একটি বাস্তব নাকবা নির্মাণ; ফারহা

২০২১ সালে লাইট অব দ্য ওয়ার্ল্ড ফটোগ্রাফির মঞ্চোকাপানো সেই এক জোড়া পেঙ্গুইন মেলবোর্নের কোনো ভিন্ন দুটি দ্বীপে দীর্ঘদিন একলা বিচ্ছিন্ন দাঁড়িয়ে ছিল কম হলেও ছ’মাস। এ- দীর্ঘসময়ে ওই দুটি প্রাণ-ই কখনো হয়তো রোদে পুড়ে কিংবা বৃষ্টিতে ভিজে; নিশ্চয়ই নির্ভিক অথবা বিমর্ষচিত্তে ওদের বিরহের ক্ষতটা নিয়েই ঠাই দাঁড়িয়েছিল!

তবে চিরন্তন হলো- প্রিয়জন হারানোয় কিংবা বিচ্ছেদের বেদনায় ক্ষতবিক্ষত প্রাণদুটি যখন মাসের পর মাস ওদের ভাঙা হৃদয়খানা উজাড় করে সমূদ্র পানে চেয়ে ছিল নিষ্পলক, তখনও ওরা লোকচক্ষুর ঢের আড়ালেই! কোন এক ভর পূর্ণিমায় যখন একত্রিত হলো পেঙ্গুইন দুটি, অর্থাৎ ওয়াইল্ডলাইফ ফটোগ্রাফিটা ঠিক যে সময়ের, যেন তখন থেকেই আলোচনায় পাখি দুটির বিচ্ছেদ ও পুণর্মিলন।

গুরুভাষ্যে- কোন সংগ্রাম, বিচ্ছেদ, না পাওয়ার দহন বা অর্জনের প্রবল বাসনা, কিংবা স্বাধিকার আন্দোলনে সর্বস্ব ত্যাগ; কার্যতঃ প্রতিটির-ই স্বীকৃতি অকল্পনীয়, যদি না দীর্ঘ আরাধনার পর সেই কাঙ্ক্ষিত অধরার আলিঙ্গন মেলে।

বোধহয় একারণেই, নাকবার প্লাটিনাম জয়ন্তী পূর্ণ হলেও ভূমধ্যসাগরের তীরে জন্ম নেওয়া মুজাহিদ ফিলিস্তিনিরা নাকবার বিপরীতে করা তাদের শাশ্বত সংগ্রামের স্বীকৃতি পায়নি আজও।
শুভ্র, সুশৃঙ্খল ও স্বাভাবিক জীবনযাপনে যে পর্যায়ের

বিপর্যয় নেমে এলে মানুষ কোনঠাসা হয়ে তার কয়েক পুরুষের ভিটে-বাড়ি ত্যাগ করে, রোশনাইহীন কোনো সরু আইল ধরে কয়েকশো মাইল পাড়ি দেয় নিরাপদ শরনার্থী শিবিরের খোঁজে, এবং নিজভূমি ত্যাগের এই দীর্ঘ বিচ্ছেদ যাত্রায় চোখে পড়ে কতশত গণকবর, লাশের মিছিল, বেয়োনেটের আঘাতে চৌচির দেহাবয়ব; প্রিয়জনের আহাজারি, মায়ের ওম ছেড়া নবজাতকের হোঁ-হোঁ কান্না; এর সবটা জুড়েই আজকের পচাত্তর নাকবা। মূলত এর প্রেক্ষিতেই ২০২১ সালে জর্দানের প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায় সেদেশের গুণি নির্মাতা দারিন জে. সাল্লামের একটি বাস্তব নাকবা নির্মাণ- ফারহা।

৪৮ -এ আরব ফিলিস্তিনের কোনো সমৃদ্ধ ও প্রত্যন্ত এক শেখ শাসিত গ্রামে সিনেমাটির প্রথম দৃশ্যপট। একটি শ্যামল গ্রাম, শুভ্র জলপ্রপাত, সুশ্রী সমাজ ও মৃণ্ময়ী মানব-মানবী; ইত্যাদীর সমন্বয়ে গ্রামটিকে আরব সংস্কৃতির আলোকে বেশ জাদরেলভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। ওসমানী আমলের দারস কিংবা মক্তব ভিত্তিক পাঠ্যরীতি খেলাফত পতনের পরও গ্রামটিতে বিদ্যমান। তবে ভূরাজনৈতিক উত্থানপতন ও ক্ষমতার বালাবদলের প্রভাবে গ্রামের এই চিরাচরিত শিক্ষারীতিতেও পরিবর্তনের হাওয়া লেগেছে। গ্রামের নিয়ম ভেঙেই সামর্থ্যবান লোকেরা তাদের সন্তানদেরকে শহরের স্কুলে ভর্তি করতে আরম্ভ করেছে। গ্রাম্য সালিশের সর্বোচ্চ ব্যক্তি যিনি, গ্রামটির শেখ আশরাফ বারহাম -এর ঘরের মেয়ে ‘ফারহা’-ও একই বায়না ধরেছে। তবে শেখ আশরাফ মেয়ের এই বেআইনি বায়নার বিড়ম্বনা অনুভব করার আগেই কপাল ঘুচিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্থ আরেক ব্যপার নিয়ে- গ্রামে ডজনে ডজনে ইহুদি সৈন্য প্রবেশ করছে! দাবী করছে গ্রামের কর্তৃত্বও! তবে মানুষের না, মাটির। অর্থাৎ জুড়ে বসা সেনারা স্বয়ং তাদেরই গ্রামান্তর করতে চায়! সেটিও গ্রামের মালিকানা দাবী করে! এনিয়ে গ্রামের যুবকেরা প্রতিনিয়তই আশরাফের ভিটেয় জমায়েত হচ্ছে, পশু শিকারের মুষ্টিমেয় অস্ত্র ও লাঠিসোঁটা নিয়েই যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়তে চাচ্ছে তারা। কিন্তু আশরাফের একটি কথায়-ই সকল প্রস্তুতি ভেস্তে যাচ্ছে তাদের- “আমি এখনো আরব নেতাদের কোনো নির্দেশ পাইনি, অস্ত্র পাইনি। তোমরা এখনই আক্রমণে যেও না! ”
– এভাবেই এগুতে থাকে “ফারহা”-র দৃশ্যপট!

১৪ মে ফিলিস্তিনের ৫৫ শতাংশ ভূমির মালিকানা দাবী করে স্বঘোষিত স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ইজরায়েল আত্মপ্রকাশ করে। সমগ্র ফিলিস্তিন জুড়ে দাবানলের মতো ক্ষোভে ফুসতে থাকে সাধারণ মানুষেরা। সৌদি আরব, মিশর, সিরিয়া, ইরাক ও জর্দান স্বশস্ত্র যুদ্ধের ঘোষণা দেয় ইজরায়েলের বিরুদ্ধে। যার প্রেক্ষিতেই ১৫ মে থেকে দখলদার প্রশাসনের সক্রিয় আক্রমণের মুখে পড়ে লক্ষ লক্ষ ফিলিস্তিনি জনগণ। শুরু হয় ১ম আরব-ইজরায়েল যুদ্ধ।

গ্রামটিতে বসবাসরত কয়েক হাজার মানুষের কোলাহল, চিৎকার, ছুটোছুটি, পালায়ন- ইত্যাদির মাধ্যমে ১৫ মে এর ভয়াবহতা ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করা হয়েছে সিনেমাটির পরের ধাপে। যেখানে গ্রামের কর্তা হিসেবে আশরাফ বারহাম ইজরায়েলি হত্যাযজ্ঞের মাঝেও গ্রাম ছেড়ে না যাওয়ার কথা জানিয়ে দেন। ফলতঃ ফারহাও পিতাকে ছেড়ে যাওয়ায় অস্বীকৃতি জানায়। এমতবস্থায়, নিরাপত্তার খাতিরে ফারহাকে বাড়ির এক পরিত্যক্ত গুদাম কক্ষে আশ্রিত রেখে বেরিয়ে যান আশরাফ।
তখন থেকে সিনেমার পুরো অংশ জুড়েই ফারহা অধ্যায়।

একটি জানালাবিহীন অন্ধকার ঘর, চারিদিকে বোমার শব্দ, বারুদের গন্ধ, দরজার ছিদ্র দিয়ে আসা টিয়ারগ্যাস; ইত্যাদি উপস্থাপনের মাধ্যমে কক্ষটির বাইরে সংঘটিত হওয়া ভয়াবহ যুদ্ধের মহাসমারহ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে৷ গুদাম ঘরটিতে শুকনো খাবার ও ফলের আধিক্য থাকলেও তীব্র পানিশূন্যতা, ভয়, আতঙ্ক ও পিতার ফিরে আসার অপেক্ষায় অন্ধকার ঘরে মজে যেতে থাকে ফারহা। এই অবস্থায় দুইদিন পার হয়ে গেলেও ফারহার পিতার ফিরে না আসাকে সিনেমার সিকোয়েন্স অনুযায়ী কোথাও ইজরায়েলি সেনাদের আক্রমণে মৃত হিসেবেই ধরে নেওয়া যেতে পারে।

তৃতীয় দিন রাতে মুষলধারে বৃষ্টি! ফারহা কক্ষটির এক ছিদ্র ভেঙে হাত দিয়ে বৃষ্টির পানি স্পর্শ করে। পান করে। ছিদ্র দিয়ে বাইরে যতটুকু চোখ যায়, শুধুই ধ্বংসযজ্ঞ! জনমানবহীন এক মৃত্যুপুরী! দূর আকাশের যুদ্ধ বিমান থেকে ছোড়া বোমার শব্দ ছাড়া কোথাও কোনো আওয়াজ নেই! এক দিবস আগের এতো সবুজ শ্যামল ও প্রাণোচ্ছল গ্রামটি যেন আজ দখলদার গোষ্ঠির আক্রমণে মৃত্যু বরণ করেছে!
ফারহা কক্ষটি থেকে বের হওয়ার প্রাণপণ চেষ্টা চালাতে থাকে।

পরদিন সকালে কক্ষটির বাইরে এক নারীর তীব্র প্রসব বেদনার কান্না ফারহাকে ঘুম ভাঙিয়ে জাগ্রত করে। বাইরে চোখ মেলে দেখে- তিন শিশু, এক গর্ভবতী নারী ও এক পুরুষের একটি পরিবার। ফারহার কক্ষটির ঠিক বাইরেই গুড়িয়ে দেওয়া এক বাড়ির ধ্বংস্তুপের উপর সন্তান প্রসব করেন সেই নারী। ফারহাও সজোড়ে চিৎকার করে তাকে কক্ষটি থেকে বের করার আকুতি জানাতে থাকে।

ফারহার চিৎকারে সাড়া দিয়ে পরিবারটির পুরুষ সদস্য খুব করে দরজা ভাঙার চেষ্টা করে। কিন্তু দরজা এতোই মজবুত ছিল যে, সেটি ভাঙার শব্দ আশেপাশে বেশ জোড়ালোভাবে শোনা যেতে থাকে। আর সেই শব্দ অনুসরণ করেই ঘটনাস্থলে এক গাড়ি ইজরায়েলি সৈন্য এসে হাজির!

ফারহা অবলোকন করে শতাব্দীর ঘৃণ্যতম হত্যাকাণ্ডসমূহের একটি। সবে জন্ম নেওয়া নবজাতকসহ পরিবারটির ছয় সদস্যকে এক লাইনে দাঁড় করিয়ে একে একে গুলি করে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়! তবে নবজাতক শিশুটির ক্ষেত্রে ইহুদি কমান্ডারের নির্দেশ আসে এমন- আমি এই শিশুর জন্য গুলি নষ্ট করতে সম্মত নই, বুটজোড়ার পা দিয়েই ওর মুখাবয়ব গলিয়ে দাও!

একটি নির্জন, অন্ধকার, পানিশূন্য ও ধ্বংসপ্রায় কক্ষ। যে কক্ষটি জানেনা তার পরিচয়, ভাষা ও ভবিষ্যৎ। সামনে পড়ে থাকা ছয়টি গলিত লাশ, গুড়িয়ে দেওয়া ভবনের উপর কাক, মাছি আর বন্য শুকুনগুলো ছিড়ে ছিড়ে খাচ্ছে ওই লাশগুলো- আর সেই কক্ষটির ভেতরেই পাঁচদিন যাবত আটকে থাকা ফারহা। স্ক্রিনপ্লে’র দারুণ এই অংশটিতে প্রকৃত নাকবার ভয়াবহতা স্পষ্টতই ফুটে উঠেছে।

এক পর্যায়ে, গুদামঘরটির কাঁচামালের আড়াল থেকে ফারহা এক রিভলবার আবিষ্কার করে। তার ক্ষুধার্ত, তৃষ্ণার্ত ও ভয়ার্ত চেহারায় ফুটে উঠে বাইরের ধ্বংসলীলা আলিঙ্গনের হাতছানি। দরজায় ডজনখানেক গুলি করতেই তা খুলে পড়ে যায়। ফারহা বেরিয়ে আসে নতুন ও অভিশপ্ত এক দুনিয়ায়৷

১৯৪৯ সালে আরব-ইজরায়েল যুদ্ধ পরবর্তী সিরিয়ার এক শরনার্থী শিবির থেকে বর্ণিত হয় রাদিয়া মূলচরিত্রের এই বাস্তব গল্পটি। সম্প্রতি “ফারহা” নামে নাকবার এই বাস্তব নির্মাণটি সেসময় ফিলিস্তিনে চালানো জায়নবাদী ইজরায়েলি আগ্রাসনের ভয়াবহতা অনেকাংশেই ফুটিয়ে তুলিছে। তবে গতবছর সিনেমাটির জন্য আন্তর্জাতিক আদালতে ইজরায়েলের পক্ষ থেকে জর্দানের বিরুদ্ধে মানহানি মামলার গুঞ্জন সরব হয়ে উঠিছিল।

১০৭ বার পঠিত

শেয়ার করুন

Picture of রোয়াক ডেস্ক

রোয়াক ডেস্ক

রোয়াক, ইসলামী চিন্তা ও গবেষণা ইন্সটিটিউটের অনলাইন মুখপাত্র। বুদ্ধিবৃত্তিক ও সময়ের চিন্তাগত সংকট থেকে উত্তরণের জন্য কাজ করে যাবে।
Picture of রোয়াক ডেস্ক

রোয়াক ডেস্ক

রোয়াক, ইসলামী চিন্তা ও গবেষণা ইন্সটিটিউটের অনলাইন মুখপাত্র। বুদ্ধিবৃত্তিক ও সময়ের চিন্তাগত সংকট থেকে উত্তরণের জন্য কাজ করে যাবে।

মতামত প্রকাশ করুন

Scroll to Top