ফররুখ আহমদের কাব্যে মুসলিম ঐতিহ্য

কবি ফররুখ আহমদের কাব্যে মুসলিম ঐতিহ্যের বিস্তারিত অনুসন্ধান, বিবরণ ও মূল্য বিচার আমাদের এ প্রবন্ধের উদ্দেশ্য নয়। এ প্রবন্ধে কবি ফররুখ আহমদের কবি-মানসের প্রকৃতি বিশ্লেষণে তাঁর সামগ্রিক কাব্য সাধনায় নয়, বরং সামান্য কয়েকটি উদ্ধৃতির মাধ্যমে তাঁর ঐতিহ্য-প্রীতি, ইতিহাস লালন এবং তামাদ্দুনিক ও তাহযীবী বিকাশ প্রয়াসের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশের চেষ্টা করব। এখানে একটি কথা মনে রাখতে হবে যে, কোন কবির শিল্পী সত্তা বিশেষ করে ভাগ করা যায় না। কবি-সত্তা স্বয়ংসম্পূর্ণ, একক, নিরবচ্ছিন্ন ও অবিভাজ্য। আমরা আলোচনার সুবিধার্থে শিল্পীর সমগ্র প্রকাশকে নানা ভাগে বিভক্ত করে একেক দিকের আলোচনা করি। এভাবে নানা বিষয় সূক্ষ্ম ধারায় বিভাজিত হয়ে আমরা একটি মৌলসত্তা ও অভিন্ন শিল্প মূল্যায়নে পৌঁছতে পারি। ফররুখ আহমদ কবি, তাঁর কবিসত্তা অক্ষত এককে অবিভাজ্য। তাই সামগ্রিকতার আংশিক মূল্যায়ন একদেশদর্শিতার পরিচায়ক ও বিশ্লেষণ সীমিত হতে বাধা।

ভাব ও বিষয়ভিত্তিক বিভাজনে ফররুখ কাব্যকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। তার মধ্যে সর্বপ্রথম যা চোখে পড়ে সেটি হল তাঁর ঐকান্তিক চিন্তা ও সহানুভূতি বিভিন্নভাবে তাঁর কাব্যে রূপায়িত হয়েছে। বিভিন্ন বিষয়কে অবলম্বন করে তা উজ্জীবিত হয়েছে। ঐতিহ্য একটি জাতির সংস্কৃতি বিকাশে সহায়ক হয়। আর সে সামগ্রিক বৈশিষ্ট্যের প্রতিফলিত রূপই তার সংস্কৃতিতে বিধৃত। এদেশে এ ভৌগোলিক পরিমণ্ডলে মুসলিম সংস্কৃতির বিকাশ ঘটেছে ইসলামের শিক্ষা, আদর্শ, ঈমান, আকিদাহ ও উত্তরাধিকারের সমন্বিত; সংস্কার ও অনুশীলনে। ঈসায়ী উনিশ শতকের গোড়ার দিকে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে যে বাংলা ভাষা তার প্রাথমিক গতিবেগ হারিয়ে নির্জীব সংস্কৃত বহুল কঠিন বন্ধনে আবদ্ধ হন; বিশ শতকের গোড়া থেকেই এর প্রতিক্রিয়া শুরু হয়। মুসলিম বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় আবার সেই আরবি ফারসি মিশ্রিত প্রাণের ভাষা প্রতিষ্ঠার চেষ্টায় নিয়োজিত হয়। এ চেষ্টা ফলবর্তী হয় কাজী নজরুল ইসলামের আবির্ভাবের মধ্য দিয়ে। কবি ফররুখ আহমদ এ ধারারই অন্যতম বাহক ও ধারক। বস্তুত বলা যায়, কাজী নজরুল ইসলামের যেখানে সমাপ্তি ফররুখ আহমদের সেখানে শুরু।

বাংলা কাব্যে মুসলিম রেনেসাঁর কবি ফররুখ আহমদের আবির্ভাব ঘটে কাজী নজরুল ইসলামের কাব্য সাধনার যৌবনে। ১৯১৮ সালে প্রথম মহাযুদ্ধের অবসান, নজরুলের কাব্য জগতে প্রবেশ এবং বাংলায় মুসলিম রেঁনেসার উজ্জীবন। আর এ সালেই ফররুখ আহমদের জন্ম। শৈশব পেরিয়ে নবীন আলোকে বিশ্বকে দেখার এবং আত্মজিজ্ঞাসা ও আত্মসচেতনতার বয়সে আসতে তাঁকে বহু চড়াই উৎরাই পার হয়ে আসতে হয়েছে। মুসলিম সমাজের চরম দুর্দশা তাঁকে পীড়িত করে। নবীন জীবনের আশা নিয়ে, নবযৌবনের প্রচণ্ডতা নিয়ে তিনি বাংলার মানুষকে দেখেন, দেখেন সমাজ ও সংস্কৃতিকে। ইংরেজ কবি শেলি যে দুঃখে বলেছেন, swear, I bleed, সে দুঃখই ফররুখ আহমদকে পীড়িত করে, ক্লিষ্ট করে। তিনি আমাদের সমাজের স্বকীয় সভাকে সুদৃঢ় করার দৃঢ় প্রত্যয়ে বাংলা কাব্যাকাশে উদিত হন। তাঁর উচ্চারণে আমাদের সংস্কৃতি, আমাদের তাহযীব তামাদ্দুন, আমাদের জীবনের সমুজ্জ্বল অধ্যায় অংকুরিত হয়। তিনি নজরুল ইসলামের ধারায় এক নব বিপ্লবের চেতনায় সমৃদ্ধ জীবন সৃষ্টির স্বপ্ন দেখেন। নজরুল ইসলামের ধারায় এক নব বিপ্লবের চেতনায় সমৃদ্ধ জীবন সৃষ্টির স্বপ্ন দেখেন। নজরুল ইসলাম যেমন তীব্র তীক্ষ্ণ কষাঘাতে নিদ্রিত সিংহকে জাগ্রত করে তোলেন তেমনি ফররুখ তাঁর নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে সে সুপ্ত ক্ষমতাধর জাতিকে প্রাণের স্পন্দনে জাগিয়ে তোলেন। তিনি বাংলা কাব্যে মুসলিম জাতিকে এক বিপ্লবী চেতনায় উদ্বুদ্ধ করেন। অলস জড়তার বিরুদ্ধে তাঁর লেখনী জিহাদী ভূমিকা পালনে অবতীর্ণ হয়। তিনি অন্যায়, শোষণ, লাঞ্ছনা ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উদাত্ত কণ্ঠে আহ্বান জানান হাজার দ্বীপের বদ কসমের উপরে লানত হানি কিশতির মুখ ফিরায়েছি মোরা টানি।

নিজেকে আজ

জয় করে নিতে চালাও সাহসী কুচকাওয়াজ।

মনের সকল দিগন্তে করো সমর সাজ

মাটির আকাশে মনের আকাশে গর্জে বাজ।

নজরুল ইসলাম প্রথম আবির্ভাবেই যে কাজটি করেছিলেন, তাঁর সার্থক অনুসারী ফররুখ আহমদও সে ধারাকে সাফল্যের সাথে এগিয়ে নিয়ে যেতে সমর্থ হন। কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর সারা জীবনের সাধনার পূর্ণ পরিপক্ব ফলটি নিয়েই আমাদের সাহিত্যের আসরে অবতীর্ণ হন। এ দিক থেকে অন্যদের মত তাঁর কাব্য সাধনার শৈশব, কৈশোর, যৌবন ও প্রৌঢ়ত্বের ক্রম বিবর্তন নেই। একেবারেই পূর্ণাঙ্গ সার্থক সৃষ্টি নিয়ে ঘটে তাঁর আবির্ভাব। আর ফররুখ আহমদ প্রায় তেমনি, মনে হয় যেন পূর্বসূরি নজরুলের পদাঙ্ক অনুসরণ করেই সাফল্যের ফলটি ভাবের অনুগামী ভাষা প্রয়োগের মাধ্যমে নিজস্ব বৈশিষ্ট্যের সার্থক সৃষ্টি নিয়েই এ আসরে অবতীর্ণ হন। সকল হীনমন্যতা, নীচতা, কৃপনতা, কুসংস্কার ঝেড়ে ফেলে দিয়ে জাতিকে সত্য-সুন্দরের পথে আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। আত্মপ্রত্যয়ে দৃঢ়চিত্ত হয়ে এগিয়ে যাওয়ার উৎসাহ দিয়েছেন। তিনি চলার পথের নির্দেশ দিয়ে বলেছেন:

এবার তোমার যাত্রা সে পথে

যেথা উমরের পায়ের দাগ

জং ধরে যেথা পড়ে আছে হায় আলীর হাতের জুলফিকার।

ফররুখ আহমদ তাঁর কাব্যে সাগরের উদাত্ত হিন্দোল, লোনা দরিয়ার ডাক, সিন্দবাদের নির্ভয় প্রত্যয়ের আহ্বান জানিয়েছেন। তাঁর আহ্বানে রয়েছে সকল সংশয় অতিক্রম করে দুর্বার গতিতে চলার উদ্দীপনা।

সে কথা জানি না, মানি না সে কথা, দরিয়া ডেকেছে নীল হুলি জাহাজের হালে উদ্দাম দিগন্ত ঝিলমিল,

জংগী জোয়ান দাঁড় ফেলে করি পরিয়ার পানি চা

আফতাব ঘোরে মাথার উপরে মাহতার ফেলে দাগ

তুফান ঝড়িতে তোলপাড় করে কিশতির পাটাতন

মোরা নির্ভীক সমুদ্র স্রোতে দাঁড় ফেলি বার মাস।

কবি ফররুখ আহমদ বিদ্রোহী কবির ভাবশিষ্য বিপ্লবী কবি। আমাদের ঘরের ভাষায়, মুসলিমের নিজের ভাষায়, ইসলামের পরিভাষায় ফররুখের আত্মস্ফূর্তি ঘটেছে দুঃসাহসী প্রেরণায়। তাই দেখি সাত সাগরের মাঝি কবিতায়

তিনি বাছাই করে শব্দ চয়ন করেছেন এবং শব্দ পানি তরঙ্গের মহিমায় অন্বর বিদ্ধ হয়েছে সতর্ক ও নিপুণ শিকারীর তীরের মতোই, তিনি বলেনঃ

“কাঁকনা বিছান পদ্ম

কত ৰাধা কত সমুদ্র পর্বত

মধ্য দিনের পিশাচের হামাগুড়ি

শকুনি ফেলিছে ছায়া আমাদের মাথার উপরে উড়ি,

ফেলেছি হারায়ে তৃণঘন বন, যত পুষ্পিত বন

তবু দেখা যায় দূরে বহু দূরে হেরার রাজ তোরণ।”

এ হেরার রাজ তোরণ মুসলিমের পথের দিশারী ধ্রুব নক্ষত্রসম। একথা কেউ কোন দিন শুনিয়েছে আমাদের? ভাবে ভাষায় ছন্দে ফররুখ তাঁর পূর্বসূরি মধুসূদন, রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল ইসলামকে আত্মসাৎ করেছেন; আত্মস্থ করেছেন কীট্স, শেলি, বায়রন, মিল্টনকে। রবীন্দ্রনাথ যখন বলেন,

ওরে বিহঙ্গ, তবু বিহঙ্গ মোর

এখনি অন্ধ বন্ধ করো না পাখা।

তখন স্বভাবতই মনে পড়ে মহাকবি ইকবালের শাহীনের কথা, শেলির স্কাইলার্কের কথা। ফররুখের কল্পনায় সে বিহঙ্গ বা স্বর্ণ ঈগল রূপ পরিগ্রহ করেছে এভাবে।

“হে বিহঙ্গ এই জিঞ্জিরে প্রবল আঘাত হানো, সাত আকাশের বিয়াবানে ফের উদার মুক্তি আনো,

এখানে থেকে না পড়ে।

হে বিহঙ্গ। এ শুধু শান্তি বুঝতে পার না তুমি, ক্ষণ বিস্মৃতি জাগায় সামনে বালিয়াড়ি মরুভূমি।

দেখেছো কেবল তৃষ্ণায় ভরা কালো রাত্রির বিষ

সূর্যোদয়ের পথে দেখো নাই মিঠে পানি। ওয়েসিস ।

এ দুঃখ রজনীর কি অবসান নেই? নেই কি প্রভাত সূর্যোদয়, প্রভাত পাখির গান?

কবি বলেন:

“রাত পোহাবার কত দেরী পাঞ্জেরী?

শুধু গাফলতে, শুধু খেয়ালের ভুলে

দরিয়া অথৈ ভ্রান্তি নিয়াছি তুলে,

আমাদেরি ভুলে পালির কিনারে মুসাফির দল বসি দেখেছে সভায় অন্ত গিয়াছে তাদের সেতারা, শশীঃ

মোনের খেলায় ধূলায় লুটায়ে পড়ি

কেঁদেছে তাদের দুর্ভাগ্যের বিস্বাদ শর্বরী।”

ফররুখ আহমদ তাঁর পূর্বসূরি, বিশেষ করে মধুসূদন, রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল ইসলামকে এবং ত্রিশের কবিদের অস্বীকার করেননি। বরং তাঁর কাব্য সাধনার বিভিন্ন পর্যায়ে তাঁদের কাব্যধারা ও কাব্যরীতিকে অনুসরণ ও স্বীকরণ করে নিয়ে নিজস্ব স্বাতন্ত্র্য ও স্বকীয়তা অর্জন করেছেন। জন্ম দিয়েছেন নতুন কাব্যরীতির। ফররুখ আহমদের কবিতায় বিষয়বস্তু, ছন্দ, আঙ্গিক ও রূপরীতির এবং উপমা উৎপ্রেক্ষা ও চিত্রকল্পের যে বৈচিত্র্যময় ব্যবহার, কবিতার ছন্দ, আঙ্গিক রূপরীতি নিয়ে যে পরীক্ষা-নিরীক্ষা তার মূলে কবির সৃজনী প্রতিভা এবং শিল্প সচেতনতা যেমন কাজ করেছে, তেমনি কাজ করেছে ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকারবোধ এবং বাংলা ও ইউরোপীয় সাহিত্যের বিশেষ করে কাব্য সাহিত্যের সঙ্গে তাঁর নিবিড় পরিচয়। বিদ্রোহী কবি এবং বাংলা সাহিত্যে মুসলিম ঐতিহ্যের ও রেনেসাঁর অসামান্য রূপকার কাজী নজরুল ইসলামের মতই ফররুখ আহমদও ফারসি সাহিত্যের ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারকে স্বীকরণের মাধ্যমে নিজের কাব্য সাধনায় সাফল্যের সঙ্গে ব্যবহার করেছেন।

ফররুখ আহমদের কবিতার বিষয়বস্তু, ভাষা, ছন্দ, আঙ্গিক ও রূপরীতি এবং উপমা উৎপ্রেক্ষা চিত্রকল্পের ব্যবহারে পূর্বসূরি কবিদের বিশেষত মাইকেল, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ইসলাম, জীবনানন্দ দাশ প্রমুখের যে প্রভাব লক্ষণীয় তা ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকারকে গ্রহণ এবং স্বীকারকরণের ফলাফল। কবিতায় ইসলামী আদর্শ, ঐতিহ্য ও মূল্যবোধের রূপায়ণে এবং মানবতাবাদের উজ্জীবনে তিনি নজরুলের এবং মহাকবি আল্লামা ইকবালের কাব্যধারা থেকে প্রেরণা লাভ করেছেন, অমিত্রাক্ষর ছন্দের ব্যবহারে এবং নাট্যকাব্য ও মহাকাব্য রচনায় ও ক্লাসিক ভাষারীতির প্রয়োগে আদর্শের আদল পেয়েছেন মাইকেল মধুসূদন দত্তের কাব্যধারা থেকে, এবং রোমান্টিক স্বপ্ন কল্পনা ও সৌন্দর্যবোধের উৎসারণে আর গীতিকাব্য রচনায় তিনি আদর্শের আদল পেয়েছেন রবীন্দ্রনাথ ও জীবনানন্দ দাশের কাব্যধারা থেকে।

কবি ফররুখ আহমদ আমাদের ঐতিহ্যকে জীবনের পথ দেখিয়েছেন। তিনি সকল জাগরণী বাণী শুনিয়েছেন। তাওহীদের পথে; জীবনের অনুশীলনীতে অধ্যাত্ম সাধনায় উৎসাহিত করেছেন। তিনি নিজের তাসাওফ অনুসরণ করেছেন, মুরাকাবা, মুশাহাদা করেছেন। ফলে তাঁর কাব্যের বহু স্থানে তাসাওফের শিখা প্রজ্জ্বলিত হয়ে উঠেছে। তিনি ‘সিরাজাম মুনীরা’  শীর্ষক কবিতায় মহানবী (সা.)-এর পথ ধরে যুগে যুগে যারা এগিয়ে চলেছেন, তাদের বিবরণ দিয়েছেন এভাবে চলেছে ধ্যানের জ্ঞান-শিখা বয়ে জিলানের বীর, চিশতী বীর রঙ্গিন করি মাটি সূরাহী নকশবন্দের নয়ন নীর, জ্ঞানের প্রেমের নিশান তুলেছে হাজার সালের মুজাদ্দিদ রায় বেরেলীর জঙ্গী দিলীর ভেঙেছে লক্ষ রাতের নিদ ওরা গেছে বহি তোমার নিশান রেখে গেছে পথে সেই নিশানি। তবু সে চলার শেষ নাই আর, কোনদিন শেষ হবে না জানি। লাখো শামাদান জ্বলে অফুরান রাত্রি তোমার রশ্মি স্মরি সে আলো বিভায় মুখ তুলে চায় প্রাণ পিপাসায় এ শবরী।

তিনি চার খলীফা ও পীরানে পীরদের জীবনালেখ্য তুলে ধরেছেন, আহ্বান জানিয়েছেন জিহাদে আকবরের। ষড়রিপু দমন করে আত্মাকে শক্তিশালী করার, মুনীকে বুলন্দ করার আহ্বান জানিয়েছেন। যেমন ইকবাল বলেছেন :

‘খুদীকো কার বুলন্দ এতনা কে/হর তকদীর সে পহলে

খোদা খোদ বান্দাসে পুচ্ছ/বাতা তেরে রেজা কিয়া হ্যায়।’

তেমনি ফররুখ আহমদ বলেছেন:

পাশবিকতার ললাটে তীব্র তাঁর উদ্যত করো/এই সংগ্রাম….. জিহাদ বৃহত্তর ….. প্রগাঢ় রক্ত পাপড়ি খোলার মত একটি নিমেষ দাও অন্তত।

ফররুখের কবি-কর্মে বিধৃত হয়েছে হাতেম তাঈ, নওফেল, পাঞ্জেরী, হারুনুর রশীদ, সুলেমান নবীর শিকলে বন্দী বিশাল জীন, এসেছে দরিয়ার তুফান, মরু সাইমুম, কালো আকীক, নিকষ দরিয়া, বিয়াবান মরু, পোখরাজ, ইয়াকুত, এমনি অসংখ্য রূপক, উপমা ও প্রতীক। ফররুখ আমাদের জীবন-সত্তাকে জাগ্রত করার উদ্দেশ্যে তাঁর কাব্য-শিল্পে যে অবদান রেখে গেছেন তা আমাদের হৃদয়ে চিরভাস্বর হয়ে থাকবে। প্রাচীনকে কেন্দ্র করে নতুনের ইতিহাস সৃষ্টি হবে। প্রাচীনের উপর বর্তমান অভিনব রূপে নির্মাণ করবে ভবিষ্যৎকে। ফররুখ আহমদের কাব্যে মুসলিম ঐতিহ্যের রূপায়ণ কাব্যমূল্যের মর্যাদায় উত্তীর্ণ হয়েছে। প্রতিভার যে বিশিষ্ট চেতনা ও প্রক্রিয়ায় বাংলা কাব্যে এ অভিনব শক্তি সঞ্চারিত হয়েছে, তার মর্মবাণী সর্বদাই আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যবহ।

কাব্যের বহিরঙ্গে ফররুখের কৃতিত্ব আরবি ফারসি শব্দের অবাধ সংযোজনার। এগুলোর ভাবানুষঙ্গ মুসলিম ঐতিহ্যের স্মৃতি বিজড়িত, তার অনেকটাই আমাদের দৈনন্দিন জীবনের ব্যবহারিক সম্পদ থেকে আহরণ করা হয়েছে, আর বাকিটা সংগ্রহ করা হয়েছে ইসলামী সাহিত্য, ইতিহাস প্রাক আধুনিক যুগের পুঁথি সাহিত্য থেকে। কবির লক্ষ্য হলো- আলংকারিকের সে বিখ্যাত বাণী “The best words in the best order” অর্থাৎ শব্দের যথাযথ প্রয়োগ, লালিত্য সৃষ্টি ও কাঙ্ক্ষিত ব্যঞ্জনায় পাঠকের চিত্ত জয় করা। শব্দের অবিশ্বাস্য বিস্ময়কর ধ্বনিগত ব্যঞ্জনা বহু ক্ষেত্রে অর্থ-নিরপেক্ষ মোহবিস্তারে সমর্থ হয়েছে। এ সম্পর্কে সমালোচক মোহিতলাল মজুমদারের একটি মন্তব্য প্রাসঙ্গিক মূল্যায়নে যথাযথ মনে করি। তিনি কবি নজরুল ইসলাম সম্বন্ধে যা বলেছেন, ফররুখ আহমদ সম্বন্ধেও তা প্রযোজ্য। তিনি বলেছেন : ছন্দকে রক্ষা করে তার মধ্যে একটি অবলীলা, স্বাধীন, স্ফূর্তি, অবাধ আবেগ, কবিতাকে কোথাও হারিয়ে ফেলেননি। ছল যেন ভাবের দাসত্ব করছে। কোনখানে অধিকারের সীমা লঙ্ঘন করেনি। এ প্রকৃত কবি শক্তিই পাঠককে মুগ্ধ করে। কবিতা আবৃত্তি করলেই বোঝা যায় যে, শব্দ ও অর্থগত ভাবের সুর কোনখানে ছন্দের বাঁধনে ব্যবহৃত হয়নি। বিস্ময়, ভয়, ভক্তি, সাহস অটল বিশ্বাস এবং সর্বোপরি প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত একটি ভীষণ গভীর অতিপ্রাকৃত কল্পনার সুর, শব্দ বিন্যাস ও ছন্দ ঝংকার মূর্তি ধরে ফুটে উঠেছে। দৃষ্টান্ত দেয়া যেতে পারে :

ঘন সন্দল কাফুরের বনে ঘোরে এ দিল বেহুঁশ

হাতির দাঁতের সাঁজোয়া পরেছে শিলাদৃঢ় আবলুস,

পিপুল বনের ঝাঁঝালো হাওয়ায় চোখে যেন ঘুম নামে,

নামে নিজকে সিন্ধু ঈগল দারিয়ার হাম্মামে ।

এ পদ্ধতিগুলোতে ভাবানুযায়ী শব্দ বিন্যাস, অন্ত্যমিল ও গভীর গভীর ধ্বনি ছন্দের অধীন হয়ে এবং চমৎকার ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করে এক অভিনব রূপ লাভ করেছে। ফররুখের ঐতিহ্য-প্রীতি সামান্য ঋদ্ধ মানসের অতীতের প্রতি অন্ধ মোহের সঙ্গে তুলনীয় নয়। কবি অতীতকে স্মরণ করেছেন বর্তমানকে নির্মাণ করার উদ্দেশ্যে হাতিয়ার রূপে। তাঁর দৃষ্টিতে ইতিহাস চির জীবন্ত ইতিহাসের বিবর্তন আছে, মৃত্যু নেই। যুগে যুগে সে নব নব আবর্ত সৃষ্টি করে চলেছে। মুহররম মাসে বা শহীদে কারবালা রচনা করতে গিয়ে তার উদ্গত অশ্রু গড়িয়ে পড়েছে সমকালীন মানুষের তৃষ্ণাতত্ত জীবনের উপর। সিরাজাম মুনীরা, আবু বকর সিদ্দিক, উমর দরাজ দিল, ওসমান গনি, আলী হায়দার কিংবা গাওসুল আজম, সুলতানুল হিন্দ, মুজাদ্দিদ আলফে সানী প্রমুখের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে স্বদেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের কথাই স্মরণ করেছেন। বাংলা কাব্যে মুসলিম ঐতিহ্যের রূপায়ণে দুটি কাব্যসূত্র ফররুখ আহমদের সাফল্যের মূলে ক্রিয়াশীল। প্রথমত বাংলা হোক, আরবি, ফারসি বা উর্দু হোক শব্দের ধ্বনিগত ব্যবহারে তিনি ছিলেন অসাধারণ কুশলী শিল্পী। দ্বিতীয়ত তাঁর ঐতিহ্যবোধ জীবন-সম্পৃক্ত। অতীতকে তিনি নকল করেননি, ইতিহাসকে তিনি কেবল বিবৃত করেননি, ঐতিহ্যকে আওড়ে যাননি, তাকে নবরূপ দান করেছেন। বর্তমানের সঙ্গে তার সেতু বন্ধন ঘটিয়েছেন, অনাগত দিনের স্বপ্ন সম্ভাবনায় তাকে ঐশ্বর্যশালী করেছেন।

বাংলা কাব্যকুঞ্জের বহু প্রতিভাবান কবি দীর্ঘকাল ধরে রূপকল্প সৃষ্টির এক ঐশ্বর্যদীপ্ত ঐতিহ্য গড়ে তুলেছেন। ফররুখ আহমদ তাঁর পূর্বসূরিদের অবদান স্বীকার করেও রূপকল্প নির্মাণে তাঁর স্বকীয়তা ও স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখেছেন। তিনি তীক্ষ্ণ টানের সরল রেখায় সুন্দর সুন্দর রূপকল্প সৃষ্টিতে অসাধারণ সৌন্দর্য দেখিয়েছেন।

দেখুন বুরাইর সাথে পেয়েছি ভালাই অফুরান জিন্দিগী

আবলুস ঘন আঁধারে পেখম খুলেছে রাতের শিল্পী।

কিংবা

তৃষ্ণানের ছাঁচে ঘূর্ণাবর্তে সুগঠিত তার অনু পুষ্ট পালকে পিছলিয়া পড়ে প্রবাল বর্ণ ধনু।

অন্যত্র,

দেখ আসমানে ফোটে সেতারার কলি, আরশির মত নিটোল পানিতে মুখ দেখে বকাওলি।

ফররুখ আহমদের কবিতার স্থানে স্থানে যে অপূর্ব বর্ণালি ও শাণিত রূপচ্ছটা রয়েছে, তার কিছু পরিচয় এসব উদ্ধৃতিতে ধরা পড়েছে। মহাকবি ইকবাল বলেছেন: আমাদের অধিকাংশ কাব্যই মৃত্যুর বন্দনা গীতি ছাড়া আর কিছুই নয়। ওহে বন্ধু, যদি তোমার তহবিলে কাব্যের উপমা থেকে থাকে, তবে মৃত্যুহীন জীবনের পরশ-পাথরে তা চুঁইয়ে নাও। প্রবল বজ্রবর্ষণের পূর্বে যেমন বিদ্যুৎ চমক, তেমনি পরিচ্ছন্ন দৃষ্টিধারাই কর্মপথের সন্ধানী দূত। একথা সত্য যে, রাতের গভীরতম অন্ধকার অংশই অদূরাগত সুবহে সাদিকের নকীব এবং এ সময়েই মুআযযিনের কন্ঠস্বরে ঊষার আযানের তকবীর ধ্বনি ঘোষণার প্রয়োজন সবচাইতে বেশি। ফররুখ আহমদের কাব্য সে ঊষার আযানের তকবীর ধ্বনি ঘোষণার মত। ফররুখ আহমদের কাব্যে সে ঊষার আযানের কল্যাণের সুর, সঞ্জীবনী স্পর্শ আর বজ্রেগর্ভ জ্যোতি জ্বালা আছে। তার সুর ধ্বনিতে নার’ ও ‘নূর’-এর সম্মেলন ঘটেছে।

ফররুখ একাডেমী পত্রিকা, ২য় সংখ্যা, অক্টোবর, ২000

১৭১৯ বার পঠিত

শেয়ার করুন

Picture of রোয়াক ডেস্ক

রোয়াক ডেস্ক

রোয়াক, ইসলামী চিন্তা ও গবেষণা ইন্সটিটিউটের অনলাইন মুখপাত্র। বুদ্ধিবৃত্তিক ও সময়ের চিন্তাগত সংকট থেকে উত্তরণের জন্য কাজ করে যাবে।
Picture of রোয়াক ডেস্ক

রোয়াক ডেস্ক

রোয়াক, ইসলামী চিন্তা ও গবেষণা ইন্সটিটিউটের অনলাইন মুখপাত্র। বুদ্ধিবৃত্তিক ও সময়ের চিন্তাগত সংকট থেকে উত্তরণের জন্য কাজ করে যাবে।

মতামত প্রকাশ করুন

Scroll to Top