আদালত প্রতিষ্ঠায় ইসলামী সভ্যতার দৃষ্টান্ত

আল-কুরআন প্রদর্শিত জীবনযাপন করার পক্ষে কতকগুলো মূল্যবান অপরিহার্য বস্তু রয়েছে। আল-কুরআনে আল্লাহ্ সম্বন্ধে বর্ণনা প্রসঙ্গে তাঁকে সকলকিছুর সারসত্তা (Essence) হিসাবেও সকল গুণের মহান অধিকারী হিসাবে ধারণা করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, কারণ তিনিই সকলকিছুর মহান সৃষ্টিকর্তা। সারসত্তা হিসাবে আল্লাহ্ মানবজ্ঞানের বহু ঊর্ধ্বে বিরাজমান। তাঁর যাত সম্বন্ধে কোন মানুষের সম্যক ধারণা হওয়া সম্ভবপর নয়; একইসাথে তিনি অবাঙমানস-গোচর। তবে তাঁর গুণাবলী এ দুনিয়ার সর্বত্র রূপায়িত। এগুলো একদিকে যেমন আল্লাহর গুণাবলী বা মূল্যবান, তেমনি অপরদিকে চিন্তার মাধ্যম বা Category-ও বটে। এদের আলোকেই আল্লাহ্ সম্বন্ধে মানুষ কিছুটা ধারণা করতে সমর্থ হয়। চিন্তার মাধ্যম হিসাবে কেবল এদের সার্থকতা নয়; বরং বাস্তব জগতেও তারা সত্য বলে তাদের Subjective ও Objective দুই-ই বলা যায়। এক্ষেত্রে গ্রীক দার্শনিক এরিস্টটল তাঁর দ্বাদশ চিন্তার মাধ্যমকে বিষয়ীমুখ (Objective) বলে ধারণা করতেন। অপরদিকে কান্ট তাঁর দ্বাদশ মাধ্যমকে আত্মমুখ (Subjective) বলে নিশ্চিত ছিলেন। আল-কুরআনুল কারীম তাদের উর্ধ্বে অনন্য আবিষ্কার করে মানব-মন-সাপেক্ষ তাদের মর্যাদা লঘু করেনি বরং আল্লাহ্‌ গুণাবলী বাস্তব জগতেও সত্য বলে ঘোষণা করেছে।

 

এসব গুণের সংখ্যা সর্বশুদ্ধ নিরানব্বই। আর-রহমান, আর-রাহীম, আল- করীম, আস-সাত্তার প্রভৃতি আল্লাহর গুণবাচক নামগুলোকে দার্শনিক পরিভাষায় মান (Values)-ও বলা যায়, আবার মানব-চিন্তার মাধ্যম(Category)ও বলা যায়। এ মাধ্যমগুলো আবার এ দুনিয়ার নানা ক্ষেত্রে বাস্তবায়িত, এদের মধ্যে আবার যোগসূত্র রয়েছে। আল্লাহ্ এ দুনিয়ার সৃষ্টিকর্তা বলে প্রত্যেকটি গুণের সঙ্গে তাঁর এ সৃষ্টির গুণ অচ্ছেদ্যভাবে বিজড়িত। তিনি রহীম (দয়ালু); তবে অন্য কোন সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টিতে তিনি দয়ালু নন। তাঁরই সৃষ্ট এ মখলুকাতে তিনি দয়ালু। তেমনি তিনি আস্-সাত্তার অর্থাৎ আচ্ছাদনকারী। তবে তাঁর এ গুণ তাঁর সৃষ্ট দুনিয়াতেই প্রকাশিত হচ্ছে। তেমনি তিনি আদিল অর্থাৎ ন্যায় বিচারক। তবে তাঁর এ বিচারও তাঁরই সৃষ্ট জগতে কার্যকরী। তাই দেখা যায় প্রত্যেকটি গুণের পটভূমিকায় আল্লাহর সৃষ্টিধর্মী গুণ ‘খালিক’ নামক গুণ বিদ্যমান। ন্যায়বিচারের অনুষঙ্গ হিসাবে আবার নানা বিষয় উহ্য রয়েছে। ‘বিচার’ শব্দ থেকে সমাজ জীবন, রাষ্ট্রীয় জীবন প্রভৃতির প্রসঙ্গও আলোচনা ক্ষেত্রে দেখা দেয়। মানুষ সামাজিক জীব। সে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বাস করতে পারে না। আবার সমাজ জীবনেও অন্য দশজন থেকে পার্থক্য বজায় রাখতে না পারলে ব্যষ্টি হিসাবে তার অস্তিত্ব লোপ পায়। কাজেই তার সামাজিক বা যুথচারী প্রবৃত্তির (Gragarious instinct) সঙ্গে তার অসামাজিক (Unsocial) প্রবৃত্তির সংঘর্ষ দেখা দেয়। এ উভয় প্রবৃত্তির মধ্যে সমঝোতা সাধনের জন্য যুগে যুগে নানাবিধ বাণী নিয়ে পয়গম্বর, পীর দরবেশ, সাধু-সন্ন্যাসী আবির্ভূত হয়েছেন। আদল হচ্ছে এ দু’টো প্রবৃত্তির সামঞ্জস্য বিধানের নীতি।

তার উপর প্রকৃতির কোলে বিরাজমান জীব-জন্তু, গাছপালা বৃক্ষাদির যে বৃহত্তর জগৎ রয়েছে, তাদের সঙ্গে মানুষের সম্বন্ধ নির্ণয়ও অতিশয় প্রয়োজনীয়। তাদের দান মানুষ কতটুকু পর্যন্ত গ্রহণ করতে পারে এবং প্রতিদানে তাদের কি দিতে হবে তাও নির্ধারিত হওয়া প্রয়োজনীয়। কাজেই আদল বা আদালতকে ব্যাপক অর্থেই গ্রহণ করতে হবে। আদলের প্রকৃত অর্থ হচ্ছে এতেদাল বা সমতা। মুসলিম জীবনের নীতির উৎস আল-কুরআনুল কারীমে আদল সম্বন্ধে নিম্নোক্ত তাগিদ দেওয়া হয়েছে- “হে মু’মিনগণ! তোমরা সুবিচার প্রতিষ্ঠাকারী হও, যদি তোমাদের নিজেদের বিরুদ্ধে অথবা তোমাদের পিতামাতা ও আত্মীয়-স্বজনের বিরুদ্ধে গ্রহণ করতে হয়, তবুও যে-কোন মূল্যে ন্যায়বিচার কায়েম করো।”

 

অন্যস্থলে বলা হয়েছে-

“নিশ্চয়, আল্লাহ্ পাক সুবিচার ও পরোপকারের আদেশ দিচ্ছেন, আত্মীয়-স্বজনকে অর্থ সম্পদ দান করার নির্দেশ দিচ্ছেন এবং অশ্লীল-অন্যায় কাজ সম্পর্কে তিনি নিষেধ করেছেন, তিনি তোমাদের নসিহত করেছেন, হয়ত তোমরা সে নসিহত গ্রহণ করবে।”

এই আয়াতে ‘আমর বিল আদলে’ শব্দটা ব্যবহার করা হয়েছে, অর্থাৎ সুবিচার কায়েম করার আদেশ দিচ্ছেন আল্লাহ্ পাক।

এ সুবিচার আবার কুরআন প্রদর্শিত নীতির ভিত্তিতেই হওয়া চাই। প্রকৃতপক্ষে আল-কুরআন মানব-জীবনের সর্বাঙ্গীন মঙ্গলের জন্য যে সব নীতি প্রতিপালন করার নির্দেশ দিয়েছে, সেসব নীতি যথাযথভাবে পালন করাই ইসলামের দৃষ্টিতে আদল বা ন্যায়বিচার। এতে ত্রুটি-বিচ্যুতি দেখা দিলে তা ন্যায় বিচারসঙ্গত বলে গণ্য হবে না। কুরআনুল কারীম প্রদর্শিত পথে এ দুনিয়ায় ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত করতে হলে, তাই তিনটি ক্ষেত্রে ন্যায়-নীতির প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন। প্রথমত ব্যক্তিগত জীবনে ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা করবে। দ্বিতীয়ত সামাজিক জীবনে তা প্রতিষ্ঠিত করতে সচেষ্ট হবে, এবং তৃতীয়ত প্রকৃতি বা পরিবেশের মধ্যেও সে নীতি প্রতিষ্ঠায় তাকে অংশ গ্রহণ করতে হবে।

 

ব্যক্তিগত জীবনে ন্যায়নীতি প্রতিষ্ঠার অর্থ সংযত জীবনযাপন। আমাদের প্রত্যেককেই আল্লাহ সুবহানাহু তা’আলা-সীমা লঙ্ঘন না করতে আদেশ দিয়েছেন। তার সরল অর্থ-এই জীবনের কোন প্রবৃত্তিকেই অস্বীকার না করে-তার যথাযথ সন্তোষ-বিধান। তবে এ সন্তোষ যেন বিলাসিতায় পর্যবসিত না হয়। কামবৃত্তি মানব-জীবনে সহজাত। তাকে অস্বীকার করলে যৌন জীবনে বিকৃতি দেখা দিতে পারে। তাই ইসলাম প্রত্যেক নর-নারীকেই কতকগুলো শর্ত আরোপ করে যৌন-ক্ষুধা পরিতৃপ্তির অনুমতি দিয়েছে। তবে যাতে সর্বাবস্থায় এ স্বাভাবিক পরিতৃপ্তি অতিরিক্ত মাত্রায় যৌন বিলাসে পর্যবসিত না হয়, তার প্রতি সাবধান করে দিয়েছে। তেমনি অন্যান্য সহজাত বৃত্তি ও প্রবৃত্তির বেলায়ও যাতে সন্তোষ বিধানের সীমা লঙ্ঘন করা না হয় তার নির্দেশ দিয়েছে। সামাজিক আইন-কানুনগুলো মানব-জীবনের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ও শান্তি প্রতিষ্ঠার মাধ্যম বলে আল-কুরআন পরিষ্কার ভাষায় তা পালনের নির্দেশ দিয়েছে। ইসলামের বিশেষত্ব এই যে, ব্যক্তিগত, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় আইনের মধ্যে কোন পার্থক্য স্বীকার করা হয়নি। যা ব্যক্তিগত জীবনে পরিহার্য, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনেও অপরিত্যাজ্য। এই জন্যই আদল বা ইতেদাল একই সূত্র অবলম্বন করে অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক প্রভৃতি জীবনের নানাবিধ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

 

হযরত রাসূলে আকরাম (সা)-এর জীবনে আদালত প্রতিষ্ঠার সর্বশ্রেষ্ঠ উদাহরণ পাওয়া যায়। পরবর্তীকালে খোলাফায়ে রাশেদীনের জীবনে, তাবেয়ীন ও তাবে-তাবেয়ীনের জীবনে সে প্রচেষ্টার নিদর্শন পাওয়া যায়। উমাইয়া বা আব্বাসীয় শাসনকর্তাদের জীবনে এবং মোঘল ও উসমানী সুলতানদের মধ্যেও আদালত প্রতিষ্ঠার দৃষ্টান্ত দেখা যায়। এ ক্ষেত্রে আরও প্রণিধানযোগ্য বিষয় এই যে, মুসলিমদের আধিপত্যের সময় শাসন বিভাগ (Executive), বিচার বিভাগ থেকে সব সময়ই পৃথক ছিল। কাযীর বিচার এখনও জনসমাজে আদর্শ হিসাবেই পরিগণিত। হযরত রাসূলে আকরাম (সা)-এর জীবনে আদল বা ন্যায়বিচারের প্রতি কি অপরূপ নিষ্ঠা ছিল, তা একটিমাত্র উদাহরণেই সুস্পষ্ট হয়ে উঠবে। একদা বনি মঞ্জুম গোত্রের একজন মহিলাকে চুরির অপরাধে প্রিয় নবী (সা)-এর দরবারে হাজির করা হলো। তিনি চুরির শাস্তি হস্ত-কর্তনের আদেশ দিলে তাঁর সমীপে সেই মহিলাকে সম্ভ্রান্ত পরিবারের মহিলা হিসাবে রেহাই দেওয়ার সুপারিশ করা হয়। প্রিয় নবী (সা) তখন রাগান্বিত হয়ে আল্লাহর শপথ করে বলেছিলেন- “যদি আমার কন্যা ফাতেমাও এই অপরাধ করতো, তবে আমি তাকেও অনুরূপ শান্তি দিতাম।” আর একবারের ঘটনা, প্রিয় নবী (সা)-এর দরবারে জনৈক ইহুদী একজন মুসলমানের বিরুদ্ধে নালিশ করলো। তিনি সত্য ও ন্যায়ের খাতিরে সে ইহুদীর পক্ষে রায় দিয়ে সুবিচার কায়েম করার ক্ষেত্রে এক অনুপম আদর্শ স্থাপন করেছেন। প্রকৃতিতে অবস্থিত নানাবিধ জীব-জন্তুর সঙ্গে কিভাবে ন্যায়সঙ্গত ব্যবহার করতে হয় তারও উদাহরণ রাসূল (সা)-এর জীবন থেকে পাওয়া যায়। একদা এক সাহাবী কয়েকটি পাখীর ছানা খুব উল্লাসের সঙ্গে হযরতের জন্য নিয়ে এলেন। পক্ষী-দম্পতি ছানার মায়ায় তাকে অনুসরণ করে হযরতের কাছেই এসে করুণ বিলাপ জুড়ে দেয়। রাসূলে আকরাম (সা) রাগান্বিত হয়ে ছানাগুলোকে তাদের কাছে ফিরিয়ে দেবার জন্য সঙ্গে সঙ্গেই আদেশ দিলেন। এতে বুঝা যায়, অনর্থক কোন প্রাণীকেও কষ্ট দেওয়া ইসলামের দৃষ্টিতে প্রশংসনীয় নয়।

 

খোলাফায়ে রাশেদীনের জীবনে সেই আদল প্রতিষ্ঠার জন্যই ঐকান্তিক আগ্রহ – দেখা দেয়। রাসূলে আকরাম (সা)-এর ইন্তেকালের পর ইয়ামেনের অধিবাসীরা যাকাত আদায় করতে বিরত হলে প্রথম খলীফা হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রা) তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন অর্থাৎ ইসলামের একটি অতি প্রয়োজনীয় অঙ্গকে পরিত্যাগ করায় এদের শাস্তি দেওয়া অবশ্য কর্তব্য বলেই গণ্য করেন। তেমনি রাসূলে আকরাম (সা)-এর ইন্তেকালের পরে তাঁর একমাত্র কন্যা হযরত ফাতিমাতুজ জোহরা (রা) খায়বার ও ফিদক বা ফাদাকের সম্পত্তির একমাত্র উত্তরাধিকারী হিসাবে দাবি করলে তিনি তাঁর এ দাবি প্রত্যাখ্যান করে বলেন, “আমি রাসূলে আকরাম (সা)-কে বলতে শুনেছি, নবী-রসূলদের কোন উত্তরাধিকারী নেই।”

 

দ্বিতীয় খলিফা হযরত উমর ফারুক (রা)-এর জীবনে আদল প্রতিষ্ঠার নীতি বিশেষভাবেই ফুটে উঠেছে। তাঁর গোটা জীবন-ই আদলের এক জীবন্ত দৃষ্টান্ত। সদ্য ধর্মান্তরিত মুসলিম নরপতি জাবলা হজ্জ উপলক্ষে তাওয়াফকালে এক দরিদ্র বৃদ্ধের আঘাত লাগে; তাতে তিনি ক্রুদ্ধ হয়ে ঐ বৃদ্ধকে চপেটাঘাত করেন। হযরত উমর এই অন্যায়ের জন্য তাকে শাস্তি দিতে মনস্থ করেন। তার জন্য সমর-সভা (War Council)-এর সকলেই ইসলামের শৈশবাবস্থা স্মরণ করে এই আসন্ন সংগ্রাম থেকে খলিফাকে বিরত রাখতে চেষ্টা করেন। কিন্তু খলিফা তাঁর সংকল্পে অচল ও অটল রইলেন।

নীতিভ্রষ্ট ব্যক্তি যে পদের-ই অধিকারী হোক না কেন, তাকে শাস্তি দিতে কোনদিনই খলিফা উমর (রা) ইতস্তত করেন নি। তিনি যখন শুনতে পেলেন যে, পারস্যের বিলাসিতা গভর্নর সা’দকে স্পর্শ করেছে এবং তিনি একটি প্রাসাদ তৈরি করে তাতে খসরুর প্রাসাদ থেকে একটি তোরণ এনে সংযোগ করেছেন, তিনি তৎক্ষণাৎ লিখে পাঠালেন, “আমি শুনতে পেলাম তুমি খসরুগণের অনুকরণ করে নিজের ব্যবহারের জন্য অত্যুচ্চ প্রাসাদ নির্মাণ করেছ এবং তাতে একটি কপাট এনে লাগিয়েছ। তোমাদের উদ্দেশ্য পারস্য সম্রাটগণের মত দ্বারবান (প্রহরী) রাখা তাতে বিচার ও সাহায্যপ্রার্থী ব্যক্তিদের বিঘ্ন ঘটবে। তুমি এভাবে হযরত (সা)-এর পথ ত্যাগ করে খসরুগণের পন্থা অবলম্বন করছ। মনে রাখবে, খসরুগণ প্রাসাদ থেকে গিয়ে কবরে বিলুপ্ত হয়েছে, আর হযরত (সা) তাঁর সামান্য কুটির হতে সর্বোচ্চ বেহেশতে আরোহণ করেছেন। আমি মুহাম্মদ বিন মুসলিমকে তোমার প্রাসাদ ধ্বংস করতে আদেশ দিয়েছি। এ দুনিয়ায় দুটো ঘরই তোমার জন্য যথেষ্ট-একটি বাসগৃহ অপরটি খাজাঞ্চিখানা।” আরও অসংখ্য দৃষ্টান্ত দিয়ে দ্বিতীয় খলিফা হযরত উমর ফারুক (রা.)-এর আদল প্রতিষ্ঠার প্রতি অবিচলিত শ্রদ্ধার প্রমাণ পেশ করা যেতে পারে।

 

তৃতীয় খলিফা হযরত উসমান (রা.), আমির মুয়াবিয়া, আর ইবনুল-আস ও মারওয়ানের পরামর্শে পরিচালিত হতেন বলে একটি শ্রুতি এখনও চলতি রয়েছে। তবে জীবনের অন্তিম সময় তিনি আত্মোৎসর্গ করে প্রমাণ করেছেন যে, ন্যায়-বিচারকেই তিনি আদর্শ নীতি হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন। মারওয়ানের শঠতায় যখন মিসরের গভর্নর মুহাম্মদ ইবনে আবু বকরের প্রাণ সংশয় দেখা দিয়েছিল তখন ক্ষিপ্ত বনু হাশিম সম্প্রদায় তাঁর জন্য মারওয়ানের প্রাণের দাবি করেছিলো। ইসলামী বিধান মতে তিনি তাদের এ প্রস্তাবে সম্মত হননি বলে অকস্মাৎ ঝড়ের বেগে বনু হাশিম গোত্রের লোক তাঁকে আক্রমণ করে বসে। তিনি ইচ্ছা করলে বনু উমাইয়া গোত্রের লোকদের আহ্বান করে মহাযুদ্ধের সূচনা করতে পারতেন; তবে যাতে মুসলিম ভ্রাতৃবৃন্দের খুনে মদীনার মাটি তাঁর ওসিলায় রঞ্জিত না হয়, এ জন্য তিনি নিজে শাহাদাত বরণ করেন। আদল প্রতিষ্ঠায় অপারগ হয়ে এরূপভাবে শাহাদাত বরণ আদল প্রতিষ্ঠারই এক অতি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

মহান খলিফা হযরত আলী (রা.)-এর জীবনে আদল প্রতিষ্ঠার ভূরি ভূরি দৃষ্টান্ত রয়েছে। এক দিন খলিফা আলী (রা) খুতবা পাঠ করছিলেন। হঠাৎ তাঁর দৃষ্টি আপতিত হল পুত্র হাসান ও হুসেনের দেহের উপরে। তাঁরা দামী চাদর পরিধান করে মসজিদে আগমন করেছেন। খলিফা খুতবা দানে ক্ষান্ত হলেন। তাঁদেরকে জিজ্ঞাসা করলেন, ঐ চাদর তাঁরা কোথায় পেয়েছেন। তিনি অবগত হলেন কোন এক ধনী ব্যক্তি তাঁদেরকে এগুলো উপঢৌকন দিয়েছে। চাদর দু’টি সঙ্গে সঙ্গেই হাসান (রা) ও হুসেন (রা)-এর দেহ হতে অপসারিত হয় এবং বায়তুল মালের খাজাঞ্চির হাতে চলে যায়। হযরত আলী (রা)-এর একটি লৌহবর্ম ছিল। সিফফিনের যুদ্ধে বর্মটি হারিয়ে যায়। কিছুকাল পরে লৌহ বর্মটি কুফায় এক ইহুদীর পরিধানে লক্ষ্য করেন। তিনি তাকে বলেন এ বর্মটি আমার। ইহা আমি বিক্রয় করিনি বা কাউকে দেইনি। তুমি এ বর্ম কোথায় পেলে? ইহুদী জবাব দিল যে, বর্মটি তারই। অগত্যা খলিফা কুফার কাজী শারিহ-এর আদালতে মামলা দায়ের করেন। কাজী খলিফাকে তাঁর পক্ষের সাক্ষী উপস্থিত করতে নির্দেশ দিলে, তিনি পুত্র হাসান (রা) ও ভৃত্য কাম্বারকে কোর্টে হাজির করেন। দু’জনেই বর্মটি ভালভাবে চিনতেন। কিন্তু কাজী দু’জনের সাক্ষ্যই অগ্রাহ্য করলেন। কারণ, একজন বাদীর পুত্র ও অপরজন বাদীর ভৃত্য। বিচারে পরাভূত হয়ে খলিফা বিনা বাক্য-ব্যয়ে গৃহে প্রত্যাবর্তন করেন। আইন-আদালতের প্রতি মুসলিম রাষ্ট্রপ্রধানের আনুগত্য ও কাজীর নিরপেক্ষ বিচারে ইহুদী অভিভূত হয়ে যায়। সে খলিফার নিকট অপরাধ স্বীকার করে বর্মটি ফিরিয়ে দেয়, ক্ষমা প্রার্থনা করে এবং ইসলামী জীবনে দীক্ষা গ্রহণ করে। কোন এক জিহাদে একজন ইহুদীকে পরাভূত করে হযরত আলী (রা) তার বুকে সওয়ার হয়ে যখন তার গলায় খঞ্জর হানতে চাইলেন; তখন সে ইহুদী তাঁর মুখে থুথু নিক্ষেপ করলো। তিনি তৎক্ষণাৎ তাকে ছেড়ে দাঁড়িয়ে গেলেন। তাকে কেন মারলেন না-এ প্রশ্ন যখন সে করলো। তখন তিনি জওয়াব দিলেন-এখন তোমাকে মারলে ব্যক্তিগত জিঘাংসার বশবর্তী হয়েই মারবো, এটি আমাদের দীনের বহির্ভূত। আগে তোমাকে মারতে চেয়েছিলাম আল্লাহর দীনের প্রতিকূলতা দূর করবার জন্য। তাঁর এ আচরণে মুগ্ধ হয়ে ইহুদী ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। তাঁকে লক্ষ্য করে একদিন উসমান ইবনে হানিফ বলেন, “আপনি বিত্ত-সম্পদের সমবণ্টন নীতি অনুসরণ করেছেন। এ নীতির মাধ্যমে আপনি সমাজের মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তিদের সাধারণ মানুষের পর্যায়ে নামিয়েছেন, নিগ্রো এবং পারসিয়ানদেরকে সমান মর্যাদা দিয়েছেন। আপনি দাস ও মালিককে বায়তুলমাল হতে সমপরিমাণ অংশ দিচ্ছেন, ধনীদেরকে তাদের জায়গীর হতে বঞ্চিত করছেন, তাদের বিশেষ মর্যাদা লোপ করছেন। এ নীতির দ্বারা আপনি খিলাফতের ও নিজের কল্যাণের চেয়ে সর্বনাশকেই ডেকে আনছেন। আর এ কারণেই প্রভাব ও সম্পদশালী আরবগণ আপনাকে পরিত্যাগ করে আমীর মুয়াবিয়ার দলে যোগ দিচ্ছে। দরিদ্র, অক্ষম লোকজন আপনার কোন উপকারই করতে পারবে না। অসহায় বিধবা ও দাসগণ আপনাকে কোন সাহায্য করতে পারবে না।” খলিফা প্রত্যুত্তরে বলেন-“অসম ধন বণ্টনের মাধ্যমে আমি এক বিত্তশালী সম্প্রদায় সৃষ্টি করে তাদের দ্বারা শোষণের পথ প্রশস্ত করতে পারি না। সমাজের এক শ্রেণি কর্তৃক অপর শ্রেণির শোষণের কোন পন্থাই আমি মুহূর্তের জন্যও অনুমোদন বা বরদাশত করতে পারি না।” খারেজি আবদুর রহমান ইবনে মুলজামের আঘাতে কুফার মসজিদে ধরাশায়ী হয়েও তিনি তাঁর অন্তিম উপদেশে বলেছিলেন, “আমার মৃত্যুর পর খারেজিদের সন্ধানে ও হত্যার মানসে ধাবিত হয়ো না। পাপ-পঙ্কিল জীবনযাত্রা এবং মানবতা বিরোধী কার্যকলাপে জীবন অতিবাহিত করার চেয়ে সত্য পথ অনুসন্ধানে বহির্গত পথভ্রষ্ট হওয়া শ্রেয়।”

 

সাহাবিদের অন্যতম প্রধান ছিলেন হযরত আবু যর গিফারী (রা)। তাঁর আদল বা ন্যায়নিষ্ঠা ছিল অতি-মানবিক। খলিফা উমর ফারুক (রা.)-এর খিলাফতের সময় এক ব্যক্তি চুরি ও নরহত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত হয়ে প্রাণ দণ্ডাদেশ প্রাপ্ত হয়। ঘটনার বিবরণে প্রকাশ করা হয়েছে, মদিনার এক ফলের বাগানে একটি চোর প্রবেশ করে ফলাদি চুরি করতে আরম্ভ করলে বাগানের মালিক তার পুত্রগণসহ চোরকে তাড়া করলে সে দৌড়ে বাগানের সীমা অতিক্রম করার চেষ্টা করে। প্রবেশ পথে বাগানের মালিক তাকে ধরে ফেলে। তবু চোর ঝাপটা-ঝাপটি করে তাকে ফেলে দিয়ে চলে যায়। এতে বাগানের বুড়ো মালিকের মৃত্যু হয়। তখন সময় ছিল ভোর বেলা। ফজরের আযান শুনে মুসল্লিগণ নামায আদায় করার উদ্দেশ্যে মসজিদে রওয়ানা হচ্ছেন, এমন সময় ঐ চোর মালিককে ফেলে পালিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ করলে সকলে মিলে চোরকে ধরে ফেলে। চোর কিন্তু অপরাধ স্বীকার না করে বলে, প্রকৃত চোর আগেই পালিয়ে গিয়েছে। আসল চোর পালাবার সঙ্গে সঙ্গে এসে উপস্থিত হওয়ায় তাকে চোর বলে ভ্রম হয়েছে। যারা তাকে পাকড়াও করেছে তারা কিন্তু সকলেই এক বাক্যে তাকেই চোর বলে সাব্যস্ত করে সাক্ষ্য প্রদান করে। কাজেই চুরি ও হত্যার অপরাধে খলিফা উমর (রা) তার প্রাণ দণ্ডাদেশ দেন। লোকটির বাড়ি ছিল সিরিয়ার পথে। সে মদিনায় এসেছিল কোন কাজ উপলক্ষে। তাই খলিফাকে মিনতি করে বলে, “আমি তো চুরি করিনি; তবু যে কোন কারণেই হোক চোর বলে সাব্যস্ত হয়েছি, আমাকে সময় দিন। আমি বাড়িতে গিয়ে আমার শাস্তির কথাটা বলে আমি আমার অবর্তমানে ওরা কিভাবে চলবে তাও তাদের কাছে বলে আসি।” মহান খলিফা তার উত্তরে বলেন, “এভাবে খুনের আসামীকে তো মুক্তি দেওয়া যায় না-তুমি যে আবার ফিরে আসবে তার কোন প্রমাণ নেই। তুমি যদি উপযুক্ত ও বিশ্বাসী লোককে জামিন দিতে পারো-তাহলে তোমাকে সুযোগ দেওয়া যায়।”

 

এ লোকটার জামিন কে হবে? যদি সে ফিরে না আসে তবে তার পরিবর্তে জামিনদারকে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলতে হবে। কেউই এগিয়ে এলো না। বহুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে হযরত আবু যর গিফারীর (রা) লোকটার বিবরণ শুনলেন। তার মুখ দেখে তার কথায় আস্থা স্থাপন করে তিনি এগিয়ে এসে বললেন-“আমি এ লোকটার জামিন হতে রাযী আছি।” তাঁকে এ জামানতের মর্ম সম্যকভাবে বুঝিয়ে দেওয়া সত্ত্বেও তিনি অবিচলিতভাবে তাঁর মনোভাব ব্যক্ত করলেন। লোকটার জামানত মঞ্জুর করা হল এবং তাকে দেশে যেতে অনুমতি দেওয়া হল। নির্ধারিত তারিখে ও সময়ে ফাঁসির মঞ্চ তৈরি করা হল। লোকটার কিন্তু কোন পাত্তাই নেই। অগত্যা হযরত আবু যর গিফারী ফাঁসির মঞ্চে আরোহণ করে খলিফার আদেশ প্রতিপালন করার জন্যে প্রস্তুত হলেন। তবে সকলে একটু সময় অপেক্ষা করতে খলিফাকে অনুরোধ করেন।

 

কিছু সময় পরে দেখা গেল বহু দূরে একটি ইঁদুরের মত জীব মদিনার দিকে এগিয়ে আসছে। তারপর সে জীবটাই আরও বড় হয়ে বকরির আকারে দেখা দিল। কিছু সময় পর দেখা গেল এটি বকরি নয় ঘোড়া। দেখতে দেখতে প্রকাণ্ড আরবী ঘোড়ায় চড়ে লোকটি উপস্থিত হয়ে ঘোড়া থেকে নেমেই ফাঁসির মঞ্চে উপস্থিত হয়ে জল্লাদকে কাজ সমাধা করতে অনুরোধ করে। জল্লাদ প্রস্তুত হতে না হতে, প্রকৃত চোর বেরিয়ে এসে বলে- “এই লোকটি নিরপরাধ, আমিই প্রকৃত চোর; তবে আমি চুরি করার অবসর পাইনি। ওরা বাপ বেটা বেরিয়ে এসে আমায় তাড়া করলে আমি দৌড়ে পালিয়ে যাই। বুড়া আমার পথ আগলালে তাকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টাতেই তার মৃত্যু হয়।” চোরের এভাবে আত্মপ্রকাশ করায় নিহত ব্যক্তির ছেলেরা মুগ্ধ হয়ে তাকে মাফ করে দেয়। এমন ভাবে একজন নিরপরাধ ব্যক্তির জীবন রক্ষা পায়। হযরত আবু যর গিফারী তার জন্য জামিন না হলে হয়তো সঙ্গে সঙ্গে লোকটির ফাঁসি হয়ে যেত এবং খলিফার তরফ থেকে ইনসাফের ত্রুটি দেখা দিত। এজন্যই হযরত আবু যর গিফারী স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে জামিন হয়ে এ পরিস্থিতিতেও আদল প্রতিষ্ঠার সুযোগ দিলেন।

উমাইয়াদের শাসনকালের সূচনায় মুসলিমেরা ক্রমশই ইসলামের প্রতি বিমুখীতার ভাব প্রদর্শন করলেও তাদের মধ্যে কারো কারো জীবনে সত্য ও ন্যায়ের প্রতি যে শ্রদ্ধা ছিল আজকার দিনে তা দুর্লভ। আমীর মুয়াবিয়াকে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের জন্য দোষী সাব্যস্ত করা হয় এবং ইসলাম জগতে শাহানশাহী আমদানী করার জন তাকে দায়ী করা হয়। অথচ তার মধ্যেও আদলের অভাব ছিল না। সিফফিনের যুদ্ধে হযরত আলী (রা.)-এর পক্ষে জারকা বিনতে ওহী নাম্নী একজন মহিলা প্রচণ্ডতম সংগ্রাম করে মুয়াবিয়ার সেনাদলতে পর্যুদস্ত করলেও আমীর মুয়াবিয়া পরবর্তীকালে রাজাধিরাজের ক্ষমতালাভ করেও তার কোন ক্ষতি করেন নি; বরং বন্ধুগণের নিকট তার প্রশংসা করেছেন। তাকে দামেশকে ডেকে এনে তার কটুক্তি শ্রবণে ক্রুদ্ধ না হয়ে তাকে পুরস্কৃত করেছেন।

আমীর মুয়াবিয়ার দক্ষিণ হস্ত স্বরূপ আমর ইবনুল-আস্ ইসলাম জগতে নানাবিধ ইসলাম বিরোধী প্রথার প্রবর্তন করলেও মিসরের গভর্নর থাকাকালীন সময়ে তাঁর সুবিচারের জন্য তিনি মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে সকলেরই শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন। তাঁর অবস্থানকালে একদল লোক খ্রিস্টানদের উপাস্য একটা পাথরের মূর্তির নাসিকা ছেদন করেছিল। তাদের পাদ্রী এ অপরাধের জন্য আমর ইবনুল আস (রা.)-এর কাছে বিচারপ্রার্থী হলে তিনি সাক্ষী আনবার জন্য পাদ্রীকে বলেন। এ ঘটনার কোন সাক্ষী ছিল না, তাই অপারগ পাদ্রী বিরক্ত হয়ে বলেন, “এভাবে আমাদের উপাস্য মূর্তির অবমাননা হলে আমরা কিভাবে ধর্ম পালন করতে সমর্থ হব?”

আমর তার এ তিক্ত মন্তব্য শুনে একখানা থালা ও একখানা ধারালো ছুরি আনবার আদেশ দেন। ধারালো ছুরিখানা পাদ্রীর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলেন, “আমার কর্তৃত্বাধীন রাজ্যে যখন এমন অঘটন ঘটেছে, তখন আপনাদের মূর্তির নাসিকা কর্তনের অপরাধের শাস্তিস্বরূপ আমার নাসিকা কর্তন করে নিন।” বলা বাহুল্য, পাদ্রী ও তার অধীন খ্রিস্টান সমাজ তার এ আদেশ পালন করেনি। তবে তাঁর এ সুবিচার তারা দেখে মুগ্ধ হয়ে যায়।

 

উমাইয়াদের পতনের পর বাগদাদে আব্বাসী খিলাফতের প্রতিষ্ঠার পর আব্বাসী শাসনকর্তাদের আচরণে ইনসাফ ও আদলের প্রতি নিষ্ঠা দেখা যায়। আল-মনসুরের মত শাসনকর্তাও কুফার কাজীর সমন(নথি) পেয়ে আদেশ পালন করতে পরানুখ হননি। পূর্বেই বলা হয়েছে, ইসলামে শাসন বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথক থাকায় ব্যক্তিগত অভিযোগের প্রতিকারকল্পে সবসময়ই সুবিচার হত। তারও পরে মোঘল সুলতানেরা ভারতে শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। বাংলা অঞ্চলের অন্যতম শাসক গিয়াসউদ্দিন আযম শাহের নাম এ অঞ্চলে সুবিদিত, তিনি যে কিভাবে সাধারণ অপরাধীর মত এক নিরপরাধ বিধবার ছেলেকে হত্যা করার অপরাধে কাজীর আদালতে উপস্থিত হয়ে দোষ স্বীকার করেছিলেন, তা আজ এ অঞ্চলের মানুষের ঘরে ঘরে প্রচারিত।

মোঘল সুলতান জাহাঙ্গীর নানা ভুল কাজকর্মে লিপ্ত থাকলেও ইনসাফের ব্যাপারে ছিলেন অত্যন্ত ন্যায়পরায়ণ ও কঠোর। ইতিহাস আজও সাক্ষ্য দিচ্ছে, দিল্লী, আগ্রা, লাহোর অথবা যে কোন স্থানে তিনি উপস্থিত থাকুক না কেন, তার দুর্গের একপাশে একটি ঘণ্টা বাঁধা থাকতো। কোন মজলুম সে ঘণ্টায় ধ্বনি তুললে তিনি স্বয়ং বের হয়ে এসে তার অভিযোগ শুনতেন। একদা সুদূর বাঙাল মুলুক থেকে এক মজলুম পিতা গিয়ে অভিযোগ করে যে তৎকালীন বাঙলার নওয়াব ফয়েজ উল্লাহ নগর পরিক্রমণ কালে তার শিশু পুত্রকে হস্তী পদতলে পিষ্ট করেছেন। শাহানশাহ্ অভিযোগ শোনামাত্রই কাসেদ মারফত ফয়েজ উল্লাহকে তলব করেন। তিনি তলব পাওয়ামাত্রই শাহানশাহের দরবারে উপস্থিত হননি। তারপরে এক সাময়িক কর্মচারীর মারফতে সংবাদ দিলে তিনি দিল্লীতে উপস্থিত হয়ে যমুনার অপর পারে তাঁবু খাটিয়ে রাত্রিতে আমোদ-প্রমোদে লিপ্ত রইলেন। পরদিন প্রভাতে সুলতানের সঙ্গে মোলাকাত করবেন বলে তাঁর মতলব ছিল। তবে সুলতান তাঁকে সে অবসর দেননি। তার আগমন সংবাদ শুনেই মজলুম পিতাকে হাতির উপর তুলে সুলতান এক সামরিক অফিসারকে নওয়াব ফয়েজ উল্লাহর শিবিরের উপর হস্তী চালনা করতে নির্দেশ দিলেন। বলা বাহুল্য, ফয়েজ উল্লাহ যেভাবে ছেলেটিকে হত্যা করেছিলেন সেভাবেই তিনি মৃত্যুবরণ করতে বাধ্য হলেন। এভাবে ইসলামী সভ্যতার ইতিহাস থেকে বিচার ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার ভূরি ভূরি দৃষ্টান্ত দেওয়া যেতে পারে। মুসলমানেরা ইসলামী নীতি থেকে ধীরে ধীরে বহুদূরে সরে যাওয়ায় এক দিকে যেমন ইসলামী জীবন পদ্ধতি তাঁদের জীবনে কার্যকরী থাকেনি, তেমনি আদালত ও ইহসান তাঁদের জীবন থেকে অন্তর্হিত হয়েছে!

১৮০৯ বার পঠিত

শেয়ার করুন

মতামত প্রকাশ করুন

Scroll to Top