সংস্কৃতি ও ইতিহাসের বয়ান তৈরিতে বাংলা অঞ্চলের সংকট ও প্রস্তাবনা

 

মানব সভ্যতার ইতিহাসে আখলাক ও আদালত প্রতিষ্ঠাকারী, গোটা মানবতাকে ন্যায়ভিত্তিকভাবে পরিচালনাকারী একমাত্র সভ্যতা ‘ইসলামী সভ্যতা’। ইসলামী সভ্যতা আমাদের এ উপমহাদেশেও পরিচালনা করেছে দীর্ঘ ৭শ বছরের সালতানাত। এ সভ্যতার পতন পরবর্তী ২শ বছর যাবত ব্রিটিশ শোষণের ফলে সৃষ্টি হয়েছে এক হীনমন্য ইতিহাসের বয়ান; যে বয়ানের প্রভাবে আমাদের সামনে আসছে নানাবিধ অযৌক্তিক প্রশ্ন!

যে প্রশ্নগুলো সর্বাগ্রে আসে, তা হলো ইসলামী সভ্যতার অন্যান্য অঞ্চলগুলোর (বাগদাদ, আন্দালুস) মতো আমরা প্রভাবশালী কোনো শক্তি ছিলাম না, আমাদের সমৃদ্ধ কোনো ইতিহাস ছিলো না, তাহলে আমাদের দ্বারা কীভাবে নতুন সভ্যতা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব?
আমাদের শক্তিশালী কোনো সাংস্কৃতিক ভিত্তি ছিলো না, তাহলে আমাদের দ্বারা কীভাবে সাংস্কৃতিক অঙ্গনে নতুন ধারা তৈরি করা সম্ভব?
কীভাবে আমাদের ইতিহাস ও সংস্কৃতির নতুন বয়ান ও আলাপ তৈরি করা সম্ভব?

এসব প্রশ্নের উত্তরে প্রথমেই আমাদের ইতিহাস ও সাংস্কৃতিক ভিত্তি নেই– এমন মনোভাব সৃষ্টি হওয়ার পেছনের ঐতিহাসিক যোগসূত্রের অনুসন্ধান করতে হবে। এক্ষেত্রে উপনিবেশবাদী বা জায়নবাদী ও ব্রাহ্মণ্যবাদী শক্তির সাথে আমাদের সংগ্রামের ঐতিহাসিক মাত্রা নির্ণয় আজ সবচেয়ে বেশি গুরুত্ববহ। আজ আমাদের কীভাবে ইতিহাসবিহীন, হীনমন্য ও আত্মবিশ্বাসহীন জাতিতে পরিণত করা হচ্ছে সেটির রাজনৈতিক কর্মসূচি ও পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে হবে, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে কীভাবে এটি বিষ ছড়াচ্ছে সে সম্পর্কে জানতে হবে। জানতে হবে কেনই বা তারা আমাদের সভ্যতার আগুনকে (জ্ঞানদর্শন, শিক্ষা, সংস্কৃতি, উদ্ভাবন ইত্যাদি) অস্বীকার করছে। অথচ তারাই বলছে, উপমহাদেশে ৭শ বছর আগুনের ধোঁয়া (রাষ্ট্র, অর্থনীতি, কৃষি, প্রশাসন ইত্যাদি) ছিলো! অর্থাৎ ধোঁয়া ছিলো কিন্তু আগুন ছিলো না– এ জাতীয় একটি হীনমন্য যুক্তি! এ যুক্তি, লিখা ও ইতিহাসকে আমরাই কেন বৈধতা দিচ্ছি তা নিয়েও ভাবতে হবে।

সেই সাথে আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হলো ‘শত্রু চেনা’। রাজনৈতিক সচেতনতার অন্যতম শর্ত এটি। এক্ষেত্রে বর্তমান সময়ে আমাদের মূল শত্রু কে?

মুসলিম উম্মাহর মুজতাহিদ, মুজাহিদদের সার্বজনীন স্বীকৃত মত অনুসারে মূল শত্রু হলো ‘ব্রিটিশ জায়নবাদী সভ্যতা’ এবং আমাদের উপমহাদেশের ক্ষেত্রে মুসলমানদের আরেকটি শত্রু হলো ব্রিটিশ জায়নবাদীদের ছত্রছায়ায় নতুন রূপে বেড়ে উঠা ‘ব্রাহ্মণ্যবাদী আধিপত্যবাদ’। (এ অঞ্চলের সেক্যুলার গোষ্ঠী মূলত ব্রাহ্মণ্যবাদী আধিপত্যবাদের দোসর এবং বাঙালী জাতীয়তাবাদ হলো ব্রাহ্মণ্যবাদী জাতীয়তাবাদের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এখানকার কমিউনিস্টরাও কমিউনিজমের মুখোশে ‘লাল সাম্প্রদায়িকতা’র ব্রাহ্মণ্যবাদী রাজনীতিই চালায়!)

ব্রিটিশ জায়নবাদী সভ্যতার ন্যায় এই ব্রাহ্মণ্যবাদী আধিপত্যবাদের নিজস্ব প্রজেক্ট আছে, সাংস্কৃতিক দর্শন আছে। এ প্রেক্ষিতে ‘শত্রু চেনা’ বা রাজনৈতিক সচেতনতার বিষয়টি বুঝতে হলে শুধুমাত্র একটি দিকে তাকালেই যথেষ্ট হবে, তা হলো বর্তমান বাংলাদেশের গণমানুষের মনস্তত্ত্ব কোন অবস্থায় আছে এবং যুব ও শিশু মননের ক্ষেত্রে আমরা কোন ইতিহাস ও চরিত্রগুলোর প্রভাব দেখতে পাই? এর উত্তর হিসেবে যা আসবে, তা হলো ব্রিটিশ জায়নবাদী সভ্যতার পরে ব্রাহ্মণ্যবাদী/হিন্দুত্ববাদী সংস্কৃতির আগ্রাসন আমাদের পুরো জাতিকে নিজের আত্মপরিচয় ভুলিয়ে দিচ্ছে; যুবক থেকে শিশু সবার কাছে ইসলামী সংস্কৃতি একেবারেই অচেনা হয়ে উঠছে। ইসলামের ধর্মীয় চিন্তার ভুল ব্যাখ্যা সবার চিন্তারাজ্যে প্রবেশ করছে। আমাদের প্রাত্যহিক ও প্রভাবশালী বয়ানে ইসলামী সভ্যতার ধারণা আজ গরহাজির!

অথচ ইসলামী সভ্যতা বাংলাকে উপহার দিয়েছিলো এক স্বর্ণালী সালতানাত! মুসলিম শাসনামলের ৭শ বছরে ‘ভারতীয় উপমহাদেশ’ সর্বোচ্চ সম্মান ও মর্যাদার অধিকারী ছিলো। গোটা উপমহাদেশ আদালত, ন্যায়ভিত্তিক অর্থনীতি, সর্বোচ্চ উৎপাদন ও সহমর্মিতায় পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছিলো। রাষ্ট্র পরিচালনার প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ খাতই ছিলো সমৃদ্ধ। সুবা-বাংলা/সুলতানী বাংলা আমাদের গৌরবময় অতীত; বর্তমান বাংলাদেশও এ শক্তিশালী মুসলিম সভ্যতার অংশ।

অর্থনীতিতে বাংলা অঞ্চল ছিলো মুসলমানদের গর্বের অঞ্চল, সামাজিকব্যবস্থা ছিলো উন্নত, কৃষিব্যবস্থা ছিলো নতুন ধারা সৃষ্টিকারী পথপ্রদর্শক। এ অঞ্চলে তিনশোর অধিক পণ্য ও খাদ্যদ্রব্য উৎপন্ন হতো এবং নিজস্ব জাহাজে পৌঁছে যেতো দুনিয়ার ৮০ টি অঞ্চলে।
প্রতিরক্ষাব্যবস্থাও ছিলো শক্তিশালী; ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজির সৃষ্ট ধারার ধারাবাহিকতায় বুজুর্গ উমেদ খাঁ এর মতো সেনাপতি, ইবনে হোসেনের মতো নৌ-সেনাপতি, দেওয়ান মুনাওয়ার খানের মতো বীর যোদ্ধা, অত্যাচারী রাজা আচক নারায়ণের বিরুদ্ধে বিজয় অভিজান পরিচালনাকারী বারো আউলিয়া সিপাহসালার সৈয়দ নাসিরউদ্দিন ও বদর পীর, গৌড় গোবিন্দের বিরুদ্ধে বিজয় অভিযান পরিচালনাকারী শাহ জালাল যার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
শিক্ষা খাতে আলোড়ন তুলেছিলো আমাদের হারিয়ে যাওয়া দারসবাড়িগুলো। তখনকার শ্রেষ্ঠ আলেমদের সাথে আমরা স্মরণ করতে বাধ্য হই আগা বাকের খাঁ, শায়েস্তা খাঁ, সেকান্দার গাজীদেরকে।

বাংলার সাংস্কৃতিক আধিপত্য ছিলো স্ব মহিমায় ভাস্বর। রুমি, জামি, হাফিজ, গাঞ্জেশকর, বুল্লে শাহ, আমীর খসরু, আলাওলদের কাব্য-গান কিংবা গিয়াস উদ্দিনের দরগার নাশিদ, আজান, যিকির ইত্যাদি ছিলো সাংস্কৃতিক তারুণ্যে দীপ্তিমান বাংলার ছোট একটি উদাহরণ।

অথচ আজ আমরা এসব মনে রেখে ইসলামের ঐতিহাসিক অবদান, ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে ইসলামের কেন্দ্রীয় ভূমিকা এবং আমাদের সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয়কে আত্মস্থ করে অগ্রসর হতে পারি না! যদি পারতাম, তবেই বোঝা যেতো, উপমহাদেশের মুসলমানদের এ হীনমন্যতাগুলো মূলত জায়নবাদী ও ব্রাহ্মণ্যবাদীদের পূর্ব পরিকল্পনার ফসল। বাস্তবিকভাবে আমাদের নিজেদের এ সকল অভিযোগ ও প্রশ্ন যে অমূলক এবং অবান্তর তা আমাদের ৭০০ বছরের এই গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস অধ্যয়ন করলেই বোঝা যায়। আমাদের সুসমৃদ্ধ ইতিহাস, আমাদের সংস্কৃতির অসাধারণ ঐতিহ্য এ বিষয়টি স্পষ্ট করে দিচ্ছে যে, যোগ্য ব্যক্তিত্ব, ইস্তেকামাত ও ইখলাসের সাথে কাজ করে গেলে অবশ্যই আমাদের ইতিহাস ও সংস্কৃতির নতুন বয়ান উঠিয়ে আনা সম্ভব।

এখন প্রশ্ন হলো, আমাদের এ ইতিহাস থাকা সত্ত্বেও কীভাবে আমরা শিকড়চ্যুত ও ইতিহাসহীন জাতিতে পরিণত হলাম?
এক্ষেত্রে জবাব হলো ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের ধারক-বাহক জায়নবাদীরা ও তাদেরই মানসসন্তান ব্রাহ্মণ্যবাদীদের মিলিত প্রচেষ্টায় তৈরিকৃত শিক্ষাব্যবস্থা, মিডিয়া ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের কারণেই এটি হয়েছে।

আগ্রাসনের এ ক্ষেত্রকে মোটা দাগে তিন ভাগে বিভক্ত করা যায়–

• সাংস্কৃতিক আধিপত্য এবং ইতিহাসের বিকল্প বয়ান তৈরি
• মিডিয়া আগ্রাসন
• ভাষাগত সাম্রাজ্যবাদ

সাংস্কৃতিক আধিপত্য এবং ইতিহাসের বিকল্প বয়ান তৈরির ক্ষেত্রে প্রভাবশালী শক্তি, অঞ্চল কিংবা রাষ্ট্র তার নিজস্ব সংস্কৃতি অধীনস্থদের উপর চাপিয়ে দেয় এবং অধীনস্থদের সংস্কৃতির প্রতিটি ক্ষেত্র ধরে নিজেদের সংস্কৃতির আদলে বিকল্প চিন্তার বাস্তবায়ন ঘটায়। যার ফলে অধীনস্থরা তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি বিস্মৃত হয়ে যায়। এর মাধ্যমে অধীনস্থ বা শোষিত জনগোষ্ঠীর ইতিহাসকে ধ্বংস করে দেওয়া হয়।

বাংলা অঞ্চলের ক্ষেত্রেও ব্রিটিশ উপনিবেশবাদীরা এ কাজটিই করেছে। এর মাধ্যমে প্রথমেই তারা বাংলায় ইসলামী সভ্যতার স্মারকচিহ্নগুলো ধ্বংস করে দেয়। উদাহরণস্বরূপ, জার্মান পণ্ডিত ম্যাক্স মুলারের হিসাব অনুযায়ী ব্রিটিশরা বাংলা দখল করার পরও ৭০,০০০ প্রতিষ্ঠান বিদ্যমান ছিলো। অথচ আজ তার একটিও আমরা খুঁজে পাই না! আজ আমরা সোনারগাঁওয়ের মাদ্রাসাতুশ শরফ, দারসবাড়িগুলো সম্পর্কে জ্ঞাত নই!

স্মারক ধ্বংসের পাশাপাশি তারা গ্রন্থ পাচার এবং পরবর্তীতে স্যার যদুনাথ সরকারসহ অন্যান্য আজ্ঞাবহ ইতিহাসবিদদের মাধ্যমে জায়নবাদী ও ব্রাহ্মণ্যবাদীদের যৌথ উদ্যোগে বাংলার ইতিহাসের বয়ান বদলে ফেলে; আর উগ্র সাম্প্রদায়িক সাহিত্যিক বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্ররা তা মানুষের মন ও মননে গল্পাকারে তুলে ধরেন! পরবর্তীতে আহমদ ছফা থেকে শুরু করে বাংলাদেশের অন্যান্য বামপন্থী ও বাঙালী জাতীয়তাবাদীদের (যেটা মূলত হিন্দুত্ববাদের একটি পরিমার্জিত সংস্করণ) সম্মিলিত প্রভাবের ফলশ্রুতিতে আমাদের ৭শ বছরের সমৃদ্ধ ইতিহাস থেকে আমাদের যোগসূত্র হারিয়ে যায়, আমাদের ইতিহাস চর্চায় তাদের বয়ানই প্রভাবশালী হয়ে ওঠে। এভাবে ব্রিটিশ জায়নবাদীরা তাদের শাসন গুটিয়ে নেওয়ার পরও তাদের তৈরি, তাদের আজ্ঞাবহ, তাদের পরিকল্পনার ফসল ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এ শোষণ এখনো অব্যাহত রেখেছে। ফলশ্রুতিতে তাদের তৈরি ব্যবস্থার অনুগত হিসেবে বেড়ে উঠার পাশাপাশি তাদের কারণেই সৃষ্ট হীনমন্যতার শিকার হয়ে শোষিত জনগোষ্ঠী আত্মবিশ্বাসও হারিয়ে ফেলেছে।
মালিক বিন নবী তাঁর সভ্যতার বয়ানে মূলত এ বিষয়টিকেই চিহ্নিত করেছেন, অর্থাৎ ঔপনিবেশিক শক্তি কীভাবে কোনো অঞ্চল ত্যাগ করেও তার প্রভাব বজায় রাখে তা বলেছেন।

চীনা জেনারেল সান জু তাঁর সুবিখ্যাত গ্রন্থ “দ্য আর্ট অব ওয়ার” এ বলেছিলেন,

“কোন জাতিকে যদি যুদ্ধ ছাড়াই পরাজিত করে দিতে চাও, তাহলে তাদের ভালো বিষয়গুলোকে খারাপভাবে উপস্থাপন করো, তাদের ইতিহাস ও মূল্যবোধকে হাস্যকরভাবে উপস্থাপন করো।”

ভালোভাবে লক্ষ্য করলে আমরা দেখবো, আমাদের অঞ্চলে ব্রিটিশরা এ পন্থাই অনুসরণ করেছে! ফলে আমরা আমাদের ইতিহাসের অসাধারণ দিকগুলো জানি না, আমাদের ইতিহাস আমাদের আত্মবিশ্বাসের উৎস না হয়ে হীনমন্যতার কারণে পরিণত হয়েছে!

এমন অবস্থা সৃষ্টিতে আমরাও দায়মুক্ত নই, কারণ যেখানে বিকল্প হিসেবে নিজস্ব ইতিহাসের বয়ান ও আলাপ তুলে ধরা ছিলো সময়ের সবচেয়ে বড় দাবি, সেখানে আমরা হাত গুটিয়েই বসে আছি। ইবনে খালদুন এবং ইসলামী সভ্যতার ইতিহাস দর্শনের সামগ্রিক ধারণার আলোকে আজও আমাদের ইতিহাসগত ভিত্তি তৈরি হয়নি। আমরা পক্ষপাতদুষ্ট ও একপেশে বয়ানের বিপরীতে নতুন আলাপ তুলে ধরা দূরে থাক, ইসলামের ঐতিহাসিক ক্ষেত্রগুলো পর্যন্ত তুলে ধরতে পারিনি! এটি অবশ্যই আমাদের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা।

সবচেয়ে ভয়ানক বিষয় হলো ইতিহাসের বয়ান তৈরির বিশাল যুদ্ধের প্রশ্নগুলোর যথাযথ আলাপ তুলে না ধরে আমরা ইসলামকে শুধুমাত্র ধর্মতাত্ত্বিক আলোচনায় সীমাবদ্ধ করে ফেলেছি! এক্ষেত্রে মূল ত্রুটিপূর্ণ বয়ান হলো শুধু রাসূল (সা.) এর সীরাত ও খোলাফায়ে রাশেদার মধ্যেই ইসলামের ইতিহাসকে সীমাবদ্ধ করে ফেলা। সন্দেহাতীতভাবেই সে সময়টা আমাদের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু অবশ্যই তা আমাদের ১২শ বছরের ইতিহাসকে অস্বীকার করে নয়! এক্ষেত্রে আমাদের আন্দোলনকে সফল করার জন্য জরুরী জরুরি হলো এই ১২শ বছর, বিশেষত উপমহাদেশের ৭শ বছরের স্বর্ণালি ইতিহাসের সাথেও নিজেদের যোগসূত্র তৈরি করা; সেই সাথে ব্রাহ্মণ্যবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়ার জন্য আত্মপরিচয় নির্মাণ ও সংস্কৃতির প্রশ্নে যুগের প্রেক্ষিতে সর্বাধিক যৌক্তিক জবাব হাজির করা। মানুষের সামনে যদি আমাদের ১২শ বছরের বিশ্ব পরিচালনা, বাংলায় ৭শ বছরের ইসলামী সভ্যতার চিত্রটুকু তুলে ধরতে পারি, তাহলে অবশ্যই হীনমন্যতা কেটে যাবে এবং হারানো চেতনা ফিরে আসবে। আল ফারাবী বলেছিলে, “ঐতিহ্যবিহীন জ্ঞান মূলত মুর্খতা।” তাই জ্ঞানচর্চা ও নিজস্ব ভিত্তি নির্মাণে ইতিহাসের যোগসূত্র স্থাপনের গুরুত্ব কত বেশি তা সহজেই অনুভব করা যায়।

সার্বিকভাবে আমাদের করণীয় হলো–

• আমাদের স্বর্ণোজ্জ্বল সভ্যতার শক্তিশালী ইতিহাসের বয়ান তৈরি ও তা তুলে ধরার মাধ্যমে সবাইকে হীনমন্যতা ও পরিচয় সংকট থেকে বের করে আনা এবং ইবনে খালদুনের ন্যায় মহান আলেম দার্শনিকদের মূলনীতি ও ইসলামী সভ্যতার ইতিহাস, দর্শনের বয়ানের আলোকে সামগ্রিক ইতিহাস রচনার মাধ্যমে ইতিহাসের সাথে আমাদের যোগসূত্র স্থাপন করা, নিজেদের ঐতিহাসিক আত্মপরিচয় পুনরুদ্ধারের যুদ্ধে যা আমাদের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার।
• উপমহাদেশের ইসলামী সভ্যতার ইতিহাসকে সঠিকভাবে তুলে ধরার পাশাপাশি ভূখন্ডগত দিক থেকেও যে আমরা প্রতারিত হচ্ছি সেই বোধ তৈরি করা, আমরা যে সব হারিয়ে বসেছি সে বোধও উপলব্ধি করানো।
• মুসলমানগণ কীভাবে এই বাংলার ভূখন্ড, সমাজ, সংস্কৃতি সুনিপুনভাবে তৈরি করেছে এবং সাজিয়েছে তার সত্যিকার বয়ান তৈরি।
• এ অঞ্চলের পীর-সুফি, মুজাহিদ (পুরুষ ও নারী), দরবেশ, আলেমদের বয়ান তৈরি।
• স্থাপত্যশৈলী, সংস্কৃতিসহ সব ক্ষেত্রে ব্রাহ্মণ্যবাদের ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়া এবং বিরাজমান থাকার আদ্যোপান্ত তুলে ধরা।
• বাঙালী পরিচয় কীভাবে এলো এবং এটি যে ভারতীয় আধিপত্যবাদেরই একটি অংশ তা এবং এই পরিচয় নিয়ে (বর্তমানে যেভাবে প্রতিষ্ঠিত) কেন ভারতীয় সাম্রাজ্যবাদ মোকাবেলা করা যাবে না তার যৌক্তিক জবাব ও নতুন বয়ান হাজির করা।
• এই বাঙালীত্ব, হিন্দু জমিদার ও মুসলমান প্রজার সম্পর্ক ও কলোনিয়াল ঐতিহাসিক জন্মসূত্র অনুসন্ধান করা।
• বাঙালী সংস্কৃতির সাথে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের আধ্যাত্মিক সংস্কৃতির বিচ্ছিন্নতা তুলে ধরা।
• এ অঞ্চলের মুসলমানদের প্রতি আগ্রাসন যেহেতু ভারতীয় উপমহাদেশের অনান্য অঞ্চলের মুসলমানদের আগ্রাসনের থেকে অবিচ্ছিন্ন; তাই ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে আমাদের ইতিহাসে গ্রোথিত লড়াইকে অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে ধারণ করা। মুজাহিদ বখতিয়ার খিলজী, নূর কুতুব আলম, তিতুমীর, আল্লামা ইকবালসহ অজস্র বীর মুজাহিদের সংগ্রামকে স্মরণে রেখে এগিয়ে যাওয়া।

সর্বোপরি যুগের আলোকে যথোপযুক্ত ও বহুমুখী সমাধানের মাধ্যমেই এ অবস্থান থেকে উত্তরণ ঘটানো সম্ভব।

মিডিয়া আগ্রাসনের আলাপে যদি আমরা আসি, তাহলে দেখবো, আমাদের সময়ের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো মিডিয়া ইন্ডাস্ট্রি আর প্রযুক্তি।

আমরা জানি, রাজনৈতিক লড়াইয়ের অন্যতম শর্ত হলো সাংস্কৃতিক লড়াই। আর সাংস্কৃতিক লড়াইয়ের অন্যতম অনুষঙ্গ মিডিয়া ও প্রযুক্তি; অর্থাৎ নিজস্ব সাংস্কৃতিক ভিত্তি নির্মাণ বা ইসলামী সংস্কৃতির মূল ভিত্তি নিয়ে পর্যাপ্ত কাজ এবং উন্নত প্রযুক্তির সমন্বয়ে মিডিয়ার মাধ্যমে গণ পরিসরে স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক চিহ্ন নিয়ে হাজির হওয়া।

বাংলা অঞ্চলের প্রেক্ষিতে আমাদের সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের প্রধান দুটি প্রতিপক্ষ ব্রিটিশ জায়নবাদী ও ব্রাহ্মণ্যবাদী দর্শনের সাথে সাংস্কৃতিক লড়াইয়ে আমাদের নিজস্ব ভিত্তি নির্মাণ করে গণ পরিসরে প্রভাব বিস্তার ব্যতীত কখনোই সফল হওয়া সম্ভব নয়, আর এ বৃহৎ ক্ষেত্র ছাড়া সম্ভব নয় আগামীর ইসলামী সভ্যতা বিনির্মাণও। আমাদের ঐতিহাসিক যোগসূত্র ও সাংস্কৃতিক নতুন বয়ান হাজির করাও একই সূত্রে গাঁথা। নিজস্ব সাংস্কৃতিক ভিত্তি দাঁড় করানোর আগে সাংস্কৃতিকভাবে শক্তিশালী হওয়াটা আকাশকুসুম কল্পনারই শামিল।

মুহাম্মাদ আসাদ সেই ১৯৩০ সালেই স্পষ্টভাবে বলেছিলেন, “মুসলিমদের ঐক্য এবং নিজস্ব সংস্কৃতির ভিত্তি যতদিন না দাঁড়াবে, সে পর্যন্ত পাশ্চাত্যের জন্য ইসলাম কখনোই হুমকি নয়!”
অথচ এর প্রায় একশো বছর পরে বর্তমানে হলিউড, বলিউড, অত্যাধুনিক মুভি, সিরিয়ালের দুনিয়ায় আমাদের অঙ্গন থেকে বিকল্প কোনো যাত্রা শুরুই হয়নি!

জায়নবাদী ও ব্রাহ্মণ্যবাদী আগ্রাসনের সমালোচনা করে ও তা থেকে শুধুই ক্রমাগত আত্মরক্ষা করে কোনো লাভ নেই, কারণ আত্মরক্ষা করে কখনো নিজেদের ভিত্তি নির্মাণ সম্ভব নয়। আবার নিজেরা দুর্বল হলে আত্মরক্ষাও করা যায় না। প্রথম কাজই হলো আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক সাংস্কৃতিক অঙ্গন থেকে ইসলামী সংস্কৃতির ভিত্তি তৈরি করা, অর্থাৎ মিডিয়া জগতে বিকল্প প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করা।

তাই আবশ্যকীয় কর্ম হলো–

• এই অঞ্চলের (ভারতের) মিউজিকসহ শিল্প-সংস্কৃতির অন্যান্য ক্ষেত্রে মুসলমানদের অবদান তুলে ধরা। নাট্যদল থেকে সিনেমা পর্যন্ত, সেই সাথে স্থাপত্যেশৈলীতেও পাশ্চাত্যের কথিত আধুনিকতা বিরোধী আধ্যাত্মিক বিপ্লব ঘটানো।
• মুসলিম সংস্কৃতির নিজস্ব দিবসসমূহ উদযাপন করা। সাপ্তাহিক ঈদ জুম’আ, রমজান, শাবান, মিলাদুন্নবী ইত্যাদি ঘটা করে উদযাপন করা। বিয়েসহ সকল সামাজিক অনুষ্ঠানে ইসলামী সংস্কৃতির সর্বোচ্চ পরিস্ফুটন ঘটানো। এক্ষেত্রে গতানুগতিক বিদয়াতি ফতোয়া দেওয়ার পরিবর্তে উসূল ও মেথডোলজি, উসূলে ফিকহ, হিউম্যান সাইকোলজি, সোশ্যাল সাইন্স বোঝা গুরুত্বপূর্ণ, কারণ সংস্কৃতিকে কখনো গতানুগতিক ফতোয়া দিয়ে মোকাবেলা করা যায় না।
• স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কথা মাথায় রেখে সাংস্কৃতিক আয়োজন ও নতুন ধারা তৈরি করা।
• প্রযুক্তির বয়ান, সাহিত্যের ধারা, খাদ্য সংস্কৃতিতে আগ্রাসন ও বিকল্প খাদ্য সংস্কৃতি চালু।
• সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে শাহ জালাল, নূর কুতুবুল আলম, তিতুমীর, দুদু মিয়া, হাজী শরীয়তুল্লাহসহ আমাদের সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক আত্মপরিচয়ের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ মহান মুজাহিদগণ, ব্যক্তিত্ব, পীর, সুফি, দরবেশ, আলেমদের জীবন কাহিনী তুলে ধরা। তাদের জীবনকে পরিপূর্ণভাবে উপস্থাপন করা, যেন আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম নিজেদের মডেল হিসেবে তাদেরই পরিচয় দেয়।
• ইসলামী সংস্কৃতির মূলনীতির উপর পাণ্ডিত্য অর্জনকারীদের কর্তৃক বর্তমান দুনিয়া, পাশ্চাত্য সংস্কৃতির ভিত্তি ভালোভাবে বুঝে পর্যাপ্ত গ্রন্থ, গবেষক, সাংস্কৃতিক জগতে শক্তিশালী ব্যক্তিত্ব তৈরি করা।
• সেমিনার, কনফারেন্স, প্রেজেন্টেশন এর আয়োজন করা।
• বাংলা অঞ্চলের সাংস্কৃতিক ইতিহাসের প্রেক্ষিতে নতুন সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সূচনা করতে হবে। এর মাধ্যমেই মূলত বর্তমান যুগের সাথে সর্বোত্তম বোঝাপড়ার ফলশ্রুতিতে যুগের প্রেক্ষিতে সবচেয়ে বেশি স্থায়ী উদ্যোগ নেওয়া সম্ভবপর হবে। এক্ষেত্রে অবশ্যই সামগ্রিক উদ্যোগকে প্রাধান্য দিতে হবে। মাথায় রাখতে হবে শুধুমাত্র কতিপয় শিল্পীগোষ্ঠী, ব্যক্তিগত-সামাজিক উদ্যোগ দিয়ে এ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা অসম্ভব। একইসাথে ২০ বছর আগের মডেলে কাজ করে গেলেও তা প্রভাব বিস্তারকারী হবে না। যুগের প্রেক্ষিতে সবচেয়ে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে সর্বোত্তম ও সর্বোন্নত পন্থায় আমাদের ইতিহাস ও সংস্কৃতিকে যুব সমাজের সামনে উপস্থাপন করতে হবে।

সর্বোপরি এসব চিন্তা ও কাজের মধ্য দিয়েই ব্যক্তিত্ব গড়ে উঠবে, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড ও নিজস্ব ধারা তৈরি হবে।

তৃতীয় বা সর্বশেষ আলাপ, ভাষাগত সাম্রাজ্যবাদের ক্ষেত্রে যদি আমরা আসি, প্রথমেই বলতে হয় ভাষাগত বিষয়টি প্রতিটি সভ্যতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ, একইসাথে সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তারকারী।

সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের সবচেয়ে শক্তিশালী মাধ্যম হলো ভাষা। ভাষা হলো একটি জাতিসত্তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক উপাদান। এ উপাদানকে যদি বিকৃত বা বিধ্বস্ত করা যায়, বা বদলে ফেলা যায় একটি তাহলে নিজস্ব স্বাতন্ত্র্য দুর্বল হয়ে পড়ে এবং সে জাতিকে কোনো ধরনের প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই পরমুখাপেক্ষী ও হীনমন্য করে দেওয়া সম্ভব! বাংলা অঞ্চলের মুসলমানদের যে নিজস্ব ও স্বতন্ত্র ভাষা কয়েক শতাব্দীব্যাপী ধরে বিকশিত ও সমৃদ্ধ হয়েছিলো, তা ১৮৫৭ সালে ইসলামী সভ্যতার পতনের পর বিরাট ধাক্কা খায়। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের পণ্ডিতেরা সে ভাষাকে আগাগোড়া পালটে দেন। ফলশ্রুতিতে ইসলামী সভ্যতার বাংলার বদলে তা পরিণত হয় হিন্দুয়ানি বা সংস্কৃতায়িত বাংলায়! (এ কথা বলে রাখা ভালো, বাংলা অঞ্চলের যে ভাষাকে ব্রাহ্মণ্যবাদী সাহিত্যিক আর পণ্ডিতেরা বদলে দিয়েছিলেন, তা ছিলো বাংলার মানুষজনের সাধারণ ভাষা। সকলেই এ ভাষায় কথা বলতেন, এমনকি হিন্দুরাও। সুতরাং মুসলমানরা যখন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিলেন, তখন তারা এর সাহায্যে হিন্দু বা অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের উপর জুলুম করেছেন এমনটি ভাবার কোনো সুযোগ নেই। আর মুসলিমরা আসার পূর্বে বাংলা ভাষার কী করুণ অবস্থা ছিলো এবং মুসলিম সুলতানরা পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে কীভাবে সত্যিকারার্থে বাংলা ভাষাকে নবজন্ম দিয়েছেন তার বিশ্বস্ত বয়ান পাওয়া যায় দীনেশচন্দ্র সেনের “প্রাচীন বাঙ্গলা সাহিত্যে মুসলমানদের অবদান” গ্রন্থে।)

ভাষা সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ার হওয়ার কারণেই ব্রিটিশরা ক্ষমতায় এসেই ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরসহ ব্রাহ্মণ্যবাদী ঐতিহাসিকগণ ও ভাষাতাত্ত্বিকদের মাধ্যমে সুবা বাংলা/বাংলা সালতানাতের বাংলা ভাষায় আগ্রাসন চালায়, সংস্কৃতায়ন করে ইসলামী শব্দ ও পরিভাষাগুলোকে মুছে দেয় এবং বিকল্প পরিভাষা সৃষ্টি করে। আবার এ পরিভাষাগুলোকে বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্রদের মতো প্রভাবশালী সাহিত্যিকদের মাধ্যমে মানুষের মন ও মননে পৌঁছে দেয়। আজ তাই জায়নবাদী ও ব্রাহ্মণ্যবাদী রাজনীতির বোঝাপড়া আমরা বুঝতে পারি না, ব্রাহ্মণদের লাল সাম্প্রদায়িকতার মানেও জানি না।

আগ্রাসনের ফলে সৃষ্ট বিকল্প ও পরিবর্তিত পরিভাষা দিয়ে এ আগ্রাসনেরই মোকাবেলা করা কি আদৌ সম্ভব? এ অনেকটা কেরোসিন ঢেলে আগুন নেভানোর মত বিষয়!

এক্ষেত্রে মাথায় রাখতে হবে ভাষা মূলত চিন্তার বাহন, আর ভাষাকে নিয়ন্ত্রণ করার অর্থ হলো মানুষের চিন্তাকাঠামোর জগতটাকেই নিয়ন্ত্রণ করা। এ কারণেই ব্রিটিশরা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েই ১৮৩৭ সালে ফারসি ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা থেকে সড়িয়ে দেয়। আর পরবর্তীতে কিভাবে তাদের আজ্ঞাবহ চিন্তক, সাহিত্যিক, ভাষাতাত্ত্বিক ও ব্যকরণবিদদের দ্বারা ভাষার খোলনলচে পালটে দেয়, সে ইতিহাস তো আমাদের সামনে হাজির!

এক্ষেত্রে সমাধান কী?

প্রথমটি হলো বাংলাদেশে অর্থনীতি, সংস্কৃতি, সমাজ, পরিবারসহ সব ক্ষেত্রেই যে সংকট বিদ্যমান, তা রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত। তাই সমাধানের ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত ও সামাজিক উদ্যোগের বহুবিধ গুরুত্ব থাকলেও সামগ্রিক সমাধান রাজনীতি ও রাষ্ট্রব্যবস্থার মাধ্যমেই করতে হবে।

একে কেন্দ্র করে বহু আলাপ, বহু দিক থেকে তর্ক থাকলেও মোদ্দাকথা এটিই যে, রাজনৈতিক প্রশ্নকে এড়িয়ে সংকটের সমাধান নিতান্তই অপরিণামদর্শীতা এবং এটি অবাস্তবও। একেবারে ক্ষুদ্রতর ইস্যু থেকে শুরু করে বৃহৎ সমস্যাগুলো দিনশেষে রাজনীতি ও ব্যবস্থাগত অবস্থানের সাথেই সম্পৃক্ত হয়। উদাহরণস্বরূপ, একজন মানুষের আখলাকবিহীন আচরণ কিংবা পারিবারিক সমস্যাও রাষ্ট্র ব্যতীত সামগ্রিকভাবে সমাধান করা যায় না। সে জায়গাতে সংস্কৃতি ও ইতিহাসের বয়ান নির্মাণের সংকট মোকাবেলার ক্ষেত্রে তার আবশ্যকীয়তা কতটুকু তা খুব সহজেই অনুমেয়। প্রফেসর ডঃ নাজমুদ্দিন এরবাকান তাই বলেছিলেন, “আমরা ছোট নল দিয়ে আলো ছড়াচ্ছি, আর ওরা বড় পাইপ দিয়ে জাহেলিয়াত ছড়াচ্ছে।” তাই সমাধান বাস্তবায়নের জন্যও আমাদের বড় পাইপ দরকার, ব্যবস্থাগত অবস্থান ও সামগ্রিক উদ্যোগ দরকার।

তাই সময়ের এ সন্ধিক্ষণে এসে আমাদের করণীয় হলো–

• ইসলামী সংস্কৃতির উসূল তথা নিজস্ব ভিত্তিসমূহ নিয়ে পর্যাপ্ত গবেষণা করা। ভাষা শেখা, তারপর ইসলামের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলের বড় বড় শিক্ষকদের থেকে জ্ঞান অর্জন করা।
• নিজেরা শক্তিশালী হওয়া। যে কোনো সভ্যতা-ই প্রভাবশালী ও বিজয়ী শক্তিতে পরিণত হওয়ার আগে অভ্যন্তরীণভাবে শক্তিশালী হওয়ার দিকে সব চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। এসব নিজস্ব উপকরণের মধ্য দিয়েই নিজেদের আত্মবিশ্বাস, কর্মতৎপরতা, নিবেদিতপ্রাণ হয়ে সভ্যতা বিনির্মাণের কাজ করার বিশাল প্রজন্ম গড়ে ওঠে।
প্রখ্যাত দার্শনিক ও মুজতাহিদ আল্লামা ইকবালের ভাষায়, “সমাজের অধঃপতন রোধের একমাত্র কার্যকরী পন্থা হলো আত্মশক্তি প্রবুদ্ধ মানুষ গড়ে তোলা। কেবল তারাই পারেন জীবনের গভীরতার উদ্দেশ্য দিতে।”
ইকবালের এই আত্মশক্তি প্রবুদ্ধ মানুষের প্রয়োজন সবখানেই। সাংস্কৃতিক অঙ্গন থেকেও ইকবাল উঠে আসতে হবে, তথা আত্মশক্তিসম্পন্ন ব্যক্তি উঠে আসতে হবে।

এ চ্যালেঞ্জটি সবচেয়ে বহুমুখী ও দীর্ঘস্থায়ী। তাই ধৈর্যের সাথে অবিচল থেকে কাজ করে যাওয়ার কোনো বিকল্প নেই। একইসাথে আমাদের বিবিধ চ্যালঞ্জের কথা মাথায় রেখে মানব ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষগণ তথা নবীগণ, সাহাবা ও আমাদের ১২০০ বছরের সভ্যতার মুজাহিদদের আদলে আমরণ সংগ্রাম করে যেতে হবে।

সময়ের সংকট মোকাবেলায় শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভী, আল্লামা শিবলী নোমানী, মুজতাহিদ আল্লামা ইকবালদের মতো কর্মবীর হতে হবে, ইখলাস ও ইস্তেকামাতের সাথে এসব ক্ষেত্রে আমৃত্যু সংগ্রামে লিপ্ত থাকতে হবে। আমাদের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের ইকবাল, হামিদুল্লাহ উঠে আসার আগ পর্যন্ত আমাদের কোনো উদ্যোগই সফল হবে না, কারণ সফলতার প্রথম শর্ত হলো শক্তিশালী ও যোগ্য ব্যক্তিত্ব গড়ে তোলা।
আমাদের সফলতার সূর্য এই ইখলাসের ভেতর দিয়েই উদিত হবে, ইনশাআল্লাহ। আত্মবিশ্বাস হারানো যাবে না কোনোভাবেই। একজন মুমিনের জন্য হতাশ হওয়া হারাম! এ কথা মনে রাখতে হবে, আল্লামা ইকবাল, আল্লামা শিবলী নোমানী, মাওলানা মওদূদী, মুহাম্মদ হামিদুল্লাহরা কিন্তু ব্রিটিশ উপনিবেশের সময়েই উঠে এসেছেন। আজকের ব্রিটিশ জায়নবাদী ও ব্রাহ্মণ্যবাদীদের শেকল ভেঙেও এ শোষিত জমিন থেকে মুক্তির পতাকা হাতে ইকবাল, শিবলী নোমানী, মওদূদী, হামিদুল্লাহরা উঠে আসবেন, ইনশাআল্লাহ।

১৩৪০ বার পঠিত

শেয়ার করুন

Picture of হাসান আল ফিরদাউস

হাসান আল ফিরদাউস

সংগঠক এবং সমাজ ও সংস্কৃতি বিষয়ক গবেষক হাসান আল ফিরদাউস-এর জন্ম টাংগাইল জেলায়। পড়াশুনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়য়ে সমাজবিজ্ঞান বিভাগে। এছাড়াও আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও ইসলামী সভ্যতা নিয়ে পড়াশোনার পাশাপাশি উসূল, ফিকহ এবং রাজনৈতিক দর্শনের উপর বড় শিক্ষকদের সাহচর্যে গবেষণা করে যাচ্ছেন। আন্তর্জাতিক স্কলার ও চিন্তাবিদদের সমন্বয়ে নানাবিধ গবেষণা ও একাডেমিক কার্যক্রম পরিচালনার পাশাপাশি নিয়মিত লেখালেখি করছেন। বর্তমানে তিনি ‘ইসলামী চিন্তা ও গবেষণা ইন্সটিটিউট’-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্বরত আছেন। একইসাথে জ্ঞানের পুনর্জাগরণ ও নবধারার কাগজ ত্রৈমাসিক মিহওয়ার-এর সম্পাদকও।
Picture of হাসান আল ফিরদাউস

হাসান আল ফিরদাউস

সংগঠক এবং সমাজ ও সংস্কৃতি বিষয়ক গবেষক হাসান আল ফিরদাউস-এর জন্ম টাংগাইল জেলায়। পড়াশুনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়য়ে সমাজবিজ্ঞান বিভাগে। এছাড়াও আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও ইসলামী সভ্যতা নিয়ে পড়াশোনার পাশাপাশি উসূল, ফিকহ এবং রাজনৈতিক দর্শনের উপর বড় শিক্ষকদের সাহচর্যে গবেষণা করে যাচ্ছেন। আন্তর্জাতিক স্কলার ও চিন্তাবিদদের সমন্বয়ে নানাবিধ গবেষণা ও একাডেমিক কার্যক্রম পরিচালনার পাশাপাশি নিয়মিত লেখালেখি করছেন। বর্তমানে তিনি ‘ইসলামী চিন্তা ও গবেষণা ইন্সটিটিউট’-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্বরত আছেন। একইসাথে জ্ঞানের পুনর্জাগরণ ও নবধারার কাগজ ত্রৈমাসিক মিহওয়ার-এর সম্পাদকও।

মতামত প্রকাশ করুন

Scroll to Top