একটি সভ্যতার জন্য সেই সভ্যতার জ্ঞানের ইতিহাস অনেক বেশী গুরুত্ত্বপূর্ণ। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আমাদের ইসলামের ইতিহাসকে জ্ঞানের উপরে ভিত্তি করে নয় বরং যুদ্ধ ও রাজনীতিকে কেন্দ্র করে রচনা করা হয়েছে। প্রতিটি জ্ঞানের আলাদা আলাদা ইতিহাস থাকতে পারে তবে সামগ্রিকভাবে জ্ঞান ও সংস্কৃতির ইতিহাসের উপর ভিত্তি করে ইতিহাস রচিত হয়নি। আপনারা জানেন ইবনে সা’দ এর ‘তাবাকাত’ অন্যান্য মাগাযী ও সীরাত গ্রন্থ থেকে ভিন্ন। ইবনে সা’দ এর ‘তাবাকাত’ ইসলামের ইতিহাসকে, জ্ঞান ও আলেমদেরকে কেন্দ্র করে রচিত হয়েছে। তাবাকাতের মতো গ্রন্থাবলী আধুনিক সময়ে এসেও রচিত হয়নি। ইসলামী সভ্যতার কেন্দ্র সমূহে গড়ে ওঠা জ্ঞানের ধারা গুলোকে প্রাধান্য দিয়ে তুলনামূলক আলোচনা সম্বলিত কোনো গ্রন্থ নেই।

একই সময়ে কোন কোন ধারা গড়ে উঠেছিল, তাদের মধ্যে কোন কোন বিষয়ে মিল ছিল, কোন কোন বিষয়ে পার্থক্য ছিল সেগুলোকে বর্ণনাকারী গ্রন্থও খুঁজে পাওয়া যায় না। যেমন; হিজাজ, বিলাদী শাম, ইরাক, খোরাসান, মাওয়ারাউন নাহার, ভারতীয় উপমহাদেশ, দক্ষিণপূর্ব এশিয়া (এশিয়া প্যাসিফিক), উত্তর আফ্রিকা এবং এই সকল এলাকার প্রভাবিত অঞ্চলসমূহে একই সময়ে কোন ধরণের চিন্তাগত বিতর্ক  হতো? কোন ধরণের জ্ঞানগত বিতর্ক সংগঠিত হয়েছে? কোন ধরণের উসূলের সন্ধান করা হয়েছে? এগুলোর উপর ভিত্তি করে তুলনামূলক কোনো কাজ আমাদের হাতে নেই। আর থাকলেও যা আছে, তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই নগণ্য।

যেমন, অন্যান্য মুসলিম অঞ্চল থেকে স্বতন্ত্রভাবে ভারতীয় উপমহাদেশে কোন কোন ধারা গড়ে উঠেছে? অন্যান্য মুসলিম অঞ্চল থেকে এদের মধ্যে পার্থক্য কী? মাওয়ারাউন নাহারের ধারা সমূহ এবং উত্তর আফ্রিকার ধারা সমূহের মাঝে কোন কোন বিষয়ে মিল আছে এবং কোন কোন ক্ষেত্রে পার্থক্য রয়েছে? এখানে প্রাচীন আন্দালুসিয়ার কোনো প্রভাব আছে কিনা? কারণ ভারতীয় উপমহাদেশ এই দৃষ্টিকোণ থেকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানগণ অনেক অঞ্চলে ইসলামী ধারা প্রতিষ্ঠা করেছে। যেমন, দক্ষিণ আফ্রিকা। এখানে মূলত ভারতীয় মুসলমানগণ ইসলামী সংস্কৃতিকে গড়ে তুলেছে। সিঙ্গাপুর ও এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে ইসলামের যে ধারা, এই ধারা মূলত গড়ে তুলেছে ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানগণ। শুধু তাই নয় বর্তমান লন্ডন বা ইংল্যান্ডে যে ইসলামী জীবন ধারা রয়েছে তা মূলত ভারতীয় উপমহাদেশেরই ধারা। আমি সাধারণত ফ্রান্স, জার্মানি ও ইংল্যান্ডের মধ্যে তুলনা করে থাকি।

ফ্রান্সের মুসলিম সংখ্যালঘুগণ বেশিরভাগ আলজেরিয়া ও তিউনিসিয়া তথা উত্তর আফ্রিকা থেকে আগত। ফলশ্রুতিতে তারা ফ্রান্সে উত্তর-আফ্রিকার ইসলামী ধারা প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেছেন।

ইংল্যান্ডে বসবাসকারী মুসলমানদের অধিকাংশই হলো ভারত, পাকিস্তান কিংবা বাংলাদেশ থেকে আগত কিংবা বংশোদ্ভূত। আপনারা যদি লন্ডনের কোনো মসজিদে ঢুকেন তাহলে লন্ডনের কোনো মসজিদে নয়; বরং ভারতীয় উপমহাদেশের কোনো মসজিদে প্রবেশকারী হবেন। লন্ডনের সবচেয়ে ভালো মসজিদটি বাংলাদেশীদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত। সেই মসজিদে যদি প্রবেশ করেন তাহলে লন্ডনের মসজিদে নয়, যেন বাংলাদেশের কোনো মসজিদে প্রবেশ করেছেন- এরকমই মনে হবে।

তাই ভারতীয় উপমহাদেশ অনেক গুরুত্বপূর্ণ। ভারতীয় উপমহাদেশের প্রতিষ্ঠিত ইসলামী ধারাটি মিশ্রিত একটি ধারা, যাতে আছে তাসাউফ, আখলাক, ফিকহ, কালাম এবং হাদীস। পরবর্তীতে আবার এগুলোর মধ্য থেকে অনেকে পৃথকও হয়েছেন। সাইয়্যেদ আহমাদ খান এবং তার মডার্নিস্ট ধারারও অনেকে রয়েছেন।

ভারতীয় উপমহাদেশে অনেক বড় বড় মুতাফাক্কির ও বিজ্ঞ আলেমের জন্ম হয়েছে। তবে বিগত দুইশত বছরের দিকে যদি তাকাই তাহলে অষ্টাদশ শতাব্দীর শাহ্ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভী ছিলেন একাই একটি মক্তব, একটি স্কুল অফ থট, বড় একটি ধারা। যদি কোনো আলেমের উসূল থাকে তাহলে তিনি একটি ধারায় পরিণত হন। যদি উসূল না থাকে তাহলে তিনি কবি, লেখক, চিন্তাবিদ হতে পারেন, তবে কোনো ধারা হতে পারেন না। শাহ ওয়ালীউল্লাহ দেহলভীকে যে বিষয়টি একটি ধারায় পরিণত করেছিল সেটি হলো, তিনি সত্যিকারের একজন উসূল সন্ধানী ছিলেন।

প্রথমে আমি তার জীবনীকে সংক্ষিপ্তভাবে তুলে ধরে অতঃপর তার উসূল নিয়ে আলোচনা করতে চাই। কারণ, তিনি তাঁর উসূলের বড় একটি অংশ তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা’ তে আলোচনা করেছেন। তাঁর উসূল ও অন্যান্য চিন্তাকে তাঁর অন্যান্য কিতাবেও খুঁজে পাওয়া সম্ভব। তিনি বহুমাত্রিক আলেম ছিলেন। কোনো একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে নয়; বরং অনেক বিষয়েই তিনি দক্ষ ছিলেন। যদি কেউ এক ধরণের বা এক ধারার পড়াশুনা করে তাহলে সে উসূলবিদ হতে পারে না। উসূলবিদগণ বিভিন্ন বিষয়ে গভীরভাবে অধ্যয়ন করেন।

শাহ ওয়ালিউল্লাহ, বিখ্যাত আলেম আহমাদ বিন আব্দুর রহিম এর সন্তান হিসেবে দুনিয়ায় আসেন। পিতা আলেম হওয়ার কারণে একটি আলেম পরিবারে তিনি লালিত পালিত হন। তাঁর পিতা ‘ফতোয়ায়ে আলমগীরি’ রচনায় অংশগ্রহণকারী একজন আলেম। একইসাথে তিনি অনেক বড় একজন ফকীহ ছিলেন।

আমাদের সভ্যতায় নিজের জীবনী নিজে লিখেছেন এমন আলেম খুবই কম। আলেমগণ সাধারণত তাদের নিজেদের জীবনী লেখেন না। শাহ ওয়ালিউল্লাহ তাঁর নিজের জীবন নিয়ে একটি সংক্ষিপ্ত রিসালা লিখেছেন “আল জুম’উ লাতিফ ফি তারজুমাতি আব্দি দায়িফ”। এই বইয়ে তিনি তাঁর নিজের জীবনী লেখেন।

“৫ বছর বয়সে আমাকে মক্তবে পাঠানো হয়, ৭ বছর বয়সে আমি হাফেজ হই, আট বছর বয়সে ফার্সী শিখি , এরপর আরবী ভাষা শেখা শুরু করি, ১৪ বছর বয়সে বিয়ে করি এরপর বাবার কাছে বাইয়াত গ্রহণ করি।” বাবার কাছে বাইয়াত গ্রহণ করার মানে হলো, তার বাবা নকশীবন্দি তরীকার অনেক বড় একজন শায়েখ ছিলেন। ফলশ্রুতিতে তিনি এক সুফি পরিবারে ছিলেন এটা তিনি বুঝাচ্ছেন।

শাহ ওয়ালীউল্লাহ দেহলভীর উপর আরবী ভাষায় বিশেষ করে সৌদিপন্থী আলেমদের লেখা জীবনী যদি পড়েন তাহলে দেখতে পাবেন যে, তাকে সালাফী হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। এটা ভুল, এরকম করা মোটেও সঠিক নয়। মক্কা ও মদিনায় যাওয়া এবং সেখানে পড়াশুনা করা, হাদীস শিক্ষা করা ও হাদীসের প্রতি আলাদা গুরুত্ব দেয়া বিশেষত ইলমূল হাদীসকে ভারতীয় উপমহাদেশে বইয়ে নিয়ে আসা, বিদয়াতের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা এইগুলোকে দলীল হিসেবে দেখিয়ে তাকে অনেকেই সালাফী প্রমাণ করতে চান। কিন্তু তিনি মোটেও সালাফী নন।

শাহ ওয়ালিউল্লাহর বয়স যখন ১৭ বছর তখন তার পিতা ইন্তেকাল করেন। সেই সময় পর্যন্ত কাজী বায়যাভী, তালবিহ, শরহে বেকায়া, হিদায়ার মত গ্রন্থসমূহকে তিনি  কখন, কীভাবে পড়েন সেগুলো নিয়েও আলোচনা করেছেন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো তার পিতার একটি মাদরাসা ছিল। নাম ‘রাহিমিয়া মাদরাসা’। আমার কাছে নামটি খুব পছন্দ হয়েছে। এই ‘রাহিমিয়া মাদ্রাসায়’ তিনি অধ্যয়ন করেন। পিতার মৃত্যুর পরও তিনি কিছুকাল এই মাদরাসায় পড়াশুনা করেন। ২৮/২৯ বছর বয়সে পৌঁছালে জ্ঞানের জন্য সফরে বের হন এবং হিজাজে যান।

আপনারা জানেন, আলেমগণের মিলনমেলায় হজ্জ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত। হজ্জ আজকে এই বিশেষত্বকে হারিয়ে ফেলেছে। হজ্জ এবং উমরা উভয়টি বর্তমানে এই বৈশিষ্ট্যকে হারিয়ে ফেলেছে। ঐ সময়ে আলেমগণ সমবেত হলে একজন অবশ্যই আরেকজনের কাছ থেকে কোনো না কোনো কিতাব পড়তেন এবং ঐ কিতাবের ইজাজত গ্রহণ করতেন। যার কারণে মাওয়ারাউন নাহার থেকে আগত একজন শিক্ষক মিসর থেকে আগত একজন আলেমের শিক্ষক হতেন আবার মিসর থেকে আগত একজন আলেম ইরাক থেকে আগত একজন আলেমের উস্তাজ হতেন। এটি অসাধারণ একটি ঐতিহ্য।

শাহ ওয়ালীউল্লাহ দেহলভী সৌদি আরবে যান এবং সেখানে দুই বছরের চেয়ে বেশি সময় অবস্থান করেন। সেখানে যে সকল আলেমদের সাথে সাক্ষাৎ করেন তাদের সকলের নাম উল্লেখ করেছেন এবং কার কাছ থেকে কী কিতাব পড়েছেন সেগুলোও উল্লেখ করেছেন। এখানে অবস্থানকালে তিনি বেশিরভাগ সময়ই হাদীস অধ্যয়ন করেন। হাদীসের পাশাপাশি অন্যান্য গ্রন্থও অধ্যয়ন করেন।

ইলমুল হাদীসের ক্ষেত্রে ‘মুয়াত্তা’র সাথে পরিচিত হওয়ার পর তিনি ভিন্নধর্মী একটি চিন্তায় নিবিষ্ট হন। তিনি ঐ সময়ে বুখারীও পড়েছেন আবার মুয়াত্তাও পড়েছেন। তবে ‘আসাহহুল কিতাবি বা’দা কিতাবিল্লাহ’ (আল্লাহর কিতাবের পর সবচেয়ে বিশুদ্ধ কিতাব) নামক কথাটি বুখারীর ক্ষেত্রে নয় মুয়াত্তার ক্ষেত্রে ব্যবহার করেন। হাদীস গ্রন্থসমূহকে সিরিয়াল করার ক্ষেত্রে এক নম্বরে তিনি মুয়াত্তাকে স্থান দেন। তিনি একজন হানাফী হওয়ার পরেও মুয়াত্তাকে অনেক বেশি গুরুত্ব দেন। যদিও তাঁর সম্পর্কে বলা হয়ে থাকে যে, “হানাফিয়্যুন আমালান, শাফিয়িয়্যুন তাদরিসান”। শাফেয়ী ফিকহের উপর অনেক বেশি পড়াশুনা করলেও আমলগত দিক থেকে হানাফী হিসেবে আমরা তাকে চিনি।

তিনি মুয়াত্তার দুটি ব্যাখ্যা রচনা করেন একটি ফার্সী ভাষায় অপরটি আরবী ভাষায়। একটির নাম হলো ‘আল-মাসওয়া’ অপরটির নাম ‘আল-মুসাফফা ফি শারহিল মুয়াত্তা’। আমি ফার্সি ভাষায় লিখিত ব্যাখ্যাটি পড়িনি। তবে আরবী ভাষায় লিখিত ব্যাখ্যাটি পড়েছি। আমি নিজেও ব্যক্তিগতভাবে আমার হাদীস অধ্যয়ন ‘মুয়াত্তা’কে ভিত্তি করে পড়েছি। শুধু আমিই নই, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করার সময়েও আমাদের শিক্ষার্থীদের ‘মুয়াত্তা’কে বেইজ করে অধ্যয়ন করতে বলতাম। কারণ ‘মুয়াত্তা’ শুধুমাত্র একটি হাদীস গ্রন্থই নয়, একইসাথে মদীনার ‘মেমোরি’। ইমাম মালিক রাসূল (সা.) ও সাহাবীগণের বসবাসকৃত মদীনাকে সংরক্ষণ করেছেন। আমি যখন দিয়ানাত এর প্রেসিডেন্ট ছিলাম, তখন দিয়ানাতের অধীনে যে সকল দারস-হালকা হতো সেগুলোকে আমি মুয়াত্তা কেন্দ্রিক করার চেষ্টা করেছিলাম এবং সেই অনুযায়ী দারস প্রোগ্রামও সাজিয়ে দিয়েছিলাম। আমি এটা করেছিলাম মূলত শাহ ওয়ালীউল্লাহ দেহলভীর দ্বারা প্রভাবিত হয়ে। পরবর্তীতে আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলা হয় যে, আমি সিহাহ সিত্তার বিরোধী। আমাকে এই অপবাদ দিয়ে পরবর্তীতে সেই দারস প্রোগ্রামকে পরিবর্তন করা হয়। সেটা আর জারি থাকেনি। কারণ মুয়াত্তা কেন্দ্রিক হাদীস শিক্ষাকে জারী রাখতে হলে জ্ঞানের প্রয়োজন। শুধুমাত্র রেওয়ায়েতের জ্ঞান মুয়াত্তা পড়ার জন্য যথেষ্ট নয়। অর্থাৎ মুয়াত্তার হাদীস অধ্যয়ন করার জন্য শক্তিশালী একটি উসূলের প্রয়োজন।

পরবর্তীতে তিনি মক্কা ও মদীনা থেকে ভারতে ফিরে আসলে প্রথমে হাদীসের হালকা গড়ে তুলেন এবং সেখানে প্রথমে মুয়াত্তা পড়াতেন। ঐ সকল দারস-হালকাতেই তিনি মূলত মুয়াত্তাকে ব্যাখ্যা করেন।

এখানে তিনি আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেন। ভারতীয় উপমহাদেশে ঐতিহ্যবাহী ধারা অনেক শক্তিশালী। তারা ঐতিহ্যকে অনেক বেশি প্রাধান্য দিয়ে থাকে। ফিকহের কিতাবসমূহকে এমনভাবে পড়েন যেন এগুলো অপরিবর্তনীয় নস! এ কারণে হাদীস ও ফিকহের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে ফিকহুল হাদীস নামে নতুন একটি কাজ শুরু করেন। হানাফী ধারার সাথে হাদীসকে সম্পৃক্ত করার কিংবা হাদীসের সাথে সংযোজন ঘটানোর চেষ্টা করেন। এই কারণে মুয়াত্তাকে হাদীস শাস্ত্রের কেন্দ্রে স্থাপন করার পর সবচেয়ে বড় যে কাজটি করেন সেটি হলো, ফিকহ ও হাদীসকে একত্রিত করে নতুনভাবে কাজ শুরু করেন।

একইভাবে যে সকল বিষয়ে তিনি সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেন তার মধ্যে একটি হলো, ইজতিহাদ ও তাকলীদ । এর মাধ্যমে তিনি জ্ঞানের ক্ষেত্রে ধীরে ধীরে ইহ্ইয়া ও তাজদীদের আন্দোলন শুরু করেন।

হাদীসের সাথে ফিকহ, তাসাউফের সাথে শরিয়ত, আকল ও নাকলকে মিশ্রিত করার প্রচেষ্টা শাহ ওয়ালিউল্লাহর সকল গ্রন্থে দেখতে পাওয়া যায়। এগুলোর সাথে সাথে ইজতিহাদ ও তাকলীদ নিয়েও অনেক আলোচনা করেছেন। ইমাম শাহ ওয়ালিউল্লাহর অন্যতম বড় একটি কাজ হলো, তিনি মাদরাসা শিক্ষার পাঠ্যক্রমের মধ্যে ইতিহাস ও হিকমাহর (দর্শন) দারসকে সংযুক্ত করে দেন।

ইমাম শাহ ওয়ালীউল্লাহর ‘হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা’র পরে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ হলো,
عقد الجيد في أحكام الاجتهاد والتقليد
এই গ্রন্থে তিনি ইজতিহাদ ও তাকলীদ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন।

অপরটি হলো ‘আল-ইনসাফ ফি আসবাবিল ইখতিলাফ’। উস্তাজ আব্দুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ এই গ্রন্থের তাহকীক করেছেন। তার এই তাহকীক বইটিকে আরও অনেক বেশি সৌন্দর্যমণ্ডিত করেছে।

ইমাম শাহ ওয়ালীউল্লাহ দেহলভীর লেখা-

১। হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা
২। عقد الجيد في أحكام الاجتهاد والتقليد
৩। আল ইনসাফ ফি আসবাবিল ইখতিলাফ

বই তিনটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই বই তিনটির প্রতিটি লাইনকেই খুব সতর্কতার সাথে চিন্তা করে অধ্যয়ন করা প্রয়োজন।

আমি পূর্বেও উল্লেখ করেছি যে, ইমাম শাহ ওয়ালীউল্লাহর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ হলো ‘হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা’। এই গ্রন্থে তিনি তাঁর উসূল বর্ণনা করেছেন। আপনারা জানেন যে, ‘হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা’ শব্দদ্বয় একটি আয়াত থেকে নেয়া হয়েছে।

এটি এমন একটি গ্রন্থ যার পূর্বে এমন আর কোনো গ্রন্থ রচিত হয়নি। এই গ্রন্থটি সকল কিছুর মধ্যে সমন্বয় ও সংযোজন ঘটায়। প্রথমত, আকল ও নাকলের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে। দ্বিতীয়ত, তাসাউফ ও শরীয়তের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে। তৃতীয়ত, উসূল এবং আখলাককে মিশ্রিত করে তুলে ধরে। আমি মনে করি এই বিষয়গুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

 হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগার কিছু বৈশিষ্ট্য

 

১/ জ্ঞানকে তিনি ‘শরীয়তী জ্ঞান’ ও ‘মাসলাহাতী জ্ঞান’ নামে দুই ভাগে ভাগ করেন এবং তিনি মাসলাহাতকে আহকামের মূল হিসেবে গ্রহণ করেন। তিনি বলেন, আহকামে শরীয়া শুধুমাত্র ইখতিবারের জন্য নয়। অর্থাৎ, হুকুমসমূহ কেবলমাত্র কৃতকার্যদেরকে জান্নাতে এবং অকৃতকার্যদেরকে জাহান্নামে পাঠানোর জন্য আসেনি। প্রতিটি হুকুমেরই একটি ‘ইল্লত’ রয়েছে আর সেই ইল্লত হলো ‘মাসলাহাত’। শাহ ওয়ালীউল্লাহর মতে, হুকুমের উদ্দেশ্য হলো- মাসলাহতের প্রতিষ্ঠা ও মাফসাদাতের অপসারণ।

হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগার কিছু কিছু অধ্যায়ে আকলের উপর জোর দেওয়ার কারণে তাকে ‘মু’তাযিলা’ অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়। অথচ তিনি এই গ্রন্থেরই এক স্থানে বলেছেন, আকল হালাল ও হারামকে নির্ণয় করতে পারবে না এবং হুসুন ও কুবুহকে নির্ণয় করতে হলে ওহীর প্রয়োজন। এই কথা বলার পরও আকলের উপর অনেক বেশি গুরুত্ব প্রদান তাকে মু’তাযিলা বলে অভিযুক্ত করার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আকলের উপর জোর দানকারী সকল আলেমদেরকে অভিযুক্ত করার পাশাপাশি শাহ ওয়ালীউল্লাহ দেহলভীকেও এই অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়।

২/ ইমাম শাহ ওয়ালীউল্লাহ দেহলভী তার হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাকে দুই ভাগে বিভক্ত করেন।

ক) القواعد الكلية التي تنتظم بها المصالح المرئية في الشرائع।

এই অধ্যায়ে তিনি ইমাম গাজালীর ‘ইহইয়া উলূমুদ্দীন’ এর মধ্যে উল্লেখ করেছেন, এমন কয়েকটি বিষয়কে উসূলের মধ্যে সন্নিবেশিত করে উল্লেখ করেন। যেমন, أسرار الشرائع- অর্থাৎ শরীয়তের অন্তর্নিহিত অর্থসমূহকে দুটি মূলনীতির উপর দাঁড় করান। একটি হলো, مبحث البر و الاثم অর্থাৎ কল্যাণ ও অকল্যাণ বিষয়ক অধ্যায়। খুব ভালোভাবে লক্ষ্য করুন এটি উসূলের একটি গ্রন্থ। এমন একটি গ্রন্থে مبحث البر و الاثم নামক একটি শিরোনাম রয়েছে। অপর একটি অধ্যায়ের নাম হলো, مَبْحَث السِّياسات المِلِّيَّة অর্থাৎ জাতীয় রাজনীতির অধ্যায়। এখানে মিল্লাত শব্দটি তিনি উম্মত অর্থে ব্যবহার করেছেন।

ইসলামী সাহিত্যে তিনি নতুন একটি পরিভাষা যুক্ত করেন সেটা হলো الارتفقات ‘ (আল-ইরতিফাকাত)। এ পরিভাষাটি আরব ভাইগণও ভারত থেকে শিখেছেন। ‘الارتفقات ’ কে الإنتفعات العامة (সর্বসাধারণের জন্য সুবিধা, Public Benefit) হিসেবে অনুবাদ করা হয়। তবে এর সামগ্রিকতার দিকে তাকালে দেখা যায় যে তিনি ‘الارتفقات ’ দ্বারা সমগ্র মানবতার কল্যাণকে বুঝিয়েছেন। ‘الارتفقات ’ নামক পরিভাষাকে তিনি মাকাসিদের মধ্যে স্থাপন করেন।

অন্য আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পরিভাষা শাহ ওয়ালীউল্লাহ ব্যবহার করেছেন। সেটা হলো, تدبير منزل । এই পরিভাষাটিকে সর্বপ্রথম আল ফারাবী ব্যবহার করেন। কিন্তু শাহ ওয়ালীউল্লাহ تدبير منزل কে ‘الارتفقات ’এর মধ্যে স্থাপন করে উসূলের মধ্যে সন্নিবেশ করার চেষ্টা করেন।

খ) في بيان ما جاء عن النبي صلى الله عليه وسلم تفصيلا এই অধ্যায়ে তিনি রিসালাত নামক পরিভাষাকে কোরআন ও সুন্নতকে একত্রিতকারী একটি দলীল হিসেবে বিশ্লেষণ করেন। এই কারণে তিনি সুন্নতকে দুই ভাগে বিভক্ত করেন। একটি হলো রিসালাতের অংশ হিসেবে সুন্নত, অপরটি হলো অন্যান্য সুন্নত। এই রিসালাতের অংশ হিসেবে পরিগণিত হওয়া সুন্নতের সাথে অন্যান্য সুন্নতকে তিনি আলাদা করেন এবং তিনি বলেন, যে সুন্নতটি রিসালাতের অংশ সে সুন্নতকে কিয়ামত পর্যন্ত মুসলমানদের অনুসরণ করতে হবে

এই গ্রন্থে গুরুত্বপূর্ণ একটি বাক্য রয়েছে যেটি নিয়ে আমাদের চিন্তা-ভাবনা করা প্রয়োজন। সেই বাক্যটি হলো “আমাদের ফিকহ রূহবিহীন একটি শরীরের মতো আমাদের মধ্যে তার অস্তিত্বকে রক্ষা করে চলেছে এবং ফিকহের রূহ হলো আহকামের আসরারসমূহ”। অর্থাৎ ইবাদতের উদ্দেশ্য হলো ফিকহের রূহ। নামাজের হিকমত, রোজার হিকমত বা আসরারসমূহকে হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগার মতো একটি উসূলের গ্রন্থে আমরা দেখতে পাই। তিনি আরও বলেন ‘ফিকহের সবচেয়ে বড় রূহ হলো ইজতিহাদ’। ফিকহ যখন ইজতিহাদকে হারিয়ে ফেলে তখন তা রূহবিহীন একটি শরীরের মতো হয়ে যায়।

৩। এই গ্রন্থে তিনি জ্ঞানকে নিম্নোক্তভাবে বিন্যাস করেন :

ক) ইলমুল হাদীস
খ) ইলমুল লুগাত
গ) ইলমুল ইসতিনবাত
ঘ) ইলমুল ইসতিদলাল
ঙ) ইলমুল আসরার

ইলমুল আসরার নামক অধ্যায়ে শরীয়তের সাথে তাসাউফ এবং উসূলের সাথে আখলাককে একত্রিত করার চেষ্টা করেন।

একইভাবে তার ব্যবহৃত গুরুত্বপূর্ণ পরিভাষাসমূহের মধ্যে একটি হলো, ‘সা’দাত’ (سعادة) বা কল্যাণ , এই পরিভাষাটিকে তিনি মাকাসিদ ও উসূলের মধ্যে উল্লেখ করেন। আপনারা জানেন যে, সা’দাত (কল্যাণ) একইসাথে আখলাকের প্রকারভেদের মধ্যে একটি। অর্থাৎ, আনুগত্যের আখলাক রয়েছে, ফজিলতের আখলাক রয়েছে এবং সাদাতের আখলাক রয়েছে। কেউ কেউ বলে থাকে যে সা’দাতের আখলাক মুসলমানগণ গ্রীকদের কাছ থেকে নিয়েছে। এই কথার কোনো ভিত্তি নেই। এটা এখান থেকে, ওটা ওখান থেকে এইভাবে বলে তারা আমাদের চিন্তা ও দর্শনকে, গ্রীক দর্শনের অংশ বলে চালিয়ে দিতে চায়। এসব ব্যাপারে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে।

ইমাম শাহ ওয়ালীউল্লাহ, আখলাকের সাথে উসূল এবং আখলাকের সাথে ফিকহকে মিশ্রিত করার সময় ‘সা’দাত’ নামক পরিভাষাটিকে কেন্দ্রে স্থাপন করেন। তিনি বলেন, সা’দাতকে অর্জন করতে হলে চারটি বিষয় প্রয়োজন।

১। ত্বাহারাত (পবিত্রতা)। এখানে শুধুমাত্র শারীরিক পরিচ্ছন্নতা নয়; বরং বাহ্যিক ও আধ্যাত্মিক পরিচ্ছন্নতা এর অন্তর্ভুক্ত।
২। আল্লাহর সামনে বিনীতভাবে নত হওয়া।
৩। ঔদার্য, মহানুভবতা, উদারতা, বদান্যতা ও দয়া। একজন মানুষের সাথে অন্য মানুষের সম্পর্ক স্থাপনের মূলভিত্তি হিসেবে এই পরিভাষাটিকে ব্যবহার করেন।
৪। আদালত।

এই বিষয়গুলোকে তিনি মাকাসিদ বা বড় উদ্দেশ্য হিসেবে নির্ধারণ করেন। আমরা যদি এই সকল বিষয়কে অর্জন করতে পারি তাহলে সা’দাতে দারাইনে (ইহকালীন ও পরকালীণ কল্যাণ) উপনীত হতে সক্ষম হব।

ইমাম শাহ ওয়ালীউল্লাহ দেহলভীর এই সকল কার্যক্রমকে উসূলের সন্ধান হিসেবে আখ্যায়িত করে থাকি। বিশেষ করে অষ্টাদশ শতাব্দীতে এই সকল বিষয়কে তিনিই সামনে নিয়ে আসেন। এই জন্য তিনি একটি ইহইয়া ও তাজদীদ আন্দোলনের অগ্রদূত। পরবর্তীতে, তাঁর ছেলে আব্দুল আযীয দেহলভীও অনেক বড় একজন মুহাদ্দিস হন। দেহলভী ধারা ভারতীয় উপমহাদেশে অনেক বড় একটি শক্তিশালী ধারা হিসেবে তার ধারাবাহিকতাকে বজায় রাখতে সক্ষম হয়। তিনি যখন বেঁচে ছিলেন তখন তার বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ ছিল। তবে ভারতীয় উপমহাদেশে যে সকল আলেম দল-মত নির্বিশেষে সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন ইমাম শাহ ওয়ালীউল্লাহ দেহলভী।

 

অনুবাদঃ বুরহান উদ্দিন আজাদ

৪৪৮৮ বার পঠিত

শেয়ার করুন

Picture of প্রফেসর ড. মেহমেদ গরমেজ

প্রফেসর ড. মেহমেদ গরমেজ

প্রফেসর ড. মেহমেদ গরমেজ তুরস্কের একজন প্রথিতযশা আলেম। জীবন্ত কিংবদন্তি এ আলেমে দ্বীন ইসলামের মৌলিক বিষয়সমূহকে মানুষের সামনে তুলে ধরার ক্ষেত্রে নিরলসভাবে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
১৯৬২ সালে তুরস্কের গাজিআনতেপ শহরের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ছিলেন একজন প্রখ্যাত আলেম। তিনি তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা পিতার কাছেই সম্পন্ন করেন। প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করার পর উসমানী ধারার প্রখ্যাত আলেম, 'মেহমেদ আমীন আর' এর নিকট শিক্ষা লাভ করেন। ড. গরমেজ পূর্ব আনাতোলিয়ান অঞ্চলে অবস্থিত উসমানী খিলাফতের সময়কালে প্রতিষ্ঠিত মাদরাসা থেকে শিক্ষা লাভের সময় প্রখ্যাত আলেমে দ্বীন উস্তাদ 'মেহমেদ আমীন আর' এর তত্ত্বাবধানে ছিলেন। সেসময় তিনি একইসাথে গাজিআনতেপ মাদরাসায়ও পড়াশোনা করেন এবং সেখান থেকে কৃতিত্বের সাথে উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা শেষে আঙ্কারা বিশ্ববিদ্যালয়ে থিওলজি বিভাগে ভর্তি হন। আঙ্কারা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত অবস্থায় তিনি মসজিদে ইমামতি ও মাদরাসায় শিক্ষকতা করতেন। আঙ্কারা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স ডিগ্রী লাভ করার পর হাদীস বিভাগে মাস্টার্সে ভর্তি হন এবং খাতীব আল বাগদাদীর বিখ্যাত গ্রন্থ شرف أصحاب الحديث-এর মুহাক্কিক প্রখ্যাত হাদীস শাস্ত্রবিদ প্রফেসর ড. সাঈদ হাতীবওলুর অধীনে মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। তাঁর মাস্টার্সের থিসিস ছিল, 'মুসা জারুল্লাহ বিগিয়েফের চিন্তা ও দর্শন'।
মাস্টার্স করার সময়ে তিনি মিশরে গমন করেন এবং কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণা করেন। কায়রোতে অবস্থান কালে মিশরের স্বনামধন্য ফকীহ মুহাম্মদ সেলিম আল-আরওয়াহ এবং প্রখ্যাত মুহাদ্দিস রিফাত ফাওজীর কাছ থেকে শিক্ষা লাভ করেন। এক বছর কায়রোতে অবস্থান করার পর পুনরায় তুরস্কে ফিরে আসেন এবং পুনরায় আঙ্কারা বিশ্ববিদ্যালয়ে ডক্টরেট (PhD) শুরু করেন। ১৯৯৪ সালে কৃতিত্বের সাথে তিনি তাঁর PhD শেষ করেন। তার PhD-এর থিসিস ছিলো "সুন্নত ও হাদীস বুঝা এবং ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে পদ্ধতিগত সমস্যা।" PhD চলাকালীন সময়ে তিনি এক বছর লন্ডনে অবস্থান করেন এবং সেখানে 'স্কুল অফ অরিয়েন্টাল এন্ড আফ্রিকান স্টাডিজ' এ গবেষক হিসেবে কাজ করেন। তাঁর এ থিসিস ১৯৯৬ সালে তুরস্কের ইসলামিক ফাউন্ডেশন এর গবেষণা বিভাগে প্রথম স্থান অর্জন করে এবং সে বছর এ গবেষণার জন্য তুর্কী সরকার তাকে গবেষণা পুরস্কার প্রদান করে। তার এ থিসিসটি আরবী ও ইংরেজি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। এ থিসিসের কারণে তিনি তাঁর একাডেমিক জীবনের অধিকাংশ সময় 'উসূলে ফিকহ' অধ্যয়নে ব্যয় করেন এবং এ সময়ে তিনি একজন উসূলবিদ হয়ে উঠেন।
এযাবৎকাল পর্যন্ত তিনি পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের বড় বড় মুহাদ্দিস, উসূলবিদ, আলেমগণের সান্নিধ্য লাভ করেছেন ও বিভিন্ন গবেষণায় তাদের থেকে বহু জ্ঞান অর্জন করেন। এছাড়াও উসমানী ধারার বড় বড় দার্শনিকদের সান্নিধ্যে দীর্ঘসময় পড়াশোনা করেন। তিনি আহমেদ ইয়েসেভি বিশ্ববিদ্যালয়, হাজেত্তেপে বিশ্ববিদ্যালয় এবং আঙ্কারা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অনেক বিশ্ববিদ্যালয়, ইন্সটিটিউট ও গবেষণা কেন্দ্রে শিক্ষকতা করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করার পাশাপাশি তিনি অন্যান্য ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। যেমন-ইসলাম শিক্ষা গবেষণা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন এবং তুরস্কের ইসলামী আন্দোলনের মহান নেতা প্রফেসর ড. নাজমুদ্দিন এরবাকান-এর সাথে দীর্ঘদিন কাজ করেন।
২০০৩ সালে তিনি Presidency of the Republic of Turkey Presidency of Religious Affairs এর ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে যোগদান করেন। এ দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি শিক্ষকতাও জারি রাখেন এবং ২০০৬ সালে প্রফেসর হন। দীর্ঘ ৭ বছর এ Religious Affairs এর ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন কালে সমগ্র মুসলিম উম্মাহর সাথে যোগাযোগ স্থাপন করেন এবং মুসলিম উম্মাহকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ২০১০ সালে তিনি Religious Affairs- এর প্রেসিডেন্ট মনোনীত হন এবং ২০১৭ সাল পর্যন্ত এ দায়িত্ব পালন করেন। এ গুরু দায়িত্ব পালন কালেও তিনি তাঁর গবেষণা চালিয়ে যান এবং এক মুহূর্তের জন্যও জ্ঞান গবেষণায় বিরতি দেননি। এ সময়ে তিনি মুসলিম উম্মাহর গুরুত্বপূর্ণ আলেমদের সাথে সু-সম্পর্ক গড়ে তোলেন এবং তাদেরকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য কার্যকরী ভূমিকা পালন করেন। গাজা, আরাকান, সোমালিয়া, সুদান, মধ্য এশিয়া এবং বলকান অঞ্চলের মুসলমানদের সমস্যা সমাধান করার জন্য অনেক পরিকল্পনা গ্রহণ করেন এবং তা বাস্তবায়নের জন্য প্রচেষ্টা চালান। Religious Affairs-এর প্রেসিডেন্ট থাকা অবস্থায় অবরুদ্ধ গাজা সফর করেন এবং হামাস নেতা ইসমাইল হানিয়ার সাথে সাক্ষাৎ করে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষে সংহতি ঘোষণা করেন। গাজাতে অবস্থানকালে তিনি অবরুদ্ধ গাজাবাসীর খোঁজ-খবর নেন। এরপর তিনি বাইতুল মুকাদ্দাসে যান এবং ঐতিহাসিক এক খুতবা প্রদান করেন।
২০১৭ সালে Religious Affairs-এর দায়িত্ব থেকে অবসর গ্রহণ করেন এবং দুটি প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন। একটি হলো International Islamic Though: Foundation অপরটি হলো Institute of Islamic Thought. বর্তমানে তিনি এ প্রতিষ্ঠান দুটির প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
Picture of প্রফেসর ড. মেহমেদ গরমেজ

প্রফেসর ড. মেহমেদ গরমেজ

প্রফেসর ড. মেহমেদ গরমেজ তুরস্কের একজন প্রথিতযশা আলেম। জীবন্ত কিংবদন্তি এ আলেমে দ্বীন ইসলামের মৌলিক বিষয়সমূহকে মানুষের সামনে তুলে ধরার ক্ষেত্রে নিরলসভাবে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
১৯৬২ সালে তুরস্কের গাজিআনতেপ শহরের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ছিলেন একজন প্রখ্যাত আলেম। তিনি তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা পিতার কাছেই সম্পন্ন করেন। প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করার পর উসমানী ধারার প্রখ্যাত আলেম, 'মেহমেদ আমীন আর' এর নিকট শিক্ষা লাভ করেন। ড. গরমেজ পূর্ব আনাতোলিয়ান অঞ্চলে অবস্থিত উসমানী খিলাফতের সময়কালে প্রতিষ্ঠিত মাদরাসা থেকে শিক্ষা লাভের সময় প্রখ্যাত আলেমে দ্বীন উস্তাদ 'মেহমেদ আমীন আর' এর তত্ত্বাবধানে ছিলেন। সেসময় তিনি একইসাথে গাজিআনতেপ মাদরাসায়ও পড়াশোনা করেন এবং সেখান থেকে কৃতিত্বের সাথে উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা শেষে আঙ্কারা বিশ্ববিদ্যালয়ে থিওলজি বিভাগে ভর্তি হন। আঙ্কারা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত অবস্থায় তিনি মসজিদে ইমামতি ও মাদরাসায় শিক্ষকতা করতেন। আঙ্কারা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স ডিগ্রী লাভ করার পর হাদীস বিভাগে মাস্টার্সে ভর্তি হন এবং খাতীব আল বাগদাদীর বিখ্যাত গ্রন্থ شرف أصحاب الحديث-এর মুহাক্কিক প্রখ্যাত হাদীস শাস্ত্রবিদ প্রফেসর ড. সাঈদ হাতীবওলুর অধীনে মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। তাঁর মাস্টার্সের থিসিস ছিল, 'মুসা জারুল্লাহ বিগিয়েফের চিন্তা ও দর্শন'।
মাস্টার্স করার সময়ে তিনি মিশরে গমন করেন এবং কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণা করেন। কায়রোতে অবস্থান কালে মিশরের স্বনামধন্য ফকীহ মুহাম্মদ সেলিম আল-আরওয়াহ এবং প্রখ্যাত মুহাদ্দিস রিফাত ফাওজীর কাছ থেকে শিক্ষা লাভ করেন। এক বছর কায়রোতে অবস্থান করার পর পুনরায় তুরস্কে ফিরে আসেন এবং পুনরায় আঙ্কারা বিশ্ববিদ্যালয়ে ডক্টরেট (PhD) শুরু করেন। ১৯৯৪ সালে কৃতিত্বের সাথে তিনি তাঁর PhD শেষ করেন। তার PhD-এর থিসিস ছিলো "সুন্নত ও হাদীস বুঝা এবং ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে পদ্ধতিগত সমস্যা।" PhD চলাকালীন সময়ে তিনি এক বছর লন্ডনে অবস্থান করেন এবং সেখানে 'স্কুল অফ অরিয়েন্টাল এন্ড আফ্রিকান স্টাডিজ' এ গবেষক হিসেবে কাজ করেন। তাঁর এ থিসিস ১৯৯৬ সালে তুরস্কের ইসলামিক ফাউন্ডেশন এর গবেষণা বিভাগে প্রথম স্থান অর্জন করে এবং সে বছর এ গবেষণার জন্য তুর্কী সরকার তাকে গবেষণা পুরস্কার প্রদান করে। তার এ থিসিসটি আরবী ও ইংরেজি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। এ থিসিসের কারণে তিনি তাঁর একাডেমিক জীবনের অধিকাংশ সময় 'উসূলে ফিকহ' অধ্যয়নে ব্যয় করেন এবং এ সময়ে তিনি একজন উসূলবিদ হয়ে উঠেন।
এযাবৎকাল পর্যন্ত তিনি পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের বড় বড় মুহাদ্দিস, উসূলবিদ, আলেমগণের সান্নিধ্য লাভ করেছেন ও বিভিন্ন গবেষণায় তাদের থেকে বহু জ্ঞান অর্জন করেন। এছাড়াও উসমানী ধারার বড় বড় দার্শনিকদের সান্নিধ্যে দীর্ঘসময় পড়াশোনা করেন। তিনি আহমেদ ইয়েসেভি বিশ্ববিদ্যালয়, হাজেত্তেপে বিশ্ববিদ্যালয় এবং আঙ্কারা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অনেক বিশ্ববিদ্যালয়, ইন্সটিটিউট ও গবেষণা কেন্দ্রে শিক্ষকতা করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করার পাশাপাশি তিনি অন্যান্য ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। যেমন-ইসলাম শিক্ষা গবেষণা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন এবং তুরস্কের ইসলামী আন্দোলনের মহান নেতা প্রফেসর ড. নাজমুদ্দিন এরবাকান-এর সাথে দীর্ঘদিন কাজ করেন।
২০০৩ সালে তিনি Presidency of the Republic of Turkey Presidency of Religious Affairs এর ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে যোগদান করেন। এ দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি শিক্ষকতাও জারি রাখেন এবং ২০০৬ সালে প্রফেসর হন। দীর্ঘ ৭ বছর এ Religious Affairs এর ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন কালে সমগ্র মুসলিম উম্মাহর সাথে যোগাযোগ স্থাপন করেন এবং মুসলিম উম্মাহকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ২০১০ সালে তিনি Religious Affairs- এর প্রেসিডেন্ট মনোনীত হন এবং ২০১৭ সাল পর্যন্ত এ দায়িত্ব পালন করেন। এ গুরু দায়িত্ব পালন কালেও তিনি তাঁর গবেষণা চালিয়ে যান এবং এক মুহূর্তের জন্যও জ্ঞান গবেষণায় বিরতি দেননি। এ সময়ে তিনি মুসলিম উম্মাহর গুরুত্বপূর্ণ আলেমদের সাথে সু-সম্পর্ক গড়ে তোলেন এবং তাদেরকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য কার্যকরী ভূমিকা পালন করেন। গাজা, আরাকান, সোমালিয়া, সুদান, মধ্য এশিয়া এবং বলকান অঞ্চলের মুসলমানদের সমস্যা সমাধান করার জন্য অনেক পরিকল্পনা গ্রহণ করেন এবং তা বাস্তবায়নের জন্য প্রচেষ্টা চালান। Religious Affairs-এর প্রেসিডেন্ট থাকা অবস্থায় অবরুদ্ধ গাজা সফর করেন এবং হামাস নেতা ইসমাইল হানিয়ার সাথে সাক্ষাৎ করে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষে সংহতি ঘোষণা করেন। গাজাতে অবস্থানকালে তিনি অবরুদ্ধ গাজাবাসীর খোঁজ-খবর নেন। এরপর তিনি বাইতুল মুকাদ্দাসে যান এবং ঐতিহাসিক এক খুতবা প্রদান করেন।
২০১৭ সালে Religious Affairs-এর দায়িত্ব থেকে অবসর গ্রহণ করেন এবং দুটি প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন। একটি হলো International Islamic Though: Foundation অপরটি হলো Institute of Islamic Thought. বর্তমানে তিনি এ প্রতিষ্ঠান দুটির প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

মতামত প্রকাশ করুন

Scroll to Top