হালের অর্থনীতিতে ভয়াবহ বেকারত্ব ও ছাত্রসমাজের ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তা

করোনাকালীন সময়ে অর্থনৈতিক সংকট ভয়াবহ আকারে বেড়েছে তা সত্যি, কিন্তু সমাধানের চিন্তা ও আওয়াজকে বাদ দিয়ে সংকট কেন্দ্রিক সব সমস্যার জন্য করোনা পরিস্থিতিকে দোষারোপ করলেই কি মুক্তি পাওয়া যাবে?

ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (ইআইইউ) প্রতিবেদন মতে বর্তমানে বাংলাদেশের ৪৭ শতাংশ স্নাতকই বেকার। জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) তথ্য মতে দেশে ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী বেকার যুবকের সংখ্যা ১ কোটি ৩২ লাখ। বাংলাদেশে এখন ১০ কোটি ৫৬ লাখ মানুষ কর্মক্ষম, যা মোট জনগোষ্ঠীর ৬৬ শতাংশ। কিন্তু সে অনুযায়ী কর্মসংস্থান কোথায়?
চাকরির একেবারেই সাধারণ ছয়টি পদের বিপরীতে অনলাইন ও অফলাইনে আবেদন জমা পড়ে ৮২ হাজার ৬৫২টি! ভাবা যায় দেশের কী অবস্থা?

প্রশ্ন হলো এসবের জন্যও কি করোনা পরিস্থিতিই দায়ী? এসব কি একদিনেই হয়েছে? ‘না’।

আবার এখন করোনাকালীন যে অবস্থা, তাতে ভবিষ্যতে খাতা-কলমে এ সংখ্যা এবং জনজীবনের দুর্দশা যে কত গুণ বাড়বে তা হিসাবেরও বাইরে!

প্রথম আলোর প্রতিবেদন অনুযায়ী এ সময়ে দরিদ্র ও অতি দরিদ্র মানুষের সংখ্যা ৪ কোটি ৭৫ লক্ষ থেকে বেড়ে দ্বিগুণ, অর্থাৎ সাড়ে আট কোটিতে পৌঁছাচ্ছে, যাদের দৈনিক আয় ১.৯ ডলারেরও কম। খাদ্য সংকটে নতুনভাবে যুক্ত হয়েছে ৬ কোটি ৯৯ লক্ষ মানুষ। সংখ্যাগুলো কখনোই বাস্তবতাকে ধারণ করে না, তারপরও শুধুমাত্র সংখ্যার হিসেবেই পরিস্থিতি কী ভয়াবহ তা আমরা ভাবতে পারছি?

আবার দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বাড়ার সাথে সাথে মধ্যবিত্ত মানুষেরও আয় কমছে, ব্যক্তিগত সঞ্চয় ফুরিয়ে যাচ্ছে, চিকিৎসা ব্যয় বাড়ছে; সামষ্টিক বা পারিবারিক সঞ্চয় কমছে বলে ব্যক্তিগত ধার/ঋণের সুযোগ কমছে। এ সংকোচনের ফলাফল বিশ্লেষণ করলে স্পষ্ট বুঝা যায়, প্রতিনিয়তই বেকারত্বজনিত কর্মহীনতার কবলে পড়ে শিক্ষা খাতে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর পরিমাণ শুধু বাড়তেই থাকবে।
কৃষি ও ভাসমান কাজে নিশ্চিতভাবে শিশুশ্রম বাড়বে।
একইসাথে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থীদের ঝরে পড়া ব্যাপকহারে বাড়বে।
গ্রামীণ ও দরিদ্র শিক্ষার্থীদের পাশের হার কমে আসবে।

তাহলে আগামী প্রজন্মের ভবিষ্যৎ কী?
শিক্ষায় ঝরে পড়া বিশাল ছাত্র-সমাজকে নিয়ে কে ভাবছে? আগামীর প্রজন্মকে নিয়ে আমাদের ভাবনা কী? রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ গ্রহণের ব্যাপারে, প্রতিবাদ করে বা যে কোনো উপায়ে সংকট তুলে ধরে রাষ্ট্রকে সমাধান করতে বাধ্য করার ব্যাপারে কারোরই যেন মাথাব্যথা নেই!

একটু চিন্তা করে দেখুন তো, বেকারত্ব আর ঝরে পড়ার পরিমাণ যখন বাড়বে, সামাজিক অপরাধ আর নিরাপত্তাহীনতা কি তখন কমবে? নাকি ভয়াবহ আকারে বাড়তে থাকবে?

এদিকে অধ্যয়নরত ৪০% শিক্ষার্থীর অর্থ যোগান দেয় তার পরিবারের প্রবাসে থাকা সদস্যরা। তাদের কী অবস্থা?
এ আয় আমাদের রেমিট্যান্স আয়ও, যা দেশের আয়ের অন্যতম প্রধান উৎস। অথচ প্রবাস থেকে শ্রমিকরা ফিরে আসছে প্রতিনিয়ত! ফলে আয়ের অন্যতম উৎস রেমিট্যান্সের পরিমাণও কমে যাচ্ছে । এখন পর্যন্ত খালি হাতে দেশে ফিরেছেন প্রায় ২৩ লক্ষ শ্রমিক, কিন্তু সমাধানের কোনো উদ্যোগ নেই!

আবার খেটে খাওয়া শ্রমিক, কৃষক, সবজি বিক্রেতা থেকে শুরু করে এ জাতীয় হাজারো ক্ষুদ্র শ্রেণি-পেশার মানুষদের এখন যা অবস্থা, তা তো আমরা স্বচক্ষেই দেখতে পারছি ।

এসবের সমাধান কার কাছে?
(হ্যাঁ, মানুষ ব্যক্তিগতভাবে মানুষের পাশে দাঁড়াবে । কিন্তু সবচেয়ে বড় দায়িত্ব রাষ্ট্রের। রাষ্ট্র যদি পাশে না দাঁড়ায়, মানুষ কতদিন ব্যক্তিগতভাবে সাহায্য সহযোগিতা করতে সক্ষম হবে?)

কিছুদিন আগেও দেখেছিলাম করোনা সংকট মোকাবেলায় শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলো অনেক বরাদ্দ দিয়েছে যা সরাসরি এ শ্রেণি-পেশার মানুষেরা পেয়েছে। যেমন:
যুক্তরাষ্ট্র ১ ট্রিলিয়ন ডলার, জার্মানি ৬১৪ বিলিয়ন ডলার, ব্রিটেন ৪১২ বিলিয়ন ডলার, স্পেন ২১৬ বিলিয়ন ডলার, কানাডা ৫৬.৮ বিলিয়ন ডলার, পোল্যান্ড ৫১.৩ বিলিয়ন ডলার, চেক রিপাবলিক ৪০ বিলিয়ন ডলার, সুইডেন ২৯ বিলিয়ন ডলার, ইতালি ২৭ বিলিয়ন ডলার, সংযুক্ত আরব আমিরাত ২৭ বিলিয়ন ডলার, কাতার ২৩ বিলিয়ন ডলার, জাপান ১৯ বিলিয়ন ডলার, হংকং ১৫ বিলিয়ন ডলার, তুরস্ক ১৫ বিলিয়ন ডলার, সৌদি আরব ১৩ বিলিয়ন ডলার বরাদ্দ দিয়েছে ।

আমাদের দেশের বরাদ্দ কোথায়?
(হ্যাঁ, দেয়! কাদের দেয়? বড় বড় কোম্পানিগুলোকে দেয়, অর্থাৎ তেলা মাথায় তেল দেওয়া! আবার নামে যতটুকু দরিদ্রদের দেয়, তার কতটুকুই বা তাদের কাছে পৌঁছায়?)

সব মিলিয়ে এ সংকট কবে কাটবে? কবে এ নিয়ে সরকার চাপে পড়বে? আমরাই বা কবে বৃহত্তর পরিসরে আওয়াজ তুলবো?

এসবের উত্তরে একটি কথা ঘুরেফিরেই শুনতে হয় ‘বাংলাদেশ তৃতীয় বিশ্বের দরিদ্র একটি দেশ, দরিদ্র্যতা এর নিত্য বিষয়’। অথচ আমাদের ৫০ এর উপরে খনিজ সম্পদ, সব বিদেশীদের হাতে ইজারা দেওয়া। ইউরেনিয়ামের মত দামী সম্পদ, যার জন্য এত যুদ্ধ, তা কিনা আমরা সাম্রাজ্যবাদীদের বিনা পয়সায় দিয়ে যাচ্ছি!

এদিকে কৃষির ক্ষেত্রে “বণিক বার্তা”য় প্রকাশিত সবচেয়ে ভয়াবহ যে রিপোর্ট আমরা দেখেছি, তা হলো ধান ব্যতীত সকল প্রকার কৃষিদ্রব্য বাহির থেকে আমদানি করতে হচ্ছে আমাদের! অথচ আমরা গান গাই ‘ধন ধান্য পুষ্প ভরা, আমাদের এই বসুন্ধরা’..

গার্মেন্টস খাতে যা হচ্ছে তা নিয়ে আর কী-ই বা বলবো! লাখ লাখ মানুষ পথে বসার উপক্রম!
শুধু গার্মেন্টস কেন, সব খাতেই একই অবস্থা ।

আচ্ছা, এ কৃষি, শিল্প, খনিজ সম্পদ, বন্দর নিয়ে যদি আমাদের সমাজের নীতিনির্ধারকরা না ভাবেন, তবে মুক্তি আসবে কীভাবে?
হাজারো বেকার ও ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের নিয়ে যদি কোনো পরিকল্পনাই না থাকে, তবে আমাদের ভবিষ্যৎই বা কী?

জাতির ভবিষ্যৎ বিনির্মাণকারী এ শিক্ষিত বেকার ও ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের নিয়ে না ভাবলে ভবিষ্যৎ অন্ধকারেই নিমজ্জিত হতে থাকবে, আর অসুস্থ প্রতিযোগিতায় আগামী প্রজন্মের উজ্জ্বল সম্ভাবনাগুলো মারা পড়বে।

ঈদ পরবর্তী কুরবানীর গোশত খাওয়ার আনন্দঘন সময়ে আমার বেদনার সুর বাজানোর কারণ হলো সত্যিকারের আনন্দ আমরা করতে পারছিনা। মানুষ ভালো না থাকলে কিসের আনন্দ! করোনা চলে গেলেই সব ঠিক হয়ে যাবে– বিষয়টি আসলে তেমন নয়। এ দুর্দশা বহুদিনের। এখনই পদক্ষেপ না নিলে প্রতিদিন দুর্দশা আরও বহুগুণে বৃদ্ধি পেতে থাকবে। তাই আজ করোনা সমস্যা, কাল আরেক সমস্যা, পরশু অন্য আরেক সমস্যার অজুহাতে বসে থাকলে চলবে না। এ সকল সমস্যা চলতেই থাকবে, এটিই স্বাভাবিক। সমস্যার অজুহাতে নির্লিপ্ত হয়ে থাকলে অবস্থার উন্নতি কখনোই হবে না, বরং দিনকে দিন পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যেতে থাকবে।

কিন্তু আমরা যদি আমাদের প্রত্যেকটি খাতকে শক্তিশালী করার পরিকল্পনা গ্রহণ করি এবং সে আলোকে কাজ করে যাই, তাহলে সকল সমস্যা ও সংকট মোকাবেলা অবশ্যই সহজ হয়ে যাবে এবং এতে করে স্থায়ী মুক্তির দিকেও ধাবিত হওয়া সম্ভব হবে।

১০৯৩ বার পঠিত

শেয়ার করুন

Picture of হাসান আল ফিরদাউস

হাসান আল ফিরদাউস

সংগঠক এবং সমাজ ও সংস্কৃতি বিষয়ক গবেষক হাসান আল ফিরদাউস-এর জন্ম টাংগাইল জেলায়। পড়াশুনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়য়ে সমাজবিজ্ঞান বিভাগে। এছাড়াও আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও ইসলামী সভ্যতা নিয়ে পড়াশোনার পাশাপাশি উসূল, ফিকহ এবং রাজনৈতিক দর্শনের উপর বড় শিক্ষকদের সাহচর্যে গবেষণা করে যাচ্ছেন। আন্তর্জাতিক স্কলার ও চিন্তাবিদদের সমন্বয়ে নানাবিধ গবেষণা ও একাডেমিক কার্যক্রম পরিচালনার পাশাপাশি নিয়মিত লেখালেখি করছেন। বর্তমানে তিনি ‘ইসলামী চিন্তা ও গবেষণা ইন্সটিটিউট’-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্বরত আছেন। একইসাথে জ্ঞানের পুনর্জাগরণ ও নবধারার কাগজ ত্রৈমাসিক মিহওয়ার-এর সম্পাদকও।
Picture of হাসান আল ফিরদাউস

হাসান আল ফিরদাউস

সংগঠক এবং সমাজ ও সংস্কৃতি বিষয়ক গবেষক হাসান আল ফিরদাউস-এর জন্ম টাংগাইল জেলায়। পড়াশুনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়য়ে সমাজবিজ্ঞান বিভাগে। এছাড়াও আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও ইসলামী সভ্যতা নিয়ে পড়াশোনার পাশাপাশি উসূল, ফিকহ এবং রাজনৈতিক দর্শনের উপর বড় শিক্ষকদের সাহচর্যে গবেষণা করে যাচ্ছেন। আন্তর্জাতিক স্কলার ও চিন্তাবিদদের সমন্বয়ে নানাবিধ গবেষণা ও একাডেমিক কার্যক্রম পরিচালনার পাশাপাশি নিয়মিত লেখালেখি করছেন। বর্তমানে তিনি ‘ইসলামী চিন্তা ও গবেষণা ইন্সটিটিউট’-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্বরত আছেন। একইসাথে জ্ঞানের পুনর্জাগরণ ও নবধারার কাগজ ত্রৈমাসিক মিহওয়ার-এর সম্পাদকও।

মতামত প্রকাশ করুন

Scroll to Top