ব্রিটিশ পূর্ব মুসলিম শাসনামলে বাঙালায় রাষ্ট্রভাষা ছিল দু’টি তার একটি ফারসী, অপরটি বাঙালা

আধুনিক বাঙালা ভাষা ও সাহিত্যের পাঠকমাত্রেই জানেন ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে রক্ত ঝরিয়ে বাঙালা ভাষার রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি আদায় করা হয়। আর সরকারি কাজে বাঙালা ভাষার ব্যবহার শুরু হয় তারও অনেক পরে ১৯৭১ সালে যুদ্ধের মাধ্যমে আজাদী অর্জনের পর। কিন্তু আজ পর্যন্ত যে কথাটি কেউ জানেন না-তা হল বাঙালা ভাষার আদি রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও সরকারি কাজে তার ব্যবহার ব্রিটিশ -পূর্ব মুসলিম শাসনামলেই ঘটে। সম্ভবত: ১৩৫১ সালে লোয়ার ও আপার বেঙ্গল তথা ‘বঙ্গাল’ ও ‘গৌড়’ মিলিয়ে একটি একক দেশ গঠন করার সময় থেকে মুসলিম শাসকগণ-ই বাঙালা ভাষার এমন অচিন্ত্যনীয় রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দেন এবং সরকারি কাজে তা ব্যবহারেরও ব্যবস্থা নেন। ঠিক কবে থেকে বাঙালা ভাষার এই অপূর্ব খুস নছিবের সূচনা হয়, তা দিন তারিখ দিয়ে বলা না গেলেও এ তরফে যে সব নমুনা নিশানা। জোগাড় করা গিয়েছে তা থেকে দেখা যায়; সতের শতকের পয়লা দশক থেকেই বাঙালা ভাষার এমন রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও সরকারি ব্যবহার ঘটে চলেছে। এ সময় থেকে আঠারো শ সাতান্ন সাল পর্যন্ত তো বটেই; এমন কি, তারপরও বহুকাল ১৯২০? অবধি অন্য সব ‘রাষ্ট্রভাষা’ রূপে তথা সরকারি ভাষা হিসাবে বাঙালা বহাল ছিল। অফিস আদালতে সে ভাষা ব্যবহৃতও হত। এসবের মাঝে মুসলিম আমলে, বিশেষ করে ১৭১০ সাল থেকে ১৯৬৫ সাল অবধি সরকারি ভাবে বাঙালা ভাষা ব্যবহারের যে সব নমুনা পাওয়া গিয়েছে তার দরমিয়ানে রয়েছে সরকারি সইমোহর খচিত প্রায় পঞ্চাশটি নমুনা। সরকারি অফিসারদের সই-সীল করা এসব নমুনার ঐতিহাসিক ও ভাষাতাত্ত্বিক মূল্য অসীম কারণ আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত বাঙালী মাত্রই জানেন; ব্রিটিশ ও তার পূর্ববর্তী আমলে নাকি মুসলমানরা বাঙালা ভাষাকে আপন ভাষা বলে গণ্য করত না। বাঙালা ভাষা জানত না, শিখত না; পড়ত না। উর্দূই ছিল তাদের প্রিয় ভাষা তথা আপন ভাষা। এ ব্যাপারে তারা নবাব আবদুল লতীফ প্রভৃতির নজীর দিয়ে বলেন- মুসলিম অভিজাত শ্রেণী চিরকাল বাঙালাকে ঘৃণা করে এসেছে, আর সেই ধারায় ১৯৪৭ সালে দেশভাগ হবার পর, তখনকার পূর্ব পাকিস্তানে উর্দূকেই রাষ্ট্রভাষা করার অপচেষ্টা দেখা দেয়। বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে মুসলিম অভিজাত শ্রেণীর এই ভূমিকার কথা যে সঠিক ও তথ্যভিত্তিক নয়; সে বিষয়ে বেশী কিছু বাহাছের আনজাম না করেই একথা বলা যায়- মুসলিম আভিজাত শ্রেণীর এক বিরাট অংশ দীর্ঘকাল অব্যাহত ভাবে বাঙালা ভাষার চর্চা করে এসেছেন । মুসলমান সুলতান, সিপাহসালার, উজীর-নাজির, নবাব দেওয়ানরা কেবল সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতা দানের মধ্যেই নিজেদের বাঙালা-প্রীতিকে সীমাবদ্ধ রাখেন নি; সেই সাথে এই ভাষার ‘রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি’ ও ‘সরকারি ব্যবহারকেও নিশ্চিত করেন। এক্ষেত্রে তারা দরবারে যেমন মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে দরবারী কবিদের নানা ভাষা থেকে কাব্যানুবাদে উৎসাহ দেন তেমনি দৈনন্দিন জীবনের মত রাষ্ট্রীয় জীবনেও বাঙালা ভাষার  ব্যবহারকে তাজিমের সাথে এস্তেমাল করেন। তাঁরা একদিকে যেমন আরবী ফারসি ভাষার ব্যবহার করেছেন; অন্যদিকে তেমনি অনুমোদন করেছেন ফার্সি-বাঙালা’ এবং সংস্কৃত- বাঙালারও ব্যবহার। তাই খেয়াল করলে দেখা যায়- মুসলিম শাসকগণ মসনদ লাভের সময় থেকেই মুদ্রা, মসজিদ ও কবরের শিলালিপি প্রস্তুতিতে ব্যবহার করেছেন আরবী লিপি, আরবী ভাষা ও আরবী বাক্য; আর উচ্চ পর্যায়ের রাষ্ট্রীয় কাজে, সই মোহরে (Scal-এ) স্বাক্ষর দানে (Signature-এ) কিংবা মন্তব্য লেখনে ব্যবহার করেছেন ফার্সি লিপি, ফার্সি ভাষা ও ফার্স বাক্য, ফার্সি স্বাক্ষর। তাদের সীলমোহরের বা সই মোহরের ভাষাও হত ফার্সি। কিন্তু তাদের রাষ্ট্রীয় জীবনের এক বড় অংশ জুড়ে থাকত বাঙালা ভাষার সরকারি ব্যবহার। এরকম ব্যবহার ঘটত অফিস আদালত বা প্রশাসনিক কাজকর্মে, বিচারালয়ে, আর্থিক প্রতিষ্ঠানে, রেজিস্ট্রেশন এবং ব্যক্তিগত কাজকর্মেও এমন কি, প্রজারা সুলতান, নবাব বা সুবেদার দেওয়ানদের দরবারেও বাঙালা ভাষায় আর্জি পেশ করতে পারতেন তা ফার্সি – বাঙালায় লেখা হোক বা সংস্কৃত-বাঙালায় । এসব বিষয়ে যে বিপুল পরিমাণ সরকারি বেসরকারি নজীর বা নমুনা নিশানা আমার হাতে এসেছে তা থেকে একটি বিস্ময়কর সরকারি হুকুম-নামা বা অনুমতিদান পত্রের উল্লেখ করা যায়। এটি বাঙালার বিখ্যাত নবাব শায়েস্তা খানের আমলে তাঁর অধীনে কর্মরত দেওয়ান মরহুম বদিয়ত জমা খাঁ (বদি উজ্জামান খান) এর সই মোহর যুক্ত নমুনা । সংস্কৃত ভাঙা বাঙালায় একজন অমুসলিম লেখকের লিখিত ও নবাব শায়েস্তা খানের অধীন শাহ উজীয়াল পরগনা রাজ্যের দেওয়ান সাহেবের স্বাক্ষর দ্বারা অনুমোদিত এই হুকুম-নামাটি একটি তালুক ক্রয়-বিক্রয়ে অনুমতি দান-পত্র। ফারসি ভাষায় সরকারি সইমোহর (Seal) ও দেওয়ান সাহেবের স্বাক্ষরযুক্ত অনুমতি পত্রটি নিম্নরূপ “স্বস্তি সমস্ত সুপ্রাশস্ত্যালস্কৃত সতত বিরাজমান মহারাজাধিরাজ শ্রীযুত আওরঙ্গজেব সাহাদের পাদানামত্যুদখিনি গৌড়রাজ্যে অগ্নিযুক্ত শ্রীযুত নবাব খান মহাশয়ানামধিকারে শ্রীযুত গোবিন্দরাম রায় মহাশয়ে বিষয়িণি নবত্যধিক পঞ্চদশমিত শকাকে সাহোজ্জীয়ান রাজন্তর্গত বাড়রা গ্রামে শ্রীরামেশ্বর বিশারদ ভট্টাচার্য্যস্য সভায়ামনেকেধামুপস্থিতৌ শ্রীনারায়ণ চক্রবর্তিনঃ সকাশাত সার্থমুনীং গৃহীত্বা শ্রীকৃষ্ণপ্রসাদ দেয় শ্রীকালিকাপ্রসাদ দেয় শ্রীউমানন্দ দেয়কা নিগুর গ্রামকীয় তালুক কৃষ্ণপ্রসাদ দেয় সম্মন্ধি দানসাগরসংঙ্গক ষটপক্ষিকা পরিমিত নাল ভূমিং পূর্ব্বলিখিত রিতুদাতরি স্বেচ্ছয়া বিক্রীতবন্তঃ । ইতি সন সদর ১০৭৪ সন পরগনাতি ৪৬৬ তেরিখ ১ আষাঢ়

অত্রার্থে সাক্ষিণ:

শ্রীরামেস্বর রায়স্য

শ্রীরামকৃষ্ণ দত্তকঃ

শ্রীউমান্দ দেয়স্য

শ্ৰীকৃষ্ণপ্রসাদ দেয়স্য

শ্রীরাঘব চক্রবর্ত্তী

শ্রীরমাকান্ত শৰ্ম্মা

শ্রীচণ্ডিচরন মাতাকঃ

শ্রীনারায়ন চন্দ

শ্রীকালিকাপ্রসাদ দেয়স্য

শ্রীরামনারায়ণ দেবশর্ম্মা

শ্রীমহেশ দাস

সভাপতিরত্ব শ্রীরামেশ্বরবিশারদ ভট্টাচার্য্যঃ উভয়ানুমত্যা শ্রীকৃষ্ণ দেবশর্ম্মণা লিখিতমিনমিতি”

উপরে লিখিত নমুনা থেকে জানা যায় ফাক সুপ্রশস্ত অলংকৃত সতত বিরাজমান মহারাজাধিরাজ শ্রীযুত আওরঙ্গজেব সাহা দেব (কর্তৃক) গৌড় রাজ্যে (আসলে বাঙালা রাজ্যে) তাঁর নিযুক্ত শ্রীযুত নবাব শায়েস্তা খান দের অধিকারে থাকা সাহ উজিয়াল পরগণা রাজ্যে এই তালুক কেনাবেচা হয়। হুকুম.নামা’র লেখক শ্রী কৃষ্ণবল্লভদেব শর্মণ। তাই ভাষাটা প্রায় পুরোপুরি-ই সংস্কৃতসিক্ত বাঙালা। একথা পূর্বেই বলা হয়েছে। এছাড়া নমুনাটি থেকে আরও যা জানা যায়- তা’হল শাহ্ উজীয়াল পরগনা রাজ্যের বাড়রা গ্রামে রামেশ্বর ভট্টাচার্য উপস্থিত থেকে কৃষ্ণপ্রসাদ ও অন্যান্যকে নিগুঢ় গ্রামস্থ তালুক স্বেচ্ছায় বিক্রয় করেন। এই তালুক উভয় পক্ষের অনুমতি অনুযায়ী কৃষ্ণবল্লভদেব শৰ্মণ কতৃক লিখিত। সন ১০৭৪-এর ১লা আষাঢ়। এরপর নবাব শায়েস্তা খাঁর আমলের ঐ অনুমোদন পত্রের প্রায় একশ বছর পর অপর একটি পরগণা রাজ্যের মালিক কর্তৃক তৎউপরস্থ সরকারি কর্মকর্তার নিকট লিখিত একটি আবেদন পত্রের উল্লেখ করা যায়। এই সরকারি আবেদন পত্রের লেখক হরিপুরের অধিকারী বা শাসক মুন্সী রেয়াজ উদ্দীন মুহাম্মদ ।

উপরস্থ মালিক রাজনগরেরা শাসকের নিকট বিখ্যাত বক্রেশ্বর- এর মেলায় লোকজন, হাতি ঘোড়া নিয়ে জুলুম হাঙ্গামা বা লুটপাট করার বিরুদ্ধে প্রতিকার প্রার্থনা করেন । দরখাস্তটি লেখা হয় ১১৭২ সালের ৯ই ফাল্গুন। ফারসি ভাষায় সই মোহরকৃত ও স্বাক্ষরযুক্ত ঐ আবেদন পত্রের পুরো বয়ান নিচে কোট করা হল-

লিপিকাল ১১৭২ সাল

তঙ্গে হরিপুরের এতমাম্দার ও কর্ম্মচারি ও কোতওয়াল ও জমাদারান সুচরিত্রেষু আগে মৌজে ডিহি বক্রেশ্বরের গোপিনাগ শর্ম্মা ও রামজীউ শৰ্ম্মা ও লক্ষীকান্ত শৰ্ম্মা ও জয়চন্দ্র শর্ম্মা ও রাজ্জিধর শর্ম্মা জাহির করিলা জে-উক্ত ডিহি বক্রেশ্বর-দেবত্তর মৌজা দরবস্ত ও চক গঙ্গারামের ডিহি ও চক শিবপুর-সাবীক বীররাজার দত্ত বক্রেশ্বরনাথ শিবঠাকুরের নিষ্কর দেবত্তর মৃদু পুরুষ ২ হইতে জীবের সেবা পূজা করিয়া দখলিকার আছে বীররাজার দত্ত সনন্দ রাখে এক্ষণ বক্রেশ্বর মেলাতে হুজুরের লোক লস্কর হাতী ঘোড়াতে বাজারে জুলুম হাঙ্গামা করে এজন্য দরখাস্ত করি বক্রেশ্বরের মেলাতে জুলুম না করে তেঁহায় যেমত হুকুম অতএব উক্ত ডিহি বক্রেশ্বর দরবস্ত দেবত্তর মৌজা ও চক গঙ্গারামে ডিহি ও শিবপুর সাবিক বীররাজার দেওয়া যথার্থ তাহার সনন্দ রাখে উক্ত শর্ম্মা পাণ্ডা মজকুরেরা পুরুষ-২ মুদ্দাত হইতে’ জীউর সেবা পূজা করিয়া দখলিকার আছে ও বক্রেশ্বরে যে বাজার হয় তাহাতে খাজনা আদায় করিয়া দখলিকার আছে উক্ত দেবত্তর বৃত্তি বেশাদে কেহ জুলুম হাঙ্গামা করিবে না ও কখন শর্ম্মা মজকুরদিগকে তলপ করিবে না যেন পাণ্ডা মজকুর সাবেক সুরত’ জিয়ের সেবা পূজা করিয়া পুত্রপৌত্রাদি ভোগ দখল করে। পরালাগি মুন্সী রেয়াজুদ্দীন মুহাম্মদ ইতি সন ১১৭২ সালের ৯ই ফাল্গুন।”

এই রচনাটির সংগ্রাহক ও প্রকাশক শিবরতন মিত্র এটিকে বলেছেন বক্রেশ্বরে প্রাপ্ত রাজনগরের রাজ প্রদত্ত সনদ” বা ছনদ। আসলে এটি রাজনগরের রাজার বা মুসলিম শাসকের নিকট তরফ উত্তর-ডিহি বক্রেশ্বরের শাসকের ‘পরওনা’ বা ‘অবহিতি পত্র’।

এই পত্রে বা infroration letter এর বয়ান থেকে জানা যায়- ডিহি বক্রেশ্বর ছিল। রাজনগর রাজ্যের অধীন। এই ডিহি বক্রেশ্বরে শিবমন্দির ছিল এবং সেই মন্দিরের পান্ডা বা সেবাইত্রা ছিলেন গোপীনাম শর্মা গং। এরা মুসলিম আমলের রাজনগরের রাজা বীর প্রদত্ত দেবোত্তর লাখেরাজ সম্পত্তির সনদ বলে পুরুষানুক্রমে গোটা সম্পত্তি ভোগ দখল করে এসেছে। এই ডিহি বক্রেশ্বরের সঙ্গে সঙ্গে চক গঙ্গারাম পুরের ডিহি ও চক শিবি পুরের মৌজাও অওতাভুক্ত ছিল। আর ছিল বাজার এবং মেলা। এই বিশাল দেবোত্তর সম্পত্তির ওপর ১৭৬৫ সালে মুসলিম শাসনের অবসানের পর-ই অবিচার অত্যাচার শুরু হয়। সরকারি লোকজনের হামলা হতে থাকে মেলায়, বাজারে এবং খোদ সেবাইত্রাদের ওপর। সেবাইত্রা বিষয়টি তরফের মালিক বা শাসককে জানালে তিনি তা জানান তাঁর উপরস্থ রাজনগরের তখনকার শাসক মুনশী রেয়াজ উদ্দীন মুহাম্মদকে। তিনি সমস্ত বিষয়টি তদন্ত করান এবং দেবোত্তর সম্পত্তির মূল সনদও প্রাপ্ত হন। অভিযোগ সত্যপ্রমাণীত হওয়ায়, তাঁর স্বাক্ষরিত হুকুম নামা সেবাইত্রাদের পক্ষেই জারী হয়। হুকুম-নামা’য় যাদের লক্ষ্য করে নির্দেশ পাঠানো হয় তাঁরা হলেন হরিপুর তরফের এতমামদার (বন্দোবস্তকারী বা তরফ মালিক) অন্যান্য কর্মচারী এবং কোতোয়াল বা পুলিশ কর্মকর্তা এবং জমাদার (পুলিশ বিভাগের কর্মচারী)।

১১৭২ সালের ৯ই ফাল্গুন লিখিত এই পরোয়ানা বা হুকুম-নামা’য় ফারসি সইমোহর (Seal) এবং স্বাক্ষর রয়েছে। অতএব, এটি একটি সরকারি ডকুমেন্ট তাতে কোন সন্দেহ নেই। এটির শেষে লিখিত “পরত্তলিগি” শব্দটি সম্ভবত: “পরওয়ানা লিখি” হবে। দ্বিতীয়ত মুনসী রেয়াজ উদ্দীন মুহাম্মদ রাজনগরের তখনকার শাসক অথবা সেই শাসকের মুনশী বা লেখকও হতে পারেন। মূল পরওয়ানাটি দেখা গেলে হয়তো সন্দেহ দূর করা সহজ হত।

এবার মরহুম রাজা আছাদুল্লা খার লেখা ফার্সি ভাষায় সই মোহর করা ১৯১৩ সালের ৮ই মাঘ-এর একটি সনন্দ বা সনদ (হুকুমনামা ) নিচেয় হাজির করা হল নকল সনদ বমহর রাজা আসদুল্লা খাঁ সাহেব- সন ১১১৩ সাল ৮ মাঘ।

হুকুম শ্রীযুত দেওয়ান সাহেব জী-

ইজ্জ্বত আসার বৈকুণ্ঠরাম দত্ত সিকদার ও মধুষুদন সম্মা কারকুন সুচরিতেষু আগে তরফ খএরাত সেখ আবদুল্লার ও সেখ আবদুল মোমেন সাং দুর্গাপুর আরজ হইলা জাহির করিলেন জে পরগনা খটঙ্গা দুর্গাপুরে খএরাত জমী সালি ১০ দস বিঘা পাই ভোগ করিতেছি সনন্দ রাখি এখন সীকদার সনন্দ তলব করে জে হুকুম হয় তাহার আরজ ষনিঞা হুকুম করিল সনন্দ তহকীব করহ যদি মো. সনন্দ ভোগ প্রমাণ খএরাত মনযুর রাখিল সনন্দ করিয়া দেহ অতএব সনন্দ তহকীব করা গেল সনন্দ সন ১১০৩ সাল ২১ অগ্রান ৮০ দাগে অজবস্তুর সালি মাঠ জমা খারিজ হুজুরে মুহব্বের জাহির করিলেক অতএব মো, পূৰ্ব্ব সোনন্দ ভোগ প্রমাণ খএরাত মনযুর রাখিল মোং কী, পঞ্চানন রায় বকসী জা এ মোং খএরাত ছাড়িয়া দিহ তপসীন জএনমৌফীক পরওানা জমী দষ বিঘা জমা আট তঙ্কা নএ আনা সাড়ে ভোগ পাত্তান ছাড়িঞা পাড়িযাদিহ ইতি ৮ মাঘ ১১১৩ সন।

এই হুকুম-নামা বা পরওয়ানার বিবরণ থেকে জানা যায়- এটি একটি মোহরাংকিত রাজকীয় সনদ বা আদেশের নকল। এটি এলাকাধিপতি বা পরগণা খটঙ্গাদুর্গা পুরের মালিক রাজা আসাদুল্লা খা, তাঁর দেওয়ান সাহেবের প্রতি শিকদারও কারকুন পদাধিকারী দুই ব্যক্তিকে পরোয়ানা পাঠিয়ে জানাতে বলছেন যে, শেখ আবদুল্লাহ ও আবদুল মোমিন (উভয়েই দুর্গাপুরের বাসিন্দা) তাদের সনদ মাফিক প্রাপ্ত খয়রাতি বা দানের দশবিঘা জমির সনদ ধারী অধিকারী। শিকদার তাদের সনদ তলব করেছে। নইলে জমি খারিজ করে নেবার ভয় দেখিয়েছে। তারা তাঁদের দরখাস্ত মাফিক খয়রাতি জমির সনদ পেশ করেছে। এ জন্য পরোয়ানা বা হুকুম-নামা নিয়ে পঞ্চানন বখসিকে পাঠানো হল । তাং ৮ই মাঘ, ১১১৩ সাল -১৭০৬ খ্রীষ্টাব্দ ।

ইতিহাসের সাথে মিলিয়ে নিলে দেখা যায়, সময়টি তখন বাঙালার বিখ্যাত ও শক্তিমান নবাব মুর্শিদকুলি খানের রাজত্বের দোছরা বছর। এই পরোয়ানা থেকে আরও জানা যায় সে সময় শিকদারদের ক্ষমতার দাপট ছিল এবং তা তাঁরা যখন-তখন যেখানে-সেখানে খাটাবার কোশেশ করিতেন। কিন্তু নবাবের সুশাসন প্রজাদের জান ও মাল-এর হেফাজত করত।

আরও বলা দরকার যে, এসময় দিল্লীর সিংহাসনে ছিলেন সম্রাট আওরঙ্গজেব। এবার ১১২৫ সালে লিখিত একখানি ‘ইস্তফা’ পত্রের নমুনা পেশ করা হবে। এটি একখানি ব্যতিক্রমধর্মী সরকারী ডকুমেন্ট। ডকুমেন্টটি নিম্নরূপ

(লিপিকাল ১১২০ সাল)

শ্রীশ্রীহরি

শরনং

মহুর সহি মহুর

কাজাই কাননগো নবাব

জাফর খা

মহুর মহুর

ফৌদীরি সাহিনা

নিগার মহুর

হাবস্কা

নকল বিমজ্জীম নিগার

আশ ৫ জিব গোস্বামী

৯ চৈতন্য

৫ গোবিন্দজিউ

২ বৃন্দাবন ৪ গোস্বামী

(শ্রীরামানন্দ দেবস্য

সাঃ লতা

শ্রী রাষবিন্দ দেবস্য সাঃ শ্রীপাট খরদহ

শীপঞ্চানন্দ দেবস্য

শ্রী আত্যারাম দেবস্য সাঃ শান্তিপুর

সাকীন যুপুর

শ্রীবল্ববীকান্ত দেবস্য

সাঃ বিরচন্দ্রপুর

শ্রীকৃষ্ণকীঙ্কর দেবসৰ্ম্মণঃ

শ্রীমদনামোহন দেবস্য

সাঃ শুদপুর

শ্রীহৃদয়ানন্দ দেবস্য সাঃ কানাইডাঙ্গা

শ্রী শ্রী অদ্বৈত সস্তান

সাঃ গয়নাপুর মালদহ শ্রীগোপালগোবিন্দ দেবসম্মনঃ

সাং রায়না

শ্রীপঞ্চানন দেবশর্ম্মণ সাঃ বাহাদুরপুর)

লিখিতং শ্রীরাসানন্দ দেবস্য তথা শ্রীরাসবিদ্ৰ দেবস্য তথা শ্রীপঞ্চানন্দ দেবস্য তথা শ্রীআত্যারাম দেবস্য শ্রীবল্ববিকান্ত দেবস্য তথা শ্রীমদনমোহন দেবস্য শ্রীহৃদয়ানন্দ দেবস্য ও গয়রহ ইস্তফা পত্রমিদং কার্য্যঞ আগে সন ১১২৫ সাল আমরা শ্রীশ্রী গিয়া সত্তাই জয়শীংহ মহারাজা মহাশয় শ্রীশ্রী তিনলক্ষ বর্ত্তির হাজার ভাগবত সাস্ত গ্রন্থ করিয়াছিলেন তাহার ১ এক লক্ষ গ্রন্থ শ্রী জমুনায় সমার্পণ করিয়াছিলেন বাকী এক লক্ষ গ্রন্থ শ্রী শ্রী পদ্মাসনে পচগীরি গারা ছিল বাকী এক লক্ষ বর্ত্তিয় হাজার গ্রস্থ শ্রী ‘গাদিতে আছিল তাহার গাদিয়ান একমৎ শ্রী’ আছিলা তাহার পর মেলেচ্ছের কালে গাদী মেলেচ্ছে শ্রীমন্দীরে দখল করিয়াছিল মেলেচ্ছের ভয়ে শ্রীশ্রী, জয়নগরে গেলেন পদ্যাসন খুলিয়া, সেই এক লক্ষ গ্রন্থ আনীয়া শ্রীমহারাজ্য ব্রাহ্মণ পণ্ডিত আনিয়া এবং পঞ্চদেবালয়ের গোম্বামী আনীয়া সেই সকল গ্রন্থ বিচার করিয়া সকিয়া ধৰ্ম্ম প্রেধান করিয়াছিলা সকলে কহিলেন সকিয়া ধৰ্ম্ম স্থাহি শ্ৰী শ্ৰী স্থানে সকীয়া ধৰ্ম্ম প্রেকাস করিবেন এবং আমাদিগে কহিলেন তোমরাহ সকীয়া ধৰ্ম্ম জাজন করহ এবং নতুবা বিচার করহ তাহাতে দেব পাণিত বিচারে সকীয়া স্থাহি করিলেন আমরা পরকিয়াম সিদ্ধান্ত বিচার না করিয়া সকীয়ায় দস্তখত করিয়াছিলাম পরে আমরা কহিলাম গৌর দেশে শ্রী শ্রী প্রভুর পাদাঙ্কীত স্থান সেখানে শ্রীশ্রী ভাগবত সাস্তি আছেন এবং সভাসতস্থান আছেন তাহারা মহাপাধ্যায় বিচার হইবেক গোড়ে পরকিয়া ধর্ম্মের অধিকারী তাহারা সকীয়া ধৰ্ম্ম লবে কেন এখানে জেমৎ সভাসদ হইল গৌরদেশে অনেক সভাসত আছে বিচার করিবেক অতএব এখানকার সভাসদ এক পণ্ডিত ও এক মনস্বোপদার জায় তবে বিচার করিয়া সকীয়া ধৰ্ম্ম সঙ্গ স্থাপন করিয়া আইসে তাহাতে সর্ববসনম মতে শ্রীযুত মহারাজা সভাসদ শ্ৰীযুত কৃষ্ণদেব ভট্টাচার্য জিহো সকীয়া পরকীয়া বিভিন্ন্য করিলেন তিহোঁ দিগবিজয় মহারাজার সভা হইতে তাহাকে আনীয়া এবং এক মনস্বোবদার সহিত প্রেয়াগ ও কাশী হইয়া আইলাম তাঁরাও সকীআজ দস্তখত করিয়া দিলেন পরে গৌড়দেশে আসীয়া গোস্বামীগণ এবং মহান্তসন্তান মহান্তসাখাগণ জেজে স্থানে আছেন সর্ব্বত্রে অনেক বিচার হইল সকলে বিচারে দিগবিজই স্থানে অজয়পত্র দিলেন পরে শ্রীপাট খণ্ডে আইলাম তাহাদের সহিত অনেক কথোপকথন হইল তাহারা কহিলেন আমরা শ্রী শ্রী মহাপ্রভূ মতাবলম্বি তাহার মতাঅধিকারী শ্রীশ্রী ছয় গোস্বামী তাহারা জেমত অবলম্ব গ্রহণ করিয়াছেন সেই মত আমরা জাজন করি সেই স্বব মতের সার গোম্বামীরা বেদ প্রিণিত এবং নি প্রিণিত এবং রস প্রিণিত জে সকল ভাগবত সাওস্ত করিয়াছেন তাহা বিতিরেক করিয়া আমরা সকীআয় কিমত দস্তখত করিব অতএব শ্রীযুত গোম্বামীর গাদির গ্রন্থসাস্তে অধিকারী শ্রীশ্রী চিনিবাষ আচার্য্য ঠাকুর তাহার সন্তান সকল আছেন তাহাদের স্থানে আগে দত্ত খত করাহ তবে আমারহ দস্তখত করিয়া দিব এ কথায় আমরা শ্রীপাট জাজিগ্রাম জাইয়া দখল করিতে কহিলেন আমরা সকীআঅ দস্তখত বিনা বিচারে-পারিব নাই আমরা শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর মতাবলম্বি অতএব বিচারে যে ধর্ম্ম স্থাই হয়ে তাহাই লইবে এই মত করার হইল বিচার মানিলাম তাহাতে পাতসাই শুভা শ্রীযুক্ত নবাব জাফর খাঁ সাহেব নিকট দরখাস্ত হইল তিহোঁ কহিলেন ধৰ্ম্মাধর্ম্ম বিনা তজবিজে হয় না অতএব বিচার কবুল করিলেন সেই মত সভাসদ হইল শ্রীপাট নবদ্বীপের শ্রীকৃষ্ণরাম ভট্টাচার্য্য ও তৈলঙ্গ দেশের শ্রীরামজয় বিদ্যালঙ্কার শোনার গ্রামের শ্রীরামরাম বিন্যাস ও শ্রীলক্ষীকান্ত ভট্টাচাৰ্য্য গয়বহ শ্রীশ্রীকাশীর শ্রীহরানন্দ ব্রহ্মচারি ও শ্রীনয়ানন্দ ভট্টার্চায্য ও গয়রহ একন্তু হইয়া শ্রীশ্রী” রাধামোহন ঠাকুর শ্রী আচার্য্য ঠাকুরের সন্তান তাহার সঙ্গে শ্রীযুতরাজা সাত্তায়ের পাভাপণ্ডীত অনেক সাস্ত সিদ্ধান্ত বিচার করিলেন তাহাতে শ্রীশ্রী আচার্য্য প্রভুর সন্তান শ্রীশ্রী রাধামোহন ঠাকুরকে পরাভব করিতে পারিলেক না অতএব শ্রীদিগবিজয় ভট্টাচার্য্য পরাভব হইয় অজয়পত্র লিখিয়া ঠাকুরের স্থানে শীষ্য হইয়া পরকীয়া ধৰ্ম্ম গ্রহণ করিলেক এবং দস্তখত পরকিয়ায় ধর্ম্মের পর করিয়া দেসকে গেলেন, এখানে জে সকল সাস্তগ্রেস্থ লইয়া বিচার হইল সেই সাস্ত শ্রীদ্বীগবিজয় শ্ৰীযুত মহারাজার নিকট গেলেন পুন ২সভা শ্রীযুত রাজার সভাসতে বিচার হইল বিচারে পরকিয়া ধর্ম্ম মোক্ষ হইল শ্রীমং আগম শ্রীমৎ ব্রেহ্মবৈবর্ত্ত এবং শ্রীমৎ ব্রেসদেবের শ্রীমৎ ভাগবৎ এবং শ্রীমৎ হরিবংস আদি ভাগবত সাস্ত এবং শ্রীগোস্বামিদিগের শ্রীমৎ ভক্তি সাস্ত এই সকল গ্রেস্থের মতে পরাভব হইয়া জয়নগরে গেলেন সেখানে পুন সভাসত হইয়া বিচার হইল শ্রীশ্রী রাধাকুণ্ডে পরক্রিয়া ধর্ম্মের ঢাণ্ডাগারা গেল এখানে পরকিয়া অধিকারী চারি অধিকারী শ্রীসরকার ঠাকুর শ্রীআচার্য্য ঠাকুরের সন্তান শ্রীরাধামোহন ঠাকুর অতএব শ্রীনরহরি সরকার ঠাকুরের পরিবার ও আচার্য্য ঠাকুরের পরিবার শ্রীমৎ নরোত্তম ঠাকুরের পরিবার ও শ্রীমৎ জীবগোস্বামীর পরিবার এই চার স্তবে বাঙ্গলায় অমরা পঞ্চ পরিবারের মধ্যে খারিজ হইলাম তোমরা আপন ২ পরিবারে বিলাতে দখল করিয়া পরম সুখে ভোগ করহ আমরা এই চার পরিবারে পর দখল করিব না দখল করি শ্রীশ্রী সরকারে দণ্ডী এবং গুণাকার হইব এতদর্থে বিচার পরাভব হইয়া ইস্তেফা পত্র লিখিয়া দিলাম ইতি সন সদর তারিখ ১৭ ফাল্গুন।

ইসাদি:

শ্রীপক্ষনারায়ণ মজুমদার

স্বাধীন ডাহাপাড়া

শ্রীকাজী ছদরুদ্দী

সাঃ মহিমাপুর

শ্রীকৃষ্ণরাম ভট্টাচার্য্য

সঃ শ্রীপাট নবদ্বীপ

শ্রীরামজয় বিদ্যালঙ্কার

সাঃ উৎকল কটক

শ্ৰীনয়ানন্দ ভট্টাচাৰ্য্য

সাঃ মহুলা

শ্রীআসান খাঁ

মনসোপ ফোজদারী

মনস্বোপ অবস্কানিগর

শ্রীসেখ হিঙ্গান

শ্রীরামহরি মজুমদার

মনস্বোপ ঘউরী

সোনারগ্রাম

শ্রীরামমরাম বিদ্যাভূষণ

শ্রীহরানন্দ ব্রহ্মচারী

সাঃ শ্রীকাশী

[সাঃ পঃ পঃ -১৩০৬, পৃ. ২৯৭-৩০১]

এই ‘ইস্তফানামা’ বা দাবী ত্যাগ পত্রটি যেভাবে লেখা তা থেকে বোঝা যায় এটির বাম পাশে কয়েকজন পদস্থ সরকারি কর্মকর্তার সইমোহরসহ স্বাক্ষর ছিল। ঐ সই ও সিলমোহরের প্রথমটি ছিল বাঙালার নবাবের প্রধান বিচারক বা কাজীর। তাঁর নাম ইসাদীতে উল্লেখ করা হয়েছে। তিনি কাজী “ছদরুদ্দী’ বা কাজী সদরুদ্দীন। তার স্বাক্ষরকে শাহী মোহর বা কাজাই” (কাজীর) সহ মোহর রূপে দেখানো হয়েছে। “মাতৃভাষা বাংলা লেখাপড়ায় এত ঘৃণা যে, তাহারা তাহা মুখে উচ্চারণ করাই অপমানজনক মনে করেন। এই অদূরদর্শিতার পরিনাম কি সর্বনাশা তাহা ভাবিলে শরীর শিহ রিয়া ওঠে। যে দেশের বায়ু, জল, অন্ন, ফল, মৎস, গোস্ত, দুগ্ধ, ঘৃত খাইয়া তাহাদের শরীর পরিপুষ্ট সে দেশের ভাষার প্রতি অনাদর করিয়া তাহারা যে কি সর্বনাশের পথ উমুক্ত করিতেছে তাহা ভাবিলেও প্রাণে এক ভীষণ আতঙ্ক উপস্থিত হয়” তাঁর পাশের দোছরা মোহর সই কানন গো” সাহেবের। ইন কে তা নিশ্চিত নয়। তবে

এটি একটি উচ্চ পদ। কানুন গো’র পাশে সই মোহর রয়েছে নবাব জাফর খার। ইন বাঙালার বিখ্যাত অপর নবাব মরহুম মুর্শিদকুলী খান। তাঁর আর একটি নাম ছিল করতলব খান। এরপরের মোহর ফৌজদার এর। ইসাদী থেকে জানা যায় এই মনসোপ (মনসব ফৌজদার) মরহুম আসান খাঁ বা আহসান খান। তার পরে পড়েছে মোহর “সাহিনা”। অর্থাৎ শাহী মোহর। বোধ হয়, এইটি রাষ্ট্রীয় মোহর (Seal)। তারপরের মোহরটি “নিগার মহুর” বা পরবর্তী মোহর। ইসাদীতে লিখিত “মনস্বোপ” (মনসব) “অবস্থানিগর” বা “অবস্থা নিগর” এর। তাঁর নাম রামহরি মজুমদার।

মোহর এর নিচের অল্প কথায় লেখা “অবস্থা” অর্থ স্পষ্ট নয়। প্রাপ্ত দলিলটি যে মূলের নকল, বা Certificd Copy স্পষ্ট “নকল বিমজ্জীস” অর্থ মূল অনুযায়ী নকল। এখানেও আছে একটি সরকারি মোহর বা সিল (Seal)। এভাবে ছ’টি সরকারি সই মোহর ও স্বাক্ষরযুক্ত ইস্তফা পত্রটির উপরে ডান দিকে দু’সারিতে আড়ভাবে লেখা দশগ্রামের দশজন বৈষ্ণব-প্রধানের নাম। তাঁরা হলেন-

১. সাকিনঃ লতা-র রামানন্দ দেব ২. ” স্ত্রীপাট খড়দহ-এর রাঘবিন্দ দেব

৩. ” গয়নাপুর (মালদহ) এর পঞ্চানন্দ দেব

৪. ” সুপুর-এর আত্মারাম দেব

৫. ” বীরচন্দ্রপুর-এর বহুবীকান্তদেব বা বল্লভী কান্তদের

৬. শুদপুর-এর মদন মোহান দেব

৭. ” কানাই ডাঙ্গার হৃদয়ানন্দ দেব

৮. ” শান্তিপুর-এর অদ্বৈত-বংশধর, গোপাল গোবিন্দদেব

১৯. ” রায়না-র কৃষ্ণকিঙ্কর দেব ও ১০. ” বাহাদুর পুর-এর পঞ্চানন দেব।

এরপর ইস্তফা পত্রে লিখিত ৫ জিব (জীব) গোস্বামী ৯. (চৈন), ৫. গোবিন্দীউ ২. বৃন্দাবন এবং ৪. গোস্বামী” কেন লেখা হয়েছে, তা বলা কঠিন। যাহোক, উপরে কথিত আড়ভাবে নাম সই করা দশ জন বাঙালী (তাদের ভাষায় গৌড়ীয়”) বৈজ্ঞব ঠাকুর বিজয়ীপক্ষ বা ইস্তফাপত্র গ্রহণকারী। এদের লিখিত ভাবে জানানা হচ্ছে যে, ১১২৫ সালে আমরা শ্রীধাম (বৃন্দাবন) গিয়ে জানলাম (জয়পুরের) মহারাজা জয়শীংহ (জয়সিংহ) শ্রীধামে তিন লাখ বত্রিশ হাজার ভানবত শাস্ত্রগ্রন্থ রচনা করাগ। তার মাঝে এক লাখ গ্রন্থও যমুনায় ফেলে দেন (হয়তো সেগুলো নিকৃষ্ট ছিল। বলে)। বাকি গ্রন্থের মধ্যে এক লাখ শ্রীধাম পদ্মাসনে গচগীরি (?) গাড়া বা পোতা ছিল। বাকি এক লাখ বত্রিশ হাজার গ্রন্থ ‘শ্রীধাম গাদিতে বৃন্দাবনে ছিল। তার গাদিয়ান বা গদিন শীন একমৎ (?) শ্রীধাম ছিল। তারপর ম্লেচ্ছের কালে (মুসলিম আমলে) ম্লেচ্ছে (মুসলমানে) ঐ গাদি দখল করে। তখন তাদের ভয়ে শ্রীধাম জয়নগরে স্থানান্তরিত হল। (গেলেন)। এসময় পদ্মাসন খুঁড়ে লুকানো এক লাখ গ্রন্থ এনে মহারাজ ব্রাহ্মণ পন্ডিত এবং পঞ্চ দেবালয়ের গোস্বামীদের সে সব গ্রন্থ বিচার করে স্বকীয়া ধর্ম প্রধান বলে। ঘোষণা করেন । (তার অর্থ ঐ সময় বৈষ্ণব মতে রাধা, কৃষ্ণের স্বকীয়া বা বৈধপত্নী, না পরকীয়া’ বা ‘অবৈধ প্রেমিকা তা নিয়ে তর্ক দেখাদেয়।

এই বাহাছের অবসান ঘটাবার জন্য জয়পুরের মহারাজা যে উদ্যোগ নেন। তাতে গোস্বামী ও ব্রাহ্মণ পণ্ডিতান রাধা, কৃষ্ণের বৈধপত্নী বলে রায় দেন। সেই রায় অনুসারে ‘স্বকীয়া’ মতানুযায়ী সাধনার জন্য সকল বৈষ্ণবদের প্রতি হুকুম জারী হয়। রাজার হুকুমে বলা হয়, ‘হয় তোমরা স্বকীয়া ধর্ম যাজন কর, নয়তো পুনরায় বিচার কর।’ তখন আমরা ‘পরকীয়া মত’ সিদ্ধান্ত বিচার না করে ‘স্বকীয়ায়’ দস্তখত করি।

পরে আমরা বলি-গৌড়দেশ চৈতন্য প্রভুর পদাংকিত স্থান। সেখানে বহু বৈষ্ণবসভা আছে। তাঁরা ও মহামহোপাধ্যায়। তাঁদের নিয়ে বিচার হবে। গৌড়ীয়রা (বাঙালী বৈজ্ঞবরা) পরকীয়া ধর্মে আস্থাশীল। তারা স্বকীয়াধর্ম কেন নেবে? তাই এখানে যেমন সভা ও বিচার সিদ্ধান্ত হ’ল, সেই রকম বিচার সিদ্ধান্ত সেখানেও হতে হবে। সে জন্য এখানকার সভাসদ পন্ডিতদের একজন ও মনসবদারদের একজন  গৌড়ে গিয়ে ‘স্বকীয়াধর্ম’ বিচারে প্রতিষ্ঠা দান করে এলে, ভাল হয়।’ একথায় সকলে সম্মত হ’লে মহারাজা, সভাসদ-পন্ডিত কৃষ্ণদেব ভট্টাচার্যকে একজন মনসবদারসহ আমাদের সাথে পাঠান। এই দিগ্বিজয়ী পণ্ডিত কৃষ্ণদেব ভট্টাচার্যই স্বকীয়া পরকীয়া বিচার করে, স্বকীয়া মত শ্রেষ্ঠ বলে প্রতিষ্ঠা দান করেন। আমরা তখন যারা জয়পুর থেকে প্রয়াগ ও কাশী হয়ে ‘গৌড়ে (বাঙালায়) আসেন। তারাও (কাশী, প্রয়াগের বৈষ্ণবরা) স্বকীয়ায় দস্তখত করে দেন।

পরে গৌড় দেশে (বাঙালা দেশে) এসে গোস্বামীগণ, মোহান্ত-সন্তানগণ মোহান্ত শাখা গণ, যারা যেখানে আছেন, সব খানেই বিচার হয়। সবাই দ্বিগ্বিজয়ী স্থানে”অজয় পত্র” লিখে দেন। পরে শ্রী পাটখণ্ডে (নবদ্বীপে) এলাম। তাঁরা আলাপ আলোচনাকালে বললেন-স্বৰ্গীয় মহাগ্রতু (চৈতন্য দেবের) মতানুসারী। তাছাড়া, স্বর্গীয়, ষড়গোস্বামী প্রভৃতি যে মত গ্রহণ করেছে, সেই মত আমরা যাজন করি। তারা বেদ প্রণীত, ‘ওন (?) প্রণীত-রস প্রণীত যেসব ভাগবত সাস্ত্র লিখে গেছেন, তা বাদ দিয়ে আমরা স্বকীয়ায় দস্ত খত করতে পারিনে।

এছাড়া স্বর্ণয় গোস্বামীর গাদির গ্রন্থের অধিকারী স্বর্গীয় চিনিবাস আচার্য ঠাকুরের সন্তানরা আছেন, তাঁদের কাছে গিয়ে আগে দস্তখত করাও। তবে আমরাও দস্তখত করব।’ একথায় আমরা শ্রীপাট যাজিগ্রাম যেতে সম্মত হই।

তখন পাতসাই (বাদশাহী’ শব্দের বিকৃত রূপ) সুবাদার নবাব জাফর খাঁ সাহেবের নিকট দরখাস্ত দেওয়া হল। তিনি বললেন, ধর্মাধর্ম বিনা তজবিজে (বিচারে) হয় না । তিনি বিচারের অনুমতি দিলেন। সেই হুকুম অনুযায়ী সভা বসল। তাতে শ্রীপাট নব দ্বীপের কৃষ্ণরাম ভট্টাচার্য, তৈলঙ্গ দেশ এর রামজয় বিদ্যালঙ্কার, সোনার গাঁয়ের (ঢাকার) রামরাম বিদ্যাভূষণ, লক্ষীকান্ত ভট্টাচার্য প্রভৃতি এবং কাশীর হরানন্দ ব্রহ্মচারী ও নয়ানন্দ ভট্টাচার্য প্রভৃতি একত্র ও একাত্ম হয়ে স্বর্গীয় রাধামোহন ঠাকুর ও তাঁর সাথে রাজসভার সভাপন্ডিত, অকেন শাস্ত্রাদি বিচার করেন, তাতে স্বৰ্গীয় আচার্য প্রভুর সন্তান স্বর্গীয় রাধা মোহন ঠাকুরকে পরাভব করতে ব্যর্থ হন। ফলে দ্বিগ্বিজয় ভট্টাচার্য তাঁকে অজয় পত্র লিখে দেন ও তাঁর শিষ্য হন তিনি এভাবে পরকীয়া ধর্মের পক্ষে দস্তখত করে দেশে ফিরে যান। গৌড়ে (বাঙালায়) যে সব শাস্ত্রগ্রন্থ অনুযায়ী বিচার হয়, দ্বিগ্বিজয় ঠাকুর সেগুলো দেশে নিয়ে যান এবং জয়পুরের রাজসভায় সেগুলো নিয়ে বার বার আলোচনা হয়। তাতে পরকীয়া মতবাদের-ই জয় হয়। আগম, ব্রহ্মীবৈৰ্ত্ত ব্রহ্মবৈবর্ত্ত (পুরান) ভাগবত, হরিবংশ, গোস্বামীদের ভক্তিশাস্ত্র ও গকহ নিয়ে বিচার হয় জয়পুরেও পরকীয়া মতবাদ বিজয়ী হয় সেখানেও পরকীয়ার ঝান্ডা ওড়ে।

তারপর পরাজিত পক্ষ লিখিত ভাবে জানান সুবা বাঙালার চার প্রধান বৈষ্ণব পরিবার যথাক্রমে নরহীর সরকার ঠাকুরের পরিবার, আচার্য (রাধা মোহন) ঠাকুরের পরিবার নরোত্তম ঠাকুরের পরিবার ও জীব গোস্বামীর পরিবার এর সঙ্গে দ্বিগ্বিজয় ভট্টাচার্য পরিবার যুক্ত হয়ে পঞ্চ বৈষ্ণব পরিবারে সামিল (খারিজ) হন আমরা উক্ত চার পরিবারের ধর্মাচরণের কোন বিরোধীতা করব না। করলে সরকার কতৃক অপরাধী (গুনাহগার) হব। এভাবে পরাজিত হয়ে ইস্তফা পত্র লিখে দিলাম। দন্ডনীয় তারপর ইসাদী বা সাক্ষী হিসেবে যে আট জনের নাম সই রয়েছে তাদের মধ্যে পদস্থ চার ব্যক্তি হলেন

১। কাজী ছদরুদ্দীন, সাকিন, মহিমাপুর

২। আসান খাঁ (মনসবদার, ফৌজদারী)

৩। রামহরি মজুমদার (মনসবদার অবস্কা নিগর)

৪। শেখ হিঙ্গান (মনসবদার, গৌড়ী বা গৌড়ীয় / ঘউরী), এ সব অতি উচ্চ পদমর্যাদা- অধিকারী ছাড়া আরও যেসব বিশিষ্ট অমুসলিম, ইসাদী ছিলেন, তারা হলেন (সোনার গাঁ ঢাকা) রামরাম বিদ্যাভূষণ, কাশীর হরানন্দ ব্রহ্মচারী, মহলার নয়ানন্দ ভট্টাচার্য, উৎকল উড়িষ্যা কটক এর রামজয় বিদ্যালঙ্কার, শ্রীপাট নব দ্বীপের কৃষ্ণরাম ভট্টাচার্য ও ডাহাপাড়ার দক্ষ নারায়ণ মজুমদার।

যাহোক, এরকম আরও ফারসি সই ও সীল মোহর যুক্ত সরকারী ডকুমেন্টস থেকে দেখা যায়, সুলতানী ও মুঘল আমলে সুবা বাঙালায় দুটি ভাষাকে রাষ্ট্র ভাষার মর্যাদা দান করা হয় তার একটি হল কেন্দ্রীয় সরকারের (দিল্লীর সম্রাটের) রাষ্ট্রীয় ভাষা ফার্সি; অপরটি হল সুবা (প্রদেশ) বাঙালার ‘রাষ্ট্রীয় ভাষা বাঙালা। তখন প্রাদেশিক সমস্ত সরকারি ও বেসরকারি, প্রশাসনিক এবং সাধারণ কাজকর্ম বাঙালায় চালানো হত আর তার-ই গ্রহণযোগ্যতা, স্বীকৃতি ও সম্মান বৃদ্ধির জন্য ঐ সব সরকারি নথিপত্র, দলিল দস্তাবেজ, আদালতের ও দরবারের হুকুম-নামা তথা নবাবের আদেশ, কাজীর বিচারের রায়, উকিলের নোটিশ আর্জির দরখাস্ত, সালিস-বাহাছের সিদ্ধান্ত, রেজিষ্ট্রেশন দপ্তরের কাগজানি সব কিছুর ওপর-ই বসত ফারসি স্বাক্ষর ও পদস্থ কর্মকর্তাদের ফারসি সই মোহর। বলা দরকার যে, তখন সারা হিন্দুস্তানে (বাঙালায়ও) উর্দুভাষা চালু থাকলেও এসব দলিলাদি ও নথি পত্রের কোথাও উর্দূর ব্যবহার দেখা যায় না। কাজেই রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাঙালার এই গৌরবও স্বীকৃতিকে খাটো করে দেখার উপায় নেই। তার কোন অবকাশই নেই।

১৯৫২ সালে বাঙালা ভাষাকে উর্দূর পাশাপাশি অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার যে দাবী করা হয় তা যে অযৌক্তিক ও ঐতিহ্যহীন ছিল না উপরের আলোচনা থেকে তার প্রমাণ পাওয়া যায়। আমরা যদি সে সময় ১৬৫২ ও ১৭৫২ সালের রাষ্ট্রীয় ভাষানীতি জানতাম, তার সঙ্গে আমাদের পরিচয় থাকত, তাহলে অবাঞ্ছিত রক্তপাত এড়ানো যেত। আমরা যদি জানতাম বহু প্রাচীনকাল থেকেই বাঙালা ভাষা, ফারসি ভাষার সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মুসলিম শাসনমলে রাষ্ট্রীয় ভাষার মর্যাদা ভোগ করেছে এবং সর্বস্তরে সে ভাষা ব্যবহৃত হয়েছে তাহলে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের প্রয়োজন হত না।

 

লেখক:ভাষাবিজ্ঞানী ড. এস. এম. লুৎফর রহমান

১২৬৩ বার পঠিত

শেয়ার করুন

Picture of রোয়াক ডেস্ক

রোয়াক ডেস্ক

রোয়াক, ইসলামী চিন্তা ও গবেষণা ইন্সটিটিউটের অনলাইন মুখপাত্র। বুদ্ধিবৃত্তিক ও সময়ের চিন্তাগত সংকট থেকে উত্তরণের জন্য কাজ করে যাবে।
Picture of রোয়াক ডেস্ক

রোয়াক ডেস্ক

রোয়াক, ইসলামী চিন্তা ও গবেষণা ইন্সটিটিউটের অনলাইন মুখপাত্র। বুদ্ধিবৃত্তিক ও সময়ের চিন্তাগত সংকট থেকে উত্তরণের জন্য কাজ করে যাবে।

মতামত প্রকাশ করুন

Scroll to Top