বিমারিস্তান তথা প্রাচীন ইসলামিক হাসপাতাল: আই সার্জারি ও মিউজিক থেরাপির মতো অধুনা চিকিৎসা কৌশলের অগ্রদূত

চিকিৎসা বিজ্ঞানের ইতিহাস হাজার বছরের পুরোনো। প্রাচীন গ্রীক, ফার্সি ও ভারতীয় সভ্যতায় রোগ নিরাময়ের ক্ষেত্রে পরিকল্পিত পদ্ধতির প্রচলন খুজে পাওয়া যায়। এতদসত্ত্বেও, বর্তমানে একটি আধুনিক হাসপাতাল বলতে যা বুঝায় আর এর অন্তর্ভুক্ত বিষয়গুলোর রয়েছে এক স্বতন্ত্র ইতিহাস, যেটি সাধারণ মানুষদের কাছে অজানাই রয়ে গেছে।

গ্রীকদের অ্যাসক্লেপিয়া বা নিরাময় মন্দির আর রোমানদের ভ্যালেটুডিনারিয়া বা সামরিক হাসপাতাল থেকে থাকলেও বর্তমানের আধুনিক হাসপাতালগুলোর সাথে সামঞ্জস্য পাওয়া যায় মধ্যপ্রাচ্যে গড়ে উঠা মধ্যযুগীয় হাসপাতালগুলোর।

পারস্য আর আরবদের ‘বিমারিস্তান’ কিংবা তুর্কিদের ‘দারুশশিফা’, মূলত ছিল একটি প্রতিষ্ঠান এবং একটি মতবাদের প্রবর্তা যা পরবর্তীতে চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যখাতে বিপ্লব ঘটিয়েছে। বিমারিস্তান শব্দটি এসেছে  ফার্সি ভাষা থেকে। ‘বিমার’ বলতে বুঝায় ‘অসুস্থ ব্যক্তি’ আর ‘স্তান’ হচ্ছে ‘স্থান’; এ থেকে ‘বিমারিস্তান’ এর অর্থ দাঁড়ায় ‘অসুস্থদের স্থান’।

 

ইউরোপে  খ্রিস্টানদের  গীর্জাগুলিতে অসুস্থদের চিকিৎসা করার সুবিধা থাকলেও চিকিৎসা পদ্ধতি আধুনিক প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করতে পেরেছিল না। এ দিক থেকে মধ্যযুগীয় ইসলামী সভ্যতায় ছিল চিকিৎসা সেবার একটি বিস্তৃত ব্যবস্থাপনা যা আধুনিক হাসপাতালগুলোর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। বিমারিস্তানের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ ইসলামের প্রাচীনতম উদাহরণ দেখা যায় রাসুলুল্লাহ (সা.) এর সময়ে ৬২৭ খ্রিস্টাব্দে খন্দক যুদ্ধের সময়। সেসময় রুফাইদা আল আসলামিয়া নামক একজন মহিলা সাহাবী একটি তাবুতে অস্থায়ী চিকিৎসা কেন্দ্র স্থাপন করেন।

পরবর্তীতে, ভ্রাম্যমাণ বিমারিস্তানের এই ধারণাটি অনেক বিস্তৃত হয়। ইসলামি সভ্যতার শহরের কেন্দ্রগুলিতে থাকতো স্বেচ্ছাসেবীরা, পাশাপাশি থাকতো সার্বক্ষণিক ভেষজ ঔষধের সরবরাহ, ফার্মেসি এবং চিকিৎসকগণ। সব রোগীকেই তার জাতি, ধর্ম, পুরুষ-নারী বা অসুস্থতা নির্বিশেষে চিকিৎসা সেবা প্রদান করা হতো, কাউকেই ফিরিয়ে দেওয়া হতো না।

 

সর্বপ্রথম সবচেয়ে বড় বিমারিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয় ৭০৬ খ্রিস্টাব্দে দামেস্কে এবং পরবর্তী শতাব্দীতে আব্বাসীয় খলিফা হারুন আল-রশীদের সময়কালে গ্রানাডা, কায়রো এবং বাগদাদের শহরগুলিতে আরও বেশ কয়েকটি বিমারিস্তান স্থাপিত হয়। পঞ্চদশ শতকের শেষের দিকে, শুধুমাত্র মুসলিম কর্ডোভায় চল্লিশ থেকে পঞ্চাশটির মতো হাসপাতাল ছিল।

 

বিনামূল্যে বিশ্বমানের স্বাস্থ্যসেবা

যে বিষয়টি এই স্থাপনাগুলিকে এত গুরুত্বপূর্ণ এবং অনন্য করে তোলে তা হল, এগুলি এমন সময়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল যখন সাধারণ হাসপাতালের কোনো অস্তিত্বই ছিল না। আরব ও মুসলিম বিশ্বের বিমারিস্তানগুলো সেই সময়ে বিশ্বমানের স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করত এবং রোগীকে কোনো ধরনের সেবামূল্য পরিশোধ করতে হতো না। মানসিক রোগ এবং সংক্রামক রোগ সহ সকল ধরনের অসুস্থতায় জাতি, ধর্ম, পুরুষ-নারী কিংবা অসুস্থতার ধরণ নির্বিশেষে কোনও রোগীকে ফিরিয়ে দেওয়া হতো না।

ভিন্ন ভিন্ন রোগের জন্য আলাদা ওয়ার্ড থাকার পাশাপাশি উদ্বেগ কিংবা মানসিক অস্থিরতাগ্রস্ত রোগীদেরকেও শারীরিক অসুস্থতাগ্রস্ত রোগীদের মতো সমান গুরুত্ব সহকারে চিকিত্সা সেবা প্রদান করা হতো, যেখানে পাশ্চাত্য এই সাম্প্রতিককালে এসে মানসিক স্বাস্থ্যকে গুরুত্বের সাথে দেখছে।

 

দামেস্কের নূর আল-দিন জেঙ্গির বিমারস্তানের মাঝের দিকে ছিল একটি পানির ফোয়ারা এবং একটি বাগান আর এর পাশাপাশি বিভিন্ন রোগের চিকিংসার জন্য ছিল আলাদা আলাদা কক্ষ ( যা বর্তমান হাসপাতালগুলোর ওয়ার্ড সিস্টেমের মতো)। (যিরার আলী)

বিমারিস্তানের রোগী এমনকি শিক্ষানবিশরাও হতো মুসলিম, ইহুদি কিংবা খ্রিস্টানদের মধ্য থেকে। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত আটাশ জন পর্যন্ত চিকিৎসক কর্মরত থাকতেন। বেশিরভাগ হাসপাতালে ফার্মাসি থাকতো যেগুলোতে অনেক দূর-দূরান্ত, যেমন, ভারত থেকে আমদানিকৃত ঔষধও পাওয়া যেতো। বেশির ভাগ হাসপাতাল দান বা ওয়াকফ-অনুদানের অর্থায়নে পরিচালিত হতো। ওয়াকফ গ্রহণের সময় একটি আইনী চুক্তি করা হতো যাতে বিমারিস্তান পরিচালনার জন্য নির্ধারিত শর্তাবলী থাকতো। মূলত এই চুক্তির নথিগুলিই ছিল বিমারিস্তানের দ্বার এবং পরিষেবাগুলি সকলের জন্য উন্মুক্ত রাখার নিশ্চয়তাস্বরূপ।

বড় বড় সভ্যতার রাজধানীসমূহ, যেখানে থাকতো বহু জাতি ও সম্প্রদায়ের বাস ও সংস্কৃতির সংমিশ্রণ, যেমন বাগদাদ, দামেস্ক বা ফেজের মতো শহর গুলোর শাসক ও অভিজাত শ্রেণীর ব্যাক্তিগণ জনসাধারণের উপকারের জন্য এই ধরনের দাতব্য প্রতিষ্ঠানগুলো চালু করার একটা বাধ্যবাধকতা অনুভব করতেন।

বিমারিস্তান, মাদ্রাসা কিংবা হাম্মাম (গোসলখানা) কেবলমাত্র সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মান-ই বৃদ্ধি করতো না, বরং এগুলোকে গুরুত্বপূর্ণ দাতব্য কার্যক্রম হিসেবে বিবেচনা করা হতো, যা সে-সময়কার শাসকদের আরও জনপ্রিয় করে তুলেছিলো।

জেঙ্গি সুলতান নূর-আল-দিন জেঙ্গি দ্বারা নির্মিত দামেস্কের ‘নূর-আল-দিন’ হাসপাতাল দ্বাদশ শতাব্দীর বিমারিস্তানের একটি চমৎকার উদাহরণ যা জনসাধারণের প্রতি সুলতানের বিশাল প্রচেষ্টার নিদর্শন।

সিদি ফ্রেজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১২৮৬ সালে এবং ১৯৪৪ সাল পর্যন্ত নিঃস্ব ও মানসিকভাবে অসুস্থদের জন্য একটি এতিমখানা হিসেবে কার্যকর ছিল। (যিরার আলী)

আরও পশ্চিমে, মরক্কোর পুরনো শহর ফেজে, আরেকটি অনন্য ধরনের বিমারিস্তানের নিদর্শন পাওয়া যায়। মারিনি রাজা ইউসেফ ইবনে ইয়াকুব ১২৮৬ সালে সিদি ফ্রেজে বিমারিস্তান প্রতিষ্ঠা করেন। এটি ছিল নিঃস্ব এবং মানসিকভাবে অসুস্থদের জন্য আশ্রয়স্হল; যেটি ১৯৪৪  সাল পর্যন্ত কার্যকর ছিল এবং ইতিহাসের পাতায় সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি হিসেবে স্থান করে নিয়েছে।

এটি কেবল মাত্র অসুস্থ মানুষদেরই সেবা দিতো না। এটি ছিল একটি ‘স্টোর্ক হসপিটাল’ যা অসুস্থ ও আহত পাখিদেরও সেবা প্রদান করতো। মানুষ এবং প্রাণীর প্রতি এই ধরনের সেবা কার্যক্রম সম্পদশালী ও ক্ষমতাশীল ব্যাক্তিদের বিপুল পরিমাণ ওয়াকফ ব্যতিত সম্ভব ছিলো না।

 

দক্ষিণ আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের বিমারিস্তান গুলো এতটাই অগ্রগামী ও জনপ্রিয় ছিলো যে এসব স্থানে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সেবা গ্রহণ ও শিক্ষাদানের জন্য রোগী এবং স্কলারগণ আসতেন। যেমন, আন্দালুসিয় স্কলার ‘ইবনে রুশদ’ একটি বিমারিস্তানে শিক্ষাদানের জন্য কর্ডোভা ছেড়ে মরক্কোতে গিয়েছিলেন।

 

চিকিৎসার ধরণ

বিমারিস্তান ছিল মধ্যযুগীয় চিকিৎসা বিজ্ঞানের যুগান্তকারী পরিবর্তন গুলোর মধ্যে অগ্রগামী যার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিলো সার্জারী, এনাটমি ও ডিজিজ স্ট্যাডি; একই সাথে এটি মানসিক সমস্যার মতো অপ্রতীয়মান বিষয়ের প্রতিও যথেষ্ট গুরুত্বারোপ করেছিলো।

আই সার্জারী বা চোখের অস্ত্রপচার  (বিশেষ করে ক্যাটার‍্যাক্ট বা ছানি অপারেশন) ছিল ইসলামী চিকিৎসা বিজ্ঞানের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় সফলতার গল্পগুলোর মধ্যে একটি। আধুনিক অস্ত্রপচারের জনক আন্দালুসীয় স্কলার আবু আল কাশিম আল জাহরাভী (আলবুকাসিস) চিকিৎসা পদ্ধতির উপর ত্রিশ খন্ডের এনসাক্লোপিডিয়া রচনা করেন, যা অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত ইউরোপে ব্যবহৃত হতো।

 

আলো, বাদ্যযন্ত্র ও প্রবাহমান পানির ধ্বনির দ্বারা চিকিৎসা

মানসিক রোগে আক্রান্ত রোগীদের নতুন এক পদ্ধতিতে চিকিৎসা করা হতো। তাদেরকে সাধারণ রোগীদের থেকে ভিন্ন জায়গায় রাখা হতো, তাদের চিকিৎসায় ঔষধ ব্যবহার করা হতো না, বরং আবসস্হলের বিশেষ পরিবেশই ছিল তাদের নিরাময়ের মাধ্যম। প্রতিকার হিসেবে ব্যবহৃত হতো পর্যাপ্ত আলো, সুমধুর ধ্বনি (বাদ্যযন্ত্র কিংবা প্রবাহমান পানির শব্দ), পর্যাপ্ত পরিমাণে বিশুদ্ধ বাতাস নয়তোবা আলাপচারিতা।

বিমারিস্তানের নিয়ম অনুযায়ী কোনো রোগী পরিপূর্ণ সুস্থ হওয়ার আগে বিমারিস্তান ছেড়ে যেতে পারতো না।

চিকিৎসা পদ্ধতির মূলে ছিলো বিমারিস্তানগুলোর স্থাপনাশৈলী ও অবস্থান। উদাহরণ স্বরুপ সেলজুক সালতানাতের সময়কার দারুশশিফাগুলোর কথা বলা যায়, যেগুলো বাগানের মধ্যে কিংবা আশেপাশে তৈরি করা হতো। প্রকৃতির নির্মলতাই সুস্থতার নিয়ামক হিসেবে কাজ করতো।

রোগীদের জন্য শান্ত পরিবেশ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বিমারিস্তানগুলো প্রায়শই মূল শহরের বাইরে তৈরি করা হতো, যার উদাহরণ হিসেবে এখনো টিকে আছে পঞ্চাদশ শতাব্দীতে তৈরীকৃত তুরস্কের এদিরনের এই বিমারিস্তানটি। (যিরার আলী)

সুলতান দ্বিতীয় বায়েজিদ কর্তৃক নির্মিত একটি প্রখ্যাত দারুশশিফা ছিল তুরস্কের উত্তর-পশ্চিম অংশের শহর এদিরনেতে। যদিও এটি এখন আর চলমান নেই, কিন্তু এর বিশাল আকৃতি ও স্থাপত্যশৈলীই ইঙ্গিত করে মানসিক চিকিৎসাকে এখানে কতটা গুরুত্ব দেওয়া হতো।

এর অবস্থান ছিলো শহরের সীমানার বাইরে। কেননা এর চিকিৎসা পদ্ধতি অনেকাংশেই ছিল সুর ও সুগন্ধি নির্ভর। যে কারণে এর অবস্থান অটোম্যান রাজধানীর ব্যস্ত শহরের যানজট ও কোলাহল থেকে দূরে থাকাই সমীচীন ছিল। বলা বাহুল্য যে, নান্দনিকতা ছিলো দারুশশীফা ও বিমারিস্তানগুলোর স্থাপনাশৈলীর অন্যতম অত্যাবশ্যকীয় উপাদান।

 

মানসিক রোগের সঠিক চিকিৎসার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল সঠিকভাবে রোগ নির্ণয় করা। দশম শতাব্দীতে পারস্যের বিজ্ঞানী, চিকিৎসক ও দার্শনিক ‘ইবনে সীনা’ তৎকালীন উপেক্ষিত অদৃশ্য রোগ তথা মানসিক রোগ (যেমন, ভালোবাসা কেন্দ্রিক কষ্ট) নিয়ে গবেষণা ও চিকিৎসা প্রদান শুরু করেন। তিনি ‘সাইকোসিস’ কে অন্যান্য মানসিক রোগ থেকে আলাদা হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেন।

তার সবচেয়ে বিখ্যাত এনসাইক্লোপিডিয়া “The Canon of Medicine”  সহস্রাব্দেরও বেশি সময় ধরে ছিল অপ্রতিদ্বন্দী ও অতুলনীয়, যা অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত সারা বিশ্বের মেডিকেল ছাত্রদের শিক্ষা দেওয়া হতো।

 

এদিরনের এই দারুশশীফার মতোই দারুশশীফাগুলো মসজিদের সাথে সংযুক্ত থাকতো; এ যেন নিরাময়ের সাথে আধ্যাত্মিকতার সম্মিলন। (যিরার আলী)

এক্ষেত্রে পারস্যের আরো একজন উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব ছিলেন ‘আবু জায়েদ আল-বালখি’ যার সবচেয়ে বিখ্যাত গ্রন্থ হলো নবম শতাব্দীতে রচিত ‘Sustenance of the Soul’। গ্রন্থটির প্রায় অর্ধেক অংশেই তিনি মনস্তাত্ত্বিক অসুস্থতা নিয়ে আলোচনা করেছেন। গ্রন্থটিতে তিনি যৌক্তিকভাবে দেখিয়েছেন যে, মানসিক অসুস্হতার চিকিৎসা শারীরিক অসুস্থতার চিকিৎসার মতোই গুরুত্বপূর্ণ। তিনি এতে বালখি (Bulkhy) ডিপ্রেশন, এনজাইটি (anxiety) এবং ওসিডি (obsessive Compulsive disorder)  বা সূচিবাই রোগ নিয়ে আলোচনা করেছেন, যেখানে পশ্চিমা বিশ্ব বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে এসে এগুলোকে আলাদা রোগ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। তিনি ডিপ্রেশনকে দুই ভাগে বিভক্ত করেছেন- পরিবেশগত ও জীনগত, এবং এদের চিকিৎসার জন্য ভিন্ন ভিন্ন চিকিৎসা পদ্ধতি বর্ণনা করেছেন৷।

এরপর থেকে মানসিক স্বাস্থ্যকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া শুরু হয় এবং লোকেদের যে একটি বিশ্বাস ছিল যে রোগ বা অসুস্থতা পাপের কারনে হয়- এ থেকে মানুষ বেরিয়ে আসে।

 

মিউজিক থেরাপি (Music Therapy)

ইসলামী চিন্তাধারার অনেক গুলো ধারায় বিশেষ করে সুফিবাদে মিউজিককে আধ্যাত্নিকতার সম্মিলন হিসেবে বিবেচনা করা হয়। দার্শনিক ও সঙ্গীত তাত্ত্বিক ‘আবু নাসর আল-ফারাবি’ নবম শতাব্দীতে মিউজিকের উপর একটি মৌলিক গ্রন্থ রচনা করেন। এতে তিনি মিউজিকের  সৃষ্টিতাত্ত্বিক গুণাবলী উপস্থাপন এবং আত্মা ও শরীরের উপর এর থেরাপিউটিক প্রভাব নিয়ে আলোচনা করেন।

তিনি ব্যাখ্যা করেছেন, মিউজিক কিভাবে তালের ছন্দ-লয়ের তারতম্যের সাথে সাথে অনুভূতির পুনর্জ্জীবন বা সতেজতা দান করে; যা যেকোনো ধরনের সমস্যাকে দুরীভূত করতে পারে। এমনকি রোগীর শরীর, মন ও আত্মার যেকোনো ধরনের ভারসাম্যহীন অবস্থাকে নিরাময় করতে পারে (গ্রিক-রোমান মেডিসিনের এর মূলনীতির উপর ভিত্তি করে)।

প্রতিটি সুর ভিন্ন ভিন্ন অনুভূতি প্রকাশ করতে পারে, যেমন, আনন্দ, তৃপ্তি, স্বাচ্ছন্দ্য, দুঃখ, ভয়, তন্দ্রা ইত্যাদি।

আল – মানসুরী, কায়রো; এটি ১২৪৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো, যার মূল পানির ফোয়ারা নীল নদের সাথে সংযুক্ত ছিলো। (যিরার আলী)

ফারাবি তার গ্রন্থ , কিতাব আল-মুসিকা আল-কাবির (Kitab al-Musiqa al-Kabir)  এ এক সূক্ষ্ণ গাণিতিক সূত্র প্রণয়ন করেন যা আরব এবং অটোমান মিউজিক থেরাপির মূল ভিত্তি তৈরী করে এবং একইসাথে বর্তমান ইউরোপের মিউজিক থেরাপির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।

পরবর্তীতে ওসমানীয়রা নির্দিষ্ট কিছু রোগের চিকিৎসার জন্য নির্দিষ্ট কিছু ধরণের মিউজিকের শ্রেণীবিভাগ করেন। যেমন, কিছু সুর যেগুলো প্যারালাইসিসে আক্রান্ত রোগীদের জন্য উপকারী ছিল, কিছু ছিল অনিদ্রার জন্য, কিছু পায়ের পাতার ব্যাথা কিংবা ইউরিনারি ট্র্যাক ইনফেকশন (মূত্রনালীর সংক্রমণ) এর ক্ষেত্রে উপকারী ছিল। সুর ও বিভিন্ন সুমধুর শব্দ কিভাবে শারীরিক ও মানসিক অসুস্থতার প্রতিকারে আসে, তারা তার উদাহরণ স্থাপন করে।

বিমারিস্তানগুলো ছিল চিকিৎসার পাশাপাশি মাদরাসা ও ইবাদতের স্থান। অনেক বিমারিস্তানের সাথেই মাদরাসা, লাইব্রেরি ও মসজিদ সংযুক্ত থাকতো কিংবা এগুলো একত্রে বড় কমপ্লেক্স হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হতো।

কায়রোর আল-মানসুরি বিমারস্তানের সাথে সংযুক্ত মাদ্রাসার অভ্যন্তরীণ প্রাঙ্গন (যিরার আলী)

এই ধরনের স্থাপনাগুলো নিরাময়ের অন্তর্নিহিত প্রকৃতিকে তুলে ধরে যেমনটি ইসলামি সভ্যতায় দেখা যায়ঃ জ্ঞান ও দর্শনের প্রেক্ষাপট থেকে বিবেচনা করলে শারীরিক অসুস্থতা নির্ণয় ও নিরাময়ের জন্য প্রয়োজন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও হাসপাতাল, কিন্তু আধ্যাত্নিক উন্নতির জন্য প্রয়োজন স্রষ্টার কাছে পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণ ও স্রষ্টার স্মরণ।

অসুস্থদের প্রতিকার ও স্বস্তি প্রদানের জন্য বিমারিস্তানগুলোতে ব্যবহৃত নকশা ও স্থাপত্যশৈলী যা শহরের বাড়ি-ঘর নির্মাণেও ব্যবহৃত হতো। উদাহরণস্বরুপ আরব, পারস্য ও ভারতীয় বাড়িগুলোর অভ্যন্তরীন প্রাঙ্গনে থাকতো বাগান, আর তাতে থাকতো প্রশান্তিময় শীতল হাওয়ার বিভিন্ন গাছপালা।

মাঝের দিকে থাকতো একটি পানির ফোয়ারা এবং বাড়ির প্রতিটি অংশে থাকতো পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা, যার উদাহরণ এখনো টিকে আছে দামেস্কে।

 

বিমারিস্তানগুলোর প্রভাব আজও পর্যন্ত বিদ্যমান রয়েছে। কিন্তু পশ্চিমা চিকিৎসা পদ্ধতিতে মুসলিম বিজ্ঞানীদের অবদান ক্রমবর্ধমানভাবে স্বীকৃতি পেলেও, বিমারিস্তানগুলোর বিশেষ স্থাপত্যশৈলী, পরিচালনার পন্থা ও মানবতাপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি কিংবা মিউজিক থেরাপির মতো শিল্প পুরোটাই আজ বিলুপ্তপ্রায়।

সাম্প্রতিক কালে পাশ্চাত্য চিকিৎসা ব্যবস্থায় থেরাপি হিসেবে শব্দ ও মিউজিকের ব্যবহার লক্ষ্য করা যাচ্ছে। আর একটি চিন্তাধারা গড়ে উঠছে যারা ড্রাগ কিংবা মেডিসিনের চেয়ে প্রাকৃতিক নিরাময় পদ্ধতিকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে।

সবশেষে বলা যায়, এই বিমারিস্তানের ধারণাই মূলত আজকের আধুনিক হাসপাতাল ও মানসিক চিকিৎসা পদ্ধতির পথিকৃৎ।

অনুবাদঃ ডাঃ সুমাইয়া তাবাসসুম, সেক্রেটারি জেনারেল শিউলিমালা একাডেমি।

৪৩৫ বার পঠিত

শেয়ার করুন

Picture of রোয়াক ডেস্ক

রোয়াক ডেস্ক

রোয়াক । ইসলামী চিন্তা ও গবেষণা ইন্সটিটিউটের অনলাইন মুখপাত্র। বুদ্ধিবৃত্তিক ও সময়ের চিন্তাগত সংকট থেকে উত্তরণের জন্য কাজ করে যাবে।
Picture of রোয়াক ডেস্ক

রোয়াক ডেস্ক

রোয়াক । ইসলামী চিন্তা ও গবেষণা ইন্সটিটিউটের অনলাইন মুখপাত্র। বুদ্ধিবৃত্তিক ও সময়ের চিন্তাগত সংকট থেকে উত্তরণের জন্য কাজ করে যাবে।

মতামত প্রকাশ করুন

Scroll to Top