বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম
হাল যমানায় মুসলিমদের উপরে দমন পীড়ন অত্যাচারের মাত্রাটা বিশ্বজনীন পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। এরকম প্রহসনের ধারা মুসলিম উম্মাহর উপরে এই প্রথম নয়!
এই ধারাতো ইসলামের একেবারে শুরু থেকেই, যার ফলাফলই তো ছিল ইতিহাসের গতিপথ পালটে দেয়া সায়্যিদুল মুরসালীন ও তাঁর সাহাবীগণের হিজরত। এর পরের ইতিহাসতো শুধু ইসলামের বিজয়ের ইসলামের মহিমান্বিত সম্প্রসারণের….
আজকের পরিণতির এই নিষ্ঠুর ধারার সূচনাটা হয়েছিল আলমে ইসলামীর একেবারে পশ্চিম থেকে, ফেরদাউসে মাকফুদ আন্দালুস থেকে। স্পেনের যমীন থেকে সম্পূর্ণ ইসলামকে নির্মূল করতে সফল হলো ইউরোপীয়ানরা। এর পরের কয়েক শতাব্দী মোটামুটি এই মুসিবত থেকে উম্মাহ মুক্ত ছিল।
উপনিবেশিক শাসনের শেষ পর্যায়গুলোতে হতে থাকল ক্ষমতার পালাবদল। ইউরোপীয়ানরা মুসলিম ভূখন্ডগুলো শোষণ করে সাফ করে দিল, উপর্যুপরি লুণ্ঠনের পরে ক্ষমতার মসনদের নাগাল দিয়ে গেল মুসলিম বিরোধী শক্তিগুলোকে। আফ্রিকায় খ্রিষ্টানদের হাতে, হিন্দুস্তানে হিন্দুদের হাতে, আর পূর্ব এশিয়া ( মালয়, ইন্দোচীন) অঞ্চলে উঠে আসল চীনা সংস্কৃতিঘেঁষা বৌদ্ধ আর খ্রিষ্টানরা। এই ধারারই আরেকটি মুখ ছিল কম্যুনিস্টদের দখলে, চীন এবং রাশিয়া-মধ্য এশিয়াকে ভাগ করে নিল; তুর্কিস্তান রাখল চীন আর পামিরের অপর প্রান্তের মধ্য এশিয়ার তুর্কি ভূখন্ডগুলো এবং সেই সাথে ককেশাশ অঞ্চল (কাস্পিয়ানের উভয় প্রান্ত)। সর্বশেষ ধাক্কা হিসেবে এলো উসমানীয়দের পতন, শুধুমাত্র আনাতোলিয়া তুর্কিদের হাতে ছেড়ে দিয়ে বলকান ছিনিয়ে নেয়া হলো। ইরাক ও বিলাদে শামকে যুক্তরাজ্য আর ফ্রান্স ভাগ করে নিল, সেই সাথে বন্টিত হলো উত্তর আফ্রিকাও। এদের সাথে সেখানে ইতালিও উপস্থিত। খুব দ্রুতই এরা প্রতিষ্ঠা করে ফেলল ফিলিস্তিনের মাটিতে বর্তমান বিশ্বের ক্যান্সার, পাশ্চাত্যের জারজ সন্তান ইজরাইল। যাইহোক, সে ইতিহাসের গলিতে হাঁটতে গেলে সফর শেষ হবেনা হয়ত।
আলমে ইসলামীর যেখানেই এরা পরিবর্তন সাধন করেছে সেখানেই ইসলামের বিপরীত কোন বয়ান বা মতবাদ নিয়ে হাজির হয়েছে। যেমনঃ গণতন্ত্র, কম্যুনিজম, সোশ্যালিজম, ক্যাপিটালিজম, ফ্যাসিজম, ন্যাশনালিজম, অধুনা জায়োনিজম, হিন্দুইজম, বুদ্ধইজম আরো কত কি! মাওলানা মওদূদী এসকল ‘ইজম’ কে একই মায়ের সন্তান বলে আখ্যায়িত করেছেন। এসকল মতবাদের বাস্তবায়নের জন্য তারা যথাসাধ্য সকল কার্যক্রমই সম্পাদন করেছে। মুসলিমদের সকল স্বাধীনতা হরণ করে নিজেদের অসামঞ্জস্যপূর্ণ সিস্টেম চাপিয়ে দেয়ার সর্বাত্নক চেষ্টা চালিয়েছে; কিছুটা আঞ্চলিকভাবে আর কিছুটা বিশ্বজনীনভাবে। কখনো প্রত্যক্ষভাবে কখনো পরোক্ষভাবে। মস্তিষ্ক দখলের এ চক্রান্ত এখন পর্যন্ত বিন্দুমাত্র গতিহ্রাস করেনি বরং উত্তরোত্তর বেড়েই চলছে।
আঞ্চলিকভাবে এন্টি মুসলিম অপারেশনে তাদের কিছু কমন বয়ান আছে, যেগুলোকে তারা বিভিন্ন আঙ্গিকে হাজির করে থাকে। অধিকাংশ সময় তারা সবচেয়ে সফল এন্টি মুসলিম অপারেশনের গতিধারাই অবলম্বন করে। আন্দালুসে যেমন মুসলিম বিতাড়ন সম্পন্ন হয়েছিল, এরাও চায় ঠিক একই পদাঙ্ক অনুসরণ করে একই লক্ষ্য অর্জন করতে।
তাদের মূল লক্ষ্য হলো ইসলামের অপসারণ। যেখানে শুধুই মুসলিমগণ বিদ্যমান সেখানে আভ্যন্তরীণভাবে ইসলামের সাবস্টিটিউট দাঁড় করানো হয়, যেমন আরব দেশ সমূহে, তুর্কিতে, উপমহাদেশের মুসলিম দেশ দুটি, মালয় অঞ্চল। এখানে সেক্যুলারিজম আর পুঁজিবাদের সমন্বয়ে জাতীয়তাবাদ (আরব, তুর্কি, বাঙালী,মালয়) দাঁড়িয়ে গেল। যেগুলো ভিতর থেকে ইসলামের প্রাণসত্ত্বাকে, ইসলামের বিশ্বজনীনতাকে দূর্বার গতিতে ভেঙ্গে চুরমার করে দিতে লাগল। মধ্য এশিয়ায় কম্যুনিজম এসে তো আল্লাহর প্রতি মুসলিমদের বিশ্বাসটাই কেড়ে নিতে সোচ্চার। যেখানে ইমান নিয়েই টানাটানি সেখানে ইসলামের অস্তিত্বের ভয়াবহতা নিয়ে প্রশ্নের কোন অবকাশ থাকেনা।
যেখানে মুসলিমের সাথে অন্য কোন জাতির উপস্থিতি আছে বা উপনিবেশকরা মুসলিমদের অপজিটে যে শক্তিকে উত্থিত করে গেছে (হিন্দুস্তানে হিন্দু ব্রাহ্মণ্যবাদ, তুর্কিস্তানে চীনা জাতীয়তাবাদ, বলকানে ইউরোপীয়ান ইউনিয়ন (ক্রুসেডীয় ধারার ঝান্ডাবাহক), ফিলিস্তিনে ইজরাইল (জায়নবাদের হেডকোয়ার্টার), আফ্রিকায় বর্ণবাদ, রাশিয়া নিয়ন্ত্রিত ইউক্রেনের ক্রিমিয়ায় ও ককেশাশের চেচনিয়ায় রুশ জাতীয়তাবাদ। ফিলিপিনের মিন্দানাও, থাইল্যান্ডের পাত্তানি, মায়ানমারের আরাকান- এসকল অঞ্চলে চায়না সংস্কৃতি প্রভাবিত বৌদ্ধ খ্রিষ্টান জাতি সমূহ) তারা জাতীয়তাবাদের বয়ান তুলে সেখানে মুসলিমদের উপর গণহত্যা চালাচ্ছে, অভিবাসিত করছে, নাগরিকত্ব কেড়ে নিয়ে বন্দী করছে। এর সবচেয়ে বড় বড় উদাহরণ আমাদের সামনে এই মুহুর্তে চলমান।
এদের সকলেরই এসকল গণহত্যা ও আগ্রাসনের পেছনে যুক্তি একটাই; ”মুসলিমরা এই মাটির মানুষ নয়, এদেরকে এদের নিজের মাটিতে ফেরত যেতে হবে, অন্যথায় মৃত্যুবরণ করতে হবে। এই ভুখন্ডে এদের জীবিত থাকার কোন অধিকার নাই। কেননা এরা বহিরাগত।” তাদের চূড়ান্ত টার্গেট থাকে- হয় মুসলিমকে ইসলাম ছাড়তে হবে, আর নাহয় ইসলাম নিয়ে এলাকা ছাড়তে হবে। ঠিক ৫০০ বছর আগেকার ইসলাম নির্মূলের স্পেনীয় ধারা। বলছিলাম সম্প্রতিকালে সেই ধারারই একজোটে বিশ্বজনীন হয়ে যাওয়া প্রসঙ্গে….
শেষোক্ত এই মোটিভের পেছনে ইসলাম বিরোধীদের যে ভিত্তি রয়েছে তাকে আমরা ‘কৌলিন্যবাদ’ বলতে পারি, যাকে শ্রেষ্ঠত্ববাদ, সম্ভ্রান্তবাদ বা হামবড়াভাবও বলা যেতে পারে।
এই কৌলিন্যের শিকড় প্রথিত থাকে গোত্রে, বর্ণে, জাতিতে, ভূমিতে, ইতিহাসে, ঐতিহ্যে, ভাষায়, বিশেষ কোন সিফাতে (গুণ,ক্ষমতা)। ঠিক একারণেই বিভিন্ন জাতির জাতীয় বীর থাকে। জাতীয় ঐতিহাসিক বয়ান থাকে। কখনো বা ধর্মের নাম মিশিয়ে ক্রুসেডের মত বয়ান তৈরী করা হয়। এগুলো তাদের চিন্তা-চেতনা, মিশন- ভিশন, মত ও পথের পাথেয় হয়ে থাকে। এর মাধ্যমে ওই সকল জাতিগোষ্ঠী নিজেদের শিকড় বা ভিত্তির নাগাল পেয়ে থাকে। এই কৌলিন্যবাদ তাদের আশা আকাঙখা, ভাবনা ভরসা, আবেগ অনুভূতির সিংহভাগ জুড়ে থাকে। এটা তাদের এমন এক স্বপ্ন দেখিয়ে থাকে যার মাধ্যমে তারা বিশেষ কোন লক্ষ্য অর্জনে নিজেদের সর্বস্ব বিলীন করা সহ যেকোন পদক্ষেপ গ্রহণের সাহস করতে পারে। এসকল ভিশন তাদের জীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্যে পরিণত হয় এবং সেই লক্ষ্যপানে সমগ্র জাতিসত্ত্বা ধাবিত হতে থাকে। এমন এক পর্যায় আসে যখন তারা তা বাস্তবায়নের জন্য যে কোন কিছু করতে প্রস্তত থাকে। একে আমিরা জাতীয় ভিশন বলতে পারি। যেমন হিন্দুত্ববাদীদের রামরাজ্য, জায়নবাদীদের প্রমিজড ল্যান্ড( প্রতিশ্রুত ভূমি) প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যমাত্রা ইত্যাদি, এরকম উদাহরণের তালিকা আরো বিশাল।
ইনসানী ইতিহাসের সূচনাটা হয়েছিল ঠিক এই কৌলিন্যের কারণেই। সূরা সোয়াদে আল্লাহ এই সূচনার ঘটনাটা এভাবে বর্ননা করেছেন যেঃ
إِذْ قَالَ رَبُّكَ لِلْمَلٰٓئِكَةِ إِنِّى خٰلِقٌۢ بَشَرًا مِّن طِينٍ
যখন তোমার রব ফেরশ্তাদেরকে বললো, “আমি মাটি দিয়ে একটি মানুষ তৈরি করবো। (৩৮:সোয়াদ:৭২)
فَإِذَا سَوَّيْتُهُۥ وَنَفَخْتُ فِيهِ مِن رُّوحِى فَقَعُوا لَهُۥ سٰجِدِينَ
তারপর যখন অমি তাকে পুরোপুরি তৈরি করে ফেলবো এবং তার মধ্যে নিজের প্রাণ ফুঁকে দেবো। তখন তোমরা তার সামনে সিজদাবনত হয়ে যেয়ো।” (৩৮:সোয়াদ:৭৩)
فَسَجَدَ الْمَلٰٓئِكَةُ كُلُّهُمْ أَجْمَعُونَ
এ হুকুম অনুযায়ী ফেরেশ্তারা সবাই সিজদাবনত হয়ে গেলো, (৩৮:সোয়াদ:৭৪)
إِلَّآ إِبْلِيسَ اسْتَكْبَرَ وَكَانَ مِنَ الْكٰفِرِينَ
কিন্তু ইবলিস নিজে শ্রেষ্ঠত্বের অহংকার করলো এবং সে কাফেরদের অন্তর্ভূক্ত হয়ে গেলো। (৩৮:সোয়াদ:৭৫)
قَالَ يٰٓإِبْلِيسُ مَا مَنَعَكَ أَن تَسْجُدَ لِمَا خَلَقْتُ بِيَدَىَّ ۖ أَسْتَكْبَرْتَ أَمْ كُنتَ مِنَ الْعَالِينَ
রব বললেন, “হে ইবলিস! আমি আমার দু’হাত দিয়ে যাকে তৈরি করেছি তাকে সিজদা করতে তোমাকে কিসে বাঁধা দিয়েছে? তুমি কি বড়াই করছো, না তুমি কিছু উচ্চ মর্যাদার অধিকারী?” (৩৮:সোয়াদ:৭৬)
قَالَ أَنَا۠ خَيْرٌ مِّنْهُ ۖ خَلَقْتَنِى مِن نَّارٍ وَخَلَقْتَهُۥ مِن طِينٍ
সে জবাব দিল, “আমি তার তুলনায় শ্রেষ্ঠ, তুমি আমাকে সৃষ্টি করেছো আগুন থেকে এবং তাকে মাটি থেকে।” (৩৮:সোয়াদ:৭৭)
قَالَ فَاخْرُجْ مِنْهَا فَإِنَّكَ رَجِيمٌ
বললেন, “ঠিক আছে, তুমি এখান থেকে বের হয়ে যাও, তুমি বিতাড়িত (৩৮:সোয়াদ:৭৮)
وَإِنَّ عَلَيْكَ لَعْنَتِىٓ إِلٰى يَوْمِ الدِّينِ
এবং প্রতিদান দিবস পর্যন্ত তোমার প্রতি আমার লানত।” (৩৮:সোয়াদ:৭৯)
قَالَ رَبِّ فَأَنظِرْنِىٓ إِلٰى يَوْمِ يُبْعَثُونَ
সে বললো, “হে আমার রব! একথাই যদি হয়ে থাকে, তাহলে এদেরকে যখন পুনরায় উঠানো হবে সে সময় পর্যন্ত আমাকে অবকাশ দাও।” (৩৮:সোয়াদ৮০)
قَالَ فَإِنَّكَ مِنَ الْمُنظَرِينَ
বললেন, ঠিক আছে, তোমাকে সেদিন পর্যন্ত অবকাশ দেয়া হলো (৩৮:সোয়াদ:৮১)
إِلٰى يَوْمِ الْوَقْتِ الْمَعْلُومِ
যার সময় আমি জানি।” (৩৮:সোয়াদ:৮২)
قَالَ فَبِعِزَّتِكَ لَأُغْوِيَنَّهُمْ أَجْمَعِينَ
সে বললো, “তোমার ইজ্জতের কসম, আমি এদের সবাইকে পথভ্রষ্ট করবোই, (৩৮:সোয়াদ:৮৩)
إِلَّا عِبَادَكَ مِنْهُمُ الْمُخْلَصِينَ
তবে একমাত্র যাদেরকে তুমি একনিষ্ঠ করে নিয়েছো তাদেরকে ছাড়া।” (৩৮:সোয়াদ:৮৪)
মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদের সামনে উক্ত ঘটনাটি কথোপকথন আকারে বর্ননা করেছেন এবং খুব সুসংহতভাবে ইবলিসের অবাধ্যতার কারণ চিহ্নিত করে দিয়েছেন যা হলো ‘শ্রেষ্ঠত্ববোধ’। অবাধ্যতার শাস্তি স্বরুপ তাকে বহিষ্কার করা হলে তখনও সে আল্লাহকে চ্যালেঞ্জ করে বসে এবং আল্লাহর ইযযতের কসম করে বলেঃ তোমার একনিষ্ঠ বান্দা ছাড়া সকলকেই আমি পথভ্রষ্ট করে ছাড়ব।
অতঃপর ইবলিস তার চ্যালেঞ্জ অনুযায়ী আদম ও হাওয়াকে আঃ কে জান্নাত থেকে বিতাড়িত করে দুনিয়াতে নামিয়ে আনতে সক্ষম হয়। দুনিয়ার যমীনে সংঘটিত প্রথম রক্তপাতের পেছনেও দায়ী ছিল এই কৌলিন্যবোধ। কেননা ইবলিস কাবিল কে এভাবে প্ররোচিত করতে থাকে যে- তুমি বড় সন্তান, তোমার পছন্দ আগে, কে কি কুরবানী করল বা আল্লাহর কি ফয়সালা হলো তা দেখার বিষয় নয়; তোমার লক্ষ্য হাসিল করাটাই মুখ্য। সুতরাং হত্যা করো হাবিলকে আর নিজের প্রাপ্য বুঝে নাও। ঠিক এভাবেই ইবলিস কাবিলের কৌলিন্যে আঘাত করে এবং মানব ইতিহাসের প্রথম হত্যাকান্ডটি, প্রথম রক্তপাতটি ঘটিয়ে ফেলে।
সেই দুনিয়ার শুরু থেকেই আমরা যদি নবীগণের ইতিহাস লক্ষ্য করি তবে দেখতে পাই যে, অধিকাংশ নবী ও রাসূলগণকে দাওয়াতি মিশন বাস্তবায়ন করতে কৌলিন্যবাদের সাথেই মোকাবেলায় জড়িয়েছেন।
- হযরত ইবরাহীম আঃ স্বগোত্রীয় কুলীন মূর্তিপূজকদের সাথে বিবাদে জড়িয়ে ব্যাবিলন ত্যাগ করেন, (নমরুদের খোদায়ী দাবী এবং ইবরাহীম খলিলুল্লাহর দাঁতভাঙ্গা জবাবে তার পরাস্ত হওয়ার ইতিহাস তো সর্বজনবিদিত) সেখান থেকে মিশরে যান। সেখানেও এক কুলীন রাজার কুনজরে পড়েন। এরপরে আরবে এসে মক্কা প্রতিষ্ঠিত করেন।
- হযরত ইউসুফ আঃ প্রথমত তার কৌলিন্যবোধ সম্পন্ন বড় ভাইদের দ্বারা তার বাবা হযরত ইয়াকুব আঃ এর কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হন। তার ভাইদের চিন্তাধারা ছিল- আমরা এতগুলো বড়ভাই থাকতে ছোট ইউসুফ কেন বাবার উত্তরাধিকার পাবে? এটা হতে দেয়া যায়না, সুতরাং বিদায় করো। দ্বিতীয়বার তিনি নির্দোষ হওয়ার পর ও মিশরের রাজার কৌলিন্যবোধের অসহায় শিকারে পরিণত হন। নিজের স্ত্রী ই অপরাধী এবং ইউসুফ আঃ সম্পূর্ণ নির্দোষ ও পূতঃ পবিত্র এটা জানার পরও রাজা তার নিজের মান ইজ্জতের ব্যাপার বলে ইউসুফ আঃ কে কারাগারে প্রেরণ করেন।
- হযরত মূসা আঃ যে প্রেক্ষাপটে দুনিয়াতে আসেন, ঠিক তখনই ফেরাউনের কৌলিন্যবোধ এমন পর্যায়ে পৌছে গেল যে, সে নিজেকে খোদা দাবী করে বসল। ইসরাইলীদের ওপর দমন পীড়ন নীতি প্রণয়ন করল, কেননা তারা সে সময়ে ছিল ঐশী জ্ঞানের ধারক। তারা ফেরাউনকে ইলাহ বলে স্বীকার করতে প্রস্তত ছিলনা। যার সমাধান স্বরুপ ফেরাউনী রাজত্বে ইসরাইলীদের সকল শিক্ষাদীক্ষা বন্ধ করে দিয়ে শুধুমাত্র কারিগরী শিক্ষা দেয়া হতে থাকল যাতে তারা ফেরাউনকে ইলাহ বলে অস্বীকার করার কোন চিন্তাও তারা না করতে পারে। (ঠিক যেমন এই সময়কার পাশ্চাত্য সভ্যতা মৌলিক জ্ঞানের চর্চার পরিসর কমিয়ে দিয়ে কারিগরীর দুয়ারকে হাজারগুণ সম্প্রসারণ করে দিয়েছে। এজন্যই পাশ্চাত্য সভ্যতাকে ফেরাউনী সভ্যতার ধারা বলা হয়ে থাকে) ঠিক এমন সময়ই সে জানতে পারল এক ইসরাইলী শিশুর কথা যে তাকে ও তার খোদায়ীকে ধ্বংস করবে। ফলশ্রুতিতে সে ইসরাইলীদের গর্ভধারণ ও সন্তান জন্মদান রহিত করে দিল। এরপরের ইলাহী কুদরত তো আমাদের সকলেরই জানা।
- হযরত ঈসা আঃ এর জন্ম আল্লাহপাক সাধারণ নিয়মের বাইরে সংঘটিত করলেন। সেই থেকেই তিনি ও তাঁর মা হযরত মারইয়াম আঃ এর পেছনে পড়ে গেল তৎকালীন ইহুদী কুলীন শ্রেনী। অবশেষ হযরত ইসা আঃ এর রিসালাতও অস্বীকার করে ফেলল এমনকি তাকে হত্যার জন্য বেরিয়ে পড়ল এই কুলীন শাষক শ্রেণী। শেষ পর্যন্ত আল্লাহ পাক রুহুল্লাহ কে আসমানেই উঠিয়ে নিলেন।
- সায়্যিদুল মুরসালীন হযরত মুহাম্মাদ সাঃ এর দাওয়াতি কাজের মূল বাধা ছিল মক্কার তৎকালীন কুলীন শ্রেণী। মূর্তি পূজক ও মূর্তী তৈরীকারক সেই সাথে মূর্তির ব্যবসায়ীগণ সকলেই জোট গঠন করেছিল ইসলামের বিরুদ্ধে। আবু জাহেল, আবু লাহাব, উতবা,শায়বা রাতের আঁধারে নিজ নিজ জায়গা থেকে আল্লাহর রাসূলের কালামে পাকের তেলাওয়াত শুনতো, ইসলামের সৌন্দর্যে মোহিত হতো তবুও দিনের বেলায় নির্যাতন ও বিদ্রুপের বন্যা বইয়ে দিত শুধু কৌলিন্যের খাতিরে। কেননা ইসলামে কৌলিন্যের কোন বিশেষ স্থান নেই, আল্লাহর বান্দা সকলেই সমান, নাই কোন ভেদাভেদ। এটাই ছিল হুজ্জাতুল বিদার ভাষণের মূল প্রতিপাদ্য। সুতরাং ইসলাম যদি প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়, তাহলে তাদের সম্ভ্রান্তবাদ হুমকির মুখে পড়বে। হারিয়ে যাবে তাদের হামবড়া ভাবের বাহার। ঠিক এতটুকু স্বার্থের খাতিরে তারা ইসলামকে অস্বীকার করে বসল!
- একইভাবে মদিনায় ইহুদীরা নিজেদের কৌলিন্যের কারনে কখনোই হযরত মুহাম্মাদ সাঃ কে বরণ করে নিতে পারেনি এবং আজীবন তাঁর জন্য সকল প্রকার হুমকির বন্দোবস্ত করেছে। (হত্যাচেষ্টা থেকে শুরু করে যুদ্ধ বাধিয়ে দেয়া পর্যন্ত, সব!) যদিও তারা জানত যে শেষ নবীর আবির্ভাব আরবে হবে। এজন্য তারা আরবে বসতি করল। কিন্তু দেখা গেল যে, শেষ রাসূল তাদের বনু ইসহাক থেকে নয় বরং বনু ইসমাঈল থেকে এলেন যা তাদের কৌলিন্যে মারাত্নক আঘাত করল।
- এরকমভাবে অধিকাংশ জায়গায় নবী রাসূলগণ এই কুলীন শ্রেণীর বিরুদ্ধে দাওয়াতী মিশন পরিচালনা করে গেছেন। হযরত নূহ আঃ, হযরত ইউনুস আঃ, হযরত হূদ আঃ, হযরত সালেহ আঃ, হযরত শুয়াইব আঃ, হযরত লূত আঃ এর কথা কোরআনে সরাসরি বর্নিত। তাদের সংগ্রাম যে কুলীন শ্রেনীর বিপরীতে ছিল তার বর্ননায় আল্লাহ ‘আখি’ বা ভাই শব্দের ব্যবহার করেছেন। কেননা ওই সকল জাতি তাদের নবী রাসূলদের নিচুজাত, বা তাদের চেয়ে কম সম্ভ্রান্ত মনে করত। আল্লাহ তাদের জবাব দিলেন ভাই শব্দ দ্বারা। ভাই এমন একটি সম্পর্ক, যার অধিকার, মর্যাদা, ক্ষমতা এবং সকল কিছুই সমান সমান হয়ে থাকে। সুতরাং আল্লাহ নিশ্চিত করে দিলেন যে, তোমাদের চেয়ে আমার আম্বিয়াগণের কৌলিন্য কোন অংশেই কম নয় বরঞ্চ তাঁরা আমার বিশেষ বান্দা।
(এ ব্যাপারে সূরাতুশ শুয়ারা পড়ার পরামর্শ রইল)
সুতরাং নবীগণের ইতিহাস পর্যবেক্ষণে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে- তাওহীদের দাওয়াত অস্বীকার করার পেছনে যে মোটিভ কাজ করে সেটা হচ্ছে কৌলিন্যবোধ। যা সরাসরি শয়তানি স্বভাব বা চিন্তা। শয়তান ঠিক তার কসম অনুযায়ী নিজের দোষের দ্বারা দুষ্ট করে বিপথগামী করে চলেছে মানবজাতিকে। একেবারে ইনসানী ইতিহাসের শুরু থেকেই সে একই ক্রমধারা বিভিন্ন আঙ্গিকে ব্যবহার করে চলেছে।
এই কৌলিন্যবাদের ভিত্তি মূলত শ্রেষ্ঠত্ব। শ্রেষ্ঠত্বের প্রশ্ন সামনে চলে আসায় কৌলিন্যদুষ্ট কোন জনগোষ্ঠি অপর কোন জনগোষ্ঠিকে বরদাশত করতে পারেনা। ঠিক এ কারণেই সভ্যতা সমূহের উত্থান পতন প্রক্রিয়া চলে আসছে। যেমনঃ প্রাচীন কালে রোমান–পারসিক দ্বন্দ্ব, আর্য– অনার্য দ্বন্দ্ব, সাদা– কালোর বর্ণভেদ, ইহুদীদের সাথে খৃষ্টানদের এবং এই একই ধারায় অন্যান্য আরো মোকাবেলা।
পক্ষান্তরে দ্বীনে ইসলামে এরকম কৌলিন্যবাদের কোন স্থান নেই, ফলশ্রুতিতে উপরোক্ত অন্তর্দ্বন্দ্বপূর্ণ জাতি গুলো ইসলামের বিরুদ্ধ শক্তিতে একজোট হয়ে গেল, এবং যার যার জায়গা থেকে একই ক্রমধারা অবলম্বন করায় ইসলামের বিরুদ্ধে আগ্রাসন আজ বিশ্বজনীনতা পেয়েছে। কারণ তারা যেখানে এক জাতিই আরেক জাতিকে বরদাশত করতে পারেনা সেখানে কৌলিন্যবাদের উৎখাতকারী ইসলামকে তারা বরদাশত করতে যাবে কেন? আর বিশ্বজনীন একটি দ্বীনের বয়ানও বিশ্বজনীন, সুতরাং বিশ্বজনীন বিষয়ের বিশ্বজনীন বিরোধীতা প্রতিবন্ধকতাটা আসাই স্বাভাবিক।
কিন্ত অত্যন্ত আফসোসের বিষয়, আমরা যে জায়গাটাতে ভুল করে ফেলি সেটা হলো- আমরা এন্টি ইসলামের এই রূপটাকে বিশ্বজনীনভাবে মিলিয়ে দেখতে ব্যর্থ হই বরং এটাকে আঞ্চলিক-সাম্প্রদায়িক লড়াই হিসেবে বিচার করে থাকি। ঠিক এই কারনেই এক অঞ্চল থেকে ইসলামের উপরে আঘাত আসালে অন্য অঞ্চল চুপ থাকে। কেননা আত্মচিন্তা ইনসানের ফিতরাত।
আমরা বুঝতে পারিনা যে, এই আগ্রাসন সমগ্র দ্বীনে ইসলামকে অপসারণের আগ্রাসন, এটা আসলে আল্লাহর সাথে ঔদ্ধত্য প্রকাশ করে ইবলিশের করা কসমের বাস্তবায়ন, এটা হক্ব ও বাতিলের মাঝে চলে আসা এক চিরন্তন লড়াই।
আমরা কীভাবে এসকল বিষয় উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হই যেখানে- আমাদের বিশ্বাস এক, আমাদের রাসূল এক, আমাদের দ্বীন এক, কালিমা এক, আমাদের একক উম্মাহ ঘোষণা করা হয়েছে, একে অপরকে ভাই- ভাই সম্পর্ক দেয়া হয়েছে (যে পদ্ধতি আল্লাহ তায়ালা কুরআনে নির্দেশ করেছেন)
কৌলিন্যবাদদুষ্ট হিসেবে শয়তানের সাথে আমাদের দ্বন্দ্বের যায়গাটা ঠিক কোথায়? আসুন নিরূপণ করি।
আসলে ইসলাম আর শয়তানি কৌলিন্যবাদের লক্ষ্য একই তবে লক্ষ্যমাত্রা ভিন্ন।
উভয়েরই লক্ষ্য ইবাদত (দাসত্ব) প্রতিষ্ঠা।
আর লক্ষ্যমাত্রা হলোঃ- কৌলিন্যবাদ চায় খালেকের পরিবর্তে মাখলুকের ইবাদত প্রতিষ্ঠা করতে। যা আল্লাহর সরাসরি নিষেধ, এবং আল্লাহ এই অপরাধ কক্ষনোই ক্ষমা করবেন না। কারণ এটা সেই অবাধ্যতা যা শয়তান আল্লাহর সাথে করে বিতাড়িত হয়েছে। আর এটা সরাসরি শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করে অভিশপ্ত হওয়া মাত্র। এজন্য তারা জাহানে আল্লাহর পরিবর্তে বিভিন্ন ব্যক্তি বা বস্তুর রাজত্ব কায়েম করে আদতে যা শয়তানেরই রাজত্ব প্রতিষ্ঠা বৈকি!
আর ইসলাম চায় সর্বময় ক্ষমতার মালিক, সকল কিছুর সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের ইবাদত কায়েম করতে। তাওহীদের সর্বময় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে এবং সে অনুযায়ী আল্লাহর খলিফা হিসেবে প্রেরিত মানব জাতির মাধ্যমে জাহান পরিচালনা করা। যা আল্লাহর সরাসরি নির্দেশ এবং এটি একমাত্র তাঁরই হক।
আর সার্বভৌমত্ব (হুকুমাত) প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনার জন্য পাঁচটি বিষয়ের ওপর অধিকার প্রয়োজনঃ-
- ১.শহরত বা প্রসিদ্ধি, প্রতিষ্ঠা পাওয়া
- ২.দৌলত বা সম্পদ,অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ
- ৩.কুওয়াত বা শক্তিমত্তা, সক্ষমতা
- ৪.রিয়াসাত বা নেতৃত্ব, নীতিনির্ধারক হওয়া
- ৫.আযমত বা মহত্ব, সুপার পাওয়ারে পরিণত হওয়া
পাঁচটি আপেক্ষিক বিষয় নিয়ন্ত্রন করে উপরোক্ত পাঁচটি বিষয়ের দ্বারপ্রান্তে পৌছা যায়ঃ-
- ১.আদালত- ন্যায়ের মানদন্ড, ইনসাফ, ইহসান
- ২.আমানত- নিরাপত্তা, সোশ্যাল সিকিউরিটি, জুলুম নিয়ন্ত্রণ
- ৩.সালামত- শান্তি, সাবলীলতা, ফাসাদ নিয়ন্ত্রণ
- ৪.মুসাওয়াত- সমতা, ঐক্য নিয়ন্ত্রন, অধিকার নিশ্চিত করণ
- ৫.দারাজাত- সভ্যতার অগ্রগতির মাধ্যম, যেমনঃ জ্ঞানের উৎকর্ষ, ভাষার সমৃদ্ধি, শক্তিশালী সংস্কৃতি, ভারসাম্যপূর্ণ ব্যবস্থা বা সিস্টেম ইত্যাদি।
আর এই দশটি ধাপের নতিজা বা ফলাফল হচ্ছে হুকুমাত। আর এখানেই ইসলামী হুকুমাতের সাথে কৌলিন্যবাদী শয়তানী হুকুমাতের পার্থক্য। ইসলামের সাথে কৌলিন্যবাদ দোষে দুষ্ট অন্যান্য সভ্যতার আকাশ পাতাল তফাতটা ঠিক এখানেই।
কৌলিন্যবাদ সবসময় প্রথম পাঁচটি শর্ত পূরণের চেষ্টা চালিয়ে পরবর্তী আপেক্ষিক পাঁচটি বিষয় বিগড়ে, ধ্বংস করে, হত্যা করে,দলিত মথিত করে।
আর ইসলাম সর্বাবস্থায় প্রথমোক্ত পাঁচটি শর্ত পূরণ করেছে পরবর্তি পাঁচটি বিষয়কে নতুনভাবে প্রতিষ্ঠাও ও সাফল্যের সর্বোচ্চ শীর্ষে আরোহণ করিয়ে। এবং এভাবেই আল্লাহর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা ও খলিফা হিসেবে মুসলিমগণ তা পরিচালনা করেছেন।
ইসলামী সভ্যতা যেখানেই গিয়েছে, সেখানকার প্রতিষ্ঠিত সভ্যতা না থাকলে নতুন ধারার অভূতপূর্ব সভ্যতা প্রতিষ্ঠা করেছে। যেমন আন্দালুসে, আর প্রতিষ্ঠিত সভ্যতা থাকলে তাকে আরো বেশি শক্তিশালী ও সমৃদ্ধ করেছে। যেমন পারস্যে, বাংলায়।
ইসলামী সভ্যতা অতীত সকল সভ্যতার জ্ঞানকে উন্নয়ন করেছে, বিজিত সভ্যতার ভাষাকে সমৃদ্ধ করেছে, সংস্কৃতিকে শক্তিশালী করেছে। অর্থনীতিকে অকল্পনীয় মাত্রায় গতিশীল করেছে। এক কথায় বিশ্বজনীন ইসলামী মূল্যবোধের আলোকে সাজিয়েছে।
পক্ষান্তরে কৌলিন্যবাদের জীবাণুবাহী পাশ্চাত্য জায়নবাদী সভ্যতা ও তার দোসররা যেখানেই গিয়েছে, সেখানেই সভ্যতার ধ্বংস সাধন করেছে। ভাষাকে হত্যা করেছে, সংস্কৃতিকে পঙ্গু করে দিয়ে নিজেদের খাপছাড়া সংস্কৃতি চাপিয়ে দিয়েছে। অর্থনীতিকে এক কেন্দ্রিক করে নিজেদের আঙ্গুল ফুলিয়ে কলাগাছ করে অন্যদের না খাইয়ে মেরেছে। মানুষের মধ্য হতে মূল্যবোধ ও অনুভূতি ছিনিয়ে নিচ্ছে। এরকম আত্নসাতের মাত্রা আরো লম্বা আরো গভীর এবং আরো ভয়ঙকর।
হাল যমানায় শয়তানি কৌলিন্যবাদের ধারক বাহক পাশ্চাত্য জায়নবাদী সভ্যতা ও তার দোসররা নিজেদের ফাটা ঢোল নিজের পিটিয়েই কুল কিনার করতে পারছেনা। ফাটা ঢোল বলার কারন তাদের কৃতকর্মের ইতিহাস পর্যবেক্ষণ করলেই বোঝা যাবে। ইসলামের সাথে কৌলিন্যবাদের দ্বন্দ্বের ইতিহাসভিত্তিক উদাহরণ গুলো সামনে আসলেই একে একে উন্মোচিত হবে সভ্যতার আড়ালে ঢাকা চরম জাহেলিয়াতপূর্ণ অসভ্যতার। আর এই মুখোশ উন্মোচিত হতেই হবে, কেননা পাশ্চাত্য মনে করে ইসলাম মধ্যযুগীয় ধর্ম ব্যবস্থা এবং এর ঝান্ডাবাহীদের হাত থেকে ইসলামকে ছিনিয়ে নিয়ে ধ্বংস করে ওই সকল জনগোষ্ঠীকে সভ্যতার কাতারে শামিল করাটা তাদের আজন্ম দায়িত্ব! এজন্য তারা যেখানে যেভাবে পারছে ইসলাম বিতাড়ন এবং সেখানকার অধিবাসীদের সভ্যতার কাতারে শামিল করছে(!)।
দেখা যাক এবার উদাহরণ গুলোঃ-
- কৌলিন্যবাদের মরন ছোবলে নীল হয়ে যাওয়া ইসলাম মদিনায় নির্বাসিত হলো এবং সেখানে বহু বাধা বিপত্তি ও হুমকি মোকাবেলা করে মদিনা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করল এবং একসময় মক্কা বিজয় করে নিল। হাজারো নির্যাতনের স্মৃতিচিহ্ন বয়ে বেড়ানো মুসলিমরা সেদিন রক্তপাতহীন বিপ্লবের যে নজীর স্থাপন করেছে, সমগ্র বিশ্বে এমন উপমা পাওয়া যাবেনা। সকলকে সাধারণ ক্ষমা ঘোষনা করা হলো, যেখানে সকল মুশরিক অত্যাচারীরা থর থর করে কাঁপছিল, সেখানে এমন অপ্রত্যাশিত ক্ষমা পাওয়াটা কি পরিমাণ রহমত স্বরুপ ছিল!
- বিনা রক্তপাতে অর্ধজাহানের শাসনকর্তা হযরত উমরের (রাঃ) জেরুজালেম অধিকারের পরে ইউরোপীয়ানরা ক্রুসেড পরিচালনা করে যখন কুদস দখল করে নিল, তারা আরদুল মুকাদ্দাসে এই পরিমাণ মুসলিমের রক্ত ঝড়ালো যে, ঘোড়ার হাঁটু পর্যন্ত সে রক্তে ডুবে গেল। পক্ষান্তরে ইসলামের বীর সেনাপতি সালাহুদ্দিন আল আইয়ুবী যখন কুদস কে পুনরুদ্ধার করলেন তখন স্থানীয় খ্রীষ্টানদের জানমাল সব নিয়েই নিরাপত্তার সাথে শহর ত্যাগ করার অনুমতি দিলেন!
- আঁধারের চরম স্তরে পতিত থাকা ইউরোপে সভ্যতার কিংবদন্তি চেরাগ জ্বালে এই ইসলামই। প্রতিষ্ঠা করে ৮০০ বছরের কিংবদন্তী সোনালী ইতিহাসের সভ্যতা আন্দালুস । যার উপরে ভিত্তি করে আজকের পাশ্চাত্য এতদূর। কিন্তু সে ইউরোপীয়ানরাই স্পেনের মাটি থেকে মুসলিম বিতাড়ন করে ফেলল!
- ইউরোপের পূর্বদিকে ইসলাম যখন কনস্টান্টিনোপলে প্রবেশ করেছিল, তখন শহরবাসী হাজিয়া সোফিয়ায় সমবেত হয়ে মৃত্যুর প্রহর গুনছিল, তখন সুলতান ফাতিহ মেহমেদ তাদের ক্ষমা ঘোষনা করলেন আর তাদের বাইজেন্টাইন সভ্যতার প্রতীক হাজিয়া সোফিয়াকে মসজিদের মর্যাদা দান করলেন। পক্ষান্তরে আন্দালুসের মাটিতে যখন ইউরোপীয় আগ্রাসন চলে, তখন তারা সকল কিছু জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দিল। মুসলিমদের তিল তিল করে গড়ে তোলা লাইব্রেরীর বইগুলো সব পানিতে ফেলে দিল। তা সংখ্যায় এত ছিল যে স্রোত পর্যন্ত আটকে গিয়েছিল! যেখানে কনস্টান্টিনোপলে মুসলিমরা বিধর্মীদের ধর্মগৃহে নিরাপত্তা প্রদান করলো আর তারা আন্দালুসের মুসলিমদের নিরাপত্তা দেয়ার ঘোষণা দিয়ে মসজিদের ভেতরে ঢুকিয়ে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মারল! মুসলিমদের মসজিদগুলোকে ক্যাস্টাইলে পরিবর্তন করে ফেলা হল!
- মুসলিমগন ফ্রান্সের দুর্ভিক্ষের সহায়তায় জাহাজভর্তি ত্রাণ পাঠানোর নজীর স্থাপন করেছে যেখানে একদিন এই ইউরোপীয়রাই জাহাজ ভর্তি হিজরতকামী মুসলিমদের যিন্দা পুড়িয়ে মেরেছিল!
- ইসলাম ইউরোপের বলকানে প্রবেশ করে অন্তর্দ্বন্দ্বপূর্ণ শত শত ছোট ছোট রাজ্যের অস্থিতিশীল ব্যবস্থাকে আদল ও ইনসাফ দিয়ে পরিবর্তন করে শান্তির বাতাস বইয়ে দিল আর পাশ্চাত্য মুসলিম অঞ্চলগুলোতে উপনিবেশের মাধ্যমে প্রবেশ করে যুদ্ধের আগুন জ্বেলে দিল। যার ধারাবাহিকতা এখনো শেষ হয়নি। ইরাক সিরিয়ার হাজার বছরের সভ্যতা আমেরিকা মাটির সাথে মিশিয়ে দিল। রাশিয়া ধ্বংস করে ছাই করে দিল মধ্য এশিয়ার ঐতিহ্যবাহী সভ্যতা। উগ্র হিন্দুত্ববাদী ভারতীয়রা আজ ব্যস্ত হাজার বছরের প্রতিষ্ঠিত ইসলামী সভ্যতার নাম ও নিশানা মুছে দিতে!
- প্রায় দু হাজার বিছর নির্বাসিত থাকার পরে ফিলিস্তিনের মাটিতে অবৈধভাবে ঠাই পাওয়া ইহুদীরাও আজ মুসলিমের মাথা নিয়ে হোলি খেলে। এর ইতিহাস এই পরিমাণ ভয়ঙকর যে- এর আলোচনায় গেলে বর্তমান গোটা সিস্টেম নিয়েই আলোচনা করতে হবে!
- ভারতবর্ষে চার শ্রেণীর বর্ণবাদ সহ অন্যান্য সকল যুলুমের উৎখাত করে ৮০০ বছরের ন্যায় ভিত্তিক সভ্যতা প্রতিষ্ঠা করল ইসলাম আর সেই ইসলামকেই আজকে বহিরাগত বলে খতম করে দেয়ার অপচেষ্টার পারাকাষ্ঠা প্রদর্শন করছে কৌলিন্যবাদীরা।
- অপর দিকে আমেরিকার মাটিতে ইউরোপীয়ানরা মাত্র চার শতক আগে পৌছেই তিন তিনটে সভ্যতা ধ্বংস করল (ইনকা, মায়ান, এ্যাজটেক)। ষোড়শ শতাব্দীতে রেড ইন্ডিয়ানদের মেরে মাত্র এক শতাব্দীতে জনসংখ্যা কমিয়ে আট কোটি থেকে মাত্র এক কোটিতে নামিয়ে নিয়ে আসলো যেখানে স্বাভাবিক ভাবে প্রজননের মাধ্যমে একশ বছরে জনসংখ্যা আরো কোটি তিনেক বাড়ার কথা! গনগত্যার মাত্রাটা উপলব্ধী করা যাচ্ছে! সেই সাথে তারা আফ্রিকার উপরের তাদের পঙ্কিলতার কালো হাত বাড়িয়ে দিল। আমেরিকার নতুন মাটিতে ব্যাপক পরিমানে আফ্রিকান মানব দাস হিসেবে পাচার করে আফ্রিকার জনসংখ্যা অর্ধেকে নামিয়ে নিয়ে আসল! যুলুমের একটি মাত্র উদাহরণ দিচ্ছিঃ সপ্তদশ শতকে যখন ইউরোপীয় সৈন্যদের কুমিরের চামড়া নির্মিত বুটের বেশ চাহিদা দেখা গেল, তখন এরা কুমির শিকার করতে লাগল। যেহেতু হরিণ ও খরগোশ কিনতে টাকা বেশি লাগত, তাই এরা কুমিরের টোপ হিসেবে মানুষের সন্তান ব্যবহার করত। কালো মানুষের সন্তান বলে কথা! কি নির্মমতা, কি অসভ্যতা- যা কল্পনারও অতীত। (তারাই নাকি আজকের সভ্যতার মশালবাহী, মূর্তিও প্রতিষ্ঠা করে বিশ্ববাসীকে জানান দিচ্ছে(!)স্ট্যাচু অব লিবার্টি!)
এটাতো শুধু তাদের অতীত ইতিহাস, বর্তমানের পাপাচার গুলো নিয়ে আলোচনাই হয়ত শেষ করা যাবেনা। এই এরাই কিনা আজকে সভ্যতার ধ্বজা ধারী, যারা দুনিয়াকে গ্লোবাল ভিলেজ বানিয়ে সভ্যতার কাতারে শামিল করার প্রয়াস ব্যক্ত করে। দুনিয়ার সকল প্রান্তে শান্তি প্রতিষ্ঠা করার অধিকার যেন এদের পৈত্রিক উত্তরাধিকার(!)।
শেষ করতে চাই একটি প্রশ্ন দিয়ে-
একটু ভেবে দেখেন একটি জিনিস, ভারতে মুসলিমরা যদি ৮০০ বছরের ন্যায়ভিত্তিক সভ্যতা প্রতিষ্ঠা করার পর ও যদি বহিরাগত হিসেবে বিবেচিত হয়, এবং নির্মুল এর শিকার হয়, তবে আমেরিকার মাটিতে তিন তিনটে সভ্যতার ধ্বংস সাধন করে আধুনা মার্কিনীরা (অভিবাসী ইউরোপীয়ানরা) আমেরিকার মাটিতে বহাল তবিয়তে থেকে মুসলিমদের বিরুদ্ধে উস্কানি দিতে পারে কীভাবে….???
কোন অধিকার আছে তাদের যে কৌলিন্যবোধ তাদের এতখানি নাক উঁচু করে দিয়েছে!
আজ কোন সে শক্তির কারণে কৌলিন্যবাদ নিজেকে ইসলামের প্রতিদ্বন্দ্বীতার কাতারে শামিল করার প্রয়াস পাচ্ছে? কোত্থেকে তাদের এত হিম্মত আসছে। কীভাবে তারা ইসলামকে মধ্যযুগীয়, অসভ্য আখ্যা দিয়ে নিজেদের সভ্য ও সভ্যতার কারিগর বলতে পারছে? যেখানে তাদের সমগ্র ইতিহাসই বর্বরতার, যুলুমের, অত্যাচারের। ইতিহাস সাক্ষী, এরা গড়তে জানেনা, জানে শুধু ধ্বংস করতে। এদের গড়া সভ্যতাও ঠিক এমনই ভঙ্গুর, যেকোন সময় ভেঙ্গে যেতে পারে। এর অসামঞ্জস্যতার মাত্রা এতটাই প্রকট। আল্লাহ কোরআনে তো এদের দিকেই ইশারা করেছেন
وَإِذَا قِيلَ لَهُمْ لَا تُفْسِدُوا فِى الْأَرْضِ قَالُوٓا إِنَّمَا نَحْنُ مُصْلِحُونَ
যখনই তাদের বলা হয়েছে, যমীনে ফাসাদ সৃষ্টি করো না, তারা একথাই বলেছে, আমরা তো সংশোধনকারী।
أَلَآ إِنَّهُمْ هُمُ الْمُفْسِدُونَ وَلٰكِن لَّا يَشْعُرُونَ
সাবধান! এরাই ফাসাদ সৃষ্টিকারী, তবে তারা এ ব্যাপারে সচেতন নয়।
সুতরাং এরাই হচ্ছে প্রকৃত অসভ্য এবং নির্লজ্জ একটি ধারা যা শয়তানের সরাসরি ডিরেকশনে পরিচালিত হয়ে থাকে। সকল অসভ্যতার মূল এই কৌলিন্যবাদী পাশ্চাত্য সভ্যতা ও তার ধারক বাহকেরা।
এরা আজকে হুকুমতের আসনে আসীন ঠিক মুসলিমদের গাফিলতির জন্য, ইসলামী সভ্যতার ধারক বাহকদের উচিত সে গাফিলতি ঝেড়ে ফেলে কৌলিন্যবাদী ফেরাউনী সভ্যতার পতন ঘটিয়ে পুনরায় ইসলামী সুমহান ঐশী সভ্যতার পুনরুত্থান ঘটানো এবং দুনিয়ার সর্বত্র সর্বময় কর্তৃত্বের অধিকারী মহান আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জতের ইবাদত প্রতিষ্ঠা করা। সেই সাথে মানব জাতিকে শয়তানের খপ্পর থেকে মুক্ত করে আল্লাহর লা’নতের আওতার বাইরে নিয়ে গিয়ে ইহকালীন শান্তি ও পরকালীন মুক্তির পথে পরিচালিত করা।
বনের বাঘ যখন শিকার করে তখন সে শিকারকে তাড়া করে, এক পর্যায়ে শিকারকে ছাড়িয়ে যায় এবং সামনে থেকে হামলা করে শিকারের সবচেয়ে নাজুক জায়গা- গলায় আক্রমণ চালায়। ঠিক সেভাবেই বুনো শুয়োরের মত হম্বিতম্বি করতে থাকা কৌলিন্যবাদের ধারক বাহক পাশ্চাত্য যায়নবাদী সভ্যতা ও তার ধারক বাহকদের লম্ফঝম্ফে মাথা না ঘামিয়ে এদের মূল ভিত্তিতে আঘাত করে চূর্ণ বিচূর্ণ করে একটি ঐশী সভ্যতার প্রতিষ্ঠা করাটা এখন সময়ের দাবী।
সে দাবী পুরণের জন্যই মুসলিমদের ফিরে যেতে হবে ইসলামের মৌলিক ভিত্তি ও উসূলের দিকে। ইসলামী সভ্যতার কালজয়ী সোনালী ইতিহাসের দিকে। মুসলিমদের হতে হবে শিকড় সন্ধানী। চিনে নিতে হবে শত্রু-মিত্র। সর্বত্র হাকীকত অন্বেষণ করে নিজেদের চিনে নিয়ে ঝাপিয়ে পড়তে হবে সর্ব শক্তি নিয়ে তাওহীদের প্রতিষ্ঠায় যমীনের সর্বত্র। সর্বাত্নক মোকাবেলায় নামতে হবে শয়তানী শক্তি ও তার ধারক বাহক দের বিরুদ্ধে। গুড়িয়ে দিতে হবে বাতিলের প্রাসাদ এবং আল্লাহর খলিফা হিসেবে যমীনের সর্বত্র কায়েম করতে হবে আদালতের ভিত্তি, এবং তখনই প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর ইবাদত প্রতিষ্ঠিত হবে যমীনে।
ইসলামী হুকুমাত বা সভ্যতা প্রতিষ্ঠা করা কোন সাধারণ জয় পরাজয়, দখল বা পুনর্দখলের খেলা নয়, বারং এটা একটি বিশ্বজনীন ভিশন। যার চূড়ান্ত লক্ষ্যই হচ্ছে মানবতার মুক্তি। সুতরাং অন্যান্য সভ্যতা, জাতির মত ইসলাম কেও উত্থান পতনশীল কোন শক্তি জ্ঞান করাটা মোটেও সমীচীন নয়। বরং এর উৎপত্তিই হয়েছে মানবতার কল্যাণের জন্য। অর্থাৎ যতদিন মানবতা আছে, ইসলাম ও ততদিন থাকবে। অর্থাৎ জয় পরাজয়ের হিসাব নিকাশে না গিয়ে সমগ্র ইনসানিয়াতকে মহা পরাক্রমশালী আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার গোলামীর মধ্যে নিয়ে এসে দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণ লাভ করাই হবে উদ্দেশ্য।
যেমন আল্লাহ তায়ালা কুরয়ান মাজীদে আমাদের শিখিয়েছেন,
رَبَّنَآ ءَاتِنَا فِى الدُّنْيَا حَسَنَةً وَفِى الْءَاخِرَةِ حَسَنَةً وَقِنَا عَذَابَ النَّارِ
হে আমাদের রব! আমাদের দুনিয়ায় কল্যাণ দাও এবং আখেরাতেও কল্যাণ দাও এবং আগুনের আযাব থেকে আমাদের বাঁচাও। (২: আল-বাক্বারাহ: ২০১)