বিশ্বব্যাপী পুনর্জাগরণের অদম্য নকীব ‘শহীদ ইমাম হাসান আল বান্না’

আমর ইবনুল আস (রা.) এর গড়ে তোলা মিশর একসময় হয়ে ওঠে সুলতান সালাহউদ্দীন আইউবীর শহর। এখন আমাদের কাছে যা শহীদ বান্নার শহর হিসেবে পরিচিত। কে এই বান্না? যিনি মনে অসীম সাহস আর কর্মে ইখলাস নিয়ে যৌবনের প্রারম্ভে মাত্র ২২ বছর বয়সে ১৯২৮ সালের মার্চ মাসে তৎকালীন সাম্রাজ্যবাদের ছায়া বেষ্টিত মিসরে এক বিপ্লবী সংগঠন গড়ে তোলেন। যা কিনা পরবর্তী সময়ে মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকাসহ সমগ্র দুনিয়াব্যাপী এক নবজাগরণ সৃষ্টি করে।

তিনি বিংশ শতকের অন্যতম সেরা সংগঠক, আলেম, রাজনীতিবিদ এবং কালের মহানায়ক শহীদ ইমাম হাসান আল বান্না।

বান্না জন্মগ্রহণ করেন ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে মিসরের আলেকজান্দ্রিয়া শহরের এক ঐতিহ্যবাহী আলেম পরিবারে। তাঁর পিতা শায়খ আবদুর রহমান আল-বান্না ছিলেন একজন বিজ্ঞ আলেম এবং প্রখ্যাত মুহাদ্দিস। তিনি “আল ফাতহুর রব্বানী লি তারতিবি মুসনাদি’ল ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল আশ-শায়বানী” নামক গ্রন্থের রচয়িতা। শহীদ বান্নার প্রাথমিক শিক্ষা পারিবারিক আবেশে পিতার নিকট শুরু হয়। ৮ বছর বয়সেই তিনি মহাগ্রন্থ আল-কোরআন হেফজ করেন। অতঃপর তাকে আলেকজান্দ্রিয়ার মাদরাসাতুর রাশাদে দ্বীনিয়াতে ভর্তি করা হয়। ছাত্র জীবনে তুখোড় মেধাবী এবং চরিত্রবান হিসাবে তিনি সকলের সুদৃষ্টি আকর্ষণ করেন। মেধার স্বাক্ষর এতোটাই রাখেন যে, শিক্ষকগণও অনেক জটিল বিষয়ে শহীদ বান্নার সাথে আলােচনা করতে দ্বিধা করতেন না।

মাদরাসার শিক্ষা সমাপ্ত করে ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দে বান্না টিচার্স ট্রেনিং কলেজে ভর্তি হন। ট্রেনিং শেষে কিছুকাল শিক্ষকতার কাজে ব্যয় করেন। শিক্ষকতার জীবনেই শহীদ বান্নার অসাধারণ প্রজ্ঞার পরিচয় ফুটে ওঠে এবং দ্বীনের প্রতি দরদবােধের জন্য খ্যাত হয়ে উঠেন। এই সময়ে তিনি বক্তৃতা এবং লেখনীর সাহায্যে দ্বীন প্রচারের কাজে আত্মনিয়ােগ করেন। প্রাথমিক স্কুলের সংকীর্ণ চৌহদ্দিতে শিক্ষকতার গণ্ডীতে আবদ্ধ থেকে বৃহত্তর সমাজ-জীবনে কোনো বৈপ্লবিক কর্মপন্থা গ্রহণ সম্ভব নয় মনে করে যুবক বান্না উচ্চতর শিক্ষা লাভের উদ্দেশ্যে কায়রাের সুবিখ্যাত আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। আল-আজহার মুসলিম জাহানের অন্যতম শ্রেষ্ঠ এবং প্রাচীন শিক্ষালয়। আজহারের সুপ্রাচীন ঐতিহ্য এবং বৃহত্তম জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে শহীদ বান্নার অনুসন্ধিৎসু মনের খােরাক ছিলো অপরিসীম। কয়েক বছর গভীর মনােযােগে অধ্যয়ন করে ১৯২৭ সালে কৃতিত্বের সাথে গ্রাজুয়েশন ডিগ্রী লাভ করেন।

কায়রােতে অধ্যয়ন কালেই তিনি সামাজিক সংগঠনের সাথে যুক্ত হয়ে ভবিষ্যৎ কর্মজীবনের ভিত্তিভূমি রচনা করেন। এখানে পড়াশােনা কালে তিনি ব্যাপক চিন্তা-ভাবনা এবং নানামুখী কর্মের সাথে যুক্ত হয়ে বাস্তব ময়দানে কাজ করার সুযােগ লাভ করেন। এসময় “আঞ্জুমানে ইনসিদাদে-মুহাররমাত” “জামিয়তে মাকারেমে আখলাকে ইসলামী” প্রভৃতি সামাজিক সংগঠন তখন মিসরের বিভিন্ন এলাকায় কাজ করছিল। অন্যায়ের প্রতিরােধ এবং মুসলিম সমাজকে সত্য ও ন্যায়ের পথে উদ্বুদ্ধ করাই ছিলো এই প্রতিষ্ঠানগুলোর লক্ষ্য। এই সব সংস্থার সক্রিয় কর্মী হিসাবে হাসানুল বান্না নিজেকে যুক্ত করেন। সামাজিক সংগঠনের সাথে যুক্ত হওয়ার ফলে যৌবনের প্রারম্ভেই মিসরীয় মুসলিম সমাজের সাথে প্রত্যক্ষভাবে পরিচিত হওয়ার সুযােগ লাভ করেন। তদানীন্তন মিসরীয় সমাজ-জীবন ছিলো পাশ্চাত্যের চতুর্মুখী আগ্রাসনের চারণক্ষেত্র। শিক্ষিত মুসলমান সমাজের বিরাট এক অংশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তির গভীর ষড়যন্ত্র-জালের আড়কাঠি হিসাবে সামান্য স্বার্থের বিনিময়ে বিবেক বিক্রি করে চলছিলো।

রাজা ফারুক তখন মিসরের শাসনকর্তা। নামে তিনি শাসক হলেও প্রশাসন-যন্ত্রের সব গুরুত্বপূর্ণ পদ ছিল খ্রিষ্টান এবং বিদেশী ইংরেজদের দখলে। দেশের অর্থনীতির প্রধান নিয়ন্তা ছিল ইহুদী ব্যবসায়ী চক্র। ইসলামের এই দুই প্রধান শত্রু মিলে মুসলমান জনগণকে আত্মবিস্মৃত মােহগ্ৰস্ত করে রাখার সকল বন্দোবস্ত পাকা-পোক্ত করে রেখেছিলো। সাহিত্য-সংস্কৃতি হতে শুরু করে সমাজ-জীবনের প্রতিটি রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করার ব্যাপক সুব্যবস্থা ছিল তাদের হাতের মুঠোয়।

সুয়েজ প্রণালীর বদৌলতে মিসর প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের প্রধান যােগসূত্র এবং ব্যবসা-কেন্দ্র হিসাবে অপরিসীম গুরুত্বের অধিকারী। উপরন্তু নীলনদ-বিধৌত মিসরের ভূমি অত্যন্ত উর্বর বিধায় কৃষিক্ষেত্রেও এই দেশটির বিরাট ভূমিকা রয়েছে। এসব কারণে গােড়ার দিক থেকেই পাশ্চাত্যের দখলদার শক্তির লুলােপ দৃষ্টি এই দেশের প্রতি নিবদ্ধ ছিলো। রাজতন্ত্রের দুর্বল ভিত্তিভূমি সাম্রাজ্যবাদীদের পক্ষে অত্যন্ত উপযােগী। তাই রাজতন্ত্র-শাসিত মিসরভূমিতে পাশ্চাত্য ষড়যন্ত্রকারীদের দীর্ঘকালের কুটিল আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়িত হতে দেরি হলো না। রাজা ফারুক ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদীদের সাথে এমন সব চুক্তিতে আবদ্ধ ছিলেন, যেগুলো নামে মাত্র স্বাধীন চুক্তি হলেও প্রকৃত অর্থে দেশটি ইংরেজ আশ্রিত একটি রাজ্য ছাড়া আর কিছুই ছিলো না। ইংরেজ এবং ইহুদীদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় দেশের সর্বত্র নৈশক্লাব, রঙ্গমঞ্চ এবং প্রেক্ষাগৃহের জাল ছড়িয়ে দেয়া হয়। সর্বত্র ব্যভিচার এবং আমােদ-ফুর্তির প্লাবণ শুরু হলো। সাধারণ কফিখানাগুলো পৰ্যন্ত নৃত্য-গীত এবং ব্যভিচারের আড্ডাখানায় পরিণত হয়। চারিদিকে এইরূপ অস্বাভাবিক অনাচারের প্লাবণ দেখে যুবক হাসান আল বান্নার অনুভূতিপ্রবণ অন্তর দারুনভাবে আলােড়িত হয়।

এর কবল থেকে জাতিকে মুক্ত করে এক সোনালী সমাজ প্রতিষ্ঠায় বান্না নিজের জীবনকে উৎসর্গ করার সিদ্ধান্ত নেন।  ইসলামই যে মানব মুক্তির একমাত্র অবলম্বন সেটা তিনি মনে-প্রাণে বিশ্বাস করতেন। তাই তিনি তার এক বক্তৃতায় দৃঢ় কণ্ঠে ঘোষণা করেন, “হে আমার জাতি! নতুন করে ইসলামে আবার ফিরে আসুন। আপনাদের জন্য এখানেই রয়েছে সম্মান ও মর্যাদা। এখানেই রয়েছে শান্তি ও সুখ।” তিনি এমন এক প্রজন্মের প্রয়োজন অনুভব করেন যারা ইসলামকে আঁকড়ে ধরে রাখবে, ইসলাম তাদেরকে ধরে রাখবে এমন নয়।

যুবক বান্না আল-আজহার হতে বের হয়েই তাঁর স্বপ্ন বাস্তবায়নে মাঠে নামেন। দীর্ঘ এক বছর সময় নিয়ে তিনি তার চিন্তা, কাজ এবং পরিকল্পনা নানা জনের সাথে আলোচনা-পর্যালোচনা করেন। এর মধ্য থেকে ৬ জন উল্লেখযোগ্য। তারা হলেন-

১. হাফেজ আবদুল হামিদ।

২. আবদুর রহমান হাসিবুল্লাহ।

৩. জাকি উল মাগরেবী।

৪. আমানুল হাসরী।

৫. ইসমাঈল ইর্জ এবং

৬. ফুয়াদ ইবরাহীম।

১৯২৮ সালের মার্চ মাসে এই কয়জন জান-বাজ মুজাহীদদেরকে নিয়ে আলেকজান্দ্রিয়ায় ইমাম হাসানুল বান্নার ক্ষুদ্র বাসভবনে ইখওয়ানুল মুসলিমীনের ঐতিহাসিক যাত্রা শুরু হয়।

প্রাথমিক পাঁচ বছর আলেকজান্দ্রিয়াতেই সংস্থার সদর দফতর থাকে। এখান থেকেই চারিদিকে বিস্তৃত প্রতিকূল পরিবেশের বিভীষিকা অতিক্রম করে দেশের বিভিন্ন এলাকায় নব আন্দোলনের দাওয়াত ছড়িয়ে পড়ে । আদর্শিক দৃষ্টিভঙ্গির আলােকে রাজধানী কায়রাে ছিল সর্বাপেক্ষা সমস্যা জর্জরিত এলাকা। তাই পাঁচ বৎসর পর কিছুটা শক্তি সঞ্চয় করে ১৯৩৩ সালে ইখওয়ানের সদর দপ্তর আলেকজান্দ্রিয়া থেকে কায়রােতে স্থানান্তরিত করা হয়।

প্রাথমিক অবস্থায় কিছুটা শক্তি সঞ্চয় করে ইখওয়ান কর্মীগণ সর্বাত্মক অভিযান শুরু করেন। তারা পানশালার অলস আডডা গুলোতে পর্যন্ত আত্ম-বিস্মৃত মানুষকে আত্মউপলব্ধির দাওয়াত দিতে থাকেন। প্রথম প্রথম বিদ্রুপ-প্রত্যাখ্যানের সম্মুখীন হয়। কিন্তু অল্প দিনের ব্যবধানে পরিস্থিতির ব্যপক পরিবর্তন দেখা গেল। দলে দলে লােক এসে আন্দোলনে শরীক হতে লাগলেন। হাসানুল বান্নাই ছিলেন আগা-গােড়া এই আন্দোলনের মুরশিদে আ-ম বা প্রধান পরিচালক। আন্দোলনকে ধাপে ধাপে অগ্রসর করার উদ্দেশ্যে হাসানুল বান্না যে সমস্ত বক্তৃতা বিবৃতি এবং ইশতেহার প্রকাশ করতেন, এর প্রত্যেকটিই ছিলো যেন এক একটি অগ্নিস্ফুলিঙ্গ, অন্তরের গভীর হতে উত্থিত প্রতিটি কথাই দরদী অন্তরকে স্পর্শ করত।

ইখলাসের প্রভাবের তাঁর দেয়া প্রতিটি বক্তব্য শ্রোতাদের মনে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করতো। তার বক্তৃতার প্রভাব কতখানি; যুবকদের উদ্দেশ্যে দেয়া এই বক্তৃতাই তা প্রমাণ করে।

হে যুবকগণ !

একটি আদর্শ তখনই সফল হবে, যখন সেই আদর্শের ব্যাপারে তোমাদের ঈমান শক্তিশালী হবে, তার প্রতি তোমাদের ইখলাস পরিপূর্ণ হবে, তোমাদের বীরত্ব ও সাহসিকতা সে আদর্শের জন্য বৃদ্ধি পাবে। আর সেই লক্ষ্যে পৌঁছার জন্য তোমাদের প্রস্তুতি নিতে হবে। সে প্রস্তুতি হলো আত্মত্যাগ, কুরবানী এবং নিরলস প্রচেষ্টা চালানো।

আর এর ভিত্তি হলো চারটি-

১। ঈমান।

২। ইখলাস।

৩। বীরত্ব এবং

৪। কঠোর পরিশ্রম

আর এই চারটিই হল যুবকদের বৈশিষ্ট্য।

কেননা ঈমানের মূল ভিত্তি বুদ্ধিদীপ্ত কলব। ইখলাস এর মূল ভিত্তি বিশুদ্ধ হৃদয়, সাহসিকতার মূল ভিত্তি হলো শক্তিশালী চেতনা। আর কাজের মূল হলো দৃঢ় সংকল্প। এই বৈশিষ্ট্যগুলো একমাত্র যুবক ছাড়া অন্য কোথাও পাওয়া যায় না। একারণে প্রতিটি জাতির অতীত এবং বর্তমানের উন্নতি ও অগ্রগতির পিছনে যুবকরাই ছিল মুল চালিকা শক্তি এবং গোপন রহস্য।

প্রতিটি আদর্শবাদী যুবকের স্লোগান ছিল  إِنَّهُمْ فِتْيَةٌ آمَنُوا بِرَبِّهِمْ وَزِدْنَاهُمْ هُدًى (তারা ছিলো কয়েকজন যুবক, তারা তাদের রবের ওপর ঈমান এনেছিলো এবং আমি তাদের সঠিক পথে চলার ক্ষমতা বাড়িয়ে দিয়েছিলাম।  (সুরা কাহফ ১৩)

তোমরা নিরাশ হইয়ো না, কেননা মুসলমানদের চরিত্রে কখনোই নিরাশার ছাপ পড়তে পারে না।

আজকের বাস্তবতাই গতকালের স্বপ্ন, আজকের স্বপ্নই আগামী দিনের বাস্তবতা। এখনও অনেক সময় আছে, সকল প্রকার বিশৃঙ্খলা এবং সীমালঙ্ঘনপূর্বক কর্মকাণ্ডের পরও মুসলিম জনগণের মধ্যে ঈমানী চেতনা মূর্তমান ও জাগরূক। দুর্বল কখনোই সারাজীবন দুর্বল থাকবে না, আর শক্তিমানের শক্তিও সারাজীবন টিকে থাকে না।  وَنُرِيدُ أَن نَّمُنَّ عَلَى الَّذِينَ اسْتُضْعِفُوا فِي الْأَرْضِ وَنَجْعَلَهُمْ أَئِمَّةً وَنَجْعَلَهُمُ الْوَارِثِينَ (আমি সংকল্প করেছিলাম, যাদেরকে পৃথিবীতে লাঞ্ছিত করে রাখা হয়েছিল তাদের প্রতি অনুগ্রহ করবো, তাদেরকে নেতৃত্ব দান করবো, তাদেরকেই উত্তরাধিকারী বানাবো।) (সুরা কাসাস ৫)

নিশ্চয় সময় অনেক বড় বড় ঘটনার জন্ম দিবে এবং অনেক বড় বড় কাজেরও সুযোগ সৃষ্টি করে দিবে।

হে আগামীর পুর্ণজাগরণের রাহবারেরা,

সমগ্র দুনিয়া আজ তোমাদের দাওয়াতের অপেক্ষায়। আর সে দাওয়াত হলো হেদায়াতের, সে দাওয়াত হলো সফলতা এবং শান্তির। জাতিকে পথ প্রদর্শন করা এবং নেতৃত্ব দেওয়ার পালা আজ তোমাদের উপর এসে পড়েছে।

وَتِلۡكَ الۡاَيَّامُ نُدَاوِلُهَا بَيۡنَ النَّاسِ (এ–তো কালের উত্থান-পতন, মানুষের মধ্যে আমি এর আবর্তন করে থাকি।) (সূরা আলে ইমরান-১৪০)

وَتَرۡجُوۡنَ مِنَ اللّٰهِ مَا لَا يَرۡجُوۡنَ‌ؕ (আর তোমরা আল্লাহর কাছে এমন জিনিস আশা করো, যা তারা আশা করে না।) (সূরা নিসা-১০৪)

ওহে যুবকেরা!

প্রস্তুতি নাও। আজকের কাজ আগামী দিনের জন্য ফেলে রেখো না। হয়তো আগামীকাল সময় নাও পেতে পারো।❞

১৯৪৫ সালের শেষ দিকে ইখওয়ানুল মুসলিমীনের আমীর নির্বাচনে শহীদ বান্না আমরণ ইখওয়ানের মুর্শিদে আম নিযুক্ত হন। দীর্ঘ বিশ বছর ইখওয়ানুল মুসলিমীনের মুরশিদে আ-ম বা প্রধান হিসাবে হাসানুল বান্না মিসর-বাসীকে ইসলামের দাওয়াত দেন। তাঁর সে দাওয়াতের ঢেউ মিসরের সীমা অতিক্রম করে সমগ্র আরব-জাহানে ছড়িয়ে পড়ে। যুব সমাজের মধ্যে ইসলামের বিপ্লবী চেতনা এমন ভাবে ছড়িয়ে পড়ে যে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বাণিজ্য কেন্দ্র, অফিস-আদালত থেকে শুরু করে খেতে-খামারে পর্যন্ত এই চেতনার প্রভাব অত্যন্ত দর্শনীয় ভাবে ফুটে ওঠে। বিশ বছরের কর্মজীবনে ইখওয়ান প্রায় বিশ লক্ষ প্রাথমিক সদস্য এবং দুই হাজারেরও বেশি শাখা প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। দেশের বাহিরে সুদান, সিরিয়া, ইরাক এমনকি সুদূর তুরস্কে পর্যন্ত ইখওয়ানের প্রভাব পরিলক্ষিত হতে থাকে। ইখওয়ানের সামগ্রিক আন্দোলনের মধ্যে শিক্ষা-সংস্কার এবং ইসলামী ভাবধারায় তরুণ মানস গড়ে তােলার প্রয়াস ছিল অন্যতম প্রধান কর্মসূচী। এই কর্মসূচীর অধীনে ইখওয়ান কর্মীগণ অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। নারী শিক্ষা সংস্কারে তারা পৃথক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং স্বতন্ত্র কারিকুলাম তৈরি করেন।

সত্যের সঙ্গে অসত্যের, হকের সঙ্গে বাতিলের সংঘাত চিরন্তন। ইসলামের যে দাওয়াতে বাতিল শক্তির টনক নড়ে না, সেই দাওয়াতের যথার্থতা সম্পর্কে সন্দেহ পােষণ করার যথেষ্ট কারণ থাকে। হকের দাওয়াত জোরদার হওয়ার সাথে সাথেই বাতিল সর্বশক্তি নিয়ে তার বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ইখওয়ানের আন্দোলনের সাথে এই চিরন্তন রীতির ব্যত্যয় হলো না। রাজা ফারুক পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর হাতের পুতুলে পরিণত হয়ে গেছিলেন। ইখওয়ানের বৈপ্লবিক আন্দোলনের গতিধারা প্রত্যক্ষ করে সাম্রাজ্যবাদীরা রীতিমত আতঙ্কিত হয়ে ওঠে। এবার সর্বশক্তি নিয়ােগ করে ইখওয়ানের আওয়াজকে স্তব্ধ করে দেওয়ার জন্য তারা তৎপর হয়ে ওঠে ।

১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে রাজা ফারুক ইখওয়ানুল মুসলিমীনকে বে-আইনী ঘােষণা করে সংগঠনের কর্মীগণকে ব্যাপকভাবে কারাগারে নিক্ষেপ করতে শুরু করে। বিপ্লবী ইমাম হাসান আল বান্না-ই যে এই বিপ্লবী কাফেলার প্রধান রাহবার, এই সম্পর্কে শত্রুরা ভালোভাবেই ওয়াকেফহাল ছিলো। তাছাড়া শহীদ বান্না ছিলেন বরাবরই দখলদার ইজরায়েলের অস্তিত্বের বিরোধী। ফলে আন্দোলনের অসংখ্য কর্মীকে গ্রেফতার করার পরও মুরশিদে আমকে গ্রেফতার করা হলো না। তাঁকে দুনিয়া থেকে চিরতরে বিদায় করে দেয়ার পৈশাচিক ষড়যন্ত্র আঁটা হলো ।

১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দের ১২ই ফেব্রুয়ারি দিবাগত রাতে ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন হবে, পরিকল্পনা আঁটা হলো। মুরশিদে আ-ম সন্ধ্যার পর শুব্বানুল মুসলিমীনের কেন্দীয় কার্যালয় থেকে কর্মীসভায় বক্তৃতা দিয়ে ফেরার পথে তাঁর গাড়ি লক্ষ্য করে পর পর কয়েক রাউণ্ড গুলী করা হয়। সাথে সাথে ধরায় লুটিয়ে পড়ে মহান বিপ্লবীর নিতর দেহ। হাসপাতালে নেয়ার পথে তিনি মহান রবের সাক্ষাতে উর্ধ্বজগতে পাড়ি জমান।

–ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।

দ্বীনের চেরাগ ফুৎকারে নিভিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টা চিরন্তন। কিন্তু সত্যের আলো কি তাতে নিভে যায়? ইখওয়ানের বিপ্লবী নেতা শহীদ হয়েছেন, কিন্তু তাঁর পয়গাম আজ বিশ্বব্যাপী এক বিপ্লবী পয়গাম। তৃতীয় বিশ্বে যে সংগ্রামী অগ্রযাত্রা শুরু হয়েছে, সেই কাফেলার অগ্রভাগে আজ অমর শহীদ হাসানুল বান্না’র স্বপ্নই বাস্তবায়িত হতে দেখা যাচ্ছে। আজ মরক্কো হতে ইন্দোনেশিয়া পৰ্যন্ত শহীদের এক এক কাতর। খুনে ইসলামী বিপ্লবের এক একটি বেগ-বতী স্রোতধারার সৃষ্টি করেছে।

শহীদ বান্নার শেষ পয়গাম ছিলো,—

“আল্লাহর দ্বীনকে জীবনের সর্বক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত করার পূর্ব পর্যন্ত আমাদের কাফেলার বিরাম নাই।

প্রাপ্তি স্বীকার

 

১. ইসলামী সভ্যতায় রাজনীতি ও বিশ্বব্যাপী ইসলামী আন্দোলন, হাসান আল ফিরদাউস। মক্তব প্রকাশন, আগষ্ট-২০২১।

২. উত্তর আধুনিক মুসলিম মন, ফাহমিদ-উর-রহমান। বাংলা সাহিত্য পরিষদ। এপ্রিল-২০১০

 

১২৮১ বার পঠিত

শেয়ার করুন

Picture of রোয়াক ডেস্ক

রোয়াক ডেস্ক

রোয়াক । ইসলামী চিন্তা ও গবেষণা ইন্সটিটিউটের অনলাইন মুখপাত্র। বুদ্ধিবৃত্তিক ও সময়ের চিন্তাগত সংকট থেকে উত্তরণের জন্য কাজ করে যাবে।
Picture of রোয়াক ডেস্ক

রোয়াক ডেস্ক

রোয়াক । ইসলামী চিন্তা ও গবেষণা ইন্সটিটিউটের অনলাইন মুখপাত্র। বুদ্ধিবৃত্তিক ও সময়ের চিন্তাগত সংকট থেকে উত্তরণের জন্য কাজ করে যাবে।

মতামত প্রকাশ করুন

Scroll to Top