প্রায় বারোশত বছর ন্যায়, আদালত ও মারহামাতের সাথে সমগ্র পৃথিবী পরিচালনা করার পরেও এই একবিংশ শতাব্দীতে এসে মুসলমানরা আজ দ্বীন, জ্ঞান, রাজনীতি ও আধুনিকতাকে একত্রিত করতে পারে না। অথচ, ইসলামের একেবারে শুরুর শতাব্দীতেই এমন একজন ব্যক্তি জন্মেছিলেন, যিনি এসবকিছুকে একত্রিত করেছিলেন। ফলশ্রুতিতে, তাঁর চিন্তাধারার প্রভাব আজও সমগ্র পৃথিবীকে ব্যাপৃত করে রেখেছে। এমনকি, মুসলিম উম্মাহর এতোসব চতুর্মুখী সমস্যার মাঝেও জ্ঞান, চিন্তা ও সার্বজনীন দৃষ্টিভঙ্গির জন্য তিনি আজও পৃথিবীব্যাপী সমানভাবে সমাদৃত।
তিনি মূলত মানব মনে চিন্তার খোরাক জোগাড় করে চিন্তাশক্তির বিস্তৃতি ঘটিয়েছিলেন। তিনি একাধারে কালাম শাস্ত্রের মূলভিত্তি নির্ণয় করেছেন, উসূল ও ফিকহ শাস্ত্রকেও তিনি সুবিন্যস্ত করেছেন এবং শিক্ষা পদ্ধতিতে অভূতপূর্ব এক বিপ্লব সাধন করেছেন। পাশাপাশি, পারস্য ও রোমান জ্ঞানধারার বিপরীতে ইসলামের বিশ্বজনীনতাকে উচ্চকিত করেছেন তিনি; যার ফলে তাঁর চিন্তাশক্তি প্রভাব বিস্তার করেছিলো সুদীর্ঘ হাজার বৎসরের ইসলামী সভ্যতার প্রত্যেক অঞ্চলে।
একবাক্যে বলা যায়, তিনি ছিলেন তাঁর শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ একজন মুজাদ্দিদ।
এতেই শেষ নয়, তাঁর জীবদ্দশায় তিনি তো জ্ঞানের প্রতিটি অঙ্গনে পদার্পণ করেছেন; পাশাপাশি, মৃত্যুর সময়ও রেখে গেছেন আরেকদল চিন্তাশীল মুজতাহিদ, মুতাফাক্কির, মুহাদ্দিস ও ফকিহ-কে। তিনি যে চিন্তাধারা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, সুদীর্ঘ হাজার বছর পর আজও সেই চিন্তাধারা সমানভাবে প্রাসঙ্গিক, গুরুত্ববহ, নন্দিত ও আলোচিত।
আর তাই, ঠিক হাজার বছর পরেও, তাঁর চিন্তাধারায় প্রভাবিত আরেক বলিষ্ঠ মসীর অধিকারী কলমের ডগায় চিত্রায়িত করলেন তাঁরই বর্ণিল ও বর্ণাঢ্য জীবন। এই বই তাঁর জীবনের অনবদ্য দাস্তান, ইতিহাসধারার পাঙক্তেয় এবং উপমহাদেশীয় অনিবার্যতম এক দলিল।
মূলত, উপমহাদেশের অন্যতম প্রভাবশালী ও মননশীল লেখক, ইসলামী চিন্তাবিদ, মহান আলেম, বিদগ্ধ ইতিহাসবেত্তা, উর্দু সাহিত্যের স্তম্ভখ্যাত আল্লামা শিবলী নোমানী (রহ.) কর্তৃক রচিত মহান দার্শনিক, মুহাদ্দিস, ফকীহ, মুতাফাক্কির, মুজতাহিদ ও উসূলবীদ ইমাম আজম আবু হানিফা নোমান বিন সাবিত (রহ.) এর জীবনচরিত, জ্ঞান, কর্মকাণ্ড, চিন্তাধারা ও দর্শনের অনবদ্য সমষ্টি “সীরাতে নোমান” গ্রন্থের কথাই বলছিলাম এতক্ষণ যাবত।
📌 বই পরিচিতি
আজ থেকে প্রায় সাড়ে তেরোশত বৎসর পূর্বে জন্মগ্রহণ করা এই মহান মনীষী তাঁর কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে জ্ঞান, উসূল, মেথডলজি, চিন্তাধারা ও দর্শনে যে বিপ্লব ঘটিয়েছিলেন, সে বিপ্লব প্রভাব বিস্তার করেছিল ইসলামী সভ্যতার প্রতিটি অঞ্চলে। যার ফলাফলস্বরূপ আমরা লক্ষ্য করি, সারাবিশ্বে এখনও সর্বোচ্চ সংখ্যক মুসলিম তাঁর চিন্তাধারায় প্রভাবিত এবং হানাফি মাযহাবের অনুসারী। তাকে নিয়ে যে আঙ্গিকে আলোচনা হওয়ার কথা ছিলো দর্শন, সাহিত্য ও ইতিহাসে, অজ্ঞাত কোনো এক কারণে তা চাপা পড়ে গিয়ে তাঁর মহান ব্যপৃত জ্ঞান, উসূল, মেথডলজি, চিন্তাধারা, দর্শন ও ধর্মতাত্ত্বিক কর্মকাণ্ডগুলো সংকীর্ণভাবে শুধুমাত্র ধর্মতাত্ত্বিক অবস্থান ও দৃষ্টিভঙ্গির আড়ালেই সীমাবদ্ধ হয়ে গিয়েছে। অথচ ইমাম সাহেব ও হানাফী মাযহাবের শ্রেষ্ঠত্বই হচ্ছে এর সামগ্রিকতায়, অর্থাৎ তা হচ্ছে বিশ্বজনীন প্রেক্ষিতে মানবপ্রকৃতির সাথে সর্বোচ্চ সামঞ্জস্যপূর্ণ। তাই বিদগ্ধ এই ইতিহাসবেত্তা ইমাম সাহেবকে নিয়ে আলাপ, আলোচনা, পর্যালোচনা ও চর্চার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে বইয়ের পাতায় ফুটিয়ে তুলেছেন ইমাম সাহেবের আসল চরিত্র, কর্মকাণ্ড, চিন্তাধারা ও দর্শন।
💠আল্লামা শিবলী নোমানী কর্তৃক ইমাম সাহেবকে নিয়ে রচিত অনবদ্য এই গ্রন্থটিকে তিনটি অধ্যায়ে আলোচনা করা হয়েছে। যথা:
১. ইমাম সাহেবের ব্যক্তিগত জীবনচরিত।
২. ইমাম সাহেবের কর্মকাণ্ড, চিন্তাধারা ও দর্শন।
৩. ইমাম সাহেবের সুযোগ্য উত্তরসূরী।
💠প্রথম অধ্যায়
এই অধ্যায়ে ইমাম সাহেবের পরিচয়, উপনাম, বয়স, শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, জ্ঞানার্জন, শিক্ষকবৃন্দ, শিক্ষকতা, ফতোয়া-দান, ওফাত ও চারিত্রিক গুণাবলি সম্পর্কে সম্যকভাবে আলোচনা করা হয়েছে।
◾এই অধ্যায়ে ইমাম সাহেবের শিক্ষাঙ্গনে পদার্পণের ঘটনা, তাঁর প্রতি শিক্ষকদের ভালোবাসা ও সম্মান, ইহইয়া বিন সাঈদ ও কাতাদা বসরীর (রহ.) সাথে মুনাজারাসহ আরো বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বাহাসের ঘটনা লিপিবদ্ধ করা হয়েছে।
◾ইমামে আযম (রহ.) এর জ্ঞানার্জন এবং তাঁর গবেষণার বিষয় নির্বাচন নিয়ে উত্থিত ধোঁয়াশার সমাধান প্রদানের পাশাপাশি ইমাম সাহেবের জ্ঞানার্জনের জন্য বিভিন্ন অঞ্চল যেমন–কুফা, বসরা, মক্কা ও মদীনা সফরের ঘটনাও শিক্ষকবৃন্দের নাম উল্লেখপূর্বক বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
◾চল্লিশ বছর ইশার অযু দিয়ে ফজর সালাত আদায়, ধারাবাহিকভাবে ত্রিশ বছরের রোজা, সাত হাজারবার কুরআন কারীম খতম, তুচ্ছ কারণে দীর্ঘদিন মাছ ও বকরীর গোশত না খাওয়া, ইমাম সাহেবের কোনো কন্যাসন্তান না থাকা সত্ত্বেও কোনো এক অদ্ভুত কারণে মেয়ের নামানুসারে তাঁর নামকরণ হওয়া; এমন সব আজগুবি ঘটনা ও কাহিনীগুলোকেও খণ্ডন করা হয়েছে। যেহেতু বইটার মূল বিষয়বস্তু ইমাম সাহেবের জীবনচরিত নয়, তাই এইসব বিষয়ে লেখক অযথা সময়ক্ষেপণ করেননি। কারণ, মনোরঞ্জক এইসব ঘটনা স্বাভাবিকভাবেই মানবপ্রকৃতি ও আকলের বিরুদ্ধে অবস্থান করে।
◾ইমাম সাহেব (রহ.) এর ওফাত, ওফাতকালীন প্রেক্ষাপট, উমাইয়া ও আব্বাসীয় খেলাফতকালে সংঘটিত বিদ্রোহ দু’টির ইতিহাস এবং তৎকালীন প্রেক্ষাপটানুযায়ী ইমাম সাহেবের কার্যক্রম বেশ ভালোভাবেই ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। লেখক বিষয়টা এমনভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন যে, কেউ যদি এই বিদ্রোহ দু’টি সম্পর্কে না-ও জেনে থাকে, শুধু “সীরাতে নোমান” পড়লেই বিদ্রোহের ইতিহাস অনেকটা তার জানা হয়ে যাবে!
◾ইমাম হাম্মাদ, আতা ইবনে আবি রাবাহ, ইমাম আওযায়ী, ইমাম বাকির, ইমাম মালিক, ইবনুল মোবারক, সুফিয়ান সাওরী (রহ.) সহ প্রমূখের সাথে সংঘটিত উল্লেখযোগ্য ঘটনা-সমূহের চুম্বকাংশ তুলে ধরা হয়েছে।
◾ইমাম ইবনে সাবিত (রহ.) এর মাকে আমর ইবনে যারকার নিকট নিয়ে যাওয়ার বিখ্যাত ঘটনা; এছাড়াও তাঁর মেধা, রায়, বিচক্ষণতা, দূরদর্শিতা, উন্নত চিন্তাধারা, আভিজাত্য, আধুনিকতা, প্রখর স্মৃতিশক্তি, বুদ্ধিমত্তা, অধ্যবসায়, সহজাত প্রকৃতি-প্রতিভা ও খোদাভীরুতার উদাহরণ এবং কাজী আবু ইউসুফকে দেওয়া মনোমুগ্ধকর, আবেগঘন, হৃদয়গ্রাহী উপদেশসমূহ উল্লেখ করা হয়েছে এই অধ্যায়ে।
💠দ্বিতীয় অধ্যায়
এই অধ্যায়-ই মূলত বইটির প্রধান আকর্ষণ। এই অধ্যায়েই ইমাম সাহেবের জ্ঞান, উসূল, কর্মকাণ্ড, মেথডোলজি, চিন্তাধারা, দর্শন নিয়ে; সর্বোপরি ইমামে আযম (রহ.)-কে নিয়ে চর্চা-আলোচনা করা হয়েছে। শুধু এতোটুকুই নয়, অসাধারণ এই আলোচনাকে বিদগ্ধ ইতিহাসবেত্তা তাঁর মননশীল মেধা খাটিয়ে বেশ সাজানো-গোছানো ও পরিপাটি করে উপস্থাপন করেছেন, যার ফলে দুর্বোধ্য এই বিষয়কে পাঠকের জন্য খুবই সহজবোধ্যভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। ইমাম সাহেবের গুরুত্বপূর্ণ কর্মকাণ্ড সম্বলিত এই অধ্যায়টি আলোচনাকালে অলিখিতভাবেই এটি চারটি অংশে বিভক্ত হয়ে গিয়েছে। যথা:
১. ইমাম সাহেবের লিখিত কর্মকাণ্ড
২. আকাইদ ও কালাম শাস্ত্র
৩. হাদীস ও উসূলে হাদিস
৪. ফিকহ শাস্ত্র
🔘প্রথম অংশ
এই অংশে ইমাম সাহেব কর্তৃক প্রণীত তিনটি গ্রন্থ সম্পর্কে সবিস্তারে আলোচনা করা হয়েছে। গ্রন্থগুলো হলো:-
১. আল আলিম ওয়াল মুতাআল্লিম
২. আল ফিকহুল আকবার
৩. মুসনাদে আবি হানিফা
◾এই অংশে ইমাম সাহেব ও তাঁর গ্রন্থগুলোর মধ্যকার সম্পর্ক নিয়ে লেখক বেশ গবেষণামূলক আলোচনা করেছেন। ইমাম রাযী ও শাহ ওয়ালীউল্লাহ দেহলভী (রহ.) এর গবেষণা উল্লেখপূর্বক যুক্তি ও তথ্যের মাধ্যমে প্রমাণ করেছেন যে, ইমাম সাহেবের জীবদ্দশায়-ই তাঁর কিতাব বিলুপ্ত হয়ে গেছে। বর্তমানে তাঁর নামে প্রচলিত যে সব বই-পুস্তক রয়েছে, তা মূলত বংশপরম্পরায় ইমাম সাহেবের নামে শ্রুত কথাগুলো তাঁর কোনো একজন ছাত্র বেশ গোছালোভাবে লিপিবদ্ধ করেছেন।
🔘দ্বিতীয় অংশ
ইমাম সাহেবের আগমনকালে ইসলাম নামক দীপ্তিমান প্রজ্জ্বলিত মশালটি বিশ্বময় আলোকিত করছিল। রোম-পারস্যের অধীবাসীরা তখন তাদের নেতাদের প্রতি বিতৃষ্ণ এবং মুসলিমদের আখলাক-আধ্যাত্মিকতায় মুগ্ধ হয়ে ইসলামের ছায়াতলে এসে সমবেত হচ্ছিল। তবে এতো বিশাল দু’টি সাম্রাজ্যের বিপরীতে মুসলিম মনীষীগণ তখনও বিশ্বজনীন প্রেক্ষিতে বুদ্ধিবৃত্তিক অঙ্গন, দর্শন এবং অদৃষ্ট বিষয়ক মাসআলা-মাসায়েল নিয়ে কাজ শুরু করেননি। কিন্তু ইমাম সাহেব এসে সে অঙ্গনে কাজ করলেন, বিশ্বজনীন প্রেক্ষিতে আকাইদ শাস্ত্রকে ঢেলে সাজালেন, কালাম শাস্ত্রের উদ্ভব ঘটালেন। আর তাই, তাঁর চিন্তাধারা সুদীর্ঘ হাজার বছর পরে এখনও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক, গুরুত্ববহ, নন্দিত ও আলোচিত।
ইসলামী চিন্তাবিদ আল্লামা শিবলী নোমানী তাঁর বইয়ের “চিন্তাধারা ও দর্শন” অধ্যায়ের দ্বিতীয় অংশে মূলত এই আকাইদ ও কালাম শাস্ত্র নিয়েই বিস্তর আলোচনা করেছেন।
◾বিশ্বজনীন প্রেক্ষিতে আকাইদ শাস্ত্রকে ঢেলে সাজানো এবং কালাম শাস্ত্রের উদ্ভব ঘটানোর কারন ও প্রক্রিয়া; এছাড়াও এই শাস্ত্রের মাসআলা-মাসায়েল নিয়ে যুগশ্রেষ্ঠ আলেমদের ভেতরকার মতবিরোধ, মতবিরোধের চূড়ান্ত পর্যায়ের ঘটনা এবং আকিদাগত কারণে কাফির, ফাসিক ও মুরজিয়া ফতোয়া-দানের উল্লেখযোগ্য ঘটনাগুলোও এখানে বর্ণনা করা হয়েছে।
◾ইমান ও আমল একে অপরের অন্তর্ভুক্ত কি-না; এই বিষয় নিয়ে ইমাম সাহেব সহ অন্যান্য ইমামদের মতামত বিশদভাবে আলোচনা করা হয়েছে এই অংশে। পাশাপাশি, উক্ত বিষয়ে খ্যাতিমান মুহাদ্দিস উসমান বাত্তীকে দেয়া ইমাম সাহেবের দীর্ঘ একটি পত্র নিয়েও বিশেষভাবে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
◾এরপর ইমানের বেশ-কম হওয়া বা না হওয়া নিয়ে অন্যান্য মতামত খণ্ডন করে ইমাম সাহেবের মতামতটিকে যুক্তি-প্রমাণ সহকারে পর্যালোচনা করা হয়েছে। পরিশেষে, অন্যান্যদের মতো আকিদাগত কারণে কাফির, ফাসিক, মুরজিয়া ইত্যাদি ফতোয়া প্রদান না করার বিষয়টি তুলে ধরার মাধ্যমে ইমাম সাহেবের উদারতার প্রমাণ পেশ করা হয়েছে এই অংশটিতে।
🔘তৃতীয় অংশ
এই অধ্যায়ের তৃতীয় পর্বে হাদীস ও উসূলে হাদীস শাস্ত্রে ইমাম সাহেবের কর্মকাণ্ড, চিন্তাধারা, অবদান এবং এটিকে সুবিন্যস্ত করার ঘটনা, পদ্ধতি ও প্রক্রিয়া আলোচনা করা হয়েছে।
এটি মূলত একটি যুক্তিখণ্ডনমূলক পর্ব। বর্তমানে হাদীস ও উসূলে হাদীস শাস্ত্রে ইমাম সাহেবের দক্ষতা নিয়ে যাদের গাত্রদাহ রয়েছে, সেইসব স্থূলদৃষ্টি সম্পন্ন লোকজনের অযৌক্তিক যুক্তি ও দাবির অসারতা প্রমাণ করা-সহ সেগুলোর দাঁতভাঙা জবাব দেওয়া হয়েছে এই অংশটিতে।
◾হাদিস বর্ণনার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস, হাদিসের পরিচয়, হাদিসের শ্রেণিবিভাগ, যিন্দিকদের জাল হাদিস তৈরি ও প্রচলন; এমনকি উমাইয়া সালতানাতের সময়ের জাল হাদিসের বিস্তৃতি সম্পর্কেও আলোচনা করা হয়েছে এখানে।
◾এই অংশে হাদিস গ্রহণ ও মুজতাহিদ হওয়ার শর্তাবলি, মুহাদ্দিসগণের শ্রেণিবিভাগ, ইমাম সাহেবের হাফেজে হাদিস হওয়ার ঘটনা, ওমর (রা.) এর অতিরিক্ত হাদিস বর্ণনা না করার কারণ এবং হাদিস বর্ণনায় অসতর্কতার বিষয়েও আলোকপাত করা হয়েছে।
◾উসূলে হাদীসের সুবিন্যস্তকরণ, কিয়াসবিরোধী হাদীস, আকল ও জ্ঞান-বুদ্ধির পরিপন্থী হাদিস, হাদিসের মোকাবেলায় কিয়াসের অগ্রহণযোগ্যতা, রিওয়ায়াত বিল-মা’নার পরিচয় ও বর্ণনার হুকুম এবং এই বিষয়ে ইমাম সাহেব কর্তৃক প্রণীত মূলনীতি নিয়েও বিশদভাবে আলোচনা করা হয়েছে এই অংশটিতে।
◾পরিশেষে হাদীস বর্ণনাকারীদের জীবনচরিত অর্থাৎ রিজাল শাস্ত্র এবং এর সাথে সম্পর্কিত ইতিহাস নিয়ে বিশাল পর্যালোচনার মাধ্যমে এই পর্বের ইতি টানা হয়েছে।
🔘চতুর্থ অংশ
সমগ্র ইসলামী বিশ্বে যে সকল মহান ইমামের প্রবর্তিত ফিকহ অনুসরণ করা হচ্ছে, তাঁরা হলেন চারজন। যথা:
১. ইমাম আবু হানিফা (রহ.)
২. ইমাম মালিক (রহ.)
৩. ইমাম শাফেয়ী (রহ.) এবং
৪. ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল (রহ.)।
মূলত, ফিকহী মাসাআলার প্রচলন ও প্রসারের মূলে রয়েছে এর সৌন্দর্য ও কার্যকারিতা। তবে সন্দেহাতীতভাবে বলা যায়, এর মূলে রয়েছে ফিকহ প্রবর্তকের ব্যক্তিত্ব, প্রভাবও মাহাত্ম্য। এই বিবেচনায় ইমাম আবু হানিফা (র.) ব্যতিরেকে অপরাপর ইমামগণ উপরোক্ত গুণাবলির কারণেই জনগণের মাঝে সর্বজনীনতা লাভ করেছিলেন। তবুও ইমাম সাহেব ও তাঁর মাযহাব হাজার বছর পরে এখনও সর্বাধিক প্রসিদ্ধ। কেননা, ইমাম সাহেবের জ্ঞান, চিন্তাধারা ও দর্শন এবং হানাফি মাযহাবের উসূল ও মেথডোলজি বিশ্বজনীন প্রেক্ষিত হওয়ার পাশাপাশি মানব-প্রকৃতির সাথে সর্বাধিক সামঞ্জস্যপূর্ণ। তাই, তিনি ও তাঁর মাযহাব আজও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক, গুরুত্ববহ, নন্দিত ও আলোচিত। অথচ তাঁর ছিল না ইমাম শাফেয়ী (রহ.) এর মত পারিবারিক পরিচয়, ছিল না ইমাম মালেক (রহ.) এর মতো সর্বাধিক প্রসিদ্ধ কাজের ক্ষেত্র।
ইমাম সাহেবের চিন্তাধারায় প্রভাবিত উপমহাদেশের এই ইসলামী চিন্তাবিদ তাঁর “সীরাতে নোমান” বইয়ের “চিন্তাধারা ও দর্শন” অধ্যায়ের তৃতীয় অংশে ইমাম সাহেবের সর্বাধিক পরিচিত বিষয় অর্থাৎ ফিকহ শাস্ত্রের উপর আলোকপাত করেছেন।
◾এই অংশের প্রথমেই ইমাম সাহেবের কার্যক্রম পরিচালনার স্থান—কুফা, কুফায় আগমনকারী সাহাবী হযরত আলী (রা.), আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) ও তাবেয়ী ইমাম ইবরাহীম নাখয়ী (রহ.) এর জীবনী এবং তাঁদের ফিকহী চিন্তাধারায় ইমাম সাহেবের প্রভাবিত হওয়ার ঘটনাক্রম উল্লেখ করা হয়েছে।
◾ইমাম সাহেবের ফিকহ শাস্ত্রের প্রতি অনুরাগী হওয়া এবং ঝুঁকে পড়ার কারণ, এর প্রক্রিয়া ও ফলাফল, ফিকহ শাস্ত্রের মাসআলা বিশ্লেষণ এবং ফিকহ শাস্ত্র লিখন পদ্ধতি নিয়েও বিস্তর আলোচনা করা হয়েছে এখানে।
◾ইমাম সাহেব কর্তৃক হানাফি মাযহাবের উদ্ভব, হানাফি মাযহাবের উসূল ও বৈশিষ্ট্য, হানাফি মাযহাবের গ্রহণযোগ্যতা এবং ইসলামী সভ্যতার প্রতিটি অঞ্চলে হানাফী মাযহাবের প্রভাবের কারণও যথাযথভাবে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে এই অংশটিতে।
◾যাকাত, চুরি, উত্তরাধিকার, লেনদেন, তায়াম্মুম ও বিবাহ সম্পর্কিত ফিকহে হানাফির কিছু মাসআলা-মাসায়েল এর উপর উত্থাপিত প্রশ্নের দালিলিক জবাব দেওয়া হয়েছে। পরিশেষে, এই সকল ক্ষেত্রে বিশ্বজনীনতা ও মানব-প্রকৃতির সর্বাধিক সামঞ্জস্যপূর্ণতার বিষয়টিও বিশ্লেষণাকারে ফুটিয়ে তোলার মাধ্যমে দ্বিতীয় অধ্যায় শেষ করা হয়েছে।
💠তৃতীয় অধ্যায়
বইটিতে এই অধ্যায় মূলত “পরিশিষ্ট” নামে আলোচনা করা হয়েছে। এখানে ইমাম সাহেবের গড়ে তোলা সুযোগ্য চিন্তাশীল, মুজতাহিদ, মুতাফাক্কির, মুহাদ্দিস ও ফকিহগণের জীবনী লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। মননশীল এই লেখক হানাফি মাযহাবের ইমামদের জীবনীচরিত ফুটিয়ে তোলার সময় অধ্যায়টিকে দুই ভাগে বিভক্ত করেছেন। যথা:
১. হাদীসাঙ্গন
২. ফিকহাঙ্গন
◾এই অধ্যায়ের প্রথম ভাগে মুহাদ্দিসগণের জীবনচরিত লিপিবদ্ধ করে এটাই প্রমাণ করা হয়েছে যে, ইমাম সাহেব নিজে যেমন সূক্ষ্মদর্শী মুহাদ্দিস ছিলেন, উত্তরাধিকারী হিসেবেও তেমনি সুযোগ্য মুহাদ্দিস গড়ে তুলেছেন। কারণ, একজন ফকিহ হতে হলে প্রথমেই তাকে হাদীস বিশারদ হতে হবে। কেননা, ফকিহর কাজই হচ্ছে, হাদীসের অভ্যন্তরীণ বিধিবিধান ও আইনগত দিক পর্যালোচনা করা।
◾প্রথমভাগে ইহইয়া ইবনে সাঈদ আল কাত্তান, ইহইয়া ইবনে যাকারিয়া, ওয়াকী ইবনুল জাররাহ, ইয়াযীদ ইবনে হারুন, হাফস ইবনে গিয়াস, আবু নাসীম আন-নাবীল, আব্দুর রাজ্জাক ইবনে হুমাম এবং দাউদ আত-তাঈ (রহ.) এর জীবনী তুলে ধরা হয়েছে।
তাঁরা একেকজন ছিলেন হাদীস শাস্ত্রের নক্ষত্র তুল্য, যাদের উপর ভিত্তি করে হাদীস শাস্ত্র টিকে রয়েছে। এছাড়াও মুহাদ্দিসগণ ইমাম সাহেবের এমন সুযোগ্য উত্তরসূরী ছিলেন যে, ইমাম বুখারী, ইমাম মুসলিম, আহমাদ ইবনে হাম্বল (রহ.) পর্যন্ত তাদের ছাত্র হতে পেরে গর্বিত হতেন। এমনকি “আমিরুল মুমিনীন ফিল-হাদিস” উপাধীপ্রাপ্ত আব্দুল্লাহ ইবনুল মোবারক (রহ.)-ও ছিলেন ইমাম সাহেবের হাতেগড়া ছাত্র।
◾বিশ্বজনীন প্রেক্ষিতে মানব প্রকৃতির সাথে সর্বোচ্চ সামঞ্জস্যপূর্ণ হানাফি মাযহাবের মূল রূপকার ফকিহবৃন্দ অর্থাৎ কাজী আবু ইউসুফ, ইমাম মুহাম্মাদ, ইমাম যুফার, কাসিম ইবনে মা’ন, আসাদ ইবনে আমর, আলী ইবনুল মুসহির, আফিয়া ইবনে ইয়াযীদ, ইমাম হাব্বান এবং ইমাম মানদিল (রহ.) এর জীবনচরিত দ্বিতীয়ভাগে লিপিবদ্ধ করার মাধ্যমে-ই বইটির ইতি টানা হয়েছে।
📌 ব্যক্তিগত পাঠ-প্রতিক্রিয়া ও পর্যালোচনা
মক্তব প্রকাশন যেহেতু আমাদের বরাবরই মৌলিক বই উপহার দিয়ে আসছে, সে পরিপ্রেক্ষিতে “সীরাতে নোমান” টা অবশ্যই মৌলিক বইয়ের বাহিরে না। মৌলিক বই হিসেবে একজন পাঠকের নিকট বইটির লেখার ধাঁচ সম্পূর্ণ নতুন ও ব্যতিক্রম মনে হতে পারে। আর তাই, এই বইটা হজম করতে হলে একজন পাঠক হিসেবে তার কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিভাষা সম্পর্কে অবগত থাকতে হবে। পাশাপাশি, হাদিস, উসূলে হাদীস, ফিকহ, উসূলে ফিকহ বিষয়েও মৌলিক ধারণা রাখতে হবে। নচেৎ পাঠকের নিকট এই বইয়ের প্রতিটি পৃষ্ঠা দুর্বোধ্য মনে হবে।
তবে একটা বিষয় উল্লেখ না করলেই নয় যে, যেহেতু মহান এই দার্শনিক ইমাম সাহেবের জীবনীর উপরে জ্ঞান, উসূল, মেথডোলজি, চিন্তাধারা ও দর্শনের আঙ্গিকে তেমন একটা নজর বুলানো হয়নি, তাই বইয়ের প্রতিটি পাতায় নিত্য-নতুন তথ্য-তত্ত্বে রোমাঞ্চিত হতে পারেন একজন পাঠক।
মজবুত বাইন্ডিং, চমৎকার প্রচ্ছদ, মনোমুগ্ধকর ডিজাইন এবং মৌলিক কন্টেন্ট এর ধারাবাহিকতা রক্ষার ক্ষেত্রে মক্তব প্রকাশনের আরেকটি মাইলফলক “সীরাতে নোমান” বইটি।
এছাড়াও অনুবাদকের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল হিসেবে ঝড়ঝড়ে ও সহজবোধ্য অনুবাদের জন্য তিনি অবশ্যই যথোপযুক্ত শুকরিয়া পাওয়ার দাবিদার।