- প্রসঙ্গ কথাঃ
(আজকের মুসলিম বিশ্ব নামে পরিচিত ভৌগোলিক এলাকাসমূহ দীর্ঘদিন ধরে পাশ্চাত্য শাসনের নাগপাশে বন্দী ছিল । বিশ শতকের প্রথমভাগে মুসলমানরা আজাদী চেতনায় উদ্দীপ্ত হয়ে উঠে। যার পরিণতিতে আজ বিশ্বে প্রায় অর্ধশত স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্র জন্মলাভ করেছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে,, মুসলমানরা এই সব দেশে রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জন করলেও তাদের নিজস্ব সভ্যতা সংস্কৃতির মৌলিক নীতির ভিত্তিতে তাদের জাতিসত্তা গঠিত। হয়নি। যদিও কম বেশী মুসলিম বিশ্বের সকল দেশের বেলায় এ কথা সত্য যে এটা অর্জনের প্রেরণা নিয়ে মুসলিম জনগণ আজাদী সংগ্রামে অংশ-নিয়েছে। এ কাঙ্ক্ষিত জাতিসত্তা যদি গঠন করতে হয় তবে জনগণকে ইসলামী আদর্শের আলোকে শিক্ষিত করে তুলতে হবে। পাশ্চাত্য আদর্শ, সভ্যতা ও সংস্কৃতির আলোকে শিক্ষিত করে এটা অর্জন করা সম্ভব নয়। কিন্তু মুসলিম বিশ্বের সর্বত্রই শিক্ষা ব্যবস্থার উপর পাশ্চাত্য আদর্শের প্রাধান্য বিদ্যমান । মুসলিম উম্মাহ হিসেবে টিকে থাকতে হলে সর্বপ্রথম প্রয়োজন ইসলামী আদর্শের আলোকে শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়ন করা। আর এ দায়িত্ব বর্তায় মুসলিম দেশসমূহের সরকারের উপর। ‘সাইয়েদ আবুল আলা মওদূদী’ ছাত্রদের সামনে প্রদত্ত এক ভাষণে এই দিকটার গুরুত্ব তুলে ধরার সাথে সাথে তার দিক নির্দেশও করেছেন। কিন্তু যাদের উপর এ দয়িত্ব তারা যদি তা পালনে এগিয়ে না আসেন তবে দেশের তরুণ ছাত্র সমাজই দ্বিতীয় কার্যকরী শক্তি যারা তাদের নিজেদের প্রচেষ্টায় তা কার্যকরী করতে পারে । আর এ জন্যে ছাত্র সমাজের করণীয় সম্পর্কে তিনি অত্যন্ত সুচিন্তিত নির্দেশিকা দিয়েছেন)
- মুসলিম বিশ্বের পুনর্গঠনে ছাত্র সমাজের ভূমিকাঃ-
প্রিয় ছাত্র ভাইয়েরা এবং উপস্থিত সুধীমণ্ডলী, যে বিষয়ে আমাকে এখন বক্তব্য পেশ করতে হবে সে পর্যায়ে কিছু বলার পূর্বে আমি আন্তরিক সন্তোষ প্রকাশ করছি যে মুসলিম বিশ্বের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের প্রায় সর্বত্রই এমন সব যুবক বর্তমানে আছে যাদের হৃদয় ঈমানের নির্মল আলোক প্রভায় উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে। যারা মুসলিম হিসেবে নিজেদের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন, সাথে সাথে তারা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে ইসলামের প্রাণ প্রবাহ সৃষ্টির জন্য কম বেশী চেষ্টা করে চলেছেন। মুসলিম বিশ্বের কল্যাণকামী কোন ব্যক্তিই এই অবস্থার প্রতি সন্তুষ্ট না হয়ে পারেন না। এটা কারো জন্যে ক্ষতিকর তো নয়ই বরং তা মহান আল্লাহরই রহমত। কেননা মুসলিম বিশ্বের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ ব্যবস্থার উপর পাশ্চাত্য চিন্তা, বিশ্বাস, মতাদর্শের প্রাধান্য থাকা সত্ত্বেও আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে অনুরূপ যুবক মওজুদ রয়েছে এবং তারা প্রবল প্রতিকূলতার মোকাবিলায় নিজেদের কর্তব্য পালন করে যাচ্ছে।
মুসলিম দেশসমূহের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নির্মাণে ছাত্রদের কি ভূমিকা হওয়া বাঞ্ছনীয় তাই হচ্ছে আমার আজকের বক্তৃতার আলোচ্য বিষয়। এ প্রসঙ্গে সর্বপ্রথম যে বিষয়টি উল্লেখ করতে চাই, যে সকল মুসলিম দেশের ছাত্ররা পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদের প্রত্যক্ষ ঔপনিবেশ শাসনের গোলামীতে বন্দী কিংবা পাশ্চাত্য জাতিসমূহের নিকট প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে পরাজয় বরণের পর তাদের চিন্তাধারা ও সভ্যত-সংস্কৃতির প্রভাবে গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছে এবং যাদের শিক্ষণ ও প্রশিক্ষণসহ জীবনের প্রতিটি দিক ও বিভাগ পাশ্চাত্য থেকে প্রাপ্ত মতাদর্শ ও জীবন পদ্ধতির উপর ভিত্তি করে চলছে, আমার এই ভাষণ তাদের উদ্দেশ্যে প্রদত্ত হচ্ছে। আমার দৃষ্টিতে এই সমস্ত দেশের অবস্থা প্রায় অভিন্ন এবং তারা একই ধরনের সমস্যার সম্মুখীন । এদিক দিয়ে তাদের পরস্পরে তেমন কোন পার্থক্য নেই ।
এ পর্যায়ে আরো স্মরণ রাখা দরকার, “মুসলিম বিশ্ব” বলতে এর জমিন, পাহাড় কিংবা নদনদীকে বুঝায় না বরং সেখানে বসবাসকারী জনসমষ্টিকেই বুঝায় । মানুষ মাত্রই মরণশীল। নির্দিষ্ট আয়ুষ্কাল শেষে প্রত্যেককে বিদায় নিয়ে চলে যেতে হবে। এই সব দেশে আমাদের সভ্যতা, সংস্কৃতি এবং জীবনব্যবস্থাকে অক্ষুন্নভাবে টিকিয়ে রাখার একটি মাত্র পথ আছে। আর তা হচ্ছে আমাদের পূর্বপুরুষদের থেকে প্রাপ্ত উত্তরাধিকার পরবর্তী বংশধরদের নিকট যথাযথভাবে পৌছে দেয়া এবং তাদেরকেও উক্ত উত্তরাধিকার পরবর্তী বংশধরদের কাছে হস্তান্তর করার যোগ্যতাসম্পন্ন করে গড়ে তোলা।
- জাতীয় স্থিতি ও বিনাশের তাৎপর্যঃ
দুনিয়ার ইতিহাসে যেসব জাতি ও সভ্যতা ধ্বংস হয়েছে তার অর্থ এই নয় যে তাদের সমস্ত বংশধর নিঃশেষ হয়ে গেছে। প্রকৃতপক্ষে তাদের জাতীয় স্বাতন্ত্র্য ও বিশেষত্বের বিলুপ্তিই তাদের ধ্বংস হওয়ার সঠিক তাৎপর্য । দৃষ্টান্তস্বরূপ উল্লেখ করা যায়, আমরা যখন বলি, ব্যাবিলন সভ্যতা নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে, মিশরের ফেরাউনী জাতি ধ্বংস হয়ে গেছে, তখন আমরা এ কথায় বুঝাতে চাই যে ব্যাবিলনীয় ও ফেরাউনী জাতি যে সভ্যতা ও সংস্কৃতির ধারক ছিল তার বিশেষত্ব ও সারবত্তা নিঃশেষ হয়ে গেছে, তাদের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ গুণাবলীর অবসান হয়েছে। ব্যাবিলনীয়দের বংশধররা এখনো বেঁচে আছে কিন্তু তাদের জাতীয় স্বাতন্ত্র্য বিলীন হয়ে গেছে। প্রাচীন মিশরীয়দের বংশধররা এখনো অবশিষ্ট রয়েছে কিন্তু ফেরাউনী ও কিবতী সভ্যতা-সংস্কৃতি বর্তমানে সম্পূর্ণরূপে অস্তিত্বহীন । তার কারণ হচ্ছে, এই জাতির বংশধররা তাদের পরবর্তী বংশধরদের নিকট নিজেদের জাতীয় বিশেষ উত্তরাধিকারকে হারিয়ে ফেলেছিল। কোন জাতির নতুন বংশধররা যদি নিজেদের জাতীয় স্বাতন্ত্র্য ও বিশেষত্ব হারিয়ে ফেলে অতঃপর অপর কোন বিশেষত্ব গ্রহণ করে তা হলে তার অর্থ এই দাঁড়ায় যে সেই জাতি ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। ইতিহাস থেকে জানা যায়, বনী ইসরাইলীদের দশটি গোত্র বিলুপ্ত হয়ে গেছে, যাদের আজ কোন হদীস পাওয়া যায় না। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, তাদের সবাইকে হত্যা করা হয়েছে এবং এজন্য তাদের অস্তিত্ব ও বংশধারা খতম হয়ে গেছে। বরং তার অর্থ হচ্ছে তাদের মধ্য থেকে ইসরাইলী হওয়ার অনুভুতি শেষ হয়ে গেছে এবং এদের বংশধররা নিজেদেরকে ইসরাইলী বংশধর বলে মনে করছে না। ইসরাইলী বিশেষত্ব ও ইসরাইলী সভ্যতা সংস্কৃতির পার্থক্যপূর্ণ গুণাবলী হারিয়ে ফেলার পর তারা দুনিয়ার অপরাপর জাতিসমূহের মধ্যে মিলে একাকার হয়ে গেছে। তারা যে ইসরাইলী একথা তাদের বংশধররা আজ জানেই না। এই দৃষ্টিতে বলা যায় যে, একটি জাতির টিকে থাকা সম্পূর্ণরূপে নির্ভর করে জাতির পরবর্তী বংশধরদের নিজেদের জাতীয় স্বাতন্ত্র্য ও বিশেষত্বকে টিকিয়ে রাখার মত যোগ্যতা সম্পন্ন করে গড়ে তোলার উপর। এখানে আমি এ বিষয়টির গুরুত্ব আপনাদের নিকট বিশ্লেষণ করতে চাই।
- সভ্যতার উত্তরাধিকার হস্তান্তরকরণঃ
মুসলিম দুনিয়া নামে পরিচিত বিশাল ভৌগোলিক এলাকাসমূহ আমাদের পূর্বপুরুষরা কেবলমাত্র ইসলামী সভ্যতা ও আমরা যে জীবন ব্যবস্থার দাবীদার তার প্রতিষ্ঠা করার এবং যে সমস্ত আইন বিধান ও জীবন যাত্রাপ্রণালীকে আমরা নির্ভুল বলে বিশ্বাস করি তা কায়েম করার জন্যেই অর্জন করেছিলেন। অপরাপর জাতিগুলোর মত মুসলিম উম্মাহর স্থিতির জন্য ইসলামের নামে পরিচিত সভ্যতা, সংস্কৃতি ও জীবন যাত্রা প্রণালীর যে উত্তরাধিকার আমরা আমাদের পূর্ব পুরুষদের নিকট থেকে লাভ করেছি এবং যার দরুন আমরা অন্য জাতি থেকে এই মুসলিম নামক ভিন্ন জাতি হওয়ার গৌরব অর্জন করেছি তা যথাযথভাবে ভবিষ্যত বংশধরদের পর্যন্ত পৌঁছাতে হবে। পরবর্তী বংশধররাও একই রঙে রঙিন হয়ে উঠবে এবং তাদেরও আমরা সেই নীতি ও আদর্শে গড়ে তুলবো যাতে করে মুসলিম জাতি টিকে থাকতে পারে। ব্যক্তি হিসাবে কোন মুসলমান চিরঞ্জীব নয় কিন্তু মিল্লাত হিসাবে মুসলিমরা চিরঞ্জীব থাকতে পারে। এ জন্যে শর্ত হচ্ছে তাদের এমনভাবে গড়ে তোলা, যেন তারা সভ্যতার এ উত্তরাধিকারকে হস্তান্তরিত করতে পারে এবং বংশানুক্রমিকভাবে হস্তান্তরের এই ধারা অব্যাহত গতিতে চলতে থাকে । পার্থক্য সৃষ্টিকারী এই বৈশিষ্ট্যসমূহ যদি আমরা অক্ষুন্ন রাখতে সক্ষম না হই এবং আমাদের পরবর্তী বংশধররা যদি বিদেশী ও বিজাতীয় সভ্যতা সংস্কৃতির অনুসারী হয়ে গড়ে উঠে তাহলে ভবিষ্যতে মুসলিম জাতির অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়ে যাবে। তখন এই মুসলিম জাহান সেই নামেই অভিহিত হতে থাকবে যে আদর্শে তা গড়ে উঠবে। তখন আমাদের ঔরসজাত বংশধররা অবশ্য বেঁচে থাকবে কিন্তু আমাদের আদর্শিক উত্তরাধিকার শেষ হয়ে যাবে । যে উদ্দেশ্যে মুসলিম জাহান সৃষ্টি হয়েছিল, ইসলামী সভ্যতা সংস্কৃতির অনুপস্থির কারণে তার নাম চিহ্ন কোথায়ও অবশিষ্ট থাকবে না বরং তখন তা ভিন্নতর এক সভ্যতা সংস্কৃতির লীলাভূমিতে পরিণত হবে। যার ফলে আমাদের জাতীয় স্বাতন্ত্র্যের বিলুপ্তি ঘটবে । এখন এই আলোচনা থেকে আপনারা অনুধাবন করতে পারেন যে, প্রকৃতপক্ষে ছাত্রদের সমস্যা কী এবং তা কতবেশী গুরুত্বপূর্ণ। এটা শুধু শিক্ষা সমস্যাই নয় বরং এ হচ্ছে আমাদের জাতীয় অস্তিত্ব ও স্থিতির সমস্যা। মুসলিম উম্মাহ হিসাবে আমরা কেবল এ ভাবেই বেঁচে থাকতে পারি যদি আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে পাঠরত ও গড়ে ওঠা তরুণ বংশধররা ইসলামী সভ্যতার ধারক ও বাহক হয়ে বসবাস করতে পারে।
- উত্তরাধিকার হস্তান্তর করার দুটি পদ্ধতিঃ-
এ লক্ষ্য অর্জনের দুটি মাত্র পথ আছে। একটি হচ্ছে ছাত্রসমাজ। নিজেরাই সেজন্য চেষ্টা চালাবে। আর দ্বিতীয় পদ্ধতি হচ্ছে, সরকার এই অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌছাতে সহায়ক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা চালু করবেন। এখন আমি এই দুটি পদ্ধতি সম্পর্কে পৃথকভাবে আলোচনা করবো।
- ছাত্রদের অবলম্বনযোগ্য পদ্ধতিঃ
আল্লাহর মেহেরবানীতে আমাদের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে অধ্যয়নরত ছাত্ররা সচেতন, বোধশক্তি সম্পন্ন এবং নিজেদের ভালমন্দ পার্থক্য করার যোগ্যতা সম্পন্ন । তারা যতটুকু জ্ঞানই লাভ করেছেন তার সাহায্যে তারা অন্তত নিজেদের জানতে চাইলে জানতে পারেন এবং নিজেদের কল্যাণের পথ খুঁজে নিতে পারেন। এইজন্য সমস্ত দায়-দায়িত্ব কেবলমাত্র সরকারের উপরই বর্তায় না বরং তা ছাত্রদের প্রচেষ্টার উপরও অনেকখানি নির্ভর করে। আমাদের তরুণ শিক্ষার্থীদের এ কথা গুরুত্ব সহকারে অনুভব করতে হবে যে, তারা মুসলমান এবং এই ভূমিতে তাদেরকে মুসলিম হিসেবেই টিকে থাকতে হবে। মুসলিম উম্মাহর স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যাবলী অর্জন ও সংরক্ষণের প্রতি তাদের নিজেদের মধ্যেই এমন প্রেরণা ও আগ্রহ সৃষ্টি হওয়া দরকার, যা হারিয়ে গেলে মুসলিম উম্মাহর স্বাতন্ত্র্য থাকতে পারে না।
- ইসলামের মৌলিক বিশ্বাসঃ
ইসলামের মৌলিক বিশ্বাস হচ্ছে তাওহীদ, রিসালাত ও আখেরাত। প্রত্যেকেরই এ কথা ভাল করে অনুধাবন করা উচিত যে এই তিনটি কিংবা এর কোন একটির ব্যাপারেও সন্দেহ জন্মালে ইসলামী সভ্যতা ও সংস্কৃতি অনুযায়ী জীবন যাপন করা সম্ভব হতে পারে না। এই বিষয়ে সন্দেহ উদ্রেককারী প্রত্যেকটি জিনিসই ইসলামী সভ্যতার ভিত্তি বিনষ্টকারী। ইসলামী সভ্যতা সংস্কৃতি অবশিষ্ট না থাকলে কোন মুসলিম দেশ টিকে থাকতে পারে না এবং ইসলামী সভ্যতা সংস্কৃতিও অবশিষ্ট থাকতে পারে না যদি না এর মধ্যে তাওহীদ, রিসালাত এবং আখেরাতের বুনিয়াদী ধারণা বিদ্যমান থাকে।
- এই বিশ্বাসসমূহের সংরক্ষণ অপরিহার্যঃ
বর্তমানে আমাদের সবচেয়ে বেশী যেদিকে গুরুত্ব দেওয়ার দরকার তা হচ্ছে আমাদের ইসলামের অনুভূতি সম্পন্ন সচেতন যুবকরা তাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে নাস্তিকতা, খোদা বিমুখতা ও সংশয় সৃষ্টিকারী যেকোন আন্দোলনকে প্রতিহত করবে এবং এর বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিরোধ গলে তুলবে। তারা ইসলামের মৌল আকিদা বিশ্বাস পরিপন্থী আন্দোলনকে দানা বেধে উঠার অবকাশ দিবে না। মুসলিম বিশ্বের স্থায়িত্ব ও মুসলিম মিল্লাতকে বাঁচিয়ে রাখার স্বার্থে সম্ভাব্য যে কোন উপায়ে এ জাতীয় আন্দোলের মোকাবিলা করা অত্যাবশ্যক। যদি এই তিনটি মৌল বিশ্বাস সম্পর্কে কেউ সন্দেহ সংশয়ের সৃষ্টি করে তা হলে সে একটি কুফরী কাজই করছে না প্রকৃতপক্ষে সে মুসলিম মিল্লাতের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করছে এবং সে মুসলিম জাহানেরই শিকড় কাটার ষড়যন্ত্র করছে। এই অনুভূতিকে খুব গভীরভাবে অন্তরে গেথে নিতে হবে। এ যাবত এ ব্যাপারে ত্রুটিবিচ্যুতি যাই হয়ে থাকুক না কেন ভবিষ্যতে যাতে এর আর পুনরাবৃত্তি না হয় এ ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। আমাদের দেশের কোন কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় এবং মাদ্রাসায় যাতে নাস্তিক্যবাদী মতাদর্শ প্রচারিত হতে না পারে এবং ইসলামের মৌল আকীদা বিশ্বাসে সংশয় সৃষ্টিকারী কোন দর্শন গজাতে না পারে সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে।
- ইসলামী নৈতিকতা ও সভ্যতা সংস্কৃতি আকড়ে ধরাঃ
আমাদের ছাত্রসমাজের দৃষ্টি দ্বিতীয় যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টির প্রতি আকৃষ্ট হওয়া দরকার তা হচ্ছে আমাদের জাতীয় সত্তার স্থিতি যেমন ইসলামের মৌলিক বিশ্বাসের উপর নির্ভরশীল অনুরূপভাবে তার নির্ভরতা ইসলামী নৈতিকতা ও আখলাকের উপরও। বস্তুত বিশ্বাস ও নৈতিকতার মধ্যে একটি গভীর সম্পর্ক রয়েছে। একটি অপরটির জন্য অপরিহার্য। ইসলামী বিশ্বাসবোধ-ই আমাদেরকে নৈতিক চরিত্র সম্পন্ন হতে বাধ্য করে। আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে দীর্ঘদিন ধরে নৈতিক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ব্যাপারে দারুণ উদাসীনতা ও গাফিলতি প্রদর্শন করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, ইসলামী ধ্যান ধারণা ও তার সমগ্র নৈতিক মতাদর্শের পরিপন্থী এক ধরনের মতাদর্শ লালন ও উৎকৃষ্ট সাধন এখানে শুরু হচ্ছে। আমাদেরকে এ কথা খুব ভালভাবেই বুঝতে হবে যে পাশ্চাত্য জাতিসমূহ যেসব চারিত্রিক বিশেষত্ব নিয়ে উন্নত হতে পারে আমরা সেই নৈতিকতাকে ভিত্তি করে উন্নতির দিকে অগ্রসর হতে পারি না। ইসলামী নৈতিকতাই হতে পারে আমাদের উত্থান ও উন্নতির একমাত্র অবলম্বন। পাশ্চাত্য দেশের মানুষ নৃত্য গীত, মদ্যপান ও ব্যাভিচারে লিপ্ত হয়েও নিজেদের দেশ ও রাষ্ট্রের জন্য ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত হতে পারে । কেননা যেসব জড়বাদী দর্শনের উপর তাদের নৈতিকতা গড়ে উঠেছে এসব আচরণ তার সাথে সাংঘর্ষিক নয়। কিন্তু মুসলিমগণ খুব ভাল করেই জানেন যে, এসব জিনিসকে আল্লাহ ও তাঁর রসূল (স) হারাম করে দিয়েছেন। তারা যদি সে সংস্কৃতিকেই গ্রহণ ও পাশ্চাত্য জীবনধারা অবলম্বন করে তা হলে প্রকৃতপক্ষে তারা ইসলামের মূল শিক্ষাকে পরিত্যাগ করেই তা করে থাকে। পাশ্চাত্যের এক ব্যক্তি এসব করে স্বীয় নৈতিক বিধানসমূহ লংঘন করে না। কিন্তু সে সংস্কৃতি গ্রহণ করলে আমরা সেই সব মৌলনীতিসমূহই লংঘন করে বসি যার উপর আমাদের নৈতিকতার ভিত্তি সংস্থাপিত। একজন মুসলমান মদ্যপান ও একজন পাশ্চাত্য দেশীয়ের মদ্যপানে অনেক পার্থক্য যদিও মদের দৈহিক ও মনস্তাত্ত্বিক ক্ষতি সব মানুষের জন্যেই সমান, সেই ব্যক্তি মুসলিম হোক কিংবা অমুসলিম। কিন্তু কাফের ব্যক্তির জীবনাদর্শে মদ্যপান হারাম নয় বলে সে যখন তা পান করে তখন সে একটা ক্ষতিকর পানীয়ই ব্যবহার করে মাত্র। তার বিশ্বাসের উপর সে পদাঘাত করে না। কিন্তু একজন মুসলিমের ব্যাপার সম্পূর্ণ ভিন্নতর। সে কোন হারাম কাজ করতে ততক্ষণ পর্যন্ত উদ্ধত হতে পারে না যতক্ষণ পর্যন্ত না খোদা ও রাসূলের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ও পরকাল সম্পর্কে বেপরোয়া ভাবধারা তার মনে প্রবল হয়ে উঠে। অতপর সে শুধু একটা হারাম কাজ করেই ক্ষান্ত থাকে না, সমস্ত হারাম কাজ করতে এবং নৈতিকতার সমস্ত সীমা লংঘন করতে উদ্ধত হয়ে উঠে। তার নিকট কোন কিছুই এমন পবিত্র থাকে না যা বিনষ্ট করা থেকে সে বিরত থাকবে।
- ইসলামী সমাজে ইসলাম বিরোধী সংস্কৃতির ক্ষতিঃ
এ আলোচনা থেকে স্পষ্ট হয়ে উঠে যে, একটি মুসলিম সমাজে ইসলাম বিরোধী সংস্কৃতি প্রচলিত হয়ে পড়লে তার ক্ষতি একটি অমুসলিম সমাজে তার প্রচলিত হওয়ার ক্ষতির তুলনায় অনেক অনেক গুণ বেশী। অমুসলিম ব্যক্তির উপর সে সংস্কৃতির খারাপ প্রভাব ঠিক ততটুকুই পড়ে যতটা একটা জাতি কিংবা একজন ব্যক্তির উপর প্রতিটি খারাপ জিনিসের প্রভাব পড়তে পারে। কিন্তু আমরা মুসলমানরা যদি কোন ফাসেকী সভ্যতা গ্রহণ করি তাহলে এর সাথে আমাদের ঈমানও ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং এর ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়ে। তখন আমাদের মধ্যে খোদা ও রাসূলের আনুগত্যের পরিবর্তে বিদ্রোহের ভাব সৃষ্টি হয়। এই বিদ্রোহ সৃষ্টি হওয়ার পর দুনিয়াতে কারোর প্রতি প্রতিশ্রুতি পূরণ এবং কোন নিয়ম শৃংখলার অনুসরণ করা অসম্ভব হয়ে উঠে। কেননা যার প্রতি প্রতিশ্রুতি পালন ও আনুগত্য করা আমাদের উপর সর্বাধিক কর্তব্য ছিল তার প্রতি আমরা পূর্বেই বিদ্রোহ করে বসেছি। এই কারণে একজন মুসলিম যখন ইসলামের কোন বিধান লংঘন করে তখন একটি নাফরমানি করে সে ক্ষান্ত থাকে না বরং একটির পর একটি নাফরমানি করতেই থাকে। এমনকি শেষ পর্যন্ত তার মধ্যে কর্তব্যজ্ঞান বলতে কিছু অবশিষ্ট থাকে না এবং সে কোন আইনের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে না। তার নৈতিক অধঃপতন কোনো সীমায় পৌছে থেমে যায় না। আপনারা একটু চিন্তা করে দেখুন, একজন মুসলিম যখন আল্লাহকে আল্লাহ, তার রাসূলকে রাসূল এবং কোরআনকে আল্লাহর কিতাব বলে বিশ্বাস করা সত্ত্বেও এমন কাজ করে যে কাজ সম্পর্কে সে জানে যে তা করতে আল্লাহ নিষেধ করেছেন, কোরআন তাকে হারাম ঘোষণা করেছে এবং পরকালে আজাবের ভয় দেখিয়েছে তখন কোন জিনিস তাকে নৈতিক মূল্যবোধের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতে বাধ্য করতে পারে? কোন আইন পরিষদ তাকে আইনের প্রতি সে আনুগত্য থাকতে পারে যাকে সে খোদা বলে মানতে পারে না? কোন জাতি কিংবা কোন দেশের জন্য সে স্বীয় সত্তা ও কামনা বাসনাকে কিভাবে ত্যাগ করতে পারে, যার কোনটিকে সে মাবুদ মনে করে না? কেননা তার মধ্যে তো সবার্ধিক পবিত্র জিনিসগুলোর প্রতিও অশ্রদ্ধা ও অসম্মানের ভাব সৃষ্টি হয়েছে। তার মধ্যে আইন লংঘন করার মারাত্মক রোগ সৃষ্টি হয়েছে। আর তার ঈমানের দিক দিয়ে সর্বোচ্চ আইনকেই সে লংঘন করে বসেছে। এই আইন লংঘনকার্য কোনো সীমায় পৌছে ক্ষান্ত হবে না । উপরন্তু সে আইন লংঘনের একটা স্থায়ী রোগে আক্রান্ত হতে থাকবে। অতপর সে কোন আইনের অনুগত থাকবে বলে আশা করা যায় না। এইরূপ ব্যক্তি কোন সাধারণ সভ্য সমাজের সদস্য হবারই যোগ্য নয়, মুসলিম সমাজের সদস্য হওয়া তো অনেক দূরের কথা।
- মুসলিম ছাত্রদের মধ্যে অনৈসলামী সভ্যতা সংস্কৃতির প্রভাব; একটি ভয়াবহ সংকটঃ
এ বিষয়টিকে যথার্থভাবে অনুধাবন করা হলে সহজেই বুঝতে পারা যাবে যে যারা আমাদের বিদ্যালয়সমূহে আমাদের ছাত্র সমাজকে চরিত্রহীন বানাচ্ছে, ইসলাম পরিপন্থী সংস্কৃতির প্রচলন ঘটাচ্ছে ও ইসলামী নৈতিকতার বন্ধন চূর্ণ করার ব্যাধি ছড়াচ্ছে তারা কত বড় অপরাধ ও দেশের কত মারাত্মক অকল্যাণই না সংঘটিত করে চলেছে! আমাদের তরুণ ছাত্রসমাজকে স্বয়ং এর ক্ষতি অনুধাবন করতে হবে। আমাদের রাষ্ট্র পরিচালকেরা যদি অজ্ঞতাবশত এ ভুল করে, এমতাবস্থায় আমাদের ছাত্র সমাজেরই কর্তব্য নিজেদেরকে যথাসম্ভব এ ক্ষতি থেকে রক্ষা করা। নিজেদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে এ জন্যে একটা সাধারণ জনমত গড়ে তোলা কর্তব্য যেন ছাত্ররা নিজেরাই এই ভ্রান্ত সভ্যতা সংস্কৃতি গ্রহণ না করে এবং সমাজে ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে এর প্রচলন হতে দেয়। বস্তুত ছাত্রদের মধ্যেই যদি এই সাধারণ জনমত সৃষ্টি হয় এবং তারা নিজেরাই এর বিরোধী হয়ে উঠে তবে জোর করে এর প্রচলন করার সাধ্য কার আছে? এটা পরিষ্কার যে পুলিশের সাহায্যে তো আর ছাত্রদেরকে এ ধরনের কাজে অংশগ্রহণ করতে বাধ্য করা যায় না এবং আইন করেও অনৈসলামী সভ্যতা সংস্কৃতি অবলম্বনে বাধ্য করা যেতে পারে না। এ জন্যে সাধারণত প্ররোচনা-প্রোপাগাণ্ডা চালানো হয় এবং তাদের অভ্যাস ও চরিত্র বিকৃত করার চেষ্টা করা হয়। তাদেরকে একটা রোগে আক্রান্ত করা হচ্ছে বলে যদি ছাত্ররা মনে করে তাহলে তারা নিজেরাই এর থেকে বাঁচার চেষ্টা করতে পারে এবং নিজেদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে এ জাতীয় অকল্যাণের প্রসার রোধ করতে পারে। ছাত্রদের মধ্যে এই জনমত সৃষ্টির প্রচলন চলুক এটাই আমার কামনা।
উপরে বর্ণিত কাজ দুটি সম্পর্কে আমার বিশ্বাস যে ছাত্ররা নিজেরাই এই কর্তব্য পালন করতে পারে। তারা যদি এই কাজ দুটি করতে পারে তাহলে আমাদের শিক্ষালয়সমূহে বর্তমানে প্রচলিত দোষ ত্রুটিসমূহ দূর করতে সক্ষম হবে। সেই সংঙ্গে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় কৃত ত্রুটির কারণে ইসলাম সম্পর্কে জ্ঞান লাভের দিক দিয়ে যে অসম্পূর্ণতা রয়ে গেছে তার প্রতিবিধানে ছাত্রসমাজকে সচেষ্ট ও মনোযোগী হতে হবে। এ পর্যায়ে সরকারের করণীয় সম্পর্কে আমি পরে আলোচনা করবো। মনে করুন সরকার এ দিকে কোন লক্ষ্য দিচ্ছে না। তাই বলে ইসলাম সম্পর্কে জ্ঞানার্জনের যে দায়িত্ব ব্যক্তিগতভাবে আপনার উপর বর্তে তা থেকে আপনি নিষ্কৃতি পেতে পারেন না। প্রত্যেক প্রাপ্ত বয়স্ক মুসলিমেরই, যার চেতনা রয়েছে, যে নিজ ইচ্ছামত কাজ করার যোগ্যতা অর্জন করেছে – তার কর্তব্য হচ্ছে, যে ইসলামের সে প্রবক্তা ও যে ইসলামের কারণে সে নিজেকে মুসলিম বলে পরিচয় দিচ্ছে, তা যথার্থভাবে জানার জন্য সে চেষ্টা চালাবে। ইসলামের সার নির্যাস তো অতি সহজেই এবং সামান্য চেষ্টার ফলেই মানুষ অর্জন করতে পারে। আপনার মাতৃভাষায় ইসলাম সম্পর্কে যে সব বই পত্র পাওয়া যায় প্রথমে তা পড়ুন এবং কমপক্ষে এতটুকু জ্ঞান অর্জন করুন যে মুসলমান ও কাফেরের মধ্যে পার্থক্য কী, কোন মৌলিক জিনিসের কারণে একজন কাফের মুসলমান হয়, একজন মুসলমানকে কোন সব বিষয়ের উপর ঈমান আনতে হয়, মুসলিম হিসাবে দায়িত্ব ও কর্তব্য কি কি, কোন কোন জিনিস বা কাজ মুসলমানের জন্যে হারাম, তার জন্য অবশ্য পালনীয় নৈতিকতার মূল নীতি কি কি, দৈনন্দিন জীবন যাপনের জন্য ইসলামে কি পন্থা নির্ধারণ করেছে যা একজন মুসলমানের জন্য অবশ্য পালনীয়। এটা এমন দুরূহ ব্যাপার নয় যার জন্য আপনাকে কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গিয়ে বছরের পর বছর দ্বীনি শিক্ষা অর্জন করতে হবে। সামান্য মনোযোগ ও সামান্য প্রচেষ্টার ফলে আমাদের যুবকেরা ইসলাম সম্পর্কে এতটুকু জ্ঞান অর্জন করতে পারে, উপরন্ত বিভিন্ন ভাষায় এর পর্যাপ্ত উপকরণ মওজুদ রয়েছে। আমি কামনা করি যে আমাদের প্রত্যেক যুবক এই জ্ঞানের প্রয়োজন অনুভব করে তা অর্জনের জন্য চেষ্টা করে, এই গুণ আপনার পরীক্ষায় পাস কিংবা ডিগ্রী অর্জনের জন্য নয় বরং মুসলমান হবার স্বার্থেই প্রয়োজন।
- মুসলিম দেশের সরকারসমূহের প্রথম কর্তব্যঃ-
আমাদের সরকারকে চিন্তা করতে হবে সমাজে যে এতটা ব্যাপক দুর্নীতি ও অনাচার পুঞ্জীভূত হয়ে উঠেছে তার কারণ কী? এমন কি কারণ রয়েছে যার ফলে যাবতীয় প্রচেষ্টা, আইন-কানুন, দুর্নীতি দমন বিভাগ থাকা সত্ত্বেও দুর্নীতি কমার পরিবর্তে বেড়েই চলেছে। দুর্নীতি আমাদের গোটা আইন ব্যবস্থাকে ব্যর্থ করে দিয়েছে। দুর্নীতি সংশোধনের নিমিত্ত যত আইনই রচনা করা হয় তা শুধু আইন প্রয়োগকারীদের দুর্নীতির কারণে নিস্ফল হয়ে পড়ে। শুধু তাই নয়, আইনের প্রত্যেকটি কড়াকড়ি দুর্নীতির নুতন দ্বার উন্মুক্ত করে দেয়। এই ব্যাপারটি শুধু এতটুকু ক্ষতি সাধন করেই ক্ষান্ত থাকে না। এই দুর্নীতির কারণেই আমাদের উৎপাদিত হাজার হাজার টন খাদ্যশস্য আমাদের দুশমনদের হাতে চলে যায়। আমাদের দেশের বুভুক্ষ জনতার জন্য সাহায্য স্বরূপ বিদেশ থেকে আসা হাজার হাজার বস্তা খাদ্যশস্য বিদেশের খোলা বাজারে বিক্রি কতে দেখা গেছে। এভাবে দুর্নীতি শত্রুদেরকে আমাদের খরচেই প্রতিপালিত করছে। আরো অগ্রসর হয়ে ভেবে দেখুন তাহলে সহজেই বুঝতে পারবেন যে কেউ যদি দেশের নিজ ভাই থেকে একশত টাকা নিয়ে বেঈমানী করতে পারে, তাহলে সে দুশমন থেকে দশ হাজার টাকার বিনিময়ে তাদের নিকট আমাদের গোপন তথ্য কেন বিক্রি করতে পারবে না? যখন কোন জাতির মধ্যে গোপন তথ্য বিক্রি ও অনাচারের মহামারী ছড়িয়ে পড়ে, আর হাজার হাজার লোক যদি ব্যক্তিগত স্বার্থ উদ্ধারের জন্য জাতি, দেশ, দ্বীন ও ঈমান বিসর্জন দিয়ে দেয় তাহলে নিজেদের দেশের স্বার্থান্বেষী লোকেরা যেমন স্বার্থের বিনিময়ে এই সব লোকদের ব্যবহার করতে পারে, অনুরূপভাবে বাইরের শত্রু পক্ষও তাদেরকে ব্যবহার করতে পারে।
- বিশ্বাসভঙ্গ ও দুর্নীতি এত ব্যাপক কেন?ঃ
এখানে গভীরভাবে বিবেচনা করা দরকার এই দুর্নীতির মূল উৎস কোথায়? এটা পরিষ্কার যে আমাদের দেশে দুর্নীতি, ঘুষখোরী ও বিশ্বাসভঙ্গ যা সংঘটিত হচ্ছে তাতো করছে আমাদের দেশের শিক্ষিত লোকেরাই। কেননা দেশের গোটা রাষ্ট্রযন্ত্র ও অর্থ ব্যবস্থা পরিচালনা করছে এই শিক্ষিত লোকেরাই। দেশের অশিক্ষিত লোকেরা তো আর তা পরিচালনা করছে না। এই শিক্ষিত লোকেরা তো দেশের ঐ সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকেই শিক্ষিত হয়ে বেরিয়ে এসেছেন। এ থেকে অকাট্যভাবে প্রমাণিত হয় যে, আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যেই এমন সব ত্রুটি রয়েছে যা এত বিপুল সংখ্যক দুর্নীতিপরায়ণ ব্যক্তি তৈরী করে ছেড়ে দিচ্ছে। পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় যে সমস্ত ক্রটি রয়েছে তন্মধ্যে সবচাইতে মৌলিক ত্রুটি হচ্ছে, আমাদের সভ্যতা সংস্কৃতি ও আমাদের নৈতিকতা যেসব মৌলনীতি ও বিশ্বাসের উপর সংস্থাপিত, আমাদের জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থা তাকে শক্তিশালী করার পরিবর্তে ক্রমাগত দুর্বল করে দিচ্ছে। অথচ নিজেদের বিশ্বাসের বুনিয়াদ দুর্বল করা ব্যতীত এ শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্য থেকে বেরিয়ে এসেছেন এমন লোকের সংখ্যা খুবই নগণ্য। চিন্তা করার বিষয় আমাদের শিক্ষিত লোকদের অধিকাংশেরই যদি ইসলাম উপস্থাপিত মৌলিক বিশ্বাসসমূহে সন্দেহ সৃষ্টি হয়, তাহলে এমন কোন প্রতিষেধক দিয়ে তাদেরকে নৈতিক বিধানের উপর টিকিয়ে রাখা যাবে? খোদার ভয় ও আখেরাতে জবাবদিহীর অনুভূতি যাকে বিরত রাখতে পারে না, তাকে দুর্নীতিবাজ, বিশ্বাসঘাতক ও দায়িত্বজ্ঞানহীন হওয়া থেকে কোন জিনিস বাধা দিতে পারে? যে ব্যক্তির ভেতর নিজের উর্ধ্বের কোন শক্তির আনুগত্য করার মানসিকতা নেই সে কি করে তার ব্যক্তি স্বার্থ বিসর্জন দিতে পারে? এ জন্যে কোন না কোন উচ্চতর শক্তির আনুগত্য ও তার ভয় থাকা একান্তই অপরিহার্য। মুসলিম ব্যক্তি প্রধানত কেবলমাত্র আল্লাহ, রাসূল ও মুসলিম মিল্লাতের প্রতিই ঐকান্তিক ও নিষ্ঠা সম্পন্ন হতে পারে। এই আনুগত্যটিকে দুর্বল করে দিলে নিঃসন্দেহে লোকদের মধ্যে স্বার্থপরতা ও ব্যক্তিকেন্দ্রিকতাই প্রবল হয়ে দেখা দেবে এবং সে নিজ স্বার্থ ও প্রবৃত্তির লোভে যে কোন জিনিসকে বিসর্জন দিতে কুণ্ঠা বোধ করবে না।
- জাতীয় সংশোধনে ইসলামী আদর্শই কার্যকর নীতিঃ-
কেবলমাত্র আল্লাহর আনুগত্যকে মজবুত করার মাধ্যমে সত্য, ন্যায় ও সততার উপর দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত থাকার যোগ্যতা সৃষ্টি করা যেতে পারে। কেবল খোদার ভয় ও পরকালের জবাবদিহির অনুভূতি তীব্র হলেই মানুষ অবৈধ কাজ করা থেকে বিরত থাকতে পারে, যদিও সে কাজের ফলে এই দুনিয়ায় তাকে ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে বলে মনে হয় না। আর শুধু খোদা ও দ্বীন ইসলামের প্রতি ঐকান্তিক আনুগত্য থাকলেই মানুষ এমন সব বড় ত্যাগ স্বীকার করতে পারে যার দরুন বাহ্যত সে তার ব্যক্তিগত স্বার্থ ধ্বংস করছে বলে মনে হবে। দুনিয়ার অন্যান্য জাতির জন্য তাদের আনুগত্য ও নৈতিক মূল্যমান ভিন্নতর। তারই উপর তাদের নৈতিকতার প্রাসাদ নির্মিত হয়েছে। এই আনুগত্য ও মূল্যমান যদি মুসলমানদের মধ্যে করতে চান তাহলে পঞ্চাশ বছর ধরে এই জাতিকে অনুশাসনের মধ্যে আনার প্রচেষ্টা চালাতে হবে এবং কমপক্ষে আরো অর্ধ শতাব্দীর প্রচেষ্টায় তাদের ভেতর খাটি বিজাতীয় চরিত্র সৃষ্টি করা যাবে কিন্তু শর্ত হচ্ছে সে পর্যন্ত যদি দেশটি টিকে থাকে। কিন্তু ইসলামের ভিত্তিতে লোকদের চরিত্র গঠনের কাজ আপনি আজই শুরু করতে পারেন এবং মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই এর সুফল লাভ করতে পারেন। আল্লাহ, রসূল ও পরকালে বিশ্বাস তো মুসলিম যুবকেরা জন্মগত সূত্রেই লাভ করে। মুসলিম সমাজের সামগ্রিক পরিবেশ ও মুসলমানদের জাতীয় ঐতিহ্যের মধ্যেই এ বিশ্বাস বিদ্যমান রয়েছে। প্রথম থেকে এই জমিনে বিশ্বাস ও নৈতিক ভিত্তির যে শিকড় গেঁথে আছে এতে সামান্য পানি সিঞ্চন দ্বারাই তা সঞ্জীবিত হয়ে উঠতে পারে ও ফলদান করতে পারে। আমাদের সভ্যতা-সংস্কৃতি ও চরিত্রের প্রতি ইংরেজদের কোন আগ্রহ ছিল না। পক্ষান্তরে আমাদের মুসলিম হওয়াটাকে তারা ভীতির চোখে দেখতো, এই কারণে তারা এখানে এমন এক শিক্ষা-ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছিল যার প্রভাবে আমাদের ঈমান দুর্বল হয়ে পড়েছে, কমপক্ষে আমাদের বিশ্বাসে সন্দেহ-সংশয় সৃষ্টি করেছে এবং নিজেদের চোখেই আমাদেরকে ইসলাম থেকে যতটুকু সম্ভব দূরে সরিয়ে নেওয়াই ছিল তাদের রাজনৈতিক স্বার্থের দাবী । অতপর একটি স্বাধীন স্বার্বভৌম রাষ্ট্র অর্জিত হবার পরও যদি আমাদের শিক্ষা-ব্যবস্থা পূর্বানুরূপ থাকে তাহলে তার অর্থ হবে আমরা নিজেরাই আত্মহত্যা করছি। সত্যিই কি আমরা আত্মহত্যা করতে প্রস্তুত?
- ইসলামের প্রতি সংশয় সৃষ্টিকারী শিক্ষকরা বিশ্বাসঘাতকঃ-
আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে আজকাল এমন সব শিক্ষক রয়েছ যারা দিন-রাত শিক্ষার্থীদের মনে সন্দেই সংশয় সৃষ্টি করে চলেছেন। তারা প্রতিনিয়ত ছাত্রদের মনে এই বিশ্বাস বদ্ধমূল করার চেষ্টা করছেন যে, “ইসলামের কোন সভ্যতা-সংস্কৃতি নেই, ইসলামের কোন স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য বা জাতীয় বিশেষত্ব নেই, ইসলামের রাজনৈতিক ব্যবস্থা নেই এবং ইসলামের অর্থনীতি যদি কিছু থেকেও থাকে তাও এযুগে অচল । ইসলামের আইন-কানুন সেই বর্বর যুগের উপযোগী, তা আজকের উন্নত যুগে চলতে পারে না। ইতিহাসে মুসলমানদের কোন গৌরবোজ্জ্বল অবদান নেই। দুনিয়ায় আগত ‘হিরো’দের সবাই অমুসলিম ছিলেন। জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে যুগান্তকারী সকলেই ছিলেন অমুসলিম।ঃ আমি স্পষ্ট বলতে চাই, আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে যে সমস্ত শিক্ষক আমাদের তরুণদেরকে এ ধরনের সবক দিচ্ছেন এবং তাদের মগজে এসব ভ্রান্ত চিন্তা বদ্ধমূল করে দিচ্ছেন-তাদের তুলনায় মুসলিম বিশ্বে বড় বিশ্বাসঘাতক দ্বিতীয় আর কেউ নেই। তারা আসলে আমাদের মূলে কুঠারাঘাত হানছেন। সেই জাতির কতই না দুর্ভাগ্য যাদের ভবিষ্যত বংশধররা এ ধরনের শিক্ষকদের নিকট শিক্ষা লাভ করছে। দুর্ভাগ্য এখানেই শেষ নয়, বহুমুসলিম দেশের উচ্চতর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে এম, এড ও সমাজতত্ত্বের (sociology) শিক্ষার গোটা বিভাগটাই হয়তো আমেরিকান নতুবা আমেরিকান প্রভাবিত (তথা পাশ্চাত্য প্রভাবিত) শিক্ষকদের উপর ছেড়ে দেয়া হয়েছে। তারা আমাদের শিক্ষা ও সমাজ সম্পর্কে আমাদের ভবিষ্যত বংশধরদের ধারণা বিকৃত করার বিরাট অভিযান চালাচ্ছে। এটাকে আত্মহত্যা ছাড়া আর কি বলা যেতে পারে?
- বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থার ত্রুটি বিচ্যুতিঃ-
বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থায় যে মৌলিক ত্রুটি বিচ্যুতি রয়েছে তা কিভাবে পূরণ করা যায় এ ব্যাপারে সরকারকে চিন্তা করতে হবে। আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে জ্ঞান-বিজ্ঞানের যেসব বিষয়ে শিক্ষা দান করা হয় এগুলোর মূল বিষয়বস্তুতে কোন ত্রুটি নেই। ত্রুটি বিচ্যুতির মূলে রয়েছে এমন সব খোদাদ্রোহী লোক যারা শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়ন করেছে। আর তা রচিতও হয়েছে এমন পদ্ধতিতে যে তা পাঠ করলে শিক্ষার্থীদের মন মানসে এক সৃষ্টিকর্তাহীন বিশ্বের চিন্তা জন্মলাভ করে। তাদের মনে বিশ্বাস জন্মে যে এই বিশ্বজগত নিজ থেকেই সৃষ্টি হয়েছে ও সর্বশক্তি বলেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলছে। তার স্রষ্টা ও পরিচালক বলে কোন খোদা নেই। দ্বিতীয়তঃ এসব জ্ঞান বিজ্ঞান প্রণয়ন ও বিরচন এই ধারণার ভিত্তিতে সম্পন্ন হয়েছে যে, মানুষ নিজেই নিজের চালক ও পথ প্রদর্শক। কোন স্রষ্টার নিকট থেকে পথ নির্দেশের কোন প্রয়োজন নেই এবং এই জাতীয় পথ নির্দেশ কোন খোদা থেকে আদতেই আসে না। বস্তুত এই দুটি ধারণা ও বিশ্বাস আমাদের সভ্যতা ও সংস্কৃতির ভিত্তি বিনষ্টকারী । আমাদেরকে এর পরিবর্তনের প্রচেষ্টা চালাতে হবে। যে জ্ঞান বিজ্ঞান প্রণয়ন ও বিরচন পদ্ধতির পরিবর্তন করে তাকে খোদাবিশ্বাসের উপর ঢালাই করতে হবে। আমাদেরকে বিজ্ঞান, দর্শন ও সমাজ বিজ্ঞানের সব শাখার জ্ঞান অর্জন করতে হবে এবং মানুষের আয়ত্তাধীন যাবতীয় জ্ঞান অর্জন করতে হবে। যদি আমরা মুসলিম হিসাবে বেঁচে থাকতে চাই তাহলে জ্ঞান বিজ্ঞানের এ সমস্ত শাখাকে ইসলামের আলোকে পুনর্বিন্যাস করতে হবে। অন্যথায় আমরা চাই বা না চাই এই শিক্ষা এর বর্তমান পদ্ধতির ত্রুটির কারণে আমাদেরকে অমুসলিম বানিয়ে ছাড়বে। বস্তুত আমাদের জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থার এটাই হচ্ছে মৌলিক সমস্যা। এটা আমরা যত দ্রুত অনুভব করব ততই আমাদের জন্য কল্যাণ।
- ইসলাম ও বিজ্ঞানঃ
অনেকে ইসলামের সাথে বিজ্ঞানের সম্পর্কের প্রশ্নে পেরেশান হয়ে পড়েন। অথচ তাদের চোখের সামনে রাশিয়ান বিজ্ঞান’ এর উদাহরণ স্পষ্ট হয়ে রয়েছে। আপনিই বলুন ইসলামের সাথে বিজ্ঞানের যদি কোন সম্পর্ক না থাকে তবে মার্কসবাদের সাথে এর সম্পর্ক কি করে থাকতে পারে? কোন কমিউনিস্টই কমিউনিস্ট সমাজের লোকদেরকে বুর্জোয়া বিজ্ঞান, বুর্জোয়া দর্শন, ইতিহাস, অর্থনীতি ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রভৃতি পড়ানোকে পছন্দ করে না। বরং তারা এই সব জ্ঞান মার্ক্সবাদের রঙে রঙিন করিয়ে পড়িয়ে থাকে। যেন সমাজে কমিউনিস্ট বিজ্ঞানী ও জ্ঞান বিজ্ঞানে কমিউনিস্ট বিশেষজ্ঞ গড়ে উঠতে পারে । বুর্জোয়া দৃষ্টিকোণ থেকে রচিত জ্ঞান বিজ্ঞান পড়িয়ে কখনো কমিউনিস্ট সমাজ গড়ে তোলা সম্ভব নয়। সত্যি কথা হচ্ছে, যে জাতির নিজস্ব সভ্যতা ও সংস্কৃতি রয়েছে, যার আছে নিজস্ব জীবন দর্শন, সে জাতি কখনই সে দর্শন বিরোধী ভিন্ন আদর্শের লোকদের প্রবর্তিত জ্ঞান বিজ্ঞানে নিজেদের। তরুণ বংশধরদেরকে শিক্ষা দান করতে পছন্দ করে না। কেননা পড়ানোর অর্থ এই দাঁড়ায় যে স্বজাতি নিজস্ব জাতীয় স্বাতন্ত্র্যকে ধ্বংস করতে এবং অন্যদের মধ্যে নিঃশেষে লীন হয়ে যেতে চায়।
- বিজ্ঞানের দুটি শাখাঃ
যদি বলা হয় যে, বিজ্ঞান সার্বজনীন ও সর্বাত্মক, কোন দ্বীন ধর্মের সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই, তবে বস্তুতপক্ষে এটা নিদারুণ একটা ভুল ছাড়া আর কিছুই নয়। মূলত বিজ্ঞানের একটা দিক হচ্ছে অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণলব্ধ বাস্তব’ (Facts) এবং আরেকটি হচ্ছে প্রাকৃতিক আইন (Natural Laws)। এ দিকটা নিঃসন্দেহে বিশ্বজনীন । কিন্তু সেই সংঙ্গে এর দ্বিতীয় দিকটা হচ্ছে, সেই মানসিকতা ও দৃষ্টিভঙ্গী যা সে সব বাস্তব’ – সত্য তত্ত্ব ও তথ্যকে সুসংবদ্ধ করে তার আলোকে মতবাদ ও মতাদর্শ (theory) গড়ে তোলে। আরও রয়েছে সে মতবাদ প্রকাশ ও বিশ্লেষণ করার ভাষা। এগুলো সাধারণ ও বিশ্বজনীন নয়। বরং এতে প্রত্যেক সভ্যতা সংস্কৃতির অনুসারীদের ভিন্নতর পদ্ধতি ও ভঙ্গি রয়েছে। এহেন ভিন্নতা ও পার্থক্য থাকা নিতান্তই স্বাভাবিক। আমরা বিজ্ঞানের এই দ্বিতীয় দিকটিতেই পরিবর্তন আনতে চাই, প্রথমটিতে নয়।
একটি উদাহরণের সাহায্যে বিষয়টিকে পরিষ্কার করা যেতে পারে। এটা একটা বৈজ্ঞানিক সত্য যে, দুনিয়ার প্রায় সব জিনিসই শীতল হয়ে সংকুচিত হয়ে যেতে থাকে। কিন্তু পানির অবস্থা এর থেকে ভিন্নতর। পানি শীতল হতে হতে যখন জমে যাওয়ার পর্যায়ে আসে তখন তা প্রসারিত হয়। ও বরফ হয়ে হালকা হয়ে যায়। এই কারণে বরফ পানির উপরিভাগে ভাসতে থাকে। এটা একটা বাস্তব সত্য (fact)। এখন একজন তো এ ব্যাপারটি বর্ণনা দেয় এ ভাষায় যে পানি নিজস্ব বিশেষত্বের কারণে এরূপ হয় এবং এটাই স্বাভাবিক নিয়ম। আর অপর একজন তা বর্ণনা দিতে গিয়ে বলে, মহান আল্লাহ তাঁর নিজস্ব বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনা ও রবুবিয়াতের অধীন পানির মধ্যে এই বিশেষত্ব এজন্য রেখেছেন যেন পুকুর, নদী ও সমুদ্রের প্রাণীগুলো বেঁচে থাকতে পারে। তিনি যদি এরূপ ব্যবস্থা না করতেন তাহলে পানি জমে জমে নীচে বসে যেত। ফলে সমস্ত নদী, সমদ, বিল ও পুকুর। বরফ হয়ে যেত এবং তাতে কোন জীব বা প্রাণী বেঁচে থাকতে পারত না । দেখুন, একই বাস্তব ঘটনাকে দুই ব্যক্তি নিজস্ব দুই ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে প্রকাশ করেছেন। ফলে দুধরনের বিশ্লেষণ ভঙ্গীর প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া লোকদের উপর ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। মূল ব্যাপারটির বর্ণনা এক পদ্ধতিতে দিলে পাঠক মাত্রেরই মনে খোদার একত্ব, তার সৃষ্টিকুশলতা এবং লালন পালনের ধারণা ও বিশ্বাস বদ্ধমূল হয়। আর অপর ধরনের বর্ণনাভঙ্গী দ্বারা এই ঘটনাটির ব্যাখ্যা দিলে কারোর মনে আল্লাহ সম্পর্কে কোন ধারণাই জাগে না। বরং লোকদের মনে এই ধারণা জেগে উঠে যে, এই সমস্ত কিছু স্বয়ংক্রিয় ও আপনা আপনানিই ঘটে থাকে। তার পশ্চাতে কোন বিজ্ঞ সৃষ্টিকর্তার মহা কৌশল ও কোন শক্তিমান প্রতিপালনকারীর প্রতিপালন ব্যবস্থার কার্যকারিতা বর্তমান নেই। এই আলোচনা থেকে আপনারা সহজেই ধারণা করতে পারেন যে, একপ্রান্তিক ভঙ্গী ও পদ্ধতিতে বিজ্ঞান পড়ানো হলে এর ফলে একজন জড়বাদী বিজ্ঞানী তৈরি হবে। এই বিজ্ঞানই যদি ভিন্ন এক ভঙ্গী ও পদ্ধতিতে শিখানো হয়, তাহলে একজন মুসলিম বিজ্ঞানী তৈরি হওয়া অবশ্যই সম্ভব।
সত্য কথা হচ্ছে, বিজ্ঞানের কোন বিভাগই এমন নেই যা মানুষের অন্তরে ঈমানকে সুদৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করে দেয় না। পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, জীববিজ্ঞান, শরীরবিদ্যা (Physiology), শবব্যবচ্ছেদ বিদ্যা (Anatomy), জ্যোতিঃশাস্ত্র (Astronomy) যে বিদ্যারই কথা বলা হোক না কেন, তার মাধ্যমে এমন সব সত্য উঘাটিত হবে, যা মানুষকে প্রকৃত ঈমানদার বানাবার জন্য যথেষ্ট। বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব ও তথ্যের তুলনায় মানুষের হৃদয় মনে অধিক ঈমান সৃষ্টিকারী দ্বিতীয় কোন উপাদান নেই। এগুলোই তো হচ্ছে ঐসব ‘আয়াত’ বা নিদর্শন যার প্রতি কোরআন মজীদ বার বার পাঠকের মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। যেহেতু, বিজ্ঞানের এসব তত্ত্ব ও তথ্য খোদাদ্রোহী বিজ্ঞানীরা নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গীর আলোকে সুসংবদ্ধ ও সুবিন্যস্ত করেছে এবং বিশ্লেষণ করেছে সেই কারণেই এসব পাঠ করে মানুষ উল্টো জড়বাদী ও নাস্তিক হয়ে যায়। আমি কামনা করি যে, আমাদের সরকারসমূহ এই পার্থক্যটা অনুধাবন করুন এবং এই ব্যাপারে নিগূঢ় রহস্য উদঘাটন করার জন্য চেষ্টা করুন। বলাবাহুল্য, আমরা খোদাহীন বিজ্ঞান, খোদাহীন দর্শন ও সমাজ বি জ্ঞানসমূহ শিক্ষা দিয়ে খোদানুগত মানুষ বানাতে পারবো না। মুসলিম উম্মাহ হিসেবে যদি আমাদের বেঁচে থাকতে হয়, তাহলে অতিশীঘ্র এমন একটি প্রতিষ্ঠান গঠন করা আবশ্যক যা জ্ঞান-বিজ্ঞানের সমস্ত শাখার বর্তমান বিন্যাসের পরিবর্তন সাধন করবে এবং উপরোক্ত সমস্ত বিষয়ের উপর ইসলামী দৃষ্টিকোণের আলোকে উপযুক্ত ও প্রয়োজনীয় পাঠ্য বই তৈরি করবে। এই কাজটি সুসম্পন্ন না করা পর্যন্ত শুধুমাত্র আমাদের দ্বীন ও ঈমানই নয় বরং আমাদের দেশসমূহের অস্তিত্বও বিপন্ন হতে পারে ।
- আমাদের সরকারসমুহের দ্বিতীয় কর্তব্যঃ-
দ্বিতীয় যে বিষয়টির দিকে আমি সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই তা হচ্ছে, চারিত্রিক প্রশিক্ষণ দান। নৈতিক চরিত্র সৃষ্টির এই প্রশিক্ষণ যদিও সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রয়োজন তবে বিশেষ করে বিভিন্ন সরকারী দায়িত্বপূর্ণ পদে নিয়োগের জন্য লোক তৈরির প্রতিষ্ঠানগুলোতে এই ব্যবস্থা একান্তই অপরিহার্য। চাই তা সামরিক প্রশিক্ষণ কিংবা পুলিশের প্রশিক্ষণ অথবা সিভিল সার্ভিসের প্রশিক্ষণই হোক না কেন। এইসব প্রতিষ্ঠানে ইসলামের নৈতিক চরিত্র ও ইসলামী শিক্ষা ব্যধ্যতামূলক করা আবশ্যক, ইসলামের বিশ্বাসকে তাদের অন্তরে দৃঢ়মূল করে বসিয়ে দেয়া দরকার। ইসলামের বিধান ও হুকুম-আহকাম পালন করার জন্য তাদেরকে অভ্যস্ত করে তুলতে হবে এবং পাপ প্রবণতার যাবতীয় রাস্তা বন্ধ করে দিতে হবে। দেশকে সুদৃঢ় ও মজবুত করার এটাই হচ্ছে কার্যকর পন্থা। আমরা যখন একজন পুলিশকে প্রশিক্ষণ দেই তখন মনে করি যেহেতু তার নাম ‘আবদুল্লাহ’ ‘আবদুর রহমান’ সেহেতু সে মুসলিম চরিত্র সম্পন্ন না হয়ে পারে না। এজন্য আমরা তাকে শুধু পুলিশের কর্তব্য পালনোপযোগী করে গড়ে তুলি। তাকে মুসলিম বানাবার কোন প্রচেষ্টা চালাই না। দুনিয়ার অন্যান্য দেশে একজন পুলিশের প্রশিক্ষণে যা করা হয় আমরাও ঠিক ততটুকু করেই ক্ষান্ত হই। এর ফলে প্রশিক্ষণ লাভের পর সে একজন পুলিশের দায়িত্ব পালন করার উপযোগী হয়ে গড়ে উঠলেও তার মধ্যে ইসলামের নৈতিক চরিত্র বর্তমান থাকে না। তবে কারোর মধ্যে যদি এর ব্যতিক্রম দেখা যায় তা শুধু আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ মাত্র। আমাদের অবহেলা ও উদাসীনতা সত্ত্বেও তার মধ্যে ইসলামী নৈতিক চরিত্র অবশিষ্ট থাকার কারণ তা অন্য কিছু থেকে আগত। এমতাবস্থায় পুলিশের দ্বারা, তাদের ছত্রছায়ায় যদি অপরাধ সংঘটিত হয় ও ব্যাপক হয়ে উঠে সেজন্য অভিযোগ করা যায় না। কেননা আপনি এমন কোন প্রচেষ্টাই চালাননি যার মাধ্যমে আমাদের পুলিশের ইসলামী নৈতিক চরিত্র সিল হতে পারে। বিভিন পর্যায়ের কর্মচারী তৈরির যেসব প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা আমাদের দেশে চালু রয়েছে তার ও অমুসলিম জাতির অবলম্বিত ব্যবস্থার মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। এই কারণেই লােকেরা এখান থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর যখন বড় বড় দায়িত্বপূর্ণ পদে নিযুক্তহন তখন এদের মধ্যে ইসলামী নৈতিকতা ও চরিত্র সম্পন্ন লােক ব্যতীত অন্যের ভাল ও যােগ্য অফিসার বলে পরিগণিত হন না।
সামরিক বাহিনীর প্রশিক্ষণের ব্যাপারে বলা যায় যে, কোন কোন মুসলিম দেশের সামরিক বাহিনীর লোকেরা উত্তম অবদান রাখতে সক্ষম হয়েছেন এবং তাদের প্রবল বিক্রম, শাহাদত বরণের আগ্রহ ও মুজাহিদ সুলভ আত্মদানের দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়েছে। কিন্তু এইরূপ মুজাহিদ বানাবার জন্য আমরা সামরিক প্রশিক্ষণে কী ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি? আসলে এর উৎসমূলে রয়েছে তাদের ঐ সমস্ত মা যারা তাদের কানে আল্লাহ ও রাসূলের নাম ঢেলে দিয়েছিলেন। এর মূলে রয়েছে সেই মুসলিম সমাজ ও সে সমাজের বিলীনাবশিষ্ট ঐতিহ্য ও রীতি-নীতিই যা তাদের মনে মগজে আল্লাহ, রাসূল, পরকাল, জিহাদ ও শাহাদতের ধ্যান ধারণা দৃঢ়মূল করে বসিয়ে দিয়েছে এবং ইসলামের প্রতি ভালবাসার বীজ বপন করেছে। এসব জিনিস আমাদের সমাজে ইসলামী শিক্ষার বিদ্যমান ছিল বলেই এই জাতীয় বিপাকে তা আমাদের বিরাট কাজে এসেছে। কিন্তু আমরা যদি এই সমাজকেও প্রতিনিয়ত বিকৃতির দিকে ঠেলে দিতে থাকি তাহলে এই প্রভাব কতক্ষণ পর্যন্ত কার্যকর থাকবে? ভবিষ্যত বংশধরদের উপর এই প্রভাব ক্রমশ কমতেই থাকবে। আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে বর্তমানে প্রশিক্ষণরত মহিলাদের ক্রোড়ে লালিত পালিত হয়ে যে বংশধর গড়ে উঠবে তাদের মধ্যে এই প্রভাব অবশিষ্ট থাকার সম্ভাবনা যথেষ্ট কম। এই প্রভাব দেখা গেছে সেইসব লোকদের মধ্যে যারা নিজেদের ঘরে আপন মায়েদের নামাজ ও কোরআন পড়তে দেখেছে এবং তাদের থেকে আল্লাহ ও রসূলের নাম শুনেছে। কিন্তু বর্তমানে যেসব নতুন মা তৈরী হচ্ছে তাদের মুখে ছায়াছবির অভিনেতাদের নাম, নবাগত ছায়াছবির পর্যালোচনা ও খেলাধুলার উল্লেখ শুনতে পাওয়া যায়। তাদের মুখে আল্লাহ ও রসূলের নাম কদাচিই উচ্চারিত হয়। তাদের ক্রোড়ে লালিত-পালিত হয়ে উঠা যুবকের নিকট আল্লাহ ও রসূলের উদ্দেশ্যে জীবন উৎসর্গ করার আশা করা যায় কি? এবং বর্তমান আমাদের যুবকদের নিকট শাহাদতের আগ্রহ ও ইচ্ছে কি আদৌ পাওয়া যাবে যার উপস্থিতির ফলে তারা এ গৌরবোজ্জ্বল ত্যাগ স্বীকার করতে পেরেছিলেন? বাস্তবিক পক্ষে, আমরা যদি মুসলিম দেশসমূহ ও এর জীবন পদ্ধতির জন্য উৎসর্গীকৃত যুবক তৈরি করতে চাই তাহলে আমাদেরকে সর্বোত্তম সামরিক প্রশিক্ষণ দানের সাথে সাথে সর্বোৎকৃষ্ট ইসলামী শিক্ষা-প্রশিক্ষণ দানেরও চিন্তা করতে হবে । যার ফলে তাদের মন-মগজে ঈমান দৃঢ়মূল হয়ে বসবে। তাদেরকে এহেন আকীদা, বিশ্বাস ও নৈতিকতার প্রশিক্ষণ দিতে হবে যেন তারা ভবিষ্যতে এর চাইতেও অনেক বড় আত্মত্যাগের উপযোগী হয়ে গড়ে উঠে। আমাদের তুলনায় শতগুণ বড় ও শক্তিশালী শত্রুর মুকাবিলায় কেবলমাত্র, এই জিনিসই আমাদেরকে জীবিত রাখতে পারে ।