মুসলিম জাগরণের অনন্য কবি, আল্লামা ইকবালের প্রথম সারির অনুবাদক ও গীতিকার কবি গোলাম মোস্তফা। তিনি গদ্য সাহিত্যে তার অমর কীর্তি “বিশ্বনবী” লিখার পরে পল্লীকবি জসিম উদ্দিন বলেছিলেন,
“কবির ‘বিশ্বনবী’ এবং অন্যান্য গদ্য রচনার অকুণ্ঠভাবে প্রশংসা করি। তাঁর মতো এমন কবিত্বপূর্ণ ললিতগতিসম্পন্ন গদ্য লেখক আমাদের বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে একজনও নেই।”
অর্থাৎ গদ্য সাহিত্যের আকাশেও তিনি এক মহান তারকা।
কবি গোলাম মোস্তফার জন্ম ঝিনাইদহ জেলায়। তাঁর পিতা গোলাম রব্বানী ও দাদা কাজী গোলাম সরোয়ার দু’জনেই ছিলেন জনপ্রিয় লোককবি। কাজী গোলাম সরোয়ার তৎকালীন নীল বিদ্রোহের সময়ে জাতীয় জাগরণমূলক কবিতা লিখে খ্যাতি অর্জন করেন। অর্থাৎ বুঝা যায়, কবি গোলাম মোস্তফা বংশ পরম্পরায় তিনি কবি হয়ে উঠেছিলেন। ছোট বয়সেই তাঁর সাহিত্য প্রতিভার বিকাশ ঘটে। এ বয়স থেকেই তিনি “আল ইসলাম”, “মোহাম্মদী”, “সুলতান”, “মিহির” ও “সুধাকর” প্রভৃতি তৎকালীন প্রথম শ্রেণির পত্রিকায় সাহিত্য সাধনা চালিয়ে যান নিরবিচ্ছিন্নভাবে। ১৯১৩ সালে মাসিক মোহাম্মদী পত্রিকায় তাঁর ‘আদ্রিয়ানোপল উদ্ধার’ শীর্ষক কবিতাটি সর্বপ্রথম প্রকাশিত হয়।
পরবর্তীতে গোলাম মোস্তফা মূলত মুসলিম জাগরণের অগ্রদূত হয়ে উঠেন। তাঁর অবদান বাংলা সাহিত্যে এক বিরল দৃষ্টান্ত। তিনি ছিলেন একজন বাংলা ভাষী লেখক, অনুবাদক, গীতিকার, গল্পকার, শিশুসাহিত্যিক এবং রেনেসাঁর কবি। এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য কিছু বিষয় হলো–
• তাঁর কাব্যের মূল বিষয়বস্তু ছিলো দ্বীনে মুবিন ইসলাম ও মুসলিম সংস্কৃতি। তাঁর কাব্যের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট হলো সহজ ও শিল্পসম্মত প্রকাশ ভঙ্গি এবং ছন্দোলালিত্য; যা ইসলামের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ছায়ায় ভরপুর থাকতো। এর বাস্তব উদাহরণ হিসেবে তিনি লিখিছেন মানুষ, রাখাল খলিফা, ফাতেমা-ই-দোয়াজ দহম, আল-হেলাল, শবে বরাত, ঈদ উৎসব ইত্যাদি শত কবিতামালা।
‘ঈদ উৎসব’ কবিতায় তিনি লিখেছেন, “আজ সকল ধরা মাঝে বিরাট মানবতা মূরতি লভিয়াছে হর্ষে, আজি প্রানে প্রানে যে ভাব জাগিয়াছে, রাখিতে হবে সারা বর্ষে। এই ঈদ হোক আজি সকল ধন্য, নিখিল মানবের মিলন জন্য, শুভ যা জেগে থাক, অশুভ দূরে যাক। খোদার শুভাশিস পর্শে।”
‘রাখাল খলিফা’ কবিতায় লিখছেন, “নাছোড় খলিফা, কোন কথা তিনি তুলেন না তাঁর কানে, রাজী হল তাই অগত্যা নও কর; রাখাল চলছে উঠের পৃষ্ঠে- খলিফা লাগাম টানে। এ মহাদৃশ্য অপূর্ব সুন্দর।”
• দ্বীনে মুবিন ইসলাম ও মুসলিম সংস্কৃতির পাশাপাশি তার কবিতায় থাকতো জাতিসত্তার চেতনা। তিনি লিখিছেন স্বাধীন মিশর, হিন্দু মুসলমান, মোস্তফা কামাল, বিজয় উল্লাস ইত্যাদি বহু কাব্যমালা।
তার অন্যতম কাব্যগ্রন্থ “রক্ত রাগ” এবং পরবর্তী গ্রন্থাবলীর মধ্যে “হাসনাহেনা”, “খোশরোজ”, “সাহারা”, “বুলবুলিস্তান” ও “রূপের নেশা”, “ভাঙ্গাবুক”, “এক মন এক প্রাণ” ইত্যাদি উপন্যাস বিশেষ আলোড়ন সৃষ্টি করে।
অনুবাদক হিসেবেও তিনি উঠে আসেন এবং বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন। আরবী ও উর্দু সাহিত্য থেকে “ইখওয়ানুস সাফা”, “মুসাদ্দাস-ই-হালী” অনুবাদ করে তিনি বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন। এছাড়া তিনি আল-কোরআন এর বাংলা অনুবাদ করেন। পরবর্তীতে তিনি মহান দার্শনিক আল্লামা ইকবালের “কালাম-ই-ইকবাল”, “শিকওয়া” অনুবাদ করে নিজেকে অনন্য উচ্চতায় তুলে ধরেন।
• তৎকালীন নানামুখী বিতর্ক ও চ্যালেঞ্জকে সামনে রেখে তিনি রচনা করেন “ইসলাম ও কমিউনিজম”, “ইসলামে জেহাদ”, “আমার চিন্তাধারা” নামক গ্রন্থগুলো। এসব গ্রন্থ তাঁর গভীর চিন্তাধারার জ্ঞানলব্ধতারই পরিচয় বহন করে।
• সঙ্গীতের ক্ষেত্রেও তিনি অসাধারণ প্রতিভার পরিচয় দিয়েছেন। গায়ক ও গীতিকার হিসেবে তিনি বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। বিশেষ করে ইসলামী গান, গজল ও মিলাদ মাহফিলের বিখ্যাত “কিয়ামবাণী” রচনায় তিনি ছিলেন অদ্বিতীয়। গোলাম মোস্তফার রচিত গানগুলোর প্রায় সবকটাই আব্বাস উদ্দীন ও তাঁর নিজের কন্ঠে মিলিত ও এককভাবে রেকর্ড হয়েছে। তার মধ্যে কয়েকটি গান কবির নিজস্ব বৈশিষ্ঠ্যে ও আদর্শে রচিত। যেমন– খোদার মহিমায়, হে খোদা দয়াময় রহমান রাহিম, বাদশা তুমি দুনিয়ার, হে পরোয়ার দিগার এবং ইয়া নবী সালাম আলাইকা, ও রাব্বানা শোন শোন আমর মোনাজাত। এ গানগুলো স্বাতন্ত্র ও চিরস্থায়ী মহিমায় সমুজ্জল। তাঁর এ গানগুলোর আদর্শ চিরন্তন।
• তিনি তার কর্মের স্বীকৃতি স্বরূপ ‘সিরাত-ই-ইমতিয়াজ’ উপাধি লাভ করেন।
• তিনি ছিলেন সম্পাদক। “নওবাহার” নামক সাহিত্য পত্রিকা তাঁরই এক অসাধারণ সৃষ্টি।
• তিনি ‘কাব্য সুধাকর’ উপাধি প্রাপ্ত হন।
• রবিউল আউয়াল মাসে যে বিষয়টি সবচেয়ে সুস্পষ্টভাবে সামনে আনা দরকার, তা হলো- কবি গোলাম মোস্তফার অমর সৃষ্টি “বিশ্বনবী” গ্রন্থ। এ অমর গ্রন্থখানা গদ্যে রচিত হলেও সে গদ্য কবিতার মত ছন্দময় এবং মধুর। গ্রন্থখানা বিশ্বনবী হযরত মুহম্মদ (সা.) এর একটি সার্থক জীবন চরিত। গ্রন্থটিতে হৃদয়ের আবেগ, আন্তরিক অনুভূতি যেভাবে বর্ণিত হয়েছে, তার তুলনা আমাদের বাংলা সাহিত্যে নিতান্তই বিরল।
বলা হয়ে থাকে, “বিশ্বনবী” বাংলা সাহিত্যের হীরকখণ্ড-তুল্য গদ্যসাহিত্য। প্রখ্যাত গবেষক ও লেখক ড. এম এ সবুর বলেন,
“গোলাম মোস্তফার অনন্য কীর্তি বিশ্বনবী। বাংলা সাহিত্যের সেরা ও জনপ্রিয় গ্রন্থগুলোর একটি এই গ্রন্থ। গোলাম মোস্তফা ছিলেন রাসূল প্রেমিক এক মহান সাহিত্যিক। তিনি রাসূল (সা.) এর প্রতি অগাধ প্রেম-ভালবাসা থেকেই বিশ্বনবী রচনা করেছেন।” এ প্রসঙ্গে বইটির প্রথম সংস্করণের ভূমিকায় তিনি লিখেন, “মহাপুরুষদের জীবন শুধু ঘটনার ফিরিস্তি নহে; শুধু যুক্তি-তর্কের কণ্টক শয্যাও নহে; সে একটা ভক্তি, শ্রদ্ধা, বিস্ময় ও অনুভবের বস্তু, তাহাকে বুঝিতে হইলে একদিকে চাই সত্যের আলোক ও বিজ্ঞানের বিচার বুদ্ধি, অপরদিকে ঠিক তেমন চাই ভক্তের দরদ, কবির সৌন্দর্যানুভূতি, দার্শনিকের অন্তর্দৃষ্টি আর চাই প্রেমিকের প্রেম। আশেকে রাসূল না হইলে সত্যিকার রাসূলকে দেখা যায় না।”
প্রকৃতপক্ষে “বিশ্বনবী” গোলাম মোস্তফার ‘ইশক রাসূল’ (রাসূল প্রেম) এর ফসল। গ্রন্থটির পরতে পরতে তিনি নিজেকে ‘আশেকে রসূল’ প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছেন।
প্রিয় নবীর জীবনদর্শকে স্মরণ করে কবি লিখেছেন,
“হে রাসুল আজিকার এই পূন্য প্রভাতে আলোকে,তোমার সালাম করি-দূর হতে পরম পুলকে।জাগিয়া উঠুক আজি এই দিনে আমাদের মনেকি অসীম শক্তি আছে লুকাইয়া মানব জীবনে।”
গ্রন্থখানা পাঠ করে সাহিত্যিক শ্রীযুক্ত মনোজ বসু কবিকে একটা চিঠিতে লিখেছিলেন, “আপনার বিশ্বনবী পড়লাম। জাতির একটা বড় কাজ করলেন আপনি। মহামানুষের সর্বকাল ও সর্বদেশের সম্পত্তি। আমি ও আমার মত অনেকেই ধর্মে মুসলমান না হয়েও হযরতকে একান্ত আপনার বলে অনুভব করতে পারলাম। মহানবী (সা) কাছে পৌঁছবার এই সেতু রচনা আপনার অতুলনীয় সাহিত্য কীর্তি।” ‘বিশ্বনবী’ গ্রন্থটি তাঁর গদ্যের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন। এটি বাংলা সাহিত্যে অনবদ্য জনপ্রিয় জীবনীগ্রন্থ। ‘বিশ্বনবী’ লিখাতে হৃদয়ের যে আবেগ, বিশ্বাস ও আন্তরিকতা; ভক্তির যে ভাবোচ্ছ্বাস তা সম্পূর্ণ অভিনব। উক্ত বইয়ের উপর মন্তব্য করতে গিয়ে সাহিত্য সমালোচক শাহাবুদ্দিন আহমদ বলেছেন, “আসলে ‘বিশ্বনবী’ রচনায় তিনি একটি যুগের দাবীকে পূরণ করেছেন এবং মুসলমানদের নব-জাগরনের একটি ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁর পূর্বে বাংলা সাহিত্যে রাসুল (সা) এর জীবনী লিখে বিখ্যাত হয়েছিল শেখ আব্দুর রহিম এবং মওলানা আকরাম খাঁ। সে দুটি গ্রন্থও মুসলিম সমাজে উজ্জীবনে সাহায্য করেছে কিন্তু গোলাম মোস্তফার ‘বিশ্বনবী’ সেই ঐতিহ্য সৃষ্টির আকাশচুম্বী প্রাসাদ।”
• মহান কবির মৃত্যু বার্ষিকীতে বলা আবশ্যক- আজ গোলাম মোস্তফা পাঠ আমাদের অত্যন্ত প্রয়োজন। অবক্ষয়ের এই সময়ে তাঁর লিখনিই সমাজকে অগ্রসর পথে নিয়ে যেতে পারে। গবেষক কামরুজ্জামানের ভাষায়, মুসলিম নবজাগরনের কবি গোলাম মোস্তফা, শিল্পী আব্বাস উদ্দীন ও কবি নজরুল যেন এক সূত্রে গাঁথা। তারা আপন আপন অবস্থান থেকে বাংলা সাহিত্যে অসামান্য অবদান রেখেছেন এবং মুসলিম ঐতিহ্যের ধারাকে সমুন্নত করেছেন। বন্ধুত্বের সূত্রে তারা আবদ্ধ ছিলেন। আর এসব বন্ধুত্বের মূলসূত্রই ছিল মানবকল্যাণ এবং আদর্শ। কেননা কবি গোলাম মোস্তফার বন্ধুদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন— কাজী নজরুল ইসলাম, কন্ঠ শিল্পী আব্বাস উদ্দীন, কবি শাহাদত হোসেন, কবি জসীম উদ্দীন, কবি আব্দুল কাদির, কবি আব্দুস সাত্তার, অধ্যক্ষ ইব্রাহীম খাঁ, ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ প্রমুখ।
• শিশুসাহিত্যিক হিসেবেও তিনি অনন্য এক উচ্চতায় রয়েছেন। ‘কিশোর’ ছড়া-কবিতাটির মাধ্যমে শিশু-কিশোরেরা আন্দোলিত ও উদ্বেলিত হত। ভবিষ্যত শিশু-কিশোরেরা নিজেদেরকে প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে উঠার জন্য গোলাম মোস্তাফার কবিতার মাধ্যমে বহু অনুপ্রেরণা লাভ করতে পারে।
সর্বশেষ গবেষক ড.এম এ সবুর এর কথা দিয়ে শেষ করা যায়,
“গোলাম মোস্তফার সাহিত্যের অধিকাংশেরই উপজীব্য বিষয় ইসলামী আদর্শ ও মুসলিম ঐতিহ্য। নিছক সৌন্দর্য সৃষ্টির উদ্দেশ্যে তিনি লিখেননি; বরং ইসলাম ও ইসলামী আদর্শ রূপায়নের জন্যই তিনি লিখেছেন। তিনি রসাত্মক কবিতা রচনা করলেও কুরআন-হাদিস তথা ইসলামী আদর্শ ঐতিহ্যের প্রতি ছিলেন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিসম্পন্ন। কোন রচনা-ই যেন ইসলাম পরিপন্থী কিংবা ইসলামের বিকৃত উপস্থাপন না হয় সে দিকে তিনি ছিলেন সদা সতর্ক। ইসলামী চেতনার রূপায়ণই তাঁর সাহিত্য-সাধনার প্রধান উদ্দেশ্য এবং মুসলিম সমাজের সাহিত্য-সংস্কৃতির জাগরণ তাঁর লক্ষ্য। তিনি মুসলিম জাতির জাগরণমূলক ইসলামী বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত বিষয়াবলীকেই গীতি কবিতার আঙ্গিকে পরিবেশন করেছেন।”
মহান এই কবি ১৯৬৪ সালের ১৩ অক্টোবর ইন্তেকাল করেন।
“অনন্ত অসীম প্রেমময় তুমি বিচার দিনের স্বামীযত গুন গান, হে চির মহান তোমারি অন্তর্যামী।সরল, সঠিক পুণ্য পন্থা মোদের দাওগো বলিচালাও সে পথে, যে পথে তোমার প্রিয়জন গেছে চলি।”
(মুনাজাত, গোলাম মোস্তফা)