
ইবনে খালদুন, ইসলামী চিন্তার পর্যায়কালের দিকে লক্ষ্য করলে দেখতে পাই, তিনি ছিলেন নবায়ন পর্বের একজন দার্শনিক ।
ইবনে খালদুন ১৩৩২সালে তিউনিসিয়াতে জন্ম ও ১৪০৪ সালে মিসরে মৃত্যুবরন করেন। তিউনিসিয়ায় পড়াশোনা শেষ করে তারপর আন্দালুসিয়াতে যান, সেখানে মন্ত্রী হন, এরপরে সুলতান এর বিশেষ দূত হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। অতপর উত্তর আফ্রিকায় ফিরে আসেন, বিভিন্ন অঞ্চলে ঘুরেন, মিসরে যান এবং সেখানে মালেকী মাযহাবের চিফ জাস্টিস হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
তিনি বিখ্যাত রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান, বাবা প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। যার ফলে ছোটবেলাই বড় বড় শিক্ষকদের কাছে পড়েছেন, ২০ বছর বয়সে পড়াশোনা শেষ করে ফেলেন।
উস্তাদদের বিশেষ তত্ত্বাবধানের ফলাফল হচ্ছে, ইমাম ফখরুদ্দীন রাজীর বিখ্যাত উসুলের গ্রন্থ ‘আল মুহাসসাল’ এর সারমর্ম লিখেন ১৮ বছর বয়সে। আরবীতে বিখ্যাত একটি প্রবাদ আছে,
الوالد سر ابیہ
“সন্তান হচ্ছে বাবার চিহ্ন বা রহস্য”। ফখরুদ্দীন রাজী হচ্ছেন ইমাম গাজ্জালীর سر বা রহস্য, আবার অনেকক্ষেত্রে ইমাম গাজ্জালীকেও ছাড়িয়ে গেছেন ইমাম রাজী । চিন্তার পর্যায়কালের নবায়ন যুগ মুলত উনাকে দিয়েই শুরু হয়। যেমন, ফিলোসফি ও কালামকে একত্রিত করে, গণিত, মেডিসিন, মানতিক ইত্যাদিকে নতুনভাবে নবায়ন করেন। ইমাম রাজীর “মুহাসসাল”কে খুব ভালোভাবে পড়ে ইবনে খালদুন তার সারাংশ “লুবাবুল মুহাসসাল” (মুহাসসাল এর আসল কথা) রচনা করেন। তাই, ইমাম ফখরুদ্দীন রাজীকে ভালোভাবে না বুঝলে ইবনে খালদুনকে বোঝা সম্ভব না। কেননা, যেমন ইবনে খালদুনের মেটাফিজিক্যাল ধারণার সম্পূর্ণটাই এসেছে আল মুহাসসাল থেকে, আবার এটার প্রভাব পড়েছে আল মুকাদ্দিমাতে। তাই রাজীর মেটাফিজিক্যাল ধারণা না বুঝে ইবনে খালদুনের মেটাফিজিক্যাল ধারণা বুঝা সম্ভব না।
আবার, “লুবাবুল মুহাসসাল” বুঝা বা পড়ানোর যোগ্যতা কম উস্তাদেরই রয়েছে। কেননা ফখরুদ্দীন রাজী মেডিসিন, অ্যাস্ট্রোনমি, অ্যাস্ট্রোলজি, ফিজিক্স, গণিত, কালাম, ফিলোসফি এসবকিছুর শীর্ষ ব্যক্তি। সুতরাং তার একটা বই বুঝা, ব্যখ্যা করা অতি সহজ কোন ব্যাপার নয়! আমাদের কাছে ব্যাপারটা এমন যে ক্লাস নাইনের গণিত, ফিজিক্স পড়ে আইনস্টাইনের বই পড়া।
কিন্তু অল্প বয়সেই ইবনে খালদুনের বড় বড় শিক্ষকদের কারণে তাঁর জ্ঞানের পর্যায় ওই পর্যন্ত পৌঁছে যায়, অতঃপর তিনি ইহা লিখেন।
আরেকটি বিষয়, ইবনে খালদুনের শাইখুল কাবীর হচ্ছে ফখরুদ্দীন রাজী। তিনি মুকাদ্দিমা তে যত জায়গায় শাইখুল কাবীর বলেছেন তা মূলত ইমাম রাজীকে বুঝিয়েছেন (তবে সাধারনত শাইখুল কাবীর বলা হয় মহিউদ্দিন ইবনুল আরাবীকে)।
মহান বিজ্ঞানী ইবনে খালদুন ছিলেন সুফী শায়খ, তার নিজস্ব খানকাও ছিল। এতো যোগ্যতা, রাজনৈতিক ব্যক্তি ও ফ্যামিলির সন্তান, বহুমুখিতার কারণে প্রতিটি অঞ্চলে বড় বড় পদ গ্রহণের অফার আসত প্রতিনিয়তই।
গ্রন্থসমূহঃ
- কিতাবুল ইবার (ওয়ার্ল্ড হিস্ট্রি)
(এটার ভূমিকাই হচ্ছে আল-মুকাদ্দিমা)
- লুবাবুল মুহাসসাল।
- আত্মজীবনী, মুকাদ্দিমার সকল সোর্স আত্মজীবনীতে রয়েছে এবং বহু ভুল ধারণার জবাব পাওয়া যাবে। আত্মজীবনীর বড় শিক্ষা হচ্ছে, বর্তমান দুনিয়াকে খুব ভালোভাবে বুঝতে হবে, অন্যথায় অতীত বুঝা যাবে না। তিনি বলেন, অতীত ও বর্তমান হচ্ছে পানির মতো। পূর্বের পানি ও বর্তমান পানির যেমন সামঞ্জস্য, তেমনি অতীত ও বর্তমান সামঞ্জস্যপূর্ণ। তাই বর্তমানকে ভালভাবে না বুঝে অতীতকে বুঝা যাবেনা, আবার অতীতকে না বুঝলে ভবিষ্যতকে বুঝা যায় না।
- শিফাউস সায়িল( প্রশ্নকারীর শিক্ষা), এটা তাসাউফ সংক্রান্ত বই। এখানে তাসাউফ নিয়ে চমৎকার আলোচনা করেছেন। উনার মৌলিক গ্রন্থগুলোর মধ্যে এই চারটি বই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
ইবনে খালদুন ও তার চিন্তা সম্পর্কে কয়েকটি মন্তব্য,
- সভ্যতার ইতিহাস লিখা পাশ্চাত্যের বিখ্যাত মনীষী টয়েনবি বলেন, “আল মুকাদ্দিমা ইতিহাস দর্শনের সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ। না তার পূর্বে, না তার পরে অনুরূপ কোন গ্রন্থ লেখা হয়েছে।”
- মহান দার্শনিক আল্লামা ইকবাল বলেন, “সাহাবীদের পর থেকে উনার সময় পর্যন্ত ইসলামকে সবচেয়ে ভালভাবে বুঝতে পেরেছিলেন ইবনে খালদুন।”
- জেমিল মেরিচ বলেন, “আকাশে যদি কোনো তারকা থাকেন সেটা ইবনে খালদুন, এছাড়া আর কোনো তারকাই নেই।”
ইবনে খালদুনের চিন্তাঃ
ইবনে খালদুনের চিন্তার মূল কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে মানুষ।
তার দৃষ্টিতে ‘মানুষ’ কি?
মানুষ হচ্ছে বায়োলজিক্যাল প্রাণী, সে নিজেকে আত্মরক্ষার জন্য চেষ্টা ও কাজ করে থাকে। মানুষ একজন আরেকজনের মুখাপেক্ষী, একা কেউ যথেষ্ট নয় অর্থাৎ একজন আরেকজনের পরিপূরক। তাই একজন অন্যজনকে রক্ষা করে এবং এরই সাথে মানুষ অন্যান্য অনেক কিছুর মুখাপেক্ষী ও সেগুলোকেও মানুষ রক্ষা করে। যেমন প্রকৃতিকে মানুষ রক্ষা করে।
ইবনে খালদুন বলেন, “মানুষ বেঁচে থাকার জন্য, টিকে থাকার জন্য সে তার সব কিছুকে রক্ষা করে। আর এটিই হচ্ছে মানুষের সম্পর্কের ভিত্তি।”
তাহলে এটির শুরু কোথায়?
এটি শুরু হয় নিজের পরিবার থেকে, নিজের আত্মীয়দের মধ্য থেকে। এসব হচ্ছে গ্রুপ গ্রুপ রক্ষাপন্থা, এটিই আস্তে আস্তে একটি রাষ্ট্রে পরিণত হয় অর্থাৎ যিনি বুঝাচ্ছেন ফিজিক্যাল বিষয় থেকে সাইকোলজিকাল রূপান্তরিত হয়ে মানুষের গ্রুপ তৈরি হয় ও রক্ষা করেন, সেখান থেকে রাষ্ট্র তৈরি হয়।
অর্থাৎ ফিজিক্স থেকে সাইকোলজি, রাষ্ট্র ও আইন তৈরি হলো।
আর এই পুরো তত্ত্বটি “আসাবিয়্যা থিওরি।”
(দুঃখজনক হলেও একটি ব্যাপার হচ্ছে, পাশ্চাত্য চিন্তায় ইচ্ছায়, অনিচ্ছায় প্রভাবিতগণ আসাবিয়াহ তত্ত্বকে গোত্র/জাতীয়বাদী থিউরি ব্যাখ্যা দেয় এবং ইবনে খালদুন কে জাতীয়তাবাদী সেকুলারিস্ট বানায়! অথচ আসাবিয়্যাত এটি হচ্ছে একটি নাম বা পরিভাষা, যার ব্যাখ্যা সম্পূর্ণ ইসলামী মূলনীতির আলোকেই প্রতিষ্ঠিত, কিন্তু অনুবাদ করতে গিয়ে এভাবে গোত্র/জাতীয়তাবাদী অর্থে নিয়ে আসে, ভুল করে! এবং থিওরিকে না বোঝার কারণে তাকে ভুল ব্যাখ্যা ও অপবাদ দেয়!
উনার মত একজন বড় আলেম, মাযহাবের চিফ জাস্টিস, সুফীকে সেকুলার জাতীয়তাবাদ বানানো!
বা উনার মত এত বড় আলেম ইসলাম বুঝে নাই, ইসলামের মূলনীতি বিরোধী তত্ত্ব দিবেন! এটা পাগলের প্রলাপ ছাড়া আর কিছু নয়!)
ইবনে খালদুনের মতে রাষ্ট্রের বড় উপাদান হচ্ছে,
১। ভূখন্ড,
২। মানুষ বা আসাবিয়া,
যেখানে নবী আসেনি, কিন্তু এই দুইটি আছে সেটা হল মূলক বা রাষ্ট্র।
যেখানে নবী এসেছেন। সেখানে নবীগণ তিনটি বিষয় এনেছেন,
১। দ্বীন,
২। ভূখন্ড,
৩। মানুষ বা আসাবিয়্যাহ।
অর্থাৎ এই দ্বীনের সমন্বয়ে যা হবে তা হচ্ছে খেলাফত, এখানে দ্বীন-ই হচ্ছে খেলাফত।
অর্থাৎ দ্বীন হচ্ছে খেলাফত ও মুলকিয়াত এর পার্থক্য নিরুপন করে। দ্বীন থাকলে খেলাফত, না থাকলে মুলকিয়াত।
(অথচ এখানে দুঃখজনকভাবে ইবনে খালদুনকে ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়। শুধু মুলকিয়াত বা রাষ্ট্রের সংজ্ঞা এনে উনার থিউরি হিসেবে দেখায়, এরপর বলে এটাই ইবনে খালদুনের আলোকে মুলক বা রাষ্ট্র, সুতরাং আমরাই সঠিক।
আবার উনাকে এমনভাবে দেখানো হয়, যেন উনি এমন এক গাছ, যা মরুভূমির মাঝখানে অবস্থান করছে! আশেপাশে কিছুই নাই! কোন ঐতিহ্য, উস্তাদ, সামগ্রিকতা নাই!
অথচ ইমাম গাজ্জালী, ইমাম রাজীকে যেভাবে পড়েছেন, তেমনি ভাবে শাফেয়ীকে পড়েছেন। নিজে মালেকী মাযহাবের ইমাম ছিলেন, তৎকালীন বড়বড় উস্তাদের কাছে সরাসরি অধ্যয়ন করেছেন।
ইসলামী সভ্যতার সকল ধারাকে উনি নিবিড় ভাবে অধ্যয়ন করেছেন, সবার দ্বারাই উপকৃত হয়েছেন, সুতরাং ছিন্নভিন্ন কোন ব্যক্তি তিনি নন।
যাইহোক, ফরাসিরা ইবনে খালদুনের আল মুকাদ্দিমাকে মুসলমানদের পর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে অনুবাদ করে। যা তাদের বহুক্ষেত্রেই প্রচন্ডমাত্রায় কাজে আসে। কেননা মুকাদ্দিমায় উল্লেখিত বার্বার গোষ্ঠী মূলত আফ্রিকার মুসলিমরা, আর সে আলোকেই ফ্রান্স উত্তর আফ্রিকায় উপনিবেশ করার ক্ষেত্রে, শোষণের জন্য মুকাদ্দিমাকে ভালোভাবে গবেষণা করে, ব্যাখ্যা করে, বিস্তারিত অবস্থান বুঝে তারপর শোষণ করতে থাকে।
একইভাবে, আমরা জানি যে ফরাসি বিপ্লবের পর সোশ্যাল সায়েন্স ডেভেলপ হয়। পাশ্চাত্যের সোশ্যাল সাইন্স এর ভিত্তি নির্মাণে অসাধারণ ভূমিকা পালন করে আল মুকাদ্দিমা। এভাবে বহু ক্ষেত্রে প্রভাবিত করেছে ইবনে খালদুনের আল মুকাদ্দিমা।)
এগুলো হলো তার পরিচয় ও চিন্তা ধারা।
এপর্যায়ে ইবনে খালদুনের রাজনৈতিক চক্র বুঝার পূর্বে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল, ইতিহাসকে তিনি দুই ভাগে ভাগ করেন যা ইতিপূর্বে ছিলনা, বরং প্রচলিত সকল বয়ানকে খন্ডায়ে নতুনভাবে ইতিহাসের বিজ্ঞান দাঁড় করান।
ইতিহাস হচ্ছে দুই প্রকার যথা,
১। জাহিরী
এটি হচ্ছে দৈনন্দিন ঘটনা, রাষ্ট্রীয় কার্যক্রম, যা ঘটে, বাহ্যিকভাবে দেখায় ইত্যাদি। বর্তমানে যে কাজ সমূহ ভবিষ্যতে জাহিরী ইতিহাস হবে, তাহলো পত্র-পত্রিকা, মিডিয়া, খবর, চামচামি বা তেলবাজি ইত্যাদি।
২। বাতেনী
যা সামগ্রিক, আর তত্ত্বটিই মূলত ইবনে খালদুনকে ইবনে খালদুন বানিয়েছে, অর্থাৎ তার পূর্বে ইতিহাসকে কেউ এভাবে ডিফাইন বা ক্লাসিফাই করতে পারেনি।
সুতরাং এই সামগ্রিক ইতিহাসই মূলত ইতিহাস, যা সবকিছুকে প্রভাবিত করে। যার উপর ভিত্তি করে সব নিয়ন্ত্রিত হয়।
বাতেনী ইতিহাস হচ্ছে
وفي باطنه نظر وتحقيق وتعليل للكائنت ومباديها دقيق وعلم بكيفية الواقع واسبابها عميق
সংজ্ঞাটিকে ভালো করে লক্ষ্য করি তাহলে দেখবো,
نطر – মানে হচ্ছে, ইতিহাসের জন্য থিওরি থাকতে হবে, থিওরিটিক্যাল চিন্তাকে ডেভেলপ করা, তাত্ত্বিক চিন্তা। অর্থাৎ (দেখা বা পড়ার সাথে সাথে বিবেচনা না করে পড়া যাবে না) থিউরিটিক্যালি সামনে আনতে হবে। ইতিহাসের পেছনে, সামনে, বিভিন্ন মৌলিক বিষয়ের সাথে সম্পৃক্ত করে ইতিহাসকে পর্যালোচনা করা।
تحقيق – ক্রিটিকাল থিংকিং। শুনার সাথে সাথে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে চিন্তা করা, যেমন তিনি প্রচুর উদাহরণ দিয়েছেন,
- ইব্রাহিম (আ) ৭০ হাত লম্বা ছিল। কিন্তু তিনি বলেন, “আমি অনেকবার কুদুসে গিয়েছি তার কবর তো এত লম্বা নয়!”
- নূহ (আ) এর পুত্র কেনান এত লম্বা ছিল যে মাছ ধরে উপর দিকে ধরতো, সূর্যের তাপে পুড়াতো। তিনি বলেন, তাপ মাটির সাথে সম্পৃক্ত, যত উপরে উঠবে ততো ঠান্ডা। তাহলে এই কাহিনির ভিত্তি কি? যেমন বর্তমান যুগে আমরা এখন বিমানে উঠলেই বুঝতে পারি উপরে ঠান্ডা।
- মাসউদির বিভিন্ন ইতিহাস সহ বেশকিছু যুদ্ধের কাহিনী এনেছেন। যেমন, দুই পক্ষে ছয়লক্ষ সৈন্য ছিল। তিনি বলেন, ছয় লাখ সৈন্য এটি বাস্তবে সম্ভব? এতো বড় জায়গা কই? এত সৈন্য একসাথে কিভাবে যুদ্ধ করবে? তখন জনসংখ্যা কত ছিল?
আর এই تحقیق শব্দটি এসেছে حق থেকে। অর্থাৎ হকে পৌছানো, সত্যে পৌঁছানোর জন্য ক্রিটিকাল থিংকিং করা।
تعلیل – কজ এবং ইফেক্ট (কারণ এবং ফলাফল)। কজ ও ইফেক্টের মধ্যে সামঞ্জস্য করা অথবা পার্থক্য স্থাপন করা।
যেমন বর্তমান দুনিয়ায় যা হচ্ছে তা এমনিই হঠাৎ করেই ঘটেনা, ঘটে যাচ্ছেনা। সবই পরিকল্পিত কাজ এর ইফেক্ট।
অর্থাৎ সবই ডিজাইন করা হয়। সব যুগের ক্ষেত্রেই একই কথা, হুট করেই কিছু হয়না। তাই সেই ডিজাইন (কারণ এবং ফলাফল) পর্যালোচনা করেই ইতিহাসকে পড়া।
ومباديها دقيق – সুক্ষ্ণাতিসুক্ষ্ণ মূলনীতি। উপরের কজ এবং ইফেক্ট (কারণ এবং ফলাফল) কে মিলাতে হবে, পর্যালোচনা করতে হবে মূলত সুক্ষ্ণাতিসুক্ষ্ণ মূলনীতির আলোকেই।
وعلم بكيفية الوقع – ঘটনার অন্তর্নিহিত রহস্য, কারণ সমূহ, কিভাবে আসলো তথা সমগ্র রহস্য জানা ইত্যাদি।
আর এসব কেন? প্রশ্নের জবাব হচ্ছে تعلیل
واسبابها عميق – কারণ সমূহ হচ্ছে গভীর থেকে গভীরতর।
সর্বোপূরি বলা যায়, তারিখে বাতিনী (অন্তর্নিহিত ইতিহাস) হচ্ছে
- থিউরি।
- ক্রিটিকাল থিংকিং।
- কজ এবং ইফেক্ট।
- কারণ ও ফলাফলের কাহিনি সমূহ।
- উপরোক্ত সবকিছুর সূক্ষ্মাতিসূক্ষ মূলনীতি।
- ঘটনার রহস্য সম্পর্কে জ্ঞান এবং কারণ গুলি হচ্ছে অনেক গভীর থেকে গভীর।
“কিতাবুল ইবার” পুরোটাই এই মূলনীতির উপর ভিত্তি করে রচিত। যা ইতিহাসের কষ্টিপাথর বা মূলনীতি।
ইবনে খালদুনের রাজনৈতিক বৃত্তঃ

আমরা লক্ষ্য করেছি যে, ইবনে খালদুনের ‘বৃত্ত’। এক্ষেত্রে প্রশ্ন আসবে “বৃত্ত” কেন?
কেননা, বর্তমানের ক্ষমতাসীন রাজনীতি বা পাশ্চাত্য সভ্যতার নীতিকে বলা হয় পিরামিড আকৃতির। অর্থাৎ উপর থেকে নিচে বা নিচ থেকে উপরে এভাবেই সবকিছু পরিচালিত হয়, নিয়ন্ত্রিত হয়।
সেক্ষেত্রে ইসলামী রাজনীতি বা রাষ্ট্র হচ্ছে বৃত্ত। তাহলে পার্থক্যটা কোথায়?
ইসলামী সভ্যতার বৃত্ত হচ্ছে, “কেউ কারোর ওপরে নয়, কেউ কাউকে চাপ প্রয়োগ করবে না। অর্থাৎ একটি আরেকটির পরিপূরক।”
কিন্তু পাশ্চাত্য নীতির বর্তমান রাষ্ট্র এমন নয়।
যাইহোক আমরা বৃত্তের দিকে ভালোভাবে লক্ষ্য করলেই স্পষ্ট হব আশাকরি,
১। العلم بستان
এখানে العلم বলতে বুঝানো হচ্ছে সমাজকে, তাই এর অর্থ সমাজ হচ্ছে বাগানের ন্যায়।
سياحة الد ولة অর্থাৎ, রক্ষাকারী দেওয়াল হচ্ছে রাষ্ট্র। সমাজকে রক্ষা করবে রাষ্ট্র।
২। الد ولة سلطان
রাষ্ট্র হচ্ছে শক্তি, এখানে سلطان শক্তি অর্থে এসেছে।
تحيابه السنة আর এটি থাকে সুন্নাতের মাধ্যমে।
অর্থাৎ রাষ্ট্র হচ্ছে শক্তি, যা সুন্নাতের মাধ্যমে টিকে থাকে।
এখানে ইবনে খালদুন তুলে ধরেছেন যে, রাষ্ট্র সুন্নতের মাধ্যমে বেঁচে থাকে। আলেমগণ বলেন, এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ “রাষ্ট্রবিহীন সুন্নাহ বেঁচে থাকতে পারে না।” কারণ, রাসূলে আকরাম (সঃ) জনপদ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গুহায় বসবাস কারী কোন ব্যক্তি ছিলেন না কিংবা মসজিদে নববীতে বসে শুধুমাত্র ওয়াজ নসিহত করেননি। তিনি একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এবং সেই রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি ছিলেন তিনি নিজে। এই জন্যই ইবনে খালদুন এইভাবে তুলে ধরেছেন যে, রাষ্ট্র ছাড়া সুন্নত তার ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে পারবে না। কারণ রাষ্ট্র না থাকলে সুন্নত শুধুমাত্র ব্যক্তিগত জীবনের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়বে। অথচ সুন্নত শুধুমাত্র আমাদের ব্যক্তিজীবনকেই প্রভাবিত করে না, সামগ্রিকভাবে সমগ্র সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে প্রভাবিত করে। আর সেটা কেবলমাত্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই হতে পারে।
ইবনে খালদুন এখানে সুন্নাহর একটি অসাধারণ ধারণা প্রদান করেছেন, তিনি সুন্নতকে সমাজের একটি নিজাম (ব্যবস্থা) হিসেবে দেখিয়েছেন।
৩। السنةسياسة
সুন্নাত হচ্ছে রাজনীতি।
তবে এক্ষেত্রে যদি লক্ষ্য করি, আমাদের বর্তমান সমাজব্যবস্থায় সুন্নাত কি? বা সুন্নাত বলতে কি ধরণের বয়ান প্রতিষ্ঠিত রয়েছে?
সে অনুযায়ী আমরা জবাব দিবো– দাড়ি, টুপি বা বিভিন্ন আনুষ্ঠানিকতা ইত্যাদি। কিন্তু সত্যিকারার্থে সবচেয়ে বড় সুন্নত হচ্ছে আদালত,হক,সত্য কথা, রাজনীতি ইত্যাদি । উনি এখানে রাসূল(সা) এর গোটা জীবনকে বুঝাচ্ছেন, তবে শুধু পলিটিকাল অর্থে নয় অর্থাৎ রাসুলের গোটা জীবন হচ্ছে “সমাজ বিনির্মাণে”র, তাই এখানে “সমাজ বিনির্মাণে”র অর্থে এসেছে। সবচেয়ে বড় সুন্নাত হচ্ছে “রাজনীতি বা সমাজ বিনির্মাণ”। অর্থাৎ সমাজকে পরিচালনা পদ্ধতি, একটি সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা।
বিস্তৃত অর্থে, এর নিজস্ব বৈশিষ্ট্যের আলোকে সামাজিক সিস্টেম ও রাষ্ট্রীয় সিস্টেম হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। তাই সুন্নতকে শুধুমাত্র ব্যক্তিজীবনকে গঠনকারী একটি বিষয় হিসেবে নয়, সামগ্রিক অর্থে সমগ্র দুনিয়াকে শাসনকারী একটি ব্যবস্থা হিসেবে তিনি সুন্নতকে সঙ্গায়িত করেছেন।
يَسُوْسُهُمَا الملک অর্থাৎ, রক্ষাকারী শাসক বা রাষ্ট্র। তবে অনেকেই রাজতন্ত্র বা গোত্র প্রীতি বোঝায় কিন্তু আসলে এখানে শাসক বোঝানো হয়েছে।
অর্থাৎ সুন্নত হচ্ছে রাজনীতি, আর রাজনীতিকে রক্ষা করে শাসক।
অর্থাৎ সুন্নাহ থেকে উৎসারিত এই রাজনীতিকে কে বাস্তবায়ন করবে? এর জবাবে তিনি রাষ্ট্র এর বাস্তবায়ন করবে। যার অর্থ হল রাসূল (সঃ) সুন্নতের একটি রাজনৈতিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ধারণা রয়েছে। আর এটা বাস্তবায়ন করবে রাষ্ট্র।
৪। الملك راع يَعُضُّهُ الْجَيْش – রাষ্ট্রনায়ক হচ্ছে রক্ষাকারী রাখাল বা পরিচালক।
يَعُضُّهُ الْجَيْش অর্থাৎ, তাকে রক্ষা করে সেনাবাহিনী। অর্থাৎ রাষ্ট্রনায়ক হচ্ছে রাখাল বা পরিচালক তাকে রক্ষা করে সেনাবাহিনী।
তবে, এ পয়েন্টের আলোচনা নিয়ে ব্যাপক ধোঁয়াশা লক্ষ্য করা যায়। মূলক অর্থ রাষ্ট্র। এখানে রাষ্ট্রনায়ক বোঝানো হলেও একটা শ্রেণী এটাকে শুধু রাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র বুঝিয়ে থাকে!
উনাকে না বুঝে, দ্বীন ও রাষ্ট্রের অবস্থান না বুঝে উনাকে সেক্যুলার বানানো হয়!
যেমন ধরুন, কোন খেলাফতের দলিল দস্তাবেজে মুলক শব্দ দেখে অনেকে বলেন, মূলক হচ্ছে সবকিছুর মালিক, সুতরাং ইসলামী রাষ্ট্র ও কমিউনিস্ট রাষ্ট্রের মতোই।
কিন্তু এটাতো ইসলামের মূলনীতি বিরুদ্ধ, অর্থাৎ রাষ্ট্রের মূলনীতি হচ্ছেত- আদালত এবং যেখানে সম্পদের স্বাধীনতাসহ সকল কিছুই ন্যায়ভিত্তিক।
যেমন- ইমাম ইবনে তাইমিয়্যা বলেন, “দুনিয়া কুফরের মাধ্যমেও আবাদ হতে পারে, যদি সেখানে আদালত থাকে। আবার যদি সেখানে ইসলাম থাকে, কিন্তু জুলুম থাকে তাহলে সেটা টিকবেনা।”
আল্লাহ ন্যায়পরায়ণ রাষ্ট্রকে সহযোগিতা করেন যদি তা কাফেরও হয়, আল্লাহ জালেম রাষ্ট্রকে সহযোগিতা করেন না, যদি তা মুমিনও হয়।
অর্থাৎ যেখানে আদালত, তারাই এগিয়ে থাকবে। বর্তমানেও আমাদের তুলনায় পাশ্চাত্যের দেশগুলিতে আদালত বেশি, সুতরাং তারাই এগিয়ে থাকবে। এইজন্যই রাসুল(সাঃ) নিজেও সাহাবাদের হিজরত করতে আদালত ওয়ালা বাদশাহ নাজ্জাসীর অঞ্চলেই অনুমতি দিয়েছিলেন।
তাই ইসলামী সালতানাতকে না বুঝে, খন্ডিত দলীলদস্তাবেজ দেখেই এসব বলা নিছক মূর্খতা!
৫। الجيش اعون
সেনাবাহিনী হচ্ছে সমাজ-সংগঠন।
يَكْفُلُهُمُ الْمَال অর্থাৎ, তাকে রক্ষা করে অর্থনীতি, সম্পদ।
অর্থাৎ, সেনাবাহিনী হচ্ছে মূল সংগঠন, তাকে রক্ষা করে অর্থনীতি। আল মাওয়ার্দী বলেন, “একটি রাষ্ট্রের অবশ্যই তিনটা জিনিস থাকা আবশ্যক,
- অর্থসম্পদ।
- শক্তিশালী সেনাবাহিনী।
- একজন আরেকজনকে একত্রিতকারী দ্বীন।”
সুতরাং এসব ব্যতীত ইসলামী রাষ্ট্রের কল্পনাই করা যায় না।
৬। المال رزق تخمعہ الرعة
সম্পদ হচ্ছে রিজিক, আর এটাকে একত্রিত করে হচ্ছে জনগণ। যেমনঃ ট্যাক্স, ভ্যাট সহ সব ক্ষেত্রে কাজ করে জনগণ।
৭। الرعیة عبید یتعبدھم العدل
জনগণ রাষ্ট্রের অনুগত, তবে তারা অনুগত থাকবে আদালতের মাধ্যমে।
(এখানে সুস্পষ্টভাবে জালিমের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের দলিল দেয়া হচ্ছে। যেমনঃ আমরা দোয়া কুনুতে পড়ি, আমরা সকল বন্ধন খুলে নিলাম, পরিত্যাগ করলাম যে জুলুম করে।)
৮। العدل ما لوف و بہ قوام العلم
আদালত এমন এক বিষয়, যা সকলের প্রয়োজন।সকলেই চায়, সকলের আকাঙ্খিত বিষয়।
তাই আদালত কে কখনোই নষ্ট করতে নেই, তাতে নিজেরাও একপর্যায়ে তার স্বীকার হতে হয়! যেমন- বিএনপির আমলে ভি’আইপি ডিভিশন বাতিল হয়, এখন সেটার জন্য সবচেয়ে বেশি দূর্ভোগ পোহাচ্ছে বিএনপিই।
উসমানী খিলাফতের বিখ্যাত দার্শনিক আলী চেলেবীও ইবনে খালদুনের বৃত্তের আলোকে এই বৃত্তটি তৈরি করেন,

আলী চেলেবীর বৃত্তের ব্যাখ্যাঃ
- জনগণের ঐক্যবদ্ধতা এবং শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয় আদালতের মধ্য দিয়ে।
- দুনিয়ার শান্তির মূলে রয়েছে আদালত।
- দুনিয়া বা বাগানের রাখাল হচ্ছে রাষ্ট্র।
- রাষ্ট্রের নিজাম হচ্ছে শরীয়ত।
- শরীয়ত/সুন্নত ছাড়া রাষ্ট্র হবে না।
- রাষ্ট্র সেনাবাহিনী ছাড়া হবে না।
- সেনাবাহিনী অর্থ-সম্পদ ছাড়া হবে না।
- অর্থনৈতিক শক্তি জনগণ ছাড়া হবে না।