সম্মানিত উস্তাদ প্রফেসর ড. মেহমেদ গরমেজ মুসলিম উম্মাহর প্রখ্যাত একজন আলেম, উসূলবিদ ও মুতাফাক্কির। সুদীর্ঘ ৪০ বছরের অক্লান্ত অধ্যয়ন, উম্মাহর মহান আলেমগণের সাথে যোগাযোগ, বিভিন্ন অঞ্চল পরিদর্শনের ফলে লব্ধ জ্ঞানের প্রেক্ষিতে অসাধারণ পর্যালোচনার মাধ্যমে তিনি ইসলামী সভ্যতার পতনের পেছনে সক্রিয় কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন ‘আখলাক বিহীনতা’কে। ‘আখলাক’ ইসলামী সভ্যতার গুরুত্বপূর্ণ একটি পরিভাষার নাম। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের অন্যতম একটি উদ্দেশ্য হলো তার বান্দা পৃথিবীতে আখলাকের বিনির্মাণ করবে। রিসালাতে মুহাম্মদীর উদ্দেশ্যও আখলাকের বিনির্মাণ। ড. মেহমেদ গরমেজের মতে এ আখলাকের মাধ্যমেই ইসলামী সভ্যতা অত্যুচ্চ অবস্থানে পৌঁছেছিলো, আর আখলাক হারিয়ে ফেলার কারণেই সভ্যতার পতন ঘটে এবং আখলাক বিহীনতার কারণেই আজ ইসলামী সভ্যতা পুনরায় ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না।
“বিশ্বব্যাপী আখলাকী সংকট” উস্তাদ ড. মেহমেদ গরমেজের এ চিন্তার এক অনবদ্য সম্মীলন। এ গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থে তিনি আখলাক বিহীনতার ফলে সৃষ্ট সংকট এবং এর থেকে উত্তরণের উপায় অসাধারণভাবে আলোচনা করেছেন।
• গ্রন্থের শুরুতেই বইয়ের নামের শিরোনামের অধ্যায়ে উস্তাদ গরমেজ মতামত ব্যক্ত করেছেন, “বিশ্বব্যাপী যে ভয়াবহ সংকট বিদ্যমান, তা হলো আখলাক বিহীনতা। আর এ সংকট এতটাই সর্বব্যাপী, পৃথিবীর কোনো প্রান্তের মানুষই তা থেকে মুক্ত নয়।” অতঃপর তিনি মানব সৃষ্টির উদ্দেশ্যের ক্ষেত্রে ইসলামী সভ্যতার মহান আলেম আল্লামা রাগেব ইস্পাহানীর চিন্তার আলোকে তার আলোচনা তুলে ধরেছেন।
মানব সৃষ্টির পেছনে ৩ টি উদ্দেশ্য রয়েছে। যথা–
১. ইবাদত
২. ইসতিখলাফ (খেলাফত)
৩. ইমারত
উস্তাদ গরমেজ আখলাকী সংকট সৃষ্টি হওয়ার কারণ হিসেবে বলেছেন,
“আজ বিশ্বব্যাপী যে আখলাকী সংকট বিদ্যমান, এটি মূলত অর্থবহতার সংকট, অর্থাৎ অর্থহীনতা থেকে সৃষ্ট একটি সংকট। বিশ্বব্যাপী আখলাকী সংকটের মূল কারণ হলো মহাবিশ্ব, মানুষ, সৃষ্টিজগতের অর্থ ও এই সকল সৃষ্টির উদ্দেশ্যকে হারিয়ে ফেলা।”
উস্তাদ গরমেজ দেখিয়েছেন, মানুষের উপর অর্পিত দায়িত্বসমূহ মানুষ কেবলমাত্র আখলাক, আদালত ও মারহামাতের মাধ্যমেই পালন করতে পারে। একইসাথে এ সকল পরিভাষা অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত।
উস্তাদ গরমেজ আরো দেখিয়েছেন, সেক্যুলার আখলাকের মৌলিক ত্রুটিগুলো কী কী এবং ইসলামের আখলাকের মধ্যে বহির্গত আখলাক কীভাবে এবং কোন ধরন নিয়ে প্রবেশ করেছে।
এসবের সমন্বয়ে এ অধ্যায়ে তাঁর আলাপ তুলনাহীন।
• গ্রন্থের দ্বিতীয় অধ্যায়ে উস্তাদ গরমেজ আলোচনা করেছেন জ্ঞানের আখলাক নিয়ে। “জ্ঞান ও আখলাক” শিরোনামের এ অধ্যায়ে তিনি জ্ঞানের সাথে আখলাকের সম্পর্ক এবং আখলাক থেকে জ্ঞান বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে ফলাফল কী হতে পারে তা নিয়ে সংক্ষেপে মৌলিক আলোচনা করেছেন।
আখলাকের ক্ষেত্রে জ্ঞানের আখলাকের ভূমিকা, জ্ঞানের আখলাক ও নিরপেক্ষতার আলাপ, ইসলামী সভ্যতায় জ্ঞানের আখলাক নিয়ে উস্তাদ গরমেজ এখানে অসাধারণ সারগর্ভ আলোচনা করেছেন।
• তৃতীয় অধ্যায়ে উস্তাদ গরমেজ আখলাক ও আদালত পরিভাষাদ্বয়ের মধ্যকার সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করেছেন। “আখলাক ও আদালত” নামক এ অধ্যায়ে তিনি তুলে ধরেছেন, আদালতকে আমরা অত্যন্ত সংকীর্ণভাবে বিবেচনা করে থাকি, অথচ আদালত একটি সামগ্রিক অর্থ দেয়, শুধুমাত্র আইন সম্পর্কীয় কোনো ধারণা নয়।
এ অসাধারণ আলোচনাকে তিনি চারটি শিরোনামের মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলেছেন–
১. আদালতের সাথে আখলাকের সম্পর্ক
২. আদালতের সাথে মারহামাতের সম্পর্ক
৩. আদালতের সাথে ইহসানের সম্পর্ক
৪. আদালতের সাথে আকলের সম্পর্ক
• তারপর উস্তাদ গরমেজ আলোচনা করেছেন জ্ঞান, আখলাক এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রসঙ্গে। “জ্ঞান, আখলাক এবং বিশ্ববিদ্যালয়” শিরোনামের চতুর্থ অধ্যায়ে তিনি তিনি জ্ঞানের চিন্তাকে নতুনরূপে হাজির করেছেন, যা আমি টানা চারবার পড়তে বাধ্য হয়েছি!
তিনি ব্যাখ্যা করেছেন, পাশ্চাত্য সভ্যতার উত্থান ও ক্ষমতায়ন পরবর্তী শিক্ষাব্যবস্থাকে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ করা হয়, তখন থেকে সবকিছুই প্রতিষ্ঠানের মোড়কে কাজ করতে থাকে। যার ফলে আমরা জ্ঞান বলতে আজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে বুঝি। পূর্ববর্তী সময়কার জ্ঞানের ব্যবস্থার পরিবর্তিত রূপকেই আমরা ধারণ করি।
উস্তাদ গরমেজ বিশ্ববিদ্যালয়কে এখানে আক্ষরিক অর্থে উপস্থাপন না করে পাশ্চাত্যের শিক্ষাব্যবস্থার ধারণাকে তুলে ধরেছেন, একইসাথে আখলাকের সাথে জ্ঞান, জ্ঞানের সাথে বিশ্ববিদ্যালয়, আবার তিনটি ক্ষেত্রের মধ্যকার সম্পর্ক তুলে ধরেছেন।
• “পয়গামে মুহাম্মদীর উদ্দেশ্য হিসেবে আখলাক” শীর্ষক পঞ্চম অধ্যায়ে উস্তাদ গরমেজ যে আলোচনা করেছেন, তার সারমর্ম করা কঠিন! প্রতিটি লাইনই একেকটি গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতি। এ অধ্যায়ে উস্তাদ ইসলামের মৌলিক লক্ষ্য হিসেবে আখলাকের অবস্থান এবং রিসালাতে মুহাম্মদীর উদ্দেশ্য হিসেবে আখলাকের ধারণা ফুটিয়ে তুলেছেন।
• ষষ্ঠ অধ্যায় অর্থাৎ “কঠিন সময়ের আখলাক” উস্তাদ গরমেজের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা। কঠিন সময়ে আখলাক রক্ষা করাটাই সবচেয়ে কঠিন এবং একইসাথে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এ অধ্যায়ে উস্তাদ কঠিন সময়ে আখলাকসম্পন্ন হয়ে টিকে থাকার পদ্ধতি আলোচনা করেছেন।
• গ্রন্থটির সর্বশেষ এবং সর্বশ্রেষ্ঠ অধ্যায় হলো “স্ক্রিন সভ্যতার যুগে হায়ার মাধ্যমে পুনরুজ্জীবিত হওয়া”। গ্রন্থের প্রতিটি অধ্যায়ই যদিও অসাধারণ ও অত্যন্ত জরুরী, কিন্তু এ অধ্যায় তাঁর মৌলিকত্ব, স্বতন্ত্রতা ও নতুন উপস্থাপনের কারণে অবশ্যই শ্রেষ্ঠ। এটি একইসাথে উস্তাদ মেহমেদ গরমেজের এক অসাধারণ সৃষ্টি।
এ অধ্যায়ে উস্তাদ গরমেজ যে আলোচনা করেছেন, শুরুতেই তা গুরুত্ব পাওয়ার দাবিদার। প্রথমত তিনি এ সভ্যতাকে আখ্যায়িত করেছেন স্ক্রিন সভ্যতা হিসেবে, যা পূর্বে কেউ করেনি। উস্তাদ গরমেজ দেখিয়েছেন, এ সভ্যতার মূল হলো স্ক্রিন (এক অর্থে টেকনোলজি)। তিনি এত অসাধারণভাবে এ বিষয়টি দেখিয়েছেন, যার ফলে পাশ্চাত্য সভ্যতার অন্তঃসারশূন্যতা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
উম্মাহর গাজ্জালী খ্যাত উস্তাদ ত্বহা আব্দুর রহমানের চিন্তার আলোকে বিশ্লেষণ করে উস্তাদ গরমেজ দেখিয়েছেন স্ক্রিন সভ্যতা কীভাবে আমাদের প্রভাবিত করছে। উস্তাদ গরমেজের ভাষায়–
“সোশাল মিডিয়া আমাদের ইদরাকী ক্ষমতাকে হত্যা করে মানুষকে তিনটি রোগের মুখোমুখী করেছে, এই তিনটি রোগই আসক্তির পর্যায়ের। যুগের গাজ্জালী নামে পরিচিতি লাভকারী মরক্কোর প্রখ্যাত আলেম ও দার্শনিক ড. ত্বহা আব্দুর রহমানের ভাষায় বললে এই রোগ তিনটি হলো–
• তাফাররুজ
• তাজাসসুস
• তাকাশশুফ”
অতঃপর তিনি প্রতিটি পরিভাষাকে ব্যাখ্যা করেছেন, সময়ের সাথে সম্পৃক্ত করেছেন যা এ আলোচনাকে নতুন মাত্রা দিয়েছে। একইসাথে উস্তাদ গরমেজের যে অসাধারণত্ব, সে আলোকে তিনি শুধু সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেই ক্ষান্ত হননি, বরং সমাধানমূলক আলোচনাও করেছেন।
তার মতে এ সংকট থেকে উত্তরণের উপায় হলো হায়ার আখলাকসম্পন্ন হওয়া, যার দিকে ইসলাম সমগ্র মানবতাকে আহ্বান করে। অর্থাৎ স্ক্রিন সভ্যতার যুগে হায়ার মাধ্যমে পুনুরুজ্জীবিত হওয়া ও হায়া সম্পন্ন একটি পুনর্জাগরণ।
এর মাধ্যমেই উস্তাদ মেহমেদ গরমেজ তাঁর আলোচনার সমাপ্তি টেনেছেন।
স্ক্রিন সভ্যতার যুগে নিজেদের উজ্জীবিত করতে হলে, সংগ্রাম করতে হলে, ইসলামী সভ্যতাকে নতুনভাবে জাগরিত করতে হলে আখলাক আবশ্যক। আখলাক ব্যতীত কখনোই ইসলামী সভ্যতার পুনর্জাগরণ সম্ভব নয়। আর সত্যিকার আখলাকসম্পন্ন হওয়ার ক্ষেত্রে এ গ্রন্থ অসাধারণ ভূমিকা রাখবে, ইনশাআল্লাহ।
[উস্তাদ প্রফেসর ড. মেহমেদ গরমেজ এর কথাসমূহকে বাংলা ভাষায় আমাদের নিকট তুলে ধরার জন্য অনুবাদক শ্রদ্ধেয় Burhan Uddin ভাইয়ের প্রতি বিশেষ কৃতজ্ঞতা। মক্তব প্রকাশনকেও ধন্যবাদ জানাই গ্রন্থটি প্রকাশ করার জন্য।]