মানবসভ্যতার ইতিহাস আমাদের শিক্ষা দেয়, যে কোনো রাজনৈতিক আদর্শ প্রতিষ্ঠা করার চেয়ে তা টিকিয়ে রাখা এবং ন্যায়ের ভিত্তিতে গতিশীল রাখা সবচেয়ে কঠিন ও কষ্টসাধ্য ব্যাপার। রাজনৈতিক বিজয় অর্জন বা রাজনৈতিক বিপ্লবের মাধ্যমেই কেবলমাত্র কোনো রাজনৈতিক চিন্তা বাস্তবায়নের পটভূমি তৈরি হয়। কিন্তু তার মানে এই নয়, বিজয় অর্জন মাত্রই সে চিন্তার বাস্তবায়ন হয়ে যায়। এজন্যই মুসলিম উম্মাহর বড় বড় আলেমগণ তাদের চিন্তাকে তুলে ধরার ক্ষেত্রে জ্ঞানের পুনর্জাগরণ ও সভ্যতার পুনর্জাগরণকে একত্রে তুলে ধরেছেন। অর্থাৎ জ্ঞানকে কেন্দ্র করে চিন্তা আবর্তিত হবে, সেই চিন্তার আলোকে গড়ে উঠা রাজনৈতিক শক্তি সমন্বিত বিপ্লবের জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাবে। এভাবে জ্ঞান ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড একটি সামগ্রিক লক্ষ্যমাত্রার দিকে সমান তালে ধাবিত হবে।
এক্ষেত্রে রাসূল (স.) এর জীবনের দিকে লক্ষ্য করলে আমরা এই বিষয়টিই দেখতে পাই। মূলত রাসূল (স.) এর মাদানী জীবন হলো তাঁর রাজনৈতিক জীবন এবং প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিকব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার সূচনাকাল। মাদানী জীবনের দশ বছরে রাসূল (স.) মদীনায় প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রকে শক্তিশালী ও মজবুত ভিত্তির উপর স্থাপন করেন। পররাষ্ট্রনীতি, অর্থনীতিসহ সকল ক্ষেত্রে বিকল্প প্রস্তাবনা দেন, বিদ্যমান সমাজ-ধারণার বিপরীতে নতুন সমাজব্যবস্থার মডেল হাজির করেন। মদীনায় তার প্রতিষ্ঠিত সমাজব্যবস্থা এমন এক টেকসই ও মজবুত ভিত্তির উপর দাঁড়ায়, যার উপর ভর করে ইসলামী সভ্যতা সুদীর্ঘ ১২০০ বছর ন্যায়ভিত্তিকভাবে গোটা দুনিয়া শাসন করে।
এখন প্রশ্ন হলো রাজনৈতিক বিজয় পাকাপোক্ত বা স্থায়ী করতে হলে কী প্রয়োজন? কিংবা রাজনৈতিক বিপ্লব স্থায়ীভাবে টিকিয়ে রাখতে হলে কোন বিষয়টি আবশ্যক?
এক্ষেত্রে এটি সুস্পষ্ট যে, ৩ টি বিষয়ের সামগ্রিক সমন্বয় ছাড়া একটি রাজনৈতিক বিজয় বা রাজনৈতিক বিপ্লব পাকাপোক্ত করা বা স্থায়ীভাবে টিকিয়ে রাখা কখনোই সম্ভব নয়। বিষয় তিনটি হলো–
• হাকিকতমুখী ‘বুদ্ধিবৃত্তি’
• ইরফানমুখী ‘সংস্কৃতি’
• আদালতমুখী ‘অর্থনীতি’
এ বিষয়গুলো একটি গাছের শিকড়ে সাথে তুলনীয়। গাছের শিকড় সাধারণত সবদিক থেকে সমান তালে বৃদ্ধি পায়, ফলে গাছের গোঁড়া মজবুত ও পাকাপোক্ত হয়। সময় যত অতিবাহিত হয়, গাছের শিকড়ও তত বিস্তৃত হয় এবং জমিতে গাছের স্থায়ী আসন গড়ে উঠে।
ঠিক তেমনি যদি রাজনৈতিক বিজয়ের স্থায়ীত্বের সাথে সম্পৃক্ত তিনটি কার্যকারণ, অর্থাৎ বুদ্ধিবৃত্তিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রের যে কোনো একটি শক্তিশালী হয় এবং অপরটি দুর্বল হয়, তাহলে বিজয় স্থায়ী হবে না। গাছের একদিকের শিকড় যদি মাটিতে বাড়তেই থাকে, আর অপরদিকে না বাড়ে, তাহলে সামান্য বাতাসেই গাছ ভেঙে পড়বে; রাজনৈতিক বিজয়ের স্থায়িত্বের বিষয়টিও তেমন। এর একদিক শক্তিশালী ও অপরদিকে দুর্বল হলে বিজয় ব্যর্থ হবে। বাস্তবতা হলো এর প্রতিটি দিকই একে অপরের পরিপূরক। এ কারণে রাজনৈতিকভাবে স্বাধীন একটি জাতি যদি বুদ্ধিবৃত্তিক ও চিন্তাগতভাবে পরাধীন কিংবা পরনির্ভরশীল হয়, তাহলে তাদের পক্ষে রাজনৈতিক স্বাধীনতা টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়, বরং তা হবে কথিত রাজনৈতিক স্বাধীনতা!
একইভাবে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নিজস্ব অবস্থান ও সাংস্কৃতিক স্বকীয়তা না থাকলে একটি জাতি দারিদ্রতা ও আত্মপরিচয়ের সংকটে নিপতিত হয়। ফলশ্রুতিতে তারা আত্মবিশ্বাস ও বিজয়ী চেতনা হারিয়ে ফেলে।
বৃটিশ পরবর্তী বাংলায় বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদীরা মূলত এ তিনটি ক্ষেত্রে ধ্বংস সাধনের মাধ্যমেই তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে। তারা বুদ্ধিবৃত্তিক দাসত্বের শৃঙ্খল, অর্থনৈতিক শোষণ ও সাংস্কৃতিক আধিপত্য চাপিয়ে দেয়, যার ফলে মুসলমানরা হীনমন্য হয়ে পড়ে।
এখানে ভিন্ন আরেকটি দিক আছে। শুধুমাত্র রাজনৈতিক ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার জন্য দুটি বিষয়ের উপস্থিতি থাকা প্রয়োজন, তা হলো–
• ক্যারিশম্যাটিক লিডার এবং
• শক্তিশালী সংগঠন
এ দুইয়ের উপস্থিতি থাকলেই তা করা সম্ভব। আর তাই রাজনৈতিক ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়াটাই রাজনৈতিক বিজয় বা রাজনৈতিক বিপ্লবের স্থায়ীত্বের ক্ষেত্রে মূল প্রশ্ন নয়। সভ্যতাগত অবস্থান বা শক্তিশালী ভিত্তি নির্মাণের জন্য যে কোনো রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের বুদ্ধিবৃত্তিক সংকট, অর্থনৈতিক শোষণ ও সাংস্কৃতিক পরনির্ভরতা কাটিয়ে উঠা আবশ্যক। চিন্তাগতভাবে কোনো জাতি যদি অপর জাতির অনুকরণ করতে শুরু করে, তাহলে সে জাতির সৃজনশীলতা ও স্বকীয়তা নষ্ট হয়ে যায়। ফলশ্রুতিতে সে জাতির তৈরিকৃত যে কোনো কিছুই পরনির্ভর ও অনুকরণমূলক হয়ে ওঠে।
একইভাবে সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয় ও স্বকীয়তা টিকিয়ে রাখতে না পারলে জাতীয় চিন্তা ও মন-মগজ ভিন্ন সংস্কৃতির অনুবর্তী হয়ে ওঠে। ফলশ্রুতিতে বাহ্যিকভাবে সে জাতির বর্ণ ও ভাষা ভিন্ন থাকলেও তারা অভ্যন্তরীণভাবে হুবহু অন্য জাতির মডেলে পরিণত হয়। এ প্রেক্ষিতে গত শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ইসলামী চিন্তাবিদ ও দার্শনিক মুহাম্মদ আসাদ বলেছিলেন,
- “নিজস্ব সাংস্কৃতিক ভিত্তি না থাকলে কোনো চিন্তা অপর চিন্তার সম্মুখে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিতে পারে না কিংবা ভিন্ন পরিচয় বহন করতে পারে না।”
অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও বিষয়টি অনুরূপ। অর্থনৈতিকভাবে পরনির্ভরশীল হয়ে রাজনৈতিক বিজয় বা রাজনৈতিক বিপ্লব পাকাপোক্ত করা বা স্থায়ীভাবে টিকিয়ে রাখা অসম্ভব। ইতিহাসে এ বিষয়টি সুস্পষ্ট। একজন ফরাসি চিন্তাবিদ ও সাহিত্যিক বলেছিলেন, “অর্থনৈতিকভাবে যার কোনো ভিত্তি নেই বা যে দরিদ্র অবস্থায় আছে, তার মাধ্যমে কোনো আর্ট কিংবা সৃজনশীল কোনো কিছু করা সম্ভব নয়। কারণ যার খাবার ও সমস্ত নিত্য প্রয়োজনীয় বস্তু অন্য কারো কাছ থেকে আমদানি করা, অর্থাৎ নিজের উৎপন্ন নয়, সে উপকরণগুলো ব্যবহার করে তার তৈরিকৃত কোন কিছু কি সৃজনশীল আর স্বকীয় হতে পারে?” আবার এ বিষয়টিও এখন সমভাবে প্রণিধানযোগ্য যে, বর্তমান অর্থনীতি মানুষের জীবনের শতকরা ৮০ ভাগের সাথে সংশ্লিষ্ট। অতএব, অর্থনৈতিক ভিত্তি না থাকলে কখনোই রাজনৈতিক বিজয় বা রাজনৈতিক বিপ্লব পাকাপোক্ত করা বা স্থায়ীভাবে টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে না, কারণ অর্থনৈতিক ভিত্তি বাদ দিলে মানুষের জীবনের বৃহদাংশই আওতাবহির্ভূত থেকে যায়!
এখন জিজ্ঞাসা হলো এ তিনটি বিষয়কে সমন্বিতভাবে কীভাবে এগিয়ে নেয়া যায়? এক্ষেত্রে পদ্ধতি কী?
পদ্ধতিগুলো হলো—
• সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা
• মন-মগজের বিস্তৃতি
• বুদ্ধি ও চিন্তার লালন
সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার ক্ষেত্রে অবশ্যই ক্রমাগত নিজেদেরকে নবায়ন করা, যুগের প্রেক্ষিতে চিন্তা করা, সময়ের আলোকে সর্বোচ্চ আপডেট হওয়া সবচেয়ে জরুরী বিষয়; যে বিষয়টিকে যুগের গাজ্জালী খ্যাত মহান আলেম ও দার্শনিক আল্লামা ত্বহা আব্দুর রহমান বলেছেন ‘তায়াক্কুল’ ও ‘তায়াম্মুল’।কিছু উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হলো–
• মানবতার মুক্তির দূত রাসূল (স.) মদীনা রাষ্ট্রেও সবচেয়ে আপডেটেড ও উন্নত পরিকল্পনা পেশ করেন। তিনি স্বতন্ত্র শিক্ষা, আদালত ও প্রশাসনের জন্য মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেন, দরিদ্রতা দূরীকরণকারী ও মানুষের মুক্তিকামী অর্থনীতির জন্য বিকল্প বাজার প্রতিষ্ঠা করেন।
• সুলতান ফাতিহ তার সময়ের সবচেয়ে আপডেটেড পরিকল্পনা ও উন্নত প্রযুক্তির প্রস্তাবনা দিয়ে ইস্তাম্বুল বিজয়ের দিকে ধাবিত হন।
• এ শতাব্দীর নাজমুদ্দিন এরবাকান শুধু একজন নেতা নন, তিনি একজন বিশ্ব বিখ্যাত বিজ্ঞানী এবং তার গঠিত আন্দোলনেও ছিলো শিক্ষাবিদ আর বিজ্ঞানীদের সমন্বয়। তিনি যখন ক্ষমতায় এসেছিলেন, তার নির্বাচনী মেনিফেস্টো তৈরি করিয়েছিলেন ৫০০ জন আন্তর্জাতিক মানের অধ্যাপকের মাধ্যমে। এ যুগের গ্রেট পরিকল্পনা তথা নতুন বিশ্বব্যবস্থার পরিকল্পনাও এই আন্দোলন থেকেই উঠে এসেছে। সুতরাং, সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা ব্যতীত কোনকিছুই সম্ভব নয়।
আবার, মন-মগজের বিস্তৃতির জন্য জ্ঞানগত ক্ষেত্রে গ্রহণের মানসিকতা, উদারতা এবং বিস্তৃত ভঙ্গিতে চিন্তা করা আবশ্যক। কারণ উপরোক্ত সব পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন এই বিষয়ের উপরেও নির্ভরশীল।
আর এ দুটি পদ্ধতির সমান্তরালে বুদ্ধি ও চিন্তার লালন, ক্রমাগত বিকাশ একইসাথে গুরুত্ববহ; যাতে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা ও মন-মগজের বিস্তৃত অবস্থান বুদ্ধি ও চিন্তাগত দিক থেকে লালন করা যায়। কম্যুনিস্ট তাত্ত্বিক লিও ট্রটস্কি তার “The Permanent Revolution” গ্রন্থে এ পদ্ধতিগুলোই তুলে ধরেছেন। একইসাথে ট্রটস্কি এ বিষয়টিও স্পষ্ট করেছেন, এ পদ্ধতিগুলোর সমন্বয় না হলে কোনো বিপ্লব আর যাই হোক, পার্মানেন্ট বা স্থায়ী হবে না।
আর এসবের মাধ্যমেই মূলত বিপ্লবের ভিত্তি আত্ম-শক্তি-প্রবুদ্ধ মানুষেরা গড়ে উঠেন এবং সভ্যতাকে স্থায়ীত্ব দিয়ে থাকেন। আত্ম-শক্তি-প্রবুদ্ধ ব্যক্তিত্ব তথা যুগের ইবনে খালদুন, আল মাওয়ার্দী, আল্লামা ইকবালরা উঠে না আসলে টিকে থাকা অসম্ভব এবং অসম্ভব।
সুতরাং পদ্ধতিগুলোর সমন্বয়ে তিনটি বিষয়কে সামগ্রিকভাবে অগ্রসর করার মাধ্যমেই কেবলমাত্র একটি রাজনৈতিক বিজয় বা রাজনৈতিক বিপ্লবকে জ্ঞান ও সভ্যতার পুনর্জাগরণের বয়ানগত মাত্রায় পৌঁছানো সম্ভব। না হয় সে রাজনৈতিক বিজয় বা রাজনৈতিক বিপ্লব শুধুমাত্র কথিত আলাপ অথবা কাল্পনিক রোমান্টিকতায়ই থেকে যাবে, কখনোই একটি বিশ্বজনীন বয়ানে পরিণত হবে না।