[১৩৪৩ বঙ্গাব্দে ফরিদপুর জেলা মুসলিম ছাত্র সম্মিলনীতে প্রদত্ত সভাপতির অভিভাষণ]
আপনারা আমাকে আপনাদের ফরিদপুর মুসলিম ছাত্র সম্মিলনীর সভাপতিত্বে বরণ করে যে গৌরব দান করেছেন, তার জন্য আমার অন্তরের অন্তস্থল থেকে অভিনন্দন ও কৃতজ্ঞতা গ্রহণ করুন। আমি বর্তমানে সাহিত্যের সেবা, দেশের সেবা এবং উম্মাহর পরিচায়ক থেকে অবসর গ্রহণ করে সঙ্গীতের প্রশান্ত সাগর দ্বীপে স্বেচ্ছায় নির্বাসন দণ্ড গ্রহণ করেছি। সেই সাথীহীন নির্জন দ্বীপ ঘিরে দিবারাত্রি প্রতিধ্বনিত হচ্ছে একটানা জলকল্লোল সঙ্গীত; আর সেই শব্দায়মান সুর ঊর্মির মুখরতার মাঝে বসে আছি বন্ধুহীন একা। এই বিশ্ব জুড়ে নেই মহামৌনীর স্তবগান নিঃশব্দ ঝঙ্কারে রণিত হচ্ছে, যদিও আমি সেই ধ্যানীর মৌন-মহিমার উৎসুক দর্শক, তবু একথা স্বীকার করতে আমার লজ্জা নেই নেই, আমার নির্জনতার বক্ষ জুড়ে শুনছি অবিরাম বিষাদিত রোদনধ্বনি, শান্তিহীন বিলাপ। মৃত্যুর পরে অশান্ত আত্মা যদি কেঁদে বেড়ায় তার কান্না বুঝি এমনি নীরব, এমনি মর্মন্তুদ! কত বিপুল বিরাট ভিত্তির উপর আমি আমার ভবিষ্যতকে সৃষ্টি করতে চেয়েছিলাম; কী অপরিণাম আশা, দুর্জয় সাহস নিয়েই না আমি নতুন জাতি নতুন মানুষের কল্পনা করেছিলাম। আমার সেই ভিত্তিকে জানি না করে অভিশাপে ধরণীতল গ্রাস করেছে, সেই স্বপ্নকে নিষ্ঠুর বস্তুর জগত অভাবের সংসার ভেঙে দিয়েছে। পরাজয় স্বীকার আমি আজও করি, কিন্তু ধৈর্যের দুর্গম দুর্গে আর কতদিন আত্মরক্ষা করব?
বেশি দিনের কথা নয়, সেদিনও আমার আশা ছিল, এই ছাত্র সমাজকে অগ্রদূত করে নব বিজয় অভিযানের আমি হব তূর্যবাদক, নকীব, সৃষ্টি করব সুন্দরের জগত কল্যাণী পৃথ্বী, ধরণীর পঙ্কিল বক্ষ ভেদ করে আনব পবিত্র আবে জমজম ধারা। সে আশা আমার আজও ফললো না। বুঝি মুকুলেই তা পড়ল ধূলায় ঝরে। আমি তাই এতদিন নিজেকে দেশের কাছে, জাতির কাছে মনে করেছি মৃত। কতদিন মনে করেছি আমার জানাজা পড়া হয়ে গেছে। তাই যারা কোলাহল করে আমায় নিতে আসে, মনে হয় তারা নিতে এসেছে আমায় গোরস্থানে। প্রাণের বুলবুলির স্থানে নয়। কত দিক থেকে কত আহ্বান আসে আজও; যত সাদর আহ্বান আসে, তত নিজেকে ধিক্কার দিয়ে বলি, ওরে হতভাগ্য! তোর দাফনের আর দেরি কত? কত দিন আর ফাঁকি দিয়ে জয়ের মালা কুড়িয়ে বেড়াবি? উম্মাহর জন্য, জাতির জন্য, দেশের জন্য কতটুকু আমি করেছি! তবু তার প্রতিদানে অতি কৃতজ্ঞ জাতি যেই শিরোপা আনে, তাতে শির আমার লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে চায়। তাই আপনাদের দাওয়াত পেয়ে যখন ধন্য হলাম, তখন দ্বিধাভরে অসঙ্কোচে তা কবুল করতে পারিনি। নেই ভাগ্যহীন নির্জনতার অন্ধ কারায় অভাবের শৃঙ্খলে বন্দি, সে কোথায় পাবে মুক্তির বাঁশি? শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আমি আমার অক্ষমতা নিবেদন করেছি আপনাদের কাসেদের কাছে, দূতের কাছে। কিন্তু তাঁরা আমার আর্জি মঞ্জুর করেননি। একদিন যারা ছিল আমার প্রাণাধিক প্রিয়তম, আত্মার আত্মীয়, তারা যখন তাদের প্রতি আমার ভালোবাসার দোহাই দিল তখন আর থাকতে পারলাম না। জীবন-যুদ্ধে ক্লান্ত, অবসন্ন, দুঃখ-শোকের শত জিঞ্জিরে বন্দি হয়েও আসতে হলো আমাকে আপনাদের পুরোভাগে এসে দাঁড়াতে। ফরিদপুরের তরুণ ফরিদ দলের নেতৃত্ব করার অধিকার নেই। । সংসারের চিড়িয়াখানায় বন্দি সিংহ, সিংহ আজ তার মাস্টার্স ভয়েসের ট্রেডমার্কের সাথে এক গলাবন্ধে বাঁধা পড়েছে। আমার এক নির্ভীক বন্ধু আমাকে উল্লেখ করে একদিন বলেছিলেন, ‘যাকে বিলিতি কুকুরে কামড়েছে তাকে আমাদের মাঝে নিতে ভয় হয়।’ সত্যি! ভয় হবারই কথা। তবু কুকুরে কামড়ালে লোকে নাকি ক্ষিপ্ত হয়ে অন্যকে কামড়াবার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে, আমার কিন্তু সে শক্তিও নেই, আমি হয়ে গেছি বিষ-জর্জরিত নির্জীব!
কিন্তু এ শোনাতে তো আমায় আপনারা আহ্বান করে আনেননি। আপনারা শামাদানে এনে বসিয়েছেন সেই প্রদীপকে যা একদিন হয়তো বা অত্যুগ্র আলোক দান করেছিল। আপনাদের এ আদরের অসম্মান আমি করব না, নিভবার আগে আমি আমার শেষ শিখাটুকু জ্বালিয়ে যাব। তাতে আপনাদেরে পথের হদিস মিলবে কি না! সকল পথের দিশারী খোদাই জানেন। আমি নিভবার আগে এই সান্ত্বনা নিয়েই নিভব নেই, আমি আমার শেষ স্নেহবিন্দুটুকু পর্যন্ত আলো জ্বালিয়ে দিয়ে যেতে পেরেছি।
তোমরা আমার সেই প্রিয়তম চিন্তাশীল যুবকসমাজ, যাদের দেখলে মনে হয়, আমি যেন কোটি বার কাবা শরিফ জিয়ারত করলাম; যাদের চোখে দেখেছি তৌহিদের রশ্নি, যাদের মুখে দেখেছি খালেদ, তারেক, মুসার ছবি, যাদের মক্তব, মাদ্রাসা স্কুল-কলেজকে মনে হয়েছে মসজিদের চেয়েও পবিত্র। যাদের বাহুতে দেখেছি আলি হায়দার উহুদের বেদেরেগ ত্যাগের শান ও শওকত, কণ্ঠে শুনেছি বেলালের আজানধ্বনি। তোমরা আমার সেই ধ্যানের মহামানবগোষ্ঠী। এ আমার এতটুকু অত্যুক্তি কল্পনা নয়। তোমাদেরে আমি দেখেছি, তোমাদের অতিক্রম করে সহস্রাধিক বৎসর দূরে যুদ্ধে বদরের ময়দানে, খায়বারের জঙ্গে। দেখেছি ওমর ফারুকের বিশ্ববিজয়ী বাহিনীর অগ্রসৈনিকরূপে, দেখেছি দূর আফ্রিকার মুসা-তারিকের দক্ষিণে, দেখেছি মিসরের পিরামিডের পার্শ্বে পিরামিড ছাড়িয়ে গেছে তোমাদের উন্নত শির। দেখেছি ইরানের বিরান মুলুক আবাদ করতে, তার আলবোর্জের চূড়া গুঁড়া করে দিতে। দেখেছি জাবালুত তারেকের জিব্রাল্টারের অকুল জলরাশির মধ্যে নাঙ্গা শমশের হাতে ঝাঁপিয়ে পড়তে। দেখেছি সেই জলরাশি সাঁতরে পার হয়ে স্পেনের কর্ডোভার বিজয়চিহ্ন অঙ্কিত করতে। দেখেছি ক্রুসেডের রণে, জেহাদের জঙ্গে সুলতান সালাউদ্দিনের সেনাদলের মাঝে দেখেছি কুরূপা ইউরোপকে সুরূপা করতে। সেদিনও দেখেছি রিফ সর্দার আবদুল করিমের সাথে, বিশ্বত্রাস কামালের পাশে, পহলভির দক্ষিণে, ইবনে সউদের সম্মুখে। যুগে যুগে তোমরা এসেছ ভাবী নেশনের নিশানবরদার হয়ে। তোমরা যে পথ দিয়ে চলে গেছ, মনে হয়েছে-আমি যদি ঐ পথের ধূলি হতাম! আমি প্রাণমন পেতে দিয়েছি তোমাদের অভিযানের ঐ পায়ে চলা পথে। আমি যেন তোমাদেরই সেই পায়ে চলা পথের ধূলিসমষ্টি, মূর্তি ধরে এসেছি তোমাদের অতীতকে স্মরণ করিয়ে দিতে, তোমাদের আর একবার তেমনি করে আমার বুকের উপর দিয়ে চলে যেতে।
কোথায় সে শমশের, কোথায় সে বাজু, সেই দরাজ দস্ত? বাঁধো আমামা, দামামায় আঘাত হানো আর একবার তেমনি করে। যে উম্মাহ যে জাতি চলেছে গোরস্থানের পথে, ফেরাও তাকে সেই পথে যে পথে চলে তারা একদিন পারস্য সাম্রাজ্য রোম সাম্রাজ্য জয় করেছিল, আঁধার বিশ্বে তৌহিদের বাণী শুনিয়েছিল। তোমাদেরই মাঝে থেকে বেরিয়ে আসুক, তোমাদের ইমাম দাঁড়াও তাঁর পতাকাতলে তাহরিমা বেঁধে। বলো, আল্লাহু আকবর, হাঁকো হায়দারি হাঁক, সপ্ত আসমান চাক হয়ে ঝরে পড়ুক খোদার রহমত, নবির দোয়া। চাঁদ সেতারা গলে পড়ুক কল্যাণের পাগল ঝোরা।
আর্ত-পীড়িত কোটি কোটি মজলুম ফরিয়াদ করছে, কে করবে এদের ত্রাণ? তোমাদের চর্বি জ্বালিয়ে জ্বালাও আবার দ্বীনের চেরাগ, এই অন্ধ পথহারা জাতিকে আলো দেখাও? তোমাদের অস্থিপঞ্জর দিয়ে গড়ে তোল পুলসেরাত। সেই পুলের উপর দিয়ে জয়যাত্রা করুক নূতন জাতি। তোমাদের শিক্ষা, তোমাদের জ্ঞান অর্জন, যদি তোমাদের মাঝেই নিঃশেষিত হয়ে যায়, তবে ভুলে যাও এ শিক্ষা, বর্জন করো এ জ্ঞানার্জন। নওকরির জন্য, দাসখত লিখার কায়দা-কানুন শেখার জন্য যদি তোমরা শিক্ষার ব্রত গ্রহণ কর, তবে জাহান্নামে যাক তোমাদের এই শিক্ষাপদ্ধতি, এই শিক্ষালয়।
তোমাদের শিক্ষায়তন তা স্কুলই হোক, আর কলেজই হোক, আর মাদ্রাসাই, হোক পীরের দরগার চেয়েও পবিত্র, মসজিদের মতোই পাক। এর অঙ্গনে যে দীক্ষা গ্রহণ কর, যে নিয়ত কর, জীবনে যদি সে ব্রত ফলপ্রসূ না হয় তবে কাজ কি এই জীবনের এক-তৃতীয়াংশ বাজে খরচ করে?
জরাগ্রস্ত পুরাতন পৃথিবী চেয়ে থাকে যুগে যুগে তোমাদের এই কিশোরদের এই তরুণদের মুখের পানে। তোমরা শোনাও তাকে তাজা তাজার গান, আর তোমাদের সেই প্রাণচঞ্চল সঙ্গীতের জাদুতে সে পাক নব-যৌবনের কান্তিশ্রী! তোমাদের বরণ করে দুলহিনের সাজে সেজে ষড়ঋতুর ডালা শিরে ধরে আজো সে চেয়ে আছে উন্মুখ প্রতীক্ষায় তোমাদের পানে। তোমাদের দক্ষিণ হস্তের দানে তার প্রতীক্ষার শূন্যতা কি পূর্ণ হবে না? কত কাজ তোমাদের ধরণীর দশদিক ভরে কত ধূলি, কত আবর্জনা, কত পাপ, কত বেদনা! তোমরা ছাড়া কে তার প্রতিকার করবে? কে তার এলাজ করবে? তোমাদের আত্মদানে, তোমাদের আয়ুর বিনিময়ে হবে তার মুক্তি। শত বিধি-নিষেধের, অনাচারের জিঞ্জির বন্দিনী এই পৃথিবী আজাদির আশায় ফরিয়াদ করছে তোমাদের প্রাণের দরবারে, তার এ আর্জি কি বিফল হবে? এই বাংলার না কি শতকরা পঞ্চান্ন জন মুসলমান। কিন্তু গুনতিতে সংখ্যাগরিষ্ঠ ছাড়া এই পঞ্চান্ন জনকে নিয়ে বাঙলার সত্যকার গৌরব করবার কতটুকু আছে, তা হিসাব করতে গেলে মনে হয় আমরা শতকরা পাঁচজন হলেই এ লজ্জার হাত থেকে বেঁচে যেতাম। বড় দুঃখে তাই বলেছিলাম,
“ভিতরের দিকে যত মরিয়াছি, বাহিরের দিকে তত
গুনতিতে মোরা বাড়িয়া চলেছি গরু-ছাগলের মত।”
এ লজ্জা, এই অপমানের গ্লানি থেকে তোমরা তরুণ যুবক বাঙলার মুসলিমকে বাঁচাও। সমাজের স্তরে স্তরে, তার গোপনতম কোণে কোণে, বোরকার অন্তরালে, আবরুর মিথ্যা আবরণে যে আবর্জনা পুঞ্জীভূত হয়ে উঠেছে, তার নিরাকরণ করো।
ইসলামের প্রথম ঊষার ক্ষণে, সুবহে সাদিকের কালে যে কল্যাণী নারীশক্তি রূপে আমাদের দক্ষিণ পার্শ্বে অবস্থান করে আমাদের শুধু সহধর্মিণী নয়, সহকর্মিণী হয়েছিলেন যে নারী সর্বপ্রথম স্বীকার করলেন আল্লাহকে, তাঁর রসুলকে। তাঁকেই আমরা রেখেছি দুঃখের দূরতম দুর্গে বন্দিনী করে সকল আনন্দের, সকল খুশির হিসসায় মাহরুম করে। তাই আমাদের সকল শুভ-কাজ, কল্যাণ-উৎসব আজ শ্রীহীন, রূপহীন, প্রাণহীন। তোমরা অনাগত যুগের মশালবর্দার তোমাদের অর্ধেক আসন ছেড়ে দাও কল্যাণী নারীকে। দূর করে দাও তাঁদের সামনের ঐ অসুন্দর চটের পর্দা। যে পর্দার কুশ্রীতা ইসলাম জগতের, মুসলিম জাহানের আর কোথাও নেই। দেখবে তোমাদের কর্তব্যের কঠোরতা, জীবন পথের দূরধিগম্যতা হয়ে উঠবে সুন্দরের স্পর্শে পুষ্প পেলব। কর্মে পাবে প্রেরণা, মনে পাবে সুন্দরের স্পর্শ, কল্যাণের ইঙ্গিত। সম্মান দেওয়ার নামে এতদিন আমরা আমাদের মাতা, ভগিনী, কন্যা, জায়াদের যে অপমান করেছি আজও তার প্রায়শ্চিত্ত যদি না করি তবে কোনো জন্মেও এ জাতির আর মুক্তি হবে না।
তারও আগে তোমাদের কর্তব্য সম্মিলিত হওয়া, সঙ্ঘবদ্ধ হওয়া। যে ইখওয়ান সর্বজনীন ভ্রাতৃত্ব, যে একতা ছিল মুসলিম উম্মাহর আদর্শ, যার জোরে মুসলিম জাতি এক শতাব্দীর মধ্যে পৃথিবী জয় করেছিলো, আজ আমাদের সে একতা নেই হিংসায়, ঈর্ষায়, কলহে, ঐক্যহীন হয়ে বিচ্ছিন্ন। দেয়ালের পর দেয়াল তুলে আমরা ভেদ-বিভেদের জিন্দানখানার সৃষ্টি করেছি; কত তার নাম শিয়া, সুন্নি, শেখ, সৈয়দ, মুঘল, পাঠান, হানাফি, শাফি, হাম্বলি, মালেকি, লা-মাজহাবি, ওয়াহাবী ও আরো
কত শত দল। এই শত দলকে একটি বোটায়, একটি মৃণালের বন্ধনে বাঁধতে পার তোমরাই। শতধাবিচ্ছিন্ন এই শতদলকে এক সামিল করো, এক জামাত করো সকল ভেদ-বিভেদের প্রাচীর নিষ্ঠুর আঘাতে ভেঙে ফেল।
বুলবুল
অগ্রহায়ণ, ১৩৪৪