।। বিসমিল্লাহির রহমানীর রাহীম ।।

 

জালিমের বিচারক এবং মজলুমের সহায়ক শক্তিশালী সেই মহান রবের নামে শুরু করছি। প্রশংসা তাঁর, যিনি সর্বদা নিত্য-নতুন কর্ম সম্পাদন করেন, যিনি মুমিনদের হৃদয়কে অবিচল রাখেন এবং অত্যাচারীদের হৃদয়ে ভীতি সঞ্চার করেন। দুরূদ ও সালাম প্রেরিত হোক মানবজাতির সর্দার মুহাম্মাদ (সা.) এর প্রতি।

সম্মানিত অতিথিবৃন্দ, বিশিষ্ট দায়ীগণ এবং বিজ্ঞ ওলামায়ে কেরাম!
আপনাদেরকে ইসলামের সম্ভাষণ জানাই, আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়াবারাকাতুহ।

আজ এখানে আমরা একত্রিত হয়েছি বর্ণনাতীত আমাদের এই দুঃখটাকে ভাগাভাগি করে নেওয়ার জন্য। গাজায় আমার ভাইয়েরা আজ অবরুদ্ধ ও কারাবন্দি, শিশুরা আজ ক্ষতবিক্ষত এবং বোনেরা আজ নিপীড়িত ও বিতাড়িত। আমাদের নিজেদের এখন প্রশ্ন করা উচিত, আজ এখানে আমরা কোন ভাষায় কথা বলবো! যদিও বা বলি, তাহলে কোন কথাগুলো বলবো! আমরা কি পশ্চিমা অত্যাচারী রাষ্ট্রের সমালোচনাতেই ক্ষান্ত থাকবো নাকি মুসলিম ঘুমন্ত রাষ্ট্রসমূহের প্রতি চেয়ে থাকবো? নাকি আমরা চুপচাপ বসে থেকে গাজার অধিবাসীদের এমন দুর্বিষহ জীবন প্রত্যক্ষ করে যাবো?

 

সম্মানিত ভাইয়েরা,
আজ আমি আমার অনুভূতি সুস্পষ্টরূপে তুলে ধরতে চাই। মহান রবের শপথ, দীর্ঘদিন যাবত আমি এসব ভেবে আসছি। আর এটা কোনো বিষয় না যে, একথাগুলো আমি ফিলিস্তিনের সেনাবাহিনীর সামনে বলবো নাকি গাজার অবরুদ্ধ অধিবাসীদের সামনে বলবো। এমনকি, কেয়ামতের দিনে আমার এসব কথার দায়ভার আমিই নেবো। এসব কথা যেন সেই সোনালী অতীতে ফিরে যাবার সোপান হয়।

আজ আমি শুধু গাজার অধিবাসীদের নিয়ে কথা বলবো না, অথবা, তাদেরকে সান্ত্বনা দেওয়া বা তাদের উদ্দেশ্যে কিছু বলবো না, বরং, আজ আমি সবার মাঝে একটি মেলবন্ধন তৈরি করার বিষয়টির প্রতি নজর দেবো।

গাজার অধিবাসীদের নিকট থেকে আমি ধৈর্য এবং ইস্তিকামাতের শিক্ষা গ্রহণ করি। গাজার নিষ্পাপ শিশুদের অশ্রুর মাঝে আমি ভবিষ্যৎ খুঁজতে থাকি। গাজার মুজাহিদদের সাহসিকতায় আমি বীরত্ব ও সাহসিকতার দর্শন পাই। গাজার অধিবাসীদের ঐক্যের মাধ্যমে আমি বিশ্বভ্রাতৃত্বের আশার সঞ্চার করে থাকি। তারা আমাদেরকে ঐক্য, ভ্রাতৃত্ব, সম্মান, মর্যাদা, সাহসিকতা ও বীরত্বের শিক্ষা দিয়ে যাচ্ছে। সর্বোপরি বলা যায়, আজকের গাজা আমাদেরকে এমন শিক্ষা দিয়ে যাচ্ছে, যা আমরা কোনো প্রতিষ্ঠানে পাই না।

 

সম্মানিত উপস্থিতি,
আজ আমি চারটি বার্তা প্রদান করতে চাই।

প্রথম বার্তাটি পশ্চিমা দেশগুলোর প্রতি,
সমগ্র বিশ্ববাসীর সামনে আজ পশ্চিমা সভ্যতার বাস্তবরূপ উন্মোচিত হয়েছে। তাদের দ্বিচারিতা, দখলদারিত্ব ও স্বার্থোদ্ধারের স্বভাবগুলো আজ সবার নিকট পরিচিত। পাশ্চাত্যের দখলদারী মনোভাবের কারণে পৃথিবীবাসী আজ বাকরুদ্ধ। তারা লাঞ্ছিত, আল্লাহর কসম, তারা বিতাড়িত। তাদের বর্ণিত ইতিহাসেই তারা লাঞ্ছিত ও বিতাড়িত। গাজায় আজ যা হচ্ছে, তা মূলত তাদের ইতিহাসেরই পুনরাবৃত্তি করছে তারা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইহুদি ও পাশ্চাত্যের কৃত অন্যায়গুলো কারো অজানা নয়। এরপর তারা এই ভূমিকে ইহুদিদেরকে দান করে দিলো। এই ভূমির মালিক তারা নয়। এই ভূমি তাদেরকেই দেওয়া হয়েছে, যারা অত্যাচারী। পশ্চিমারাই ইহুদিদেরকে অত্যাচারী, নিষ্ঠুর এবং খুনী হতে সাহায্য করেছে। এভাবেই তারা সভ্যতার ধ্বজাধারীতে পরিণত হয়েছে।

এই সময়ে এটাও স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, পশ্চিমারা এখনও ক্ষমতাকে সর্বোচ্চ মূল্য হিসেবে দেখে। তারা তাদের আইডিওলজির মাধ্যমে অনেককিছুর সমাপ্তি টেনেছে, আইডিওলজিক্যাল সমাপ্তি, সভ্যতার সমাপ্তি, ইতিহাসের সমাপ্তি। আর আমি বলি, প্রতিটি শিশুর কান্না, প্রতিটি নারীর সম্মান এবং প্রতিটি পুরুষের জীবনের বিনিময়ে আজকের এই সভ্যতার পরিসমাপ্তি হবে গাজার প্রতিটি পাথরের নিচে। পাশ্চাত্যকে সহযোগিতা করা প্রত্যেকের কবর রচিত হবে গাজার এই প্রাঙ্গণ থেকেই।

পশ্চিমা নেতারা ইজরায়েল সফরে আসে। এরপর তারা কী বলে? তারা বলে, একজন জায়োনিস্ট হওয়ার জন্য ইহুদি হওয়া কখনও শর্ত নয়। আর আমি বলি, গাজার অধিবাসীর দুর্দশা বুঝার জন্য শুধু মানুষ হওয়াই যথেষ্ট, ফিলিস্তিন বা আরব অঞ্চলের মানুষ হওয়া শর্ত নয়।

দ্বিতীয় বার্তাটি আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা, বিশেষ করে ইসলামী প্রতিষ্ঠানসমূহের প্রতি,
জাতিসংঘের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর দায়িত্ব হচ্ছে, প্রতিটি দেশের অধিকার ও নিরাপত্তার নিশ্চয়তা প্রদান করা। কিন্তু বাস্তবে, তারা শুধুমাত্র শক্তিশালী রাষ্ট্রসমূহের স্বার্থোদ্ধারের হাতিয়ার মাত্র। কিন্তু বাস্তবে, তারা জনগণের বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে অত্যাচারীদের শক্তি বৃদ্ধিতে অবদান রাখে। তারা সুপরিকল্পিতভাবেই তাদের এই সংঘাত দীর্ঘায়িত করেছে। তাদের কার্যক্রম গাজার কোনো উপকারে আসেনি। কোনো শিশুর জীবন বাঁচাতেও অবদান রাখেনি। কোনো নারীর অধিকার নিয়েও তারা সচেতন হয়নি। গাজার কোনো মসজিদ এবং হাসপাতাল রক্ষার ক্ষেত্রেও তারা অবদান রাখেনি।

অন্যদিকে, আমাদের Organisation of Islamic Cooperation (OIC) এর মতো প্রতিষ্ঠানগুলো বায়তুল মাকদিস এবং ফিলিস্তিনকে যায়োনিজমের হাত থেকে রক্ষা করার জন্যই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো। কিন্তু বর্তমানে, এমন একটি প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম আজ জেদ্দার পথে-প্রান্তরেই সীমাবদ্ধ হয়ে রয়েছে। লোক-দেখানো প্রাতিষ্ঠানিক কিছু কার্যক্রম এবং সম্মেলনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। এই প্রতিষ্ঠানগুলোই এখন তাদের মৌলিক কার্যক্রম বাদ দিয়ে বৃহৎ মুসলিম দেশগুলোর সমিতিতে পরিণত হয়েছে। সকল নেতৃবৃন্দের প্রতি (তুরস্কের মন্ত্রীবর্গ-সহ) আমার বক্তব্য হলো, এ বিষয়ে সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিত থাকুন যে, আজকের পর থেকে গাজা শুধু তুরস্কের জন্যই নয়, বরং ফিলিস্তিন-সহ সমগ্র মুসলিম উম্মাহর স্ট্র্যাটেজিকে নিয়ন্ত্রণ করবে।

আমার তৃতীয় বার্তা হলো মুসলিম উম্মাহর আলেমগণের প্রতি,
বিজ্ঞ ওলামায়ে কেরাম,
উসমানীয় খেলাফত ছিলো মুসলিম উম্মাহর জ্ঞানের একটি কেন্দ্র, যা আজ হারিয়ে গিয়েছে। পরবর্তীতে আলেমগণ মাযহাব, রাজনৈতিক, আঞ্চলিক, ভৌগলিক-সহ বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন। এ যেনো, একটি আন্দোলন ছিন্নভিন্ন হওয়ার নামান্তর।

আলেমগণ এখন সাধারণ মুসলিমদের উপর প্রভাব বিস্তার করতে অক্ষম। মুসলিম যুবসমাজের মাঝে নিজেদের অবস্থান বজায় রাখতে অক্ষম। আবার, তাদের কেউ কেউ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিষয় নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ছেন। সর্বোপরি, আলেমগণ মুসলিম উম্মাহর প্রকৃত অবস্থাকে উপেক্ষা করে যাচ্ছে। তাহলে কীভাবে আমরা উম্মাহকে একতাবদ্ধ করবো, যেখানে আমরা নিজেরাই শতধা-বিভক্ত? তাহলে কীভাবে আমরা উম্মাহর নিকট থেকে নেতৃত্ব ও প্রতিহতের আশা করবো, যেখানে আমরা নিজেদের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে ব্যতিব্যস্ত? এমতাবস্থায়, মুসলিম উম্মাহর বিরাট এই সংকটকালে ফিলিস্তিনের জন্য সকল মতাদর্শের আলেমগণকে একত্রিত হবার বিনীত অনুরোধ করছি।

আমার চতুর্থ বার্তা উম্মাহর যুবসম্প্রদায়ের প্রতি,
হে মুসলিম যুবকেরা,
তোমরাই আগামীর কারিগর। ফিলিস্তিন সংকট এসময় তোমাদের সবচেয়ে বড় ভাবনার বিষয়। এরমাঝেই রয়েছে তোমাদের সম্মান ও মুক্তি। মৌলিক বিষয়াবলীকে পাশে রেখে বিভিন্ন দলে বিভক্ত হওয়ায় তোমাদের পূর্ববর্তী প্রজন্ম উম্মাহর মুক্তি আন্দোলন সফল হতে পারেনি। কিন্তু, আমি তোমাদের নিকট আশা করবো, তোমার তাদের মতো হয়ো না। তোমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্যকে সঠিকভাবে পালন করো।

পরিশেষে, স্মরণ করতে চাই গাজার সাহসী অধিবাসীদের।
আপনার ধৈর্য ধরুন, অবিচল থাকুন, একতাবদ্ধ হয়ে কাজ করুন। এটা ভুলবেন না, মহান রব সর্বদা আপনাদের সাথেই রয়েছে, তিনি কখনও আপনাদেরকে ছেড়ে যাবেন না। আপনারা এখন মর্যাদার আসনে সমাসীন। আপনারাই এখন পৃথিবীর সবচেয়ে সম্মানিত ব্যক্তি। আপনাদের ব্যাপারেই রাসূল (সা.) বলেছেন, আল্লাহর রাস্তায় একঘণ্টা অবস্থান করা লায়লাতুল কদরে হাজরে আসওয়াদে সালাত আদায়ের চেয়েও উত্তম।

আপনারাই অগ্রগামী, যারা আপনাদের বাধা প্রদান করে তারাই নিকৃষ্ট।
আপনারাই সম্মানিত, যারা আপনাদের নিয়ে কথা বলে তারাই লাঞ্ছিত।
আপনারাই সত্যবাদী, যারা আপনাদের ছেড়ে গিয়েছে তারাই মিথ্যাবাদী।
আপনারাই বরং প্রকৃত শক্তির অধিকারী এবং রুকু-সেজদা আদায়কারী।
কেউ আপনাদের পেছন থেকে ক্ষতিসাধন করতে পারবে না, লাঞ্ছিতও করতে পারবে না।
আপনারাই আল্লাহর প্রকৃত সৈনিক, যারাই আপনাদের পেছন থেকে ক্ষতি করার চেষ্টা করে, তারাই শয়তানের দোসর।

হে ইসলামের মাতৃকুল, হে গাজার নারী, হে বীরের জন্মদাত্রী, হে প্রজন্মের বয়োবৃদ্ধা!
তোমাদের বীরত্বের সামনে আমরা তুচ্ছ। তোমাদের প্রচেষ্টা এবং অবিচলতার সামনে আমরা পরাজিত। একজন মা সাধারণত একবার জান্নাত লাভ করে থাকেন। কিন্তু আপনারা তিনবার জান্নাত লাভ করে থাকেন। প্রথমবার সন্তান জন্মদান করে, দ্বিতীয়বার তাদেরকে লালনপালন করে, তৃতীয়বার দ্বিধাহীন চিত্তে তাদেরকে শাহাদাতের পথে উৎসর্গ করে।

হে গাজার দুঃসাহসী বালকেরা!
জন্মলগ্ন থেকেই তোমরা মহান, বন্দী থেকেও তোমরা স্বাধীন। নৃশংস শত্রুরা তোমাদের পেছনেই পড়ে রয়েছে। কারণ, মুসলিম উম্মাহর আগামীর কারিগর তোমরা বালকরাই।

হে মুসলিম উম্মাহ!
তোমাদের ভাইয়েরা তোমাদের দিকে তাকিয়ে আছে, তোমাদের আশায় বসে রয়েছে, তোমাদের সহযোগিতা কামনা করে।
আমাদের বক্তব্যগুলো কি গাজার শিশুদের খাদ্যের চাহিদা পূরণ করবে?
আমাদের নিরর্থক মন্তব্যগুলো কী গাজার নারীদের রক্ষা করবে?
আমাদের নির্লজ্জ বাণীগুলো কি আমাদের ব্যর্থতাকে আড়াল করবে?
অথবা, গাজার মুজাহিদদের কি সহযোগিতা করবে?

গাজার অধিবাসীরা তাদের শত্রুদের বিরুদ্ধে লড়াই করে যাচ্ছে। তারা শুধু আমাদের নিকট থেকে সহযোগিতাটাই কামনা করে। বাস্তবতা হলো, দুর্বিষহ এই সময়ে যদি আমরা এক হতে না পারি, তাহলে আর কখনও আমরা এক হতে পারবো না। ফিলিস্তিনিরা, বিশেষ করে গাজার অধিবাসীরা আজ কঠিন এক মুহূর্ত অতিক্রম করছে। এসময়েই হয় আমরা তাদের সহযোগী হবো নতুবা আমরা বিশ্বাসঘাতকে পরিণত হবো। এর বাইরে আর কোনো পথ উন্মুক্ত নেই।

মহান রবের নিকট কামনা করি,
একে অপরের মাধ্যমে তিনি যেন আমাদেরকে শক্তিশালী করে তোলেন। আমাদেরকে একে অপরের সহযোগী করে গড়ে তোলেন। আমাদেরকে একে অপরের নিরাপত্তার স্থল হওয়ার সুযোগ প্রদান করেন। গাজার মুজাহিদ এবং বীরসেনানীদের সাহায্য করার তৌফিক দান করেন। তিনি যেন গাজার শিশু, নারী, অধিবাসী এবং তাদের স্থাপনাগুলোকে রক্ষা করেন। সর্বোপরি, মাসজিদুল আকসার প্রাঙ্গণে বিজয়ের দুরাকাত সালাত আদায়কে তিনি যেন আমাদের জন্য আবশ্যক করে রাখেন।

দুরূদ ও সালাম প্রেরিত হোক রাসূল সা., তাঁর সাহাবী এবং তার পরিবারবর্গের উপর। আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়াবারাকাতুহ।

 

অনুবাদঃ মিফতাহুর রহমান

৪৫০ বার পঠিত

শেয়ার করুন

Picture of প্রফেসর ড. মেহমেদ গরমেজ

প্রফেসর ড. মেহমেদ গরমেজ

প্রফেসর ড. মেহমেদ গরমেজ তুরস্কের একজন প্রথিতযশা আলেম। জীবন্ত কিংবদন্তি এ আলেমে দ্বীন ইসলামের মৌলিক বিষয়সমূহকে মানুষের সামনে তুলে ধরার ক্ষেত্রে নিরলসভাবে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
১৯৬২ সালে তুরস্কের গাজিআনতেপ শহরের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ছিলেন একজন প্রখ্যাত আলেম। তিনি তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা পিতার কাছেই সম্পন্ন করেন। প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করার পর উসমানী ধারার প্রখ্যাত আলেম, 'মেহমেদ আমীন আর' এর নিকট শিক্ষা লাভ করেন। ড. গরমেজ পূর্ব আনাতোলিয়ান অঞ্চলে অবস্থিত উসমানী খিলাফতের সময়কালে প্রতিষ্ঠিত মাদরাসা থেকে শিক্ষা লাভের সময় প্রখ্যাত আলেমে দ্বীন উস্তাদ 'মেহমেদ আমীন আর' এর তত্ত্বাবধানে ছিলেন। সেসময় তিনি একইসাথে গাজিআনতেপ মাদরাসায়ও পড়াশোনা করেন এবং সেখান থেকে কৃতিত্বের সাথে উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা শেষে আঙ্কারা বিশ্ববিদ্যালয়ে থিওলজি বিভাগে ভর্তি হন। আঙ্কারা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত অবস্থায় তিনি মসজিদে ইমামতি ও মাদরাসায় শিক্ষকতা করতেন। আঙ্কারা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স ডিগ্রী লাভ করার পর হাদীস বিভাগে মাস্টার্সে ভর্তি হন এবং খাতীব আল বাগদাদীর বিখ্যাত গ্রন্থ شرف أصحاب الحديث-এর মুহাক্কিক প্রখ্যাত হাদীস শাস্ত্রবিদ প্রফেসর ড. সাঈদ হাতীবওলুর অধীনে মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। তাঁর মাস্টার্সের থিসিস ছিল, 'মুসা জারুল্লাহ বিগিয়েফের চিন্তা ও দর্শন'।
মাস্টার্স করার সময়ে তিনি মিশরে গমন করেন এবং কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণা করেন। কায়রোতে অবস্থান কালে মিশরের স্বনামধন্য ফকীহ মুহাম্মদ সেলিম আল-আরওয়াহ এবং প্রখ্যাত মুহাদ্দিস রিফাত ফাওজীর কাছ থেকে শিক্ষা লাভ করেন। এক বছর কায়রোতে অবস্থান করার পর পুনরায় তুরস্কে ফিরে আসেন এবং পুনরায় আঙ্কারা বিশ্ববিদ্যালয়ে ডক্টরেট (PhD) শুরু করেন। ১৯৯৪ সালে কৃতিত্বের সাথে তিনি তাঁর PhD শেষ করেন। তার PhD-এর থিসিস ছিলো "সুন্নত ও হাদীস বুঝা এবং ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে পদ্ধতিগত সমস্যা।" PhD চলাকালীন সময়ে তিনি এক বছর লন্ডনে অবস্থান করেন এবং সেখানে 'স্কুল অফ অরিয়েন্টাল এন্ড আফ্রিকান স্টাডিজ' এ গবেষক হিসেবে কাজ করেন। তাঁর এ থিসিস ১৯৯৬ সালে তুরস্কের ইসলামিক ফাউন্ডেশন এর গবেষণা বিভাগে প্রথম স্থান অর্জন করে এবং সে বছর এ গবেষণার জন্য তুর্কী সরকার তাকে গবেষণা পুরস্কার প্রদান করে। তার এ থিসিসটি আরবী ও ইংরেজি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। এ থিসিসের কারণে তিনি তাঁর একাডেমিক জীবনের অধিকাংশ সময় 'উসূলে ফিকহ' অধ্যয়নে ব্যয় করেন এবং এ সময়ে তিনি একজন উসূলবিদ হয়ে উঠেন।
এযাবৎকাল পর্যন্ত তিনি পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের বড় বড় মুহাদ্দিস, উসূলবিদ, আলেমগণের সান্নিধ্য লাভ করেছেন ও বিভিন্ন গবেষণায় তাদের থেকে বহু জ্ঞান অর্জন করেন। এছাড়াও উসমানী ধারার বড় বড় দার্শনিকদের সান্নিধ্যে দীর্ঘসময় পড়াশোনা করেন।তিনি আহমেদ ইয়েসেভি বিশ্ববিদ্যালয়, হাজেত্তেপে বিশ্ববিদ্যালয় এবং আঙ্কারা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অনেক বিশ্ববিদ্যালয়, ইন্সটিটিউট ও গবেষণা কেন্দ্রে শিক্ষকতা করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করার পাশাপাশি তিনি অন্যান্য ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। যেমন-ইসলাম শিক্ষা গবেষণা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন এবং তুরস্কের ইসলামী আন্দোলনের মহান নেতা প্রফেসর ড. নাজমুদ্দিন এরবাকান-এর সাথে দীর্ঘদিন কাজ করেন।
২০০৩ সালে তিনি Presidency of the Republic of Turkey Presidency of Religious Affairs এর ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে যোগদান করেন। এ দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি শিক্ষকতাও জারি রাখেন এবং ২০০৬ সালে প্রফেসর হন। দীর্ঘ ৭ বছর এ Religious Affairs এর ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন কালে সমগ্র মুসলিম উম্মাহর সাথে যোগাযোগ স্থাপন করেন এবং মুসলিম উম্মাহকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ২০১০ সালে তিনি Religious Affairs- এর প্রেসিডেন্ট মনোনীত হন এবং ২০১৭ সাল পর্যন্ত এ দায়িত্ব পালন করেন। এ গুরু দায়িত্ব পালন কালেও তিনি তাঁর গবেষণা চালিয়ে যান এবং এক মুহূর্তের জন্যও জ্ঞান গবেষণায় বিরতি দেননি। এ সময়ে তিনি মুসলিম উম্মাহর গুরুত্বপূর্ণ আলেমদের সাথে সু-সম্পর্ক গড়ে তোলেন এবং তাদেরকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য কার্যকরী ভূমিকা পালন করেন। গাজা, আরাকান, সোমালিয়া, সুদান, মধ্য এশিয়া এবং বলকান অঞ্চলের মুসলমানদের সমস্যা সমাধান করার জন্য অনেক পরিকল্পনা গ্রহণ করেন এবং তা বাস্তবায়নের জন্য প্রচেষ্টা চালান। Religious Affairs-এর প্রেসিডেন্ট থাকা অবস্থায় অবরুদ্ধ গাজা সফর করেন এবং হামাস নেতা ইসমাইল হানিয়ার সাথে সাক্ষাৎ করে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষে সংহতি ঘোষণা করেন। গাজাতে অবস্থানকালে তিনি অবরুদ্ধ গাজাবাসীর খোঁজ-খবর নেন। এরপর তিনি বাইতুল মুকাদ্দাসে যান এবং ঐতিহাসিক এক খুতবা প্রদান করেন।
২০১৭ সালে Religious Affairs-এর দায়িত্ব থেকে অবসর গ্রহণ করেন এবং দুটি প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন। একটি হলো International Islamic Though: Foundation অপরটি হলো Institute of Islamic Thought. বর্তমানে তিনি এ প্রতিষ্ঠান দুটির প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
Picture of প্রফেসর ড. মেহমেদ গরমেজ

প্রফেসর ড. মেহমেদ গরমেজ

প্রফেসর ড. মেহমেদ গরমেজ তুরস্কের একজন প্রথিতযশা আলেম। জীবন্ত কিংবদন্তি এ আলেমে দ্বীন ইসলামের মৌলিক বিষয়সমূহকে মানুষের সামনে তুলে ধরার ক্ষেত্রে নিরলসভাবে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
১৯৬২ সালে তুরস্কের গাজিআনতেপ শহরের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ছিলেন একজন প্রখ্যাত আলেম। তিনি তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা পিতার কাছেই সম্পন্ন করেন। প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করার পর উসমানী ধারার প্রখ্যাত আলেম, 'মেহমেদ আমীন আর' এর নিকট শিক্ষা লাভ করেন। ড. গরমেজ পূর্ব আনাতোলিয়ান অঞ্চলে অবস্থিত উসমানী খিলাফতের সময়কালে প্রতিষ্ঠিত মাদরাসা থেকে শিক্ষা লাভের সময় প্রখ্যাত আলেমে দ্বীন উস্তাদ 'মেহমেদ আমীন আর' এর তত্ত্বাবধানে ছিলেন। সেসময় তিনি একইসাথে গাজিআনতেপ মাদরাসায়ও পড়াশোনা করেন এবং সেখান থেকে কৃতিত্বের সাথে উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা শেষে আঙ্কারা বিশ্ববিদ্যালয়ে থিওলজি বিভাগে ভর্তি হন। আঙ্কারা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত অবস্থায় তিনি মসজিদে ইমামতি ও মাদরাসায় শিক্ষকতা করতেন। আঙ্কারা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স ডিগ্রী লাভ করার পর হাদীস বিভাগে মাস্টার্সে ভর্তি হন এবং খাতীব আল বাগদাদীর বিখ্যাত গ্রন্থ شرف أصحاب الحديث-এর মুহাক্কিক প্রখ্যাত হাদীস শাস্ত্রবিদ প্রফেসর ড. সাঈদ হাতীবওলুর অধীনে মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। তাঁর মাস্টার্সের থিসিস ছিল, 'মুসা জারুল্লাহ বিগিয়েফের চিন্তা ও দর্শন'।
মাস্টার্স করার সময়ে তিনি মিশরে গমন করেন এবং কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণা করেন। কায়রোতে অবস্থান কালে মিশরের স্বনামধন্য ফকীহ মুহাম্মদ সেলিম আল-আরওয়াহ এবং প্রখ্যাত মুহাদ্দিস রিফাত ফাওজীর কাছ থেকে শিক্ষা লাভ করেন। এক বছর কায়রোতে অবস্থান করার পর পুনরায় তুরস্কে ফিরে আসেন এবং পুনরায় আঙ্কারা বিশ্ববিদ্যালয়ে ডক্টরেট (PhD) শুরু করেন। ১৯৯৪ সালে কৃতিত্বের সাথে তিনি তাঁর PhD শেষ করেন। তার PhD-এর থিসিস ছিলো "সুন্নত ও হাদীস বুঝা এবং ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে পদ্ধতিগত সমস্যা।" PhD চলাকালীন সময়ে তিনি এক বছর লন্ডনে অবস্থান করেন এবং সেখানে 'স্কুল অফ অরিয়েন্টাল এন্ড আফ্রিকান স্টাডিজ' এ গবেষক হিসেবে কাজ করেন। তাঁর এ থিসিস ১৯৯৬ সালে তুরস্কের ইসলামিক ফাউন্ডেশন এর গবেষণা বিভাগে প্রথম স্থান অর্জন করে এবং সে বছর এ গবেষণার জন্য তুর্কী সরকার তাকে গবেষণা পুরস্কার প্রদান করে। তার এ থিসিসটি আরবী ও ইংরেজি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। এ থিসিসের কারণে তিনি তাঁর একাডেমিক জীবনের অধিকাংশ সময় 'উসূলে ফিকহ' অধ্যয়নে ব্যয় করেন এবং এ সময়ে তিনি একজন উসূলবিদ হয়ে উঠেন।
এযাবৎকাল পর্যন্ত তিনি পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের বড় বড় মুহাদ্দিস, উসূলবিদ, আলেমগণের সান্নিধ্য লাভ করেছেন ও বিভিন্ন গবেষণায় তাদের থেকে বহু জ্ঞান অর্জন করেন। এছাড়াও উসমানী ধারার বড় বড় দার্শনিকদের সান্নিধ্যে দীর্ঘসময় পড়াশোনা করেন।তিনি আহমেদ ইয়েসেভি বিশ্ববিদ্যালয়, হাজেত্তেপে বিশ্ববিদ্যালয় এবং আঙ্কারা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অনেক বিশ্ববিদ্যালয়, ইন্সটিটিউট ও গবেষণা কেন্দ্রে শিক্ষকতা করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করার পাশাপাশি তিনি অন্যান্য ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। যেমন-ইসলাম শিক্ষা গবেষণা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন এবং তুরস্কের ইসলামী আন্দোলনের মহান নেতা প্রফেসর ড. নাজমুদ্দিন এরবাকান-এর সাথে দীর্ঘদিন কাজ করেন।
২০০৩ সালে তিনি Presidency of the Republic of Turkey Presidency of Religious Affairs এর ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে যোগদান করেন। এ দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি শিক্ষকতাও জারি রাখেন এবং ২০০৬ সালে প্রফেসর হন। দীর্ঘ ৭ বছর এ Religious Affairs এর ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন কালে সমগ্র মুসলিম উম্মাহর সাথে যোগাযোগ স্থাপন করেন এবং মুসলিম উম্মাহকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ২০১০ সালে তিনি Religious Affairs- এর প্রেসিডেন্ট মনোনীত হন এবং ২০১৭ সাল পর্যন্ত এ দায়িত্ব পালন করেন। এ গুরু দায়িত্ব পালন কালেও তিনি তাঁর গবেষণা চালিয়ে যান এবং এক মুহূর্তের জন্যও জ্ঞান গবেষণায় বিরতি দেননি। এ সময়ে তিনি মুসলিম উম্মাহর গুরুত্বপূর্ণ আলেমদের সাথে সু-সম্পর্ক গড়ে তোলেন এবং তাদেরকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য কার্যকরী ভূমিকা পালন করেন। গাজা, আরাকান, সোমালিয়া, সুদান, মধ্য এশিয়া এবং বলকান অঞ্চলের মুসলমানদের সমস্যা সমাধান করার জন্য অনেক পরিকল্পনা গ্রহণ করেন এবং তা বাস্তবায়নের জন্য প্রচেষ্টা চালান। Religious Affairs-এর প্রেসিডেন্ট থাকা অবস্থায় অবরুদ্ধ গাজা সফর করেন এবং হামাস নেতা ইসমাইল হানিয়ার সাথে সাক্ষাৎ করে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষে সংহতি ঘোষণা করেন। গাজাতে অবস্থানকালে তিনি অবরুদ্ধ গাজাবাসীর খোঁজ-খবর নেন। এরপর তিনি বাইতুল মুকাদ্দাসে যান এবং ঐতিহাসিক এক খুতবা প্রদান করেন।
২০১৭ সালে Religious Affairs-এর দায়িত্ব থেকে অবসর গ্রহণ করেন এবং দুটি প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন। একটি হলো International Islamic Though: Foundation অপরটি হলো Institute of Islamic Thought. বর্তমানে তিনি এ প্রতিষ্ঠান দুটির প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

মতামত প্রকাশ করুন

Scroll to Top