প্রযুক্তিগত অনগ্রসরতা, ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভলাপমেন্টের ক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকাসহ নানা কারণে শুধুমাত্র কৃষি মাধ্যমকেই প্রধান ক্ষেত্র হিসেবে বিবেচনা করা হয়, ফলশ্রুতিতে আমরা এখনো কৃষি নির্ভর দেশ হিসেবেই পরিচিত।
কিন্তু অর্থনৈতিক ভারসাম্যতা ও অভ্যন্তরীণ উন্নতির ক্ষেত্রে কৃষির বর্তমান অবস্থা কী?
অর্থনৈতিক ভয়াবহ সংকটকালে যা ভূমিকা রাখতে পারত তার কতটুকু রাখতে পেরেছে? বর্তমানে এই খাতটির সত্যিকারের অবস্থা কী? আমাদের কৃষি আদৌ কি অভ্যন্তরীণ উন্নয়নের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, নাকি কিছু মুখস্ত বয়ান তথা সবজি উৎপাদনে বিশ্বে তৃতীয়, মাছ উৎপাদনে চতুর্থ কিংবা চাল উৎপাদনে চতুর্থ অবস্থানে থাকার সংবাদ দিয়ে প্রায় ভেঙ্গে পড়া কৃষি-অর্থনীতিকে মিথ্যে প্রবোধ দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে ?
করোনাকালীন সময়ে কৃষির অবস্থা কেমন, যেখানে পরিস্থিতি-সৃষ্ট অর্থনৈতিক ধ্বস থেকে দেশকে রক্ষা করার জন্য কৃষির উন্নয়ন ছিলো অন্যতম একটি সমাধান। এ সময়ে কৃষি ও খাদ্য মন্ত্রনালয়, দূর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রনালয় কতটা ভূমিকা রাখতে পারছে? রাষ্ট্রীয় খাদ্য গুদামগুলোতে ২০-২৫ লাখ মেট্রিক টন চাল-ডাল মজুদ থাকাসহ ভয়াবহ অব্যবস্থাপনায় ৫০ লাখের অধিক পরিবহণ শ্রমিক, গৃহকর্মী, নির্মাণ শ্রমিক, বৈদ্যুতিক মিস্ত্রি, রিক্সাচালক, হোটেলবয়, ভ্যানচালক, ফুটপাথের ক্ষুদ্র পরিসরে প্রয়োজনীয় দ্রব্য বিক্রেতা, সবজি বিক্রেতাদের মতো দুই কোটির অধিক মানুষ বর্তমানে কীভাবে দিনাতিপাত করছে? তাদের অন্ন-বস্ত্র সংস্থানের অবস্থা কী? রাষ্ট্রের বা মন্ত্রণালয় কি তা জানে!
আমরা যদি গত কয়েক মাসের রিপোর্ট লক্ষ্য করি তাহলে দেখব-
• এই করোনাকালীন সময়ে কিংবা তার পূর্বের অর্থনৈতিক অবস্থা, ইনডাস্ট্রিয়াল বা কৃষির যে সামগ্রিক অবস্থা ছিল, সেই আলোকে আমাদের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪০% মানুষই দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করার অবস্থায় চলে গিয়েছে। বিভিন্ন পত্রপত্রিকা যেমন, প্রথম আলো, দ্যা ডেইলি স্টার, নয়া দিগন্ত, বণিক বার্তার কয়েক মাসের রিপোর্টের দিকে দৃষ্টি দিলে দেখতে পাব শুধু ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, চট্টগ্রামের শহরগুলোতে যে ফ্যাক্টরিগুলো আছে, সেখানে কর্মরত ৫ লাখের অধিক মানুষ চাকরিচ্যুত হয়েছে গত ৩-৪ মাসে। এছাড়া ব্র্যাক আর ডেইলি স্টারের হিসাবে বলছে প্রায় ৪৭ শতাংশ পোশাক শ্রমিক বেতন পাচ্ছে না। ছোট ছোট উদ্যোক্তা যারা ছোটখাটো ফ্যাক্টরি বা পুঁজিকে কেন্দ্র করে কাজ শুরু করেছিলো, সেগুলোর প্রায় ৭০-৮০% ই বন্ধ হয়ে গিয়েছে। বিভিন্ন নগর শ্রমিক যেমন হোটেলে কর্মরত অথবা স্থাপনা নির্মানের কাজে যুক্ত মানুষদের অবস্থাও অভিন্ন। সকলেই এই কয়েক মাসে তাদের কর্মসংস্থান হারিয়েছেন।
বিদেশে কর্মরত রেমিটেন্স যোদ্ধারাও দেশে ফিরে আসছেন, যার সংখ্যা কয়েক লাখ ছাড়িয়েছে অনেক আগেই। এমনকি ধারণা করা হচ্ছে এই সংখ্যা বেড়ে ১৪-১৫ লাখে পৌঁছাবে। সব মিলিয়ে যদি গণনায় আনা হয়, তাহলে দেখা যাবে দেশের অভ্যন্তরে প্রায় ১০ লাখের মত শ্রমিক এখন চাকরিচ্যুত, বেকার হয়ে পড়েছে ৫ লাখের মত নগর শ্রমিক এবং প্রবাস থেকে দেশে ফিরে আসা লাখ লাখ মানুষ। এই বিপুল পরিমাণ মানুষ যারা চাকরিচ্যুত হচ্ছে, কর্মসংস্থান হারাচ্ছে, প্রবাস থেকে দেশে ফিরছে তারা এখন গ্রামাঞ্চলে ফিরে যাচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো গ্রামীণ যে কর্মক্ষেত্র, যে কৃষি ব্যবস্থা তা কি আদৌ এই কর্মসংস্থানহীন মানুষগুলোকে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দিতে সক্ষম?
• কৃষিপ্রধান দেশ বাংলাদেশে বর্তমানে কৃষিকাজের সাথে জড়িত আছেন প্রায় ৬০% পুরুষ এবং ৪০% নারী। কৃষির ক্ষেত্রে বণিক বার্তায় প্রকাশিত যে সবচেয়ে ভয়াবহ রিপোর্ট আমরা দেখেছি তা হলো– ধান ব্যতীত সকল প্রকার কৃষিদ্রব্য বাহির থেকে আমদানি করতে হচ্ছে আমাদের।
একটি উদাহরণ লক্ষ্য করা যাক। বাংলাদেশে তুলার মোট চাহিদা ৭৩-৭৪ লক্ষ বেল, অথচ দেশে মাত্র ১ লক্ষ ৭১ হাজার বেল তুলা উৎপন্ন হচ্ছে। বাকিটা আমদানি করতে হচ্ছে। গবেষকরা বলছেন বাহির থেকে তুলা আমদানিতে আমাদের যে পরিমাণ ক্ষতি বা অর্থ ব্যয় হচ্ছে, তার যথাযথ উপযোগ থাকলে তা দিয়ে দেশেই প্রায় কয়েক কোটি বেল তুলা উৎপাদন করা সম্ভব! অথচ এদিকে আমরা ৯০ হাজার কোটি টাকার বিদেশি কৃষিপণ্য আমদানি করে চলছি!
হাস্যকর বিষয় হল, কোনো এক বছরে যদি ১ লাখ ৭১ হাজারের স্থলে ২ লাখ বেল তুলা দেশে উৎপন্ন হয়, তাহলে মন্ত্রী থেকে শুরু করে সবাই বলতে শুরু করবে, “আমাদের উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে।” কিন্তু মূল যে ক্ষতির জায়গাটা, সেটা আমরা কেউ-ই লক্ষ্য করছি না।
• একইভাবে যদি দেশে উৎপাদিত ফসল অর্থাৎ ধানের কথায় আসি, তাহলেও দেখতে পাব উৎপাদন ক্ষমতার চেয়ে অনেক কম ধান উৎপন্ন হচ্ছে।
আর যতটুকুই উৎপাদিত হচ্ছে, তা মজুদ করার ক্ষমতা রাষ্ট্রের নেই! তাহলে বাকি ফসল কোথায় যাচ্ছে? মহাজনেরা, বিভিন্ন কোম্পানি কিংবা সাধারণ ব্যবসায়ীরা কিনে নিচ্ছে। একটা বড় অংশই চলে যাচ্ছে এদের কাছে, যার ফলে কৃষকরা তাদের কষ্ট, শ্রম, বিনিয়োগের ন্যায্য মূল্য পাচ্ছেন না। এমনকি সরকার রাষ্ট্রীয় গুদামজাতকরণের ধারণক্ষমতাও বৃদ্ধি করছে না।
যারা ধান চাষ করে তাদের ক্ষেত্রে যদি লক্ষ্য করি, ২০০২ সালে বর্গাচাষী অর্থাৎ ভূমিহীন চাষীর সংখ্যা ছিল শতকরা ৪৫%, ২০১৬ তে এসে তা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ৬৫% এ। বর্তমানে এ সংখ্যা ৭০% ছাড়িয়ে গেছে। তাহলে ভেবে দেখার বিষয় এই ৭০% কৃষক যেখানে ভূমিহীন এবং তাদের চাষকৃত ফসলের ৫০% মালিককে দিয়ে দিতে হচ্ছে, সেখানে এই কৃষকরা কি আদৌ তাদের পরিশ্রমের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছে? অসম্ভব!
• এদিকে সারা দেশব্যাপী বেকারত্বের ভয়াবহ কালো ছায়া বিরাজমান। এই বেকার, চাকুরিহীন মানুষগুলো কোথায় যাচ্ছে? তাদের সন্তান, পরিবার সব কিছুই তো গ্রাম-কেন্দ্রিক, তাই তারা স্বাভাবিকভাবেই গ্রামমুখী হচ্ছে। কিন্তু গ্রামের যে সার্বিক অবস্থা তা দ্বারা তাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করাও সম্ভবপর নয়। এমনকি সরকার থেকেও তারা কোনো সহযোগিতা, ভর্তুকি পাচ্ছে না।
অথচ এ বছর সরকার থেকে কৃষি ভর্তুকি দেওয়া হয়েছে ৯ হাজার ৫০০ কোটি টাকা! এই বড় অঙ্কের অর্থ আসলে কোথায় যাচ্ছে, যেখানে ৭০% মানুষই ভূমিহীন চাষী! তারা তো সরকারের তালিকারই বাইরে, সরকার থেকে কোনো ঋণ পাচ্ছে না। আবার প্রত্যেক বারই ঘাটতি দেওয়া হচ্ছে। এই ঘাটতির টাকাগুলো কোথায় যাচ্ছে যেখানে ধান ছাড়া সব ফসলই আমাদেরকে বাহির থেকে আমদানি করতে হচ্ছে? এটা সহজেই অনুমেয়– এ জায়গাতেও বড় ধরণের দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা, অযোগ্য নেতৃত্ব কাজ করছে।
♦ ব্রিটিশ পূর্ববর্তী সময় বা বাংলা সালতানাতের সময়ে আমাদের দেশে উৎপাদিত ২৫০ টির বেশি (কারো কারো মতে ৪০০টি) ফসল আমরা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করতাম; যে ফসলগুলো অধিকাংশই এখন বিদেশ থেকে আমদানি করা হচ্ছে। শীতের মৌসুমে আমাদের দেশে ফুলকপি, বাধাকপি, গাজর, টমেটো এ জাতীয় সকল সবজি উৎপাদন শুরু হবে; কিন্তু এই ফসলগুলোর বীজ সেই বিদেশি কোম্পানিগুলো থেকেই আমদানি করা!
এক্ষেত্রে কোম্পানিগুলো যে মারাত্মক কাজটি করে থাকে তা হলো-
– তারা প্রথমেই বীজগুলোকে প্রচন্ডমাত্রায় বিষাক্ত করে তৈরি করে অর্থাৎ বীজকে জেনেটিকালি মোডিফাই করা হয়। জেনেটিকালি মোডিফাইড বীজে এমন কিছু কৃত্রিম পরিবর্তন আনা হয় যা মানব দেহের জন্য ক্ষতিকারক। তারা বীজের আংশিক বিষাক্ত করে মূলত, যার ফলে সেখানে পোকা তৈরী হয়।
– আবার ফসল উৎপাদনের ক্ষেত্রে বীজে ক্ষতিকারক পোকার আক্রমণ ও বিস্তার রোধে আমরা ব্যবহার করি তাদেরই তৈরি মারাত্মক বিষক্রিয়াযুক্ত কীটনাশক। এই কীটনাশকগুলো পোকার প্রজনন ক্ষমতা বিনষ্ট করে; আর বিষক্রিয়ার ফলস্বরূপ বীজ থেকে প্রাপ্ত ফসল, ফল-ফলাদি, শাকসবজি গ্রহণ করে আমাদের দেশের যুবকরাও তাদের যৌবন হারিয়ে ফেলছে।এ প্রসঙ্গে সূরা বাক্বারার ২০৫ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ তা’আলা বহু আগেই আমাদের সতর্ক করেছেন। কীটনাশক প্রয়োগের ফলে ফসলের সত্যিকার স্বাদও নষ্ট হয়ে যায়।
– অতঃপর আসে ফসলি জমি প্রস্তুত করতে তাদের তৈরি সার প্রয়োগ, যা সুস্থ শরীরে অকারণে ইনজেকশন পুশ করে করে রোগাক্রান্ত বানানোর বিশেষ প্রক্রিয়ারই নামান্তর। সার প্রয়োগের উদ্দেশ্য হল উৎপাদন বৃদ্ধি করা। অথচ এ প্রয়োগের কারণে ফসল বেশি হলেও খড় ভালো হচ্ছে না, যার ফলে পশুপাখিদের খাবারের পরিমাণ কমে যাচ্ছে। কীটনাশক-সার প্রয়োগের কারণে পশু-পাখির খাবার বিষাক্ত হয়ে পড়ছে। বিষাক্ত খাবার বা খাবারের অভাবে অনেক প্রজাতির পাখির সংখ্যাও দিনে দিনে কমে যাচ্ছে।
জমিতে প্রয়োগকৃত সার বা কীটনাশক বৃষ্টির পানির মাধ্যমে পুকুর-নদীতে মিশছে, ফলে মাছেরাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
• কৃষকেরা জমিতে সার-কীটনাশক ব্যবহার করছে কৃষির ধারাবাহিকতা রক্ষা করার জন্য। কিন্তু তারা কোনো ধরণের রাষ্ট্রীয় ঋণ পাচ্ছে না, স্থায়ী পুঁজিও নেই তাদের। তাহলে তারা কিভাবে এই কৃষিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে? সমাধানস্বরূপ তারা বিভিন্ন এনজিও, গ্রামীণ মহাজন, গ্রামের কিছু অঞ্চলভিত্তিক সাহেব যারা পুঁজি ঋণ দিয়ে থাকেন তাদের দ্বারগ্রস্ত হচ্ছেন। এছাড়া আছে ব্যাংক, ক্ষুদ্র ঋণ প্রকল্প। কিন্তু এগুলোর প্রতিটিতেই রয়েছে সুদের মহা কারবার। একজন সবজি চাষীর ভাষ্যমতে তাকে ১০০ টাকায় সুদ দিতে হচ্ছে ২১ টাকা। এতে তার লাভের পরিমাণ ১০০ টাকায় ১০৫-১১০ টাকা। অর্থাৎ এখানেও সুদের পরিমাণ বেশি। কুটির শিল্প, মৎস শিল্পের সাথে যারা জড়িতদের সুদ দিতে হয় ১৭% আর লাভ হয় ১৫%। তাহলে বুঝাই যাচ্ছে গ্রামীণ সুদের কী ভয়াবহ অবস্থা!
• কৃষিতে ভয়াবহ লোকসান কিংবা লাভ এত কম হওয়ার কারণের কথা যদি চিন্তা করি, তাহলে লক্ষ্য করব সমগ্র বিষয়ের পেছনে কিছু সিন্ডিকেট কাজ করে। কৃষিপণ্য উৎপাদনের পর তা বাজারজাত করার জন্য বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অনেক দূরের পথ পাড়ি দেওয়ার প্রয়োজন হয়। কিন্তু আমাদের দেশের রাস্তাঘাটের যে করুণ দশা, তাতে যাতায়াত করে নির্দিষ্ট স্থানে পণ্য নিয়ে যেতে অনেক বড় পরিমাণ যাতায়াত খরচ, কষ্ট এবং শ্রম ব্যয় হচ্ছে। তারপর থাকে বাজার চাঁদাবাজি। এখানেই একটা অংশ চলে যায়। আবার ক্রেতার ক্ষেত্রে বাড়তি পাওনা হিসেবে থাকে রাস্তায় রাস্তায় চাঁদাবাজি। এ নানা ধরণের সিন্ডিকেটের কারণে রংপুরের ২ টাকার টমেটো আমাদের হাতে আসতে আসতে তার দাম হয়ে যায় ৪০ টাকা। কিন্তু কৃষক তো সেই বিক্রয়মূল্য দুই টাকাই পাচ্ছে! খরচ হচ্ছে দুই টাকা, বিক্রিও করছে দুই টাকায়। আর আমরা যারা ক্রেতা, তারা কিনছি ৪০ টাকায়। এই বড় ধরনের অব্যবস্থাপনা, দূর্নীতি, আখলাকবিহীন অবস্থার কারণে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে কৃষকসমাজ এবং সাধারণ মানুষ, লাভ হচ্ছে সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীদের।
• LLRD এর মতে বর্তমানে ৫০% পুরুষ এবং ৬০% নারী কৃষক পুষ্টিহীনতায় ভুগছে। বিভিন্ন ক্ষুদ্র ঋণ, অন্যান্য চাহিদার কারণে তারা নিজেদের উৎপাদিত ফসল, শাক-সবজি, নিজেদের চাষ করা মাছ নিজেরাই গ্রহণ করতে পারছে না। তারা স্বাস্থ্যসেবা পাচ্ছে না, বঞ্চিত হচ্ছে তাদের সন্তানেরাও। এমনকি অনেক বছর আগেও তাদের অবস্থা এ রকমই ছিল। আর তারা যতটুকু গ্রহণ করতে পারছে, সেটাতেও আছে কীটনাশক, সার আর ভেজালের সমাহার। তাহলে চিন্তা করে দেখুন, এই চাষী, হাওড়-নদীর জেলে, প্রান্তিক ও ভূমিহীন কৃষক, নারী কৃষক, কুটির-শিল্পীদের নিয়ে, তাদের উৎপাদন বৃদ্ধি নিয়ে আমরা একটুও ভাবছি? রাষ্ট্রের কোন সহযোগিতা বা উদ্যোগ আছে? আছে কি কোন পরিকল্পনা, পর্যালোচনা, প্রস্তাবনা? না, নেই। তারমানে প্রথমেই যেটা উল্লেখ করা হয়েছে, তারা যা-ই করছে সবটাই গ্রামের মহাজনদের কাছ থেকে সুদ নিয়ে৷ এতে করে তাদের দারিদ্র্য তো কোন অংশে কমছেই না, বরং দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। তাদের স্বাস্থ্য, অর্থনৈতিক অবস্থা সবকিছুরই করুণ অবস্থা। এমনকি শিক্ষা থেকেও তারা অনেক অনেক দূরে।
• করোনাকালীন সময়ে শহরাঞ্চলের যে ২ কোটি পুরুষ কর্মসংস্থানহীন হয়ে পড়েছে তারা সবাই কিন্তু গ্রামেই ফিরে যাচ্ছে। ফলে পরিবারের অর্থনৈতিক দায়িত্বটা অনেকাংশে তাদের স্ত্রী অর্থাৎ নারীদের উপর চলে গেছে। গ্রামের নারীরা হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল পালন করে কিছু টাকা আয় করে। এই আয়ের পরিমাণ-ই বা কতটুকু? তারা আদৌ ন্যায্যমূল্যটা পাচ্ছে? তাদের স্বাস্থ্যের কী অবস্থা, চিকিৎসার কী অবস্থা? আর যতটুকুই বা পাচ্ছে তা দিয়ে কি সংসার, একটি পরিবার চালানো সম্ভব? সবমিলিয়ে এই প্রশ্নগুলো কিন্তু থেকেই যায়!
• রাষ্ট্রীয় হিসাবমতে এবং বিভিন্ন গবেষণা সেলগুলোর বলছে, এই করোনাকালীন সময়ে দেশের প্রায় ৬ কোটি ৯৯ লক্ষ মানুষ খাদ্য সংকটে ভুগছে। আরো ৬ কোটি মানুষ দিন আনে দিন খায়। এছাড়া কোনো উপায়ন্তর নেই। এভাবে চাকুরিচ্যুত হওয়া এক বিরাট সংখ্যক মানুষ তাদের চাহিদা মেটাতে পারছে না।
♦ প্রশ্ন আসতে পারে– তাহলে কি আগে আমাদের কর্মসংস্থান ছিল না?
প্রথমেই বলা হয়েছে আমাদের ২৫০ এর মত ফসল ছিল, যা আমরা রপ্তানি করে কোটি কোটি টাকা আয় করতে পারতাম; সেখানে আজ ধান ব্যতীত বাকি সব ফসল আমাদের বাহির থেকে আমদানি করতে হচ্ছে। এ নিয়ে রাষ্ট্রের কোন চিন্তা-ভাবনা নেই, নেই কোন পরিকল্পনা, প্রস্তাবনা, উদ্যোগ।
– দুধ সারা পৃথিবীর মানুষের জন্য উপাদেয় একটি খাবার। কিন্তু আমরা কি দেশের মানুষের দুধের চাহিদা মেটাতে পারছি? দেশের ডেইরি ফার্মগুলোর দ্বারাও কি এই চাহিদা মেটানো সম্ভব হচ্ছে? অথচ এই দুধকে কেন্দ্র করে ৪০-৫০ লক্ষ মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা সম্ভব। এ ক্ষেত্রেও কোন উদ্যোগ নেই!
– তারপর আছে মৎস শিল্প। বাংলাদেশের মৎস শিল্প ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, অথচ এ নিয়ে আমাদের কোন মাথাব্যথা নেই। আমাদের দেশে প্রায় হাজারের উপরে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ পাওয়া যেত; এখন পাঙ্গাস আর তেলাপিয়া ছাড়া তেমন কোন মাছই সহজলভ্য নয়। নদী দূষিত হওয়া, অব্যবস্থাপনা, রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ না থাকায় আমাদের যে বিশাল রপ্তানি শিল্প তা আজ ধ্বংসের মুখে।
– তারপর রয়েছে পাটশিল্প। আমরা লক্ষ্য করেছি, পাটশিল্পের সাথে জড়িত লক্ষ লক্ষ শ্রমিক আজ নতুন করে বেকার হল। পাটকলগুলোকে বন্ধ করে দেওয়া হল। অথচ এই পাট ছিল আমাদের সোনালি আঁশ। যতটুকু ছিল, সেটুকুও বন্ধ করে দেওয়া হল। চাইলেই কি এখানে লক্ষ লক্ষ কিংবা কোটির উপরে কর্মসংস্থান করা যেত না?
আমাদের বন্দরকে ঘিরে যে অপব্যবস্থাপনা আছে, সেগুলো বন্ধের কোন উদ্যোগ নাই।
– এরপর রয়েছে চা শ্রমিকেরা। তাদের নিয়ে কোন আলাপ নেই, নেই কোন উদ্যোগ। অথচ আমাদের দেশের অন্যতম একটি বড় শিল্পক্ষেত্র হল চা শিল্প। ন্যায্যমূল্য দিয়ে, সঠিক বেতন দিয়ে এখানেও লক্ষ লক্ষ মানুষের কর্মসংস্থান করা সম্ভব ছিল।
আমাদের ক্ষুদ্র কুটির শিল্প, আমাদের মাছ, পাট, চা, তুলা, মসলা– প্রতিটি ক্ষেত্রেই যদি আমরা যথাসময়ে যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করতাম, তাহলে এই ভয়াবহ পরিস্থিতির উদ্ভব হতনা।
• সর্বশেষ যে বিষয়টি তুলে ধরব তা হল সম্প্রতি ঘটে যাওয়া বন্যা পরবর্তী পরিস্থিতি। বন্যার ফলে ৭০-৮০ লক্ষের (কোন কোন রিপোর্ট বলছে কোটির উপরে) উপর কৃষক এবং অন্যান্য কর্মসংস্থানে যুক্ত মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হল। তাদেরকে নিয়ে কোন উদ্যোগ নাই। তাদেরকে নিয়ে কি আদৌ ভাবছি আমরা? কিছু কিছু জেলায় ৬ মাসের অধিক সময় যুবকেরা বেকার জীবনযাপন করতে বাধ্য হচ্ছে। সেটা নিয়েও কোন কথা হয়নি।
সব মিলিয়ে আমরা দেখতে পাচ্ছি কৃষির ক্ষেত্রে আমাদের যে বিশাল সম্ভাবনা ছিল, সে সম্ভাবনা দিয়ে বেকারত্ব তো দূরের কথা, প্রায় ৭০-৮০ টি অঞ্চলে আমাদের পণ্য রপ্তানি করে প্রায় ২০ কোটির উপরে মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা যেত, উল্টো বিদেশ থেকে শ্রমিক এনেও কাজ করানো যেত। সেই কৃষি নিয়ে আমরা ভাবছি না, বরঞ্চ এই কৃষিই আজ আমাদের শেষ করে দিচ্ছে! আমরা অসুস্থ হয়ে পড়ছি, স্বাস্থ্যহীন হয়ে পড়ছি। চিকিৎসার জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়াচ্ছি, আবার সেই চিকিৎসা ব্যবস্থার অবস্থাও বেহাল।
আমাদের দেশে যে ভয়াবহ বেকারত্ব, অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক ধ্বস, তা থেকে উত্তরণে বড় ভূমিকা রাখতে পারে বাংলাদেশের এই মহাসম্ভাবনাময়ী কৃষি খাত। কৃষির প্রতিটি অভ্যন্তরীণ বিভাগকে নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে। উদ্যোগ নিতে হবে, প্রস্তাবনা তৈরি করতে হবে। বিরোধী দল, রাজনৈতিক দল, সামাজিক ও ধর্মীয় সংগঠন সবাইকে এ বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলে, রাষ্ট্রকে চাপ এবং সঠিক পরামর্শ দিয়ে একটি সমৃদ্ধ বাংলাদেশের জন্য চেষ্টা করতে হবে। এর কোন বিকল্প নেই।