গত দুশো বছরের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, সামগ্রিকভাবে একটি জাতিকে জাগিয়ে তুলতে ও সমাজে আত্ম-শক্তিসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব গড়ে তুলতে পারস্পরিক যে সহযোগিতা আবশ্যক তা বর্তমান সমাজে অনুপস্থিত। এই সহযোগিতা ব্যক্তি থেকে রাষ্ট্র সকল পর্যায়ে জারি না থাকলে জাতির উত্তরণ অসম্ভব হয়ে পড়ে, এবং বিপরীতে এক মহাবিপর্যয় ডেকে আনে।
ইসলামী সভ্যতার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাই, পারিবারিক প্রভাব, সামাজিক প্রচেষ্টা, রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা ইত্যাদির ফলে গড়ে উঠতো শক্তিশালী ব্যক্তিত্ব। বিষয়টি সামগ্রিকভাবে সকল ক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ। সমন্বিত সহযোগিতা ব্যতীত বৃহত্তর পরিবর্তন সম্পূর্ণই অসম্ভব। একথা অন্যান্য সভ্যতার জন্য যতটা গুরুত্বপূর্ণ তার চেয়ে অনেকগুণ বেশি তাৎপর্যপূর্ণ মুসলিম মিল্লাতের জন্য।
প্রজ্ঞাময় আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন,
ﻭَﺍﻟَّﺬِﻳﻦَ ﻛَﻔَﺮُﻭﺍ ﺑَﻌْﻀُﻬُﻢْ ﺃَﻭْﻟِﻴَﺎﺀُ ﺑَﻌْﺾٍ ۚ ﺇِﻟَّﺎ ﺗَﻔْﻌَﻠُﻮﻩُ ﺗَﻜُﻦ ﻓِﺘْﻨَﺔٌ ﻓِﻲ ﺍﻟْﺄَﺭْﺽِ ﻭَﻓَﺴَﺎﺩٌ ﻛَﺒِﻴﺮ
যারা সত্য অমান্যকারী তারা একে অপরের সাহায্য করে৷ তোমরা (ঈমানদার লোকেরা) যদি পরস্পরের সাহায্যে এগিয়ে না আস তাহলে পৃথিবীতে ফিতনা সৃষ্টি হবে এবং বড় বিপর্যয় দেখা দিবে৷
(আনফাল : ৭৩)
পরস্পরে সহযোগিতার ব্যাপারে আয়াতটি আমাদেরকে প্রত্যক্ষ নির্দেশনা দিচ্ছে। বর্তমান জাহেলী ব্যবস্থা তথা পাশ্চাত্য সভ্যতা এক্ষেত্রে উদাহরণ পেশ করেছে, তারা যে ক্ষেত্রসমূহে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে সেগুলো হলো,
• জ্ঞানের ক্ষেত্রে সহযোগিতা।
• অর্থনৈতিক সহযোগিতা ইত্যাদি।
ইসলামী সভ্যতা এক্ষেত্রে সর্বশ্রেষ্ঠ মডেল। তৎকালীন সময়ের বিভিন্ন সালতানাতের মধ্যে আন্তঃযোগাযোগ, জ্ঞানের আদান-প্রদান ছিল লক্ষ্য করার মতো। এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে যেতো জ্ঞানার্জনের জন্য। যা ব্যক্তির গন্ডি পেরিয়ে রাষ্ট্র অবধি বিস্তৃত ছিল। এভাবেই মুঘল, উসমানীসহ সমসাময়িক বিভিন্ন সালতানাত সমৃদ্ধ হয়েছে, উপকৃত হয়েছে। আর জ্ঞানের ক্ষেত্রে পারস্পরিক সহযোগিতা, যোগাযোগ আবশ্যক। নইলে সামগ্রিকভাবে জ্ঞানার্জন অসম্ভব।
একটু লক্ষ্য করলেই দেখব যে, ক্ষমতাসীন পাশ্চাত্য সভ্যতা জ্ঞানের জগতে রাজত্ব করছে এবং বহুদূর অগ্রসর হয়েছে। কারণ তারা প্রতিটি ক্ষেত্রে একে অপরকে সর্বাত্মক সাহায্য করছে এবং প্রতিনিয়ত সেই সহযোগিতার ধারা অব্যাহত রাখছে। যেমন-
• স্কলারশিপ।
• Research and Development-এর ক্ষেত্রে কমন প্রজেক্ট।
• UNESCO.
• রয়াল ইন্সটিটিউট
• প্রতিবছর বিভিন্ন দেশের লক্ষাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থী এবং চিন্তাশীলদের কোর্স, বিভিন্ন সেমিনার ও কনফারেন্সে অংশগ্রহণ করানো সহ মানব সম্পদ উন্নয়নে সামগ্রিক প্রচেষ্টা।
ফলাফল হিসেবে গোটা দুনিয়া তাদের চিন্তা ও মেথডোলজি দিয়েই জ্ঞানচর্চা করছে, শিক্ষার্থীদের শিক্ষা দিচ্ছে এবং স্ব-স্ব অঞ্চল পরিচালনায় পরিকল্পনা করছে। এখানেও তারা সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করছে মুসলিম দেশগুলোর রাজনীতিবিদ, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের। কারণ বিকল্প কোনো মডেল নাই। যার ফলে সবাই-ই তাদের অনুকরণ করছে। ফলশ্রুতিতে , দেশ পরিচালনাকারী নেতা, বুদ্ধিজীবী মহল পাশ্চাত্য চিন্তার বাহিরে ভিন্ন কোনো কনসেপ্ট পেশ তো দূরের কথা চিন্তাও করতে পারেন না।
এখন প্রশ্ন আসতে পারে, আমাদের মুসলিম দেশগুলোতে সেই সুযোগ ও পরিবেশ নেই। কিংবা যারাও করছে তারা নির্দিষ্ট গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ। সেক্ষেত্রে ব্যক্তি পর্যায়ে কতটুকুই বা কাজ করা সম্ভব?
আমি মনেকরি, ব্যক্তি ও গ্রুপ পর্যায় থেকে অনেক কিছুই সম্ভব। কেননা, আল্লামা ইকবাল, মাওলানা মওদূদী, নাজমুদ্দিন এরবাকান, ত্বহা আব্দুর রহমানরা নিজস্ব চেষ্টা এবং শিক্ষকদের থেকে শিক্ষাগ্রহণ ও কাজ করেছেন। তবে তাদের পেছনে ছিলেন সহযোগিতাকারী মহান কারিগরগণ। সুতরাং আমাদের জন্যও তা অসম্ভব না।
আমাদের ইসলামপন্থীদের এক্ষেত্রে নিয়তে কোনো ঘাটতি নেই। সমস্যা হলো আখলাকী, সমস্যা হলো উদারতার, অভাব হলো সহযোগিতামূলক মানসিকতার।
এটা ঠিক যে, বর্তমানে বড় প্রতিষ্ঠান বা রাষ্ট্র পর্যায়ের সহযোগিতা আমাদের জন্য কল্পনাতীত ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু ব্যক্তি বা গ্রুপ পর্যায়ে জ্ঞানের জন্য আমরা পরস্পর পরস্পরকে পথ দেখানোর পাশাপাশি একে অপরকে পরামর্শ করতাম, কাজ দিতাম তাহলেও কি এই দৈন্যতা তৈরি হত? অন্তত ব্যক্তি বা নিজস্ব ক্ষেত্রগুলোতেও কি যোগ্য ব্যক্তিত্ব তৈরি বা লোক উঠিয়ে আনার চেষ্টা করছি? সহযোগিতা করছি? অর্থাৎ এটা চিন্তা করলেই উপলব্ধি করা করা যায় এভাবে ধারাবাহিক সহযোগিতা অব্যাহত থাকলে আমাদের অবস্থান কত উপরে চলে যেতে পারত।
যেভাবে, ইমাম জুয়াইনিরা-ইমাম গাজ্জালীদের, শাম-ই তাবরিজিরা—মাওলানা রুমিদের, আক শামসেদ্দিনরা—সুলতান ফাতিহদের, ইবনে তাইমিয়্যারা—ইবনে কাসির, মেহমেদ কতকুরা—এরবাকানদের তৈরি করেছিলেন।
উদার প্রজ্ঞাবান মানুষেরা এভাবে প্রজ্ঞাবান ব্যক্তি তৈরি করেছেন, তুলে এনেছেন। কিন্তু এমন দরদী প্রজ্ঞাবান আলেম কি এখন নেই? থাকলেও কি আমরা তাদের থেকে শিক্ষাগ্রহণ করি? সবচেয়ে ভয়াবহ দিক হলো, যারা চিন্তাগত ক্ষেত্র নিয়ে কাজ করতে চায়, যোগ্য হতে চায়, প্রান্তিক চিন্তার অধিকারীগণ তাদেরকে জাহেল মনে করে! বাতিল মনে করে! কেউ কাজ করলেও, এটা তো ওই দলের কিংবা ওই পন্থীদের, সুতরাং তাদের সাথে কি কাজ করব, আমার পন্থীরা কই! যেন একপন্থীরা সব মোকাবেলা করে ফেলবে!
চিন্তা করুন তো, যেখানে এমনিতেই আমরা শূন্যতে অবস্থান করছি, পাশ্চাত্যের মোকাবেলা ও ইসলামী সভ্যতার শ্রেষ্ঠত্ব তুলে ধরার মতো একজন বড় মাপের দার্শনিক আমাদের নেই, সেখানে অভ্যন্তরীণ এই সব সংকীর্ণ চিন্তা নিয়ে যদি বসে থাকি, তাহলে কোনো দিন কি পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে ন্যায়ভিত্তিক অর্থনীতির বিজয় সম্ভব? মানুষের মুক্তি সম্ভব? মুক্তির একমাত্র উৎস ইসলামী সভ্যতার পুনর্জাগরণ সম্ভব?
আমরা কোরআনের এই সাহায্যকে কোন অর্থে নিয়ে বসে আছি, নিজেরাও অনুভব করছি কিনা সন্দেহ।
এক আমেরিকার কিছু ইন্সটিটিউট যেখানে প্রতিবছর বিভিন্ন দেশের হাজার হাজার বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, শিক্ষার্থী এবং চিন্তাশীলদের কোর্স করায়, বিভিন্ন সেমিনার ও কনফারেন্সে অংশগ্রহণ করায়, সেখানে আমরা কি দেশীয় অবস্থান থেকেও কিছু কি করতে পারতাম না? কোনো প্লাটফর্ম কি আমাদের ছিল না? কতজনই বা গড়ে উঠছে আগামীর ইকবাল হিসেবে! কিন্তু তবুও কেন উদ্যোগ নেই?
ব্যক্তি উঠিয়ে আনা, সহযোগিতা, এক সার্কেল অন্য সার্কেলের সাথে সমন্বিত কাজ কোনোটাই আমাদের হচ্ছে না। জ্ঞানের নামে আমরাই সবচেয়ে বেশি অহংকার করি, একে অপরকে হিংসা করি, অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে আজ জ্ঞানের আকাশ বিষিয়ে উঠেছে!
ফলে আমরা কত বড় বিপর্যয়ের মুখে এবং সমাজের কাছেও ইসলামপন্থীরা ক্রমেই পশ্চাৎপদ হয়ে যাচ্ছি। তাই, জ্ঞানের পুনর্জাগরণ, যুগের আলোকে কাজ ও পরিবেশ সৃষ্টির জন্য আয়াতের শিক্ষাকে কাজে লাগানোর কোনোই বিকল্প নেই। ইখলাসপূর্ণ সহযোগিতার মাধ্যমে যোগ্য মানুষ উঠিয়ে আনতেই হবে, অন্যথায় সমগ্র দুনিয়াতেই মহাবিপর্যয়ের সৃষ্টি হবে।
এজন্য আমাদের নিজেদের আখলাকী অন্তর বা নৈতিক জমিনকে প্রস্তুত করার দোয়া ও চেষ্টা করি। কারণ এই জমিন প্রস্তুত হলেই আমরা নিজেরা তৈরি হতে পারব এবং অন্যদের তৈরি করতে পারব। সহযোগিতার নতুন দুয়ারও উন্মোচিত হবে, ইনশাআল্লাহ।