আফ্রিকায় প্রভাবশালী পরাশক্তিগুলোকে আরো দুর্বল করতে এবং তাদের প্রভাব নিঃশেষ করতে রাশিয়া সে শক্তিগুলোর বিরুদ্ধে নতুন কৌশল প্রণয়ন করেছে।
আফ্রিকা নিয়ে রাশিয়ার আগ্রহ কোন সাময়িক বিষয় নয়, বরং একটি কৌশলগত পদক্ষেপ। বিগত বছরগুলোতে আফ্রিকার অন্যতম ঔপনিবেশিক শক্তি ফ্রান্স, মহাদেশটিতে ক্রমাগতভাবে কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। রাশিয়া এখন চাচ্ছে আফ্রিকায় ফ্রান্সের বিকল্প হয়ে উঠতে।
এই কৌশলের নবিনতর পদক্ষেপ হিসেবে রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সেরগেই ল্যাভরভ এবং উপ প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইউনুস বেক ইয়েভকুরভ বেশ কয়েকটি আফ্রিকান দেশে ধারাবাহিকভাবে সফর করেছেন।
এসব সফরে রাশিয়ান কূটনৈতিকদের চারটি গন্তব্য ছিল : গিনি, কঙ্গো প্রজাতন্ত্র, বুরকিনা ফাসো এবং শাদ। অন্যদিকে সামরিক কর্মকর্তারা লিবিয়া সফর শেষে নাইজার এবং মালি সফর করেন।
ল্যাভরভ ৩ রা জুন, ২০২৪ শে গিনি ভ্রমণের মধ্য দিয়ে তার কূটনৈতিক সফর শুরু করেন। যেখানে রুসাল সহ বেশ কিছু রাশিয়ান কোম্পানি কাজ করছে। রুশ দূতাবাসের তথ্যমতে এই রুসাল রাশিয়ার এ্যালুমিনিয়াম প্লান্টগুলোতে কাঁচামাল সরবরাহ করে, এ খাতের মোট উৎপাদনের শতকরা ২৫ ভাগই রুসালের অবদান।
জুনের ৪ তারিখ তিনি কঙ্গো প্রজাতন্ত্রে পৌঁছান, যেখানে শুধু ২০২৩ সালের জানুয়ারী থেকে এপ্রিল মাসের মধ্যে রাশিয়ার সাথে বাণিজ্যের মাত্রা আচানক ৮৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছিল। সফরের সময় আলোচিত বিষয়াবলীর মধ্যে ছিল উভয়পক্ষের মধ্যে সামরিক প্রকৌশলগত সহযোগীতা বৃদ্ধি করা।
কঙ্গোতে কিছু রুশ সামরিক বিশেষজ্ঞ পাঠানো হবে মর্মে ২০১৯ সালে দুই দেশের মধ্যে একটি চুক্তি হয়েছিল। এখনও দেশটিতে অত্যাধুনিক রুশ সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ নিয়ে দর কষাকষি চলছে।
জুনের ৫ তারিখ, ল্যাভরভ বুরকিনা ফাসো পৌঁছান। যে দেশটিতে বর্তমান মস্কোর সাথে ঘনিষ্ঠ সামরিক সরকারের শাসন জারী রয়েছে। সেখানে তিনি জানান যে, “বুরকিনা ফাসোতে রুশ প্রশিক্ষকদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে।“
বুরকিনা ফাসোতে ল্যাভরভের সফরকালীন বক্তব্য থেকে তাস নিউজ এজেন্সি উদ্ধৃতি করেছে-“ প্রেসিডেন্ট ইবরাহীম তাওরে ক্ষমতায় আসার পরে আমাদের দেশের সাথে সর্বপ্রথম যে চুক্তি হয়, তখন থেকেই আমরা খুব নিবিড়ভাবে সামরিক এবং সমর প্রকৌশল খাত সহ সকল ক্ষেত্রে দ্বিপাক্ষিক সহযোগীতা বজায় রেখেছি।“
একই দিনে ল্যাভরভ চতুর্থ দেশ হিসেবে শাদে পৌঁছান এবং বলেন, “আমি আপনাদের নিশ্চয়তা দিতে পারি যে আমাদের বন্ধুত্ব কোনভাবেই আমাদের সাথে থাকা ফ্রান্সের সম্পর্ককে প্রভাবিত করবেনা। ফ্রান্সের পদ্ধতিই ভিন্ন; তারা এই মূলনীতি মেনে চলে যে, হয় তুমি আমার সাথে, নয় তুমি আমার বিরুদ্ধে।”
বুরকিনা ফাসো এবং শাদের সাথে ইতিহাসে প্রথমবারের মত রাশিয়ার সংযোগ স্থাপিত হলো এই সফরের মধ্য দিয়ে, যা গত দুই বছরের মধ্যে ল্যাভরভের ষষ্ঠ আফ্রিকা মহাদেশ সফরের একটা অংশ ছিল।
জুলাই, ২০২২ সালে রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী মিশর, ইথিওপিয়া , উগান্ডা, কঙ্গো প্রজাতন্ত্র ভ্রমণ করেন। এরপরে তিনি জানুয়ারী, ২০২৩ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা, ইসওয়াতিনি, এ্যাঙ্গোলা এবং ইরিত্রিয়া সফর করেন। একই বছর ফেব্রুয়ারীতে তিনি মালি, মৌরিতানিয়া এবং সুদানেও সফর করেন। মে মাসের শেষ এবং জুনের শুরতে কেনিয়া, বুরুন্ডি, মোজাম্বিক সফর করেন। ২০২৩ সালে ব্রিকস সম্মেলনে যোগ দিতে আগস্ট মাসে তিনি সফর করেন দক্ষিণ আফ্রিকায়।
সামরিক সফর
সমান্তরালভাবে নর্থ আফ্রিকান নিউজ ২০২৪ সালের জুনের ২ তারিখ প্রতিবেদন করে যে, পূর্বাঞ্চলের বিদ্রোহী জেনারেল, খলিফা হাফতার জুনের শুরতে রাজমায় অবস্থিত জেনারেল কমান্ড হেডকোয়ার্টারে রুশ উপ প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ইউনুস বেক ইয়েভকুরভকে স্বাগত জানান।
একই উৎসের তথ্যমতে, সামরিক প্রশিক্ষণ এবং সক্ষমতা বৃদ্ধ সহ সামরিক ও অর্থনৈতিক খাতে তাদের ইতিবাচক অগ্রগতির গুরুত্ব তুলে ধরে খলিফা হাফতার দুই দেশের ভ্রাতৃপ্রতীম সম্পর্কের বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
রাশিয়ার সামরিক দূত সন্ত্রাসবাদ এবং উগ্রতাবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে পারষ্পারিক সহায়তার দিকে ইঙ্গিত করে লিবিয়ার জেনারেল কমান্ড ফোর্সের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে তার দেশের অবদানের কথা তুল ধরেন।
নোভা নিউজের খবর অনুসারে, ২০২৪ এর ৪ জুন ইয়েভকুরভ লিবিয়ার বেনগাযি থেকে নাইজারে পৌঁছান।
একই সূত্র উল্লেখ করে যে, রাশিয়ান সামরিক কর্মকর্তা নাইজারের বর্তমান সামরিক সরকারের প্রধান আব্দুর রহমান ছিয়ানি এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রী সালিফৌ মোদির সাথে সাক্ষাত করেন। যেখানে সুরক্ষা, প্রতিরক্ষা এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন সহ বিভিন্ন খাতে দ্বিপাক্ষিক সহযোগীতার আলোচনা স্থান পায়।
উভয়পক্ষ আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সমন্বিত সমাধান খোঁজার লক্ষ্যে পারস্পারিক শ্রদ্ধা এবং বিশ্বাসের ভিত্তিতে কৌশলগত অংশিদারিত্ব শক্তিশালী করার আগ্রহ প্রকাশ করে। ইয়েভকুরভ নাইজারকে তাদের সকল বৈধ উদ্যোগে সমর্থন করার জন্য রাশিয়ার প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেছেন।
ইয়েভকুরভ প্রকৃতপক্ষে নাইজার এবং রাশিয়ার মধ্যে একাধিক খাতে সহযোগিতার একটি স্মারক স্বাক্ষর করতে ৪ ডিসেম্বর, ২০২৩-এ নিয়ামে এসেছিলেন।
আফ্রিনজ ওয়েবসাইট ৫ জুন, ২০২৪-এ রিপোর্ট করেছে যে রাশিয়ার উপ-প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ইউনুস বেক ইয়েভকুরভ মালির প্রতিরক্ষামন্ত্রী সাদিও কামারার সাথে দেখা করেছেন।
সূত্রটি উল্লেখ করেছে যে মন্ত্রী সাদিওর সাথে মালিতে এই বৈঠকে দুই দেশের মাঝে ইতোমধ্যে ভালোভাবে এগিয়ে চলা সামরিক সহযোগিতার দিকে মনোনিবেশ করা হয়।
এক দশকেরও বেশি সময় ধরে চলমান সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে নিরলস যুদ্ধে মালিকে সমর্থন করার জন্য রাশিয়া তার প্রস্তুতি এবং অবিচল প্রতিশ্রুতি কখনোই লুকানোর চেষ্টা করেনি।
ওয়েবসাইটটি উল্লেখ করেছে যে “এই সমর্থনের জন্য ধন্যবাদ, মালিয়ান সেনাবাহিনী সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলি থেকে অঞ্চলগুলির সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছে।”
প্রভাব বলয় নষ্ট করা
রাশিয়ার এই পদক্ষেপ সমূহের ব্যাখ্যায়, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও আফ্রিকা বিষয়ক বিশেষজ্ঞ আহমেদ নুরুদ্দীন বলেছেন যে রাশিয়ার অভিষ্ঠ লক্ষ্যগুলি তার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সফরের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত, বিশেষ করে এক বছরেরও কম সময়ের মধ্যে চার চার দফা সফর এটারই ইঙ্গিত দেয় যে, ন্যাটো দেশগুলির দ্বারা আরোপিত একঘরে করন থেকে রাশিয়া যেকোন মূল্যে মুক্তি পেতে চাইছে।
তিনি আল-ইস্তিকলালকে বলেন যে এই সফর ও পদক্ষেপের মাধ্যমে রাশিয়ার লক্ষ্য হচ্ছে, সামগ্রিকভাবে আফ্রিকায় ফরাসি এবং পশ্চিমা প্রভাব বলয় ভেঙে ফেলা। সকল পক্ষকে ক্লান্ত করে দেবার কৌশল প্রয়োগ করে তাদের দুর্বল ও নির্মূল করে দেয়া। এখানে, “পক্ষ” বলতে আফ্রিকান দেশগুলি, লাতিন আমেরিকার দেশগুলি এবং এশিয়ান দেশগুলি উদ্দেশ্য।
বিশেষভাবে নুরুদ্দীন দেখান যে “২০১৪ সালে ক্রিমিয়াকে সংযুক্ত করার পর রাশিয়ার গৃহীত এই কৌশলটি আফ্রিকা অঞ্চলে পশ্চিমা প্রভাবকে দুর্বল করে চলেছে। এবং এখানে রাশিয়া উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছে।”
নুরুদ্দীন আরও ব্যাখ্যা করেছেন কীভাবে এই কৌশলটিতে নিরাপত্তা এবং সমর সংক্রান্ত দিকগুলি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। যেমন প্রাথমিকভাবে বিশেষজ্ঞদের দ্বারা সামরিক সহায়তা প্রদান এবং আফ্রিকান শিক্ষার্থীদের রাশিয়ান ইনস্টিটিউটে প্রবেশ করানো। আবার, পুরো আফ্রিকা মহাদেশ জুড়ে থাকা দেশগুলিতে ওয়াগনার গ্রুপ বাহিনী মোতায়েন বৃদ্ধির মাধ্যমেও এই কৌশলের লক্ষ্য অর্জিত হচ্ছে।
বিশেষভাবে তিনি উল্লেখ করেন, “এই সমস্ত কিছু রাশিয়াকে পশ্চিমের বিরুদ্ধে উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক স্বার্থ অর্জন করতে সাহায্য করেছে, বিশেষ করে ফ্রান্সের বিরুদ্ধে ; যখন আমরা ফ্রান্সকে মালি থেকে অপমানিত এবং নাইজার, বুর্কিনা ফাসো এবং মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্র থেকে তার রাষ্ট্রদূতকে বহিষ্কার হতে দেখেছি।”
তিনি জোর দিয়ে বলেন, “এই দেশগুলি, তাদের অর্থনৈতিক দুর্বলতা এবং ভঙ্গুরতা সত্ত্বেও, একাধিক স্তরে ফরাসি অর্থনীতির জন্য হুমকিস্বরূপ। উদাহরণস্বরূপ, ফ্রান্স দ্বারা শোষিত হয়ে আসা নাইজারের একটি ইউরেনিয়াম খনি রয়েছে যা ফ্রান্সের পারমাণবিক শক্তির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।”
“উপরন্তু, প্যারিস সাধারণত উপকূলীয় এবং আফ্রিকান দেশগুলিতে প্রচুর পরিমাণে সোনা, হীরা এবং মূল্যবান ধাতব খনির উপর শোষণ পরিচালনা করে।”
তাই, নুরদ্দীন পুনর্ব্যক্ত করেন যে রাশিয়া যখন ফ্রান্সকে চারটি দেশ থেকে বহিষ্কার হওয়াকে কাজে লাগিয়ে ময়দানে আসে, তখন এটি একদিকে যেমন সরাসরি ফ্রান্সের অর্থনীতিকে হুমকির মুখে ফেলে দেয় এবং অন্যদিকে, আফ্রিকার এই দেশগুলিতে ফ্রান্সের কৌশলগত নিরাপত্তা এবং গুরুত্বপূর্ণ স্বার্থকে হুমকির মুখে ফেলে দেয়।
অন্যদিকে, ইউরেশিয়া-আরব স্টাডিজ সেন্টার (সিএইএস) এর গবেষক দিমিত্রি ব্রিডজে বলেছেন যে রাশিয়া এখন বিভিন্ন আফ্রিকান দেশ সমূহের সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলতে এবং তাদের কাছে যেতে আগ্রহী। এটা আফ্রিকায় যেকোন সময় পা রাখার প্রয়োজনীয়তার উপর ভিত্তি করে তার গৃহীত কৌশল।
তিনি আল-ইস্তিকলালকে এটা পরিষ্কার করেন যে, ল্যাভরভের এই সফরটিই প্রমাণ হিসবে যথেষ্ট যে রাশিয়া আফ্রিকায় ফ্রান্সের দুর্বল নীতি থেকে উপকৃত হয় এবং আফ্রিকান দেশগুলিতে ফ্রান্সের প্রাক্তন ঔপনিবেশিক ভূমিকার জন্য প্রত্যাখ্যান প্রকল্পে বিনিয়োগ করে।
“বিশেষ করে ফ্রান্স যেহেতু আফ্রিকাকে কিছুই দেয়নি; না জনগণের মুক্তিকে সমর্থন করে, না মহাদেশটির জন্য ভাল একটি অর্থনৈতিক মডেল হিসাবে কাজ করে। উল্টো ফ্রান্সের দৃষ্টিভঙ্গি হলো আফ্রিকান এই দেশগুলির পলিসিকে ম্যানিপুলেট করা এবং তাদের খনিজ সম্পদ লুট করা।”
রাশিয়ান এই একাডেমিক গবেষক জোর দিয়ে বলেন যে মস্কো পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে আফ্রিকান বিষয়গুলোতে সরাসরি নিযুক্ত রয়েছে, “সাংস্কৃতিক এন্ট্রিপয়েন্টগুলোর মধ্য দিয়ে রাশিয়া আফ্রিকা মহাদেশে তার সফট পাওয়ারকে আরো শক্তিশালী করতে চায়। যেমন শিক্ষা, স্নাতক পর্যায়ের দক্ষতা বৃদ্ধি, রুশ ভাষার প্রসার ও পাঠদান ইত্যাদি।”
ব্রিডজে বিশেষভাবে উল্লেখ করেন যে রাশিয়া প্রশিক্ষণের মধ্য দিয়ে আফ্রিকান সামরিক নেতাদের একটি নতুন অভিজাত শ্রেণী তৈরি করতে কাজ করছে, যা ভবিষ্যতে আফ্রিকার দেশীয় নীতিতে বেশ প্রভাব রাখবে। এছাড়াও, বেশ কয়েকটি আফ্রিকান দেশের সহযোগিতার জন্য প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে আফ্রিকা কর্পস; এমন একটি প্রকল্প যা আফ্রিকা মহাদেশের ভবিষ্যত বিনির্মাণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
তিনি আরো উল্লেখ করেন যে আফ্রিকায় সোভিয়েত নীতির রেখে যাওয়া উত্তরাধিকার থেকে রাশিয়া উপকৃত হচ্ছে, কেননা আফ্রিকায় ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক নীতির তুলনায় এটি ততোটা নেতিবাচক নয়। মস্কো একটি বহুমাত্রিক ডাইমেনশনের জন্য এই পলিসি তৈরি করেছে।
তিনি এ ব্যাপারটাও একেবারে উড়িয়ে দেননি যে রাশিয়া বেশ কয়েকটি আফ্রিকান দেশের সাথে তার সম্পর্ক গভীর করবে। যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার অধীনে থাকা রাশিয়ার অর্থনীতির সাথে পাশ্চাত্য, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সংঘর্ষের একটি ক্ষেত্র তৈরি করবে।
বিশেষজ্ঞ এই ব্যক্তি আরও উল্লেখ করেন যে অভিবাসন এবং বৈদেশিক সম্পর্ক সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ইউনিয়ন নীতিগুলির ব্যর্থতার আভাস হিসেবে বেশিরভাগ ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশে চরম ডানপন্থী প্রভাবের উত্থান ঘটছে। এর মধ্য দিয়েই রুশ-পশ্চিমা প্রতিযোগিতা অব্যাহত থাকবে ।
রুশ কর্মকাণ্ড থেকে আফ্রিকা কী সুবিধা পাবে সে সম্পর্কে এক প্রশ্নের জবাবে, আহমেদ নুরুদ্দীন বলেছেন যে প্রথম সুবিধাটি হলো কৌশলগত অংশীদারদের মধ্যে বৈচিত্র্য আনা। এটি সাবেক ঔপনিবেশিক দেশগুলি বা প্রভাবশালী রাষ্ট্রগুলির বিরুদ্ধে বৃহত্তর সার্বভৌম লাভ অর্জনের জন্য কৌশলের নতুন এক মানদন্ড স্থাপন করবে।
অন্য একটি সাক্ষাতকারে তিনি আল-ইস্তিকলালকে বলেছিলেন, “আমরা দেখতে পাই যে আফ্রিকান দেশগুলি রাশিয়া থেকে গম আমদানির উপর প্রচুর নির্ভরশীল, ২০% গম রাশিয়া থেকে আমদানি হয়ে আসে। তাছাড়া, আফ্রিকার খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে রাশিয়াও অন্যান্য প্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রী রপ্তানি করে।”
COVID-19 সংকট আফ্রিকার কাছে প্রমাণ করেছে যে রাশিয়ার উপর নির্ভর করা যেতে পারে, কারণ এটি এমন সময়ে বেশ কয়েকটি আফ্রিকান দেশে ভ্যাকসিন সরবরাহ করেছিল যখন এই ভ্যাকসিনগুলি বিশ্বব্যাপী দুষ্প্রাপ্য ছিল। আবার বিশ্ব প্রত্যক্ষ করেছে কীভাবে সেসময় ইউরোপ নিজের দিকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল।
নুরুদ্দিন আরও বলেন যে রাশিয়া বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অস্ত্রের উৎস। এদিকে অস্ত্র প্রদানের ক্ষেত্রে মূলত আফ্রিকান দেশগুলোকে ব্ল্যাকমেইল করার লক্ষ্যে পাশ্চাত্য অন্যায্যভাবে এক প্রকার অধিকার দাবি করে; যেমন মানবাধিকার, স্বাধীনতা এবং গণতন্ত্র ইত্যাদী। অথচ আসল উদ্দেশ্য এসবের ছদ্মবেশে আফ্রিকান দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ বিষয় এবং নীতিসমূহে নাক গলানো। অথচ পাশ্চাত্যের মত এই অনধিকার চর্চা না করেই আফ্রিকার বাজারে রাশিয়া সেসব অস্ত্র সরবরাহ করে চলেছে।
ফরাসি দৃষ্টিকোণ
ফরাসি সহ ইউরোপীয় মিডিয়া, আফ্রিকায় রাশিয়ার ক্রমবর্ধমান ভূমিকাকে উপেক্ষা করেনি। বরং নিশ্চিত করেছে যে মস্কো আফ্রিকা মহাদেশে তার প্রভাব বাড়াতে চায়। যেমনটি উঠে এসেছে ফরাসি ওয়েবসাইট আফ্রিকা নিউজের ৭ জুন, ২০২৪ -এর সম্পাদকীয়তে।
ওয়েবসাইটটি উল্লেখ করেছে যে ফ্রান্স এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো ঐতিহ্যবাহী মিত্রদের বিকল্প হিসেবে রাশিয়া এই অঞ্চলে ক্রমবর্ধমান সংখ্যক আফ্রিকান সরকারের জন্য পছন্দের নিরাপত্তা অংশীদার হয়ে উঠেছে।
এতে আরো বলা হয় যে, মস্কো প্রাইভেট সিকিউরিটি কোম্পানি ওয়াগনার এবং এর সম্ভাব্য উত্তরসূরি আফ্রিকান লিজিওনের ব্যবহারের মাধ্যমে আফ্রিকান দেশগুলির সাথে তার সামরিক সহযোগিতা উল্লেখযোগ্যভাবে প্রসারিত করেছে। যেখানে রাশিয়ান ভাড়াটে সৈন্যরা আফ্রিকান নেতাদের রক্ষা করা থেকে শুরু করে চরমপন্থীদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে দেশগুলিকে সহায়তা করে থাকে।
এই প্রবন্ধে উঠে এসেছে যে রাশিয়া ইউক্রেনে তার আগ্রাসনের বিষয়ে ৫৪ টি আফ্রিকান দেশের অনেকের কাছ থেকে রাজনৈতিক সমর্থন বা কমপক্ষে নিরপেক্ষতা চায়৷ কেননা আফ্রিকান দেশগুলি জাতিসংঘের বৃহত্তম ভোটিং ব্লক গঠন করে।
সম্পাদকীয়টিতে অভিযোগ করা হয়েছে যে আফ্রিকান দেশসমূহ এবং পাশ্চাত্যের মধ্যে সম্পর্ক নষ্ট করার জন্য বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য রাশিয়ার সাথে সংশ্লিষ্ট এসব সংস্থা কাজ করে যাচ্ছে।
একই উৎসের তথ্যমতে, সাবেক ঔপনিবেশিক শক্তি ফ্রান্সের প্রতি জনগণের হতাশা ও ক্ষোভকে রাশিয়া রাজনৈতিক অস্থিরতা ও ক্রোধে পরিণত করেছে এবং সেসব দেশে অভ্যুত্থান ঘটিয়েছে।
সামরিক অভ্যুত্থানগুলি ফ্রান্স এবং পাশ্চাত্য ঘেঁষা সরকারগুলিকে ক্ষমতাচ্যুত করেছে। কিন্তু, বেকারত্ব এবং অন্যান্য অসুবিধা দূর করতে খুব একটা কাজ করেনি।
রাশিয়া রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ না করেই নিরাপত্তা সহায়তা প্রদান করে। যা রাশিয়াকে সাম্প্রতিক বছরগুলিতে ক্ষমতা দখলকারী সামরিক জান্তার অধীনে থাকা মালি, নাইজার এবং বুরকিনা ফাসোর মতো দেশগুলিতে একটি আকর্ষণীয় অংশীদার করে তোলে। এর বিনিময়ে, মস্কো আফ্রিকান দেশগুলোর কাছে খনিজ ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধা চায়।
আফ্রিকা নিউজ উল্লেখ করেছে যে “রাশিয়া মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্রে সোনা এবং হীরা, কঙ্গোতে কোবাল্ট, সুদানে সোনা এবং তেল, মাদাগাস্কারে ক্রোমাইট এবং জিম্বাবুয়েতে প্ল্যাটিনাম এবং হীরা, সেইসাথে নামিবিয়াতে ইউরেনিয়ামের অ্যাক্সেস পেয়েছে।“
এতে আরও বলা হয়েছে যে, ওয়াগনার এবং রাশিয়া ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেন আক্রমণের পর থেকে আফ্রিকান সোনার বাণিজ্য থেকে প্রায় ২.৫ বিলিয়ন ডলার আয় করেছে।
বিপরীতে, ২৮ মে ২০২৪ -এ ফরাসি ম্যাগাজিন লে গ্র্যান্ড কন্টিনেন্ট কর্তৃক প্রকাশিত “”Militarizing Africa: Soviet Assets for Russian Doctrine,” শিরোনামের একটি গবেষণায় যুক্তি দেখানো হয় যে ” আফ্রিকা মহাদেশের সাথে দীর্ঘমেয়াদী লেনদেনের ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করার জন্য রাশিয়ার একটি কৌশল এবং পরিকল্পনাগত অভাব রয়ে গিয়েছে।”
সমীক্ষায় উল্লেখ করা হয় যে “আফ্রিকাতে সোভিয়েত নীতি পশ্চিমা পুঁজিবাদের বিকল্প প্রস্তাবনা হিসেবে একটি আদর্শের মধ্যে নিহিত ছিল। কিন্তু, বর্তমানে আফ্রিকায় রাশিয়ার কৌশলগুলি সাধারণত সুবিধাবাদী, মৌলিক সম্পদের উৎস সমূহের দখল এবং আন্তর্জাতিক ফোরামে রাজনৈতিক পুঁজি অর্জনের দিকেই মনোনিবেশ করে।”
একই সূত্রমতে, “আফ্রিকা মহাদেশে চলমান অস্থিতিশীলতার মধ্যে ক্রমবর্ধমান প্রতিযোগিতার কারণেই সেখানে রাশিয়ার পুনরুত্থান ঘটে চলেছে।”
“রাশিয়ার পাশ্চাত্য বিরোধী মতবাদ অনেক আফ্রিকান অভিজাতের স্বার্থের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। তারা ঔপনিবেশিক দায় সম্পর্কে ন্যায্য ভাবেই ঐতিহাসিক অভিযোগ উত্থাপন করে এবং পাশ্চাত্যের সাথে একটি বস্তুনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপনে ব্যর্থ হওয়াকে রাশিয়ার সাথে তাদের ক্রমবর্ধমান সম্পর্কের ন্যায্যতা প্রমাণের দলিল হিসবে পেশ করে।”
উপসংহারে এসে এই প্রতিবেদন বলছে, “এই পরিস্থিতিতে, রাশিয়ার আক্রমণের মুখে ইউক্রেন – আফ্রিকান দেশগুলিকে তার পক্ষে জমায়েত করার মত এক বৃহত্তর চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে।”
(মূলঃ আল-ইস্তিকলাল পত্রিকা
অনুবাদঃ হিশাম আল নোমান)