বিশ্বসভ্যতায় বাংলার মুসলমানদের অবদান প্রশ্নে এ প্রজন্মের চিন্তাধারা

একটি জাতির সম্মান ও মর্যাদা হলো সে জাতি বিশ্বসভ্যতায় কী অবদান রেখেছে তা। আরবী ভাষায় একটি প্রবাদ আছে,
شرف المكان بالمكين
অর্থাৎ “কোনো স্থানের সম্মান সে স্থানে বসবাসকারীদের উপর ভিত্তি করে নির্ণীত হয়।”
এ প্রশ্নের আলোকে মুসলিম উম্মাহর দ্বিতীয় বৃহৎ জনগোষ্ঠী বাংলার মুসলমানদের অবদান নিয়ে অনেকেই অযৌক্তিক সমালোচনা, নানাবিধ প্রশ্ন উত্থাপন করে যাচ্ছেন!
প্রশ্ন ওঠে, বিশ্বসভ্যতায় বাংলার মুসলমানদের ঠিক কী অবদান আছে? বাংলার আদৌ কোনো সমৃদ্ধ ইতিহাস আছে কিনা?
বাংলায় মুসলিম শাসন বহিরাগত মুসলমানদের দ্বারা হওয়ার কারণে তা বাংলার নিজস্ব সালতানাত হতে পারেনি, বহিরাগত মুসলমান কিংবা আশরাফ-আতরাফ তত্ত্ব, বাঙ্গালী মুসলমান ইত্যকার কড়চা বাংলা অঞ্চলের মুসলমানদের ইতিহাস আলোচনায় নতুন নয়। কিন্তু প্রশ্ন হলো মৌলিক ইতিহাস বিস্মৃত হয়ে আমরা কেন এ সকল আলাপেই নিমগ্ন হই? এর বেশ কিছু কারণ রয়েছে।
প্রথমত, পুঁজিবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী পাশ্চাত্য সভ্যতা চায় মুসলমানদেরকে ও অন্যান্য জাতিকে ইতিহাসবিহীন জাতিতে পরিণত করতে। আর এক্ষেত্রে তারা সবচেয়ে বেশি সফল হয়েছে আফ্রিকা ও ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানদের ক্ষেত্রে।
একইসাথে বৃটিশ একাডেমিয়া কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত শিক্ষাব্যবস্থা আজ গোটা উপমহাদেশে বিদ্যমান। ফলশ্রুতিতে মুসলমানদের আত্মবিশ্বাস তৈরি, ইতিহাস ও সভ্যতার বয়ান তৈরির ক্ষেত্রে স্বাধীন জ্ঞান চর্চা নেই, পর্যাপ্ত শিক্ষক নেই! তাই আমরা বাঙালীরা নিজস্ব সমৃদ্ধ ইতিহাস বাদ দিয়ে বৃটিশ একাডেমিয়া, ওরিয়েন্টালিস্টদের তৈরি করা ইতিহাসের বয়ানকে সামনে রেখে সবকিছু পাঠ করি এবং বিচার-বিশ্লেষণ ছাড়াই তা গ্রহণ করি।
দ্বিতীয়ত, আমরা যতটুকু গ্রহণ করি, ততটুকুই আবার ভারতীয় সংস্কৃতি আর সভ্যতার অংশ হিসেবে গ্রহণ করি (যেটা মূলত উপমহাদেশের ইসলামী সভ্যতার গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসকে পুরোপরি সরিয়ে ফেলার জন্য ব্রিটিশ-ব্রাক্ষ্মণ্যবাদীদের যৌথ প্রজেক্ট)। অথচ আমরা ভুলে যাই, আজকের গৌরবোজ্জ্বল ভারতীয় সভ্যতার অধিকাংশ ভিত্তিমূল মুসলিম শাসনকালের সৃষ্টি।
পাশাপাশি ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিম সালতানাতের পূর্বে একটি শক্তিশালী ও সমৃদ্ধ সভ্যতা ছিলো। সে সভ্যতা গণিতের ধারণা দিয়েছে, দর্শনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে, আরো অনেক ক্ষেত্রে তাদের পদচারণা ছিলো। এক কথায় তারা ছিলো সমৃদ্ধ। কিন্তু পরবর্তীতে সে সমৃদ্ধির জায়গা থেকে প্রতিটি বিষয়কে আরো বেশি উন্নত করেছে মুসলিম সালতানাত। অর্থনীতি, প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্রনীতি, কৃষি, ধর্মীয় সম্প্রীতি, শিক্ষাব্যবস্থা– সব ক্ষেত্রেই অনেক বেশি সমৃদ্ধশালী হয়ে উঠেছিলো উপমহাদেশের মুসলিম সালতানাতগুলো।
কিন্তু এসবকে আমরা অবদান হিসেবে দেখি না কিংবা তুলে ধরতে পারিনা কেন? কেনই-বা বারবার হীনম্মন্য বয়ান তথা বাঙ্গালীর ইতিহাস নেই, অবদান নেই ইত্যাদি বয়ান তুলে ধরি!
আমরা এ ভুল কেন করছি? আমাদের পূর্ববর্তী ইতিহাস তো আমাদের এটি শেখায় না!
আব্বাসী খেলাফতের সময় যখন সারা দুনিয়ার বিভিন্ন সভ্যতার মৌলিক গ্রন্থ, জ্ঞানসমূহ অনুবাদ করা হচ্ছিলো, রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় সারা দুনিয়ার জ্ঞানকে একত্রিত করা হচ্ছিলো, তখনও কিন্তু মুসলমানরা সবকিছু একদম ঢালাওভাবে অনুবাদ করে ফেলেনি কিংবা সবকিছুকে গ্রহণও করেনি। তাহলে এখন আমরা কেন চোখ বুঁজে বৃটিশ একাডেমিয়ার বয়ান মেনে নিচ্ছি?
আমরা আমাদের ইতিহাস, অন্যান্য ইতিহাস, ওরিয়েন্টালিস্টদের ইতিহাস, ইউরোপীয় বয়ান, ব্রাহ্মণ্যবাদীদের বয়ানকে কেন আমরা সেভাবে পর্যালোচনা করতে পারছি না? কতটুকু গ্রহণ বা কতটুকু বাদ দেওয়া দরকার, সেটা আমরা কেন বুঝতে পারছি না?
তৃতীয়ত, বিশ্বসভ্যতায় অবদান কীভাবে রাখতে হয়? সভ্যতার মৌলিক ভিত্তিসমূহ কী কী, যা দ্বারা বিশ্বসভ্যতার দৃষ্টিকোণ থেকে কোনো জাতির অবদান পর্যালোচনা করা যায়? এগুলো হলো–
১. জ্ঞান।
২. অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক উৎপাদন।
৩. রাজনীতি ও প্রশাসন।
এছাড়াও ভাষা, নগর ও স্থাপত্য আলাদা গুরুত্ব বহন করে। তাই এসব বিষয়ও আলাদা পর্যালোচনার দাবি রাখে৷
এসব ক্ষেত্রে বাংলার মুসলমানদের অবস্থান পর্যালোচনা করা যাক।
১. জ্ঞানের ক্ষেত্র:
ইসলামের ইতিহাসে আমরা দেখতে পাই, রাসূল (স.) দারুল আরকাম প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সাহাবীদেরকে শিক্ষা দেওয়া এবং জ্ঞান যে একটি জাতি বা সমাজের ভিত্তি হিসেবে কাজ করবে তা উম্মতের সামনে তুলে ধরেন।
পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথমবারের মতো শিশু ও বন্দীদেরকে লিখাপড়া শেখানোর মাধ্যমে মুক্তিপণ দেওয়ার ব্যবস্থা চালু করেন তিনি, যার নজির দ্বিতীয়টি নেই। এরপর আসহাবে সুফফা প্রতিষ্ঠাসহ নানাবিধ সামষ্টিক উদ্যোগ গ্রহণ করেন। আমরা জানি যে, কোরআনে ‘ইকরা’ বলতে সামগ্রিকতাকে বোঝানো হয়েছে, অর্থাৎ তুমি মানুষকে পড়ো, সমাজকে পড়ো, মানুষের রূহকে পড়ো, সামগ্রিকভাবে মহাবিশ্বকে পড়ো– এ কথা বলা হয়েছে। এজন্যই এত দ্রুত মানব সভ্যতায় মুসলমানদের প্রভাব বিস্তার সম্ভব হয়েছিলো। অথচ বর্তমান সময়ে আমরা পড়ালেখাকে কিছু নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যের মাঝে সীমাবদ্ধ করায় আমাদের সভ্যতাকে পর্যন্ত প্রকৃত অর্থে তুলে ধরতে পারছি না!
জ্ঞানের গুরুত্বের বিষয়টা আমরা আমাদের সভ্যতায় প্রতিটি ক্ষেত্রে দেখতে পাই। যেমন– উসমানী খেলাফত। উসমানী খেলাফত শুরু হয় উসমান গাজীর মাধ্যমে, যিনি ছোট একটি গোত্র প্রতিষ্ঠা করার পর সর্বপ্রথম উরহানিয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন এবং তৎকালীন সময়ের সেরা আলেম আল্লামা দাউদ আল কায়সারীকে সে মাদরাসার প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিয়ে আসেন। তিনি ছিলেন তৎকালীন সময়ে আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের অত্যন্ত প্রভাবশালী একজন শিক্ষক। Morning Shows the day, সকালের সূর্য বলে দেয় দিন কীভাবে যাবে! উরহানিয়া মাদ্রাসাও তার ভবিষ্যৎ দেখিয়ে দিয়েছিলো।
ইসলামী সভ্যতার অধিকাংশ খলিফা-ই শিক্ষাব্যবস্থায় সর্বোচ্চ জোর দিয়েছেন। বিভিন্ন ধারার উত্থান, জ্ঞানের আন্দোলন ও গুরুত্বপূর্ণ মাদ্রাসাসমূহ তাদের পৃষ্ঠপোষকতায়-ই প্রতিষ্ঠা হতো।
এবার ভারতীয় উপমহাদেশের প্রসঙ্গে আসি। ভারতীয় উপমহাদেশের ক্ষেত্রে জহিরুদ্দিন মুহাম্মদ বাবরসহ অধিকাংশ সুলতানের অবদান আমাদের জন্য অবিস্মরণীয়। পাশাপাশি এ অঞ্চলে সূফী দরবেশদের মাদ্রাসাসমূহ জ্ঞানের ক্ষেত্রে অনন্য অবদান রেখেছে। এসব প্রতিষ্ঠান থেকেই মুজাদ্দিদে আলফে সানী, ইমাম শাহ ওয়ালীউল্লাহ দেহলভী, মহাকবি আলাওল ও সুলতান গিয়াস উদ্দিন আজম শাহরা উঠে এসেছেন। এখান থেকেই উঠে এসেছেন কুতুব মিনার, আতিয়া মসজিদ, আন্দরকিল্লার স্থাপত্যবিদরা। ধ্বংস্তুপে পরিণত হওয়া চাঁপাইনবাবগঞ্জ এর দারসবাড়ি, মাদ্রাসাসমূহ যে আমরা দেখতে পাচ্ছি, এসব ছিলো মুসলিম সালতানাতের শ্রেষ্ঠ স্মৃতিচিহ্ন, শিক্ষার প্রাণকেন্দ্র।
এতকিছুর পরেও বলা হয়ে থাকে, উপমহাদেশে কোনো শিক্ষাব্যবস্থা ছিলো না!
এক্ষেত্রে ছোট্ট একটি প্রশ্ন হলো শিক্ষাব্যবস্থা যদি না-ই থাকতো, তাহলে কীভাবে ইমাম শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভীর মতো শ্রেষ্ঠ মুজতাহিদ উঠে এসেছেন? কীভাবে বাদশাহ আলমগীর উঠে এসেছেন? বাংলার বুজুর্গ উমেদ খাঁ এর মতো সেনাপতি, ইবনে হোসেনের মতো নৌ-সেনাপতি, দেওয়ান মুনাওয়ার খানের মতো বীর যোদ্ধা, বারো আউলিয়া সিপাহসালার সৈয়দ নাসিরউদ্দিন ও বদর পীরসহ এ ধরনের ব্যক্তিত্বরা কীভাবে উঠে এসেছেন?
কীভাবে আল বিরুনী উঠে এসেছেন? তৎকালীন শিক্ষাব্যবস্থার অধীনস্থ মাদরাসা থেকে পড়াশোনাকারীরা কীভাবে তাজমহলের ন্যায় অনবদ্য স্থাপত্য তৈরি করেছেন? বাংলার এত এত স্থাপত্য কীভাবে তৈরি হলো? কীভাবে উপমহাদেশের অন্তর্ভূক্ত আফগানিস্তানের থেকে মানবতার ইতিহাসে সেরা আলেম ইমাম ফখরুদ্দীন রাযী উঠে এসেছেন? আগা বাকের খাঁ, শায়েস্তা খাঁ, সেকান্দার গাজীদের মতো মনীষীগণ-ই বা কীভাবে তৈরি হলেন?
বলা হয়ে থাকে, বাংলা অঞ্চলের মুসলমানরা নিরক্ষর ছিলো! অথচ সাড়ে সাতশো বছরের ঐতিহ্যবাহী মক্তবগুলো বাংলার শিক্ষাব্যবস্থার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। এখানের প্রতিটা গ্রামে গ্রামে, বাড়িতে বাড়িতে মক্তব প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো। যে অঞ্চলের মানুষ কোরআন পড়তে জানে, সে অঞ্চলের মানুষ কীভাবে নিরক্ষর হয়?
তারা বলে, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা ছিলো না, শিক্ষা ক্ষেত্রে কোনো কাজ হয়নি। শিক্ষা ক্ষেত্রে আমাদের অবস্থানকে তারা অস্বীকার করে নির্দ্বিধায়। আবার তারাই বলছে, এ অঞ্চলে অর্থনীতি ছিলো, কৃষি ছিলো, প্রশাসন ছিলো, রাষ্ট্র ছিলো। এগুলোকে তারা স্বীকার করে। এখন প্রশ্ন হলো এ ক্ষেত্রগুলো কি কোনো ধরনের শিক্ষাব্যবস্থার সাহায্য ছাড়া এমনিতেই সচল ছিলো? অর্থাৎ তারা ধোঁয়াকে স্বীকার করছে, কিন্তু আগুনকে অস্বীকার করছে! আমরাও তার অনুসরণ করছি! এখানে কি স্পষ্ট বোঝা যায় না যে, এসব ব্রিটিশ একাডেমিয়ার ইতিহাসবিহীন জাতিতে পরিণত করার পরিকল্পনা বা ষড়যন্ত্রের অংশ? (তবে বাংলার শিক্ষাব্যবস্থার উচ্চমানের দ্বিধাহীন প্রশংসাও বৃটিশদের অনেকে করেছেন। যেমন– বৃটিশ জেনারেল স্লিম্যান। তিনি তাঁর লেখায় বাংলা অঞ্চলের শিক্ষাব্যবস্থাকে অক্সফোর্ডের সাথে তুলনা করেছেন। বাস্তবতা হলো বাংলা অঞ্চলের শিক্ষাব্যবস্থা তাঁর বয়ানের তুলনায় বহুগুণ সমৃদ্ধশালী ছিলো।
সাংস্কৃতিক আধিপত্য এবং ইতিহাসের বিকল্প বয়ান তৈরির ক্ষেত্রে প্রভাবশালী শক্তি, অঞ্চল কিংবা রাষ্ট্র তার নিজস্ব সংস্কৃতি অধীনস্থদের উপর চাপিয়ে দেয় এবং অধীনস্থদের সংস্কৃতির প্রতিটি ক্ষেত্র ধরে নিজেদের সংস্কৃতির আদলে বিকল্প চিন্তার বাস্তবায়ন ঘটায়। ফলশ্রুতিতে অধীনস্থরা তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি বিস্মৃত হয়ে যায়। এর মাধ্যমে অধীনস্থ বা শোষিত জনগোষ্ঠীর ইতিহাসকে ধ্বংস করে দেওয়া হয়। বাংলা অঞ্চলের ক্ষেত্রেও ব্রিটিশ উপনিবেশবাদীরা এ কাজটিই করেছে। এর মাধ্যমে প্রথমেই তারা বাংলায় ইসলামী সভ্যতার স্মারকচিহ্নগুলো ধ্বংস করে দেয়। উদাহরণস্বরূপ, জার্মান পণ্ডিত ম্যাক্স মুলারের হিসাব অনুযায়ী ব্রিটিশরা বাংলা দখল করার পরেও ৭০,০০০ প্রতিষ্ঠান বিদ্যমান ছিলো। অথচ আজ তার একটিও আমরা খুঁজে পাই না! আজ আমরা সোনারগাঁওয়ের মাদ্রাসাতুশ শরফ, দারসবাড়িগুলো সম্পর্কে জ্ঞাত নই!
অর্থাৎ জ্ঞান একটি জাতি বা সমাজের ভিত্তি হিসেবে কাজ করে এবং সকল ফলাফল জ্ঞানের উপর ভিত্তি করে হয়ে থাকে। জ্ঞান যত বেশি, প্রোডাকশন তত বেশি হয়।
পাশাপাশি জ্ঞান ছাড়া কোনো সভ্যতাই নিজস্ব ভিত্তি নিয়ে টিকে থাকতে পারে না। এক্ষেত্রে উল্লেখ্য, বাংলায় মুসলিম সভ্যতার সময়কাল ছিলো ৫০০ বছর! যদি জ্ঞান না থাকতো, তবে এ সভ্যতা কীভাবে এত দীর্ঘ সময় টিকে ছিলো?
বর্তমান সময়ের একটি সাধারণ বিল্ডিং নির্মাণের ক্ষেত্রেও আমরা স্থাপত্য এবং সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং এর ক্ষেত্রে যথেষ্ট জ্ঞান না থাকার কারণে হুবহু পাশ্চাত্যকে অনুকরণ করছি। অর্থাৎ যে সকল ক্ষেত্রে আমাদের জ্ঞান নেই, সে সকল ক্ষেত্রে আমরা ব্যর্থ হচ্ছি! এভাবে সমাজের সকল উৎপাদন ও ভিত্তিমূল জ্ঞানের উপর নির্ভরশীল।
তাই পাঁচশো বছরের বাংলা অঞ্চলের মুসলিম সভ্যতার শ্রেষ্ঠ অর্থনীতি, শক্তিশালী প্রশাসন, উন্নত কৃষি ও শিল্প, সেরা প্রতিরক্ষাব্যবস্থা, গৌরবোজ্জ্বল নগর ও স্থাপত্য ইত্যাদিই বুঝিয়ে দেয়, আমাদের জ্ঞানতাত্ত্বিক ভিত্তি কতটা মজবুত ছিলো, বিশ্বসভ্যতায় আমরা কীভাবে অবদান রেখেছিলাম!
২. অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক উৎপাদন:
ভারতীয় উপমহাদেশে ছিলো অত্যন্ত সমৃদ্ধ একটি অঞ্চল। সমগ্র বিশ্বের প্রায় ২৫-৩০% GDP নিয়ন্ত্রণ করতো এ উপমহাদেশ। আমাদের কৃষি থেকে শুরু করে মসলা, কাপড় বিশ্ব-বিখ্যাত ছিলো। এ দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে আমাদের বাংলা ছিলো কৃষি ও বাণিজ্যের অন্যতম মূল রাজধানী। এটি প্রতিষ্ঠিত সত্য যে, আমরা উপমহাদেশের মুসলমানগণ ও বাংলা সালতানাত পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি অবদান রেখেছি অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে। সুতরাং এ অবদানকে কেউ প্রশ্নবিদ্ধ করা এক প্রকার বাতুলতা!
পাশাপাশি ইসলামী সভ্যতা একইসাথে দেখিয়েছে যে, শুধু অর্থনৈতিক উৎপাদন একটি সভ্যতাকে খুব বেশি সামনে এগিয়ে নিতে পারে না, একইসাথে সাংস্কৃতিক উৎপাদনও করতে হয়। সাংস্কৃতিক উৎপাদনের সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, জ্ঞানের চর্চা। শহর ও গ্রামকে বসবাসের উপযোগী করে আমি যে মূল্যবোধকে ধারণ করি তার আলোকে গড়ে তোলা। অধিকাংশ শহরে সে মূল্যবোধ লালিত হবে, আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম সে মূল্যবোধ ধারণ করে বেড়ে উঠবে। মূল্যবোধ ও সংস্কৃতির প্রতিফলনের জন্য সূরা বনী ইসরাঈলের ২৬ থেকে ৩৮ নাম্বার আয়াত থেকে শিক্ষা নেওয়া হতো। এগুলো বর্তমানে আমাদের সমাজে কতটুকু বাস্তবায়িত? অর্থাৎ সাংস্কৃতিক উৎপাদন সম্পর্কেও আমরা এখন জ্ঞানহীন। যেমন– আমাদের মিউজিক, আর্ট, শিল্পকলা, স্থাপত্য, আমাদের ঘরের সাজসজ্জা কোথা থেকে এসেছে? আমার ঘরে আমার স্থানীয় সংস্কৃতি, ইসলামী সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ কতটুকু প্রতিফলিত হয়? এ বিষয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এগুলোতে আমরা নজর দেই না কিংবা ইসলামী সভ্যতার গুরুত্ব-ই উপলব্ধি করি না!
পুঁজিবাদী আগ্রাসনের ধাক্কায় কীভাবে টাকা উপার্জন করবো, আমেরিকান ড্রিমস কীভাবে বাস্তবায়ন করবো সেদিকেই আমরা নিজেদের ধ্যান-জ্ঞান দিয়ে রাখি! কিন্তু আমাদের ভাষা-সংস্কৃতি কতটুকু শক্তিশালী সেদিকে নজরও দিচ্ছি না! সভ্যতা বা সংস্কৃতির সবচেয়ে বড় ঘর হলো ভাষা। যেমন– সিঙ্গাপুর, আরব আমিরাত অর্থনৈতিকভাবে উন্নত, কিন্তু সাংস্কৃতিগতভাবে শূন্য! সেখানকার অধিবাসীরা আরবী, আঞ্চলিক মাতৃভাষার চেয়ে ইংরেজিতেই বেশি কথা বলে, যার ফলেই তাদের এ অবস্থা।
অর্থনৈতিক উন্নতির পাশাপাশি সাংস্কৃতিক উন্নতির গুরুত্ব বোঝাতে গিয়ে “ইসলামী ডেক্লারেশন”-এ আলীয়া বলেছেন, “শুধু এককেন্দ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন একটি জাতিকে নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।”
এ এককেন্দ্রিকতা একটি জাতিকে অধঃপতনের দিকেও নিয়ে যায়। যেমন– বর্তমান সমাজ। যেখানে আমাদের সাহিত্য, আমাদের কবিতা, আমাদের শিল্প কোনো কিছুরই বিকশিত হওয়ার সুযোগ নেই! সবই পুঁজিবাদী আগ্রাসনের হাতে বন্দী!
যাই হোক, আমরা যদি বাংলার মুসলিম সালতানাতের ইতিহাস পর্যালোচনা করি, তাহলে এ বিষয়টি অসাধারণভাবে ফুটে ওঠে। এ সালতানাত অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক উৎপাদন সমানভাবে করে একটি উন্নত সভ্যতা বিশ্ববাসীকে উপহার দিলো, অসাধারণ উপমা হিসেবে পেশ করলো, তবুও আমরা বলছি বিশ্বসভ্যতায় আমাদের অবদান নেই!
৩. রাজনীতি ও প্রশাসন:
জ্ঞান ও উৎপাদনকে সঠিকভাবে বন্টন করবে রাষ্ট্রীয় আকল, কারণ এটির সঠিক বাস্তবায়ন না হলে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হবে। এক্ষেত্রে ইসলামের মূলনীতি হলো–
• আদালত।
• ইহসান।
• সামাজিক নিরাপত্তা।
• ব্যক্তিত্বের বিকাশ সাধন।
• চিন্তা ও ধর্মের স্বাধীনতা (ইসলাম কারো ব্যক্তি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করে না।)।
ইসলাম যেহেতু মানুষকে মূল্যবোধের আলোকে গড়ে তোলে, তাই আমাদের সমাজের ভিত্তি হলো আখলাক এবং আদালত।
যেসব রাষ্ট্র নাগরিকদের মর্যাদা, নিরাপত্তা নিশ্চিত কর‍তে পারেনি, উল্টো তাদের উপর কঠোরতা আরোপ করেছে, সেসব রাষ্ট্র খুব কম সময়ই টিকে থাকতে পেরেছে। যেমন– সোভিয়েত ইউনিয়ন মাত্র ৭০ বছর টিকে ছিলো, কারণ এ রাষ্ট্রব্যবস্থা জনগনের শোয়ার ঘর পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেছে!
কিন্তু একেকটি ইসলামী রাষ্ট্র ৫০০-৭০০ বছর স্বমহিমায় দাঁড়িয়ে ছিলো, বাংলা সালতানাতের ইতিহাসও ভিন্ন নয়। সুতরাং বিশ্বসভ্যতায় এ অনন্য উপমা কীভাবে প্রশংসিত হবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আমরা আমরা সমাজকে মূল্যবোধের আলোকে গড়ে তুলেছিলাম। সে সমাজে মূল বিষয় ছিলো ইহসান। এখানে আইন, আদালত আর ইহসান হলো আখলাকের বিষয়। এজন্য আমাদের সমাজে ভিত্তি ছিলো আখলাক। এভাবে শ্রেষ্ঠত্বের নিশান উড়িয়েছিলো আমাদের বাংলা সালতানাতের প্রশাসনিক ব্যবস্থাও।
নগর, সংগীত ও স্থাপত্য:
একটি সভ্যতার মোহর দুই জায়গায় খুব শক্তিশালীভাবে প্রতিফলিত হয় এবং সংস্কৃতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো–
১. সংগীত, মিউজিক।
২. স্থাপত্য।
হিন্দুদের উলু ধ্বনি জাতীয় কিছু বিষয় ছাড়া নিজস্ব কোনো মিউজিক ছিলো না, এবং এখনকার যা রয়েছে, সবই অন্যদের থেকে ধার করা! হিন্দু মিউজিক বলে পরিচিত এ রকম শক্তিশালী ভিত্তিসম্পন্ন কিছু পাওয়া যায় না, বরং ভারতীয় উপমহাদেশে যতগুলো মিউজিকের ধারণা, সব মুসলমানদের তৈরি করা। কাওয়ালি, হামদ ও নাত, মারেফতী, মুর্শিদি, ভান্ডারী, সুফী সংগীত ভারতীয় উপমহাদেশের সুফীদের সংগীতের ভান্ডার। আবার নকশীবন্দী ত্বরিকাসহ সবারই আলাদা সংগীতের ধারা রয়েছে। আমির খসরু বা আখি সিরাজ উপমহাদেশের মিউজিক জগতের অন্যতম স্তম্ভ। কাওয়ালী থেকে শুরু করে বিশাল একটি ধারা উনাদের মাধ্যমেই শুরু হয়েছে। হাল আমলের সুরসম্রাট নুসরাত ফতেহ আলী, সামি ইউসুফও এর দ্বারা প্রভাবিত। এবং বৃটিশ শোষণ পরবর্তী নজরুলের সংগীতের যে প্রাজ্ঞতা, তা পূর্বের সালতানাতের রূহের সাক্ষ্যই বহন করে।
ঐতিহাসিকদের মতে, বাংলা অঞ্চলে বহু ধারার মিউজিক বিদ্যমান ছিলো। সুতরাং এ সভ্যতা শুধুমাত্র মিউজিকের ক্ষেত্রেই যদি এত কিছু করে থাকে, তাহলে অন্যান্য ক্ষেত্রে কী করেছিলো তা সহজেই অনুমেয়!
এখন আমরা যদি আমাদের স্থাপত্য নিয়ে পর্যালোচনা করি, সেক্ষেত্রে একটি উদাহরণ দিয়ে আমাদের অবদান তুলনা করতে চাই। ভারতীয় উপমহাদেশে হিন্দুদের মন্দিরের অবকাঠামো মুসলমানরা আসার পরে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। কীভাবে পরিবর্তন হয়েছে? হিন্দুদের স্থাপত্যকলায় জানালার ধারণা সে অর্থে ছিলো না, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জানালা সদৃশ ছিদ্রের প্রচলন ছিলো শুধু। কিন্তু মুসলমানরা যাওয়ার পর, বিশেষ করে কুতুব মিনার তৈরির পর থেকে তারা বড় বড় জানালা বানাতে শুরু করে, এভাবে সব ক্ষেত্রেই মুসলমানদের মতো পরিকল্পিত বিষয় গড়ে তোলার চেষ্টা করে। বাস্তবতা হলো এ ধর্মগুলোর মাধ্যমে কখনোই স্থাপত্যের শক্তিশালী ভিত্তি রচনা করা, ছাপ ফেলা সম্ভব নয়। যেমন– হিন্দু, জৈন ধর্মে পরিচ্ছন্নতার ধারণা পর্যন্ত গোছালো মূলনীতি আকারে নেই! সুতরাং তারা কিছু মন্দির প্রতিষ্ঠা করলেও সে অর্থে তাদের দ্বারা স্থাপত্য প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে উপমহাদেশে আমরা মুসলমানরা গর্বের সাথে বলতে পারি, স্থাপত্য, পরিকল্পিত নগর আমরাই সফলভাবে সৃষ্টি করতে পেরেছি এবং আমরাই বিশ্বসভ্যতায় এক অনন্য নজির সৃষ্টি করেছি। সমসাময়িক পৃথিবীতেও স্থাপত্য ও নগর পরিকল্পনায় আমরাই ছিলাম অতুলনীয়।
বাংলা অঞ্চলের শত শত প্রাচীন মুসলিম স্থাপত্য, পুরান ঢাকার স্মৃতিচিহ্ন, সোনারগাঁওসহ ১২০০ সালে প্রতিষ্ঠিত এসব প্রাচীন ক্ষেত্র কিসের সাক্ষ্য দেয়? সাক্ষ্য দেয়, স্থাপত্য এবং মিউজিকে আমরা সেরা ছিলাম। কিন্তু জ্ঞান ও বুদ্ধিভিত্তিক ক্ষেত্রে সমাজ তার হাফেজা তথা মেমোরিকে হারিয়ে ফেলার কারণে আমাদের মনে হচ্ছে, চিন্তাগত ক্ষেত্রে বাংলার মুসলমানরা বিশ্বসভ্যতায় কোনো অবদান রাখতে পারেনি। অর্থাৎ বিশ্বসভ্যতা অবদানের সংজ্ঞাই আমরা বৃটিশ একাডেমিয়ার আদলে পর্যালোচনা করছি, আর তাই হীনম্মন্যতার বয়ান দিচ্ছি!
চিন্তা করে দেখি তো, একটি সভ্যতা স্থাপত্য, মিউজিক শিল্পে এত উন্নতি সাধন করেছে, অথচ এর কোনো জ্ঞানগত ভিত্তি ছিলো না– এটি কখনো সম্ভব? আবার ইদানীং বলা হচ্ছে, বাংলার কোনো চিন্তাগত ভিত্তি নেই, থাকলেও তার রেফারেন্স বা দলিল নেই, সুতরাং বিশ্বসভ্যতায় বাংলার কোনো অবদান নেই।
প্রশ্ন হলো সূর্য যে আছে তার দলিল কী?
জবাব হলো আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখুন। কারণ সূর্যের কখনো দলিল প্রয়োজন হয় না। অর্থাৎ সব কিছুর জন্য দলিল প্রয়োজন হয় না, আকলী চোখ দিয়ে লক্ষ্য করলেই তা উপলব্ধি করা যায়।
আমাদের সবচেয়ে বড় দলিল হলো এ বাংলার জমিন, যে জমিনে এত বড় বড় স্থাপত্য গড়ে উঠেছে, যে জমিনে এত শক্তিশালী অর্থনৈতিক ভিত্তি গড়ে তোলা হয়েছে; সে সংস্কৃতি, যে সংস্কৃতি এত উৎকর্ষ সাধন করেছে; সে কয়েকশো বছরের শক্তিশালী প্রশাসন, রাজনীতি ও শিক্ষাব্যবস্থা, যা পৃথিবীকে আন্দোলিত ও লালিত করেছে; যে সমাজের জ্ঞান ও চিন্তা, যার উপর ভিত্তি করে এত সুলতান, আলেম ও ব্যক্তিত্ব গড়ে উঠেছে। এসবই কি সবচেয়ে বড় দলিল নয়?
মূলত এক্ষেত্রে আমরা সবচেয়ে বেশি ব্যর্থ হয়েছি জাতির হাফেজা তথা স্মৃতিভান্ডার বা মেমোরি রক্ষার ক্ষেত্রে। ইসলামী সভ্যতার শুধুমাত্র মূলনীতির উপর ভিত্তি করেও আমরা অনেক কিছু তৈরি করতে পারতাম; তুলে ধরতে পারতাম, সাংস্কৃতিক উৎপাদন সবচেয়ে বেশি ফুটে উঠেছে শহরে, কারণ সভ্যতার প্রতিফলন শহরে, সমাজে ও মানুষের চিন্তা-চেতনায় সবচেয়ে বেশি হয়। কিন্তু এগুলো আমাদের কোথাও নেই, আমাদের শহরগুলো আজ এক একটি ধ্বংসস্তুপ!
তাই নয়া আহ্বান হওয়া উচিত, আমরা যার যার অবস্থান থেকে হলেও কাজ করবো, বাড়ি বানালে সেটা আমাদের সভ্যতার আলোকে সুন্দর করে বানাবো। আমাদের সমাজ, আবহাওয়ার সাথে সম্পৃক্ত এ ধরনের বাড়ি বানাতে হবে। এক্ষেত্রে মূলনীতি হওয়া উচিৎ, আমি যদি সম্পূর্ণ করতে না পারি, তাহলে সম্পূর্ণ ছেড়ে দিবো না। আমার যতটুকু সামার্থ্য আছে, ততটুকুর আলোকে করবো। এভাবে যদি আমরা আমাদের বাড়িকে সাজাতে পারি, তাহলে সময়ের ব্যবধানে অবশ্যই একটি পরিবর্তন আসবে, কারণ মানুষ সুন্দরের পূজারী। সুন্দর দেখলে মানুষ এমনিতেই আকর্ষিত হয়। তাই যা আছে, তাকে সুন্দর, সাংস্কৃতিকভাবে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করা আবশ্যক।
বাংলা ভাষার সমৃদ্ধির পিছনে মুসলমানদের অবদান, তাদের ঐতিহাসিক ভিত্তি স্থাপনের বর্ণনা দু-চার লাইনে ব্যাখ্যা করলে তা অসমাপ্ত রয়ে যাবে এবং বাংলা ভাষার সমৃদ্ধশালী ইতিহাস ও উপাখ্যানের প্রতিও অবিচার করা হবে। ভাষার সমৃদ্ধির বিবেচনায় চিন্তা করতে গেলে অন্যান্য সব অঞ্চল বাদ দিয়ে যদি আফ্রিকার দিকে তাকাই, সবচেয়ে আশ্চর্যজনক বিষয় হলো আফ্রিকার মতো বিশাল দেশে কোনো নিজস্ব ভাষা নেই বললেই চলে। মরক্কো, আলজেরিয়ায় ফ্রেঞ্চ সাম্রাজ্যবাদের কারণে তাদের নিজস্ব ভাষা যেন আজ বিলুপ্ত। অথচ–
• দুইশো বছরের ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণের শিকার হয়েও আমাদের মাতৃভাষা বাংলা সগৌরবে টিকে আছে।
• স্বরতন্ত্র, লিপি থেকে শুরু করে বাংলা ভাষার সম্পূর্ণ প্যাটার্ন আমাদের নিজস্ব।
• আমাদের মৌখিক এবং লিখিত ভাষায় পার্থক্য নেই।
এর দ্বারা বাংলা ভাষার ভিত্তি কতটা শক্তিশালী তা সহজেই অনুমেয়।
আমাদের ভাষা, জাতীয়তা, আত্মপরিচয় নানাভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হলেও এ অঞ্চলের সাহিত্য-সংস্কৃতি, সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধ, জাতীয়তার মূল ভিত্তি ও আত্মপরিচয়ের গৌরবময় বাহন বাংলা। এত শোষণের পরেও নজরুল, ফররুখের রচিত ভাষা ও সাহিত্যের দূর্জয় প্রকাশ সাক্ষ্য দেয়, এ ভাষা বিশ্বসভ্যতার বিবেকের ভাষা।
বিশ্বসভ্যতায় বাংলার মুসলমানদের অবদান নিয়ে যারা প্রশ্ন তুলেছেন, তাদের পাল্টা প্রশ্ন করতে চাই, বিশ্বসভ্যতা বলতে কী বুঝেন? বিশ্বসভ্যতা শব্দটা কবে এসেছে এবং কোথা থেকে এসেছে?
সভ্যতা যদি চিন্তা ও বিশ্বাসের সাথে সম্পৃক্ত হয়, সেক্ষেত্রে সভ্যতায় অবদান রাখাকে দুইভাগে ভাগ করা হয়।
১. অর্থনৈতিকভাবে অবদান রাখা।
২. সাংস্কৃতিকভাবে ও বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে অবদান রাখা৷
উপরোক্ত আলাপে এটি ফুটে উঠেছে যে, আমাদের অবদান কতটুকু এবং আমাদের অজ্ঞতার জায়গা কোথায়!
এরপরেও যদি সন্দেহ জাগে, তবে এ ঘাটতি ইসলামী সভ্যতা বা ইতিহাসের নয়, এ ঘাটতি আমাদের জ্ঞানের। অর্থাৎ সূর্যকে যদি ঢেকে রাখি, তাহলে এর আলো বন্ধ হয়ে যায়নি কিংবা সূর্য পূর্বে ছিলো না– এ কথা বলার সুযোগ নেই!
যেমন– প্রফেসর ড. তাহসিন গরগুন প্রমাণ করেছেন যে, পৃথিবীর সর্ববৃহৎ হস্তলিখিত লাইব্রেরী হল সুলেইমানিয়া। এখানে উসমানী আমলের ৮০০ জন আলেমের লিখিত বই আছে। তিনি তার ছাত্রদের দিয়ে তালিকা করেছেন, তারা গবেষণায় ৮০০ আলেম পেয়েছেন, এদের মধ্যে ৮০ জন আছেন তাঁদের প্রত্যেকের বই এর সংখ্যা ১০০ উপরে। এর মধ্যে অনেক বই আছে যেগুলো মৌলিক।
চিন্তা করুন তো, ঔপনিবেশিক শোষণ থেকে অনেকাংশেই মুক্ত থাকা সত্ত্বেও যদি তাদের এ অবস্থা হয়, তাহলে ২০০ বছরের শোষিত বাংলা অঞ্চলের অবস্থা কেমন হওয়ার কথা?
আমাদের সব লাইব্রেরির বই ইংল্যান্ডে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, ধ্বংস করা হয়েছে ! উসমানী খেলাফতের এত কিছু থাকার পরেও তাদের অবদান অস্বীকার করা হয় এবং বলা হয়, উসমানীরা যুদ্ধ ছাড়া কিছুই করেনি, জ্ঞান-দর্শনে তাদের কোনো অবদান নেই! এ প্রেক্ষিতে ওই অঞ্চলের ঐতিহাসিকরা বলে, মানুষ অজ্ঞ হলেও চোখে পড়া উচিৎ, সুবিশাল সোলায়মানিয়া লাইব্রেরিসহ মসজিদগুলো নিজেই এক একটি সাক্ষী, যেখানে ১০ হাজার মানুষ একসাথে নামাজ পড়তে পার, অথচ এখানে তখন কোনো মাইক লাগতো না! বর্তমান বিজ্ঞানীরা আজ পর্যন্ত এর রহস্য আবিষ্কার করতে পারেনি, কারণ এর স্থপতি মিমার সীনান ছিলেন একইসাথে একজন পদার্থবিদ, রসায়নবিদ ও মিউজিকের সর্বোচ্চ চূড়া৷ বিজ্ঞানীর পাশাপাশি শ্রেষ্ঠ মিউজিশিয়ান না হলে এ ধরনের স্থাপত্য নির্মাণ কখনোই সম্ভব নয়। রসায়ন না জানলে শক্ত মাটি, পাথরের উপর ভিত্তি করে এত মজবুত বিল্ডিং তৈরি করা সম্ভব হতো না। এমনকি তিনি দেয়ালের ভেতরে লিখে গিয়েছিলেন, পরবর্তীতে সংস্কার করার সময় কোন কোন উপকরণ প্রয়োজন হবে বা কীভাবে সংস্কার করতে হবে, যে লিখা ৪০০ বছর পরে সংস্কারের জন্য দেয়াল ভেঙ্গেও পাওয়া গেছিলো। প্রশ্ন হলো তিনি কোন কালি দিয়ে লিখছেন যে, ৪০০ বছরেও তা মুছেনি? আর কতটা দক্ষতা থাকলে এত বছর পরের সংস্কার কাজের পদ্ধতিও তিনি বলে যেতে পারেন ?
একইভাবে আমাদের অঞ্চলের স্থাপত্য, প্রাচীন শহর ও ভাষা, সুবিশাল সালতানাতের স্মৃতিচিহ্ন দেখার পরেও যদি আমরা বলি, মুসলমানদের কোনোই অবদান নেই, তাহলে আমাদের জন্য বৃটিশ একাডেমিয়ার চিন্তার দাসত্ব ছাড়া ভিন্ন কিছু করার নেই!
এজন্য ইতিহাস ও সংস্কৃতিকে ভালোভাবে না পড়লে কখনোই অবদান সম্পর্কে জানা সম্ভব নয় এবং অবদান রাখাও সম্ভব নয়। কোনো জাতি তার অতীতকে অস্বীকার করতে পারে না, কারণ সে জাতির বৈশিষ্ট্য অতীতের সৃষ্টি। এটিই আমাদের মূলনীতি হওয়া উচিত। আমাদের এ সমাজ ও সভ্যতা ছিলো মানুষের সমাজ ও সভ্যতা। নানা সংকট, উত্থান-পতনের আবর্তেই তা পরিচালিত হতো। এখান থেকে মূল শিক্ষাগুলো গ্রহণ করাই আসল পর্যালোচনা। অর্থাৎ আমরা ইতিহাসকে নিন্দা করবো না, বরং বিশ্লেষণ করবো।
এসব পর্যালোচনা করে শিক্ষা ও আত্মবিশ্বাসী আলাপগুলোই তুলে ধরার দায়িত্ব ছিলো আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এক্ষেত্রে, নয়া জ্ঞান উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে বরাবরই ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে!
এজন্য আমাদের নতুন করে সমাধানে জন্য কাজ করতে হবে।
যেমন– কাজী নজরুল ইসলাম কারাগারে বসেও রচনা করেছেন,
“কারার ঐ লৌহকপাট,
ভেঙ্গে ফেল, কর রে লোপাট,
রক্ত-জমাট
শিকল পূজার পাষাণ-বেদী।
ওরে ও তরুণ ঈশান!
বাজা তোর প্রলয় বিষাণ!
ধ্বংস নিশান
উড়ুক প্রাচীর প্রাচীর ভেদি।”
তিনি জেলে থেকেও নিজের সমাজকে জ্ঞানের উৎস হিসেবে নিয়েছেন এবং নিজের ভাষার শ্রেষ্ঠত্ব দেখিয়েছেন। তখন ছিলো ইংরেজদের জয়-জয়কার, অথচ তার কবিতায় একটি ইংরেজি শব্দও নেই।
মুসলমান ও ইংরেজদের সংঘাত চলাকালে তিনি বলছেন,
“তিমির রাত্রি, মাতৃমন্ত্রী সান্ত্রীরা সাবধান!
যুগ-যুগান্ত সঞ্চিত ব্যথা ঘোষিয়াছে অভিযান।
ফেনাইয়া উঠে বঞ্চিত বুকে পুঞ্জিত অভিমান,
ইহাদের পথে নিতে হবে সাথে, দিতে হবে অধিকার।
অসহায় জাতি মরিছে ডুবিয়া, জানে না সন্তরন
কান্ডারী! আজ দেখিব তোমার মাতৃমুক্তি পন।
হিন্দু না ওরা মুসলিম? ওই জিজ্ঞাসে কোন জন?
কান্ডারী! বল, ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মার
গিরি সংকট, ভীরু যাত্রীরা গুরু গরজায় বাজ,
পশ্চাৎ-পথ-যাত্রীর মনে সন্দেহ জাগে আজ!
কান্ডারী! তুমি ভুলিবে কি পথ? ত্যজিবে কি পথ-মাঝ?
করে হানাহানি, তবু চলো টানি, নিয়াছ যে মহাভার!
কান্ডারী! তব সম্মুখে ঐ পলাশীর প্রান্তর,
বাঙালীর খুনে লাল হল যেথা ক্লাইভের খঞ্জর!
ঐ গঙ্গায় ডুবিয়াছে হায়, ভারতের দিবাকর!
উদিবে সে রবি আমাদেরি খুনে রাঙিয়া পূনর্বার।
ফাঁসির মঞ্চে গেয়ে গেল যারা জীবনের জয়গান,
আসি অলক্ষ্যে দাঁড়ায়েছে তারা, দিবে কোন্ বলিদান
আজি পরীক্ষা, জাতির অথবা জাতের করিবে ত্রাণ?
দুলিতেছে তরী, ফুলিতেছে জল, কান্ডারী হুশিয়ার!”
নিজের সমাজ ও চেতনাকে উৎস বানালে যে ছোট একটি কবিতা দিয়ে শক্তিশালী বড় সভ্যতার বিপরীতে লড়াই করা যায়, তার উদাহরণ এটি। যে সাম্রাজ্যের সূর্য ডুবে না, সে সাম্রাজ্যের জেলে বন্দী থেকে যদি এমন সব কবিতা, প্রতিবাদী কথামালা তিনি রচনা করতে পারেন, তাহলে আমাদের পক্ষে এখন তা কেন সম্ভব নয়? এগুলো আমাদের সামনে জ্বলন্ত উদাহরণ, যা ব্যাপকভাবে আন্দোলিত ও প্রভাবিত করে।
আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে ১০/১২ টি গান গোটা জাতিকে উজ্জীবিত করেছিলো!
যেমন–
“মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি। …যে শিশুর মায়া হাসিতে আমার বিশ্ব ভোলে।”
তাই আমাদের কর্তব্য হলো আমাদের সমাজকে উৎস হিসেবে নেওয়া এবং আমাদের সমস্যা সমাধানের জন্য কাজ করা। বৃটিশ ওরিয়েন্টালিস্টদের শিখিয়ে দেওয়া পদ্ধতিতে এসব বোঝা সম্ভব নয়!
হ্যাঁ, এটি সত্য যে, আমাদের গৌরবজ্জ্বল অতীতের কোনো কিছুই এখন অবশিষ্ট নেই বা আমাদের হাতে নেই। কিন্তু তা প্রমাণ করা সম্ভব! সত্যের আলাদা শক্তি আছে। সত্যকে সবার সামনে হাজির করাটাও আমাদের দায়িত্ব, যে দায়িত্ব পালন করেছিলেন এ শতকের মহান মুজাহিদ, আলেম ড. ফুয়াদ সেজগিন। তিনি ইসলামী সভ্যতার ইতিহাসের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন। পশ্চিমা সভ্যতার বুদ্ধিবৃত্তিক প্রবঞ্চনা ও তৈরিকৃত মিথ্যা বয়ানকে তিনি যৌক্তিকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করে ইসলামী সভ্যতার শ্রেষ্ঠত্ব তুলে ধরেন।
তার মতোই আমাদের উপমহাদেশে, আমাদের বাংলা অঞ্চলের মানুষদের মধ্য থেকে নিজেকে উৎসর্গকারী কিছু মানুষ প্রয়োজন, যারা উপমহাদেশের ইসলামী সভ্যতার ইতিহাসকে, ইসলামের জ্ঞানের ইতিহাসকে, ইসলামের শিক্ষা ও সংস্কৃতির ইতিহাসকে, আলেম এবং দার্শনিকদের ইতিহাসকে, স্থাপত্য ও শিল্পকলার ইতিহাসকে, সমাজ ও অর্থনীতির ইতিহাসকে এবং পরবর্তীতে ব্রিটিশ শোষণের নিকৃষ্টতম জুলুমপূর্ণ অধ্যায়কে ও ব্রিটিশ পরবর্তী হীনম্মন্যতার সময়কালকে খুব ভালোভাবে তুলে ধরে আত্মবিশ্বাসী বিজয়ের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করার মতো বয়ান সৃষ্টি করবে। অবশ্যই অবশ্যই ড. ফুয়াদ সেজগিনের মতো আমাদেরকেও নিজেদেরকে উৎসর্গ করতে হবে। কেননা ত্যাগ ও প্রচেষ্টা ছাড়া এ হীনম্মন্যতা, আত্মবিশ্বাসহীনতা থেকে মুক্তি পাওয়া অসম্ভব।
আমরা যদি আমাদের জ্ঞান, চিন্তা ও পর্যালোচনার জায়গায় শক্তিশালী হই, তবে অবশ্যই সত্যকে খুঁজে পাব। এভাবেই ইসলামী সভ্যতার নিশ্চিত বিজয়, নতুন দুনিয়া গড়া ও ইসলামী সভ্যতার পুনর্জাগরণ অবশ্যই সম্ভব এবং এটি ততটাই সত্য, যতটা সত্য আগামীকালের সূর্যোদয়।
১৭৫৩ বার পঠিত

শেয়ার করুন

Picture of হাসান আল ফিরদাউস

হাসান আল ফিরদাউস

সংগঠক এবং সমাজ ও সংস্কৃতি বিষয়ক গবেষক হাসান আল ফিরদাউস-এর জন্ম টাংগাইল জেলায়।পড়াশুনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়য়ে সমাজবিজ্ঞান বিভাগে। এছাড়াও আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও ইসলামী সভ্যতা নিয়ে পড়াশোনার পাশাপাশি উসূল, ফিকহ এবং রাজনৈতিক দর্শনের উপর বড় শিক্ষকদের সাহচর্যে গবেষণা করে যাচ্ছেন। আন্তর্জাতিক স্কলার ও চিন্তাবিদদের সমন্বয়ে নানাবিধ গবেষণা ও একাডেমিক কার্যক্রম পরিচালনার পাশাপাশি নিয়মিত লেখালেখি করছেন।বর্তমানে তিনি ‘ইসলামী চিন্তা ও গবেষণা ইন্সটিটিউট’-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্বরত আছেন।একইসাথে জ্ঞানের পুনর্জাগরণ ও নবধারার কাগজ ত্রৈমাসিক মিহওয়ার-এর সম্পাদকও।
Picture of হাসান আল ফিরদাউস

হাসান আল ফিরদাউস

সংগঠক এবং সমাজ ও সংস্কৃতি বিষয়ক গবেষক হাসান আল ফিরদাউস-এর জন্ম টাংগাইল জেলায়।পড়াশুনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়য়ে সমাজবিজ্ঞান বিভাগে। এছাড়াও আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও ইসলামী সভ্যতা নিয়ে পড়াশোনার পাশাপাশি উসূল, ফিকহ এবং রাজনৈতিক দর্শনের উপর বড় শিক্ষকদের সাহচর্যে গবেষণা করে যাচ্ছেন। আন্তর্জাতিক স্কলার ও চিন্তাবিদদের সমন্বয়ে নানাবিধ গবেষণা ও একাডেমিক কার্যক্রম পরিচালনার পাশাপাশি নিয়মিত লেখালেখি করছেন।বর্তমানে তিনি ‘ইসলামী চিন্তা ও গবেষণা ইন্সটিটিউট’-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্বরত আছেন।একইসাথে জ্ঞানের পুনর্জাগরণ ও নবধারার কাগজ ত্রৈমাসিক মিহওয়ার-এর সম্পাদকও।

মতামত প্রকাশ করুন

Scroll to Top