(সাইয়েদ হোসেইন নাসর এবং হামজা ইউসুফ, দুইজন অত্যন্ত বড়মাপের চিন্তাবিদ৷ তারা কয়েক দশক ধরে একে অপরকে চেনেন। এটি ২০২৩ সালের অক্টোবরের শেষের দিকে তাদের মধ্যে হওয়া আলাপচারিতার রেকর্ডের সম্পাদিত প্রতিলিপি।)
তারা এই আলোচনায় ঐতিহ্যগত ইসলামী দর্শন এবং মেটাফিজিক্স নিয়ে আলোচনা করেছেন। এর সাথে সম্পর্কহীন চিন্তকেরা কীভাবে গভীর বুদ্ধিবৃত্তিক ঐতিহ্যকে ঝুকির মধ্যে ফেলেন, যার কিনা তার নিজস্ব মহিমায়ই আধুনিক সমাজে অবদান রাখতে সক্ষমতা রয়েছে।
হামজা ইউসুফ: আমি সম্প্রতি একটি কনফারেন্সের উপস্থিত ছিলাম, যেখানকার লোকদের আমার সাথে দেখা হলে আমি তাদের জিজ্ঞাসা করি যে তারা কী করে? তারা বলল তারা দার্শনিক। আমি মজা করে তাদের জিজ্ঞেস করলাম, সক্রেটিসের মত?
আজকের দুনিয়ায় লোকজন দার্শনিক শব্দটিকে বেশ চমকপ্রদ হিসেবে উচ্চারণ করে থাকে, কিন্তু আপনি তো সত্যিই একজন দার্শনিক— সেই বিরল লোকদের মধ্যে একজন যাকে মহান আল্লাহ আকল এবং সৃজনশীল অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে ভূষিত করেছেন।
সমগ্র মানবতাকে জর্জরিত করে এমন চিরায়ত অস্তিত্বগত সমস্যাবলি সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তা করার জন্য আপনি প্রচুর সময় পেয়েছেন, সেই সাথে প্রতিটি নতুন যুগের সাথে আসা বিশাল সব সমস্যা নিয়েও ভাবার সুযোগ পেয়েছেন। আপনি সম্ভবত জাপানি দার্শনিক কেইজি নিশিতানির সাথে পরিচিত, তিনি বলেছেন যে নিহিলিজম (শূন্যবাদ) একটি চিরন্তন সমস্যা।
সাইয়্যেদ হোসাইন নাসর: হ্যাঁ।
হামজা ইউসুফ: নিহিলিজম কখনো হারিয়ে যায় না; বরং এটি ঘুরেফিরে বারবার হাজির হয় এবং মানুষকে চ্যালেঞ্জ করে। কিন্তু আপনি একজন বিজ্ঞানের ইতিহাসবিদ এবং বিজ্ঞানের একজন দার্শনিকও, তাই আমি আপনাকে কিছু প্রশ্ন করতে চাই। শুরুতেই প্রশ্ন থাকছে, E. A. Burtt এর বই, The Metaphysical Foundations of Modern Science কতটা প্রাসঙ্গিক?
সাইয়েদ হোসাইন নাসর: এটি বহু দশক আগে লেখা একটি ক্ল্যাসিক্যাল বই। খুব ভালো বই।
হামজা ইউসুফ: তিনি ওই বইয়ে যে বিষয়ে কথা বলেছেন তার মধ্যে একটি হল যে প্রাক-আধুনিক মানুষ- বাহ্যিক জগতের সাথে অন্তরের যোগাযোগকে বাস্তব মনে করে।
সাইয়েদ হোসাইন নাসর: হ্যাঁ।

হামজা ইউসুফ: তাই ‘জ্ঞানতত্ত্ব’ তাদের জন্য সত্যিই কোন সমস্যা ছিল না। তারপরে তিনি সেখানে এই যুক্তি দেন যে, আধুনিক দর্শনের মূল উদ্বেগ হল জ্ঞানতত্ত্ব (Epistemology)। কারণ আজকের দার্শনিকদের এই পোস্ট-কান্টিয়ান (কান্ট পরবর্তী) দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে যে বাস্তবতা (Reality) কেবল একটি বিশিষ্ট ঘটনামাত্র।
তিনি বলেছেন, “অন্তত জর্জ বার্কলে এবং লিবনিজের কাজ দিয়ে শুরু হওয়া আধুনিক মেটাফিজিক্সের ক্ষেত্রে এর জ্ঞানতাত্ত্বিক ফোকাস ছাড়াও আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোগ সূত্র রয়েছে; মূলত প্রকৃতির সাথে মানুষের সম্পর্কের এই নতুন দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধে একটি অসফল প্রতিবাদের ধারাবাহিকতার মধ্যে সেটি নিহিত।”
তারপর তিনি বলেন, যে বিষয়টি আমাকে এখানে আগ্রহী করে তুলেছে তা হলো: বার্কলে, হিউম, কান্ট, ফিচটে, হেগেল, জেমস, বার্গসন—সবাই এক ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় একটি বিন্দুতে মিলিত হয়েছে। সেটি হচ্ছে মহাজাগতিক পরিকল্পনার গুরুত্ববহ জায়গাটিতে মানুষকে তার উচ্চ আধ্যাত্মিক স্বত্ব সমেত পুনঃস্থাপন করার প্রচেষ্টা।
এই প্রচেষ্টাগুলির ক্রমাগত রদবদল এবং মানুষকে বোঝানোর ক্ষেত্রে তাদের ব্যাপক এবং ধারাবাহিক ব্যর্থতা এটাই প্রকাশ করে যে তারা যে দৃষ্টিভঙ্গিকে আক্রমণ করে যাচ্ছিল তা কতটা শক্তভাবে মানুষের মনোজগৎকে দখল করে ছিল এবং এখন সম্ভবত আগের যেকোন প্রজন্মের চেয়েও বেশি, আমরা এমন দার্শনিকদের খুঁজে পাই যারা সকল কিছুর ঊর্ধ্বে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে সৎ হতে উদগ্রীব। নিষ্পত্তি হয়ে গেছে এমন মনোভাব নিয়ে এই যুদ্ধ শেষ করতে প্রস্তুত এবং ময়দান ত্যাগ করতে প্রস্তুত।
আপনি সেই ব্যক্তিদের মধ্যে একজন যারা “ময়দান ত্যাগ” করতে অস্বীকার করেছেন। আমি সে সম্পর্কে আপনার কিছু চিন্তা শুনতে চাই।
সাইয়েদ হুসাইন নাসর: বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম। এই সমস্যাটি একটি দীর্ঘ সময় যাবত আলোচিত হয়েছে নিশ্চয়ই। এর কারণ হিসেবে আমি মনে করি, বার্কলে এবং হেগেলের মতো লোকেরা এবং আপনি যাদের কথা উল্লেখ করেছেন সেই ধরণের সমস্ত লোকেরা যারা পশ্চিমা দার্শনিক অর্থে আদর্শবাদী (আইডিয়ালিস্ট) ছিল এবং মেটাফিজিক্সকে পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টা করেছিল, তারা সম্পূর্ণরূপে সফল হয়নি কারন আসল মেটাফিজিক্স তাদের কাছে প্রকৃতপক্ষেই মওজুদ ছিল না।
দর্শনের একটি শাখা হিসেবে মেটাফিজিক্স এবং বাস্তবতার সর্বোচ্চ বিজ্ঞান হিসেবে মেটাফিজিক্স, কোনভাবেই এ দুটি গুলিয়ে ফেলা যাবেনা। তারা বিষয়সমূহের প্রকৃতি নিয়ে একটা আংশিক বোঝাপড়া অর্জন করতে পেরেছিল। উদাহরণস্বরূপ, বার্কলের আইডিয়ালিজম প্রকৃতপক্ষেই রেস এক্সটেন্সা (বর্ধিত বিষয়) এবং রেস কগিটান্স (চিন্তাগত বিষয়)১ এর মাঝে বিদ্যমান দুনিয়া সংক্রান্ত কার্তেসিয়ান দ্বিখন্ডনের একটিকে বাতিল করে দেয়ার উপরে প্রতিষ্ঠিত।
বাস্তবতা কি আসলেই অন্তরে, নাকি বহির্জগতে? (ওহী ছাড়া মানুষ তার আভ্যন্তরীণ চিন্তার বাইরে বহির্জগতের বিষয় বুঝতে পারেনা, এটা যেহেতু পাশ্চাত্যের কাছে নেই- অনুবাদক) তাই তারা বহির্জগৎকে খারিজ করে দিলো। কিন্তু এই দ্বিখণ্ডন নিজেই একটা মিথ্যা। দেকার্তের সময় থেকেই আসলে পাশ্চাত্যের লোকজন কখনোই এই মিথ্যা দ্বিখন্ডনকে গভীরভাবে পরখ করেনি।
কিন্তু উনিশ শতক পরবর্তী সময়ে কিছু মেটাফিজিক্স বিশারদ, যেমন জার্মানির ফ্রানজ ভন বাদের এই দ্বিখন্ডনকে শক্তভাবে প্রশ্ন করতে শুরু করেন। এবং আজ আমার বন্ধু ওলফগ্যাং স্মিথ, যিনি আপনার মতই ক্যালিফোর্নিয়ার বাসিন্দা এবং খুব স্মরণীয় একজন ফিজিসিস্ট এবং ঐতিহ্যগত দার্শনিক। তিনি এই সংক্রান্ত মিথ্যা নিয়ে বিস্ময়কর কিছু লিখেছেন।
যেমন খুব ক্ষুদ্র ঘটনার ভবিষ্যদ্বাণী করায় অত্যন্ত সফল বিষয় হচ্ছে কোয়ান্টাম মেকানিক্স। কেন এর কোন দার্শনিক ভিত্তি নেই? কারণ এটা সেই মিথ্যা কার্তেসিয়ান দ্বিখন্ডনই আঁকড়ে ধরে থাকতে চাচ্ছিল, কিন্তু তা ঠিক মত কাজ করেনি।
সুতরাং আপনার-আমার মত ইসলামের মেটাফিজিকাল ঐতিহ্যের প্রতি নিবেদিতপ্রাণ ব্যক্তি হিসাবে আমাদের নিজস্ব ঐতিহ্যকে আঁকড়ে থাকা উচিত এবং এসব কৃত্রিম সমস্যার দ্বারা প্রতারিত হওয়া অনুচিত।
পশ্চিমা সমস্যা সমাধানের জন্য সেইসব সমস্যার আসল কারণ সংবলিত মিথ্যাকে ফাঁস করে দিতে হবে। এজন্যই আমি পাশ্চাত্য চিন্তার বিস্তৃত ইতিহাস লিখি না। আমার একটি বই, ‘রিলিজিয়ন অ্যান্ড দ্য অর্ডার অফ নেচারে’, আমি প্রকৃতি দর্শনের বিভিন্ন মিথ্যা ঘরানার সাথে মোকাবেলা করেছি। তবে সাধারণত আমি মূলে হাত দেয়ার চেষ্টা করেছি, যে ভুলগুলো সপ্তদশ শতাব্দীতেই ঘটে গিয়েছিল।
এই কার্তেসিয় দ্বিখন্ডন সম্পূর্ণ মিথ্যা এবং ইবনে সিনা, সোহরাওয়ার্দী, মোল্লা সাদরা, ইমাম গাজালী এবং ইসলামের সমস্ত মহান আলেম, দার্শনিক এবং মুতাফাক্কিরগণ যা বলেছেন সে সব কিছুর বিরুদ্ধে।
হামজা ইউসুফ: হ্যাঁ, পাশ্চাত্যের হাতে একটা সাবলীল ঐতিহ্য ধারণ করার কোন পথ বাকী ছিলনা কেননা তাদের ঐতিহ্য অস্থিসার হয়ে গিয়েছিল, আবার বিশাল এক মেটাফিজিক্যাল ঐতিহ্যের অধিকারী ক্যাথলিক ধারাও মধ্যযুগের মত সেই মানের কোন বুদ্ধিজীবী উৎপাদন করতে পারছিলোনা।
আবার মুসলমানদেরও কিন্তু সমস্যা ছিল। প্রথমত, ইরানী মক্তব ব্যাতিরেকে আমাদের সুন্নি বলয়ে, কুর্দি এবং ইন্দো-পাকিস্তানি ধারার মত কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া, সমগ্র আরব বিশ্বে কোন কারণে- দর্শন পুরোপুরি মৃত্যুবরণ করে এবং যুক্তি সংক্রান্ত প্রশিক্ষণ থেকে বস্তুগত যুক্তি প্রায় সম্পূর্ণ সরিয়ে দেয়া হয়। তো এখানে আমাদের ঐতিহ্যের একটা বিচ্ছেদ আছে। আপনি কীভাবে সেটা পুনরুদ্ধার করবেন?
সাইয়েদ হোসাইন নাসর: এটা খুব ভাল একটা প্রশ্ন। আপনি যদি পঞ্চাশ বছর আগে আমাকে এই প্রশ্নটা করতেন, তাহলে আমার জবাব খুবই ভিন্নরকম হতো।
সৌভাগ্যবশত, ইবরাহীম মাদকৌর এবং ১৯৪০ এবং ৫০ এর দশকের প্রসিদ্ধ মিশরীয় দার্শনিক আলেমদের সময় থেকে আরব বিশ্বে, বিশেষ করে আরবের হৃদয় খ্যাত মিশরে দার্শনিক ঐতিহ্যের পুনরুত্থানের গুরুত্ব প্রতিভাত হতে থাকে।
এই ঐতিহ্য ফাতিমী আমলে এবং তার পরবর্তি কিছু সময়ে মিশরে বিদ্যমান ছিল। যা ক্রমান্বয়ে বিভাজিত হয়ে যায় কিছুটা ইমাম গাযালী পরবর্তী নতুন দার্শনিক কালামের মধ্যে, আর কিছুটা দার্শনিক সুফিবাদের মধ্যে। শিয়া প্রভাবান্বিত ইরাক ছাড়া আরব বিশ্ব থেকে এই স্বতন্ত্র দার্শনিক মক্তবটি অদৃশ্য হয়ে যায়। মোটকথা, ইরাক বাদে সমস্ত প্রধান জ্ঞানকেন্দ্রগুলি থেকে এ সংক্রান্ত আরবী জ্ঞান গায়েব হয়ে যায়।
অনেক আরব এখন সেটা পুনর্জাগরিত করার গুরুত্ব উপলব্ধি করছেন। তারা ৮০’র দশকেও চেষ্টা করেছিল। যখন বেলজিয়ামে সংসদসমূহ কর্তৃক আরবীর ওপরে প্রথম কনফারেন্স আয়োজিত হয়; তারা আরব জাতীয়তাবাদকে নিশান হিসেবে তুলে ধরতে চেয়েছিল।
কোন কোন ক্ষেত্রে সমসাময়িক আরব প্রেক্ষাপটে ইসলামী চিন্তার পুনর্জাগরণ ঘটেছে। এমনকি বর্তমান স্বৈরশাসনের মাঝেও মিশরে আমার ছয় সাতটি বই আরবীতে প্রকাশিত হয়েছে।
ইবরাহীম মাদকৌর, আব্দুর রহমান বাদাভী এবং সমস্ত বিখ্যাত মিশরীয় দার্শনিক, এমনকি পরবর্তীদের নিয়েও সেখানে নতুনভাবে প্রচন্ড আগ্রহ তৈরী হচ্ছে। অনেক শিক্ষার্থী মওলাযাদার উপর তাদের ডক্টরেট থিসিস করছেন, যা পঞ্চাশ বছর আগেও শোনা যায়নি।
এই নতুন ইসলামী দর্শন- যার আবাস পারস্যে এবং গভীরভাবে পারসিক বিষয়াবলির প্রভাবাধীন ইসলামী উপাদান সংবলিত উপমহাদেশে এবং কিছুটা হলেও তুরস্কে- ধীরে ধীরে মিশরীয়দের, তিউনিসিয়ানদের এবং অন্যান্যদের ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে সম্পূর্ণরূপে স্বীকৃত হচ্ছে।
কারণ ইসলামী বিশ্ব একটি একক বিশ্ব। আমি বলতে পারি না যে, যা মিশরীয় ঐতিহ্য তা আমার ঐতিহ্য নয়, বা যা পারস্যের তা মিশরীয়দের ঐতিহ্য নয়। আপনি এটা পুরোপুরি জানেন; আমার এটা নিয়ে আর বলার দরকার নেই।
সুতরাং, আমি মনে করি সৌভাগ্যবশত আমরা আরবদের একটি নতুন প্রজন্ম পেতে শুরু করেছি। যদিও এই আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়গুলিই মূলত প্রতিটি আরব দেশে ধনীদের সন্তানদের শিক্ষা দেয়। আবার এটাও সত্য যে, মুসলিম পরিবারগুলি তাদের সন্তানদের মিশনারি স্কুলে পাঠায়। এসব কিছু সত্ত্বেও, আসলেই তরুণ মুসলিম চিন্তাবিদদের মধ্যে একটি নতুন শ্রেণীর উত্থান ঘটেছে। তারা চিন্তাবিদ এই অর্থে যে, প্রকৃতপক্ষেই তাদের নিজস্ব ঐতিহ্যের মধ্যে গ্রোথিত একটি স্পষ্ট দার্শনিক ধারণা রয়েছে। এবং আমি এটা নিয়ে খুব, খুব আশাবাদী।
হামজা ইউসুফ: আপনি অবশ্যই এই পুনরুজ্জীবনে অবদান রাখা গুটিকয়েক কণ্ঠস্বরের মধ্যে একজন ছিলেন।
সাইয়েদ হোসাইন নাসর: আমি সামান্য কিছু অবদান রাখতে পেরেছি। বস্তুত আল্লাহই আমাকে এর জন্য প্রস্তুত করেছেন। আমি পারস্যের দার্শনিক ধারায় জন্মগ্রহণ করেছি। তারপর আমি বহু বছর পাশ্চাত্যে অধ্যয়ন করেছি, যেখানে আমার অনেক বড় বড় স্কলারের সাথে সাক্ষাত ঘটে। এরপরে পারস্যে ফিরে গিয়ে আবার অধ্যয়ন করেছি। এতে আমি ইসলামি-ফারসি দার্শনিক ঐতিহ্য এবং পাশ্চাত্যের ঐতিহ্য উভয়ে জ্ঞানই অর্জন করতে পেয়েছিলাম।
হামযা ইউসুফ: এটা আমাকে একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের দিকে নিয়ে আসলো, আপনি জানেন আমার পিতা দর্শনের একজন ছাত্র আবার একইসাথে অধ্যাপকও ছিলেন। তাই খুব অল্প বয়সেই পাশ্চাত্য দর্শন আমার সামনে উন্মুক্ত হয়ে যায়। এক্ষেত্রে আমাদের নিজস্ব দার্শনিক ধারা পুনঃসন্ধানের পাশাপাশি আপনি আমাদের তরুণ আলেমদের জন্য পাশ্চাত্য দর্শন অধ্যয়ন কতটা জরুরী মনে করেন?
আপনিতো জানেনই উভয় ধারাকে একত্রে অধ্যয়ন করাটা কতোটা দুরূহ ব্যাপার। সেই প্রাক-সক্রেটিস আমল থেকে গ্রেট হেলেনিস্টিক সময় পর্যন্ত, মধ্যযুগীয় বুদ্ধিবৃত্তিক ঘটনাপ্রবাহ এরপরে দেকার্তের আগমণ এবং হিউমের আবার সেই ধারাকে পরিত্যাগ করা, তারপরে কান্টের পাশ্চাত্য মেটাফিজিক্সের মুমূর্ষু অবস্থার বিরুদ্ধে লড়াই করে মেটাফিজিক্সকে পুনরুজ্জীবিত করার প্রচেষ্টা, পাশ্চাত্যের এই পুরো অভিযাত্রা বোঝাটা আমাদের তরুন আলেমদের জন্য কতোটা গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন?
সাইয়েদ হোসাইন নাসর: এটা খুব ভাল একটা প্রশ্ন, আমি বেশ কয়েকবার এর জবাব দিয়েছি। কিন্তু আমাকে এখানে তা আবারও বলতে হবে, কারণ পাশ্চাত্যকে আমাদের সকল দিক থেকে জানতে হবে।
আমাদের দার্শনিকদের পাশ্চাত্য দর্শন জানতে হবে, কিন্তু একজন জীবিত মানুষের মতো করে। জীবন্ত মানুষ যেমন নিজের ভিতরে যা আছে তার ভিত্তিতে বাইরের কিছু জানতে পারে, ঠিক তেমন করে।
প্রথমে একটি নির্দিষ্ট বিষয়বস্তু থাকতে হবে। এর দ্বারা আমি কী বোঝাচ্ছি? আমি বোঝাচ্ছি, সেই সকল মুসলিম যারা পাশ্চাত্যে অধ্যয়ন করছেন, তাদের পাশ্চাত্যকে অধ্যয়ন করার সময় এর মধ্যে বিলীন হওয়া যাবেনা, বরং একনিষ্ঠ মুসলিম হিসেবে সেসব অধ্যয়ন করতে হবে।
পাশ্চাত্য দর্শন অধ্যয়ন করে আমাদের এমন অনেক স্কলার আছে, কিন্তু তাদেরকে নীল তিমির মত করেই পাশ্চাত্য দর্শন গ্রাস করে ফেলেছে। তারা ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে পাশ্চাত্য দর্শনকে পড়ছেনা; বরং বস্তাপচা পাশ্চাত্য দার্শনিক হয়ে উঠছে। এরকম বহু আছে, কিন্তু আমাদের তাদেরকে দরকার নেই। আমাদের দরকার তাদেরকে, যাদের শিকড় ইসলামের দার্শনিক, মেটাফিজিক, সুফী, কালামী ধারা অর্থাৎ সামগ্রিকভাবে ইসলামের ইলমী সিলসিলায় প্রোথিত। এবং তারা এই দৃষ্টিকোণ থেকে পাশ্চাত্যকে অধ্যয়ন করবে।
আমরা তো পাশ্চাত্যকে নকল করে চলেছি। এমনকি খাবারের সময় চামচ কীভাবে হাতে রাখতে হবে, সেখানেও! কিন্তু পাশ্চাত্যের লোকজন? তারা ইসলামী দর্শনকে পাশ্চাত্য দৃষ্টিকোণ থেকেই পড়েছে যতক্ষণ না হেনরি করবিন এসে আরো ভারসাম্যপূর্ণ হবার চেষ্টা করেছেন।
পাশ্চাত্যের লেখকদের পাশ্চাত্য দর্শন, ইসলামী দর্শন, ইসলামী ধর্মতত্ত্ব, সুফীবাদ নিয়ে যত বই আছে, সব পাশ্চাত্য দৃষ্টিকোণ থেকে লেখা। তবে আমাদের এই হীনমন্যতা কেন? আমরা হলাম সেই মডার্নিস্ট যারা পাশ্চাত্যকে নকল করার চেষ্টা চালাচ্ছি, তো এই জায়গাটাতে আমরা কেন পাশ্চাত্যের অনুকরণ করিনা?
আমি নিজেও পাশ্চাত্যকে ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে পড়ার চেষ্টা করছি। এটা আমাদের তরুণ প্রজন্মকে শেখাতে হবে। এমনকি এখানেও এই ওয়াশিংটনে দীর্ঘদিনের নির্বাসিত জীবনে, ইসলামী বিশ্বে আমার অসংখ্য ছাত্র আছে। তারা আমার কাছে আসে, এবং আমি তাদেরকে এই একটি বিষয়ই শিক্ষা দেই।
আমি বলব আপনারা এখানে বড় বড় সব পাশ্চাত্য বিশ্ববিদ্যালয়ে আছেন, হ্যা! আপনাদের পাশ্চাত্যকে জানতে হবে৷ কিন্তু আপনাকে পাশ্চাত্য দৃষ্টিকোণ থেকে নয়, বরং ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে শিখতে হবে। একেবারে নিখাঁদ এবং শিকড় সমৃদ্ধ হবার চেষ্টা করুন।
যেমন আপনি, একজন চমৎকার আরবী বিশারদ। আপনি যদি ইংরেজী ভুলে যেতেন, তাহলে যাইতুনা কলেজে আপনি আর আরবীর ক্ষেত্রে কোন অবদান রাখতে পারতেন না। আপনি এখানে প্রভাবশালী কারণ আপনার ইংরেজী খুব ভালো; তারপর আপনি আরবী শিখেছেন এবং একজন আরবী ধারায় অভিজ্ঞ আলেমে পরিণত হয়েছেন। বিশেষভাবে চিন্তার মধ্য দিয়ে, কারণ চিন্তা ভাষার চেয়ে আরো বেশি গুরুত্ববহ।
হামযা ইউসুফ: ঠিক।
সাইয়েদ হোসাইন নাসর: চিন্তার সাথে সাথে আপনার সেই চিন্তার প্রেক্ষাপট (matrix) জানা থাকতে হবে। পাশ্চাত্যকে পাশ্চাত্যেরই দৃষ্টিকোণ থেকে জানার চেষ্টা করা তো নিজেই একধরণের সাংস্কৃতিক মৃত্যুর মত। ঔপনিবেশিক সময়ে মুসলিমদের এই অবস্থা হয়েছিল, হিন্দু, আফ্রিকান সহ সমগ্র অ-পশ্চিমী জনগণের এই হাল হয়েছিল। কিন্তু পাশ্চাত্যেই এ বিষয়গুলোতে ভাঙ্গন ধরতে থাকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগ দিয়ে। যখন তারা সভ্যতার সর্বোচ্চ চূড়ায় অবস্থান করছিল এবং নিজেদের মহান এক সভ্যতা বলে ভাবত।
আলহামদুলিল্লাহ, আমাদের ইসলামী সভ্যতা মৃত্যুবরণ করেনি। এর অনেক কিছু দুর্বল হয়ে গিয়েছে, অস্থিসার হয়েছে, কোন কোন যায়গায় বিস্মৃত হতে গেছে। কিন্তু কখনোই মারা যায়নি। ইনশাআল্লাহ অচিরেই বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে আমরা ইসলামী সভ্যতারর পুনর্জাগরণের সাক্ষী হতে যাচ্ছি।
হামযা ইউসুফ: ইনশা আল্লাহ। আপনি জানেন, এটা যাইতুনার লক্ষ্য উদ্দেশ্যের আওতায় পড়ে; দুটো সভ্যতাকেই বোঝার চেষ্টা করা। আমরা চাই আমাদের ছাত্ররা মুসলিম বিশ্বদর্শনের দৃষ্টিকোণ দিয়ে পাশ্চাত্য সভ্যতাকে পরখ করুক।
সাইয়েদ হোসাইন নাসর: ঠিক তাই।
হামযা ইউসুফ: কিন্তু প্রায়শই আমি যেটা ঘটতে দেখি তা হলো, আমরা আমাদের নিজেদের ধারায় গভীরভাবে প্রোথিত না থাকার কারণে পাশ্চাত্য চিন্তা এক ধরণের মোহের মত কাজ করে। আমার কাছে এর একটা ভাল উদাহরণ আছে। যেমন কালাম, দার্শনিক কালাম এসবকে এনালিটিক্যাল ফিলোসফির দৃষ্টিকোণ থেকে পুনর্বিন্যাসের চেষ্টা করা। এটা হচ্ছে কারণ পাশ্চাত্যের বিভিন্ন ফাউন্ডেশন এসব গবেষণায় ফান্ড দিচ্ছে, আবার পাশ্চাত্যের অধিকাংশ দার্শনিকই এনালিটিক। কিন্তু আমার আশংকা হচ্ছে যে, এটা তো আমাদের জন্য রীতিমতো মৃত্যুফাঁদ।
সাইয়েদ হোসাইন নাসর: অবশ্যই, তারা ভ্রান্ত বিষয়গুলোতেই টাকা ঢালছে। আপনারা যদি ওসব করেন, তাহলে আমাদের যাওয়ার কোন জায়গা থাকবেনা। আমাদের এখন প্রয়োজন হলো আমাদের নিজেদের শিক্ষাব্যবস্থাকে শক্তিশালী করা। ইসলামী বিশ্বে অথবা যাইতুনার মত যায়গায়; কিংবা আমাদের নিজস্ব ঐতিহ্য, ভাষা, ইতিহাস, চিন্তা, এবং অবশ্যই ধর্মকে উপজীব্য করে চলা বিশ্বের যোকন প্রান্তে অবস্থিত ইসলামী প্রতিষ্ঠানগুলোতে।
বিশেষভাবে যারা বুদ্ধিবৃত্তিক বিষয়াবলিতে মনযোগী হয়েছেন, ইসলামী চিন্তা, বৃহৎ পরিসরে ইসলামী দর্শন ইত্যাদির মধ্যে, তাদের অবশ্যই জানতে হবে, ইবনে সিনা বেঁচে থাকলে ডেভিড হিউমের ব্যাপারে কী বলতেন?
মানুষ লিখেছে হিউম ইমাম গাযালী থেকে ধার করেছে কারণ সে গাযালীর মত হুবহু ‘আগুনের মাঝে তুলার’ উদাহরণ ব্যবহার করেছে। এটা কোনভাবে দুর্ঘটনাক্রমে তো হতে পারেনা। আমারও মত এটিই৷ পাশ্চাত্যের উপরে ইসলামী চিন্তার এই অপরিসীম প্রভাব সম্পর্কে আমাদের জানতে হবে। কিন্তু শুধুমাত্র পাশ্চাত্য দর্শন খুঁজে চলাতো নিজেই এক ধরণের ধ্বংসাত্মক ব্যাপার।
আমাদের এটা জানতে হবে, কিন্তু এটাও জানতে হবে যে এটা অনুকরণ করার মত কিছু না। এটা বোঝার মত বিষয়, এর সঙ্গে কিছু পরিভাষা জড়িত, এটা সমালোচনা করার মত বিষয়, এটা ভয় পাবার মত কিছুনা। যদি এতে কিছু শেখার থাকে, শিখুন! আলহামদুলিল্লাহ ভালো!
যেমন ধরুন, এনালিটিক্যাল ফিলোসফি একটা উদ্ভট ব্যাপার। কিন্তু এর একটা দিক রয়েছে যা ইসলামী দর্শনের সাথে খুব মিলে যায়। আমি যখন পারস্যে মহান উস্তাদদের সোহবতে ঐতিহ্যবাহী ইসলামী দর্শন অধ্যয়ন করছিলাম, সেখানে প্রথম বিষয়ই ছিল পরিভাষা সমূহের সংজ্ঞা নিয়ে পরিষ্কার ধারণা রাখা। যেখানে আধুনিক পাশ্চাত্য দর্শনে পরিভাষাগুলো অত্যন্ত অস্পষ্ট। সুতরাং ঐ দৃষ্টিকোণ থেকে এনালিটিক্যাল ফিলোসফি আমরা যা নিয়ে বলছিলাম ঠিক তাই, কিন্তু এর শেষটা হয় অন্যরকম। কারন এনালিটিক্যাল ফিলোসফি হচ্ছে মেটাফিজিক্স বিরুদ্ধ একটা জিনিস। কিন্তু মোল্লা সাদরা, সোহরাওয়ার্দী বা ওনাদের মত যে কাউকে পড়লেই আপনি পরিশেষে আল্লাহকে জানতে সক্ষম হবেন।
হামযা ইউসুফ: ঠিক।
সাইয়েদ হোসাইন নাসর: এখানে বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার সকল সহকর্মী এনালিটিক্যাল ফিলোসফার। আমি ভাষার সুস্পষ্টতার কথা বলেছি৷ আমি এমন ধারা থেকে এসছি যেটা দর্শন শুরুই করে এমন সংজ্ঞায়ন দিয়ে যেগুলো সবসময়ই অনেক সুনির্দিষ্ট।
ইসলামী দর্শন হচ্ছে আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের মত, আধুনিক দর্শন বা পাশ্চাত্য দর্শনের মত নয়৷ আপনি যখন এটমিক ফিজিক্সে প্রোটনের কথা বলেন, তখন এর নির্দিষ্ট একটা সংজ্ঞা আছে৷ ইসলামী দর্শনেও আপনি যখন জাওহার, আ’রায, হারাকাহ যাই বলেন না কেন, এর একটা সুনির্দিষ্ট অর্থবহতা রয়েছে। যদিও আপনারা হয়ত ‘ইল্লত’ কে ইংরেজীতে “cause” হিসেবে অনুবাদ করেন। এটা একটা অস্পষ্ট অর্থ দিচ্ছে কিন্ত আরবীতে কিন্তু এটা ব্যাপক সুস্পষ্ট৷
আমি যখন ঐতিহ্যবাহী দর্শন অধ্যয়ন করছিলাম, তখন উস্তাদ আমাদের বলতেন শব্দের অর্থ, পরিভাষা এবং অভিব্যক্তি জানার জন্য আমরা যেন অবশ্যই আহলুল ইসতিলাহ (যেসকল বিশেষজ্ঞ পরিভাষা সমূহের সংজ্ঞা দিয়ে থাকেন) এর স্মরণাপন্ন হই। এরপরে আপনি ইসলামী দর্শন শিখতে পারবেন।
হামযা ইউসুফ: ঠিক।
সাইয়েদ হোসাইন নাসর: সুতরাং আমাদের এজন্য ছাত্রদের এটা বলতে হবেনা যে আহলুল ইসতিলাহগণ সঠিক কারণ লন্ডনের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কিছু দার্শনিক এটাকে সঠিক বলছেন। আমি এর বিরুদ্ধে। ঐ হীনমন্যতা এখনও আমাদের ইসলামী দুনিয়ায় রয়ে গিয়েছে যার উপর ভিত্তি করে পারস্যে গ্যেটে অনূদিত হয়েছিলেন এবং বিখ্যাত হয়ে গিয়েছিলেন।
মুসলমানরা আজ কেন বলছে গ্যেটে মহান ছিলেন? কারণ তিনি জার্মান ভাষায় লেখায় জার্মানরাই বলেছে যে গ্যেটে মহান ছিলেন, এজন্য। এখন এই ধরণের বাকবিতন্ডা আমরা ইসলামী দুনিয়ায় হরহামেশাই করে থাকি। আমরা আরবে যথেষ্ট সফর করে দেখেছি এবং বাকি ইসলামী জগতেরও একই অবস্থা। আমাদের এখান থেকে উত্তরণ করতে হবে। আমাদের অবশ্যই আত্মবিশ্বাস থাকতে হবে।
হামযা ইউসুফ: হ্যাঁ।
সাইয়েদ হোসাইন নাসর: আমি ইতোমধ্যেই আমার সময়ের শেষ প্রান্তে চলে এসেছি। আমি সত্যিকারার্থেই আপনার জন্য দোয়া করতে চাই এবং যাইতুনাতে আপনি যা করে চলেছেন তার প্রশংসা করতে চাই। এটা এই দেশে (আমেরিকায়) খুব খুব গুরুত্বপূর্ন একটা প্রচেষ্টা এবং ইতোমধ্যেই এর কিছু সাফল্যও রয়েছে। নির্ভিক থাকার চেষ্টা করুন, আরো ঐতিহ্যমুখী হয়ে উঠুন এবং বেশি বিক্ষিপ্ত হবেন না।
টীকাঃ
১. রেস এক্সটেন্সা এবং রেস কগিটান্স পশ্চিমা দার্শনিক দেকার্তের বিখ্যাত দুটি পরিভাষা। দেকার্তের মূল সৃষ্টি, ‘ডিসকোর্স অন মেথডে তিনি এই পরিভাষা দুটি উল্লেখ করেছেন। রেস এক্সটেনসা বলতে মূলত বর্ধিত বিষয়, বহির্গত অস্তিত্ব বা বাহ্যিক কাঠামো বুঝায়। পক্ষান্তরে রেস কগিটান্স বলতে চিন্তাগত বিষয়, বা অভ্যন্তরীণ/আত্মিক বিষয়ের দিকে ইঙ্গিত করে।
অনুবাদঃ হিশাম আল নোমান।