনী
সামগ্রিক ইতিহাস। আর এ তত্ত্বটিই মূলত ইবনে খালদুনকে ইবনে খালদুন বানিয়েছে, অর্থাৎ তার পূর্বে ইতিহাসকে কেউ এভাবে ডিফাইন বা ক্লাসিফাই করতে পারেনি। সুতরাং এই সামগ্রিক ইতিহাসই মূলত ইতিহাস, যা সব কিছুকে প্রভাবিত করে, যার উপর ভিত্তি করে সব নিয়ন্ত্রিত হয়।
বাতেনী ইতিহাস হলো–
وفي باطنه نظر وتحقيق وتعليل للكائنت ومباديها دقيق وعلم بكيفية الواقع واسبابها عميق
সংজ্ঞাটিকে ভালোভাবে লক্ষ্য করলে দেখবো–
نطر:
ইতিহাসের জন্য থিওরি থাকতে হবে; থিওরিটিক্যাল চিন্তাকে ডেভেলপ করা। অর্থাৎ থিউরিটিক্যালি সামনে আনতে হবে (দেখা বা পড়ার সাথে সাথে বিবেচনা না করে পড়া যাবে না)। ইতিহাসের পেছনে, সামনে, বিভিন্ন মৌলিক বিষয়ের সাথে সম্পৃক্ত করে ইতিহাসকে পর্যালোচনা করা।
تحقيق:
ক্রিটিকাল থিংকিং। শোনার সাথে সাথে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে চিন্তা করা। এ নিয়ে তিনি প্রচুর উদাহরণ দিয়েছেন। যেমন-
• ‘ইব্রাহিম (আঃ) ৭০ হাত লম্বা ছিলেন’ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “আমি অনেকবার কুদুসে গিয়েছি; তাঁর কবর তো এত লম্বা নয়!”
• ‘নূহ (আঃ) এর পুত্র কেনান এত লম্বা ছিলেন যে তিনি মাছ ধরে উপরের দিকে ধরতেন, সূর্যের তাপে পোড়াতেন।’ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “তাপ মাটির সাথে সম্পৃক্ত, যত উপরে উঠা হবে, পরিবেশ ততই ঠান্ডা হবে। তাহলে এ কাহিনীর ভিত্তি কী?” যেমন বর্তমান যুগে আমরা এখন বিমানে উঠলেই বুঝতে পারি উপরে ঠান্ডা।
• মাসউদির বিভিন্ন ইতিহাসসহ বেশ কিছু যুদ্ধের কাহিনী তিনি উল্লেখ করেছেন। বলা হয়ে থাকে যুদ্ধে দুই পক্ষে ছয় লক্ষ সৈন্য ছিলো। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “ছয় লক্ষ সৈন্য! এটি বাস্তবে সম্ভব? এত বড় জায়গা কোথায়? এত সৈন্য একসাথে কীভাবে যুদ্ধ করবে? তখন জনসংখ্যা কত ছিলো?”
আর এই تحقیق শব্দটি এসেছে حق থেকে। অর্থাৎ হক-এ পৌঁছানো, সত্যে পৌঁছানোর জন্য ক্রিটিকাল থিংকিং করা।
تعلیل:
কজ এন্ড ইফেক্ট (কারণ এবং ফলাফল)। এ দুইয়ের মধ্যে সামঞ্জস্য করা অথবা পার্থক্য স্থাপন করা।
যেমন- বর্তমান দুনিয়ায় যা হচ্ছে তা এমনিতেই হঠাৎ করে ঘটে না, ঘটে যাচ্ছে না। সবই পরিকল্পিত কাজের ইফেক্ট। অর্থাৎ সবই ডিজাইন করা। সব যুগের ক্ষেত্রে একই কথা প্রযোজ্য, হুট করেই কিছু হয় না। তাই সে ডিজাইন (কারণ এবং ফলাফল) পর্যালোচনা করেই ইতিহাসকে পড়া।
ومباديها دقيق:
সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম মূলনীতি। উপরের কজ এন্ড ইফেক্টকে (কারণ এবং ফলাফল) মিলাতে হবে, পর্যালোচনা করতে হবে মূলত সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম মূলনীতির আলোকেই।
وعلم بكيفية الوقع:
ঘটনার অন্তর্নিহিত রহস্য, কারণসমূহ, কীভাবে আসলো তথা সমগ্র রহস্য জানা ইত্যাদি। আর এসব ‘কেন?’ প্রশ্নের জবাব হলো تعلیل।
واسبابها عميق:
কারণসূমহ অনেক গভীর থেকে গভীরতর।
সর্বোপরি বলা যায়, তারিখে বাতেনী (অন্তর্নিহিত ইতিহাস) হলো–
• তত্ত্ব বা থিওরি।
• ক্রিটিকাল থিংকিং।
• কজ এন্ড ইফেক্ট।
• কারণ ও ফলাফলের কাহিনীসমূহ।
• উপরোক্ত সব কিছুর সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম মূলনীতি।
• ঘটনার রহস্য সম্পর্কে জ্ঞান এবং কারসমূহ অনেক গভীর থেকে গভীরতর।
কিতাবুল ইবার সম্পূর্ণটাই এ মূলনীতির উপর ভিত্তি করে রচিত, যা ইতিহাসের কষ্টিপাথর বা মূলনীতি।
অথচ আজ আমরা ইতিহাস বলতে বুঝি ক্ষমতার ইতিহাসকে (জাহেরী ইতিহাস), যেমন অর্থনীতি বলতেই বুঝি যাকাত-ফিতরাকে! আর এভাবেই আড়ালে পড়ে গেছে ১২০০ বছর ন্যায়ভিত্তিক দুনিয়া পরিচালনাকারী ইসলামী সভ্যতার ইতিহাস। তাই বাংলা অঞ্চলে বসবাসকারী আমরা যুবকরা আজ খুঁজে পাই না–
১. ইসলামী সভ্যতার ইতিহাস।
২. ইসলামী দর্শনের ইতিহাস।
৩. ইসলামী অর্থনীতির ইতিহাস।
৪. ইসলামী রাজনীতি ও প্রশাসনের ইতিহাস।
৫. ইসলাম প্রচারের ইতিহাস।
৬. ইসলামী সংস্কৃতি, শিল্পকলার ইতিহাস।
৭. ইসলামের শহর, স্থাপত্যের ইতিহাস।
৮. ইসলামের প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্রনীতির ইতিহাস।
৯. ইসলামী সামাজিক ব্যবস্থা, পরিবারের ইতিহাস।
১০. ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থার ইতিহাস।
১১. ইসলামের বিজয় অভিযান, সম্মুখ যুদ্ধের ইতিহাস।
১২. ইসলামের প্রজ্ঞাবান আলেমদের ইতিহাস। (শাসকদের সাথে আলেমদের দ্বন্দ্ব ছিলো, তাই বহু আলেম আলোচিত হয় না এবং আমরা তাদের সম্পর্কে জানিও না।)
১৩. ইসলামী জ্ঞানের ইতিহাস।
১৪. ইসলামী চিন্তার ধারাবাহিক উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ।
এ প্রতিটি বিষয়ের উপর শত শত গ্রন্থ রচনা প্রয়োজন, দারস ও পর্যালোচনা প্রয়োজন, গবেষণা প্রয়োজন।
এ সকল ইতিহাস ও তার পর্যালোচনা কি আমরা আদৌ জানি? এসব ছাড়া কীভাবেই-বা আমাদের নতুন সভ্যতা বিনির্মাণ সম্ভব?
আবার আমরা জানি যে, ইসলামী সভ্যতার ইতিহাসকে বোঝার ক্ষেত্রে যে বিষয়গুলো আবশ্যক–
• আল্লাহর রাসূল (সাঃ) এর সীরাত।
• প্রেক্ষাপটের আলোকে নবী-রাসূলগণের সংগ্রাম।
• অন্যান্য সকল সভ্যতার ইতিহাস।
• সকল ধর্মের ইতিহাস।
• প্রতিটি অঞ্চলের ইসলামের ইতিহাস।
• বর্তমান দুনিয়ার সামগ্রিক অবস্থান।
উপরোক্ত বিষয়সমূহের আলোকে আমরা ইসলামী সভ্যতার ইতিহাসকে বোঝার প্রচেষ্টা চালাই না; তাহলে আমরা কীভাবেই-বা ইসলামী সভ্যতার বয়ান যৌক্তিকভাবে হাজির করার স্বপ্ন দেখি?
ইসলামী সভ্যতার ১২০০ বছরের ন্যায়ভিত্তিক শাসনের ইতিহাস থেকেও আমরা আত্মবিশ্বাস খুঁজে পাই না, কারণ ইতিহাসের সকল চিন্তাই শাসকদের সমস্যা ও সীমানা কেন্দ্রিক! অথচ আমরা ভেবে দেখি না সীমানা কম-বেশি হওয়া, কিছু শাসকদের মাঝে সমস্যা থাকা খুবই স্বাভাবিক ছিলো। অপরদিকে আমরা এটিও ভেবে দেখি না গোটা দুনিয়ার অর্থনীতি, খনিজ সম্পদ কাদের হাতে ছিলো, পররাষ্ট্রনীতি কারা নিয়ন্ত্রণ করতো, কাদের চিন্তা ও পদ্ধতি দ্বারা গোটা দুনিয়ার শিক্ষাব্যবস্থা প্রভাবিত ছিলো, জ্ঞান ও উদ্ভাবন কাদের হাতে ছিলো, সাংস্কৃতিক প্রভাব-বলয় কত উচ্চ পর্যায়ে ছিলো, প্রতিরক্ষা, নৌপথ, আবিষ্কার সবই কাদের আদালতপূর্ণ ব্যবস্থা দ্বারা পরিচালিত হতো। এভাবে ইতিহাসকে সামগ্রিকভাবে পড়তে পারলে আমরা নিজেরাও আগামীর কর্তব্য খুঁজে পেতাম, শক্তিশালী হতে পারতাম, ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব তুলে ধরতে পারতাম। তাই প্রয়োজন জাহেরী ইতিহাসের তৈরিকৃত বয়ান থেকে বেরিয়ে এসে সুচারূরুপে বাতেনী ইতিহাস অধ্যয়ন করা এবং হাকীকতে পৌঁছানো। প্রয়োজন আজ সামগ্রিকতার; চিন্তা ও পড়াশোনার সামগ্রিকতা এবং কর্মতৎপরতা সামগ্রিকতার।
প্রফেসর ড. নাজমুদ্দিন এরবাকান বলেছিলেন, “মানুষের সামনে ইসলামের শ্রেষ্ঠত্বকে এমনভাবে তুলে ধরুন, যেন তারা আপনার যুক্তি ও কথার বিপরীতে অন্য কোনো যুক্তি দাঁড় করানোর সাহসও না করতে পারে। শ্রোতার কিংবা উদ্দেশ্যকৃত ব্যক্তির মাথায় পঞ্জীভূত সকল প্রশ্নের জবাব এমনভাবে দিবেন, যেন সে সম্পূর্ণভাবে আপনার সাথে ঐকমত্য পোষণ করে। আর এজন্য প্রয়োজন সভ্যতার সামগ্রিক জ্ঞান। যারা ইসলামের শ্রেষ্ঠত্বকে প্রমাণ করতে চায়, তাদের উচিত হলো সমসাময়িক সকল জ্ঞান ও মতবাদ সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারনা রাখা।” (ইতিহাসকে সামগ্রিকভাবে বোঝা ছাড়া বর্তমান সময়কে বোঝা অসম্ভব। আর বর্তমানকে ভালোভাবে উপলব্ধি করতে না পারলে ভবিষ্যৎ বিনির্মাণ সম্ভব নয়।)
আর এ কাজটিই যদি আমরা করতে পারি, এভাবেই যদি ইসলামী সভ্যতাকে বুঝতে ও উপস্থাপন করতে পারি, তাহলে অবশ্যই ফিরে পাবো সেই হারানো আত্মবিশ্বাস, ফিরে পাবো সেই চেতনাদীপ্ত উম্মাহ, ইনশাআল্লাহ্।