প্রথমত আমরা,  চিন্তা ও দর্শন হিসেবে উসূলের উৎপত্তি এবং লিখিত বা শাস্ত্র রূপে উসূলের আত্মপ্রকাশকে পরস্পর থেকে পৃথক হিসেবে বিবেচনা করে থাকি। চিন্তা ও দর্শন হিসেবে উসূলের উৎপত্তি বা আত্মপ্রকাশ হয় কোরআন নাযিল হওয়ার মাধ্যমে। কোরআন নিজে তার উপর ঈমান আনয়নকারীদেরকে উসূলের একটি চিন্তা দিয়ে থাকে। আসবাবে নুযূল, নাসেখ-মানসুখের মতো বিষয়সমূহ, একজন মানুষের উপর কোরআন অবতীর্ণ হওয়া এবং যে নবীর উপর কোরআন অবতীর্ণ হয়েছে, সে নবী কতৃক কোরআনকে তার জীবনে পরিপূর্ণভাবে বাস্তবায়ন উসূলের একটি অনুপম উপমা।

কোরআনে বর্ণিত হয়েছে,

وَلَيْسَ الْبِرُّ بِأَن تَأْتُوا الْبُيُوتَ مِن ظُهُورِهَا وَلَٰكِنَّ الْبِرَّ مَنِ اتَّقَىٰ ۗ وَأْتُوا الْبُيُوتَ مِنْ أَبْوَابِهَا ۚ وَاتَّقُوا اللَّهَ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ

“তাদেরকে আরো বলে দাও: তোমাদের পেছন দিক দিয়ে গৃহে প্রবেশ করার মধ্যে কোন নেকী নেই ৷ আসলে নেকী রয়েছে আল্লাহর অসন্তুষ্টি থেকে বাঁচার মধ্যেই, কাজেই তোমরা দরজা পথেই নিজেদের গৃহে প্রবেশ করো৷ তবে আল্লাহকে ভয় করতে থাকো, হয়তো তোমরা সাফল্য লাভে সক্ষম হবে৷”

أَلَمْ تَرَ كَيْفَ ضَرَبَ اللَّهُ مَثَلًا كَلِمَةً طَيِّبَةً كَشَجَرَةٍ طَيِّبَةٍ أَصْلُهَا ثَابِتٌ وَفَرْعُهَا فِي السَّمَاءِ

“তুমি কি দেখছো না আল্লাহ কালেমা তাইয়েবার উপমা দিয়েছেন কোন জিনিসের সাহায্যে? এর উপমা হচ্ছে যেমন একটি ভালো জাতের গাছ, যার শিকড় মাটির গভীরে প্রোথিত এবং শাখা-প্রশাখা আকাশে পৌঁছে গেছে৷”

এ আয়াতসমূহ এবং এ ধরনের অন্যান্য আয়াতসমূহ একই সাথে উসূলের প্রতি ইশারা করে থাকে।

রাসূলে আকরাম (সঃ) এর জীবদ্দশায় কোরআনের তাফসীর, তা’বীল এবং কোরআনকে তার জীবনে পরিপূর্ণভাবে বাস্তবায়নের নমুনা একটি উসূলের দিকে ইশারা করে থাকে।

 

মুয়াজ ইবনে জাবালের হাদীসের কথা আপনারা সকলেই জানেন।

হাদীসটি হল,

مِنْ أَهْلِ حِمْصَ مِنْ أَصْحَابِ مُعَاذِ بْنِ جَبَلٍ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم لَمَّا أَرَادَ أَنْ يَبْعَثَ مُعَاذًا إِلَى الْيَمَنِ قَالَ ‏”‏ كَيْفَ تَقْضِي إِذَا عَرَضَ لَكَ قَضَاءٌ ‏”‏ ‏.‏ قَالَ أَقْضِي بِكِتَابِ اللَّهِ ‏.‏ قَالَ ‏”‏ فَإِنْ لَمْ تَجِدْ فِي كِتَابِ اللَّهِ ‏”‏ ‏.‏ قَالَ فَبِسُنَّةِ رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم ‏.‏ قَالَ ‏”‏ فَإِنْ لَمْ تَجِدْ فِي سُنَّةِ رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم وَلاَ فِي كِتَابِ اللَّهِ ‏”‏ ‏.‏ قَالَ أَجْتَهِدُ رَأْيِي وَلاَ آلُو ‏.‏ فَضَرَبَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم صَدْرَهُ وَقَالَ ‏”‏ الْحَمْدُ لِلَّهِ الَّذِي وَفَّقَ رَسُولَ رَسُولِ اللَّهِ لِمَا يُرْضِي رَسُولَ اللَّهِ ‏

“রাসূলে আকরাম (সঃ) যখন মুয়াজ ইবনে জাবালকে (রাঃ) ইয়েমেনে গভর্নর করে পাঠানোর ইচ্ছা পোষণ করেন, তখন তিনি মুয়াজ ইবনে জাবাল (রাঃ) কে জিজ্ঞাসা করেন, ‘যদি তোমার কাছে কোন বিষয় আসে, তাহলে সে ব্যাপারে কিভাবে সিদ্ধান্ত দিবে?’

মুয়াজ (রাঃ) জবাবে বলেন, ‘আমি আল্লাহর কিতাব অনুযায়ী সিদ্ধান্ত দিব।’

রাসূলে আকরাম (সঃ) তার জবাব শুনে বলেন, ‘যদি সেখানে না পাও, তাহলে?’

মুয়াজ (রাঃ) জবাবে বলেন, ‘তাহলে রাসূলুল্লাহর সুন্নত অনুসারে।’

রাসূল (সঃ) তাকে পুনরায় জিজ্ঞাসা করলেন, ‘যদি রাসূলের সুন্নতে এবং আল্লাহর কিতাবেও না পাও, তাহলে?’

মুয়াজ (রাঃ) জবাবে বলেন, ‘আমি আমার বুদ্ধি বা রায়কে ব্যবহার করে ইজতিহাদ করব।’

এটা শুনে রাসূলে আকরাম (সঃ) তার (মুয়াজ) বুকে হাত রাখলেন এবং বললেন, ‘সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের যিনি তার রাসূলকে সাহায্য করেছেন এমন মানুষ দ্বারা, যাদেরকে পেয়ে আল্লাহর রাসূল (সঃ) সন্তুষ্ট।’ 

এ হাদীসটিও উসূলের দিকে ইশারা করে থাকে। আমীরুল মু’মিনীন হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) কর্তৃক তার শাসনকালে আবু মুসা আল-আশআরী (রাঃ), আবু উবায়দা (রাঃ) এবং কাজী শুরায়হাকে প্রেরিত চিঠিতে বর্ণিত বা উল্লেখিত বিষয়সমূহকে যদি আমরা ভালোভাবে বিশ্লেষণ করি, তাহলে দেখতে পাই, মহান আল্লাহ তার প্রেরিত গ্রন্থটিকে উসূলের আলোকে আমাদের জীবনে বাস্তবায়ন করার দিকে ইশারা করেছেন। শাস্ত্র রূপে উসূলের উৎপত্তি হয় আরও পরে। শাস্ত্র রূপে উসূলের উৎপত্তি হওয়ার দুইটি কারণ রয়েছে। কারণগুলো হল–

১। বহির্গত কারণ

২। অন্তর্গত কারণ

বহির্গত কারণকে যদি আমরা দেখি, তাহলে দেখতে পাই, মুসলমানগণ ইসলামকে সমগ্র দুনিয়াতে বিজয়ী এক আদর্শ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য বিজয়াভিযান পরিচালনা করে। এ সকল বিজয়াভিযানের ফলে ইরান, ইরাক, শাম, ফিলিস্তিনসহ অনেক অঞ্চল মুসলমানদের হাতে বিজিত হয়। কিন্তু এ সকল অঞ্চল শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে অনেক বেশি শক্তিশালী ছিল। ইসলাম আসার পূর্বে বিগত ২০০০ বছর ধরে এ সকল অঞ্চল জ্ঞান-বিজ্ঞান সৃষ্টি করে যাচ্ছিল। সে সকল অঞ্চলে যাওয়ার পর মুসলমানগণ এমন এমন সমস্যা ও প্রশ্নের সম্মুখীন হয়, যা তারা কোনদিন কল্পনাও করেনি। নব উদ্ভূত এ সকল সমস্যার সমাধানকল্পে মুসলমানদের মধ্য থেকে হাজার হাজার আলেম এগিয়ে আসেন। কিন্তু এ আলেমদের এক একজনের এক এক চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গী ছিল। হিজাজ অঞ্চলে বসবাসকারী আলেমগণ ও পরবর্তীতে ইসলামী শাসনের পতাকাতলে আসা অঞ্চলের আলেমগণ কর্তৃক উদ্ভাবিত জ্ঞানের মধ্যে মতপার্থক্য তৈরি হয়।

ইসলামের আত্মপ্রকাশের পর ১০০ থেকে ১৫০ বছরের মধ্যে অনেক বড় বড় সমস্যা মুসলমানদের সামনে এসে দাঁড়ায়। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল জ্ঞানের ব্যবস্থাপনা (Management of Knowledge)। দ্বীনী জ্ঞানের বিভিন্ন ধারার মধ্যে সমন্বয় করা ছিল তৎকালীন মুসলমান আলেমদের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। ওহীভিত্তিক দ্বীনী জ্ঞান যদি একটি উসূলের মধ্য দিয়ে বুঝা না যায় বা পরিচালনা করা না যায়, তাহলে সেটি মুসলমানদের মধ্যে ঐক্যের পরিবর্তে অনৈক্যের জন্ম দেয়। উসূল অনুসরণ না করার কারণে প্রথমে ইখতিলাফ বা মতপার্থক্যের সৃষ্টি হয়, আর এ মতপার্থক্য থেকেই পরবর্তীতে বিভিন্ন ফিরকা বা দলের উৎপত্তি হয়ে থাকে। এ অবস্থার মধ্যে সমন্বয় করার প্রয়োজন ছিল।

কোরআন নাযিলের শুরু থেকে রাসূলে আকরাম (সঃ) ও চার খলিফার শাসন আমল থেকে মুসলমান আলেমদের মধ্যে উসূলের চিন্তা জাগ্রত হয়েছিল। পরবর্তীতে তারা তাদের এ চিন্তাকে কাজে লাগিয়ে উসূলকে লিখিত রূপ দেন এবং এ উসূলের মাধ্যমে দ্বীনী জ্ঞানের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠা বিভিন্ন ধারার মধ্যে সমন্বয় সাধন করেন।

মূলত নস বা ওহীর বিশেষত্ব বা বৈশিষ্ট্য, মানুষের বিশেষত্ব বা বৈশিষ্ট্য, নসকে বুঝার জন্য আকলের প্রয়োজন; আর এ আকলের বিশেষত্ব এবং বৈশিষ্ট্য ভিন্নতার দাবী করে। নস (আয়াত) একটি নির্দিষ্ট ভাষায় অবতীর্ণ হওয়ার কারণে ঐ ভাষার মুহকামসমূহ রয়েছে, মুতাশাবিহসমূহ রয়েছে, মাজায (রূপক) রয়েছে, হাকিকাত রয়েছে, মুফাসসার রয়েছে, মুবায়্যান রয়েছে, মুশকিল রয়েছে এবং মুবহাম রয়েছে। এ সকল ভিন্নতা ইখতিলাফকে অবশ্যম্ভাবী করে দেয়। একই সাথে মানুষের বিশেষত্ব ও বৈশিষ্ট্য এবং তার বুঝার ক্ষমতা ভিন্নতার দাবী করে। ভিন্ন ভিন্ন মানুষগণ ভিন্ন ভিন্ন পরিবেশে, ভিন্ন ভিন্ন প্রভাবের দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে। ইখতিলাফের এ স্তর বা পর্যায়টি রহমত স্বরূপ। অর্থাৎ, নস থেকে উৎসারিত, মানুষ থেকে উৎসারিত এবং বসবাসকৃত পরিবেশ থেকে উৎসারিত প্রাকৃতিক ইখতিলাফ রহমত স্বরূপ। এক্ষেত্রে কোন সমস্যা নেই।

কিন্তু এ সকল ইখতিলাফের উপর ভিত্তি করে বিভিন্ন দল-উপদলে বিভক্ত হয়ে পড়া এবং দল-উপদলে বিভক্ত হওয়ার পর দ্বন্দ্ব ও সংঘাতে জড়িয়ে পড়া অনেক বড় একটি সমস্যা এবং আমাদের প্রভুর সবচেয়ে বড় ইচ্ছার পরিপন্থী। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের সবচেয়ে বড় ইচ্ছা কী? সবচেয়ে বড় ইচ্ছা হল উম্মাহর ওয়াহদাত বা ঐক্য। ভিন্নতার মধ্যে ঐক্য এবং ঐক্যের মধ্যে ভিন্নতা হতে পারে। কিন্তু ইখতিলাফ যেন তাফরিকা (দলাদলি)-তে রূপান্তরিত না হয়। যে ইখতিলাফ উম্মাহর জন্য রহমত স্বরূপ, সে ইখতিলাফ যেন উম্মাহর যাহমাত (সমস্যা) এর কারণ না হয়ে দাঁড়ায়। এ বিষয়ে আমাদের সাহিত্য অনেক বেশী সমৃদ্ধ।

প্রিয় শিক্ষার্থীরা, তোমাদের কাছ থেকে এ ব্যাপারে আমার চাওয়া হল তোমরা যেন ইখতিলাফের কারণ, ইখতিলাফের আদাব, ইখতিলাফের আখলাক সম্পর্কে লিখিত বইসমূহের দিকে চোখ বুলাও।

এমন অনেক বিষয় আছে, যে সকল বিষয়ে ইখতিলাফ করা ওয়াজিব, আবার এমন অনেক বিষয় আছে, যে সকল বিষয়ে ইখতিলাফ করা জায়েজ নয়। এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল মূল বিষয়সমূহকে ভিত্তি হিসেবে ধরে, এর মধ্যকার ভিন্নতাকে বিবেচনায় নিয়ে, একে কোন প্রকার দ্বন্দ্ব সংঘাতের দিকে না নিয়ে গিয়ে রহমতে পরিণত করা। কিন্তু ইসলামের প্রথম ১৫০ বছরে আলেম-উলামাদের মধ্যে সৃষ্ট ইখতিলাফ আস্তে আস্তে তাকফিরে (অন্যকে কাফির বলে আখ্যায়িত করা) তেলয়িনে (একে অপরকে অভিশাপ দেওয়া) পরিণত হয়।

ইমাম আহমদ বিন হাম্বল এ অবস্থাকে বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন,

ما زلنا نلعن أهل الرأي ويعلنوننا

“আমরা আহলে রা’য়কে অভিশাপ দিতাম, তারাও আমাদেরকে অভিশাপ দিত।”

حتى جاء الشافعي فمزج بيننا

“পরে শাফেয়ী আসেন এবং আমাদের মধ্যে সমন্বয় (ঐক্যবদ্ধতা) সাধন করেন।”

ইমাম শাফেয়ী মূলত উসূলের মাধ্যমে এ উভয় দলের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন।

এখন আমি আপনাদেরকে দুইটি বইয়ের নাম বলব, এ দুইটি বইয়ের একটির লেখক হলেন বাতালিআওসি (البطليوسي)। বাতালিআওসির খুব সুন্দর একটি বই রয়েছে,  এ বই ৮ টি অধ্যায়ে বিভক্ত। বইটি পড়লে ইসলামে ইখতিলাফের কারণ জানার সাথে সাথে ইখতিলাফের আদাব এবং আখলাক সম্পর্কেও খুব ভালোভাবে জানতে পারবেন। বইটির নাম হল,

الإنصاف في التنبيه على المعاني والأسباب التي أوجبت الاختلاف بين المسلمين في آرائهم و مذاهبهم

(সংক্ষেপে “আল ইনসাফ”) [1]

الإنصاف في التنبيه على المعاني والأسباب التي أوجبت الاختلاف بين المسلمين في آرائهم و مذاهبهم

(যে সকল বিষয়সমূহ মুসলমানদেরকে ইখতিলাফ করতে বাধ্য করে, এর কারণসমূহ ও এর অর্থসমূহ এবং এ ব্যাপারে সতর্কবানীসমূহ)

আপনারা জানেন, বাতালিআওসি (البطليوسي) কোথায়? বাতালিআওসি (البطليوسي) ছিল আন্দালুসিয়ার অন্তর্ভুক্ত, এখন তা পর্তুগীজের সীমানাবর্তী একটি শহর। এ ব্যক্তি ৫১০ হিজরীতে জন্ম গ্রহণ করেন।

 

অন্য বইটি আব্দুল জলীল ঈসার লেখা। আব্দুল জলীল ঈসা মিশরের একজন আলেম। তার বইয়ের নাম হল,

ما لا يجوز الخلاف بين المسلمين

(যে সকল বিষয়ে মুসলমানদের মধ্যে ইখতিলাফ করা জায়েজ নয়) [2]

 

সবচেয়ে মজার বিষয় হল ইখতিলাফ সম্পর্কিত অধিকাংশ বইয়ের নাম ‘ইনসাফ’! শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভির বইয়ের নামও الإنصاف في بيان أسباب الاختلاف [3]

 

আসলে এখানে মূল বিষয় হল ইখতিলাফ করলেও ইনসাফের সাথে করা। ইনসাফকে দূরে ঠেলে দিয়ে ইখতিলাফ করলে সে ইখতিলাফ সংঘাত এবং সংঘর্ষের দিকে নিয়ে যায়।

 

আমি আমার ছাত্রজীবনে এ দুইটি বই একসাথে পড়েছিলাম এবং অনেক উপকৃত হয়েছিলাম। আপনাদেরকেও অনুরোধ করব বই দুটি পড়ার জন্য।

 

আগে الإنصاف في التنبيه على المعاني والأسباب التي أوجبت الاختلاف بين المسلمين في آرائهم و مذاهبهم (“যে সকল বিষয়সমূহ মুসলমানদেরকে ইখতিলাফ করতে বাধ্য করে এর কারণসমূহ ও এর অর্থসমূহ এবং এ ব্যাপারে সতর্কবানীসমূহ”) বইটি পড়তে পারেন। এ বইটি পড়লে দেখতে পারবেন কী কী কারণে ইখতিলাফের সৃষ্টি হয়ে থাকে। যেমন: লেখক উক্ত বইয়ে ভাষাগত কারণে, নসের (কোরআন ও হাদীস) কারণে, মানুষের মেজাজের ভিন্নতার কারণে, পরিবেশের কারণে ইখতিলাফের সৃষ্টি হয় বলে উল্লেখ করেছেন।

এর পর ما لا يجوز الخلاف بين المسلمين (যে সকল বিষয়ে মুসলমানদের মধ্যে ইখতিলাফ করা জায়েজ নয়) বইটি পড়তে পারেন।

 

 

ইমাম আশয়ারীর বিখ্যাত বইয়ের নাম কী?

তার বিখ্যাত বইয়ের নাম হল مقالات الإسلاميين واختلاف المصلين ( মুসুল্লিদের ইখতিলাফ)[4]

আমি একটি কথা সব সময় বলে থাকি, এখানেও তার পুনরাবৃত্তি করতে চাই। সেটা হল মুসলমানদের মধ্যকার ইখতিলাফকে যদি আমরা নামাজের মধ্যকার ইখতিলাফের মত করে গ্রহণ করতে পারি, তাহলে আমাদের ইখতিলাফ অনেকাংশেই কমে যাবে।

আমার এ কথা বলার উদ্দেশ্য কী? যেমন আমরা নামাজের তাকবীরে তাহরিমা নিয়ে কোন মতভেদ বা ইখতিলাফ করি না। সকল স্থানে, সকল জায়গায়, সকল মুসলমানগণ নামাজ আদায় করার জন্য দাঁড়ালে ‘আল্লাহু আকবার’ বলে তাকবীরে তাহরিমা পড়ে। তাকবীর পড়ার সময় কেউ কানের লতি পর্যন্ত, আবার কেউবা আবার কাঁধ পর্যন্ত, কেউ কেউ আবার তারও নিচ পর্যন্ত হাত তুলে থাকেন।

তাকবীরে তাহরিমা পড়ার ক্ষেত্রে যেহেতু আমরা কোন ইখতিলাফ করি না, তথাপি হাত কোন পর্যন্ত তুলব বা তুলব না এটা নিয়ে মতভেদ করার মধ্যে খুব বেশি ফায়দা নেই।

কিয়ামের ক্ষেত্রে কি আমাদের মধ্যে কোন ইখতিলাফ আছে? না, কিয়াম নিয়ে আমাদের মধ্যে কোন ইখতিলাফ নেই। কিন্তু কিয়াম অবস্থায় হাত বাঁধা নিয়ে আমাদের মধ্যে ইখতিলাফ আছে। মালেকী মাযহাবের ভাইয়েরা হাত একদম ছেড়ে দিয়ে নামাজ আদায় করেন, হানাফী মাযহাবের ভাইয়েরা নাভীর নিচে বা উপরে হাত বাঁধেন, শাফেয়ী মাযহাবের ভাইয়েরা বুকের উপর কালবের কাছাকাছি হাত বেঁধে থাকেন।

নামাজের আরকানসমূহের ক্ষেত্রে আমাদের কোন ইখতিলাফ নেই, আরকানের ব্যাপারে সকলেই একমত, কিন্তু প্রয়োগের ক্ষেত্রে আমরা ভিন্ন ভিন্ন পন্থা অনুসরণ করে থাকি। একই ভাবে আমরা যদি ইসলামের সকল মৌলিক ব্যাপারে (আসলুল উসূল) এবং আসলুল কুল্লির ব্যাপারে যদি ইখতিলাফ না করে সেগুলোর বাস্তবায়নের ব্যাপারে ভিন্ন ভিন্ন পন্থা বা মতামতকে মেনে নিতে পারতাম, তাহলে আমাদের মধ্যে এত বেশি ইখতিলাফের সৃষ্টি হতো না।

এজন্য আমার কাছে ইমাম আশআরীর এ বইয়ের নাম (مقالات الإسلاميين واختلاف المصلين) অনেক অর্থবহ মনে হয়েছে।

একইভাবে ইমাম শাফেয়ী তার বিখ্যাত গ্রন্থ “আর-রিসালা”য় ‘ইখতিলাফ’ নামে একটি সন্তন্ত্র অধ্যায়ের স্থান দিয়েছেন।

এছাড়াও তার “আল-ইখতিলাফু ফিল হাদীস” নামে আলাদা একটি বই রয়েছে। যদিও বইটি “আর-রিসালা” থেকে সংকলিত। এভাবে ইমাম শাফেয়ীর “আর-রিসালা” যখন পড়বেন, তখন দেখতে পাবেন, ইখতিলাফের মধ্যে সমন্বয় সাধন করার জন্য তিনি এ উসূল শাস্ত্রটি রচনা করেছেন। মুসলমান আলেমগণ কতৃক উদ্ভাবিত ধর্মীয় জ্ঞানের মধ্যে সমন্বয় করার জন্য এবং ইখতিলাফসমূহের মধ্যে সমন্বয় সাধন করার জন্যই উসূল শাস্ত্র জ্ঞানের আলাদা একটি শাখা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।

একইভাবে ইমাম তাবারীর “اختلاف الفقهاء” ( ইখতিলাফুল ফুকাহা) নামে একই বই রয়েছে।

আবু বকর আল-জাসসাসের “ইখতিলাফুল উলামা” নামে একটি বই রয়েছে। জাসসাসের লেখা এ বইটিকে পরবর্তীতে সংক্ষিপ্ত করে সংক্ষিপ্ত সংস্করণে প্রকাশ করেন ইমাম-ত্বাহাবী, “ইখতিসারুল ইখতালাফুল উলামা” নামে।

শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভির الإنصاف في بيان أسباب“ الاختلاف” বইটি খুব ছোট একটি বই। সকলকে অনুরোধ করব বইটি ভালোভাবে পড়ার জন্য। বিশ্বাস করুন, এক বসাতেই পড়ে শেষ করতে পারবেন এবং অনেক কিছু জানতে পারবেন।

আমি আমার পূর্বের কথা পুনঃরাবৃত্তি করে বলতে চাই যে, উসূল শাস্ত্রের উন্মেষের প্রথম অভ্যন্তরীন কারণ হল বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মুসলমানগণ কর্তৃক উদ্ভাবিত জ্ঞানের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে একটি মূলনীতির আওতায় নিয়ে আসা। 

ইমাম মালেকের সাথে আব্বাসী খলিফা জাফর মানসুরের কথোপকথনটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ইসলামী জ্ঞানের উৎপত্তি এবং ইখতিলাফের স্বাভাবিকতার দিক থেকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আপনারা অনেকেই জানেন যে, খলিফা জাফর মানসুর মদিনায় গিয়ে ইমাম মালেকের সাথে সাক্ষাৎ করেন। তার সাথে সাক্ষাৎ করে বলেন যে, “আমাকে একটি বই লিখে দিন। আমি আপনার লেখা বইটিকে সকল শহরে পাঠিয়ে দিব। আর প্রতিটি শহরের বিচারক (কাজী) ও মুফতিকে বলে দিব, তারা যেন এ কিতাবের আলোকে ফতোয়া দেয় ও বিচারকার্য পরিচালনা করে।”

অপর এক বর্ণনায় বলা হয়েছে, “আমাকে একটি বই লিখে দিন। তবে বইটি যেন ইবনে উমরের কাঠিন্যতা থেকে, ইবনে আব্বাসের রুখসাত (সহজতা) থেকে এবং ইবনে মা’সউদের গারাইয়িব (শাজ ফতওয়া, আজব ফতওয়া, ভিন্ন ধারার চিন্তা ও ফতওয়া) থেকে দূরে থাকে।”

কিন্তু ইমাম মালেক তার এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি বলেন, শামে ইমাম আব্দুর রহমান আল আওজায়ী, ইরাকে ইমাম আবু হানিফা থাকা অবস্থায় আমার এ ধরনের কোন কাজ করা ঠিক হবে না।

এ ধরনের কাজের উদাহরণ ইসলামের ইতিহাসেও রয়েছে। আন্দালুসিয়াতে মুওয়াহহিদিদের শাসনামলে এ ধরণের একটি উদ্যোগ নেওয়া হয়। সকল ইখতিলাফ ও মতপার্থক্য দূর করার জন্য সকল মাযহাবকে একটি মাযহাবে রূপান্তরিত করে সকলকে একটি পথ (মতবাদ) অনুরসণ করে ফতোয়া ও বিচারকার্য পরিচালনা করার জন্য বাধ্য করা হয়। কিন্তু পরবর্তীতে মুওয়াহহিদিদের পতনও এ কারণেই হয়।

অনেক সময় অনেকেই মনে করে থাকেন যে, সকলকেই যদি একটি মেথডোলজি মানতে বাধ্য করা যায়, তাহলে ইখতিলাফ ও মতপার্থক্য কমে যাবে। কিন্তু এ পন্থা কক্ষনো কল্যাণ বয়ে আনেনি এবং এটা সঠিক কোন পন্থাও নয়।

উসূল শাস্ত্রের উৎপত্তির প্রথম কারণ হল দ্বীনী জ্ঞানের মধ্যে সমন্বয় সাধন ও এর ব্যবস্থাপনা। দ্বীনী জ্ঞানের উপর ভিত্তি করে বিভিন্ন দলে-উপদলে বিভক্ত হওয়া থেকে মুসলমানদেরকে রক্ষা করা। ইখতিলাফপূর্ণ বিষয়ে সঠিক পন্থা অবলম্বন করা, ইখতিলাফের আদাব ও আখলাকের মূলনীতিকে মুসলমানদের সামনে উপস্থাপন করা।

উসূল শাস্ত্রের উৎপত্তির দ্বিতীয় কারণ হল দ্বীনী নসসমূহ (কোরআন ও হাদীস)-কে সঠিকভাবে বুঝার ক্ষেত্রে সাহায্য করা। জাযিরাতুল আরব ছাড়া অন্য কোন অঞ্চলের ভাষা আরবী ছিল না। বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ বিভিন্ন ভাষায় কথা বলত। যেমন ইরাক, ইরান, আজারবাইজান, আফ্রিকাসহ আরও অনেক অঞ্চলের মানুষ। তারা ইসলামের আলোকে তাদের জীবন সমস্যাসমূহ সমাধান করার জন্য কোরআন ও হাদীস নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। কিন্তু তাদের ভাষা আরবী না হওয়ায় কোরআন ও হাদীস থেকে হুকুম উদ্ভাবন করা তাদের জন্য অনেক কঠিন ছিল। এজন্য ইজতিহাদ ও ইসতিনবাতের মূলনীতিসমূহ নির্ধারণ করা খুব জরুরী হয়ে পড়েছিল। এমনকি আরবগণ যখন আরব দেশসমূহ ছেড়ে এ সকল অঞ্চলে যায়, তখন তাদের আরবীও পরিবর্তন হতে শুরু করে। এক ভাষার মানুষ অন্য ভাষায় কথা বলে এমন স্থানে যাওয়ার ফলে এক ভাষার শব্দ অন্য ভাষার মধ্যে প্রবেশ করতে শুরু করে। আরবী ভাষায় নাযিল হওয়া কোরআনের অনেক শব্দের অর্থ পরিবর্তন হওয়া শুরু হয়, এক অর্থের শব্দ অন্য অর্থে ব্যবহৃত হওয়া শুরু হয়; দেখা গেছে, আরবী ভাষায় অনেক শব্দ রয়েছে যেগুলোর অর্থ অনেক ব্যাপক ও বিস্তীর্ণ, কিন্তু অন্য স্থানে যাওয়ার ফলে আস্তে আস্তে এ সকল শব্দের অর্থের ব্যাপকতা হারিয়ে যেতে শুরু করে। এমনও দেখা গেছে, শেষ পর্যন্ত একটি শব্দ তার সম্পূর্ণ ব্যাপকতা হারিয়ে একান্ত সীমিত হয়ে পড়ে। অনেক শব্দ তার আসল অর্থ হারিয়ে ফেলে এবং অস্পষ্ট অর্থের জন্য নির্দিষ্ট হয়ে পড়ে।

আপনারা যদি তাফসীর ও হাদীস শাস্ত্র হতে উদ্ভাবিত সাহিত্যের দিকে তাকান, তাহলে দেখতে পাবেন যে, غريب القران ও غريب الحديث (গারীবুল কোরআন ও গারীবুল হাদীস)-সমূহ এ কারণে উদ্ভাবিত হয়েছে। غريب القران ও غريب الحديث (গারীবুল কোরআন ও গারীবুল হাদীস) হল কোরআন ও হাদীসে ব্যাবহৃত শব্দসমূহ সমাজে থেকে আস্তে আস্তে ব্যবহৃত না হওয়ার ফলে غريب বা অপরিচিত, অস্পষ্ট অবস্থায় এসে উপনীত হয়েছে। এ বিষয়টিকে বিবেচনায় নিয়ে ইসলামের মহান আলেমগণ غريب القران ও غريب الحديث (গারীবুল কোরআন ও গারীবুল হাদীস) এর অনেক গ্রন্থ রচনা করেন, যেন কোরআন ও হাদীসের মূল অর্থ হারিয়ে না যায়।

এ কারণে দ্বীনী নসসমূহকে কীভাবে বুঝতে হবে তা জানার জন্য একটি পন্থার প্রয়োজন ছিল। উসূল শাস্ত্র এভাবেই জন্ম লাভ করে।

 

উসূলের গ্রন্থসমূহের ‘দালালাত’ অধ্যায়সমূহ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অর্থাৎ, যাহির, মুহকাম, মুফাসসার, মুজমাল, মুবায়্যান, মাজাজ, হাকীকাত, তাশবিহ, ইস্তিয়ারা, তামছিল এ সকল বিষয়কে বুঝার জন্য মূলনীতির অনুসরণ অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। মানুষের কাছে বোধগম্য করে তোলার জন্য উসূল শাস্ত্র এ সকল বিষয় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছে। এজন্য উসূলের উপর লেখা ইমাম শাফেয়ীর “আর-রিসালা” র দিকে যদি তাকান, তাহলে দেখতে পাবেন, كيف البيان  (কাইফাল বায়ান, অর্থাৎ বয়ান কী? কীভাবে বয়ান করতে হবে) নামক একটি শিরোনাম রয়েছে।বয়ান অধ্যায়ে নসকে বুঝার পদ্ধতি নিয়ে অনেক কথা বলা হয়েছে।

 

আমরা যদি পরবর্তী সময়ে লেখা উসূল গ্রন্থসমূহের দিকে তাকাই, তাহলে দেখতে পাই, পরবর্তী উসূল গ্রন্থসমূহের বড় একটি অংশ দখল করে আছে দালালাত (الدلالات)। দালালাত (الدلالات) এর অধ্যায়সমূহ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আরবী ভাষায় যে কোন একটি বাক্যকে যদি তাহকীক ও তাহলিল (সংশ্লেষণ পদ্ধতি, সিনথেসিস) করেন, তাহলে দেখতে পাবেন , ১০ থেকে ১২ টি ভিন্ন অর্থ বের করা সম্ভব। বাতালিআওসি (البطليوسي) তার বইয়ে এবং ইমাম শাতেবী তার “মুওয়াফাকাত” এ এর অনেক উদাহরণ দিয়েছেন। মাযাযী দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে এক অর্থ হয়, হাকীকী দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে এক অর্থ হয়, নিজেই নিজের মধ্যে ভিন্ন অর্থ সৃষ্টি করতে পারে। এভাবে ১০ এর বেশি ভিন্ন ভিন্ন অর্থ হতে পারে।

এ কারণে কোরআন ও হাদীসকে বুঝার জন্য উসূল এবং উসূলের এ দালালাত (الدلالات) অধ্যায়সমূহ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ইমাম শাতেবীর “মুওয়াফাকাত” এর الافهام   الفهم و (আল-ফাহম ওয়াল ইফহাম) নামক একটি অধ্যায় রয়েছে। এ অধ্যায়ে তিনি এ বিষয়ে খুব সুন্দর করে আলোচনা করেছেন। কিছু কিছু বর্ণনা নিজে নিজেই মুবায়্যান বা (স্পষ্ট), কিছু আছে যেগুলো হল মুজমাল, কিতাব সেটাকে বর্ণনা করে, আবার এমন কিছু মুজমাল আছে যেগুলোকে বর্ণনা ও বিশ্লেষণ করে থাকে সুন্নত, আবার কিছু আছে যেগুলোর ব্যাখা কেবলমাত্র সুন্নতের মধ্যে রয়েছে। যার ফলে প্রতিটিরই আলাদা আলাদা ক্যাটাগরি (বিভাগ) রয়েছে এবং প্রতিটিকেই ভিন্ন ভিন্নভাবে বুঝা প্রয়োজন।

উসূল শাস্ত্রের উৎপত্তির তৃতীয় কারণ হল ‘ইজতিহাদের মূলনীতি সমূহ নির্ণয় করা’। উসূল কেবলমাত্র নস থেকে হুকুম বের করার (ইসতিনবাত) জন্য নয়, একই সাথে ইজতিহাদ করার নিয়মকানুনসমূহ নির্ধারণ করার জন্য।

আমি এটা সব সময় বলি যে,

النصوص معدودة والحوادث ممدودة

“নসসমূহ হল সীমাবদ্ধ আর ঘটনা প্রবাহ সীমাহীন।”

এ সীমাহীন ঘটনার উপর সীমাবদ্ধ নস (কোরআন ও সুন্নাহ)-কে প্রয়োগ করার জন্য অনেক জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার প্রয়োজন। যে সকল বিষয়ে নস নেই, সে সকল বিষয়ের ক্ষেত্রে কী করব? ধরুন, নতুন একটি দুনিয়া প্রতিষ্ঠা করেছেন, এ নতুন দুনিয়ায় নতুন নতুন সমস্যা আপনাদের সামনে আসবে, এ সকল সমস্যা কীভাবে সমাধান করবেন? এ সকল সমস্যা সমাধান করার জন্য নতুন একটি ইজতিহাদের প্রয়োজন। অনেকেই আছেন যারা ইজতিহাদ এবং কিয়াসকে সমান মনে করেন। তাদের কথা অনুযায়ী কিয়াসই হল ইজতিহাদ। আবার ইসলামী জ্ঞানের ধারায় এমন অনেক ফকীহ রয়েছেন যারা ‘রায়’ এর মাধ্যমে ইজতিহাদ করেছেন। ইসতিহসান, মাসালিহি মুরসালাহ, সাদ্দে যারিয়াহ এর মত মূলনীতিসমূহকে সামনে রেখে ইজতিহাদ করা হয়েছে, এমন অনেক ইজতিহাদ রয়েছে। تحقيق المناط (তাহকীকূল মাণাত) এবং মাকাসীদও একই রকম। মাকাসীদ পরবর্তীতে আলাদা একটি শাখা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। এ সকল বিষয় উসূলের প্রয়োজনীয়তাকে অবশ্যম্ভাবী করে তোলে। যদি এটা না হতো, তাহলে ইজতিহাদের নামে একটি বিশৃঙ্খল অবস্থা সৃষ্টি হতো। যে কেউ বের হয়ে একটি চিন্তা সামনে আনত এবং বলত এটা আমার ইজতিহাদ। অথচ ইজতিহাদকে মূলনীতিসমূহের সাথে সম্পৃক্ত করা উচিত। প্রাকৃতিক জ্ঞান (Natural Science) এর ক্ষেত্রে সৃষ্টি জগতের সাথে জ্ঞানের যে সম্পর্ক রয়েছে, দ্বীনী জ্ঞানের ক্ষেত্রে জ্ঞান (ইলিম) ও নস এর সম্পর্ক তেমনই।

প্রাকৃতিক জ্ঞান (Natural Science) এর ক্ষেত্রে যেমন মহাবিশ্ব ও দুনিয়াকে বাদ দিয়ে কোন জ্ঞানের ধারা নির্মাণ করা সম্ভব নয়, তেমনি দ্বীনী জ্ঞানের ক্ষেত্রেও নস (কোরআন ও সুন্নাহ)-কে বাদ দিয়ে কোন জ্ঞান (ইলিম) এর ধারাকে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়।

এজন্য বিগত বছরসমূহ ধরে নসের গুরুত্ব নিয়ে যে বিতর্কের সৃষ্টি করা হয়েছে, এটা আমার মতে সঠিক নয়। তাদের এ তর্ক-বিতর্ক বা নসকে প্রশ্নবিদ্ধ করার যে প্রচেষ্টা, তা নসকে ভালোভাবে বুঝার কোন প্রচেষ্টা নয়, নসকে বিশ্লেষণ (analysis) করার প্রচেষ্টা।

 

এক্ষেত্রে ২ টি পদ্ধতি রয়েছে,

একটি হল المنهج التفهيمي বা বুঝার পদ্ধতি।

অপরটি হল المنهج التفكيكي বা বিশ্লেষণে পদ্ধতি।

বিশ্লেষণের পদ্ধতি দিয়ে বুঝা সম্ভব নয়। কারণ এখান থেকে কোন উসূলের উৎপত্তি হয় না।

 

 

এজন্য উসূল শাস্ত্রের উৎপত্তির তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ কারণ হল দ্বীনের ব্যাপারে যে সকল ইজতিহাদ করা হবে, সে সকল ইজতিহাদ যেন প্রবৃত্তির কামনা-বাসনা, ব্যাক্তিগত ইচ্ছা থেকে দূরে থেকে ইলাহী ইচ্ছা (মুরাদ), আসলুল উসূল, মূলনীতি, দলিল ও কায়েদার ভিত্তিতে সংগঠিত হয়।

উসূল শাস্ত্রের উৎপত্তির চতুর্থ কারণ হল মাযহাবসমূহ উৎপত্তি হওয়ার পর নিজের মাযহাবের মতবাদকে অপরের সামনে তুলে ধরে যে, কিসের উপর ভিত্তি করে এভাবে চিন্তা করেছে। এর ডকট্রিন (মূলতত্ত্ব) কী এটা ভালো ভাবে তুলে ধরার জন্য একটি উসূলের প্রয়োজন ছিল। সকলেই তার মাযহাবের যৌক্তিকতাকে তুলে ধরার জন্য উসূলের আশ্রয় নেয়। কারণ প্রতিটি মাযহাবই এক একটি উসূল এবং প্রতিটি উসূলই নিজেকে অপরের কাছে গ্রহণযোগ্যভাবে উপস্থাপন করার জন্য একটি ব্যাখার প্রয়োজন বোধ করে থাকে।

এজন্য উসূল শাস্ত্রের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ একটি বিতর্ক রয়েছে। বিতর্কটি হল, আগে কোনটার উৎপত্তি হয়েছে? উসূল নাকি মাযহাব?

আমরা যদি উসূলের ইতিহাসের ধারাক্রমের দিকে তাকাই, তাহলে দেখতে পাই, মাযহাবসমূহের উৎপত্তি হওয়ার পূর্বে উসূলের চিন্তা জাগরূক ছিল। কিন্তু উসূল শাস্ত্রের আকারে বা সিস্টেমেটিক রূপে আত্মপ্রকাশ করে মাযহাবসমূহ সৃষ্টি হওয়ার পরে। এ কারণে সকলেই তার নিজস্ব মাযহাবকে বুঝার জন্য এবং অন্যকে বুঝার জন্য উসূলের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে।

উসূল শাস্ত্রের উৎপত্তির পঞ্চম কারণ হল শুধুমাত্র নসকে সঠিকভাবে বুঝার জন্য নয়, সামগ্রিকভাবে দ্বীনকে সঠিকভাবে বুঝার জন্য এবং একটি সঠিক দৃষ্টিভঙ্গী অর্জনের জন্য এটির প্রয়োজন ছিল। শুধুমাত্র ফিকহের আইন-কানুন উদ্ভাবনের জন্য নয়, একটি ইলমী মেথড (জ্ঞানের পদ্ধতি) হিসেবে, চিন্তার একটি পদ্ধতি হিসেবে, সৃষ্টি জগত এবং মহাবিশ্বকে সঠিকভাবে বুঝার জন্য একটি পদ্ধতি ও মেথডোলজির প্রয়োজন।

বর্তমান সময়ে আমাদের এমন এক উসূলের প্রয়োজন, যে উসূল আমাদেরকে সঠিকভাবে চিন্তা করতে ও বুঝতে শেখাবে।

এ লক্ষ্যে শুধুমাত্র ফিকহের জন্য নয়, তাফসীরের জন্য, হাদীসের জন্য, ইলমূল কালামের জন্য উসূলের প্রয়োজন। এছাড়াও উসূলূদ্দীন এবং উসূলে ফিকহের মধ্যকার সম্পর্ককে খুব ভালোভাবে প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন। উসূলুদ্দীনে যে اصل (মূল বিষয়)-সমূহ রয়েছে, সেগুলোকে সঠিকভাবে নিরূপণ বা নির্ধারণ করা ছাড়া উসূলে ফিকহের اصل (মূল বিষয়)-সমূহকে তার উপর ভিত্তি করে গড়ে তোলা সম্ভবপর নয়। উসূলের শাস্ত্রের আলাদা একটি জ্ঞানের শাখা হিসেবে উৎপত্তি হওয়ার সবচেয়ে বড় ও বিস্তৃত কারণ হল এ পঞ্চম কারণ।

বর্তমান সময়ে আমাদের উসূলে তাফসীর, উসূলে ফিকহ, উসূলে হাদীসকে খুব ভালোভাবে জানা প্রয়োজন। কিন্তু একই সাথে এ সকল উসূলকে প্রভাবিতকারী বড় উসূলকে নিয়ে আমাদের চিন্তা করা প্রয়োজন।

ইবনে রুশদের খুব সুন্দর একটি সংজ্ঞা রয়েছে, তিনি বলেন,

هو أحد العلوم التي غايتها إنتاج قوانينَ تسدد الفكر والنظر وتعصمه من الزلل ان علم الاصول

“ইলমূল উসূল হল সঠিকভাবে চিন্তা করার নিয়ম-পদ্ধতিসমূহকে শিক্ষাদানকারী জ্ঞানসমূহের মধ্য একটি এবং এ জ্ঞান মানুষকে ভুল-ভ্রান্তি থেকে রক্ষা করে।”

وظيفته وظيفة البيكار/( البركار) والمسطرة في ضلط المعارف الحسية والهندسية

“একজন ইঞ্জিনিয়ার বা স্থাপত্যবিদের জন্য স্কেল যেমন গুরুত্বপূর্ণ, যারা ইসলামী জ্ঞান চর্চা করেন, তাদের জন্য উসূলও তেমন গুরুত্বপূর্ণ।”

অন্য এক স্থানে তিনি বলেন,

জ্ঞান তিন ধরনের। যথা:

১। حصول الاعتقاد غايتها অর্থাৎ ইতিকাদ বিষয়ক জ্ঞান অর্জন। যেমন: উসূলুদ্দীন, ইলমূল কালাম, আকাঈদ ইত্যাদি।

২। আমল বিষয়ক জ্ঞান, যে জ্ঞান আমলের সাথে সম্পৃক্ত। যেমন: ইলমূল ফিকহ।

৩। যে জ্ঞান মানুষের মস্তিষ্ককে সঠিক চিন্তার দিকে ধাবিত করে বা নিয়ে যায়। যেমনঃ মানতিক। 

ইমাম ফখরুদ্দীন রাযী বলেন,

“আকলী ইলিমের ক্ষেত্রে মানতিকের গুরুত্ব যতটুকু, শারয়ী ইলিমের ক্ষেত্রে উসূলের গুরুত্বও ততটুকু। অপরদিকে মানতিক হল উসূলের একটি অংশবিশেষ। উসূলবিহীন মানতিক অকল্পনীয়।”

[1]  পিডিএফ লিঙ্কঃ http://www.islamicbook.ws/asol/alinsaf-llbtliwsi.pdf

[3] বাংলা ভাষায় এর অনুবাদ হলঃ মতবিরোধ পূর্ণ বিষয়ে সঠিক পন্থা অবলম্বনের উপায়।

[4] পিডিএফ লিঙ্কঃ https://docs.google.com/viewerng/viewer?url=http://books-library.online/elebda3.net-wq-5345.pdf&hl=ar

 

 

অনুবাদঃ বুরহান উদ্দিন আজাদ

১৫২০ বার পঠিত

শেয়ার করুন

Picture of প্রফেসর ড. মেহমেদ গরমেজ

প্রফেসর ড. মেহমেদ গরমেজ

প্রফেসর ড. মেহমেদ গরমেজ তুরস্কের একজন প্রথিতযশা আলেম। জীবন্ত কিংবদন্তি এ আলেমে দ্বীন ইসলামের মৌলিক বিষয়সমূহকে মানুষের সামনে তুলে ধরার ক্ষেত্রে নিরলসভাবে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
১৯৬২ সালে তুরস্কের গাজিআনতেপ শহরের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ছিলেন একজন প্রখ্যাত আলেম। তিনি তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা পিতার কাছেই সম্পন্ন করেন। প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করার পর উসমানী ধারার প্রখ্যাত আলেম, 'মেহমেদ আমীন আর' এর নিকট শিক্ষা লাভ করেন। ড. গরমেজ পূর্ব আনাতোলিয়ান অঞ্চলে অবস্থিত উসমানী খিলাফতের সময়কালে প্রতিষ্ঠিত মাদরাসা থেকে শিক্ষা লাভের সময় প্রখ্যাত আলেমে দ্বীন উস্তাদ 'মেহমেদ আমীন আর' এর তত্ত্বাবধানে ছিলেন। সেসময় তিনি একইসাথে গাজিআনতেপ মাদরাসায়ও পড়াশোনা করেন এবং সেখান থেকে কৃতিত্বের সাথে উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা শেষে আঙ্কারা বিশ্ববিদ্যালয়ে থিওলজি বিভাগে ভর্তি হন। আঙ্কারা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত অবস্থায় তিনি মসজিদে ইমামতি ও মাদরাসায় শিক্ষকতা করতেন। আঙ্কারা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স ডিগ্রী লাভ করার পর হাদীস বিভাগে মাস্টার্সে ভর্তি হন এবং খাতীব আল বাগদাদীর বিখ্যাত গ্রন্থ شرف أصحاب الحديث-এর মুহাক্কিক প্রখ্যাত হাদীস শাস্ত্রবিদ প্রফেসর ড. সাঈদ হাতীবওলুর অধীনে মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। তাঁর মাস্টার্সের থিসিস ছিল, 'মুসা জারুল্লাহ বিগিয়েফের চিন্তা ও দর্শন'।
মাস্টার্স করার সময়ে তিনি মিশরে গমন করেন এবং কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণা করেন। কায়রোতে অবস্থান কালে মিশরের স্বনামধন্য ফকীহ মুহাম্মদ সেলিম আল-আরওয়াহ এবং প্রখ্যাত মুহাদ্দিস রিফাত ফাওজীর কাছ থেকে শিক্ষা লাভ করেন। এক বছর কায়রোতে অবস্থান করার পর পুনরায় তুরস্কে ফিরে আসেন এবং পুনরায় আঙ্কারা বিশ্ববিদ্যালয়ে ডক্টরেট (PhD) শুরু করেন। ১৯৯৪ সালে কৃতিত্বের সাথে তিনি তাঁর PhD শেষ করেন। তার PhD-এর থিসিস ছিলো "সুন্নত ও হাদীস বুঝা এবং ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে পদ্ধতিগত সমস্যা।" PhD চলাকালীন সময়ে তিনি এক বছর লন্ডনে অবস্থান করেন এবং সেখানে 'স্কুল অফ অরিয়েন্টাল এন্ড আফ্রিকান স্টাডিজ' এ গবেষক হিসেবে কাজ করেন। তাঁর এ থিসিস ১৯৯৬ সালে তুরস্কের ইসলামিক ফাউন্ডেশন এর গবেষণা বিভাগে প্রথম স্থান অর্জন করে এবং সে বছর এ গবেষণার জন্য তুর্কী সরকার তাকে গবেষণা পুরস্কার প্রদান করে। তার এ থিসিসটি আরবী ও ইংরেজি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। এ থিসিসের কারণে তিনি তাঁর একাডেমিক জীবনের অধিকাংশ সময় 'উসূলে ফিকহ' অধ্যয়নে ব্যয় করেন এবং এ সময়ে তিনি একজন উসূলবিদ হয়ে উঠেন।
এযাবৎকাল পর্যন্ত তিনি পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের বড় বড় মুহাদ্দিস, উসূলবিদ, আলেমগণের সান্নিধ্য লাভ করেছেন ও বিভিন্ন গবেষণায় তাদের থেকে বহু জ্ঞান অর্জন করেন। এছাড়াও উসমানী ধারার বড় বড় দার্শনিকদের সান্নিধ্যে দীর্ঘসময় পড়াশোনা করেন।তিনি আহমেদ ইয়েসেভি বিশ্ববিদ্যালয়, হাজেত্তেপে বিশ্ববিদ্যালয় এবং আঙ্কারা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অনেক বিশ্ববিদ্যালয়, ইন্সটিটিউট ও গবেষণা কেন্দ্রে শিক্ষকতা করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করার পাশাপাশি তিনি অন্যান্য ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। যেমন-ইসলাম শিক্ষা গবেষণা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন এবং তুরস্কের ইসলামী আন্দোলনের মহান নেতা প্রফেসর ড. নাজমুদ্দিন এরবাকান-এর সাথে দীর্ঘদিন কাজ করেন।
২০০৩ সালে তিনি Presidency of the Republic of Turkey Presidency of Religious Affairs এর ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে যোগদান করেন। এ দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি শিক্ষকতাও জারি রাখেন এবং ২০০৬ সালে প্রফেসর হন। দীর্ঘ ৭ বছর এ Religious Affairs এর ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন কালে সমগ্র মুসলিম উম্মাহর সাথে যোগাযোগ স্থাপন করেন এবং মুসলিম উম্মাহকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ২০১০ সালে তিনি Religious Affairs- এর প্রেসিডেন্ট মনোনীত হন এবং ২০১৭ সাল পর্যন্ত এ দায়িত্ব পালন করেন। এ গুরু দায়িত্ব পালন কালেও তিনি তাঁর গবেষণা চালিয়ে যান এবং এক মুহূর্তের জন্যও জ্ঞান গবেষণায় বিরতি দেননি। এ সময়ে তিনি মুসলিম উম্মাহর গুরুত্বপূর্ণ আলেমদের সাথে সু-সম্পর্ক গড়ে তোলেন এবং তাদেরকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য কার্যকরী ভূমিকা পালন করেন। গাজা, আরাকান, সোমালিয়া, সুদান, মধ্য এশিয়া এবং বলকান অঞ্চলের মুসলমানদের সমস্যা সমাধান করার জন্য অনেক পরিকল্পনা গ্রহণ করেন এবং তা বাস্তবায়নের জন্য প্রচেষ্টা চালান। Religious Affairs-এর প্রেসিডেন্ট থাকা অবস্থায় অবরুদ্ধ গাজা সফর করেন এবং হামাস নেতা ইসমাইল হানিয়ার সাথে সাক্ষাৎ করে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষে সংহতি ঘোষণা করেন। গাজাতে অবস্থানকালে তিনি অবরুদ্ধ গাজাবাসীর খোঁজ-খবর নেন। এরপর তিনি বাইতুল মুকাদ্দাসে যান এবং ঐতিহাসিক এক খুতবা প্রদান করেন।
২০১৭ সালে Religious Affairs-এর দায়িত্ব থেকে অবসর গ্রহণ করেন এবং দুটি প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন। একটি হলো International Islamic Though: Foundation অপরটি হলো Institute of Islamic Thought. বর্তমানে তিনি এ প্রতিষ্ঠান দুটির প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
Picture of প্রফেসর ড. মেহমেদ গরমেজ

প্রফেসর ড. মেহমেদ গরমেজ

প্রফেসর ড. মেহমেদ গরমেজ তুরস্কের একজন প্রথিতযশা আলেম। জীবন্ত কিংবদন্তি এ আলেমে দ্বীন ইসলামের মৌলিক বিষয়সমূহকে মানুষের সামনে তুলে ধরার ক্ষেত্রে নিরলসভাবে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
১৯৬২ সালে তুরস্কের গাজিআনতেপ শহরের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ছিলেন একজন প্রখ্যাত আলেম। তিনি তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা পিতার কাছেই সম্পন্ন করেন। প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করার পর উসমানী ধারার প্রখ্যাত আলেম, 'মেহমেদ আমীন আর' এর নিকট শিক্ষা লাভ করেন। ড. গরমেজ পূর্ব আনাতোলিয়ান অঞ্চলে অবস্থিত উসমানী খিলাফতের সময়কালে প্রতিষ্ঠিত মাদরাসা থেকে শিক্ষা লাভের সময় প্রখ্যাত আলেমে দ্বীন উস্তাদ 'মেহমেদ আমীন আর' এর তত্ত্বাবধানে ছিলেন। সেসময় তিনি একইসাথে গাজিআনতেপ মাদরাসায়ও পড়াশোনা করেন এবং সেখান থেকে কৃতিত্বের সাথে উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা শেষে আঙ্কারা বিশ্ববিদ্যালয়ে থিওলজি বিভাগে ভর্তি হন। আঙ্কারা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত অবস্থায় তিনি মসজিদে ইমামতি ও মাদরাসায় শিক্ষকতা করতেন। আঙ্কারা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স ডিগ্রী লাভ করার পর হাদীস বিভাগে মাস্টার্সে ভর্তি হন এবং খাতীব আল বাগদাদীর বিখ্যাত গ্রন্থ شرف أصحاب الحديث-এর মুহাক্কিক প্রখ্যাত হাদীস শাস্ত্রবিদ প্রফেসর ড. সাঈদ হাতীবওলুর অধীনে মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। তাঁর মাস্টার্সের থিসিস ছিল, 'মুসা জারুল্লাহ বিগিয়েফের চিন্তা ও দর্শন'।
মাস্টার্স করার সময়ে তিনি মিশরে গমন করেন এবং কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণা করেন। কায়রোতে অবস্থান কালে মিশরের স্বনামধন্য ফকীহ মুহাম্মদ সেলিম আল-আরওয়াহ এবং প্রখ্যাত মুহাদ্দিস রিফাত ফাওজীর কাছ থেকে শিক্ষা লাভ করেন। এক বছর কায়রোতে অবস্থান করার পর পুনরায় তুরস্কে ফিরে আসেন এবং পুনরায় আঙ্কারা বিশ্ববিদ্যালয়ে ডক্টরেট (PhD) শুরু করেন। ১৯৯৪ সালে কৃতিত্বের সাথে তিনি তাঁর PhD শেষ করেন। তার PhD-এর থিসিস ছিলো "সুন্নত ও হাদীস বুঝা এবং ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে পদ্ধতিগত সমস্যা।" PhD চলাকালীন সময়ে তিনি এক বছর লন্ডনে অবস্থান করেন এবং সেখানে 'স্কুল অফ অরিয়েন্টাল এন্ড আফ্রিকান স্টাডিজ' এ গবেষক হিসেবে কাজ করেন। তাঁর এ থিসিস ১৯৯৬ সালে তুরস্কের ইসলামিক ফাউন্ডেশন এর গবেষণা বিভাগে প্রথম স্থান অর্জন করে এবং সে বছর এ গবেষণার জন্য তুর্কী সরকার তাকে গবেষণা পুরস্কার প্রদান করে। তার এ থিসিসটি আরবী ও ইংরেজি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। এ থিসিসের কারণে তিনি তাঁর একাডেমিক জীবনের অধিকাংশ সময় 'উসূলে ফিকহ' অধ্যয়নে ব্যয় করেন এবং এ সময়ে তিনি একজন উসূলবিদ হয়ে উঠেন।
এযাবৎকাল পর্যন্ত তিনি পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের বড় বড় মুহাদ্দিস, উসূলবিদ, আলেমগণের সান্নিধ্য লাভ করেছেন ও বিভিন্ন গবেষণায় তাদের থেকে বহু জ্ঞান অর্জন করেন। এছাড়াও উসমানী ধারার বড় বড় দার্শনিকদের সান্নিধ্যে দীর্ঘসময় পড়াশোনা করেন।তিনি আহমেদ ইয়েসেভি বিশ্ববিদ্যালয়, হাজেত্তেপে বিশ্ববিদ্যালয় এবং আঙ্কারা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অনেক বিশ্ববিদ্যালয়, ইন্সটিটিউট ও গবেষণা কেন্দ্রে শিক্ষকতা করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করার পাশাপাশি তিনি অন্যান্য ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। যেমন-ইসলাম শিক্ষা গবেষণা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন এবং তুরস্কের ইসলামী আন্দোলনের মহান নেতা প্রফেসর ড. নাজমুদ্দিন এরবাকান-এর সাথে দীর্ঘদিন কাজ করেন।
২০০৩ সালে তিনি Presidency of the Republic of Turkey Presidency of Religious Affairs এর ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে যোগদান করেন। এ দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি শিক্ষকতাও জারি রাখেন এবং ২০০৬ সালে প্রফেসর হন। দীর্ঘ ৭ বছর এ Religious Affairs এর ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন কালে সমগ্র মুসলিম উম্মাহর সাথে যোগাযোগ স্থাপন করেন এবং মুসলিম উম্মাহকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ২০১০ সালে তিনি Religious Affairs- এর প্রেসিডেন্ট মনোনীত হন এবং ২০১৭ সাল পর্যন্ত এ দায়িত্ব পালন করেন। এ গুরু দায়িত্ব পালন কালেও তিনি তাঁর গবেষণা চালিয়ে যান এবং এক মুহূর্তের জন্যও জ্ঞান গবেষণায় বিরতি দেননি। এ সময়ে তিনি মুসলিম উম্মাহর গুরুত্বপূর্ণ আলেমদের সাথে সু-সম্পর্ক গড়ে তোলেন এবং তাদেরকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য কার্যকরী ভূমিকা পালন করেন। গাজা, আরাকান, সোমালিয়া, সুদান, মধ্য এশিয়া এবং বলকান অঞ্চলের মুসলমানদের সমস্যা সমাধান করার জন্য অনেক পরিকল্পনা গ্রহণ করেন এবং তা বাস্তবায়নের জন্য প্রচেষ্টা চালান। Religious Affairs-এর প্রেসিডেন্ট থাকা অবস্থায় অবরুদ্ধ গাজা সফর করেন এবং হামাস নেতা ইসমাইল হানিয়ার সাথে সাক্ষাৎ করে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষে সংহতি ঘোষণা করেন। গাজাতে অবস্থানকালে তিনি অবরুদ্ধ গাজাবাসীর খোঁজ-খবর নেন। এরপর তিনি বাইতুল মুকাদ্দাসে যান এবং ঐতিহাসিক এক খুতবা প্রদান করেন।
২০১৭ সালে Religious Affairs-এর দায়িত্ব থেকে অবসর গ্রহণ করেন এবং দুটি প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন। একটি হলো International Islamic Though: Foundation অপরটি হলো Institute of Islamic Thought. বর্তমানে তিনি এ প্রতিষ্ঠান দুটির প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

মতামত প্রকাশ করুন

Scroll to Top