।। বিসমিল্লাহির রহমানীর রাহীম ।।
জালিমের বিচারক এবং মজলুমের সহায়ক শক্তিশালী সেই মহান রবের নামে শুরু করছি। প্রশংসা তাঁর, যিনি সর্বদা নিত্য-নতুন কর্ম সম্পাদন করেন, যিনি মুমিনদের হৃদয়কে অবিচল রাখেন এবং অত্যাচারীদের হৃদয়ে ভীতি সঞ্চার করেন। দুরূদ ও সালাম প্রেরিত হোক মানবজাতির সর্দার মুহাম্মাদ (সা.) এর প্রতি।
সম্মানিত অতিথিবৃন্দ, বিশিষ্ট দায়ীগণ এবং বিজ্ঞ ওলামায়ে কেরাম!
আপনাদেরকে ইসলামের সম্ভাষণ জানাই, আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়াবারাকাতুহ।
আজ এখানে আমরা একত্রিত হয়েছি বর্ণনাতীত আমাদের এই দুঃখটাকে ভাগাভাগি করে নেওয়ার জন্য। গাজায় আমার ভাইয়েরা আজ অবরুদ্ধ ও কারাবন্দি, শিশুরা আজ ক্ষতবিক্ষত এবং বোনেরা আজ নিপীড়িত ও বিতাড়িত। আমাদের নিজেদের এখন প্রশ্ন করা উচিত, আজ এখানে আমরা কোন ভাষায় কথা বলবো! যদিও বা বলি, তাহলে কোন কথাগুলো বলবো! আমরা কি পশ্চিমা অত্যাচারী রাষ্ট্রের সমালোচনাতেই ক্ষান্ত থাকবো নাকি মুসলিম ঘুমন্ত রাষ্ট্রসমূহের প্রতি চেয়ে থাকবো? নাকি আমরা চুপচাপ বসে থেকে গাজার অধিবাসীদের এমন দুর্বিষহ জীবন প্রত্যক্ষ করে যাবো?
সম্মানিত ভাইয়েরা,
আজ আমি আমার অনুভূতি সুস্পষ্টরূপে তুলে ধরতে চাই। মহান রবের শপথ, দীর্ঘদিন যাবত আমি এসব ভেবে আসছি। আর এটা কোনো বিষয় না যে, একথাগুলো আমি ফিলিস্তিনের সেনাবাহিনীর সামনে বলবো নাকি গাজার অবরুদ্ধ অধিবাসীদের সামনে বলবো। এমনকি, কেয়ামতের দিনে আমার এসব কথার দায়ভার আমিই নেবো। এসব কথা যেন সেই সোনালী অতীতে ফিরে যাবার সোপান হয়।
আজ আমি শুধু গাজার অধিবাসীদের নিয়ে কথা বলবো না, অথবা, তাদেরকে সান্ত্বনা দেওয়া বা তাদের উদ্দেশ্যে কিছু বলবো না, বরং, আজ আমি সবার মাঝে একটি মেলবন্ধন তৈরি করার বিষয়টির প্রতি নজর দেবো।
গাজার অধিবাসীদের নিকট থেকে আমি ধৈর্য এবং ইস্তিকামাতের শিক্ষা গ্রহণ করি। গাজার নিষ্পাপ শিশুদের অশ্রুর মাঝে আমি ভবিষ্যৎ খুঁজতে থাকি। গাজার মুজাহিদদের সাহসিকতায় আমি বীরত্ব ও সাহসিকতার দর্শন পাই। গাজার অধিবাসীদের ঐক্যের মাধ্যমে আমি বিশ্বভ্রাতৃত্বের আশার সঞ্চার করে থাকি। তারা আমাদেরকে ঐক্য, ভ্রাতৃত্ব, সম্মান, মর্যাদা, সাহসিকতা ও বীরত্বের শিক্ষা দিয়ে যাচ্ছে। সর্বোপরি বলা যায়, আজকের গাজা আমাদেরকে এমন শিক্ষা দিয়ে যাচ্ছে, যা আমরা কোনো প্রতিষ্ঠানে পাই না।
সম্মানিত উপস্থিতি,
আজ আমি চারটি বার্তা প্রদান করতে চাই।
প্রথম বার্তাটি পশ্চিমা দেশগুলোর প্রতি,
সমগ্র বিশ্ববাসীর সামনে আজ পশ্চিমা সভ্যতার বাস্তবরূপ উন্মোচিত হয়েছে। তাদের দ্বিচারিতা, দখলদারিত্ব ও স্বার্থোদ্ধারের স্বভাবগুলো আজ সবার নিকট পরিচিত। পাশ্চাত্যের দখলদারী মনোভাবের কারণে পৃথিবীবাসী আজ বাকরুদ্ধ। তারা লাঞ্ছিত, আল্লাহর কসম, তারা বিতাড়িত। তাদের বর্ণিত ইতিহাসেই তারা লাঞ্ছিত ও বিতাড়িত। গাজায় আজ যা হচ্ছে, তা মূলত তাদের ইতিহাসেরই পুনরাবৃত্তি করছে তারা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইহুদি ও পাশ্চাত্যের কৃত অন্যায়গুলো কারো অজানা নয়। এরপর তারা এই ভূমিকে ইহুদিদেরকে দান করে দিলো। এই ভূমির মালিক তারা নয়। এই ভূমি তাদেরকেই দেওয়া হয়েছে, যারা অত্যাচারী। পশ্চিমারাই ইহুদিদেরকে অত্যাচারী, নিষ্ঠুর এবং খুনী হতে সাহায্য করেছে। এভাবেই তারা সভ্যতার ধ্বজাধারীতে পরিণত হয়েছে।
এই সময়ে এটাও স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, পশ্চিমারা এখনও ক্ষমতাকে সর্বোচ্চ মূল্য হিসেবে দেখে। তারা তাদের আইডিওলজির মাধ্যমে অনেককিছুর সমাপ্তি টেনেছে, আইডিওলজিক্যাল সমাপ্তি, সভ্যতার সমাপ্তি, ইতিহাসের সমাপ্তি। আর আমি বলি, প্রতিটি শিশুর কান্না, প্রতিটি নারীর সম্মান এবং প্রতিটি পুরুষের জীবনের বিনিময়ে আজকের এই সভ্যতার পরিসমাপ্তি হবে গাজার প্রতিটি পাথরের নিচে। পাশ্চাত্যকে সহযোগিতা করা প্রত্যেকের কবর রচিত হবে গাজার এই প্রাঙ্গণ থেকেই।
পশ্চিমা নেতারা ইজরায়েল সফরে আসে। এরপর তারা কী বলে? তারা বলে, একজন জায়োনিস্ট হওয়ার জন্য ইহুদি হওয়া কখনও শর্ত নয়। আর আমি বলি, গাজার অধিবাসীর দুর্দশা বুঝার জন্য শুধু মানুষ হওয়াই যথেষ্ট, ফিলিস্তিন বা আরব অঞ্চলের মানুষ হওয়া শর্ত নয়।
দ্বিতীয় বার্তাটি আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা, বিশেষ করে ইসলামী প্রতিষ্ঠানসমূহের প্রতি,
জাতিসংঘের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর দায়িত্ব হচ্ছে, প্রতিটি দেশের অধিকার ও নিরাপত্তার নিশ্চয়তা প্রদান করা। কিন্তু বাস্তবে, তারা শুধুমাত্র শক্তিশালী রাষ্ট্রসমূহের স্বার্থোদ্ধারের হাতিয়ার মাত্র। কিন্তু বাস্তবে, তারা জনগণের বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে অত্যাচারীদের শক্তি বৃদ্ধিতে অবদান রাখে। তারা সুপরিকল্পিতভাবেই তাদের এই সংঘাত দীর্ঘায়িত করেছে। তাদের কার্যক্রম গাজার কোনো উপকারে আসেনি। কোনো শিশুর জীবন বাঁচাতেও অবদান রাখেনি। কোনো নারীর অধিকার নিয়েও তারা সচেতন হয়নি। গাজার কোনো মসজিদ এবং হাসপাতাল রক্ষার ক্ষেত্রেও তারা অবদান রাখেনি।
অন্যদিকে, আমাদের Organisation of Islamic Cooperation (OIC) এর মতো প্রতিষ্ঠানগুলো বায়তুল মাকদিস এবং ফিলিস্তিনকে যায়োনিজমের হাত থেকে রক্ষা করার জন্যই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো। কিন্তু বর্তমানে, এমন একটি প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম আজ জেদ্দার পথে-প্রান্তরেই সীমাবদ্ধ হয়ে রয়েছে। লোক-দেখানো প্রাতিষ্ঠানিক কিছু কার্যক্রম এবং সম্মেলনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। এই প্রতিষ্ঠানগুলোই এখন তাদের মৌলিক কার্যক্রম বাদ দিয়ে বৃহৎ মুসলিম দেশগুলোর সমিতিতে পরিণত হয়েছে। সকল নেতৃবৃন্দের প্রতি (তুরস্কের মন্ত্রীবর্গ-সহ) আমার বক্তব্য হলো, এ বিষয়ে সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিত থাকুন যে, আজকের পর থেকে গাজা শুধু তুরস্কের জন্যই নয়, বরং ফিলিস্তিন-সহ সমগ্র মুসলিম উম্মাহর স্ট্র্যাটেজিকে নিয়ন্ত্রণ করবে।
আমার তৃতীয় বার্তা হলো মুসলিম উম্মাহর আলেমগণের প্রতি,
বিজ্ঞ ওলামায়ে কেরাম,
উসমানীয় খেলাফত ছিলো মুসলিম উম্মাহর জ্ঞানের একটি কেন্দ্র, যা আজ হারিয়ে গিয়েছে। পরবর্তীতে আলেমগণ মাযহাব, রাজনৈতিক, আঞ্চলিক, ভৌগলিক-সহ বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন। এ যেনো, একটি আন্দোলন ছিন্নভিন্ন হওয়ার নামান্তর।
আলেমগণ এখন সাধারণ মুসলিমদের উপর প্রভাব বিস্তার করতে অক্ষম। মুসলিম যুবসমাজের মাঝে নিজেদের অবস্থান বজায় রাখতে অক্ষম। আবার, তাদের কেউ কেউ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিষয় নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ছেন। সর্বোপরি, আলেমগণ মুসলিম উম্মাহর প্রকৃত অবস্থাকে উপেক্ষা করে যাচ্ছে। তাহলে কীভাবে আমরা উম্মাহকে একতাবদ্ধ করবো, যেখানে আমরা নিজেরাই শতধা-বিভক্ত? তাহলে কীভাবে আমরা উম্মাহর নিকট থেকে নেতৃত্ব ও প্রতিহতের আশা করবো, যেখানে আমরা নিজেদের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে ব্যতিব্যস্ত? এমতাবস্থায়, মুসলিম উম্মাহর বিরাট এই সংকটকালে ফিলিস্তিনের জন্য সকল মতাদর্শের আলেমগণকে একত্রিত হবার বিনীত অনুরোধ করছি।
আমার চতুর্থ বার্তা উম্মাহর যুবসম্প্রদায়ের প্রতি,
হে মুসলিম যুবকেরা,
তোমরাই আগামীর কারিগর। ফিলিস্তিন সংকট এসময় তোমাদের সবচেয়ে বড় ভাবনার বিষয়। এরমাঝেই রয়েছে তোমাদের সম্মান ও মুক্তি। মৌলিক বিষয়াবলীকে পাশে রেখে বিভিন্ন দলে বিভক্ত হওয়ায় তোমাদের পূর্ববর্তী প্রজন্ম উম্মাহর মুক্তি আন্দোলন সফল হতে পারেনি। কিন্তু, আমি তোমাদের নিকট আশা করবো, তোমার তাদের মতো হয়ো না। তোমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্যকে সঠিকভাবে পালন করো।
পরিশেষে, স্মরণ করতে চাই গাজার সাহসী অধিবাসীদের।
আপনার ধৈর্য ধরুন, অবিচল থাকুন, একতাবদ্ধ হয়ে কাজ করুন। এটা ভুলবেন না, মহান রব সর্বদা আপনাদের সাথেই রয়েছে, তিনি কখনও আপনাদেরকে ছেড়ে যাবেন না। আপনারা এখন মর্যাদার আসনে সমাসীন। আপনারাই এখন পৃথিবীর সবচেয়ে সম্মানিত ব্যক্তি। আপনাদের ব্যাপারেই রাসূল (সা.) বলেছেন, আল্লাহর রাস্তায় একঘণ্টা অবস্থান করা লায়লাতুল কদরে হাজরে আসওয়াদে সালাত আদায়ের চেয়েও উত্তম।
আপনারাই অগ্রগামী, যারা আপনাদের বাধা প্রদান করে তারাই নিকৃষ্ট।
আপনারাই সম্মানিত, যারা আপনাদের নিয়ে কথা বলে তারাই লাঞ্ছিত।
আপনারাই সত্যবাদী, যারা আপনাদের ছেড়ে গিয়েছে তারাই মিথ্যাবাদী।
আপনারাই বরং প্রকৃত শক্তির অধিকারী এবং রুকু-সেজদা আদায়কারী।
কেউ আপনাদের পেছন থেকে ক্ষতিসাধন করতে পারবে না, লাঞ্ছিতও করতে পারবে না।
আপনারাই আল্লাহর প্রকৃত সৈনিক, যারাই আপনাদের পেছন থেকে ক্ষতি করার চেষ্টা করে, তারাই শয়তানের দোসর।
হে ইসলামের মাতৃকুল, হে গাজার নারী, হে বীরের জন্মদাত্রী, হে প্রজন্মের বয়োবৃদ্ধা!
তোমাদের বীরত্বের সামনে আমরা তুচ্ছ। তোমাদের প্রচেষ্টা এবং অবিচলতার সামনে আমরা পরাজিত। একজন মা সাধারণত একবার জান্নাত লাভ করে থাকেন। কিন্তু আপনারা তিনবার জান্নাত লাভ করে থাকেন। প্রথমবার সন্তান জন্মদান করে, দ্বিতীয়বার তাদেরকে লালনপালন করে, তৃতীয়বার দ্বিধাহীন চিত্তে তাদেরকে শাহাদাতের পথে উৎসর্গ করে।
হে গাজার দুঃসাহসী বালকেরা!
জন্মলগ্ন থেকেই তোমরা মহান, বন্দী থেকেও তোমরা স্বাধীন। নৃশংস শত্রুরা তোমাদের পেছনেই পড়ে রয়েছে। কারণ, মুসলিম উম্মাহর আগামীর কারিগর তোমরা বালকরাই।
হে মুসলিম উম্মাহ!
তোমাদের ভাইয়েরা তোমাদের দিকে তাকিয়ে আছে, তোমাদের আশায় বসে রয়েছে, তোমাদের সহযোগিতা কামনা করে।
আমাদের বক্তব্যগুলো কি গাজার শিশুদের খাদ্যের চাহিদা পূরণ করবে?
আমাদের নিরর্থক মন্তব্যগুলো কী গাজার নারীদের রক্ষা করবে?
আমাদের নির্লজ্জ বাণীগুলো কি আমাদের ব্যর্থতাকে আড়াল করবে?
অথবা, গাজার মুজাহিদদের কি সহযোগিতা করবে?
গাজার অধিবাসীরা তাদের শত্রুদের বিরুদ্ধে লড়াই করে যাচ্ছে। তারা শুধু আমাদের নিকট থেকে সহযোগিতাটাই কামনা করে। বাস্তবতা হলো, দুর্বিষহ এই সময়ে যদি আমরা এক হতে না পারি, তাহলে আর কখনও আমরা এক হতে পারবো না। ফিলিস্তিনিরা, বিশেষ করে গাজার অধিবাসীরা আজ কঠিন এক মুহূর্ত অতিক্রম করছে। এসময়েই হয় আমরা তাদের সহযোগী হবো নতুবা আমরা বিশ্বাসঘাতকে পরিণত হবো। এর বাইরে আর কোনো পথ উন্মুক্ত নেই।
মহান রবের নিকট কামনা করি,
একে অপরের মাধ্যমে তিনি যেন আমাদেরকে শক্তিশালী করে তোলেন। আমাদেরকে একে অপরের সহযোগী করে গড়ে তোলেন। আমাদেরকে একে অপরের নিরাপত্তার স্থল হওয়ার সুযোগ প্রদান করেন। গাজার মুজাহিদ এবং বীরসেনানীদের সাহায্য করার তৌফিক দান করেন। তিনি যেন গাজার শিশু, নারী, অধিবাসী এবং তাদের স্থাপনাগুলোকে রক্ষা করেন। সর্বোপরি, মাসজিদুল আকসার প্রাঙ্গণে বিজয়ের দুরাকাত সালাত আদায়কে তিনি যেন আমাদের জন্য আবশ্যক করে রাখেন।
দুরূদ ও সালাম প্রেরিত হোক রাসূল সা., তাঁর সাহাবী এবং তার পরিবারবর্গের উপর। আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়াবারাকাতুহ।
অনুবাদঃ মিফতাহুর রহমান।