নৌ-বিজ্ঞানে মুসলমানদের অবদান

ইসলামের প্রথম যুগ হতেই মুসলিম উম্মাহ বিভিন্ন কারণে নৌ-বিজ্ঞানে পারদর্শী ছিলেন এবং ইসলাম আবির্ভাবের পর অনন্যভাবে এ প্রতিভার বিকাশ সাধিত হয়েছিলো। মুসলিম উম্মাহর প্রাচীন ইতিহাস, সাহিত্য এবং কোরআনের উদ্ধৃতি দিয়ে আমরা পূর্বে তা আলোচনা করেছি।

আবিসিনিয়াতে মুসলমানরা ব্যবসার উদ্দেশ্যে শুধু সর্বদা গমনাগমন-ই করতেন না; বরং তাঁরা আবিসিনিয়াকে দ্বিতীয় আবাসস্থলে পরিণত করেছিলেন। সেসময় লোহিত সাগরে সাধারণত রুমীদের নৌযান চলাচল করতো। ইসলামের অভ্যুদয়ের কিছুকাল পূর্বে রুমীদের একটি ব্যবসায়ী কাফেলা জেদ্দাতে উপনীত হয় এবং তাদের জাহাজ জেদ্দার নিকটবর্তী স্থানে ভেঙ্গে যায়। মক্কার মুসলমানরা উক্ত জাহাজের তক্তা ক্রয় করিয়া কা’বাগৃহের ছাদে ব্যবহার করেছিলেন।

ইসলাম ধর্ম গ্রহণের অপরাধে মক্কা নগরে যখন মুসলমানদের প্রতি চরম অত্যাচার সংঘটিত হতে লাগলো, মুসলমানরা সর্বদিকে অত্যাচারিত, উৎপীড়িত, শত্রুদের আঘাতে জর্জরিত হয়ে পড়লেন, তখন রাসূলুল্লাহ তাঁদেরকে আবিসিনিয়ায় হিজরত করতে নির্দেশ দিলেন।

নবুয়তের পঞ্চম সালে ১১ জন পুরুষ এবং ৪ জন মহিলার একটি ক্ষুদ্র মুসলিম মুহাজির দল জেদ্দা হতে দুটি বাণিজ্যপোতের সাহায্যে আবিসিনিয়ায় গমন করেন। পরবর্তী সময়ে ৮০ জন মুসলমানের একটি কাফেলা তথায় হিজরত করে যায়। মক্কার লোকেরা তাঁদেরকে পাকড়াও করার উদ্দেশ্যে তাঁদের দূত প্রেরণ করেন; কিন্তু নাজ্জাশী রাজার ন্যায়-নিষ্ঠার ফলে তাদের সেই চেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।

রাসূলুল্লাহর মদীনায় হিজরতের পর আবিসিনিয়া হতে কতিপয় মুসলমান পুনরায় মদীনায় হিজরত করে চলে আসেন। হিজরী ৬ সালে রাসূলুল্লাহ কর্তৃক ইসলামের দাওয়াত সম্বলিত চিঠিসহ আমর ইবনে উমাইয়া যুমরী আবিসিনিয়ার অধিপতি নাজ্জাশীর নিকট প্রেরিত হন। সেই সালেই নাজ্জাশী ৬০জন বিশিষ্ট লোক দ্বারা গঠিত একটি প্রতিনিধি দল রাসূলুল্লাহর খেদমতে প্রেরণ করেন। যে জাহাজযোগে প্রতিনিধি দল রওনা করেছিলেন, দুর্ভাগ্যবশতঃ তা সমুদ্রগর্ভে নিমজ্জিত হয়ে যায়। আরেক দল মদীনায় রাসূলুল্লাহর খেদমতে অবস্থানের উদ্দেশ্যে রওনা হন। মুসলিম কুল জননী উম্মে হাবিবাও তাঁদের সঙ্গে ছিলেন। নাজ্জাশী কর্তৃক তাঁরা দুইটি বিশেষ জাহাজে প্রেরিত হন। এই জাহাজদ্বয় মদীনার নিকটবর্তী ‘জার’ নামক বন্দরে উপনীত হয়। এই বন্দরটি লোহিত সাগরের আরব উপকূলবর্তী আয়লা বন্দর হতে দশ মাইল দূরে অবস্থিত ছিল। এখান থেকে মদীনা ন্যূনতম চব্বিশ ঘণ্টার রাস্তা। অনুরূপভাবে ইয়েমেনের আশআর গোত্রের ৫২জন নওমুসলিম মদীনায় গমনের উদ্দেশ্যে রওনা হন। কিন্তু বিপরীতমুখী ঝড়ো-বাতাসে তারা আবিসিনিয়ায় গিয়ে পৌঁছেন। মক্কানিবাসী মুসলমান মুহাজির পূর্ব হতে সেখানে বাস করছিলেন। তাঁরা পথভ্রষ্ট মুসলমানদের অভ্যর্থনা করেন এবং সপ্তম হিজরীতে তাঁরা জাহাজযোগে মদীনার উদ্দেশ্যে রওনা হন। খায়বার বিজয়কালে তারা সে স্থানে উপনীত হন। এই দলটি ‘আহলে সফীনা’ (নৌকাবাসী) নামে খ্যাতি লাভ করেন।

ভূ-মধ্যসাগরেও মুসলমানরাও সদাসর্বদা নৌকা ও জাহাজ পরিচালনা করতেন। লগ্ন এবং জুযাম গোত্র সিরিয়া সীমান্তের অধিবাসী ছিলেন। রুমীদের সাথে তাঁদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। ফলে রূমীদের প্রভাবে তাদের মধ্যে যারা খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করেছিলেন, হজরত তামীম দারী ছিলেন তাঁদের অন্যতম। তিনি ইসলাম গ্রহণের পর যখন মদীনায় আগমন করলেন, তখন তিনি নিজের পূর্বকাহিনী নিজেই বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন, উপরোল্লিখিত গোত্রদ্বয়ের ৩০জন লোকসহ তিনি জাহাজে আরোহণ করেন। প্রাকৃতিক দুর্যোগে তাঁদের জাহাজ দীর্ঘ এক মাসব্যাপী সমুদ্রগর্ভে ভেসে চলে, অবশেষে তা ধ্বংস হয়ে যায়। আরোহীরা ছোট ছোট নৌকায় আরোহণ করে জীবন রক্ষা করার চেষ্টা করেন এবং প্রকাণ্ড ঢেউয়ের সঙ্গে ভেসে ভেসে তাঁরা গিয়ে পৌঁছেন একটি অজানা দ্বীপে।

উল্লিখিত ঘটনা এবং আমাদের পূর্ব আলোচনা দ্বারা দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট হয় যে, মুসলিম উম্মাহ সামুদ্রিক এবং নৌযান পরিচালনায় অন্যান্য জাতি অপেক্ষা যেমন পারদর্শী ছিলেন, তেমনি ছিলেন নির্ভীক ও অসীম সাহসী। দ্বিতীয় খলিফা ওমরের খিলাফতকাল হতে মুসলমানরা নৌযান পরিচালনায় এক নতুন যুগের সৃষ্টি হয়। আরবীয় মুসলমানরা একদিকে বিভিন্ন দেশে নৌ-অভিযান পরিচালনা করেন, অপরদিকে তখন আরম্ভ হয় শান্তিপূর্ণ নৌ-ভ্রমণ ও ব্যবসা-বাণিজ্য।

ওমর (রা)-এর সময়ে ঘটনাক্রমে আরবে ভীষণভাবে খাদ্যসমস্যা দেখা দেয়। দুর্ভিক্ষের আক্রমণ হতে দেশকে রক্ষা করার জন্য হযরত ওমর সুদূর মিশর হতে খাদ্যদ্রব্য আমদানির ব্যবস্থা করেন। কিন্তু স্থলপথে তা আমদানি করতে অধিক বিলম্ব ঘটবে; সুতরাং ৬৯ মাইল দীর্ঘ একটি খাল খনন করে নীল দরিয়াকে লোহিত সাগরের সাথে যুক্ত করা হয়। তা খননে প্রায় ছয় মাস সময় অতিবাহিত হয়েছিলো। প্রথম বৎসরেই ২০টি জাহাজ ন্যূনতম ষাট হাজার টন খাদ্যশস্য নিয়ে আরব সাগর দিয়ে মদীনার নিকটবর্তী ‘জার’ বন্দরে নোঙর করে। ১ম শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত এই খালটি ব্যবহৃত হয়, কিন্তু পরবর্তীকালে এটার পতন ঘটে। অবশেষে অজ্ঞাত রাজনৈতিক কারণে আব্বাসীয় খলীফা মনসুর কর্তৃক তা বন্ধ করে দেওয়া হয়।

অনুরূপভাবে হযরত ওমরের সময়েই সুয়েজ খাল খননের পরিকল্পনা করা হয়। কিন্তু রাজনীতি বিচক্ষণ খলিফা ওমর তা নিষিদ্ধ করে দেন। মিশরের গভর্নর আমর ইবনে আস-ই সর্বপ্রথম এই পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছিলেন। আবুল ফিদা স্বীয় ভূগোলে ইবনে সাঈদের বরাতে লিখেছেন-

عند الفرما يقرب بحر الروم من بحر القلزم حتى يبقى بينها نحو سبعين ميلا قال وكان عمرو بن العاص اراد ان يخرق ما بينها في مكان يعرف بذنب التمساح فنهاه عمر بن الخطاب وقال كانت الروم تخطف الحجاح .

“ফরমার নিকটে ভূমধ্যসাগর এবং লোহিত সাগর অতি নিকটবর্তী হয়ে পড়েছিলো। উভয়ের মধ্যে মাত্র ৭০ মাইল ব্যবধান ছিল। আমর বিন আস ‘জাতুত্তিমছাহ’ নামক স্থানে উভয় সমুদ্রের মধ্যে যোগসূত্র স্থাপনের উদ্দেশ্যে খাল খননের পরিকল্পনা করলেন; কিন্তু ওমর ইবনে খাত্তাব তা নিষেধ করে দিলেন। তিনি আরও বলেন, রুমী দুর্বৃত্তরা হজ্ব গমনকারীদের রাস্তা হতে কৌশলে নিয়ে যায়।”

পাশ্চাত্য বণিক জাতি বর্তমান সুয়েজ খালের সাহায্যে মধ্যপ্রাচ্যকে যেভাবে গ্রাস করেছিলো, তার আলোকে দূরদর্শী ওমরের প্রতিবন্ধকতার রহস্য উপলব্ধি করা কোনো সূক্ষ্মবুদ্ধিসম্পন্ন প্রাচ্যবাসীর পক্ষে কঠিন হবে না।

পূর্বেই উল্লেখ করেছি, মুসলমানরা নৌযান পরিচালনা করে দুনিয়ার বিভিন্ন কেন্দ্রে ভ্রমণ করেছেন, ব্যবসা-বাণিজ্য করে উপকৃত হয়েছেন। তাঁদের জাহাজসমূহ পারস্য উপকূল হতে ভারত সমুদ্র অতিক্রম করে সুদূর চীনদেশে গমন করতো। হিজরী তৃতীয় শতাব্দীর বিখ্যাত আরব পর্যটক সোলায়মান ছয়রাফী তাঁর ভ্রমণ বৃত্তান্তে এটার বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। তিনি পারস্য সাগর হতে বাহির হয়ে ভারত সাগরে গমন করে বঙ্গোপসাগর অতিক্রমকালে বাংলার বিখ্যাত বন্দর চট্টগ্রাম এবং সিলেটের উল্লেখ বারবার করেছেন। সিলেট যে সেসময় বিখ্যাত বন্দর ছিল, প্রাচীন মুসলমানদের ইতিহাস হতে তার প্রমাণ পাওয়া যায়। মুসলমানরা পাকিস্তান, আফগানিস্তান এবং ভারতের বিভিন্ন বন্দরে অবস্থান করে চীন পর্যন্ত গমন করতেন। বঙ্গোপসাগরে প্রবেশ করলে তাঁদের অবস্থান কেন্দ্র হতে সিলেট, আরবদের ভাষায় شلامط সেলাহাট এবং চট্টগ্রাম صاد جام ছাদযাম।

সমুদ্রগর্ভে নৌযান পরিচালনার জন্য সর্বপ্রথম এবং সর্বাগ্রে প্রয়োজন হইতো নকশা বা মানচিত্রের। আরব নাবিকগণ সর্বদা মানচিত্র সাথে নিয়ে পরিভ্রমণ করতেন। সামুদ্রিক মানচিত্রের জ্ঞান তাঁরা তাঁদের পূর্ববর্তীদের নিকট হতেই গ্রহণ করতেন এবং নিজের অভিজ্ঞতা দ্বারা তাকে পূর্ণতা দান করতেন। তাঁরা নৌ-পরিচালনার নিয়ম-পদ্ধতি ও নীতি নির্ধারণ করেন। এ সম্বন্ধে তাঁরা বিরাট বিরাট গ্রন্থও রচনা করেছেন। এ বিষয়ে নিম্নবর্ণিত পুস্তকগুলি বিশেষ উল্লেখযোগ্য।

১. আল্ ফাওয়াইদ ফী উসূলে ইলমিল বারে ওয়াল্ কাওয়াইদ।
২. হাবিয়াতুল ইখতিছার ফী উসূলে ইলমিল বিহার।
৩. কজুল মুআলিমা।
ছোলায়মান মন্ত্রী কৃত-
৪. আল্-উমদাতুল মাহরীয়াহ ফী জতিল উলুমিল বাহরীয়াহ।
৫. আল্-মিনহাজুল ফাখের ফী ইল্মিল বাব্রিজ জাখের।

উপরোল্লিখিত গ্রন্থগুলিতে নৌযান পরিচালনা সম্পর্কে আবশ্যকীয় যাবতীয় তত্ত্ব ও তথ্য বিশদভাবে আলোচিত হয়েছে। দেশের অবস্থান ও দূরত্ব হতে আরম্ভ করে গ্রহ-নক্ষত্রের গতিধারা এবং বায়ু ও ঝড়-ঝঞ্ঝার নিদর্শন ও জলবায়ুর পরিচয় দেওয়া হয়েছে। এতে বিভিন্ন দ্বীপের ও বৃহৎ বন্দরের অবস্থিতি নির্দেশ করা হয়েছে।
আহমদ ইবনে মাজেদ এবং ছোলায়মান কর্তৃক রচিত গ্রন্থাবলী দ্বারা শুধু আরবরাই উপকৃত হয় নি; বরং মোঘল ও ভারতীয় উপমহাদেশের নাবিকগণও তা দ্বারা লাভবান হয়েছেন।

মোঘল নৌবাহিনীর কমান্ডার সৈয়দ আলী ভারত সমুদ্রে এবং গুজরাট উপকূলে পর্তুগীজ নৌবাহিনীর সাথে মোকাবেলার জন্য আগমন করেছিলেন। তিনি মোঘল নৌ-চালনা সম্পর্কে একটি মূল্যবান এবং বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ রচনা করেছেন। গ্রন্থখানার নাম দিয়েছেন ‘মুহীত’ (সর্বব্যাপক)। উক্ত গ্রন্থে তিনি ইবনে মাজেদ ও ছোলায়মানের রচিত গ্রন্থসমূহ হতে বিশেষভাবে উপকৃত হয়েছেন। গ্রন্থের ভূমিকায় তিনি অকপটভাবে উক্ত লেখকদ্বয়ের ভূয়সী প্রশংসাও করেছেন।

মুসলমান নাবিকগণ নৌ-বিজ্ঞান শাখায় চরম উৎকর্ষ সাধন করেছিলেন, নৌযান পরিচালনার জন্য তারা নকশা বা মানচিত্রের সঙ্গে একটি দিকদর্শন যন্ত্রও আবিষ্কার করেন, যাকে ‘কুতুব নোমা’ বা কম্পাস (Compass) নামে অভিহিত করা হয়। ‘কুতুব নোমা’ চুম্বক প্রস্তর সম্বলিত একটি যন্ত্র; যার দ্বারা দিক নির্ধারিত হয়ে থাকে। এই যন্ত্রের আবিষ্কারের সঠিক সময় নির্ধারণ করা সম্ভব না হলেও বিনা দ্বিধায় এটা বলা যেতে পারে যে, মুসলমানরাই সর্বপ্রথম এ যন্ত্রের আবিষ্কারক ছিলেন। কম্পাস (Compass) নাম দেখে পাশ্চাত্য বিদ্যায় শিক্ষিত কোনো লোকের এরূপ ধারণা জন্মানো বিচিত্র নয় যে, যন্ত্রের আবিষ্কারক ইউরোপবাসী। মুসলমানরাই প্রাথমিক যুগে সামুদ্রিক চিত্রকেই কম্পাস নামে অভিহিত করতেন; যাতে সমুদ্র ও দ্বীপ-উপদ্বীপ এবং স্থানের দৈর্ঘ্য-প্রস্থ প্রভৃতির উল্লেখ থাকত। পরবর্তীকালে দিক দর্শন যন্ত্রকেই তাঁরা উক্ত নামে অভিহিত করতে লাগলেন। নবম শতাব্দীর আরব সমুদ্রে নাবিকগণ এটাকে ‘দায়েরা’ এবং ‘বায়তুল ইবরাহ’ নামে আখ্যায়িত করা হতো।

মুছিনলিবো বলেছেন, বিশ্বস্ত সূত্রে যা প্রমাণিত হয়েছে তা এই যে, পাশ্চাত্য সমাজ মুসলমানদের নিকট হতেই কম্পাসের জ্ঞান লাভ করেছেন। মুসলমানই সুদূর চীনের সাথে সম্পর্কিত ছিলেন। মুসলমানদের নিকট হতে বহু দিনে পাশ্চাত্যবাসীরা এটার ব্যবহার আয়ত্ত করেছিলেন। কারণ, ত্রয়োদশ শতাব্দীর পূর্বে পাশ্চাত্য নাবিকরা কুতুবনোমা বা Compass ব্যবহার করেন নি। অথচ দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগের ঐতিহাসিক ইদ্রিসী বলেছেন, মুসলমানদের মধ্যে তখন এটার ব্যবহার ব্যাপক ছিল।

ভারত সাগরে অন্ধকার রাতে জাহাজ পরিচালনাকারী নাবিকগণ মৎস্য সদৃশ একটি চুম্বকপ্রস্তর ব্যবহার করতেন। কারণ, আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকায় নক্ষত্রের সাহায্যে তখন দিক নির্ণয়ের কোন উপায় থাকে না।

“They say that the Captains who nevigate the Indian seas use, instead of the needle and splintes, a sort of fish made out of hollow iron, which, when thrown into the water, swims upon the surface, and points out the north and south with its head and tail.”

ওয়াকেফ মহলের মতে, ভারত সাগরের যে নাবিকগণ জাহাজ পরিচালনা করেন, তাঁরা সুঁচ ও কাষ্ঠখণ্ডের পরিবর্তে মৎস্য সদৃশ একটি যন্ত্র ব্যবহার করতেন, যা ফাঁপা লৌহ নির্মিত ছিল। পানিতে ছেড়ে দিলে তা ভেসে চলে এবং মস্তক ও লেজ দ্বারা উত্তর-দক্ষিণের দিকে ইঙ্গিত করে থাকে। ঐতিহাসিক মাকরিযী (৭৬৬-৮৪৫ হিঃ) স্বীয় গ্রন্থে এটার উল্লেখ করে বলেছেন-

وما برح المسافرون في بحر الهند اذا ظلم عليهم الليل ولم يروا ما يهديهم من الكواكب الى معرفة الجهات يحلون حديدة مجوفة على شكل سمكة ويبالغون في ترقيقها جهد المقدرة ثم يعمل في فم السمكة شي من مقناطيس جيدا ويحك فيها بالمقناطيس فان السمكة اذا وضعت في الماء دارت واستقبلت القطب الجنوبي بفمها واستدبرت القطب الشمالي وهذا من اسرار الخليقة فاذا عرفوا جهتى الجنوب والشمال تبين منهما
المشرق والمغرب.

ভারত সাগরে পরিভ্রমণকারী নাবিকগণ অন্ধকার রাত্রিতে নক্ষত্রের সাহায্যে দিক নির্ণয়ে অক্ষম হলে তারা অন্তরশূন্য ফাঁপা মৎস্য সদৃশ একটি যন্ত্র ব্যবহার করতেন। যথাসম্ভব অতি ক্ষীণ আকারে তা নির্মিত এবং উহার মুখভাগে চুম্বক লৌহখণ্ড স্থাপন করা হয়েছিলো। সেই মৎস্য পানিতে রক্ষিত হলেই ঘুরে তার মুখ দক্ষিণে, আর লেজ উত্তরের দিকে ফিরে যেত। এটি একটি অভিনব আবিষ্কার। যখন তা দ্বারা উত্তর- দক্ষিণ নির্মিত হয়ে যেত, তখন সহজেই পূর্ব-পশ্চিম নির্ণয় করা যেত।
আহমদ ইবনে মাজেদ দাবি করেন, দিক-দর্শনের এই যন্ত্র (Compass) মুসলমানরাই আবিষ্কার করেছিলেন। তিনি বলেন-

ومن اختراعنا في علم البحر تركيب المغناطيس علم الحقة بنفسه ولنا فيه حكمة كبيرة لم تودع في كتاب
انه لم يقابل الجاه الا سهيلية فميزوا في هذه النكفة .

সামুদ্রিক আবিষ্কারের মধ্যে আমাদের অভিনব আবিষ্কার হচ্ছে চুম্বক বাক্স নির্মাণ করা এবং এতে আমাদের এরূপ দান রয়েছে যা ইতঃপূর্বে কেউ দিতে সক্ষম হয়নি।

ইহা ছাড়াও মুসলমানগণ নৌবিজ্ঞানে নতুন নতুন বহু আবিষ্কার করেছিলেন। বিখ্যাত পাশ্চাত্য নাবিক ভাস্কো-ডা-গামার সময়, অর্থাৎ নবম খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত পাশ্চাত্য নাবিকরা আরব জাতির আবিষ্কৃত জ্ঞানতত্ত্ব ও যন্ত্রের দ্বারা উপকৃত হয়েছিলেন। ‘এন্সাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা’য় বলা হইয়াছে:
Further, we learn from Osorio that the Arabs at the time of Gama “were instructed in so many of the arts of navigation, that they did not yield much to the Portuguese mariners in the science and practice of maritime metters. Also the Arabs that navigated the red sea at the same period are shown by Varthema to have used the mariner’s chart and compass.
উপরন্তু, ওসোরিওর বর্ণনা হইতে গামার সমকালীন আরবীয়দের সম্পর্কে জানা যায় যে, “তারা নৌ-বিদ্যায় এতো পারদর্শিতা অর্জন করেছিল যে, পর্তুগীজ নাবিক ও নৌ-চালক ব্যবহারিক নৌ-বিদ্যায় তৎতুল্য কিছুই করতে পারে নি। ভারথেমার বিবরণ হইতে জানা যায় যে, লোহিত সাগরে চলাচলকারী আরব নাবিকগণ সামুদ্রিক ম্যাপ ও কম্পাস ব্যবহার করতেন।

মুসলমানগণ বর্তমান যুগের ন্যায় তাঁদের সমুদ্রযানগুলোকে বিভিন্ন নামে আখ্যায়িত করতেন অথবা মালিকদের নামানুসারে তার পরিচয় প্রদান করতেন। বিখ্যাত মুসলমান পর্যটক মছউদী ৩০৪ হিজরীতে আব্দুর রহীম ইবনে জা’ফর ছয়রফীর ভ্রাতৃদ্বয় আহমদ ও আব্দুছ ছমদের জাহাজে সফর করেছিলেন।

অপর বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা জাহাজযোগে সুদূর চীন দেশে সফর করেছিলেন, তার নাম ছিল ‘জাবার’। ইহার মালিক ছিলেন ইব্রাহীম নামীয় জনৈক ব্যবসায়ী। মুসলমানগণ বিভিন্ন কেন্দ্রীয় বন্দরসমূহে জাহাজ নির্মাণের কারখানাও স্থাপন করেছিলেন, সাধারণতঃ তাঁরা তাকে ‘দারুস সানাআহ্’ (শিল্প কেন্দ্র) বলতেন। পারস্য উপকূলবর্তী উল্লাহ ও সায়াফ বন্দরে জাহাজ নির্মাণের বিরাট কারখানা ছিল।

উমাইয়া খেলাফত এবং আব্বাসীয় খেলাফতের শাসনামলে তা আরও উন্নতি লাভ করে এবং আরও বহু কারখানা স্থাপন করা হয়। ফলকথা এই যে, বঙ্গদেশের সহিত মুসলমানদের প্রথম ও প্রধান যোগসূত্র এই সমুদ্রপথেই স্থাপিত হয়েছিলো এবং নৌ-বিজ্ঞানে মুসলমানদের পারদর্শিতার জন্যই যে তা সম্ভব হয়েছিলো, এই কথাটি বুঝাবার জন্য অপ্রাসঙ্গিক হলেও মুসলমানজাতি ও নৌ-বিজ্ঞান সম্বন্ধে আমরা কিছুটা আলোচনার চেষ্টা করেছি।

সাধারণতঃ ভারতীয় উপমহাদেশে আগমনের দুটি রাস্তা বর্ণিত হয়েছে। একটি জলপথ, আর অপরটি স্থলপথ এবং এ দুপথ ধরেই মুসলমানরা বাংলাদেশেও আগমন করেছিলেন, যা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই।

 

১৪০৩ বার পঠিত

শেয়ার করুন

মতামত প্রকাশ করুন

Scroll to Top