রবিউল আউয়ালের বরকত ও কল্যাণ
সম্মানিত উপস্থিতি! রবিউল আউয়াল মাসের আগমন আমাদের সকলের জন্য উৎসব ও খুশীর বার্তা বয়ে নিয়ে আসে। কেননা তখন আমাদের মনে পড়ে যায় যে, এই মাসেরই প্রাথমিক সপ্তাহগুলোতে ‘আল্লাহর সর্বব্যাপী রহমত‘ দুনিয়ায় প্রকাশ লাভ করেছিলো। আর ইসলামের সত্য আহবায়কের আবির্ভাবের কারণে দুনিয়ার যাবতীয় দুঃখ-ব্যথা ও জ্বালা-যন্ত্রণার অবসান ঘটেছিল।
তোমরা আনন্দ ও খুশীতে আত্মহারা হয়ে উঠো। তোমাদের অন্তরে আল্লাহর সত্য নবীর প্রেম-ভালবাসা এক অভাবিত আগ্রহ-উদ্দীপনার সৃষ্টি করে। তোমরা তোমাদের অধিক থেকে অধিকতর সময় তাঁকে স্মরণ করে এবং তাঁরই ভালোবাসার খুশীতে কাটিয়ে দিতে চাও।
তোমরা তাঁর আলোচনা ও চিন্তার মজলিসসমূহের আয়োজন কর। ঐ মজলিসের সাজসজ্জার কাজে, আপন কায়িক শ্রমের বদলে প্রাপ্ত অর্থসম্পদ বিনা দ্বিধায় খরচ কর। সুগন্ধিযুক্ত তরতাজা ফুলের তোড়া তৈরী কর, কাফুর মিশ্রিত সুন্দর প্রদীপমালা এবং বিজলী বাতির আকর্ষণীয় ঝাড় প্রজ্জ্বলিত কর। আতর ও গোলাপের মিষ্টি গন্ধে যখন তোমাদের মজলিস ভরপুর হয়ে উঠে তখন তোমরা আল্লাহর প্রশংসা–প্রশস্তি এবং দরূদ ও সালামের সুমধুর সুর ধ্বনির মধ্যে আপন মাহবুব ও একান্ত প্রিয় জনের (প্রিয় নবীর) সন্ধান কর। আর এই মুহূর্তগুলোতে তোমাদের চোখের অশ্রু ও তোমাদের প্রেমাসক্ত অন্তরের আকুতি তাঁর পবিত্র নাম, তাঁর অপরিসীম ভালবাসা থেকে রূহানী জীবন লাভ করে।
অতএব কত মহান ঐসব ব্যক্তির অন্তর, যারা আপন প্রেম-ভালবাসার জন্য আসমানসমূহ ও যমীনের মাহবুব (প্রিয়জন)-কে নির্বাচন করেছে এবং কত পাকপবিত্র ঐ জিহ্বাগুলো, যেগুলো রাসূলগণের সর্দার ও সমগ্র বিশ্বের রহমতের প্রশস্তিগীতিতে সুরে ভরে উঠে।
তারা তাদের প্রেম-ভালবাসার জন্য সেই সত্তাকেই বেছে নিয়েছে, খোদ আল্লাহ্ তা’আলা যার প্রশংসা করেছেন। আর তাঁর সুর সুরে মিলিয়েছে ফিরিশতারা, সৃষ্টিজগতের পবিত্র আত্মারা এবং পুণ্যবান বান্দারা।
إِنَّ اللَّهَ وَمَلَئِكَتَهُ يُصَلُّونَ عَلَى النَّبِي طيايُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا صَلُّوا عَلَيْهِ وَسَلِّمُوا تَسْلِيمًا.
“আল্লাহ্ নবীর প্রতি অনুগ্রহ করেন এবং তার ফেরেশতারাও নবীর জন্য অনুগ্রহ প্রার্থনা করেন। হে মুমিনগণ, তোমরাও নবীর জন্য অনুগ্রহ প্রার্থনা কর এবং তাঁকে যথাযথভাবে সালাম জানাও।” (৩৩:৫৬)
সৃষ্টি জগতের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রেমাস্পদ
এতে কোন সন্দেহ নেই যে, নবীর প্রেম-ভালবাসার পবিত্র জোয়ার এবং এর পবিত্রতম আগ্রহ-উদ্দীপনা তোমাদের জীবনের সর্বাধিক মূল্যবান সম্পদ। আর তোমরা নিজেদের এই পবিত্র প্রেরণার, যত বেশী হিফাযত করবে তা কম বলে মনে হবে। তোমাদের এই আল্লাহ্ প্রেম, তোমাদের প্রভু পরওয়ারদিগারের ভালবাসার প্রতীক, তোমাদের এই প্রেমাসক্ততা তোমাদের মানবিক সৌভাগ্য ও সরল পথ অবলম্বনের উৎসমূল। তোমরা সেই পাক-পবিত্র সত্তাকে ভালবাসো, যাকে আল্লাহ্ তা’আলা সমগ্র মানব সৃষ্টির মধ্য থেকে প্রিয়জন ও প্রশংসিতজন হিসাবে বেছে নিয়েছেন এবং বিশ্বের প্রিয়জনের পবিত্র পরিচ্ছদ তাঁরই পবিত্র দেহে এঁটে দিয়েছেন। ভূপৃষ্ঠে মানুষের জন্য বৃহৎ থেকে বৃহত্তর যে কথা লেখা যেতে পারে, মানুষের প্রতি যতটুকু অধিক থেকে অধিকতর ভালবাসা নিবেদন করা যেতে পারে, মানুষের জন্য সর্বাধিক প্রশংসা-প্রশস্তি, যা ভাষায় ব্যক্ত করা যেতে পারে- মোটকথা, মানুষের ভাষা মানুষের জন্য যা কিছু বলতে পারে এবং যা কিছু করতে পারে, তার সব কিছুই এই পরিপূর্ণ ও পরিপূর্ণতম মানুষের জন্য। আর এগুলো পাবার যোগ্য তিনি ছাড়া আর কেউ নন। একজন ফারসী কবি কী সুন্দর না বলেছেন!
“হারাম শরীফ আমার ইবাদতগাহ
আর দু’জাহানের হাবিব আমার লক্ষ্যবস্তু।
আমি যেখানে সিজদা করি না কেন,
তা করি আল্লাহর দরবারের উদ্দেশ্যে।”
আরবী কবি কত সুন্দরই বলেছেন-
عبارتنا شتى وحسنك واحد – وكل الى ذالك الجمال يشير .
“আমাদের বাক্য বিভিন্ন; কিন্তু তোমার সৌন্দর্য এক, প্রত্যেকটি বস্তুই তোমার এই সৌন্দর্যের দিকে ইঙ্গিত করে।”
সর্বোত্তম বান্দা
ইলাহ্ ও রব হিসাবে আল্লাহ্ তা’আলা যেমন এক ও অংশহীন; অনুরূপভাবে পরিপূর্ণ মানুষের সর্বশ্রেষ্ঠ মানবতা ও সর্বশ্রেষ্ঠ বন্দেগীর গুণও এক ও অবিভাজ্য। তাঁর মানবতা ও বন্দেগীতে কেউই তাঁর সমান নয়। আর তাঁর একক সৌন্দর্যেও কেউ শরীক নয়।
منزه عن شريك في محاسنه فجوهر الحسن فيه غير منقسم
“তিনি তার সৌন্দর্যাবলির ক্ষেত্রে শরীক থেকে পবিত্র। অর্থাৎ তার এই সৌন্দর্যাবলির মধ্যে কোন শরীক নেই। তার সৌন্দর্যগুণের মধ্যে কোন ভাগ-বাটোয়ারা হয় নি। তাই অন্য কেউ এ থেকে কোন অংশ পায় নি।”
এ কারণেই কোরআন মজীদে আমরা দেখি যে, সমগ্র আম্বিয়া কিরামের উল্লেখ যেখানে করা হয়েছে, সেখানে তাঁদেরকে তাঁদের নাম ধরে আহবান করা হয়েছে এবং যেখানে তাঁদের ঘটনাবলি উল্লেখ করা হয়েছে, সেখানেও তাঁদের নামসহ তা উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু এই পরিপূর্ণ মানুষ, এই পরিপূর্ণ সত্তা এবং বান্দা হিসাবে যাবতীয় গুণাবলির ক্ষেত্রে শরীকহীন একক এর উল্লেখ বিভিন্ন জায়গায় এভাবে করা হয়েছে যে, না তাঁর নাম নেওয়া হয়েছে, আর না অন্য কোন গুণে তাঁর নামকরণ করা হয়েছে। বরং শুধু ‘আবদ’ (বান্দা) শব্দ দ্বারা তাঁর প্রভু তাঁকে স্মরণ করেছেন। যেমন-
سُبْحَانَ الَّذِي أَسْرَى بِعَبْدِهِ لَيْلاً مِّنَ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ إِلَى الْمَسْجِدِ الْأَقْصَى
“পবিত্র ও মহিমাময় তিনি, যিনি তার বান্দাকে রাত্রে ভ্রমণ করিয়েছিলেন মসজিদুল হারাম হতে মসজিদুল আকসায়।” (১৭: ৪১)
সূরা জিনে আল্লাহ্ বলেন,
يَكُونُونَ عَلَيْهِ لِبَدًا . وَأَنَّهُ لَمَّا قَامَ عَبْدُ اللهِ يَدْعُوهُ كَادُوا
“আর এই যে, যখন আল্লাহর বান্দা (মুহাম্মদ) তাঁকে ডাকার জন্য দন্ডায়মান হলেন তখন তারা তাঁর কাছে ভিড় জমালো।” (৭২: ১৯)
এ আয়াত দ্বারা সূরা কাহফ শুরু করা হয়েছে-
الْحَمْدُ لِلَّهِ الَّذِي أَنْزَلَ عَلَى عَبْدِهِ الْكِتٰبَ وَلَمْ يَجْعَلْ لَهُ عِوَجًا
“প্রশংসা আল্লাহরই, যিনি তাঁর বান্দার প্রতি এই কিতাব অবতীর্ণ করেছেন এবং এতে বক্রতা রাখেন নি।”-(১৮: ৪১)
সূরা ফুরকানের প্রথম আয়াত হচ্ছে-
تَبْرَكَ الَّذِي نَزَّلَ الْفُرْقَانَ عَلَى عَبْدِهِ لِيَكُونَ لِلْعُلَمِينَ نَذِيرًا.
“কত মহান তিনি, যিনি তাঁর বান্দার প্রতি ফুরকান নাযিল করেছেন, যাতে তিনি বিশ্বজগতের জন্য সর্তকারী হতে পারে।” -(২৫: ৪১)
এভাবে সূরা নাজম এ আল্লাহ বলেন-
فَاوْحَى إِلَى عَبْدِهِ مَا أَوْحَى
“তখন আল্লাহ তাঁর বান্দার প্রতি যা ওহী করার তা ওহী করলেন।” (৫৩: ১০)
সূরা হাদীদে বলা হয়েছে-
هُوَ الَّذِي يُنَزِّلُ عَلَى عَبْدِهِ أَيْتِ بينت
“তিনিই তার বান্দার প্রতি সুস্পষ্ট আয়াত অবতীর্ণ করেন।” -(৫৭: ৪৯)
উপরোক্ত স্থানগুলোতে রাসূলুল্লাহ (সা) এর নাম নেওয়া হয়নি; বরং নামের পরিবর্তে আবদ বা বান্দা বলা হয়েছে। অথচ অন্যান্য নবীদের ক্ষেত্রে আবদ শব্দ ব্যবহার করা হলেও সেই সাথে তাঁদের নামও পরিষ্কার উল্লেখ করা হয়েছে।
সূরা মারইয়ামে হযরত যাকারিয়ার জন্য ব্যবহার করা হয়েছে-
ذكر رحمتِ رَبِّكَ عَبْدَهُ زَكَرِيَّا
“এই আপনার প্রতিপালকের অনুগ্রহের বিবরণ তার বান্দা যাকারিয়ার প্রতি।” -(১৯: ৪২)
সূরা সোয়াদে হযরত দাউদ সম্পর্কে বলা হয়েছে-
وَاذْكُرْ عَبْدَنَا دَاود
“এবং স্মরণ করুন আমার বান্দা দাউদের।” (৩৮: ১৭)
ঐ সূরাতেই হযরত আইয়ুব (আ) সম্পর্কে বলা হয়েছে-
وَاذْكُرْ عَبْدَنَا أَيُّوب
“স্মরণ করুন, আমার বান্দা আইয়ুবকে।” (৩৮: ৪১)
রাসূলুল্লাহ (সা) এর বৈশিষ্ট্য
এই বৈশিষ্ট্য দ্বারা এ তত্ত্বটি বিশ্লেষণ করা আল্লাহর উদ্দেশ্য ছিলো যে, এই মহান সত্তার (রাসূলুল্লাহর) আবদিয়াত ও বন্দেগী সেই পর্যায়ে পৌঁছে গেছে, যা মনুষ্যত্বের একেবারে চূড়ান্ত পর্যায় এবং সে পর্যায় কোন বান্দাই এই কামিল বান্দার শরীক ও অংশীদার নয়। অতএব বান্দা হিসাবে তিনি হচ্ছেন পরিপূর্ণ সত্তা। সুতরাং কোনরূপ সম্বন্ধ-সম্পর্ক যুক্ত না করেই শুধুমাত্র ‘আবদ্’ বা বান্দা উপাধি দ্বারাই তাঁকে চেনা যায়। কেননা সমস্ত সৃষ্টি জগতের মধ্যে তাঁর মত আবদু বা বান্দা দ্বিতীয় নেই।
বান্দা হিসাবে যেমন তিনি অতুলনীয়, তেমনি আল্লাহর মাহবুব হিসাবেও তিনি অদ্বিতীয়। আল্লাহ তা’আলা তাঁর রহমতকে সমগ্র বিশ্বের উপর পরিব্যাপ্ত করে দিয়েছেন। আল্লাহ্ তা’আলা যেমন নিজেকে ‘আর রাহমান আর রাহীম’ বিশেষণ দ্বারা বিশেষিত করেছেন, তেমনি মুহাম্মদ (সা) কে ‘বিল মুমিনীনা রাউফুর রাহীম‘ বিশেষণ দ্বারা বিশেষিত করেছেন। কুরআন মজীদের কোথাও তাঁকে নাম ধরে সম্বোধন করেননি, বরং তাঁকে কখনো ‘ইয়া আইয়ুহার রাসূল‘ কখনো ‘ইয়া আইয়ুহাল মুযযামমিল‘ কখনো ‘ইয়া আইয়ুহাল মুদ্দাসসির‘ প্রভৃতি সম্মানিত উপাধিতে সম্বোধন করেছেন। আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁর প্রতি সম্মানপ্রদর্শনকে যেমন বান্দাদের উপর ফরয করেছেন তেমনি তাঁদের উপর ফরয করেছেন রাসূলের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করাকে। রাসূলের ভালোবাসা প্রদর্শনের অবস্থা এই যে, তিনি যে লোকালয়ে বসবাস করেছেন, যে শহরের গলি দিয়ে চলাফেরা করেছেন, সে লোকালয় এবং সে শহরের সম্মানও আল্লাহ তা’আলা সমগ্র বিশ্বের সামনে প্রকাশ করে দিয়েছেন। যেমন-
لَا أُقْسِمُ بِهَذَا الْبَلَدِ ، وَأَنْتَ حِلٌّ بِهَذَا الْبَلَدِ
“শপথ করছি এই নগরের, আর আপনি এই নগরের অধিবাসী।” (৯০: ১-২)
অতএব যার পবিত্রতা ও একক বৈশিষ্ট্যের এই অবস্থা, তাঁর স্মরণে যতগুলো মহূর্ত ব্যয় করা হোক, তাঁর প্রেমে যত অশ্রু ভাসানো হোক, তাঁর ভালবাসায় যত দীর্ঘশ্বাস ফেলা হোক, তাঁর প্রশংসা-প্রশস্তিতে জবান যত আন্দোলিত হোক, ততই মনুষ্যত্বের মর্যাদা, আত্মার সৌভাগ্য ও অন্তরের পবিত্রতা লাভ করা যাবে। একজন ফারসী কবি কী সুন্দরই না বলেছেন।
“যে পদযুগল দ্বারা তোমার পথ অতিক্রম করি তা উত্তম,
যে উসীলা বা মাধ্যম দ্বারা তোমার মিলনের
সন্ধান করি তাও উত্তম,
যে চোখ দ্বারা তোমার চেহারা দেখি তাও উত্তম,
যে যবান দ্বারা তোমার নাম উচ্চারণ করি
তাও উত্তম।”
পাওয়ার উৎসব ও হারানোর শোক
কিন্তু যখন তোমরা এই পবিত্র মাসে এসব কিছু কর এবং এই মাসে জন্মের ঘটনা সংঘটিত হওয়ার কারণে আনন্দ-উল্লাস করো, তখন এই আনন্দ-উল্লাসের মধ্যে তোমাদের কি ঐ মাতমের কথাও স্মরণ পড়ে, যা ছাড়া তোমাদের কোন খুশী হতে পারে না? কখনো তোমরা কি এই হাকীকতের প্রতি লক্ষ্য করেছ- এটা কার জন্মোৎসব, যার স্মরণে তোমরা নানা উদ্যোগ-আয়োজন কর? তিনি কে ছিলেন, যার জন্মের স্মরণে তোমরা এই আনন্দ-উৎসবের পয়গাম লাভ করেছ?
এতে সন্দেহ নেই যে, এই মাসের আগমন তোমাদের জন্য আনন্দের পয়গামবাহী। কেননা এই মাসে সেই সত্ত্বার আগমন হয়েছে, যিনি আমাদের সবকিছু দিয়েছেন। অতএব আমাদের জন্য এর চাইতে অধিক মাতম করার আর কোন মাস নেই। কেননা এই মাসে জন্মগ্রহণকারী সত্তা আমাদেরকে যা কিছু দিয়েছিলেন, তার সবকিছু আমরা হারিয়ে ফেলেছি। অতএব এই মাস একদিকে যেমন দাতার স্মরণকে সঞ্জীবিত করে, অন্যদিকে তেমনি যারা এই দাতার দানকে খুইয়ে বসেছে, তাদের ক্ষতস্থান পুনরায় দগদগে হয়ে উঠে।
মজলিসসমূহ আলোকিত, কিন্তু অন্তর অন্ধকার
তোমরা মজলিস অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করে তোমাদের ঘরসমূহ আবাদ করো, কিন্তু তোমাদের অন্তরের উজাড় বসতির কোন খোঁজ কি তোমরা রাখো? তোমরা কাফুর মিশ্রিত প্রদীপে ঝাড়বাতি প্রজ্জ্বলিত কর, কিন্তু তোমাদের অন্তরের অন্ধকার দূর করার জন্য কি কোন প্রদীপের সন্ধান কর? তোমরা ফুলের তোড়া সাজাও, কিন্তু হায়। তোমাদের সুকর্মের ফুল যে শুকিয়ে ঝরে পড়েছে। তোমরা গোলাপ জল ছিটিয়ে তোমাদের রুমাল ও জামা সুগন্ধিযুক্ত কর, কিন্তু হায়! ইসলামের মাহাত্ম্যের প্রতি লক্ষ্য করার সুবাস থেকে সকাল-সন্ধ্যা তোমরা যে বঞ্চিত। হায়। তোমাদের এই সব মজলিস যদি অন্ধকারাচ্ছন্ন থাকত, তোমাদের ইট চুনের তৈরী ঘরগুলোতে সাজ সজ্জার একটুখানি পরশও না লাগত, তোমাদের চোখগুলি এই মজলিসে সারারাত জেগে না থাকত এবং তোমাদের যবানসমূহ থেকে রবিউল আউয়াল মাসের জন্মোৎসব সম্পর্কে দুনিয়াবাসী কিছুই না শুনতো- আর এগুলোর পরিবর্তে তোমাদের আত্মা আবাদ ও সঞ্জীবিত থাকত, তোমাদের যবানসমূহ থেকে নয়, বরং তোমাদের আমল ও কাজকর্ম থেকে রাসূলুল্লাহ (সা) এর অনুপম চরিত্রের প্রশংসা ও প্রশস্তি গীতির সুরলহরী ভেসে উঠত তাহলে কতই না ভাল হত।
পবিত্র কোরআনের ভাষায়-
فَإِنَّهَا لا تَعْمَى الْأَبْصَارُ وَلَكِنْ تَعْمَى الْقُلُوبُ الَّتِي فِي الصُّدُورِ
“বস্তুতঃ চক্ষুতো অন্ধ নয়, বরং, অন্ধ হচ্ছে বক্ষস্থিত হৃদয়।”-(২২: ৪৬)
জনৈক কবির ভাষায়-
“আমার ভয়, জীবন্ত হৃদয় তুমি যেন মরে না যাও,
কেননা তোমার জীবিত থাকার নামই তো জীবন।”
অতএব আক্ষেপ, হাজার আক্ষেপ ঐ জাতির অন্যমনস্কতা ও অজ্ঞতার জন্য, যাদের প্রত্যেকটি অনুষ্ঠান ও প্রত্যেকটি মজলিস দুঃখের পয়গাম বয়ে নিয়ে আসে, কিন্তু না তারা তাদের অতীতের গৌরবোজ্জ্বল ঘটনা থেকে কোন উপদেশ গ্রহণ করে, আর না ভবিষ্যতের অন্ধকারের মধ্যে নিজেদের জীবন পথে কোন আলো প্রজ্জ্বলিত করে। তারা তাদের অনুষ্ঠানের ব্যবস্থাপনায় ডুবে থাকে, এদিক-সেদিক তাকাবার মোটেই অবসর পায় না, অথচ তাদের এই অনুষ্ঠানের প্রত্যেকটি দরূদে ও প্রত্যেকটি বাক্য মাতমের ও উপদেশ গ্রহণের একটি উদাত্ত পয়গাম ও শিক্ষা গ্রহণের একটি মরমী আকুতি নিহিত থাকে। কিন্তু এগুলো উপলব্ধি করার পূর্বশর্ত হলো, যেন চোখ খোলা থাকে, যেন কান শুনে এবং যেন অন্তর সতর্ক ও সাবধান হয়।
إِنَّ فِي ذَلِكَ لِذِكْرِى لِمَنْ كَانَ لَهُ قَلب أو القى السَّمْعَ وَهُوَ شَهِيدٌ
“এতে উপদেশ রয়েছে তার জন্য, যার আছে অন্তঃকরণ অথবা যে শ্রবণ করে নিবিষ্ট চিত্তে।” (৫০: ৩৭)
পয়গম্বরের আবির্ভাব ও আবির্ভাবের উদ্দেশ্য
রবিউল আউয়াল মাসের স্মরণে আমাদের জন্য খুশীর পয়গাম ছিলো এজন্য যে, এই মাসে আল্লাহ্ তা’আলার সেই রহমতের ফরমান দুনিয়ায় এসেছিল, যার আত্মপ্রকাশ দুনিয়ার দুর্ভাগ্য ও বঞ্চনার ধারা বদলে দিয়েছিল। মিটে গিয়েছিল জুলুম, বাড়াবাড়ি, ফিতনা-ফাসাদ ও নাফরমানীর অন্ধকার। আল্লাহ্ এবং তার বান্দাদের বিচ্ছিন্ন সম্বন্ধ জোড়া লেগেছিলো, মানুষের ভ্রাতৃত্ব ও সাম্যের আহবান শত্রুতা হিংসা-বিদ্বেষকে মুছে ফেলেছিলো এবং কুফর ও পথভ্রষ্টতার স্থলে ন্যায় ও সত্যের বাদশাহীর সাধারণ ঘোষণা প্রদান করা হয়েছিলো।
قَدْ جَاءَكُمْ مِنَ اللهِ نُورُ وَكِتَبُ مُّبِينٌ يَهْدِي بِهِ اللَّهُ مِنَ اتَّبَعَ رِضْوَانَهُ سُبُلَ السَّلْمِ وَيُخْرِجُهُمْ مِنَ الظُّلُمتِ إِلَى النُّورِ بِإِذْنِهِ وَيَهْدِيهِمْ إِلَى صِرَاطٍ مُّسْتَقِيمٍ.
“আল্লাহর নিকট হতে এক জ্যোতি ও স্পষ্ট কিতাব তোমাদের কাছে এসেছে। যারা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করতে চায়, এর দ্বারা তিনি তাদেরকে শান্তির পথে পরিচালিত করেন এবং নিজ অনুমতিক্রমে অন্ধকার হতে বের করে আলোর দিকে নিয়ে যান এবং ওদেরকে সরল পথে পরিচালিত করেন।”(৫: ১৫-১৬)
কিন্তু দুনিয়া দুর্ভাগ্য ও বঞ্চনার ব্যথায় পুনরায় ব্যথিত হয়ে উঠেছে। মানুষের ফিতনা ফাসাদ, অত্যাচার ও বাড়াবাড়ির অন্ধকার আল্লাহর আলোর উপর প্রাধান্য লাভের জন্য পুনরায় চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়েছে। ন্যায় ও সত্যের খ্যাতি উজাড় হয়ে গেছে এবং বিক্ষিপ্ত মানবগোষ্ঠীকে রক্ষা করার মত কেউ নেই। আল্লাহর যমীন, যা শুধু আল্লাহর জন্যই ছিল, তা অপরকে দিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং যারা হক ও আদালতের পক্ষপাতী, যমীনের উপর আজ তাদের কোন অস্তিত্ব নেই।
ظَهَرَ الْفَسَادُ فِي الْبَرِّ وَالْبَحْرِ بِمَا كَسَبَتْ أَيْدِي النَّاسِ .
“মানুষের কৃতকার্মের দরুণ সমুদ্রে ও স্থলে বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়ে।” (৩০: ৪১)
দুঃখের বিষয়, তোমরা তাঁর আগমন উপলক্ষ্যে আনন্দোৎসব করো, কিন্তু তাঁর আগমনের লক্ষ্যের কথা ভুলে যাও। যে উদ্দেশ্যে তাঁর আবির্ভাব হয়েছিলো, সেদিকে তোমাদের কোন দৃষ্টি নেই।
এই রবিউল আউয়াল মাস যদি তোমাদের জন্য খুশীর মাস হয়, তাহলে তা শুধু এজন্য যে, এই মাসে বিশ্বের পথভ্রষ্টতার অবসান হয়েছে এবং কালিমায়ে হক প্রচারের সূচনা হয়েছে। অতএব আজ যদি বিশ্বের ন্যায়-সতা পথ-ভ্রষ্টতার চাপে মৃতপ্রায় হয়ে গিয়ে থাকে, তাহলে আলস্যের পূজারীরা, তোমাদের কি হয়ে গেলো যে, তোমরা আনন্দোৎসবের অনুষ্ঠান পালন করো, কিন্তু যে ন্যায় ও সত্যের আবির্ভাবের জন্য এই আনন্দোৎসব, সে মৃতপ্রায় আদালত ও হককে পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য তোমাদের অন্তরে কোন উদ্যোগ নেই।
অনুবাদঃ মাওলানা আব্দুল মতীন জালালাবাদী।
[মাওলানা লিখিত বক্তৃতা প্রদানে অভ্যস্ত ছিলেন না। তিনি একদা বলেছিলেন, যা বলার তা চিন্তায় রেখে দাঁড়িয়ে যাই। রবিউল আউয়াল হিজরী ১৩৩৫ সনের (মুতাবিক জানুযারী, ইং ১৯১৬ সনের) কথা। কোলকাতার কোন এক সভায় মাওলানা সীরাতের উপর একটি ভাষণ দেন। ঐ সময়ে ‘আল বালাগ’ প্রকাশিত হয়ে গিয়েছিল এবং তিনি এর একটি সংখ্যা (১৪, ২১ ও ২৮ জানুয়ারী, ইং ১৯১৬ সন) শুধু ‘বিলাদতে নবভী’ এর জন্য উৎসর্গ করে দিয়েছিলেন। খুব সম্ভবতঃ এই ভাষণটিও তিনি ঐ সংখ্যায় প্রকাশ করেন। এর দ্বারা সীরাতের কোন কোন গুরুত্বপূর্ণ দিক যে অত্যন্ত আলোকিত হয়ে উঠে, তা কাউকে বুঝিয়ে বলার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না। সংক্ষেপে বলতে গেলে, এই ভাষণের মধ্যে সীরাতে তাইয়িবার মৌলিক দিকগুলো যে অপরূপ ভঙ্গিতে তুলে ধরা হয়েছে, সেরূপ ভঙ্গিতে কেউ আজ পর্যন্ত পেশ করতে পারেন নি।]