ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থা (মাদ্রাসা শিক্ষা) কিভাবে গ্রাউন্ড হারালো

আমরা যদি ইসলামি রাষ্ট্রব্যবস্থার মূলনীতি ও দায়িত্বকে পর্যালোচনা করি তাহলে দেখতে পাই, ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থায় সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হতো দুটি জিনিসকে।

• সামাজিক নিরাপত্তা।

• আদালত।

ইসলামী সভ্যতায় শিক্ষাব্যবস্থা ছিল সম্পূর্ণ স্বাধীন একটি ব্যবস্থা যেখানে রাষ্ট্র কখনো হস্তক্ষেপ করতে পারতো না। হ্যাঁ, রাষ্ট্র ফান্ডিং করতো কিন্তু রাষ্ট্রের কোন ধরণের কর্তৃত্ব ছিল না শিক্ষাব্যবস্থার উপর। রাষ্ট্র শুধুমাত্র সামাজিক ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা বিধান করতো।

বর্তমানে পাশ্চাত্যের আদলে যে শিক্ষাব্যবস্থা আমরা দেখি তা কতটা স্বাধীন, এই প্রশ্ন যদি করা হয় তাহলে সর্বপ্রথম পাশ্চাত্যের মনোভাব বুঝতে হবে।পাশ্চাত্য এই দুনিয়ার  সবকিছুকেই রাজনীতিকরণের আওতাভুক্ত হিসেবে বিবেচনা করে এবং সেভাবেই তা নিয়ন্ত্রণ করে। বর্তমান আধুনিকতার সবচেয়ে বড় সমস্যাটা এখানেই যে, সবকিছুকেই সে রাজনীতিকরণ করে নেয় এবং তা অতি স্বাভাবিক হিসেবে গণ্য হচ্ছে দার্শনিকদের কাছে।

ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থা কেমন ছিল?

উপরে উল্লেখ্য প্রশ্নটির ধারণা পেতে চলুন আমরা কয়েকশ বছর একটু পিছিয়ে যাই। ঐতিহাসিকভাবে আমরা জানি যে, পাশ্চাত্য দর্শনের ভিত্তিমূলে কোন নবী-রাসূল না থাকায় তারা তাদের বিশিষ্ট কবিদেরকে নবীর মতই মূল্যায়ন করে। যেমন- বৃটিশরা শেক্স-পিয়ারকে, জার্মানরা গ্যোটেকে এই দৃষ্টিতে দেখে থাকে। পাশ্চাত্য দর্শনের মূল ভিত্তি রচয়িতা এবং জ্ঞানগত ভিত্তির প্রতিষ্ঠাকারী যেহেতু জার্মানরা, সে হিসেবে আমরা জার্মান কবিদের কথাকেই বিবেচনায় নিয়ে চলুন আজকের আলোচনাটুকু শুরু করি।

• জার্মান কবি ‘গ্যোটে’ তৎকালীন সময়ে ইসলামী সভ্যতার শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে বর্ননা করতে গিয়ে শুধুমাত্র ইস্তাম্বুলের চিত্র তুলে ধরতে গিয়ে অভিভূত বারবার। তিনি ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন-

 “শুধুমাত্র ইস্তাম্বুলেই প্রায় ৯০০ মাদ্রাসা রয়েছে এবং ২৫০ টির মতো মসজিদ রয়েছে। মুসলিমদের শিক্ষাব্যবস্থা এমন এক শিক্ষাব্যবস্থা যেখানে সব ধরণের মৌলিক শিক্ষা প্রদান করা হয় এবং শিক্ষার্থীরাও এসকল মৌলিক শিক্ষা শুদ্ধ্ব অন্তঃকরণের সাথে গ্রহণ করে। এই শিক্ষাব্যবস্থা থেকে যারা নূন্যতম শিক্ষা নিয়েও বের হয় তারা  কেবলমাত্র ‘হাকীকত’ ছাড়া অন্যকিছুকে ধর্তব্যের মধ্যে নেয় না। এমনকি তাদের সামনে সুলতান হোক কিংবা খলীফা, হাকীকতকে তাঁঁরা এতোটাই প্রাধান্য দেয় যে খলিফা অথবা সুলতানের প্রভাব একদম নস্যি ওদের দৃষ্টিতে। কাউকেই  তাঁঁরা পরোয়া করে না”।

এখানে মূলত জার্মান এই কবি তৎকালীন আলেমদের প্রতি ইংগিত করেছে। অর্থাৎ তৎকালীন আলেমরা এই ধরনের উচুঁ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ছিলেন। আর এর মূল কারণ ছিল ইসলামী সভ্যতার প্রতিষ্ঠিত শিক্ষাব্যবস্থা।

বর্তমান সময়েও আমরা প্রায় একই চিত্রই প্রত্যক্ষ করি। এখনো যারা মাদ্রাসায় শিক্ষা সমাপ্ত করে, অর্থাৎ আলেমরা পূর্বের সেই সিলসিলার আলোকে এখনো সমাজে প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব হিসেবে পরিচিত। ইসলামের ইতিহাসের ক্রান্তিকালেও যদি মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থার প্রভাব এমন হয়, তাহলে তৎকালীন আমাদের সভ্যতার শিক্ষাব্যবস্থা কেমন ছিলো তা কল্পনার পরিধিতেও আমরা ধরতে পারিনা।

এবার চলুন মূল আলোচনায় আসা যাক,

১৯ শতকের আগে বিশ্বব্যাপী শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যম ছিল আরবী অর্থাৎ সকলেই ইসলামী সভ্যতার শিক্ষাকে মানদন্ড হিসেবে গ্রহণ করেছিল। এসময় পাশ্চাত্য দর্শনের দার্শনিকগণ একটা বিষয় লক্ষ্য করেন যে, তৎকালীন ইতিহাসে ইউরোপের কোন ঠাই নেই কেননা তৎকালীন শিক্ষাব্যবস্থায় আধুনিক যুগের শুরু ৫৭০ খ্রিস্টাব্দ থেকে অর্থাৎ রাসূল (সা) এর জন্মসাল থেকে। এ ব্যাপারটি পাশ্চাত্যের দার্শনিকদের ব্যাপক পীড়া দিত। তাই পাশ্চাত্যের দার্শনিকরা ইমানুয়েল কান্টের ‘ক্রিটিক অফ পিউর রিজন’ এবং তার পূর্বের বিখ্যাত দার্শনিক দেকার্তের কার্টেসিয়ান তত্ত্বের আলোকে এক নতুন থিওরী দাড় করায়। সেটি হচ্ছে-“আমরা সময়ও সৃষ্টি করতে পারি, আমরা ইতিহাসও সৃষ্টি করতে পারি” তাদের অনুসরণে পরবর্তী সকল দার্শনিকরাও এ জাতীয় কথাই বলেছেন! এরপর-ই ইতিহাস থেকে মুসলিমদের মুছে দিতে এক ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করতে পাশ্চাত্যের ঐতিহাসিকরা নিজেদের মতো করে বিশ্বের ইতিহাসকে সাজিয়ে নেয়।

১৪ শতকের পর থেকে ১৮ শতক পর্যন্ত যুগের নাম তারা দেয় রেনেসাঁর যুগ। এরপরের যুগের নাম দেয় আধুনিক যুগ এবং ১৪ শ শতক পর্যন্ত যুগের নাম তাঁরা দেয় মধ্যযুগ।

এই যে “ইউরোপীয় রেঁনেসা” (রেঁনেসার সংজ্ঞা বা অর্থ হল- পুনর্জাগরণ)  শব্দটি আমাদের শিক্ষা দেয়া হয়, সে সম্পর্কে আমরা কতটুকু চিন্তা করেছি? এই শব্দের উৎপত্তি কেন হয়েছে, কীভাবে হয়েছে তা নিয়ে আমরা কেউ কখনো কি প্রশ্ন করেছি? এছাড়াও বেশ কিছু প্রশ্ন থেকে যায়। যেমন-

বৃটিশদের কি এমন ছিলো যে তাদের পুর্নজাগরন হবে?

– ফ্রান্সের পূর্বে কি ছিলো?

– জার্মানির পূর্বে কি ছিলো?

-তাদের কি কোন ইতিহাস আছে?

-পূর্বের বিশাল কোন সভ্যতা ছিল?

(শুধুমাত্র একটি দেশ এক্ষেত্রে বলতে পারে, আর তা হলো ইটালি। কারণ রোমান সভ্যতার যা ছিলো তা সেখানেই ছিল, সে অনুযায়ী তারা বলতে পারে আমরা পুনর্জীবিত করবো।)

কিন্তু গোটা পাশ্চাত্য চতুর্দশ, পঞ্চদশ এবং ষষ্ঠদশ শতাব্দীকে বলে রেঁনেসা পিরিয়ড। তাহলে এই শব্দ কখন আবিষ্কার হলো?

জবাব হচ্ছে, “অষ্টাদশ শতকের আগে রেঁনেসা বলতে কিছুই ছিলনা।”

শেক্সপিয়ার, দেকার্তে এরা যখন কাজ করেছে, তারা কখনই কি বলেছে যে, “রেঁনেসা তৈরী করবো?” কেনইবা বলবে? কারণ পূর্বে তো তাদের কিছুই ছিলনা। হাজারো রাষ্ট্রে বিভক্ত ছিল ইউরোপ। সভ্যতার নিকৃষ্ট রূপ ছিল তারা। ইতিহাস সাক্ষী, স্পেনের মুসলিমদের সালতানাত ও উসমানীয়দের বদৌলতে ওরা সভ্যতার ছোঁয়াটুকু পেয়েছিল।

শেক্সপিয়ার, দেকার্তেরা মূলত কাজ করে গিয়েছে, স্বপ্ন দেখিয়ে গিয়েছে। পরবর্তীতে তাদের কাজের বদৌলতে একটা বড় পরিবর্তন এসেছে ইউরোপে।

এরপর থেকে ১৮ শতকের পাশ্চাত্যের দার্শনিকরা সেই পরিবর্তনকে বলতে শুরু করে রেঁনেসা।

এরই ধারাবাহিতায় ইমানুয়েল কান্ট ও তার সহযোগীরা তাদের সেই বাক্যের ব্যাপক প্রচলন করলো যে- “আমরা সময়ও সৃষ্টি করতে পারি, আমরা ইতিহাসও সৃষ্টি করতে পারি । তাই আমরা অতীতও সৃষ্টি করতে পারি, আমরা ভবিষ্যতও সৃষ্টি করতে পারি”।

একই সাথে আরেকটি থিওরী তারা দাড় করায় যে- “হাকীকত বলতে আসলেই কিছু আছে কিনা? তাদের মন্তব্য হলো- “সত্যিকার অর্থে ,আমাদের জ্ঞানের বাইরে হাকীকত বলতে কিছুই নেই। আমরা যতটুকু বুঝতে পারি ও ধারণ করতে পারি সেটিই হচ্ছে হাকীকত।”

তাদের উদাহরণসমূহ ছিল এধরণের। যেমন- আমি লিখছি, আপনারা পড়ছেন । আমি কিন্তু বাস্তবে নেই, তবে আমাকে মূলত আপনি বুঝতে পারছেন বা আপনার মাথায় বিষয়টা ধারণ করতে পারছেন, তাই আপনি আমাকে বুঝতে পারছেন।

তাদের কথা হচ্ছে এটাই– “ততোটুকুরই অস্তিত্ব আছে, যতটুকু আমরা ধারণ করতে পারি বা বুঝতে পারি। সুতরাং, হাকীকত বলতে কিছুই  নেই।” এমনকি এই থিওরীর প্রভাব পাশ্চাত্যের উপর এত বিস্তৃত হয়েছিল যে, গীর্জার পোপ’রা পর্যন্ত এর উপর বিশ্বাস করতে শুরু করলো।

তবে পাশ্চাত্যের দার্শনিকরা হাকীকত বিহীন চিন্তার দৌড়ে এক পর্যায়ে এসে খেই হারিয়ে ফেলে। তাদেরই বিখ্যাত বই “Good is dead” লিখলেও তারাই আবার বলল- ‘গড/ঈশ্বর যদি না থাকে তবুও গড/ঈশ্বরকে কে বাঁচিয়ে রাখতে হবে যেভাবেই হোক। নতুবা প্রয়োজনের আলোকে গড/ঈশ্বর একটা বানিয়ে নিতে হবে। কারণ এটা আমাদের ব্যাবসার জন্য কাজে লাগবে (এখানে সাধারণ বাণিজ্য বুঝাচ্ছে না)। এর উপরে ভিত্তি করে বহু ফায়দা আনা যায়। (এটা সম্ভবত ম্যাক্স ওয়েভারের কথা)

এভাবেই ইমানুয়েল কান্টরা, “আমরা অতীতও সৃষ্টি করতে পারি। আমরা ভবিষ্যতও সৃষ্টি করতে পারি” এই শক্তিশালী বয়ানটি বিশ্বব্যাপী প্রতিষ্ঠিত করলো।”

যদিও তারা তাদের দার্শনিক ভিত্তিকে দাড় করানোর ক্ষেত্রে সকল উদাহরন নিতো মুসলমানদের কাছ থেকে। তারা নিজেদের আলোকে  হাকীকত দাড় করাতে গিয়ে যে বড় একটি ভুল করে, তা হচ্ছে তাদের কোন নবী নেই। অথচ মুসলিমদের জন্য হাকীকত পথপ্রদর্শক হচ্ছেন পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ মানব বিশ্বনবী নবী (সাঃ)। এই বিশাল ব্যাপারটি তাদের বাদ পড়ে যায়। মূলত তারা এ বিষয়টিকে অনুধাবন করতে অক্ষম ছিল।

রাসূল সা. এর ব্যাপারটিকে তারা খুব ক্ষুদ্র হিসেবে বিবেচনা করতো। তাই  তারা তাদের নতুন এই চিন্তার দিকে ধাবিত হলো। যদিও তাদের এই চিন্তাটি অসার, তারপরও এই চিন্তাটিই ওদেরকে মুসলিমদের বিপরীতে নতুন কিছু করার প্রেরণা যুগিয়েছিল এবং সকল ধরনের শঠতার আশ্রয় নিতে উজ্জীবিত করেছিল। তাদের চিন্তাটি এরকম ছিল- “আমাদের বহু পথপ্রদর্শক আছে কিন্তু মুসলমানদের তো তেমন কেউ নেই। আমাদের যেমন ঈসা আছে, চার্চের প্রতিষ্ঠিত একটি সিস্টেম আছে, ওদের তো এসবের হুবুহু কিছুই নেই। তবুও তারা উন্নতি করছে, সুতরাং আমরাও এসব ছাড়াই উন্নতি করতে পারবো”।

এসব চিন্তার আলোকে এক পর্যায়ে তারা এ সিদ্ধান্তে পৌছে যে- “সবকিছু মানুষের দ্বারা তৈরি করা সম্ভব এবং এ দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে দুটি সিদ্ধান্ত নিল যে-

– সময়ের মালিক মানুষ।

– স্থানের মালিকও মানুষ।

আর এর উপরে ভিত্তি করেই তারা পরবর্তীতে সকল পদক্ষেপ নিল।

• এরপরে তারা আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা, শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুললো। আর শিক্ষার ব্যবস্থা হিসেবে সামনে দুটি বিষয়বস্তু নিয়ে আসলো–

১) সুনাগরিক হবে।

২) কোম্পানির কর্মচারী হবে।

সুতরাং হাকীকতের কোন প্রয়োজন নাই। শিক্ষা ব্যবস্থার কাজ হচ্ছে এই দুটি জিনিস তৈরি করা, সুতরাং এর ফাংশন অনুযায়ী সে এই কাজটিই করবে।

• বিপরীতে ইসলামি সভ্যতার শিক্ষাব্যবস্থা ছিল হাকীকত সমৃদ্ধ মানুষ তৈরির আবাসস্থল। এসকল মানুষেরা চিন্তার ক্ষেত্রে ছিল স্বাধীন, ফিকিরের ক্ষেত্রে ছিল উন্মুক্ত, কর্মের ক্ষেত্রে ছিল দিগন্তহীন বিস্তৃত মাঠ।

পূর্বের সেই জার্মান কবি গ্যোটের কাছেই ফিরে যাই আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কে সম্যক ধারণা পেতে। তিনি বলেছিলেন-

“মুসলিমরা এমন এক শিক্ষা পদ্ধতি গড়ে তুলেছে যে, সেখান থেকে যারা বের হয় তারা তাদের সুলতান কেও খাতির করে না। তারা হাকীকত ছাড়া অন্য কিছুকে পরোয়াই করেনা। তারা দ্বিধাহীন চিত্তে এমনভাবে লিখে ও বলে যে দুনিয়ার সকল কিছুই যেন তাদের সামনে মূল্যহীন এক বস্তু কারণ তারা একনিষ্ঠভাবে বিশ্বাস করে আল্লাহর সিদ্ধান্তের বাহিরে ফলাফল অন্যকিছু কখনোই আসবেনা। তাদের এই বিশ্বাসের কারণে তারা কোন ধরণের চিন্তা ব্যাতিরেকে যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়তে পারে, নিজেদের সকল সম্পদ পর্যন্ত বিলিয়ে দিতে পারে। এই শ্রেণী এমনই এক শ্রেণী।”

• ইসলামী সভ্যতা (তৎকালীন উসমানী খেলাফত) যখন আস্তে আস্তে দুর্বল হতে থাকলো, তখন ইউরোপীয় কোম্পানিসমূহ আমাদের এলাকায় আসতে শুরু করলো (যেমন ভারতীয় উপমহাদেশে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি, ডাচ কোম্পানি আসলো) ।

উসমানীরা যখন একটা কোম্পানি কে বিদায় করে, আবার আরেকটা আসে। শেষ হয়না! ভালো সমস্যায় পড়ে যায় ইসলামি সালতানাত! ইউরোপে অনেক দেশ ও প্রচুর কোম্পানি, সুতরাং একেরপর এক আসছেই।

সুলতানরাও তখন এসব কোম্পানির কারণে অতিষ্ঠ!

যেমন- তৎকালীন উসমানী সুলতান কখনো ফ্রান্সের রাজার সাথে দেখা করতো না। ফ্রান্স ছোট দেশ, উসমানী বিশাল সালতানাত সুতরাং ছোট রাজার সাথে কি আর দেখা করবে। সাধারণ দূত পাঠাতো।

কিন্তু এবার দেখা যাচ্ছে বিশাল শক্তি নিয়ে এসব কোম্পানি গুলো আসে। এক একটা কোম্পানি একটা রাষ্ট্রের সমান শক্তিশালী। তাহলে এদের কিভাবে ডিল করবে। তখন একধরনের চুক্তি আদান প্রদান হত।

• উসমানী বা ইসলামি সভ্যতা যখন পতনের দ্বারপ্রান্তে তখন দেখা গেলো, ইউরোপের ‘ল’ এর সাথে আমাদের ফিকাহ যায়না। কিন্তু তাদের সাথে মুসলমানদের ডিল করতে হচ্ছে। (অর্থাৎ আমাদের এখন যেমন সন্ত্রাসী আওমীলীগের সাথে রাজনীতি করা লাগে। যা চরম কষ্টের এবং আমাদের দুর্ভাগ্য। তেমনি আখলাক, ইহসানহীন ইউরোপের সাথে তৎকালীন উসমানীদের ডিল করতে হচ্ছে।)

যেহেতু আমাদের সাথে তাদের ‘ল’ এর সামঞ্জস্যতা নেই সুতরাং মুসলমানদের সকল শিক্ষা, রাষ্ট্রব্যবস্থার ফর্মে আনতে হবে।

ফর্ম কী জিনিস?

যেমন- ফিকাহ কে তাদের ‘ল’ স্টাইলে সাংবিধানিক ধারা আকারে নিয়ে আসা। মাদ্রাসা কে এভাবে স্বাধীন না রেখে আরো ইন্সিটিটিওশনালাইজ করা।

কিন্তু, ফর্মে আনার পরও দেখা গেলো তাদের মতো হচ্ছে না। অর্থাৎ

১) তাদের আদলে নাগরিকও তৈরি হয়না।

২) কোম্পানির কর্মচারীও তৈরি হয় না।

কারণ মাদ্রাসা শিক্ষা বা ইসলামি শিক্ষা ব্যবস্থায় এটা কখনো সম্ভব নয়।

• যাইহোক ইতিমধ্যে ইসলামি সভ্যতার রাষ্ট্রীয় পতন সম্পন্ন হলো।

– আস্তে আস্তে ইউরোপের স্টাইলে স্কুল, কলেজ, ভার্সিটি প্রতিষ্ঠা শুরু হল।

– রাষ্ট্রীয় ফর্ম পরিবর্তন হল।

– শিক্ষাব্যবস্থা ফর্ম পরিবর্তন হল।

– আইন-বিধান ফর্ম পরিবর্তন হল।

– নতুন প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠল বিশ্বব্যাপী

– রাষ্ট্রের নতুন এই ফর্মের সাথে পাল্লা দিতে গিয়ে মাদ্রাসা ব্যবস্থায়ও পরিবর্তন আসল।

আর এখানেই আমাদের মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থা তার গ্রাউন্ড হারিয়ে ফেলে।

ইউরোপের আদলে রাষ্ট্রের সেই চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে মাদ্রাসাও বিভিন্ন খোলসে আসলো, পরিবর্তন আনলো! কেউ কেউ ভিন্নভাবে চেষ্টা করলো।

• কিন্তু আর সেই হাকীকত অন্বেষণকারী আলেম উঠিয়ে আনা সম্ভব হচ্ছিল না।

এভাবেই যুগ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লো আমাদের মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থা। এখনো বিভিন্ন বয়ান থাকলেও তা যুগের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে পারে না। নতুন জ্ঞান তৈরী করতে পারে না। সভ্যতা বিনির্মানে ভিত্তি নির্মান করতে পারে না। একটা গন্ডির মধ্যেই আবর্তিত হয়..!!

• এখন তাহলে আমাদের করণীয় কি?

এক. মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থায় ফিরে যাব?

দুই. নাকি ফর্মাল শিক্ষাব্যবস্থা যে আছে তাকেই ইসলামাইজেশন করবে?

কোনটা করবো?

বর্তমান সময়ে এটাই এখন মুসলমানদের সামনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন।

১. কওমী ধাঁচের যারা তারা এক নাম্বারটাই চায়, স্বাধীনভাবে টিকতে চায়। কিন্তু মৌলিক বহু বিষয় থেকে তারা এখনো বহু দূরে, রাষ্ট্রেীয় কাঠামো থেকে দূরে।

২. ইসলামাইজেশন অফ নলেজ অর্থাৎ প্রচলিত শিক্ষা পদ্ধতি যেটা এটাকেই ইসলামাইজেশন করতে হবে। কারণ রাষ্ট্র হারানো বা বিছিন্ন হওয়া যাবে না। আবার দ্বীনও শিখতে হবে।

আবার আরেকটি ধারা– আলিয়া মাদ্রাসা ধারা। এটিও ব্যর্থ মূল লক্ষ্য অর্জন থেকে! তাহলে করণীয় কি?

কারণ আমাদের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় টিকে থাকতে হবে, আবার স্বাধীন ধারায় ফিরতে চাইলেও রাষ্ট্রের সাথে টিকে থাকতে পারবনা, একেবারেই শেষ করে দিবে। যেমন- বৃটিশ সময়ে আমরা ইংরেজি না শিখে এই ভুল করেছি!

• বর্তমান সময়ের আলোকে আমাদের করণীয়–

১) বিশ্বব্যাপী যে আন্দোলন গড়ে উঠেছে, এটার মাধ্যমে মাকাসিদ আশ শরীয়াহর এর আলোকে রাষ্ট্রীয় কাঠামো কে পরিবর্তনের চেষ্টা।

২) এটা যতদিন সম্ভব নয়, ততোদিন ফরমাল শিক্ষা গ্রহন করতে হবে। পাশাপাশি একটা গ্রুপ অফ পিপলকে আলাদা মক্তব/ইন্সিটিটিশন বা জীবন্ত গ্রন্থের কাছে পড়াশোনা করা। বেসিক তথা মৌলিক বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করা। তাতে,

– দ্বীনে মুবীন ইসলাম জানাও হবে।

– সেই সাথে সচিব, বিচারপতি, CEO হতে পারবে।

অর্থাৎ মূলকথা হচ্ছে, হাকীকত অনুসন্ধানী ছাত্র হওয়া আবার ফর্মের শিক্ষাব্যবস্থাও অর্জন করা।

সবমিলিয়ে দ্বিগুন পরিশ্রম করা। আর এটিই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
৩) হাকীকতে পৌছানোর জন্য পড়ার সাথে কাজ করে যাওয়া। এই হাক্বীকত হবে আমাদের পূর্বের ইসলামী ব্যবস্থার সেই হাক্বীকতের মতো যেখানে একজন মানুষ হাক্বীকত ছাড়া কাউকে পরোয়া করবে না।

উপরোক্ত চেষ্টা ছাড়া ইসলামাইজেশন অফ নলেজ সম্ভব না।

তাই এ শতাব্দীতে উঠে আসা জ্ঞানের মুজাহিদ আল্লামা ইকবাল, মাওলানা মওদূদীদের ত্যাগ, প্রচেষ্টা ও অনুসরণেই আমাদের প্রস্ফুটিত হওয়া সম্ভব।

সুতরাং ইস্তিকামাতের শ্রেষ্ঠ উদাহরণ, জ্ঞানসম্রাট নাজমুদ্দিন এরবাকান, আলিয়া ইজ্জেতবেগভিচ দের মত হিকমাহ ও সংগ্রামকে সমন্বয় করার প্রবল প্রচেষ্টা পাশাপাশি জ্ঞানসাধনার অনন্য মহাপুরুষ মুসা জারুল্লাহ বিগিয়েফ এবং ইসমাঈল রাজী আল ফারুকীদের ন্যায় ধারাবাহিক সাধনার কোনই বিকল্প নেই।

১২০৪ বার পঠিত

শেয়ার করুন

Picture of হাসান আল ফিরদাউস

হাসান আল ফিরদাউস

সংগঠক এবং সমাজ ও সংস্কৃতি বিষয়ক গবেষক হাসান আল ফিরদাউস-এর জন্ম টাংগাইল জেলায়। পড়াশুনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়য়ে সমাজবিজ্ঞান বিভাগে। এছাড়াও আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও ইসলামী সভ্যতা নিয়ে পড়াশোনার পাশাপাশি উসূল, ফিকহ এবং রাজনৈতিক দর্শনের উপর বড় শিক্ষকদের সাহচর্যে গবেষণা করে যাচ্ছেন। আন্তর্জাতিক স্কলার ও চিন্তাবিদদের সমন্বয়ে নানাবিধ গবেষণা ও একাডেমিক কার্যক্রম পরিচালনার পাশাপাশি নিয়মিত লেখালেখি করছেন। বর্তমানে তিনি ‘ইসলামী চিন্তা ও গবেষণা ইন্সটিটিউট’-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্বরত আছেন। একইসাথে জ্ঞানের পুনর্জাগরণ ও নবধারার কাগজ ত্রৈমাসিক মিহওয়ার-এর সম্পাদকও।
Picture of হাসান আল ফিরদাউস

হাসান আল ফিরদাউস

সংগঠক এবং সমাজ ও সংস্কৃতি বিষয়ক গবেষক হাসান আল ফিরদাউস-এর জন্ম টাংগাইল জেলায়। পড়াশুনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়য়ে সমাজবিজ্ঞান বিভাগে। এছাড়াও আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও ইসলামী সভ্যতা নিয়ে পড়াশোনার পাশাপাশি উসূল, ফিকহ এবং রাজনৈতিক দর্শনের উপর বড় শিক্ষকদের সাহচর্যে গবেষণা করে যাচ্ছেন। আন্তর্জাতিক স্কলার ও চিন্তাবিদদের সমন্বয়ে নানাবিধ গবেষণা ও একাডেমিক কার্যক্রম পরিচালনার পাশাপাশি নিয়মিত লেখালেখি করছেন। বর্তমানে তিনি ‘ইসলামী চিন্তা ও গবেষণা ইন্সটিটিউট’-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্বরত আছেন। একইসাথে জ্ঞানের পুনর্জাগরণ ও নবধারার কাগজ ত্রৈমাসিক মিহওয়ার-এর সম্পাদকও।

মতামত প্রকাশ করুন

Scroll to Top