চিন্তার সংকট থেকে রাজনৈতিক সংকট; পরিণতি: অস্তিত্বের সংকট

ইসলামী সভ্যতার বিখ্যাত দার্শনিক এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞানী আল-মাওয়ারদীর তত্ত্বের আলোকে সালাহুদ্দুনিয়া বা সমগ্র বিশ্বে শান্তি, শৃঙ্খলা ও আদালত সম্পন্ন একটি নিজাম যদি প্রতিষ্ঠা করতে হয়, তাহলে দুটি পর্যায়ে শান্তি, শৃঙ্খলা ও আদালত সমানভাবে থাকতে হবে।
১। বৃহত্তর পর্যায়
২। ক্ষুদ্রতর পর্যায়

আর এ দুটি বিষয় মূলত ছয়টি মূলনীতি বা বিষয়ের সাথে সম্পৃক্ত। যথা:
১) الدين المتّبع
২) سلطان قاهر
৩) عدل شامل
৪) أمن عام
৫) خصب دار
৬) أمل فسيح

যেখানে “الدين المتّبع” অর্থাৎ এমন একটি দ্বীন সমাজের মধ্যমণি হিসেবে থাকতে হবে, যা অনুসরণযোগ্য।

মূলনীতিগুলোকে ‘Normative values’ নামে অনুবাদ করা হয়ে থাকে, অর্থাৎ মানুষ কর্তৃক গৃহীত হয়েছে এমন একটি বিষয়। একটু লক্ষ্য করলেই দেখবো, বাংলাদেশসহ অন্যান্য মুসলিম অঞ্চলে দ্বীন হিসেবে ইসলামকে সবাই মেনে নিচ্ছে। তারা দ্বীন কতটুকু পালন করছে বা গ্রহণ করছে, তারচেয়েও বড় বিষয় হলো তারা সবাই দ্বীন অনুসুরন করার চেষ্টা করছে, তাদের মাঝে দ্বীন গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে। তবে এক্ষেত্রে মূল আলাপ হল, তা অবশ্যই অনুসরণ যোগ্য হতে হবে, এবং যদি তা অনুসরণ যোগ্য না হয় তবে তা কখনোই দ্বীনুল মুত্তাবাআ হতে পারবেনা।

বাকি মূলনীতিগুলিতে তুলে ধরা হয়েছে সামগ্রিক আদালত, সামগ্রিক নিরাপত্তা ও সমাজে মালের প্রাচুর্যতা থাকার ব্যাপারে এবং শেষে বলা হয়েছে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে বাস্তবধর্মী স্বপ্ন থাকার ব্যাপারে, যে স্বপ্ন মানুষের মাঝে ভিশন ও ভবিষ্যৎকে তুলে ধরবে।
এভাবেই আল মাওয়ার্দী তার তত্ত্বটিকে সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। এবং এটি বাস্তবিকভাবেই গ্রহণযোগ্য। যদি মুসলিম উম্মাহ এটিকে গ্রহণ বা যেকোনো জাতি, গোষ্ঠী যদি এটিকে পালন করে তাহলে সেখানে শান্তি, শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হবে।

যেমন তিনি সর্বশেষ যে বিষয়টি এনেছেন, তা হলো ‘আমানুন ফাসিহুন’, অর্থাৎ ভবিষ্যত সম্পর্কে বাস্তবিক স্বপ্ন বা জাতিকে ভবিষ্যৎ দেখানোর জন্য তিনি যে গুরুত্বারোপ করেছেন। এই মূলনীতি থেকে শুরু করে অনুসরণ যোগ্য একটি দ্বীনের আলোচনা পর্যন্ত সবগুলি বিষয় একটি জাতির মধ্যে চিন্তাগতভাবে থাকতে হবে অন্যথায় এই বিষয়টির গুরুত্ব আমরা সত্যিকারার্থে কখনোই উপলব্ধি করতে পারবে না।

আর বর্তমান বাংলাদেশে যে সংকট বিদ্যমান, আমরা খুব ভালোভাবেই বুঝতে পারছি যে, এ সংকট সামগ্রিক রাজনৈতিক সংকট, আদালত ও আখলাকের সংকট।
কিন্তু এ সংকট সৃষ্টির কারণ কী? কিসের ফলাফল স্বরুপ আমরা এ সংকটে নিপতিত?
একটু চিন্তা করলেই আমরা এর উত্তর পেয়ে যাবো।

উপরোক্ত মূলনীতিগত বিষয়গুলো আমাদের চিন্তারাজ্যে হাজির নেই, এগুলো নিয়ে সেই অর্থে কোনো চর্চা নেই, সমাধানকল্পে কোনো বাস্তবধর্মী প্রস্তাবনাও নেই! অর্থাৎ আমাদের মাঝে এক প্রকট চিন্তাগত সংকট বিদ্যমান, যা আমাদেরকে একটি ভয়ানক রাজনৈতিক সংকটের দিকে ধাবিত করেছে। মানবসভ্যতার ইতিহাসের সাক্ষ্যও বলে দেয়, যুগোপযোগী ও দুরদর্শী চিন্তার সংকট একটি জাতিকে সর্বদাই রাজনৈতিক সংকটের দিকে ধাবিত করে। আর তাই স্বাভাবিকভাবেই জাতির সামগ্রিক সংকট ‘রাজনৈতিক সংকট’ মোকাবেলার জন্য শক্তিশালী চিন্তা এবং সমাধানযোগ্য প্রস্তাবনা হাজির করতে হবে, ইতিহাসই যার প্রমাণ।

যারা চিন্তাগত সংকট মোকাবেলা করতে পেরেছে, তারাই রাজনৈতিক সংকট মোকাবেলা করতে পেরেছে; যার সবচেয়ে বড় উদাহরণ মোঙ্গল আক্রমন পরবর্তী সময়ে ইসলামী সভ্যতার জাগরণ, সেলজুক পরবর্তী সময়ে মুসলমানদের জাগরণ এবং ক্রুসেডারদের আক্রমণ পরবর্তী সময়ে মুসলমানদের জাগরণ। নিমাজ-উল-মূলক, ইবনে খালদুন, ইমাম গাজ্জালীরা যেভাবে জাতির সামনে সমাধানসূচক মূলনীতি ও ইশতেহার হাজির করেছেন, সে আলোকে পরবর্তীতে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ তাদের লক্ষ্যপানে পৌঁছানোর জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়েছেন এবং জনগণকে ভবিষ্যৎ উপলব্ধি করিয়ে সেদিকে ধাবিত করতে পেরেছেন, যার ফলে সমাধান সম্ভবপর হয়েছিলো। পাশাপাশি তৎকালীন ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক শক্তি তখনো চিন্তা তৈরি করতে পারেনি, বরং নিজাম-উল-মূলক, ইবনে খালদুনের মতো ব্যক্তিরা ও তাদের প্রতিষ্ঠানগুলোই চিন্তা তৈরি করেছিলো। বর্তমানে ব্যক্তি, বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রতিষ্ঠানগুলোকেই তাদের ন্যায় এগিয়ে আসতে হবে।

একইভাবে আরও একটি বিষয় হলো যখন কোনো জাতি রাজনৈতিক সংকট মোকাবেলা করতে পারে না, ভবিষ্যতের ইশতেহার রচনা করতে পারে না, তখনই তারা ধ্বংসের দিকে ধাবিত হয় এবং ভয়ংকর অস্তিত্ব সংকটের মধ্যে নিপতিত হয়। এ ব্যাপারে ইতিহাস বারবার সাক্ষ্য দিয়েছে। এটি প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়ম। তাই আমরাও যদি এ সংকট মোকাবেলা করতে না পারি, তাহলে আমরাও একই অস্তিত্ব সংকটে নিপতিত হবো এবং এটিই পৃথিবীর চরম বাস্তবতা।

এজন্য যুগশ্রেষ্ঠ মুজাহিদগণ বলেছিলেন, “যদি তুমি টেবিলের যুদ্ধে হেরে যাও, কলমের যুদ্ধে হেরে যাও এবং নিজেকে রক্ষা করতে না পারো, তাহলে নিশ্চিত থাকো, একদিন তুমি হেলমেট, লৌহ বর্ম পরেও জাতি এবং অর্থনীতিকে রক্ষা করতে পারবে না।” এর দ্বারা আমরা স্পষ্টতই বুঝি যে, জাতির অর্থনীতি, রাজনীতি রক্ষা না হলে গোটা জাতি ভয়ংকর অস্তিত্ব সংকটে নিমজ্জিত হবে।

এক্ষেত্রে প্রশ্ন আসতে পারে, রাজনৈতিক সংকট মোকাবেলা না করলে যে আমরা অস্তিত্ব সংকটে নিপতিত হবো– এটিই আমরা কতটুকু বুঝতে পারছি? হয়তো আমরা সত্যিই বুঝতে পারছি না, কিন্তু আমরা যদি একটু পেছন ফিরে ইতিহাসের দিকে দেখি, যে সময়ে বৃটিশরা আমাদের অঞ্চলে আগমন করছিলো, গোটা বিশ্বে তাদের উপনিবেশ স্থাপন করছিলো, ইউরোপের কেন্দ্রে বিভিন্ন বিপ্লব সাধন করছিলো, সে সময়ে আমরা মুসলমানরা আমাদের চিন্তার গতিশীলতা হারিয়ে ফেলেছিলাম এবং এখনো স্থবির অবস্থায়ই রয়েছি। আর এ কথা আল্লামা ইকবাল বারবার স্বরণ করিয়ে দিয়েছেন।

আমরা মুসলমানরা আমাদের চিন্তার গতিশীলতা হারিয়ে ফেলার ফলেই কিন্তু সেই সময়ে ইউরোপীয় পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে শক্তিশালী কোনো চিন্তা হাজির করতে পারিনি। ড. আলী শরীয়তির ভাষায়, “মুসলমানরা পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে শক্তিশালী কিছু দাঁড় করাতে পারছিলো না বলেই মার্ক্সবাদ বিশ্বব্যাপী জাতির বিবেক হিসেবে অর্বিভূত হতে শুরু করেছিলো।” তখন লেলিলের মতো ব্যক্তিরা বলতে শুরু করেছিলো যে, পুঁজিবাদের শীর্ষবিন্দু হলো সাম্রাজ্যবাদ। আর আমরা সেই সময়ে নিজেদের সভ্যতার যে গতিশীলতা, আদিল যে ব্যবস্থা তা সে অর্থে মানবতার সামনে তুলে ধরতে পারিনি!

যখন ঔপনিবেশিক শক্তি আমাদের দখল করছিলো, তখন আমরা বিতর্ক করছিলাম বন্দুক দিয়ে যুদ্ধ করবো নাকি তলোয়ার দিয়ে যুদ্ধ করবো। সেই সময়ে আমরা হজ্জ করে শাহাদাতের তামান্নায় উজ্জীবিত হলেও অন্যান্য দেশে গিয়ে উচ্চতর প্রযুক্তি তৈরি করতে নিজেদের উজ্জীবিত করতে পারিনি, যুদ্ধ করতে পারিনি। আমরা বুঝতেই পারিনি যে, সময়ের আলোকে যুদ্ধ হবে সে সময়ের সর্বোচ্চ টেকনোলজি দিয়েই। আমরা বুঝতেই পারিনি যে, দারুল হারব, দারুল ইসলামের ব্যাখ্যা ফিকহের দৃষ্টিতে কেমন হওয়া উচিত, এ সকল বিষয়ের পর্যালোচনা ও ব্যাখ্যা কেমন হবে এবং পর্যালোচনা থেকে সুষ্ঠু ইশতেহার কীভাবে প্রদান করতে হবে। আমাদের আলেমদের একটি বড় অংশ তা বুঝতে পারলেও সেভাবে বাস্তবায়ন করতে পারেননি!

অর্থনীতির ক্ষেত্রে যখন নানাভাবে শোষণের মাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছিলো, নানা তত্ত্ব উদ্ভাবন হচ্ছিলো, ইয়াল্টা কনফারেন্সের মাধ্যমে নতুন করে পৃথিবীকে ডিজাইন করা হচ্ছিলো এবং গত ৮০ বছরে পৃথিবীর অর্থনীতি, সংস্কৃতি আমাদের থেকে বিশাল একটি দূরত্বে অবস্থান করছিলো, সেই সময়ে এসেও আমরা বীমা করা হালাল না হারাম, ব্যাংকে টাকা রাখা যাবে কি যাবে না, সিনেমা হালাল নাকি হারাম– এ জাতীয় তর্কে নিমজ্জিত হয়েছি।

জ্ঞানের ক্ষেত্রেও একই কথা। যখন বৃটেন, জার্মানী, ফ্রান্স বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে আমাদের ইবনে সিনা, গাজ্জালীদের পাঠ পর্যালোচনা করেছে, তখন আমরা নিজেদের জাগরিত করার জন্য ইমাম শাতিবির রেখে যাওয়া “আল মুয়াফাক্কাত”কে অপ্রাসঙ্গিক মনে করেছি, এমনকি এ মনোভাব বিরাজমান ৪০০ বছর ধরে। গত তিন/চারশত বছর যাবৎ আমরা ফিকহ, আখলাকি বয়ানকে নতুন করে হাজির করা এবং সামনে ধাবিত হওয়ার গুরুত্বই উপলব্ধি করে পারিনি!

ফলশ্রুতিতে চিন্তাগত দিক থেকে, রাজনীতি, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে অনেক পেছনে পড়তে নিজেরাই নিজেদের বাধ্য করেছি। একইসাথে অভ্যন্তরীণ দুর্বলতার কারণে নিজস্ব ভাষা, জ্ঞানগুলোকে অপ্রাসঙ্গিক মনে করেছি এবং হারিয়ে ফেলতে শুরু করেছি।

দ্বিতীয়ত এ সকল চিন্তা, আখলাক এবং গতিশীলতার মধ্য দিয়েই কিন্তু ব্যক্তিত্ব গড়ে উঠে, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠে এবং এ ব্যক্তিত্ব, প্রতিষ্ঠানগুলোই নেতৃত্বের জন্ম দেয়, রাজনৈতিক মুভমেন্টগুলোর ইশতেহার রচনা করে, আর এ আলোকে মুক্তি ও কল্যাণের কর্মসূচি জাতির সামনে উপস্থাপিত হয়। কিন্তু আমরা এক্ষেত্রেও ব্যর্থ হয়েছি; আমরা নেতৃত্ব তৈরি ও ভবিষ্যৎ ইশতেহার রচনা করতে পারিনি। এ কারণেই গত কয়েকশো বছরে আমরা মহান সালতানাতগুলো হারিয়েছি, আমাদের স্বর্ণালী সভ্যতাকে নতুন করে বিনির্মাণ করার স্বপ্ন পর্যন্ত ভুলে গিয়েছি।

উপরোক্ত সংকটের কারণে বর্তমান বাংলাদেশে যে সমাধান দরকার ছিলো, আমরা সেই সমাধান থেকে দূরে অবস্থান করছি! চিন্তাকে বিকশিত না করতে পারার ফলে প্রত্যেকটা ক্ষেত্রে আমরা আটকে যাচ্ছি। ইতোমধ্যে অনেক ক্ষেত্রেই আমরা স্থবির হয়ে গিয়েছি। আর এই স্থবিরতা জাতিগত অস্তিত্ব সংকটের অন্যতম আলামত।

এরপরে যদি প্রশ্ন করা হয়, বর্তমান সময়ে আমরা কি নিজস্ব চিন্তা দিয়ে, নিজস্ব জাতিসত্তার রূহ দিয়ে দাঁড়িয়ে আছি? বর্তমান সমাজবিজ্ঞান, সংস্কৃতি আদৌ কি আমাদের? সামাজিক নিরাপত্তা কি আছে? রাষ্ট্রীয় সম্পদ কি আমরা রক্ষা করতে পারছি? এ সকল ক্ষেত্রে উত্তর আসবে, “না, আমরা অনেক ক্ষেত্রে ক্রমেই পিছিয়ে যাচ্ছি।”

আমাদের সমাজ কোন দিকে ধাবিত হচ্ছে, সত্যিকারার্থেই এগুলো নিয়ে চর্চা হচ্ছে কি-না? এর উত্তর পাবার জন্য পত্র-পত্রিকা, স্যোশাল মিডিয়ার দিকে তাকালেই বুঝতে পারব যে কোন সকল বিষয় নিয়ে ব্যস্ত আছি! কি নিয়ে বির্তক হচ্ছে, ভাইরাল নিউজ হচ্ছে!
অথচ নেতৃত্ব তৈরি ও ভবিষ্যৎ ইশতেহার রচনার আলাপ ব্যাতীত মুক্তি অসম্ভব।

এজন্য আল-মাওয়ারদী’ মূলনীতির আলোকে মহান সভ্যতা ইসলামি সভ্যতার দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাই, শুরু থেকে রাসূল (সাঃ) তিনি গোটা জাতির সামনে তৎকালীন সময়ের সমস্ত চ্যালেজ্ঞকে গ্রহণ করে মুক্তির জন্য একটি ওয়াদা দিয়েছিলেন। সেটি হচ্ছে একটি শান্তিপূর্ণ বিশ্বব্যাবস্থা প্রতিষ্ঠার ওয়াদা। কেননা একটি জাতি বেচে থাকে তার আগামীদিনের ওয়াদার উপর ভিত্তি করে। এজন্যই রাসূল (সাঃ) আঁকাবার শপথের নিশ্চয়তা বা যে সকল চিঠিগুলো প্রেরন করতেন সেগুলোর মধ্যেও নিশ্চয়তা দিতেন এবং রাসূল (সাঃ) এর সাহাবিদের প্রত্যেকটি ভাষণও হলো আগামীদিনের নতুন সভ্যতার নিশ্চয়তা, আদালত ও নিরাপত্তার নিশ্চয়তা, কিন্তু আমরা কি আদৌ সেই নিশ্চয়তা দিতে পারছি? আমরা কি সেই ডায়লগ তৈরি করতে পারছি?

কিন্তু তৈরি না করতে পারলে সমাধাণও আমাদের সামনে আসবে না। আবার এটার জন্য যে শক্তিশালী ভিত্তি নির্মাণ প্রয়োজন সেই ভিত্তি নির্মাণের জন্য জ্ঞানসম্রাট আলীয়া ইজ্জেতবেগভিচ বলতেন, শক্তি ও সমৃদ্ধির অন্যতম উৎস হচ্ছে আমাদের পরিশ্রম ও প্রচেষ্টা, এটার মধ্য দিয়েই বিজয় আসবে, এটার মধ্য দিয়েই সমস্ত সংকট দূরীভূত করে নতুন এক সুবহে সাদিকের জন্ম দেয়া সম্ভব, এটাই সুন্নাতুল্লাহ্, এছাড়া বিকল্প কোন রাস্তা আমাদের সামনে খোলা নেই।

তাই আমরা আমাদের চিন্তাকে, চিন্তার গতিশীলতাকে অগ্রভাগে রেখে এবং সেই চিন্তার মাঝে হাকীকত অন্বেষী জ্ঞান, মানবতার কল্যাণ, খলীফা হিসেবে ইমারতের দায়িত্ব, এগুলিকে কেন্দ্র বিন্দুতে স্থাপন করতে পারি তাহলে চিন্তার গতিশীলতা আরও বেশি গতিশীল হবে। পরবর্তীতে এসকল চিন্তা একটি প্রজন্ম থেকে অন্য একটি প্রজন্মে পৌছবে এবং পরবর্তী প্রজন্ম এসে এর ফল ভোগ করতে শুরু করবে। এটিই পৃথিবীর বাস্তবতা।

তাই বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ অর্থনীতি, অভ্যন্তরীণ উন্নয়ন, প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ও শিক্ষা কাঠামোকে ইসলামি সভ্যতার মূলনীতির আলোকে সাজিয়ে সুন্দর বাংলাদেশ গঠন সম্ভব, সেই বাংলাদেশের ভিত্তি আখলাক ও জাগতিক দুই দিক থেকেই শক্তিশালী ভিত্তি রচনা সম্ভব, তা যৌক্তিকভাবে তুলে ধরতে পারি তবেই যুব সম্প্রদায় নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করবে। একইভাবে যদি বাংলা ভাষাকে দাঁড় করাতে পারি, ডেভলাপ করতে পারি তাহলেও মুসলিম উম্মাহও দ্বীতিয় বৃহৎ ভাষা বাংলা ভাষা নেতৃত্ব দেয়ার জন্য জেগে উঠবে। যেই হিব্রু ভাষার ৫ হাজার বছর পর্যন্ত কোন খবর ছিলনা, সেই হিব্রু ভাষাই আজকে একটি আন্তর্জাতিক ভাষায় পরিণত হয়েছে। ইবনে সিনার বই অনুবাদ উম্মাহর দ্বিতীয় বৃহৎ ভাষায় নেই, অন্য কোন ভাষায়ও দেখা যায়না। সেখানে তাদের ইব্রানি ভাষায় ১৬ টি আলাদা আলাদ অনুবাদ করা হয়েছে। অথচ তাদের জনসংখ্যা মাত্র এককোটি! ১০০ বছর আগেও দুনিয়াতে তাদের কোন বাস্তবতা ছিলো না, তারা তাদের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পূর্বেও কল্পনা করেনি যে তারা একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করবে। কিন্তু ২৩ বছর বয়সী যুবক যখন সেই সপ্ন তাদের সামনে তুলে ধরলেন এবং পরবর্তীতে ৫০ বছর সময়ও লাগেনি বাস্তবায়ন হতে। তখন কিন্তু ‘ইমাম হাসান আল বান্নার’ সেই কথাটি বাস্তবায়িত হতে দেখলাম, তাহল- “আজকের স্বপ্নই আগামীকালের বাস্তবতা, এজন্যই হে যুবকেরা প্রস্তুতি গ্রহণ করো। অর্থাৎ যে যুবকেরাই প্রস্তুতি গ্রহণ করবে সেই যুবকেরাই তাদের জাতির কল্যাণ কল্যাণ নিয়ে আসতে পারবে এবং এটিই যুগে যুগে হয়েছে।

তাই আমরাও বাংলা ভাষাকে, বাংলাদেশকে সেভাবে সাজাতে পারবো ইনশাআল্লাহ্‌।

এরপর বাংলাদেশের বর্তমান সময়ের বাজেট, সামাজিক নিরাপত্তা, গার্মেন্স ফ্যাক্টরী, কৃষির ভয়াবহ সংকট, আমাদের শ্রমিক এবং ইনড্রাষ্ট্রিগুলোতে যেই ভয়াবহ জুলুম প্রতিষ্ঠিত! এ প্রত্যেকটি সমস্যার কেন্দ্রে রয়েছে রাজনৈতিক সংকট! আমাদের খাদ্য, চিকিৎসা, পরিবেশ, নগরায়ণসহ মেডিসিনের মতো সকল জায়গায় আগ্রাসণ উপনিবেশ শাষণামল থেকে বেশি মাত্রায় হচ্ছে! এটির কারণও কি রাজনৈতিক সংকট নয়? সুতরাং এই রাজনৈতিক সংকটকে মোকাবেলা করতে না পারলে যেইরকম অস্তিত্ব সংকটে নিপতিত হব একইভাবে এই রাজনৈতিক সংকট মোকাবেলা করার অন্যতম হাতিয়ার হচ্ছে চিন্তাগত সংকট মোকাবেলা করা। তাই যেকোনো মূল্যে এ বিষয়গুলোকে কেন্দ্রে রেখে আমরা আমাদের নিজেদের যোগ্য করার জন্য সর্বাত্নক প্রচেষ্টা চালাতে হবে এবং যার কোনই বিকল্প নেই। আমাদের জীবনে ভালোবাসা, অভাব ও সংকট সবই আসবে, এক্ষেত্রে আমরা যদি আমাদের লক্ষ্যকে, ভিশনকে, হাকিকতকে কেন্দ্রে স্থাপন করে এগিয়ে যেতে পারি তাহলে অবশ্যই চিন্তাগত সংকটকে মোকাবেলা করা সম্ভব। আমাদের প্রজন্মে মোকাবেলা করা সম্ভব না হলেও পরবর্তী প্রজন্মের কাছে রেখে যাব কারণ চিন্তার যুদ্ধটি একটি জাতির, প্রজন্মের ও একটি সভ্যতার যুদ্ধ।

এজন্য শপথ করতে হবে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে এই চিন্তা পৌছে দেয়ার। আর যদি এই চিন্তা পরবর্তী প্রজন্মের কাছে পৌছে দিতে পারি তাহলে অবশ্যই বিজয় আমাদের এবং এই ব্যাপারে আল্লাহ নিজে ওয়াদা করেছেন।

সর্বশেষ তালুত-জালুতের ঘটনাকে সামনে রেখে যদি শিক্ষা নিই যে, অনেক সংকট ও কঠিনতম পথ আমাদের পাড়ি দিতে হবে, সেই পথে বহুধরনের চ্যালেঞ্জ আসবে ও বাধা আসবে কিন্তু আমাদের ভিশনকে সামনে রেখে এগিয়ে গেলে, বড় একটি অংশ ঝড়ে পড়লেও যে অংশটি নবীর সাথে বিজয়ের ঝান্ডা উড়িয়েছিলো; সেই বিজয়ের ঝান্ডা উড়ানোর একজন কর্মী হিসেবে জাতির সামনে নিজেদেরকে তুলে ঊরতে পারব। আর এই প্রচেষ্টার মধ্যে দিয়েই সমাজ ও রাষ্ট্র উভয় দিক থেকেই সামনের দিকে এগিয়ে যাবে, পারষ্পরিক ভ্রাতৃত্য, রাষ্ট্রীয় ব্যাবস্থাপনায় প্রভাব পরবে ইনশাআল্লাহ্।

অস্তিত্ব সংকটে পড়ার পূর্বেই চিন্তায় গতিশীলতা ও চিন্তাগত ভিত্তি নির্মাণ করে রাজনৈতিক সংকট উত্তরণের জন্য সর্বোচ্চটুকু দিয়ে সংগ্রাম করে যেতে হবে। এটাই হোক আমাদের ইশতেহার।

১৪৯৪ বার পঠিত

শেয়ার করুন

Picture of হাসান আল ফিরদাউস

হাসান আল ফিরদাউস

সংগঠক এবং সমাজ ও সংস্কৃতি বিষয়ক গবেষক হাসান আল ফিরদাউস-এর জন্ম টাংগাইল জেলায়। পড়াশুনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়য়ে সমাজবিজ্ঞান বিভাগে। এছাড়াও আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও ইসলামী সভ্যতা নিয়ে পড়াশোনার পাশাপাশি উসূল, ফিকহ এবং রাজনৈতিক দর্শনের উপর বড় শিক্ষকদের সাহচর্যে গবেষণা করে যাচ্ছেন। আন্তর্জাতিক স্কলার ও চিন্তাবিদদের সমন্বয়ে নানাবিধ গবেষণা ও একাডেমিক কার্যক্রম পরিচালনার পাশাপাশি নিয়মিত লেখালেখি করছেন। বর্তমানে তিনি ‘ইসলামী চিন্তা ও গবেষণা ইন্সটিটিউট’-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্বরত আছেন। একইসাথে জ্ঞানের পুনর্জাগরণ ও নবধারার কাগজ ত্রৈমাসিক মিহওয়ার-এর সম্পাদকও।
Picture of হাসান আল ফিরদাউস

হাসান আল ফিরদাউস

সংগঠক এবং সমাজ ও সংস্কৃতি বিষয়ক গবেষক হাসান আল ফিরদাউস-এর জন্ম টাংগাইল জেলায়। পড়াশুনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়য়ে সমাজবিজ্ঞান বিভাগে। এছাড়াও আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও ইসলামী সভ্যতা নিয়ে পড়াশোনার পাশাপাশি উসূল, ফিকহ এবং রাজনৈতিক দর্শনের উপর বড় শিক্ষকদের সাহচর্যে গবেষণা করে যাচ্ছেন। আন্তর্জাতিক স্কলার ও চিন্তাবিদদের সমন্বয়ে নানাবিধ গবেষণা ও একাডেমিক কার্যক্রম পরিচালনার পাশাপাশি নিয়মিত লেখালেখি করছেন। বর্তমানে তিনি ‘ইসলামী চিন্তা ও গবেষণা ইন্সটিটিউট’-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্বরত আছেন। একইসাথে জ্ঞানের পুনর্জাগরণ ও নবধারার কাগজ ত্রৈমাসিক মিহওয়ার-এর সম্পাদকও।

মতামত প্রকাশ করুন

Scroll to Top