মানবতাবাদ সম্বন্ধে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য ভিন্নমুখী ধারণা প্রচলিত রয়েছে। পাশ্চাত্যে মানবতাবাদের সহজ ও সরল অর্থ হলো, এ দুনিয়ায় মানুষের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠার মৌলিক ভিত্তি হলো মানবতাবাদ। অপরদিকে প্রাচ্যে মানবতাবাদের অর্থ হলো, মানুষে মানুষে মৈত্রী ও সমবেদনার প্রকৃত কারণ প্রদর্শনই মানবতাবাদ।

প্রাচ্যে ও পাশ্চাত্যে মানবতাবাদের বিবর্তন সম্বন্ধে সুবিখ্যাত ফরাসী মনীষী অধ্যাপক সিলভালেতীর বেশ কয়েকটি মতবাদ রয়েছে। তিনি ১৯২২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যে সারগর্ভ বক্তৃতা করেছিলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে Humanism in the East and West নাম দিয়ে প্রকাশ করেছেন। আচার্য লেতী তাতে উভয় মানবতাবাদের স্বরূপ বর্ণনা করেছেন। তবে কীভাবে প্রাচ্যে ও পাশ্চাত্যে এ মানবতাবাদ বিকাশ লাভ করেছে তার ধারা তিনি বর্ণনা করেননি।  ঐতিহাসিক দিক থেকে আলোচনা করলে দেখা যায় যে, কোনো মানবতাবাদের পটভূমিতে রয়েছে দীর্ঘকালের বিবর্তনের ধারা আর এ ধারাকে সুস্পষ্টভাবে উপলব্ধি না করলে সে মতবাদকে সম্যকভাবে বুঝা যায় না।

পাশ্চাত্যের মানবতাবাদের উৎপত্তি সম্বন্ধে আলোচনা করলে দেখা যায়, সুদূর অতীতে মনীষার ক্ষেত্রে মানব-মনের যে প্রকাশ, তাতে মানব-জীবনই জ্ঞানের প্রধান লক্ষ্যবিষয় ছিলো না। গ্রীক চিন্তাধারা এ বিশ্বের আদি-সত্তার রূপ নিয়েই গবেষণায় ব্যাপৃত ছিলো। সোফিস্টগণই সর্বপ্রথমে মানব-কেন্দ্রিক আলোচনায় প্রবৃত্ত হয়ে তার মোড় ঘুরিয়ে দেন। পরবর্তীকালে সক্রেটিস সত্যিকার নীতির অনুসন্ধানে লিপ্ত হয়ে এ ধারাই অনুসন্ধান করেছেন বটে, তবে তার সুযোগ্য শিষ্য প্লেটোর নিকট আবার বিশ্ব-সত্তাই সর্বপ্রধান জ্ঞান-কেন্দ্ররূপে দেখা দিয়েছে। মানবাত্মার স্বরূপ ও তার অমরত্ব প্লেটো বা এরিস্টটল স্বীকার করলেও মানব-জীবনকে তারা উভয়েই এ বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ বিষয় বলে স্বীকার করেননি। গ্রীকদের চিন্তাধারার পতনযুগে এপিকিউরিয়ান, স্টোয়িক বা সন্দেহবাদিগণ যেসব মতবাদের অবতারণা করেছেন তাতে মানব জীবনের মূল সত্যই ছিল জ্ঞানের সর্বপ্রধান বিষয়বস্তু। তবে তাদের চিন্তায় মৌলিক কোনো কিছু না থাকায় এবং সেসব চিন্তায় ব্যাপকতাও না থাকায়, সেগুলো এ বিশ্বে কোন আলোড়নের সৃষ্টি করেনি। সীমিত পরিধিতে সেগুলো বিশিষ্ট অনুসারীদের মধ্যেই ছিলো সীমাবদ্ধ।

আদি যুগের অন্তে এবং মধ্যযুগের সূচনার পূর্বে গ্রীকদের চিন্তাধারায় সংস্পর্শে ইয়াহুদী ও খ্রিস্টধর্ম আসার পর যে অভিনব মিশ্র মতবাদের উৎপত্তি হয়, তাতে ভগবানের সঙ্গে এ পৃথিবীর সম্বন্ধ, এ পৃথিবীর উৎপত্তি, মানবজীবনের গতি ও লক্ষ্য সম্বন্ধে আলোচনা হলেও এ বিশ্বে মানুষের স্থান নির্ণয়ের কোন প্রয়াস দেখা যায়নি। ইয়াহুদী পণ্ডিতদের মধ্যে এবিস্টবুলাস গ্রীকদর্শনকে তাদের ধর্মগ্রন্থেরই এক নতুন সংস্করণ বলে মন্তব্য করেছেন। প্লেটো, হোমার প্রমুখ বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ মনীষীর ধ্যান-ধারণাকে তাদের শাস্ত্র থেকে ধার করা বিষয় বলে পরিহাস করেছেন। প্লোটিনাসের নব্য-প্লেটোবাদে যদিও আদর্শ হিসাবে ব্রহ্মজ্ঞান লাভকে গ্রহণ করা হয়েছে তবু এ বিশ্বে মানব-জীবনের স্থান নির্ণয়ের জন্য কোনো সাধনা করা হয়নি। মানব-জীবনের খ্রিস্টধর্ম সর্বপ্রথম গ্রীকদর্শনের সংস্পর্শে আসার পর থেকেই মানবজীবনের বিশ্বের একটি বিশিষ্ট মর্যাদা লাভ করে। পেটরিসটিক যুগে যীশুখ্রিস্টের ব্যক্তিত্বকে সর্বোচ্চ মান দেওয়ায় এবং ত্রিত্ববাদের বা Trinity-এর উৎপত্তি হওয়ায় যীশুখ্রিস্টের সঙ্গে সঙ্গে মানুষও এ বিশ্বের শ্রেষ্ঠ আসন লাভ করে।

এপোলোজিস্টদের চিন্তাধারার মধ্যে খ্রিস্টধর্মের বহিরঙ্গ ও অন্তরঙ্গ প্রভৃতি নিয়ে আলোচনায় অথবা গড় থেকে লগোজে (Logos) পৃথিবীর উৎপত্তির বিবরণ পাওয়া যায়। পেটরিসটিক চিন্তাধারার সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতিনিধি সেন্ট অগাস্টিনের মনীষায় ইতিহাস-দর্শনের আলোচনা একটি বিশেষ মর্যাদালাভের যোগ্য। এ’দর্শনে তিনি ইতিহাসের গতির নির্দেশ প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছেন যে,  ভগবান মানুষের ইতিহাসকে এমনভাবে নিয়ন্ত্রিত করেছেন, কতকগুলো লোক মুক্তিলাভ করে এবং কতকগুলো লোক লয়প্রাপ্ত হয়। পরবর্তীকালে অর্থাৎ স্কলাস্টিক যুগে মানবমানসের চিন্তাধারা চারটি বিষয়কে কেন্দ্র করে বিবর্তিত হয়েছে। প্রত্যয় ও যুক্তির সম্বন্ধ, ইচ্ছা ও বুদ্ধির সম্বন্ধ, প্রকৃতি ও ভগবানের অনুগ্রহের সম্বন্ধ এবং নির্বিশেষগুলোর সত্যিকার রূপ—এ’চার নিয়েই সে-যুগের চিন্তাধারা ছিলো পর্যবসিত। মধ্যযুগে পোপের শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় এবং মানব-মানসকে কেবলমাত্র খ্রিস্টধর্মের শাসন ও অনুশাসনের গণ্ডির মধ্যে চিন্তার স্বাধীনতা দেওয়ায় মনীষার ক্ষেত্রে অত্যন্ত সীমিত হয়ে পড়ে এবং মানব-জীবন কারণের অনুসন্ধিৎসা রুদ্ধ হয়ে পড়ে।

পঞ্চদশ শতাব্দীতে ইতালীতে রেনেসাঁ আন্দোলনের পূর্ব-পর্যন্ত সমগ্র ইউরোপে মধ্যযুগীয় পণ্ডিতীবিদ্যা অনুশীলনেই ছিল মগ্ন। পূর্বেই বলা হয়েছে, এ রেনেসাঁ আন্দোলনের কালেই এ-দুনিয়ায় ব্যষ্টি-মানসের চিন্তার স্বাধীনতার নীতির স্বীকৃতি লাভ করে।

প্রাচ্যের মানবতাবাদ সম্বন্ধে পূর্বেই বলা হয়েছে, সে মানবতাবাদের লড়াই ছিল মানুষের মধ্যে প্রেমের সম্বন্ধ স্থাপনের জন্য। ভারতীয় সাহিত্যে এ মানবতাবাদের যে ধারণা পরিবেশন করা হয়েছে তাতে বলা হয়েছে, এ বিশ্বের মূলে বিরাজমান রয়েছল সর্বমূলাধার একটি সত্তা, সে সত্তা থেকেই এ বিশ্বের উৎপত্তি। এ বিশ্বের উৎপত্তির মূলে রয়েছে মায়া, যার অবস্থান সদৃশ ও অদৃশ্যের মাঝে। কেননা, এক হিসাবে তার কোনো অস্তিত্ব নেই, আবার মূলসত্তা না হলেও তার একটি স্থিতি রয়েছে। তবে ব্রহ্ম ও জীবের সম্বন্ধ নির্ণয় প্রসঙ্গে উপনিষদের সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষ্যকার শংকরাচার্য মন্তব্য করেছেন-

ব্রহ্ম সত্য জগৎ মিথ্যা

জীবে ব্রহ্ম পরাপর

জীব মাত্রেই ব্রহ্মের অংশ হলে মানুষে মানুষে তো বটেই মানুষ ও ইতর প্রাণীর মধ্যে, এমনকি মানুষ ও বৃক্ষাদির মধ্যেও মৈত্রীর সম্বন্ধ প্রতিষ্ঠা হওয়া বাঞ্ছনীয়। অতি আধুনিককালে বেদান্তের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন, মানুষে মানুষে কেন প্রেমের সম্বন্ধ স্থাপিত হবে? তার উত্তর পাওয়া যায় সকল ধর্মেই, কেননা সকল মানুষের একই সৃষ্টিকর্তা। তবে মানুষ কেন ইতর জীবকে ভালবাসবে? তার উত্তর কেবল বৈদান্তিক ধর্মেই রয়েছে। কারণ উপনিষদে বলা হয়েছে, নির্গুণ ব্রহ্ম থেকেই এ জগতের সকল কিছুর উৎপত্তি কাজেই যেহেতু, একই ব্রহ্মের বিভিন্ন রূপ নিয়ে এ জগতের বিভিন্ন প্রাণি দেখা দিয়েছে এবং তাদের গোড়ায় রয়েছে একই ব্রহ্মের স্থিতি, এজন্যই তারা পরস্পরের সঙ্গে প্রেমের সম্বন্ধ আবদ্ধ হতে বাধ্য।

ভারতীয় সাহিত্যে মানুষের সঙ্গে ইতর জীবের মধুর সম্পর্কের এবং ইতর জীব কর্তৃক উচ্চতর নৈতিক আইনের সমর্থনের দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় রামায়ণ ও মহাভারতে, কাহিনী আকারে তা বর্ণিত হয়েছে এভাবে যে, পিতসত্য পালন করার জন্য রাজা রামচন্দ্র চতুর্দশ বৎসর বনবাস-ক্লেশ সহ্য করেন। ছদ্মবেশী রাবন সীতাকে হরণ করে পুষ্পক রথে রাজধানী লংকাতে গমন করাকালে শরূণরূপী জটাযুতার সঙ্গে যুদ্ধ করে সীতাকে মুক্ত করার চেষ্টা করে নিহত হয়েছে। বানর সেনার অধিনায়ক সুগ্রীব সর্বতোভাবে রামচন্দ্রকে সাহায্য করেছে।

রামায়ণ-মহাভারত ব্যতীত মধ্যযুগীয় সাহিত্যেও তার নিদর্শন পাওয়া যায়। কালিদাসের শকুন্তলা ইসলাম ও মানবতাবাদ নাটকে প্রকৃতির সঙ্গে শকুন্তলার যে নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে তা পরিস্ফুট হয়েছে মনুষতার পতিগৃহে যাবার প্রাক্কালে শকুন্তলা কেবল তার সাথী অনসূয়া ও প্রিয়ম্বদার নিকট থেকেই বিদায় গ্রহণ করেনি, আশ্রয়ের মৃগশিশু, লতা, হলু প্রভৃতি সকল বৃক্ষরাজির নিকট থেকেও বিদায় গ্রহণ করেছে।

ভারতীয় সাহিত্যে রাজা ভর্তৃহরি এখনও একটি বিশিষ্ট পদমর্যাদার অধিকারী। তিনি অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন-

“অয়ং নিজে পরবেতি গণনা লঘু চেতসাম উদার চরিতানামতু বসুধৈব কুটুম্বকং”

অর্থাৎ লমুচিত্ত লোকেরাই নিজেকে ও অপরকে ভিন্ন মনে করে, উদার চরিত্রের লোকের কাছে সমগ্র বসুধাই কুটুম্বের মত.

কেবল ভর্তৃহরিই নন, ভারতীয় সাহিত্যে আরও দৃষ্টান্ত রয়েছে। মানুষে মানুষে প্রেমের সম্বন্ধ স্থাপন করার উদ্দেশ্যে তুলশী দাস বলছেন-

“তুলসী যব জগমে আয়ো

জগ হাসে তুম রও

এয়সা করনে কর চলো

কেতুম হাসে জণ বও”

অর্থাৎ হে তুলসী, তুমি যখন এ জগতে এলে, তখন সকলেই হাসলো, কেবল তুমিই কাঁদলে। এমনভাবে জীবনযাপন করো, যাতে তুমি হেসে হেসে মরতে পারো, আর এ দুনিয়ার সকল লোক তোমার জন্য কেঁদে সারা হয়।

হিব্রু ধর্মগুলোর যে মানবতাবাদ বিকাশ লাভ করে তার প্রকৃতি কিন্তু অন্য ধরনের। হিব্রু ধর্ম বলতে ইয়াহুদী, খ্রিস্টান ও ইসলাম ধর্মকেই গণ্য করা হয়। এ তিন ধর্মের মধ্যে রয়েছে যোগসূত্র এবং এদের আদি প্রবর্তক হচ্ছেন হযরত ইব্রাহীম খলীল-উল্লাহ (আ)। তাঁর জীবনে যে মানবতাবাদের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়, তা হচ্ছে প্রকৃতি পূজার বিরুদ্ধে এক বিদ্রোহ। তিনি এক আল্লাহর ধারণার আলোকে এ জগতে নানাবিধ বস্তুকে পরীক্ষা করে, তাদের উপাসনার অযোগ্য বলে পরিত্যাগ করেছেন। এতেই সর্বপ্রথম এ জগতে মানবজাতির মুক্তি ঘোষণা করা হয়। তখন পর্যন্ত সূর্য, চন্দ্র বা নানাবিধ প্রাকৃতিক শক্তির নিকট মানুষ মাথা নত করতে অভ্যস্ত ছিল। তিনি বিদ্রোহ ঘোষণা করে সর্বপ্রথমে প্রমাণ করেন মানুষই সৃষ্টির সেরা জীব, মানুষ মাথা নত করবে একমাত্র সর্বশক্তিমান আল্লাহরই নিকট অন্য কারো কাছে নয়।

পরবর্তীকালে আল্লাহ সম্বন্ধীয় ধারণা আরও পরিষ্কার হয় হযরত মুসা (আ)- এর প্রবর্তিত ধর্মে। এ ধর্মেও মানুষকে সৃষ্টির সেরা করে একমাত্র আল্লাহকেই উপাস্য হিসেবে গ্রহণ করা হয়। তবে আল্লাহর নীতিকে প্রচার করা এই অত্যন্ত কঠোর রূপে।

চোখের পরিবর্তে চোখ, দাঁতের বদলে দাঁত (Eye for eye and tooth for tooth) হচ্ছে তখনকার মানব-জীবনকে সম্পূর্ণভাবে বিকশিত করে তোলার মাধ্যম। মানুষে মানুষে হিংসা-বিদ্বেষের ফলে যে কোলাহলের সৃষ্টি হয়, তারই প্রতিরোধ ব্যবস্থা হিসেবে গ্রহণ করা হলেও পরবর্তীকালে এ নীতি জীবন বিকাশের পথে সংকীর্ণ বলেই প্রতিভাত হয়। হযরত ঈসা (আ) উদাত্ত স্বরে ঘোষণা করেছেন, ‘যদি তোমার ডান গালে কেউ আঘাত করে তা হলে তার কাছে তুমি বাম গাল ফিরিয়ে দাও।” আবার বলেছেন, “তোমার প্রতিবেশীকে তুমি ভালবাসো।” কাজেই এ ক্ষেত্রে মানুষে মানুষে প্রেমের সম্বন্ধ স্থাপন করার জন্য রয়েছে বিপুল প্রয়াস। এ প্রেমের সম্বন্ধ স্থাপন করতে যেয়ে হযরত ঈসা (আ) নিজেও নির্যাতিত হয়েছেন।

ইয়াহুদী ও খ্রিস্টধর্মের আলোচনা করলে দেখা যায়, এ দুই ধর্মের প্রবর্তক হযরত মূসা (আ) ও হযরত ঈসা রুহুল্লাহ্ (আ) উভয়েই নির্যাতিত মানুষের কল্যাণের জন্য জীবন উৎসর্গ করতে সর্বদাই প্রস্তুত ছিলেন। হযরত মূসা (আ) নির্যাতিত বনি ইসরাইলদের পক্ষ অবলম্বন করে অত্যাচারী রাজা ফিরাউনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন এবং সর্বশেষে বনি ইসরাইলদের নিয়ে তিনি মিশর ত্যাগ করেছেন। তেমনি হযরত ঈসা (আ) দাসদের মুক্তির জন্য চেষ্টা করেছেন এবং ইয়াহুদীদের সুদের ব্যবসাও নষ্ট করার চেষ্টা করেছেন। তবে মানবতাবাদের যে সূচনা হযরত ইব্রাহীম খলীল উল্লাহ (আ)-এর জীবনে দেখা দেয়, তা হযরত ঈসা (আ) প্রবর্তিত প্রেমের মর্যাদার মধ্যেই সম্পূর্ণ বিকাশ লাভ করেনি। আরও নানাবিধ মূল্যমানের বিকাশের ফলে পরবর্তীকালে এ মানবতাবাদের ব্যাপ্তি অপরিহার্য হয়ে পড়ে। কেবলমাত্র ন্যায়বিচার বা প্রেমই মানুষের জীবনে কাম্য নয়, বরং মানুষে মানুষে ঐক্য ও চেতনা বা মানুষের মধ্যে এ দুনিয়ার সম্পদ সমানভাবে বণ্টনের যৌক্তিকতা প্রভৃতি মূল্যমানগুলোর অভ্যুদয়ের ফলে আল্লাহর ধারণার মধ্যে এগুলো পূর্ণ হিসেবে গ্রহণ করা অপরিহার্য হয়ে পড়ে। হযরত মুহম্মদ মোস্তফা (সা) প্রবর্তিত ইসলাম ধর্মে তাই আল্লাহর গুণের মধ্যে এগুলোকে স্বীকার করে নিয়ে মানব-জীবনকে পূর্ণ বিকাশের পথে নিয়ে যাওয়ার জন্য রয়েছে সাধনা।

বর্তমানকালে আমরা মানবতাবাদের ফলশ্রুতি হিসেবে যেসব মতবাদের সঙ্গে পরিচিত হচ্ছি, তাদের মধ্যে গণতন্ত্র, নারীর সমান অধিকার, চিন্তাজগতে ব্যষ্টির স্বাধীনতা ও এ দুনিয়ার সম্পদের উপর মানুষের সমান অধিকার প্রস্তুতি নীতি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। আমরা পাশ্চাত্যের মানবতাবাদের উৎপত্তি প্রসঙ্গে লক্ষ্য করেছি ব্যক্তি-স্বাধীনতা লাভের জন্যই তার উৎপত্তি হয়েছে এবং পরবর্তীকালে ধর্ম ও রাজনীতিতে তা প্রভাব বিস্তার করেছে।

প্রাচ্যের মানবতাবাদের মূল লক্ষ্য ছিল মানুষে মানুষে প্রেম, মৈত্রী ও করুণার প্রতিষ্ঠা। সে মানবতাবাদের শ্রেষ্ঠ উদাহরণ রয়েছে রামায়ণ, মহাভারত প্রভৃতি মহাকাব্যে।

হিব্রু ঐতিহ্য থেকে যে মানবতাবাদ বিকশিত হয়েছে তার মধ্যে উত্তরবিধ ভাবধারা বর্তমান। ঐতিহ্যের মধ্যে একদিকে রয়েছে মানুষে মানুষে মৈত্রীর প্রতিষ্ঠা, অপর দিকে রয়েছে আদর্শ সমাজ ও রাষ্ট্র গঠন করার ব্যবস্থা। সে মানবতাবাদ চরম বিকাশ লাভ করে জনাব রসূলে আকরাম (সা)-এর জীবনে এবং তাঁর বাণীতে। তিনি সে মানবতাবাদ কেবল প্রচার করেননি, নিজের জীবনেও তার রূপায়ণের চেষ্টা করেছেন এবং মদীনাতে আদর্শ সমাজ ও রাষ্ট্র গঠন করে জগৎ সভ্যতাকে দেখিয়েছেন কিভাবে সে-মানবতাবাদকে জীবনে রূপায়িত করা যায়।

তাঁর বাণীতেই আমরা সে মানবতাবাদের বীজমন্ত্রের উৎকৃষ্ট উদাহরণ পাই প্রথমেই তিনি আল্লাহর সঙ্গে তাঁর সম্বন্ধের স্বরূপ পরিষ্কার করে দিয়ে বলেছেন,

“আমি আল্লাহর রসুল, অর্থাৎ আল্লাহর অবতার, তাঁর পুত্র অথবা অংশীদার নই”।

তিনি যে মানুষ এবং মানুষেরই সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না প্রভৃতির অংশীদার তা পরিষ্কার ভাষায় ব্যক্ত করেছেন,

“আমি মানুষ ব্যতীত অতিরিক্ত কিছুই নই, আমি যখন তোমাদের ধর্মসংক্রান্ত বিষয়ে কোনো কিছু আদেশ করি, তখন তা গ্রহণ করবে এবং এ দুনিয়াব কোনো বিষয়ে আদেশ করলে, তখন আমি কোন মানুষ থেকে অতিরিক্ত কিছুই নই”।

এসব উক্তির মাধ্যমে তিনি সর্বপ্রথম তাঁর মানবিক সত্তার প্রতিষ্ঠা করে মানুষের মধ্যে ঐক্য চেতনা সঞ্চয়ের উদ্দেশ্যে বলেছেন,

“আল্লাহর সৃষ্ট সকল জীবই তার অন্তর্ভুক্ত এবং সে-ই আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয়, যে আল্লাহর সৃষ্ট জীবের সবচেয়ে অধিক মঙ্গল সাধন করে।”

আবার তিনি বলেছেন-

“কে সবচেয়ে বেশি আল্লাহর অনুগ্রহভাজন? সেই ব্যক্তি যার কাছ থেকে তার বান্দারা সবচেয়ে বেশি মঙ্গল লাভে সমর্থ হয়।”

“সেই ব্যক্তিই সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ, যার কাছ থেকে মানুষেরা নানাবিধ কল্যাণ লাভ করে।”

এভাবে মানব-সাধারণের কল্যাণ সাধনের জন্য তাদের মানসকে প্রস্তুত করে যাতে তাদের বাস্তবজীবনেও সে ভাবের রূপায়ণ হয়। এজন্য তিনি “কোন কাজগুলো সর্বোৎকৃষ্ট?” প্রশ্নের উত্তরে বলেছেন, কোনো মানুষের হৃদয়কে সন্তুষ্ট করা, কোনো ক্ষুধার্তকে আহার দান করা, কোনো বিপদগ্রস্ত লোককে সাহায্য করা, কোনো ব্যথিত লোকের ব্যথার উপশম করা এবং কোনো অন্যায়ভাবে কষ্টপ্রাপ্ত লোকের কষ্টের প্রতিকার করা।”

এ সকল উক্তির সারমর্ম থেকে আমরা এ সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি, সকল মানুষই সমান, তারা একই পরিবারভুক্ত লোকের মতো। মানুষের কল্যাণ-সাধন মানবজীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ কর্তব্য। এসব বাণী থেকেই পরবর্তীকালে সাম্য ও মৈত্রী প্রতিষ্ঠার অনুপ্রেরণা পাওয়া যায়। প্রকৃতপক্ষে জনাব রসুলে আকরাম (সা) এবিশ্বে গণতন্ত্রের বীজ বপন করে গিয়েছিলেন। মদীনাতে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে তিনি অতি সহজেই সে রাষ্ট্রের রাজাধিরাজ বলে আপনার নাম ঘোষণা করতে পারতেন, তবে তা তিনি করেননি এবং যাতে তা বংশানুক্রমিক রাজত্বে পরিণত না হয় তার জন্য তার বংশের অপর কোনো মানুষকে তাঁর স্থলবর্তী হিসেবে মনোনয়ন করেননি।

নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা প্রসঙ্গে সর্বপ্রথমে তখনকার দিনের সমাজ-ব্যবস্থার উল্লেখ প্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে। রসূলে আকরাম (সা)-এর জন্মের সময়ও আরব দেশের ইয়ামন প্রভৃতি প্রদেশে মাতৃকেন্দ্রিক (Maternal) সমাজ ছিল বর্তমান। এ দুনিয়ার সমাজ গঠনের ইতিহাসের পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, মাতৃপ্রধান সমাজ-ব্যবস্থা থেকে কালের ধারায় পিতৃ-প্রধান সমাজের উৎপত্তি হয়েছে। বহুযুগ পর্যন্ত পুরুষেরা নারীদের অধীন থাকায় পুরুষদের সমাজে যে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয় তার ফলেই প্রায় সকল সমাজে নারী নির্যাতন একটা ফ্যাশন হয়ে পড়ে। আরবের মাটিতে, সে নারী নির্যাতন রসূল করীম (সা)-এর অবির্ভাবের পূর্বে চরমরূপ লাভ করে। কোনো সম্পত্তিতে নারীর তো কোনো অধিকার ছিলই না, উপরন্তু একসঙ্গে বহু নারীকে বিয়ে করতে কোনো বাধাবিপত্তিও ছিল না। নারীকে পণ্যের মত পুরুষের ভোগের সামগ্রী হিসেবে গণ্য করা হতো। এমন পরিবেশেও সে যুগে জন্মগ্রহণ করেও আল্লাহর রসুলের মনে কোন প্রতিহিংসামূলক মনোবৃত্তি দেখা দেয়নি বরং তিনি নারীর বন্ধন মুক্তির জন্য সর্বতোভাবে চেষ্টা করেছেন। তাঁকে প্রশ্ন করা হয়েছিলো,

“আমি কাকে সম্মান প্রদর্শন করবো?”

তার উত্তরে তিনি বলেছেন, ‘তোমার মাকে’

এরূপ তিনবার উত্তর দানের পর বলেছেন, “তোমার বাবাকে”।

এতে স্পষ্টই প্রতীয়মান হয়, সন্তানের কাছে মায়ের স্থান বাপের তিন গুণের মতো। আবার স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন,

“বেহেশতের স্থিতি মায়েদের পদতলে”

এসব সাধারণ নীতি যাতে সমাজ-জীবনে চালু করা হয় তার জন্য বলেছেন,

“আল্লাহর আদেশ-তোমরা তোমাদের নারীদের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করবে। কেননা তারাই তো তোমাদের মাতা, কন্যা ও ফুফু বা খালা। নারীদের অধিকারগুলো পবিত্র। দেখো কোনো মতেই যেনো তাদের ন্যায্য অধিকার ক্ষুণ্ন না হয়।”

আল-কুরআনের ভাষায় তিনি পরিবারে ও সমাজে নারীর অধিকার ঘোষণা করেছেন।

চিন্তার ক্ষেত্রে মানুষের স্বাধীনতা প্রসঙ্গে তাঁর বাণীগুলো বিশেষভাবেই প্রণিধানযোগ্য। আল্লাহ যুক্তির চেয়ে উৎকৃষ্টতর কোনো কিছুই সৃষ্টি করেননি, অথবা (যুক্তি থেকে) অধিকতর ত্রুটিহীন অথবা সুন্দরতর কোন কিছু সৃষ্টি করেননি। এর মাধ্যমেই আমাদের জ্ঞানের উৎপত্তি। আবার, যুক্তি যাদের নেই তাদের পাপ-পুণ্যের কোনো বিচারও নেই। যুক্তি বা সজ্ঞানকৃত কর্মেরই মানুষ ফললাভ করে।

যুক্তি-জ্ঞানের প্রতি এতো গুরুত্বরোপ তাঁর পূর্বে কোনো নবীই করেননি। এ যুক্তির প্রতি শ্রদ্ধার ফলেই পঞ্চদশ শতাব্দীতে ইউরোপে রেনেসাঁ আন্দোলন দেখা দেয়। প্রকৃতপক্ষে ৬ষ্ঠ শতাব্দীতে জনাব রসূলে আকরাম (সা) যুক্তিকে এ জীবনে প্রতিষ্ঠার জন্য মধ্যযুগের অন্ধকারের মধ্যেও নির্দেশ দান করেছিলেন।

বর্তমানকালে মানবতাবাদের সর্বশ্রেষ্ঠ মন্ত্র হচ্ছে, এ দুনিয়া থেকে শোষণের অবসান, যেকোনোভাবেই এ দুনিয়া থেকে শেষকদের উৎখাত করে যাতে এ দুনিয়ার সম্পদ দুর্বল মানুষ সমানভাবে ভোগ করতে পারে, তার ব্যবস্থা করাই এ যুগের মানবতাবাদীদের মূল লক্ষ্য। এ মানবতাবাদেরই এক বিশেষ প্রকাশিয় রূপ সোভিয়েত রাশিয়ার সমাজবাদ ও চীন দেশের নব্যগণতন্ত্র। এ দুনিয়ায় সম্পদ কোনোকালেই বা কোনোভাবেই কোনো ব্যক্তির, কোনো গোত্রের, কোনো দলের বা কোনো শ্রেণির কুক্ষিগত না হয়, সেজন্য আল-কুরআন এ দুনিয়ার সম্পরের মালিকানা শুধুমাত্র আল্লাহরই বলে ঘোষণা করেছে। সে মালিকানার অর্থ হলো, যেভাবে চন্দ্র-সূর্যের আলো, আকাশ-বাতাস, নদ-নদী, খাল বিল প্রভৃতির পানি ভোগ করার অধিকার প্রত্যেক মানুষের রয়েছে, তেমনি এ পথিবীর সম্পদ ভোগ করার সমান অধিকার রয়েছে। এ দুনিয়ার সম্পদ বলতে খনিজ-ধাতব পদার্থ, বনজবৃক্ষাদি ভূমি থেকে উৎপন্ন শস্যাদি সবকিছুই বুঝা যায়। এসব বিষয়বস্তুতে সকল মানুষের সমান অধিকার থাকলে কলহ-কোন্দল প্রভৃতির সৃষ্টি হতে পারে বলে যাতায়াত ভাষাগত বৈশিষ্ট্য বা ভৌগোলিক ব্যবধানের জন্য মানুষের মধ্যে বিভিন্ন দেশ গড়ে উঠেছে। ফলে, সেই দেশের সম্পদের উপর সেই দেশের মানুষের বিশেষ অধিকার রয়েছে সত্য, তবে সেই দেশে উদ্বৃত্ত থাকলে সে দেশের মানুষের পক্ষে সেই উদ্বৃত্ত অপর দেশের বা ঘাটতি অঞ্চলের লোকের জন্য রিজার্ভ করে রাখা অবশ্য কর্তব্য বলে আল্লাহ তা’আলা সূরা ইউসুফে নির্দেশ দিয়েছেন।

এ দুনিয়ার সম্পদ, যার একমাত্র মালিক স্বয়ং আল্লাহ তা’আলা, যাতে সর্বাবস্থায় কোনো বিশেষ ব্যক্তি বা দল ভোগ না করে তার জন্য তাদের পক্ষের প্রয়োজনের অতিরিক্ত কোনো কিছু আত্মসাৎ করা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। হযরত উসমান গণী (রা)-এর খিলাফতকালে শাহানশাহী ভোগ-বিলাসের বিরুদ্ধে এবং অযথা একদলের মধ্যে আল্লাহর সম্পদ ভাগ-বণ্টনের প্রতিকার করে হযরত আবূ যর গিফারী (রা) বিপ্লবী আন্দোলন প্রবর্তন করেছেন। পরবর্তীকালে যাহিরী মাযহাবের প্রতিষ্ঠাতা ইমাম ইবনে হাজম মানুষের প্রয়োজনেরও সীমা নির্দেশ করেছেন। মহল্লায় তিনি স্পষ্টভাবে বলেছেন, একজন মানুষের প্রয়োজনের মধ্যে রয়েছে তার শরীরকে টিকিয়ে রাখার জন্য পুষ্টিকর আহার্য; তার লজ্জা নিবারণের জন্য ও শীত গ্রীষ্মাদি বিভিন্ন ঋতুতে তার শরীর রক্ষার জন্য উপযুক্ত পোশাক, বিভিন্ন ঋতুতে ঝড়-বৃষ্টি, বাদল বা শীতের প্রকোপ থেকে রক্ষা করতে পারে এমন বাসগৃহ।

তাই স্পষ্টই প্রতীয়মান হয়, হযরত রসূলে আকরাম (সা) যে মানবতাবাদের প্রবর্তন করেছিলেন এবং তার যে বীজমন্ত্র দিয়েছিলেন, তার আলোকেই বর্তমান কালের মানবতাবাদ আবর্তিত বা বিবর্তিত হচ্ছে। হযরত রসূলে আকরাম (সা)-এর মানবতাবাদ ছিল বাস্তবধর্মী। সে মানবতাবাদ কেবল নীতি নির্দেশ করেই ক্ষান্ত হয়নি, তাকে বাস্তব-জীবনে রূপায়ণের জন্যও প্রেরণা দান করেছেন। আজকের দুনিয়া তাঁর সে নীতি গ্রহণ করলে অনেক দ্বন্দ্বেরই অবসান হত, তা নিঃসন্দেহে বলা যায়।

 

৬১৯ বার পঠিত

শেয়ার করুন

মতামত প্রকাশ করুন

Scroll to Top