রোজা ও ঈদ
ঈদ অর্থ আনন্দ-উৎসব। ঈদুল-ফিতর অর্থ উপাস ভাংগার আনন্দ-উৎসব। এ উৎসবের আনন্দ যা-তা মামুলি আনন্দ নয়। এটা উল্লাস। যাকে বলে পুলকানন্দে ফাটিয়া পড়া। এ ঈদ আসে অনেক দিনের সাধনার পর। কি কঠোর কৃচ্ছ ও সংযম সাধনা তা। একটানা ত্রিশ দিনের নিরঙ্কু উপবাস। দিনে রোযা ও রাতে এবাদত। ইন্দিয়েরা সবাই শৃঙ্খলিত বন্দী। এক মাস পরে পায় তারা মুক্তি। কি পুলক সে মুক্তিতে। সেই মুক্তির আনন্দেই এই উল্লাস। যেন বাঁধ-ভাংগা স্রোত। সেই বেগ সেই তেজ। আনন্দ-উৎসবকে গলা-ফাটানো উল্লাসের উন্মত্ততায় উদযাপন করা যদি কখনো প্রয়োজন ও সংগত হয়, তবে তা এই দিনে। এই কারণেই এই উৎসবের এই নাম। এ নাম তাৎপর্যপূর্ণ।
কিন্তু আমরা তা ভুলিয়া গিয়াছি। প্রতি বছর আমরা সে ভুলের পুনরাবৃত্তি করিতেছি; সে ভুল দোহরাইতেছি। প্রতি বছরে আমরা এই উপলক্ষে অনেক কিছু বলিতেছি বক্তৃতায়, লিখিতেছি বিশেষ সংখ্যার সাময়িকীতে। সবই ভক্তি গদগদ কণ্ঠের কথা। ভক্তি-রসাপ্লুত লেখা। সে সব কথার যতটুকু আন্তরিক, যতটুকু অর্থপূর্ণ, তার সবটুকু রোযার কথা, ঈদের কথা নয়। রোযার আধ্যাত্মিক দিক নিশ্চয় আছে। রমজানের রোযার আরও বেশি আছে। রোযা সংযম। রমজানের রোযা সমবেত সামাজিক সংযম। এর শিক্ষা ও কল্যাণের একাধিক দিক আছে। তা বুঝিবার ও বলিবার দরকারও আছে খুবই।
রোযা কিন্তু ঈদ নয়। ঈদও রোযা নয়। ঈদুল-ফিতর রমজানের রোযা নয়। কিন্তু ঈদ-সংখ্যা কাগজে আমরা ঈদের মহিমা কীর্তনে যে বিদ্যাবুদ্ধি খরচ ও পাণ্ডিত্য জাহির করি, তার সব কথা সত্য হইলেও এগুলি ঈদের কথা নয়, রমযানের রোযারই কথা। রোযা ও ঈদ ত্যাগ ও ভোগের মতোই দুইটা অ্যান্টিথেসিস, বিপরীত গুণাত্মক কাজ। রমজানের বেলা একটা শর্ত আর একটা পুরস্কার; একটা ক্রিয়া আর একটা ফল। শ্রমের পুরস্কার যেমন বিশ্রাম, অধ্যয়নের পুরস্কার যেমন প্রমোশন, ত্যাগের পুরস্কার যেমন ভোগ, রমজানে রোজার পুরস্কার তেমনি ঈদুল-ফিতর।
কিন্তু আমরা দুইটাকে এক করিয়া ফেলিয়াছি। আমাদের আনন্দোৎসব হইয়া উঠিয়াছে এবাদতের উৎসব। এবাদত ও উৎসব একত্রে চলিতে পারে না। ফলে আমাদের ঈদের আনন্দের স্থান দখল করিয়াছে এককভাবে এবাদত। ঈদের দিন হইয়াছে এবাদতের দিন। ঈদের সমাবেশ হইয়াছে প্রার্থনা সভা। আমাদের সাংস্কৃতিক জীবনে এই দুর্ঘটনা ঘটে শুধুই পাক-ভারত উপমহাদেশে, বিশেষত পাক-বাংলায়। এমন হইবার ঐতিহাসিক কারণ আছে।
নিরানন্দের জন্ম
ছয়শ’ বছরের শাসক জাতি মুসলমানরা ইংরাজের জুলুমে এক রাতে পথের ফকির হইয়া যায়। লুপ্ত রাজ্য ও স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করে তারা প্রায় একশ’ বছর ধরিয়া। এই সময়ে প্রাণ ধারণই মুসলমানদের জন্য কঠিন হইয়া পড়িয়াছিল। আনন্দ উৎসব করিবার সামর্থ্য-সুযোগ তাদের ছিল না।
ইংরাজ শাসকদের সর্বাত্মক জুলুমবাযি চলে বাংলার মুসলমানদের উপরই বেশি। ওহাবী আন্দোলন ও সিপাহি বিদ্রোহ গণ-বিপ্লবের আকার ধারণ করে বাংলাতেই। ওদের যুলুম নিপীড়ন যত বাড়ে, মুসলিম নেতৃবৃন্দের সংকল্প হয় তত দৃঢ়। তাঁরা নিজেরা সকল প্রকার ভোগ-বিলাস ও আমোদ-উল্লাস বর্জন করেন এবং মুসলিম জনসাধারণকে করিতে বলেন। সাময়িক বিপদেই মানুষ উৎসব-আনন্দ বাতিল করে। বিপদ দীর্ঘস্থায়ী হইলে ত কথাই নাই।
কাজেই মুসলমানরা জাতীয় সংকটের দিনে অস্টারিটির নীতি হিসাবেই ঈদের দিনের উৎসবও যথা-সম্ভব সংক্ষিপ্ত করিয়াছিল। আমোদ-প্রমোদ বাতিল করিয়াছিল। ধর্মীয় অনুষ্ঠানটুকু না করিলেই নয় বলিয়া অনাড়ম্বর গুরু-গম্ভীর পরিবেশে তা সম্পন্ন করিত।
বিপদের দিনে সকল দিক হইতে বঞ্চিত ও নিরুপায় হইলে মানুষ বেশি ধার্মিক হয়। বিপদ-তারণ আল্লাহর দরগায় মোনাজাত করে। কাজেই আনন্দ-উৎসবের স্থান এবাদত-মোনাজাতে দখল করে জাতির জীবনে এমনি দুঃসময়ে। এই কৃচ্ছ সাধনা শতাব্দী কাল স্থায়ী হওয়ায় মুসলমানদের সামাজিক জীবন হইতে সকল প্রকার আনন্দ-উৎসব এবাদতের উৎসবে পরিণত হয় এই যুগে।
প্রতিষেধকের আবশ্যকতা
আসলে ঈদ ঈদই, এবাদত নয়। ঈদের জমাতে দুই রাকাত নামাজের বিধান আছে বলিয়াই ঈদের সমাবেশ প্রার্থনা-সভা হইয়া যায় নাই। নামাজের বিধান করা হইয়াছে বিশেষ এক উদ্দেশ্যে, অভিনব এক ধরনে। এই নামাজের ধরন ও শরিয়তী বিধান একটু তলাইয়া বিচার করিলেই সে বিশেষ উদ্দেশ্য স্পষ্ট বোঝা যাইবে। সে উদ্দেশ্যে সাবধানতা; প্রতিষেধকের ব্যবস্থা। দীর্ঘ সংযমের শেষে যখন মানুষকে ভোগের অধিকার দেওয়া হয়, তখন এই সাবধানতাটুকুর দরকার হয়। মানুষের মনের অবস্থা হয় তখন সদ্যমুক্ত দীর্ঘ দিনের কয়েদীর মতো। তার ভোগ স্পৃহা হয় খাঁচাছাড়া পাখীর মত উদ্দাম। লালসায় আসে তার প্রবল বন্যা, বিপুলা জোয়ার। মানুষ ভাসিয়া যাইতে পারে সে বন্যায়।
সে ইন্দ্রিয় সেবায় উন্মত্ত হইতে পারে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, অতীতে অমন অনেক হইয়াছে। ধর্মীয় আনন্দোৎসব বীভৎস অনাচারের ভৈরবী চক্রে রূপান্তরিত হইয়াছে, তীর্থস্থান ব্যভিচারের আড্ডায় পরিণত হইয়াছে, এমন নজিরে ইতিহাসের পৃষ্ঠা ভর্তি। প্রতিষেধকের সাবধানতা অবলম্বন করা হয় নাই বলিয়াই এসব ঘটিয়াছে।
তাই ইসলামে এই প্রতিষেধকের ব্যবস্থা করা হইয়াছে দুই রাকাত নামাজের বিধান করিয়া। ঈদের উৎসবের সাথে দুই রাকাত নামাজ জুড়িয়া দিয়া শরীয়ত মুসলমানদের শুধু এই কথাটাই স্মরণ করাইয়া দিয়াছে যে, উল্লাসের আতিশয্যে তারা যেন খোদাকে ভুলিয়া না যায়। তাই বলিয়া ঐ দুই রাকাত নামাজে আনন্দোৎসবকে এবাদতের পরব করিয়া ফেলে নাই।
দুই রাকাত নামাজের বিধান করিতে গিয়াও শরীয়ত যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করিয়াছে। নামাজ ধর্মীয় অনুষ্ঠান। ধর্মীয় অনুষ্ঠান গুরু-গম্ভীর ব্যাপার। সে অনুষ্ঠানে আমোদ-প্রমোদ করিলে ধর্মকে লঘু করা হয়। তাকে অসম্মান করা হয়। এই বিশ্বাসে মুসলমানরা ঈদের দিনে আমোদ-উল্লাস হইতে বিরত না থাকে সেই উদ্দেশ্যেই ঈদের নামাজে জুমা ও ওয়াকতিয়া নমাজের আহকাম-আরকান পুরাপুরি প্রয়োগ করা হয় নাই। এটা বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য।
ঈদের নমায বনাম সালাত
এক, ঈদের জমাতের মতো বড় জনসমাবেশের জন্য মাত্র দুই রাকাত নামাজের বিধান করা হইয়াছে। মুসলমান মাত্রেই জানেন যে, দুই রাকাতের কমে নমায হয় না। কাজেই ঈদের নমায স্পষ্টতই সংক্ষেপতম করা হইয়াছে। ঈদ অনুষ্ঠানকে এবাদতের অনুষ্ঠান করিবার ইচ্ছা থাকিলে অন্তত জুমার নমাযের মতো বার রাকাত নমাযের ব্যবস্থা করা হইত।
জুমার নমায হয় সপ্তাহে একবার। ঈদুল-ফিতরের নমায হয় বছরে একবার। বহু জামে-মসজিদের মুসল্লীদের এবং আরও অনেকের সমাবেশ হয় ঈদের ময়দানে। বড় জমাতে এবাদত করিবার এমন সুযোগেও শরিয়তে ফরয নমাযের ব্যবস্থা করা হইল না ঈদের জমাতে। এই বিধান হইতে এটা পরিষ্কার বোঝা যায় ঈদ পর্বকে এবাদতের অনুষ্ঠান করা শরিয়তের অভিপ্রায় নয়। তাড়াতাড়ি ধর্মীয় অনুষ্ঠানটি সারিয়া মুসলমানরা যাতে আনন্দ-উল্লাসে শরিক হইতে পারে সেই উদ্দেশ্যেই সংক্ষিপ্ততম মিনিমাম নমাযের বিধান করা হইয়াছে।
দুই, এই মুগ্ধসর নমাযটুকুকেও ফরয করা হয় নাই। বড়জোর সুন্নাতে- মোয়াক্কেদা করা হইয়াছে। এটা লক্ষ করার বিষয় যে, ধর্মানুষ্ঠান হিসাবে দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত ও সাপ্তাহিক এক ওয়াক্ত জুমার নমাযের যে বিধান করা হইয়াছে তার একটিও ফরয-ছাড়া নয়। শুধু ঈদের নমাযই ফরয-ছাড়া।
তিন, ঈদের দুই রাকাত নমাযকেও সালাতের পূর্ণ মর্যাদা দেওয়া হয় নাই। সালাতের অনেক বাধ্যতামূলক আরকান ঈদের নমাযে নাই। যথা:
- ক. জমাতের নমাযের শুরুতে আযান ও একামত অবশ্যই দিতে হইবে। ঈদের নমাযে আযান ও একামত নিষিদ্ধ।
- খ. ফরয নমায ছাড়া আর কোনো নমায জমাতে অর্থাৎ সমবেতভাবে ইমামের পিছে পড়ার বিধান নাই। কিন্তু ঈদের নমাযটুকু জমাতে ইমামের পিছে পড়িতে হয়।
- গ. সুন্নত নমাযে জোরে কেরাআত পড়া নিষিদ্ধ। কিন্তু ঈদের নমাযে জোরে কেরাআত পড়তে হয়।
- ঘ. ঈদের নির্দিষ্ট দুই রাকাত সুন্নতের অতিরিক্ত কোনও নফল নমায পড়া নিষিদ্ধ।
- ঙ. হায়েজওয়ালী স্ত্রীলোকের জন্য নমায নিষিদ্ধ। অথচ তাদের ঈদের জমাতে শামিল হইবার জন্য তাগিদ করা হইয়াছে।
- চ. জুমার নমাযের খোৎবা খোৎবায়ে-আউয়াল ও খোৎবায়েসানি দুই ভাগে ভাগ করিয়া পড়িতে হয় এবং খোৎবার মাঝখানে বসিতে হয়। কিন্তু ঈদের খোৎবা একটানে পড়িয়া ফেলা যায়।
চার, ঈদের দিনে রোজা রাখা হারাম করা হইয়াছে। অর্থাৎ এই আনন্দের দিনে কোনও মুসলমান আনন্দ-উল্লাস হইতে বিরত থাকিতে পারিবে না; ধর্মের নামেও না। তার মানে এই দিনে আনন্দ-উল্লাস করা বাধ্যতামূলক।
আনন্দের আবশ্যকতা
অতএব দেখা গেল, ঈদের দিনকে শরিয়ত ঈদের দিন হিসাবেই নির্ধারিত করিয়াছে, এবাদতের দিন নির্ধারিত করে নাই। তবু যে আমরা এ দেশে আনন্দের উৎসবকে এবাদতের অনুষ্ঠানে পরিণত করিয়াছি, তার কারণ ঐতিহাসিক। ইতিহাসের গতির অমোঘ আইন অনুসারেই তা ঘটিয়াছে।
ফলে তার অবশ্যম্ভাবী পরিণামও আমাদের ভুগিতে হইয়াছে। আনন্দোৎসবকে এবাদতের অনুষ্ঠানে পরিণত করায় আমাদের জাতির ঘোরতর লোকসান হইয়াছে। ব্যক্তিগত জীবনে যেমন, জাতীয় জীবনেও তেমন, অতিরিক্ত ধার্মিক হওয়া অধর্ম। সব ব্যাপারের মতোই ধর্ম কার্যেও আতিশয্য খারাপ। খেলার সময় খেলা পড়ার সময় পড়ার মতোই এবাদতের সময় এবাদত আমোদের সময় আমোদ, এটা খাঁটি সত্য কথা এবং জীবনের অলঙ্ঘনীয় কানুন। এ কানুন অমান্য করিলে শাস্তি পাইতে হইবে। মানুষের সকল ইন্দ্রিয়-বৃত্তিই আল্লাহর দেওয়া। ও-গুলির অসদ্ব্যবহার করা যেমন পাপ, ব্যবহার না করাও তেমনি পাপ। সে পাপ শুধু পরকালের পাপ নয়, ইহকালের জন্যও।
মানুষের চেতনার কল তিনটিঃ মন, অন্তর ও আত্মা। এর একটিকেও বিকল করা চলে না। তিনটিরই উন্মেষ ও বিকাশ দরকার। তা না হইলে মানব পূর্ণাংগ মানুষ হয় না। আনন্দ এই তিনটি কলের উন্মেষ ও বিকাশের জন্য সমান প্রয়োজন। মানুষের আনন্দের ক্ষুধা তার পেটের ক্ষুধা ও যৌন-ক্ষুধার মতোই বাস্তব ও তীব্র। এ ক্ষুধা মানুষের জৈবগুণ। সুতরাং প্রকৃতি! এই ক্ষুধা মানুষের চেতনার তিনটি যন্ত্রেই পরিব্যাপ্ত।
খোদার সৃষ্টি-কৌশলই এমন যে, মানুষের মনে, অন্তরে ও আত্মায় এমন কোনও ঘটনা ঘটে না যা তার দেহে স্পন্দিত হয় না। এ অবস্থায় মানুষের আনন্দের ক্ষুধাকে দমাইয়া রাখা পেটের ক্ষুধা ও যৌন ক্ষুধা দমাইয়া রাখার মতোই প্রকৃতি-বিরুদ্ধ। অধিক খাওয়াও যেমন স্বাস্থ্য-হানিকর, উপাস থাকাও তেমনি স্বাস্থ্য-নাশক। আনন্দ- ক্ষুধা সম্বন্ধেও এই কথাই সত্য।
এই কারণেই কোনও ধর্মই আনন্দ-উল্লাস নিষিদ্ধ করে নাই। ইসলাম ত করে নাই-ই। আল্লাহর-দেওয়া সমস্ত নিয়ামত উপভোগ করা তাঁরই নির্দেশ। জীবনের আনন্দ হইতে নিজেকে বঞ্চিত রাখার নামই বৈরাগ্য। ইসলামে বৈরাগ্য হারাম।
কিন্তু আমাদের সমাজ-সংস্কারকরা এক হদ ঠেকাইতে গিয়া আর এক হদে চলিয়া গিয়াছেন। এক সীমা রাখিতে গিয়া আরেক সীমা ভাংগিয়াছেন। এক সীমা রাখিতে গিয়া আরেক সীমা ভাংগিয়াছেন। আমোদ-প্রমোদের মধ্য দিয়া পাপচার আসে বলিয়া তাঁরা আমোদ-প্রমোদই নিষিদ্ধ করিয়া গিয়াছেন। এ যেন আংগুরে মদ তৈয়ার বলিয়া আংগুর খাওয়া ও আংগুরের আবাদ বন্ধ করিয়া দেওয়া। আমাদের সমাজপতিরা কিন্তু তাই করিয়াছেন।
এইভাবেই আমাদের উপাস-ভাংগা উল্লাসের উৎসবটা হইয়া পড়িয়াছে প্রার্থনা-সভা। রোজা শেষে ঈদের আনন্দে যেখানে প্রাণ-প্রাচুর্যে আমাদের জীবনের দুকূল ছাপাইয়া পড়া উচিত ছিল সেখানে সেদিনেও আমরা ধর্মভারে নুইয়া গুরু-গাম্ভীর্যের মধ্যে দিন কাটাইবার চেষ্টা করিতেছি।
ধর্মোৎসবের ধর্মটুকু উৎসবের উল্লাস-ধ্বনির নিচে চাপা পড়ার নজির দুনিয়াতে মাত্র একটি। সেটি আমাদের ঈদ। ঈদের দিনে আমরা মাঠে গিয়া দুই রাকাত নামাজ পড়ি। রোদে পুড়িয়া খোৎবা শুনি। কিছু বুঝি, বেশির ভাগই বুঝি না। যা বুঝি তার সবই বহুবার শোনা কথা। মন বসে না।
খোৎবা শেষ হইলে দাঁড়াইয়া আশে-পাশের চিনা-জানা দু’চার-জনকে কোলাকুলি করি। ঘামে ভিজিয়া বাড়ি ফিরিয়া আসি। ভিজা কাপড় ছাড়ি। ব্যস্! ঈদ শেষ।
অখণ্ড মনোযোগে আমরা খোৎবা শুনিয়াছিলাম বলা চলে না। নমাযে আনন্দ পাইবার মত সূফী-দরবেশে আমাদের দেশ ভর্তি, একথাও বলা চলে না। কাজেই নিরস ধর্ম-কাজ করিয়াই বাড়ি ফিরিলাম।
এবার খাওয়ার পালা। ধনী-দরিদ্র-নির্বিশেষে সকল মুসলমানই ঈদের দিনে যার-তার সাধ্যমতো ভাল-ভাল খায়, ভাল-ভাল পরে। এটা অবশ্য ছোট-বড় সব জাতিই করে তাদের উৎসবে। আমরাও করি। কিন্তু মন ও মস্তিষ্কের আনন্দ দিবার মতো কোনও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আমাদের ঈদে নাই। আমাদের আনন্দ খাওয়া-পরার মধ্যে সীমাবদ্ধ। অন্যান্য জাতি হইতে আমাদের পার্থক্য শুধু এইখানে।
এই পার্থক্য কল্যাণকর নয়। আগম-নির্গমে আসা-যাওয়ায় জাতির মনে যে আলোড়ন সৃষ্টি করে বার্ষিক ধর্মীয় উৎসবের আত্মিক গুরুত্ব ও তাৎপর্য শুধু সেইটুকু। সারা বছর ধরিয়া গণ-মন অধীর আগ্রহে এই উৎসবের অপেক্ষা করে। উৎসব-দিবসের নৈকট্যে মাশুকের আগমন সম্ভাবনায় আশেকের বুকের মতোই জাতির বুকে পুলক-স্পন্দন হয়। উৎসব আরম্ভে জাতির দেহের আনন্দ-শিহরণ ও মনের উল্লাস উন্মত্ততায় ফাটিয়া পড়ে। উৎসবের অবসান গণ-মনে জাতীয় চেতনার ছাপ, সংকল্পের রেখা ও কল্পনার রেশ রাখিয়া যায়। আসলে বার্ষিক ধর্মীয় উৎসবের মূল স্পিরিচুয়াল উদ্দেশ্য ইহাই।
আনন্দোৎসবের তাৎপর্য
যে ধর্মীয় উৎসব জাতির মনে যতবেশী স্পন্দন সৃষ্টি ও যত গভীর রেখাপাত করিতে পারে, জাতীয় উৎসব হিসাবে তা তত বেশি সার্থক। ধর্মোৎসবই সকল জতির কৃষ্টি-জীবনের বৃহত্তম উর্বর ক্ষেত্র। ধর্মীয় অনুষ্ঠানের স্কেলিটনের চার পাশ ঘিরিয়া সামাজিক আচার-আচরণ ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের যে লহ-গোশত ও রগ-রেশা গড়িয়া উঠে তারই নাম ধর্মোৎসব। এই ধর্মোৎসবের বিকাশ-বিস্তৃতিই সব জাতির কালচারের ইনফ্রাস্টাকচার। বস্তুত স্থপতি ভাস্কর্য শিল্প-সংগীত কাব্য-সাহিত্য জন্মলাভ করে এই ধর্মোৎসবকে ভিত্তি করিয়াই।
ধর্মোৎসবের বিশেষ গুণ এই যে, এ উৎসবের আয়োজন করে মুষ্টিমেয় ধনীলোকে, কিন্তু তার আনন্দ উপভোগ করে ধনী-নির্ধন সকলে। অন্য ধর্মের লোকও আকৃষ্ট হয়ে সে উৎসবে এবং শরিক হয় সে আনন্দে। এইভাবে উৎসব জাতীয় উৎসবে পরিণত হয়। এই কারণেই যে ধর্মীয় উৎসব গির্জা-মসজিদ-মন্দিরের বাহিরে যত বেশি বিস্তৃত ও প্রসারিত হয় জাতীয় রূপ পাইবার সম্ভাবনা হয় তার তত বেশি।
এই মাপকাঠিতে বিচার করিলে আমাদের আজিকার ঈদ সাংস্কৃতিক আনন্দোৎসব হিসাবে প্রাণহীন এবং জাতীয় উৎসব হিসাবে সম্ভাবনাহীন। আমাদের ঈদে আনন্দ নাই, আছে বেদনা। সংস্কৃতি নাই, আছে বিকৃতি। উল্লাস নাই, আছে আর্তনাদ। সুস্থ স্বাভাবিকরূপে নির্মল আনন্দ উপভোগ করিতে না পারিয়া আনন্দ-পাগল জনসাধারণ তাই পাপের পথে আনন্দ কুড়াইতেছে।
সাংস্কৃতিক আনন্দোৎসবের অভাবে তারা কুস্থানে গিয়া ও ক্লাবে পার্টিতে ‘ঈদ বল’ ড্যান্স করিয়া মুসলিম কৃষ্টিকে বুড়া আংগুল দেখাইতেছে। বিকলাংগ কুষ্ঠরোগী ও বেকার ভিক্ষাজীবী ছেলে-বুড়া নারী-পুরুষ ঈদের মাঠে ও রাস্তাঘাটে ভিড় ও আর্তনাদ করিয়া আমাদের আর্থিক সমাজ-ব্যবস্থাকে ও কৃষ্টিক দারিদ্যকে ধিক্কার দিতেছে। যে সমাজে আনন্দের ব্যবস্থা নাই, সেখানেই পাপ ও অপরাধ বেশি। জেলখানার কয়েদীর সংখ্যাই তার প্রমাণ।
আমাদের সুধী সমাজ ও তরুণরা এটা তীব্রভাবে অনুভব করিতেছেন। তাই তাঁরা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের অভাব দূর করার উদ্দেশ্যে ইদানিং ঈদ-রিইউনিয়নের আয়োজন করিয়া থাকেন। খুবই শুভ সূচনা। কিন্তু এই অনুষ্ঠান আজও খানা-পিনাতেই সীমাবদ্ধ। একে সাংস্কৃতিক অলংকার পরাইয়া তরুণদের প্রমাণ করিতে হইবে যে, আমাদের আনন্দ-উৎসবের চৌহদ্দি পেট নয়।
সাংস্কৃতিক আনন্দোৎসব
অতএব ঈদ উৎসবকে আমাদের সাংস্কৃতিক আনন্দোৎসব ও দেশের জাতীয় উৎসবে পরিণত করা নিতান্ত প্রয়োজন। মুসলমানদের সামাজিক ও আত্মিক কল্যাণের জন্যই এটা দরকার। কাজটা তেমন কঠিন নয়। রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে সুধীজনের উদ্যমে আর্ট-সাহিত্যের মাধ্যমে ধর্মীয় ঐতিহ্যের সাংস্কৃতিক রূপায়ণ সম্ভব। অতীতে তা হইয়াছে। আমাদের বেলায়ও তা হইতে পারে।
ধর্মের বিধান রদ-বদল করার মতো এখতেলাফী কাজে হাত দিবার কোনও দরকার হইবে না। মিলাদ অনুষ্ঠানের মতো কিছু কিছু বেদআতুল-হাসানার প্রবর্তন করিলেই চলিবে। গ্রগতিবাদী ওলামাসহ সুধী-সমাজ সহজেই এটা করিতে পারেন। হযরত ইব্রাহিমের কোরবানির স্বপ্ন, হযরত মোহাম্মদের নবুওত, হিজরত, মেয়ারাজ, জংগে-বদর, মক্কা বিজয়, বিদায়ী হজ ইত্যাদি স্মরণীয় ঐতিহাসিক ঘটনাকে আর্টের অলংকারে ভূষিত করিয়া দুই ঈদের উপযোগী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানরূপে প্রবর্তন করা যাইতে পারে। ঈদ-উৎসব দুইটিকে একদিন সমাপ্ত না করিয়া আমাদের মোহরম, হিন্দুদের দুর্গোৎসব, খৃষ্টানদের বড় দিন ও বৌদ্ধদের মাঘী পূর্ণিমার মতো একাধিক দিনে ব্যাপ্ত করা যায়।
শুধু এইভাবেই আমরা ধর্মীয় ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানকে নির্মল আনন্দের অফুরন্ত প্রস্রবণে পরিণত করিতে পারি এবং সে আনন্দ-রসের আবেহায়াতে গণমনকে সঞ্জীবিত এবং সমাজকে অপরাধমুক্ত রাখিতে পারি। ঈদ-রিইউনিয়ন, ঈদ-মেলা, ঈদ-জশন, ঈদ-যিয়াফত, ঈদ-মিছিল এই ধরনের যে কোনও নামে আমরা দুইটি ঈদকে প্রাণ-প্রাচুর্যের সাংস্কৃতিক আনান্দোৎসবে রূপায়িত করিয়া পাক-বাংলার আসমান-জমিন উল্লাস-মুখর ও জনগণের জীবন পুল্যকোজ্জ্বল করিতে পারি। আমাদের তরুণ চিন্তাবিদরা, লেখক-সাহিত্যিকরা এদিকে মনোযোগ দিবেন কি?
১লা শওয়াল, ১৩৮৪ হিজরি।