ভাষা শুধুমাত্র ভাব প্রকাশের বাহন নয়, ভাষা হচ্ছে একটি সংস্কৃতির মূল ভিত্তি এবং বাহক। এজন্য একটা ভাষার ভাণ্ডার যতবেশি শক্তিশালী ও সমৃদ্ধ হবে, ওই ভাষার সংস্কৃতি ও সমাজ ততবেশি সামনের দিকে এগিয়ে যাবে। একইসাথে ভাষা কেবল সাহিত্য সংস্কৃতির বাহন হিসেবেই নয়, একটি স্বাধীন জাতির মূল প্রাণসত্তাও বটে। বাংলা ভাষা জনসংখ্যার দিক থেকে, ইতিহাসের দিক থেকে মুসলিম উম্মাহর দ্বিতীয় বৃহত্তম ভাষা, আমাদের জাতীয় মর্যাদার প্রতীক। এজন্য ঢাকাও শুধুমাত্র বাংলাদেশের রাজধানী নয়, একটি দেশের প্রধান শহর নয়, এটি মুসলিম উম্মাহর দ্বিতীয় বৃহত্তম ভাষা ‘বাংলা ভাষা’র রাজধানী। এই অঞ্চলে মানুষের আশা, জীবনসংগ্রাম, আনন্দ-বেদনা, গৌরবগাঁথার এক অনন্য প্রতীক হিসেবে বাংলা ভাষা আমাদের সামনে সর্বদাই দীপ্তিমান। নদীমাতৃক বাংলায় চিরসবুজ প্রান্তর থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিকভাবে মুসলিম উম্মাহর অধ্যুষিত বিভিন্ন দেশে এই বাংলা ভাষা সগৌরবে এই অঞ্চলের প্রাণসত্তার প্রতিনিধিত্ব করে।
পশ্চিমের বিখ্যাত ভাবুক ও বুদ্ধিজীবী নোয়াম চমস্কির ভাষায়-
“ভাষা কতিপয় শব্দের সমষ্টি নয়, এটা একইসাথে একটি সংস্কৃতি, একটি ঐতিহ্য, একটি জাতিসত্তার একীকরণ, একটি সামগ্রিক ইতিহাস যা একটি সমাজকে তৈরি করে। এর সবকিছুই একটি ভাষার সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত।”
যেহেতু আমরা সকলেই জানি যে, সংস্কৃতির ভিত্তি হচ্ছে ভাষা। তাই ভাষার ভিত্তিকে শক্তিশালী না করে সাংস্কৃতিক ভিত্তি নির্মাণ অসম্ভব। যার কারণে আমাদের এ অঞ্চলে মুসলিম সালতানাতের সময়কালে কবি, সাহিত্যিক, বড় বড় চিন্তাবিদগণ এই ভাষাতেই তারা তাদের কাজগুলোকে সম্পাদন করেছেন। যেমন- বাংলা ভাষায় মুসলিম সুলতানদের পৃষ্ঠপোষকতা এবং বাংলা ভাষার সার্বিক বিকাশে মুসলিম কবি ও চিন্তাবিদদের অবদানের প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত হলো শাহ মোহাম্মদ সগীর লিখিত অমর সাহিত্যকর্ম ‘ইউসুফ জোলেখা’। ‘ইউসুফ জোলেখা’ সাহিত্যিক উৎকর্ষ, ভাষার ব্যবহার, শব্দের বৈচিত্র্য, নানামুখী রূপক ব্যবহার এককথায় একটি অনন্য সাধারণ এবং পূর্ণাঙ্গ সাহিত্যকর্ম হিসেবে গৃহীত। তাঁর এই অনন্য সাহিত্যকর্ম বাংলা সাহিত্যে বিপ্লবের সূচনা করে।
বাংলা ভাষার মহাকবি আলাওল ছিলেন তার সময়ের সবথেকে বড় ঔপন্যাসিক ও কালজয়ী কাব্যের স্রষ্টা। পক্ষান্তরে, ওই সময়ের আরেক কবি শেক্সপিয়র, যিনি একই সময়ে ইংরেজি ভাষাকে এক অর্থে জীবন দান করেছেন, তিনিও কিন্তু বিকশিত হয়েছেন আলাওলের পরে। এমনকি শেক্সপিয়ার মারা যাওয়ার দীর্ঘদিন পর্যন্ত তাকে সে অর্থে আবিষ্কার করা হয়নি। অর্থাৎ ইংরেজি ভাষার বহু পূর্বেই বাংলা ভাষা আলাওলদের হাত ধরে উৎকর্ষ লাভ করেছিল এবং তার সে সমৃদ্ধশালী অবস্থান ধরে রেখেই নিরবচ্ছিন্নভাবে তৎকালীন সমাজ এবং রাষ্ট্রকে পরিচালনা করে যাচ্ছিল। এবং গড়ে তুলেছিল এক বৈচিত্রময় অথচ শক্তিশালী সাংস্কৃ তিক ভিত্তি। পাশাপাশি কবি ফয়জুল্লাহর ‘গোরক্ষ বিজয়’, ‘গাজী বিজয়’, কবি আফজাল আলীর ‘নসিহতনামা’, কবি জৈনুদ্দিনের ‘রসুল বিজয়’, কবি মুজাম্মিলের ‘সায়ৎনামা’, দৌলত উজিরের ‘লায়লী মজনু’, মুহম্মদ কবীরের ‘মনোহর মধুমালতী’ ইত্যাদির ন্যায় অজস্র সাহিত্য বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধির সর্বোচ্চাসনে অধিষ্ঠিত করে। আর এ সাহিত্যরাজির অধিকাংশই ১৫ শতাব্দীর আগে লিখিত। শেক্সপিয়রের হাত ধরেই ইংরেজি ভাষা একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়। কিন্তু শাহ মোহাম্মদ সগীর থেকে শুরু করে এসকল বড় বড় কবিদের সাহিত্য পড়লেই বুঝা যায়, ইংরেজি ভাষা যখন কেবল গঠনকালীন পর্যায়ে বিদ্যমান, বাংলা ভাষা তখন বিশ্বসাহিত্যের দরবারে গনগনে সূর্য হয়ে বিরাজ করছে।
সে জায়গা থেকে বাংলা ভাষার সমৃদ্ধির পেছনে মুসলমানদের অবদান, তাদের ঐতিহাসিক ভিত্তিস্থাপনের বর্ণনা দু-চার লাইনে ব্যাখ্যা করলে তা অসমাপ্ত রয়ে যাবে এবং বাংলা ভাষার সমৃদ্ধশালী ইতিহাস ও উপাখ্যানের প্রতিও অবিচার করা হবে। ভাষার সমৃদ্ধির বিবেচনায় চিন্তা করতে গেলে অন্যান্য সব অঞ্চল বাদ দিয়ে যদি আফ্রিকার দিকে তাকাই; সবথেকে আশ্চর্যজনক বিষয় হলো আফ্রিকার মত বিশাল দেশে কোনো নিজস্ব ভাষা নেই বললেই চলে। মরক্কো, আলজেরিয়ায় ফ্রেঞ্চ সাম্রাজ্যবাদীতায় তাদের নিজস্ব ভাষা যেন আজ বিলুপ্ত। সেখানে,
দুইশ বছরের ঔপনিবেশিক শাসন শোষণের শিকার হয়েও আমাদের মাতৃভাষা বাংলা সগৌরবে টিকে আছে।
লিপি থেকে শুরু করে বাংলা ভাষার সম্পূর্ণ প্যাটার্ন আমাদের নিজস্ব।
আমাদের মৌখিক এবং লিখিত ভাষায় পার্থক্য নেই। একটি ভাষাকে বিচার করার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কিছু সূচক এগুলো। এর আলোকে দেখলেও বাংলা ভাষার ঐতিহাসিক, চৈন্তিক ও সাহিত্যগত ভিত্তি কতটা শক্তিশালী বিচার করা যায়। আর এতে আমরা দেখতে পাই, বাংলা ভাষার ভিত্তি আসলে কতটা শক্তিশালী তা সহজেই অনুমেয়।
ইতিহাস পর্যালোচনা করলে আমরা দেখি যে, উপমহাদেশ এবং সমগ্র বিশ্ব ইতিহাসে বাংলা অঞ্চল অন্যতম সর্বাধিক গুরুত্ববহ একটি অঞ্চল। আর এ গুরুত্বের একটি বৃহদাংশই জুড়ে রয়েছে বাংলাদেশের সমৃদ্ধ ভাষা ও সাহিত্য। প্রাক-মুসলিম আমলে বাংলা ভাষা অত্যন্ত দুর্বল একটি অবস্থানে ছিল। বিশেষতঃ সেন এবং ব্রাহ্মণেরা ং ব্রাহ্মণেরা বাংলা ভাষা চর্চা নিষিদ্ধ করার ফলে বাংলা ভাষা অস্তিত্ব সংকটে পড়ে যায়। পরবর্তী সময়ে ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজি বঙ্গদেশ জয় করলে, মুসলিম শাসনের সৌভাগ্যে বাংলা ভাষার নবজন্ম এবং সমৃদ্ধি ঘটে। মুসলিম সুলতানেরা যেমনি অর্থনৈতিক এবং সামাজিক ক্ষেত্রে বাংলাকে বিশ্বের একটি সমৃদ্ধ ভূখণ্ডে পরিণত করেছিলেন তেমনি বাংলা ভাষা ও সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করে বাংলাকে সমৃদ্ধ ভাষায় উন্নীত করেন। বাংলা ভাষা এবং সাহিত্যের জন্ম ও বিকাশের ক্ষেত্রে মুসলিম শাসকদের নাম নিবিড়ভাবে প্রাসঙ্গিক। অধ্যাপক দীনেশচন্দ্র সেন বলেন, “মুসলমান সম্রাটগণ বর্তমান বঙ্গ সাহিত্যের একরূপ জন্মদাতা বলিলে অত্যুক্তি হয় না। বঙ্গ সাহিত্য মুসলমানদেরই সৃষ্ট, বঙ্গ-ভাষা বাঙালি মুসলমানের বাংলা ভাষা।”
ভাষা সমৃদ্ধির সাথে সাথে বাংলা অঞ্চলে বয়ে আনা মুসলমানদের নানা মূল্যবোধ সাহিত্য ভাবনার প্রসার ঘটায়। বাংলা সাহিত্যের পূর্বতন দেবতা নির্ভরতাকে অতিক্রম করে মুসলমানদের আনীত মানবতাবাদ, বিশ্ব ভ্রাতৃত্ব প্রভৃতি ভাবনা মানবিকতায় উন্নীত করে। মুসলিম আগমনের ফলে নির্দিষ্ট গণ্ডিবদ্ধ বাঙালির দৃষ্টি বিশ্বময় প্রসারিত হয় এবং সাহিত্যিক দৃষ্টিভঙ্গি বিকশিত হয়। মহান আল্লাহর একত্ববাদী অস্তিত্বে ঈমান আনয়নের ফলে প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষের মধ্যেও তৈরি হওয়া আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের উদাহরণ বাংলা সাহিত্যে হরহামেশাই পাওয়া যায়। এসবে অনেক নিম্নবর্গের চরিত্রও পাওয়া যায়, যারা এক অদৃশ্য শক্তির প্রশ্রয়ে শোষকদের মোকাবেলা করেছেন। এ চিত্র কেবল মুসলিম লেখকদের কলমেই অঙ্কিত হয়নি; বরং অমুসলিম লেখকেরাও একই চিত্র এঁকেছেন।
মুসলমানদের হাত ধরে শুধুমাত্র বাংলা ভাষার শব্দগত সমৃদ্ধি, কিংবা সাহিত্যিক উৎকর্ষতা, অথবা বিভিন্ন ভাষার সম্মিলনে সার্বিক বিকাশই সাধিত হয়নি, বরং একইসাথে মুসলমানদের হাত তাদের আনীত নতুন চিন্তা ও দর্শনের আলোকে সাহিত্যের গতিপ্রকৃতি, বিষয়বস্তু এককথায় সমাজের চিন্তামানসের দিক সম্পূর্ণত বিবর্তিত হয়ে যায়। এর শক্তিশালী প্রভাব পড়ে তৎকালীন সময়ের সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু সমাজেও।
প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ ড. এম এ রহিমের ভাষায়-
“মুসলমানরা বঙ্গদেশে যে নতুন চিন্তাধারা ও আদর্শের আমদানি করেন, তারই কল্যাণস্পর্শে হিন্দুসমাজে বিরাট জাগরণ আসে। ফলে শ্রী চৈতন্যের বৈষ্ণবধর্ম, ধর্মঠাকুরের পূজা ও সত্যপীর পূজা প্রভৃতি বহু ধর্মমতের উদ্ভব হয়। মুসলমানদের উদারনৈতিক ভাবধারার প্রভাবে গুরুত্বপূর্ণ বৈষ্ণব ধর্মগ্রন্থ, ধর্মঠাকুরের পূজা বিষয়ক সাহিত্য, মঙ্গলকাব্য ও সত্যপীরের পাঁচালী রচিত হয় এবং বাংলা সাহিত্য সমৃদ্ধ হয়। এভাবে বাংলার সমাজ জীবনে ধর্মীয় ও বুদ্ধিবৃত্তিক শক্তি সঞ্চার করে বাংলা ভাষার শ্রীবৃদ্ধিতে উদ্দীপনা সৃষ্টির জন্য মুসলিম শাসন কৃতিত্বের অংশীদার।”
আরোও উল্লেখযোগ্য ব্যপার হলো, মুঘল-পাঠান কিংবা বাংলা সালতানাতের শাসকগণের বাংলা ভাষাকে শক্তিশালী করেছেন। যেমন- পাঠানদের ভাষা ছিল প্রস্ত (পশতু), মুঘল সালতানাতের রাষ্ট্রভাষা ছিল ফারসি। মুঘল থেকে শুরু করে সকল সালতানাতের শাসকরাই বিভিন্ন ভাষাকে ধারণ করলেও ভারতীয় উপমহাদেশের প্রত্যেকটি অঞ্চলের স্ব-স্ব ভাষাকে তারা জন্মভূমির ভাষা হিসেবে মর্যাদা দিয়েছেন এবং ঐসকল ভাষাকে চর্চার জন্য উৎসাহিত করেছেন।
বিশেষ করে সেনরা যখন কর্নাটক থেকে এসে গণহত্যা চালিয়ে রাজ্য দখল করে আইন চালু করেছিল, অষ্টাদশ পুরাণ ও রামের চরিত বাংলায় পাঠ করা নিষিদ্ধ, শোনা নিষিদ্ধ, কেউ তা অমান্য করলে শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। তারপরেই তারা বৌদ্ধধর্মের ও বাংলা ভাষাভাষী পন্ডিতদের গণহারে হত্যা করে।
কিন্তু পরবর্তীতে মুসলিম সুলতানেরা হিন্দু কবি-সাহিত্যিকদের রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা দেন যার ফলে হিন্দু কবিরা সাহিত্য চর্চার পূর্ণ পরিবেশ পান। ইসলামী সভ্যতার অসাধারণ উদার মনোভাব, বহুত্ববাদী পরিবেশ, সামাজিক নিরাপত্তা এবং রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার ফলশ্রুতিতে সকল ধর্মাবলম্বী চিন্তক, সাহিত্যিক, কবিরা তাদের সাহিত্য চর্চার সর্বোত্তম পরিবেশ পায়। ফলশ্রুতিতে বাংলা সাহিত্য পরিগঠন ও বিকাশের শ্রেষ্ঠ পরিবেশ পায়। মুসলমানদের উদারনৈতিক ভাবধারার ফলে নিম্নবর্ণের হিন্দুরা তাদের ধর্মগ্রন্থ দেখার ও নিজ ভাষায় পড়ার সুযোগ পায়। ব্রাহ্মণ্যবাদী শাসনকালে নিম্নবর্ণের হিন্দুদের জন্য তাদের ধর্মগ্রন্থ পড়া তো দূরে থাক দেখা কিংবা এর পাঠ শোনাও নিষিদ্ধ ছিল। কেউ যদি ধর্মগ্রন্থ দেখত বা শুনতো, শাসকবর্গ চোখ-কানে গরম শিসা ঢেলে তাকে হত্যা করত। মুসলিম সুলতানদের হাত ধরে এই নিকৃষ্ট শোষণমূলক প্রথা ও ভয়াবহ জুলুমের অবসান ঘটে। অনেক মুসলিম শাসক স্বয়ং যেমন সুলতান শামসুদ্দীন ইউসুফ শাহ, আলাউদ্দীন হোসেন শাহ, শাহজাদা নুসরত শাহের মতো শাসকেরা সরাসরি হিন্দু কবিদের পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন, সুযোগ দিয়েছেন। সুলতান শামসুদ্দীন ইউসুফ শাহের পৃষ্ঠপোষকতায় মালাধর বসু ‘ভগবতে’র অনুবাদ সম্পন্ন করেন। কবীন্দ্র পরমেশ্বর ‘মহাভরত’ অনুবাদকালে শাহজাদা নুসরত শাহ তাকে সরাসরি সহায়তা করেন।
সেই জায়গা থেকে এসকল মানুষের পাশাপাশি সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের কাছে। জনসাধারণের ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষাকে শক্তিশালী করেছেন মুসলমানরাই।
যেমন- তৎকালীন পণ্ডিতেরা কৃত্রিম সংস্কৃতি ভাষা জানতো এবং সেগুলো পড়ে জাতপ্রথার মাঝে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব সবসময় রক্ষা করে চলতো। যার কারণে সাধারণ মানুষ মূলধারা থেকে অনেক দূরে ছিল। কিন্তু মুসলমান খলিফাগণ এইসকল পণ্ডিতদের বিরুদ্ধাচরণ করে সাধারণ মানুষের সুবিধার জন্য, সাধারণ মানুষের পিপাসাকে নিবারণ করার জন্য সকল ধরনের গ্রন্থ বাংলায় অনূদিত করেন এবং বাংলা ভাষার দিকে এত বেশি উৎসাহিত করেন। তৎকালীন দেশীয় সংস্কৃতির ধারা রক্ষার জন্য এবং দেশবাসীর শিক্ষা-নৈতিকতা এসকল বিষয়কে শক্তিশালী করার জন্য মূলত বাংলা ভাষায় পাঠ্যপুস্তক রচতা ও শিক্ষার দিকে এতবেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। যার কারণে তৎকালীন সময়ের একজন সাধারণ কৃষকও তৎকালীন পাশ্চাত্য সভ্যতার জ্ঞানীদের তুলনায় বেশি জানতো। এমনকি তাদের তুলনায় আমাদের দেশের কৃষকদের দার্শনিক বললেও ভুল হবে না। অতঃপর ড. কাজী মোতাহার হোসেনের ভাষায়, ‘তৎকালীন শাসকদের এত বেশী উৎসাহ পেয়েছিল বিধায় বাঙালিরা নিজেদের ভাষাকে এতবেশি আত্মস্থ করতে পেরেছিল।” এভাবে ইসলামী সভ্যতা থেকে এসকল বিষয়গুলোকে গ্রহণ করে এ অঞ্চলেও নিজেদের জীবন এবং সভ্যতাকে এত বেশি উন্নত করতে পেরেছিল। অন্যদিকে মুসলমানরা এ অঞ্চলে এসেও এ অঞ্চলে ঐতিহ্যের সাথে এমনভাবে নিজেদেরকে মেলে ধরেছিল এবং ইসলামের নব-নব বিকাশ সাধনের ক্ষেত্রগুলোকে এটার সাথে সমন্বয় সাধন করে তার উদারতা ও সর্বসহযোগিতাকে এমনভাবে তুলে ধরেছিল যে এর দ্বারা সকলেই অর্থাৎ এ অঞ্চলের মাটি ও মানুষ উপকৃত হয়েছে। কোনো ধর্মও নষ্ট হয়নি, ইসলামও ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। এভাবে করেই অঞ্চলের ভিত্তি এবং ভাষার শক্তিশালী একটি অবস্থান তৈরি হয়েছে।
বাংলা ভাষার জন্য তৎকালীন দুনিয়ায় সবচেয়ে নজিরবিহীন সম্মাননা হচ্ছে-
সুলতান শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ বাংলা ভাষাকে কেন্দ্র করে এ অঞ্চলের রাষ্ট্রীয় ভিত্তি রচনা করেন। রাজনৈতিক ভাবে স্বীকৃত রাষ্ট্রের নামকরণ করেন- শাহী বাংগালাহ।
পরবর্তীতে সুলতান গিয়াস উদ্দিন আজম শাহ এই রাষ্ট্রকে সবচেয়ে উন্নত অর্থনীতির শিখরে পৌঁছিয়ে বাংলাকে রাষ্ট্রীয় ভাষায় অনুমোদন দেন, যা বাংলাকে নতুন উচ্চতায় পৌঁছে দেয়।
এসব ক্ষেত্রে আরো উদাহরণ হলো: মুঘল সালতানাতের সময়ে আরাকান রাজ্যসভায় অমার্ত্যগণ বাংলা ভাষার শ্রী বৃদ্ধির জন্য তৎকালীন সময়ে রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রচুর পরিমাণ তহবিল পেতেন, ফলশ্রুতিতে দৌলত কাজী, মহাকবি আলাওলরা বাংলা ভাষায় কবিতা লিখে অমর কীর্তি লাভ করতে পেরেছিলেন। আমরা যদি লক্ষ্য করি, তখনও সংস্কৃত ভাষা ছিল, আরবি ভাষার জয়গান ছিল, ফারসি ভাষা ছিল দরবারের ভাষা, উর্দু ভাষা ছিল প্রভাবশালী ভাষাগুলোর একটি। এতগুলো শক্তিশালী ভাষার মধ্যে থেকে মুসলমানরা গুরুত্বপূর্ণ ভাষাগুলো শিক্ষা লাভ করতেন, এসকল ভাষার মৌলিক গ্রন্থগুলো পাঠ করে করে সমৃদ্ধি অর্জন করতেন, কারণ এসকল ভাষা ইসলামের ভাষা। কিন্তু এতকিছুর পরেও তাদের নিজস্ব ভাষা- বাংলা ভাষাকে তারা চর্চা করেছেন। এবং আলাওল তাঁর সাহিত্যগুলো উপহার দিয়েছেন। রাষ্ট্রীয়ভাবে এই ভাষাকে চতুর্মুখী করে বিকাশ করেছেন।
মাটি ও জাতির রূহকে উপলব্ধি করে এ ভাষাকে ধারণ করেছেন। তারা কখনোই বিদেশি সংস্কৃতির সাথে নিজেদের বিলিয়েও দেননি আবার ইসলামের মূল যে রূহ তাকেও দূরে ঠেলে দেননি। সমন্বয় সাধন করেছেন এবং সে আলোকেই তাদের কর্মগুলো সম্পাদন করেছেন। এক্ষেত্রে কাজী মোতাহারের আরেকটি লাইন হচ্ছে, “মুঘল সালতানাতের মুসলিম শাসকেরা অনেকেই উসমানী-আব্বাসী বা আন্দালুসের ওই অঞ্চলের তথা বিদেশি বংশোদ্ভূত হলেও এই দেশকে তারা স্বদেশ হিসেবেই গড়ে তুলেছিলেন।” এই অঞ্চলের কোনো আদর্শকে, স্বতন্ত্রতাকে ও এদেশের ভাষাকে গ্রাস করা তো দূরের কথা বরঞ্চ তারা এগুলো রক্ষার ব্যপারে উৎসাহ দিয়ে তৎকালীন সুলতানগণ, তৎকালীন সুবেদাররা অন্যান্য মুসলিম অঞ্চলগুলোর সাথে যোগসূত্র সাধন করে রাষ্ট্রীয় ভাষাগুলো শিক্ষাদান করেও বাংলা ভাষা তথা আঞ্চলিক ভাষাগুলোকে শক্তিশালী করেছেন।
এ বিষয়টি ড. এম এ রহিমের বর্ণনায় ফুটে উঠেছে এভাবে-
“মুসলমানগণ অন্য জাতির শিক্ষা ও জ্ঞানের মর্যাদা দিয়েছেন এবং সর্বত্র প্রজাসাধারণের সংস্কৃতি ও আদর্শ রক্ষা করেছেন। মুসলিম শাসকবর্গ ও হাজার হাজার বহিরাগত মুসলমান বঙ্গদেশে বসতি স্থাপন করেন। তারা বাংলাদেশকে নিজেদের দেশরূপেই গ্রহণ করেন, এবং নিজেদেরকে বাংলা ভাষার সন্তান হিসেবেই পরিচয় দেন। এ দেশের আদি অধিবাসীগণের মতোই বাংলা তাদেরও ভাষা হিসেবে পরিগণিত হয়।”
বাংলা সাহিত্যের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দর্শন ‘জীবাত্মা-পরমাত্মা’ এটিরও বাংলা সাহিত্যে আমদানি ঘটেছে মুসলমানদের সুফিবাদ থেকে। বাংলা ভাষায় পুঁথি সাহিত্যের যাত্রাও শুরু হয় মুসলিম কবিদের মাধ্যমে।
সর্বোপরি, মুসলিম শাসনামলে বাংলা ভাষা একটি শক্তিশালী অবস্থানে পৌঁছে যায়। পরবর্তীতে বাংলা ভাষায় বহু লব্ধপ্রতিষ্ঠিত সাহিত্যিকের লেখনীর মাধ্যমে বাংলা ভাষা আন্তর্জাতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ একটি স্থান অধিকার করে।
এখন কথা হচ্ছে, বাংলা ভাষা কি মুসলমানদের ভাষা হিসেবে বিজয়ী শক্তিতে পরিণত হয়েছিল? অবশ্যই হয়েছিল। তৎকালীন সময়ে শুরুর দিকটায় প্রভাবশালী ভাষা না হলেও মুসলমানদের সর্বাত্মক প্রচেষ্টায় এই ভাষাটি মুসলিম উম্মাহর দ্বিতীয় বৃহৎ ভাষায় পরিণত হয়। আর এটি কট্টর মুসলিম বিদ্বেষী, বৃটিশদের আজ্ঞাবহ ও হিন্দু সমাজসংস্কারক রাজা রামমোহনের উক্তি থেকে আমরা জানতে পারি। তার কথার আলোকে, যখন ব্রিটিশরা আসে ওই সময়ের সমাজকাঠামোতেও মুসলমানগণই তাদের চিন্তা-ভাবনা, ভদ্রতা, বিচার-বুদ্ধিতে, কার্য পরিচালনায় শ্রেষ্ঠ ছিলেন। এটা সে নিজেই স্বীকৃতি দিয়েছে। মুসলিম সালতানাতের খলিফাগণ, সিপাহসালার উজির-নাজির থেকে শুরু করে সকল কাঠামো থেকেই বাংলা ভাষার প্রতি জোরদান, পৃষ্ঠপোষকতা ইত্যাদির মধ্যেই তারা সীমাবদ্ধ ছিলেন না। একইসাথে তারা রাষ্ট্রীয়ভাষার স্বীকৃতি দিয়েছিলেন এবং সরকারিভাবে তার ব্যবহারকেও নিশ্চিত করেছিলেন। এক্ষেত্রে তারা দরবারে মুসলিম অমুসলিম নির্বিশেষে সকল কবিদেরকে বিভিন্ন ভাষা থেকে বাংলায় কাব্যানুবাদের উৎসাহ প্রদান করেন। এভাবে রাষ্ট্রীয় জীবনেও বাংলা ভাষার ব্যবহারকে ব্যাপকভাবে গুরুত্ব দেন। একদিকে যেমন আরবি ও ফারসি ভাষার ব্যবহার ছিল, একইসাথে বাংলা ভাষাকেও এগুলোর সাথে তাল মিলিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য মুসলিম শাসকগণ এ অঞ্চলে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর পরই মসজিদের মুদ্রালিপি থেকে শুরু করে সকল স্থানেই আরবি, ফারসিকে যেভাবে ব্যবহার করেছেন, বাংলা ভাষাকেও একইভাবে ব্যবহার করেছেন। তাদের সীলমোহর, স্বাক্ষর, বিভিন্ন অংশ জুড়েই থাকত বাংলা ভাষার সরকারি ব্যবহার। অফিস-আদালত, প্রশাসনিক কার্যক্রম, বিচারালয়, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, রেজিস্ট্রিকরণ, ব্যক্তিগত কাজকর্ম, প্রজার সাথে সুলতানের কথোপকথন, নবাব, সুবেদার বা দেওয়ানদের দরবারেও বাংলা ভাষায় সকল কিছু পেশ করা যেত। এই ব্যপারে ড. এস এম লুৎফর রহমান চমৎকার কিছু প্রমাণাদি তুলে ধরেছেন। যেমন- তিনি শায়েস্তা খানের আমলে তৎকালীন সময়ে কর্মরত ছিলেন দেওয়ান বদিউজ্জামান খান, তার মোহরযুক্ত চিঠি ও রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন লিখিত দলিলপত্র সামনে হাজির করেন। অমুসলিমদের সাথে লিখিত চুক্তিপত্র যেমন নবাব শায়েস্তা খানের সাথে অধীন শাহ ওজিউল এবং পরগণা রাজ্যের দেওয়ান সাহেবের স্বাক্ষর দ্বারা অনুমোদিত বিভিন্ন দলিলপত্র তিনি তুলে ধরেছেন। আর এই প্রত্যেকটি দলিলপত্রের ক্ষেত্রেই আমরা দেখেছি সেগুলো বাংলা ভাষায় লিখিত এবং আদানপ্রদানকৃত হয়েছে।
বর্তমান সময়ে এসে এই প্রশ্ন জাগতেই পারে যে, এত শক্তিশালী অবস্থানে থাকা সেই জৌলুসপূর্ণ ভাষা এভাবে মুসলমানদের হাতছাড়া হবার কারণই বা কী ছিল?
আমরা জানি যে, ব্রিটিশ শাসনের সময়কালে মূলত তাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা, ১৭৫৭সালের বিপর্যয়, ১৮৩০-১৮৪০ সালের আন্দোলন, ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহ থেকে শুরু করে ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানদের যে সংগ্রাম- এই সংগ্রামের ক্ষেত্রে অগ্রগামী ভূমিকা মুসলমানরা ছাড়া অন্য কেউ সে অর্থে পালন করেনি। পরবর্তী সময়ে হিন্দু এবং শিখরা আসলেও অধিকাংশ ব্রাহ্মণ, হিন্দু সুবিধাবাদী নেতা এবং বুদ্ধিজীবীরা ব্রিটিশদের সবকিছুকে গ্রহণ করে সেভাবেই এ অঞ্চলকে পরিচালনা করার এবং বৃটিশদেরকে সহায়তা করার চেষ্টা করেছে। ফলস্বরূপ তারা তাদের ভাষাকে, তাদের সব কালচারকে গ্রহণ করে তাদের নিজেদের সুবিধাটুকু অর্জন করেছে। পক্ষান্তরে, মুসলমানদের ক্ষেত্রে কিন্তু ইংরেজি ভাষা শিখেও যেমন কোনো উপকার হচ্ছিলো না, একইভাবে এ ভাষার বিরোধীতা করেও কোনো লাভ হচ্ছিলো না। কারণ, সামগ্রিকভাবে মুসলমানরা দুর্বল হয়ে গিয়েছিল। সব মিলিয়ে এই সময়টাতে ইংরেজি ভাষা গোটা ভারতব্যাপী শিক্ষার ভাষা, রাষ্ট্রসহ সকল কিছুর ভাষায় পরিণত হয়। হিন্দু থেকে শুরু করে অন্যান্যরা গ্রহণ করলে মুসলমানদের এক্ষেত্রে ব্যর্থতার পরিচয় দিতে হয় জাতির সামগ্রিক স্বার্থের উপর ভিত্তি করেই। কারণ, আমাদের সংগ্রাম ব্রিটিশ একাডেমিয়ার বিরুদ্ধে সংগ্রাম। তাদের চাপিয়ে দেওয়া ভাষা ও জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম। সেসময়ে যখন মুসলমানরা সকল দিক থেকে শোষণের কারণে পিছিয়ে পড়লো আর্থিকভাবে, শিক্ষার দিক থেকে। সে সময়টাতে বাংলা ভাষাও চলে যায় ব্রিটিশদের হাতে, বৃটিশদের আজ্ঞাবহদের হাতে। বাংলা ভাষা এক কথায় পঙ্গুত্ব বরণ করে। আজ অবধি সেই বাংলা ভাষা আমাদের হাতে নেই।
প্রশ্ন আসতে পারে, আমাদের অঞ্চলে ব্রিটিশরা কেনো এই বাংলা ভাষাকেই সর্বপ্রথম আক্রমণ করলো? তখনও তো বাংলায় ভাষায় প্রচুর পরিমাণে বই ছিল না, সিনেমা ছিল না। তবু কেনো এই আক্রমণ? তৎকালীন অর্থনীতি, কৃষিসহ সমাজের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কাঠামোতে যে আগ্রাসন তারা পরিচালনা করেছে। সমপর্যায়ের আগ্রাসনের পরিমাণকে বৃদ্ধি করে বাংলা ভাষাকে তাদের নিজস্ব রূপে রূপায়ণ করেছে, অন্যদের হাতে তুলে দিয়েছে এবং যখন তারা দেখল এতকিছুর পরেও তারা তাদের খ্রিস্টানধর্ম, ইউরোপীয় সংস্কৃতিকে প্রতিষ্ঠা করতে পারছে না তখন মুসলমানদের বিরুদ্ধে হিন্দুদেরকে সমবেত করে (উল্লেখ্য ইতোপূর্বে হিন্দুধর্ম এত বেশি সমাবিষ্ট ছিল না) ব্রাহ্মণশ্রেণির হাতে বাংলা ভাষাকে তুলে দেয়। নতুন যে ব্রাহ্মণ্যবাদের জন্ম তারা দিয়েছে, এটির ভিত্তি যারা সর্বপ্রথম নির্মাণ করেছে সেই প্রাণসত্তা তারা বাংলা ভাষাতেই রচনা করে এই আগ্রাসন পরিচালনা করেছে। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ থেকে শুরু করে বিভিন্ন মাধ্যমে তারা বাংলাকে মুসলমানদের হাত থেকে কেড়ে নিয়ে বারবারই ভিন্ন দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে।
আমরা পড়ে থাকি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বাংলা লিপির জনক, অথচ ঈশ্বরচন্দ্র বাংলা লিপির আবিষ্কর্তা নন। বাংলায় হাজারো লিপি শিক্ষার বই আর উদ্যমের মধ্যে বর্ণপরিচয় একটি মাধ্যম। বই লিখতে তিনি লিপি সংস্কার করেন। তিনি সিভিলিয়ানদের প্রাচ্য ভাষা শিক্ষার জন্য প্রতিষ্ঠিত হিন্দির স্রষ্টা, ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের হেড পণ্ডিত ছিলেন পাঁচ বছর। গত কয়েক দশকে হিন্দি থেকে আরবি ও ফার্সি শব্দ বাদ দিয়ে বাংলা ভাষার সংস্কৃতায়ন যে নতুনভাবে চলছে তাঁর বীজ, ব্রিটিশদের পৃষ্ঠপোষকতায় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এবং তাঁর গুরু জয়গোপাল তর্কালঙ্কার বপন করে যান। তারা বাংলা ভাষায় এই কাজটা করে দেখান পারসিক অভিধান প্রণয়ন করে। বিদ্যাসাগর মশাই গুরুর পথে বাংলায় অযাচিত ও অপ্রাসঙ্গিকভাবে সংস্কৃত শব্দ ঢুকিয়ে, তার আগের দীর্ঘকালের ভাষার বিবর্তনের স্বাভাবিক প্রকাশভঙ্গী রুদ্ধ করেন। এর ফলে যে ভাষাটার জন্ম হয় তা আর যাই হোক বাংলা নয়। একে নাম দেয়া হয় ‘অভিজাত প্রমিত বাংলা’। সমস্যাটা হচ্ছে এই মান ভাষার সঙ্গে পূর্ব বাংলার আঞ্চলিক ভাষাগুলোর দূরত্বটা অনেক, এখানে সংস্কৃত শব্দ চাপিয়ে দেয়ার বিষয় আছে। এমন সব শব্দ অভিজাতদের সাহিত্যে ও কর্মে ব্যবহার করা হয়; যা প্রায় শত বছর পরেও পূর্ব বাংলার মানুষের মুখে উঠে আসেনি। এসব শব্দ রয়ে গেছে গুরুগম্ভীর কিংবা ভাবগম্ভীর। সহজাতভাবে প্রবেশ করেনি বলে শব্দগুল সাধারণের মুখে শোভা পায় না। অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক এই নিয়ে যা বলেছেন তার ভাবার্থ এরকম-পূর্ব বাংলার মানুষের লোকায়ত ভাষা থেকে কলকাতার অভিজাতদের চাপিয়ে দেয়া ভাষার দূরত্বটা এতই বেশি যে, সাধারণের মুখে ভাষাটা আসে না। সাধারণকে ভাষাটা শিখতে হয় বরং লেখাপড়া করে ‘লায়েক’ হওয়ার পরই কেবল এ ভাষায় কথা বলা যায়, শুধু তখনই এটা মুখে আসে!
বাংলা ভাষার এই নেতিবাচক বিবর্তন কিংবা বাংলা ভাষার প্রায় হাজার বছরের বেশি সময়ের স্বাভাবিক বিবর্তনের পথ রুদ্ধ করে প্রমিত বাংলা ভাষা, লেখ্য লিপিকে ঔপনিবেশিক কাঠামো অর্জন করানোর উদ্যমে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের পণ্ডিতদের অবদান প্রচুর। কারণ মূল পরিবর্তন বা সোজাকথায় আগ্রাসনের সূচনাটা তখন থেকেই।
কিন্তু এই আগ্রাসনের মূল কারণ কী? এর কারণ হলো- একটি জাতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে হলে একটি জাতির চিন্তাধারা, সংস্কৃতির ধারাকে ব্যাঘাত ঘটাতে, সোশিও-কালচারকে নিয়ন্ত্রণ করতে তাদের নিজস্ব ভাষাকে নিয়ন্ত্রণ করার কোনো বিকল্প নেই। এই কাজটি সাম্রাজ্যবাদী, যায়নবাদী ব্রিটিশরা খুব সফলতার সাথেই সম্পাদন করেছে।
কিন্তু পরবর্তীতে আমরা অন্যান্য ভাষা চর্চা করতেও পারিনি, আরবি-ফারসিকেও ভালোভাবে ধারণ করতে পারিনি, উর্দুকেও কাজে লাগাতে পারিনি। একইভাবে এসকল ভাষাকে কাজে লাগিয়ে আমরা নিজেদেরকে শক্তিশালী করার প্রধান বাহন বাংলা ভাষাকে শক্তিশালী করবো সেটাও পারিনি। এজন্য কাজী মোতাহার হোসেন বলেছিলেন, “বাংলা ভাষা তথা মাতৃভাষার প্রতি উদাসীনতায় বাঙালি মুসলমানের অন্যতম অধঃপতনের কারণ।” সত্যিকারার্থে এর বাস্তবতা রয়েছে। কেননা, জাতির রূহকে উপলব্ধি করতে হলে, ভূমিকে ধারণ করে সে আলোকে নতুন ইশতেহার প্রদান করতে হলে জাতির নাড়ি-নক্ষত্রের সাথে যোগসূত্র থাকতে হয়। সেক্ষেত্রে অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে, বাংলা ভাষা। কিন্তু আমরা সেটাকে আমাদের মত করে ধারণ করতে পারিনি। সর্বোচ্চ কিছু চেষ্টা করেছি আরবি দিয়ে, উর্দু সাহিত্য দিয়ে কিছু ধর্মীয় ব্যপার আয়ত্ত করতে; কিন্তু সেটা দিয়ে তো আমাদের এ অঞ্চলের রূহকে বুঝা সম্ভব না। ভাসাভাসা দু’চারটি লাইন মুখস্থ করে বা মূলনীতি পড়ে আমরা কখনোই এই অঞ্চলের সামাজিক সংস্কৃতিকে, নতুন সভ্যতা বিনির্মাণের ইশতেহারকে সামনে আনতে পারবো না। এজন্য ইসলামের মূল জ্ঞান যেসকল ভাষায় রয়েছে সেটার সাথে অবশ্যই আমাদের মাতৃভাষার সমন্বয় সাধন করে সকলকিছুকে সামনে নিয়ে আসতে হবে।
আবার বাংলা সাহিত্য যতটুকুই বা ছিল তা পুঁথি সাহিত্য সৃষ্টি করে বাংলাদেশের- এ অঞ্চলের চাষী থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের কিছুটা খোরাক দিলেও শিক্ষার প্রধান ভাষা হিসেবে সমাজবিজ্ঞান তথা জাতির মূল রূহ-এর মূলনীতি প্রণয়নের ভাষা হিসেবে সেভাবে দাঁড় করাতে পারিনি। বাস্তবতা হলো এই ধরণের ভাষা চর্চা দিয়ে কখনোই বাঙালি মুসলমানের পক্ষে সভ্যতা বিনির্মাণ করা সম্ভব না, বরং সাম্রাজ্যবাদীদের শেখানো বুলি, ধার করা চিন্তা দিয়েই চলতে হবে। এছাড়া আমাদের হাতে নিজস্ব কোনো সম্পদ নেই!
আবার আমরা অধিকাংশ সময় নিজেদের অলসতাকে ঢাকতে গিয়ে এককেন্দ্রিক দোষারোপ করি, যেমন- হিন্দুরা বা অন্যান্যরা সকল কিছুকে দখল করে নিয়েছে। পরিভাষা, শব্দভাণ্ডার, সাহিত্য, কবিতা, জ্ঞানের ভাষা, রাজনীতি ও অর্থনীতির ভাষা সকল কিছুই অন্যদের পরিভাষা দিয়ে, চিন্তা দিয়ে ভরিয়ে ফেলেছে। বাস্তবতা হলো অভিযোগ করে কখনোই মুক্তি মিলে না।
ইদানীং আবার বাংলাভাষাকে নিয়ে উদ্ভুত সকল সমস্যার মূলে একমাত্র পাকিস্তানি শাসনামল এবং পশ্চিম পাকিস্তান কর্তৃক উর্দু ভাষার আধিপত্যকেই দায়ী করা হয়। এমনকি স্বাধীনতার পরে যেসব লেখনী প্রকাশিত হয়েছে সেগুলো পড়লেও আমরা ভাষাকেন্দ্রিক মূল আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে ‘৫২ এর ভাষা আন্দোলনকেই বুঝি। কিন্তু বাস্তবতা কি আদতে সেটাই বলে?
বাংলা ভাষাকে নিয়ে সৃষ্ট জটিলতা মূলত ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের তৈরিকৃত।
সুতরাং বুঝা যায়, এ সকল আলাপ উপেক্ষিত থাকার কারণও আমাদের কাছে অস্পষ্ট নয়। আর এই উপেক্ষা থেকেই সমস্যার সূচনা হয়। লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রাণের বিনিময়ে ব্রিটিশদের হাত থেকে এই উপমহাদেশকে রক্ষা করা হয়, যাদের কাফনবিহীন দাফন হয়েছিল এ বাংলায়। এরপর হাজার হাজার মুক্তিকামী মানুষ রক্তার্জিত স্বাধীনতা এনে দিয়েছে এই বাংলাকে। আমরা পেয়েছি আমাদের নিজস্ব মাতৃভূমি ‘বাংলাদেশ’। সেই দেশকে সার্বজনীন করে তুলতে এদেশের ছাত্রসমাজ, শ্রমিক, কৃষক, বুদ্ধিজীবীগণ সকল স্তরের মানুষকে বাংলা ভাষাকে আঁকড়ে ধরা উচিত। যাতে করে আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা সকলেই বাংলা ভাষায় জ্ঞানার্জন করতে পারবে। বাংলা ভাষাতেই খুলে যাবে মানুষের সার্বিক বিকাশের এক অবরুদ্ধ দ্বার। কিন্তু আমাদের সমাজ, রাজনীতি, বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যেমন- অর্থনীতি, সমাজবিজ্ঞান, পদার্থবিজ্ঞান কিংবা গণিত সকল বিষয়ের পাঠদানই হচ্ছে ইংরেজিতে, যেগুলোর বাংলা পাঠ্যবই সকলের সামনে হাজির করার প্রয়োজনীয়তা ছিল সবচেয়ে বেশি।
আমাদের এই ভাষাকে, আমাদের সাহিত্যকে আমাদের নিজেদেরকেই বহন করার দায়িত্ব নিতে হবে। আমরা আমাদের সুবিশাল ইসলামী সভ্যতা, আমাদের নিজস্ব সাংস্কৃতির মুক্তির সাথে সংযোগ স্থাপণ করে আমাদের মাটি, আমাদের মানুষ ও আমাদের বাংলা ভাষার সাথে সমন্বয় করে এমন একটি সুবিশাল সাহিত্য ভাণ্ডার, জ্ঞানের ভাণ্ডার তৈরি করতে হবে, এমন সকল চিন্তা ও মূলনীতি সামনে হাজির করতে হবে, এমনসব কাব্য ও ইশতেহার আনতে হবে যেগুলো দিয়ে আমরা আবার বাংলা ভাষাকে শক্তিশালী ভাষায় তুলে ধরতে পারবো। এটি ব্যতীত কখনো আমাদের জাতির কাছে পৌঁছানো সম্ভব নয়। কীভাবে পৌঁছাবো! আমরা তো মাতৃভাষাকেই ধারণ করতে পারছি না। মাতৃভাষাকে দিয়ে সভ্যতার কথা, সাংস্কৃ তির কথা ফুটিয়ে তুলতেই পারছিনা। তাহলে মানুষ কি করে বুঝবে এর গুরুত্ব? আলীয়া ইজ্জেতবেগভিচের ভাষায়, “যেকোনো চিন্তাকে যদি আমরা ঐ মানুষের সাথে, ঐ মাটির সাথে সমন্বিত করতে না পারি, তাহলে তা কখনোই সফলতার মুখ দেখবে না। এজন্য আমাদের চেতনাকে বাস্তব রূপ দিতে হলে বাংলা ভাষাকে নিজস্ব ধারায় ইসলামী সভ্যতার আদলে তৈরি করার কোনোই বিকল্প নেই।”
উদাহরণস্বরূপ লক্ষ্যণীয়- শিক্ষা, অর্থনীতি, প্রযুক্তি সবক্ষেত্রেই বর্তমানে এশিয়া মহাদেশের অন্যতম একটি সমৃদ্ধশালী দেশ চীনেও ১৯৫০ সালের পূর্বে চায়না ভাষার সাথে সাথে অন্যান্য ভাষারও বেশ আধিপত্য ছিল। কিন্তু চীন তাদের সমাজ, রাষ্ট্র, সামাজিক শক্তিকে যথোপযুক্ত কাজে লাগিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে সিদ্ধান্ত নেয় স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় সবকিছুকে বন্ধ করে দিয়ে হলেও অধ্যাপক, সাহিত্যিক, অনুবাদক নিযুক্ত করে বই-পুস্তক, লেখনী সকল কিছুকে নিজস্ব ভাষায় অনুদিত করার, প্রকাশ করার। প্রথম কয়েক বছরেই হাজার হাজার চীনা সাহিত্য অনুদিত হয়, নিজস্ব ভাষায় লিখিত হয়। ফলশ্রুতিতে তারা তাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে চাইনিজ ভাষায়, নিজেদের রূপরেখার আলোকে দাঁড় করাতে সক্ষম হয়েছে।
উসমানী খিলাফত পরবর্তী সময়ে, উসমানীয় ভাষাকে পরিবর্তন করে যখন ল্যাটিন ভাষায় নিয়ে যাওয়া হয়, আধুনিক তার্কিশ ভাষাকেও এভাবে পরিবর্তনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। আজ সকল ধরনের জ্ঞানভাণ্ডার, সাহিত্য, চিন্তা তার্কিশরা তাদের নিজস্ব ভাষায় পাঠ করতে পারে, চর্চা করতে পারে। তাহলে আমরা কেনো পারবো না?
যেখানে বর্তমানে মাতৃভাষা হিসেবে বিশ্ব-ভাষা তালিকায় বাংলার অবস্থান পঞ্চম এবং বহুল ব্যবহৃত ভাষা হিসেবে এর অবস্থান সপ্তম। বিশ্বজুড়ে ৩০ কোটিরও অধিক মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলে। এদের মধ্যে ২৬ কোটিরও বেশি বাংলা ভাষাভাষীর বসবাস বাংলাদেশ ও ভারতে। বাংলা ভাষা ব্যবহারকারী বাকি ৪ কোটিরও বেশি মানুষ ছড়িয়ে আছেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। তবুও কেনো আমরা পারবো না?
আমরা জানি যে, দক্ষিণ এশিয়ার প্রধান কথ্য ও লেখ্য ভাষা বাংলা। বাংলাদেশ ও ভারতের জাতীয় সংঙ্গীত রচিত হয়েছে বাংলা ভাষাতেই।
বাংলাদেশের জাতীয় ভাষা বাংলা এবং এদেশের ৯৮.৯% মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলে থাকেন। এবং ১৯৮৭ সালের ‘বাংলা ভাষা প্রচলন আইন’ অনুযায়ী, “বাংলাদেশের সর্বত্র তথা সরকারী অফিস, আদালত, আধা-সরকারী, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান কর্তৃক নথি ও চিঠিপত্র, আইন-আদালতের সওয়াল জবাব ও অন্যান্য আইনানুগ কার্যাবলি অবশ্যই বাংলায় লিখতে হবে এবং যদি কোন ব্যক্তি বাংলাভাষা ব্যতীত অন্য কোন ভাষায় আবেদন বা আপিল করেন তা হলে সে আবেদন বেআইনি ও অকার্যকর বলে গণ্য হবে। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের চর্চা, গবেষণা ও প্রচারের জন্য ১৯৫৫ সালের ৩ ডিসেম্বর বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠা করা হয়।
পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন বাংলাভাষী অসংখ্য মানুষ। যেমন- ভারতে সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলা ভাষাভাষী রাজ্যগুলোর মধ্যে রয়েছে:
- ১. পশ্চিমবঙ্গ : যার জনসংখ্যা প্রায় ৭,৮৬,৯৮,৮৫২ জন। এ রাজ্যের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৮৬.২২% বাংলায় কথা বলে, অধিকাংশ অধিবাসীও মাতৃভাষা হিসেবে বাংলায় কথা বলে থাকেন।
- ২. ত্রিপুরা: এ রাজ্যের অ-উপজাতি জনসংখ্যার বেশিরভাগই বাংলাভাষী হিন্দু এবং মুসলমান। যা রাজ্যের জনসংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি।
- ৩. আসাম: ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুসারে, আসামে প্রায় ৩,১২,০৫৫৭৬ জন লোক বাস করে। ‘১১-র আদমশুমারি রিপোর্ট অনুসারে, আসাম একটি বাঙালি সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ্য। প্রকৃত বাঙালি জনসংখ্যা রাজ্যের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৫৪%।
- ৪. আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ: আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জেও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বাঙালি রয়েছে, যার আনুমানিক সংখ্যা প্রায় ১,০০,০০০ জন এবং মোট জনসংখ্যার ২৬% -২৮%। আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে বাংলা সর্বাধিক প্রচলিত একটি ভাষা, যদিও সেখানে এর সরকারী কোন স্বীকৃতি নেই।
- ৫. ঝাড়খণ্ড ২০১১ সালে বাংলা ভাষাকে তাদের দ্বিতীয় ভাষার স্বীকৃতি দেয়।
উপরের রাজ্যগুলো সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাভাষী অঞ্চল। তবে এগুলো বাদে অন্যান্য যে রাজ্যগুলোতে বিপুল সংখ্যক মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলেন সেসব রাজ্যের মধ্যে রয়েছে-নয়াদিল্লি, মুম্বাই, বেঙ্গালুরু, বিহার, ভাগলপুর, পাটনা, চেন্নাই এবং জয়পুর।
পাকিস্তানের করাচিতে প্রায় ২১ লাখ মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলেন এবং করাচি সিটি করপোরেশনের অন্যতম দাফতরিক ভাষাও বাংলা।
যুক্তরাজ্যের বৃহত্তর অভিবাসীদের স্বীকৃত পঞ্চম মাতৃভাষা বাংলা। সেখানে প্রায় ৮ লাখ লোক বাংলা ভাষায় কথা বলে থাকেন।
মধ্যপ্রাচ্য এবং যুক্তরাষ্ট্রেও প্রচুর পরিমাণ বাঙালি অভিবাসীর বসবাস রয়েছে। উপরোক্ত দেশগুলো ছাড়াও পৃথিবীতে নিম্নলিখিত বহু দেশেই বর্তমানে বহু বাংলাভাষী মানুষ ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছেন।
সিয়েরা লিওনে ২০০২ সাল থেকে বাংলাকে দ্বিতীয় রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে।
এছাড়াও সংযুক্ত আরব আমিরাতের মধ্যে দুবাই, জাপানের টোকিও, অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন, অ্যাডিলেড, পার্থ, ভিক্টোরিয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের (এই অঞ্চলে সংখ্যালঘু বাঙালি অভিবাসীরা বাংলায় কথা বলে) নিউইয়র্ক, পেনিসিলভেনিয়া, নিউজার্সি, সান জোসে, ওয়াশিংটন, ক্যালিফোর্নিয়া, কানাডার টরন্টো, মিসিসাগা, ব্র্যাম্পটন, ফ্রান্সের প্যারিস, ইংল্যান্ডের লন্ডন, ওমান, মালয়েশিয়া, স্পেন এবং জার্মানিতে প্রচুর সংখ্যক বাংলা ভাষাভাষী রয়েছেন।
এছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে আরো প্রায় ৪ কোটি জনগণ এরকম আছে যারা বাংলা ভাষাকে দ্বিতীয় ভাষা বা Second language হিসাবে ব্যবহার করে।
সব মিলিয়ে বাংলা ভাষায় কথা বলা জনগণের সংখ্যা প্রায় ৪৫ কোটি।
বিশ্বজুড়ে বাংলা ভাষার চর্চা ক্রমে বিস্তার লাভ করছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সৌরভ সিকদারের গবেষণা মতে, ‘ইংরেজি ও চীনা ভাষার পরই বিশ্বজুড়ে বাংলা ভাষার প্রতি আগ্রহ বাড়ছে।’
পৃথিবীর ৪টি মহাদেশের ৩০ টি দেশের ১০০টি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষার সাহিত্য, ইতিহাস ও সংস্কৃতি নিয়ে নিয়মিত গবেষণা ও চর্চা হচ্ছে। এ ভাষা যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সবচেয়ে বেশি চর্চা হয়ে থাকে। এর বাইরে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীন, জাপান, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, জার্মানি, পোল্যান্ড, রাশিয়া, কানাডা এবং অস্ট্রেলিয়াসহ বিশ্বের মোট ত্রিশটি দেশে বাংলা ভাষার গবেষণা হচ্ছে।
যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনে উনিশ শতক থেকেই প্রাচ্যবিদ্যা ও ভাষাচর্চা বিভাগের অধীনে বাংলা ভাষা নিয়ে গবেষণা কাজ চলছে। যুক্তরাষ্ট্রে কমপক্ষে ১০ টি বিশ্ববিদ্যালয়ে ও এশীয় গবেষণা কেন্দ্রে বাংলা ভাষার চর্চা হচ্ছে। এর মধ্যে নিউইয়র্ক, শিকাগো, মিনেসটা, ফ্লোরিডা, মেরিল্যান্ড, ক্যালিফোর্নিয়া, ভার্জিনিয়া, উইসকনসিন ও হাভার্ড উল্লেখযোগ্য।
জাপানে বাংলা ভাষার অভিধান চালু করা হয়েছে।
সম্প্রতি ডেনমার্কের আলবর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা বিষয়ে গবেষণার জন্য বেঙ্গল স্টাডি সেন্টার খোলা হচ্ছে। বেইজিং বিশ্ববিদ্যালয়ে খোলা হয়েছে বাংলা বিভাগ। প্রায় প্রতিবছরই বিশ্বের নতুন নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ খোলা হচ্ছে এবং একাডেমিক কোর্স চালু হচ্ছে।
বাংলা ভাষার প্রতি আগ্রহের কারণে বিশ্বের কমপক্ষে ছয়টি দেশের রাষ্ট্রীয় বেতারে বাংলা ভাষার আলাদা চ্যানেল রয়েছে। আরো ১০টি দেশের রেডিওতে নিয়মিত বাংলা ভাষার আলাদা অনুষ্ঠান সম্প্রচার করা হচ্ছে। যুক্তরাজ্যে ৬টি, যুক্তরাষ্ট্রে ১০ টি বাংলাদেশী মালিকানাধীন ও বাংলা ভাষার টেলিভিশন চ্যানেল রয়েছে।
বাংলা ভাষায় যুক্তরাজ্য থেকে নিয়মিত মোট ১২ টি সাপ্তাহিক পত্রিকা বের হচ্ছে। বেতার বাংলা নামে সেখানে একটি রেডিও স্টেশন রয়েছে। ধূমকেতু, জন্মভূমি, প্রতিদিন, স্বদেশ, বিদেশ নামে পাক্ষিক ও মাসিক পত্রিকাও নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে।
নিউইয়র্কে বাংলা ভাষার পত্রিকা প্রকাশ শুরু হয় ১৯৮৫ সালের ১০ জানুয়ারি থেকে। বর্তমানে প্রায় ১৮ টি সাপ্তাহিক এবং ৭ টি অনলাইন পত্রিকা প্রকাশিত হচ্ছে।
ইউরোপের ইতালিতে বর্তমানে পাঁচটি বাংলা দৈনিক পত্রিকা এবং রোম ও ভেনিস শহর থেকে তিনটি বাংলা রেডিও স্টেশন পরিচালিত হচ্ছে। ইতালি থেকে ছয়টি অনলাইন টেলিভিশন বাংলায় পরিচালিত হচ্ছে। এছাড়া ডেনমার্ক, জার্মানি, সুইজারল্যান্ডসহ ইউরোপের আটটি দেশ এবং মধ্যপ্রাচ্যের ছয়টি দেশ থেকে বাংলা ভাষায় মুদ্রিত ও অনলাইন পত্রিকা প্রকাশিত হয়ে থাকে।
বিশ্বব্যাপী বাংলা ভাষার এত বিস্তৃত প্রচার ও প্রসারের কারণেই এর শব্দ ও সাহিত্য ভাণ্ডার এত সমৃদ্ধ। সেই সাথে অত্যন্ত শ্রুতিমধুর ভাষাও এটি। ইউনেস্কো ২০১০ সালে ‘পৃথিবীর সবচেয়ে মিষ্টি ভাষা’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয় বাংলাকে। সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রেও বাংলা ভাষা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। সাহিত্যের প্রায় সবকটি শাখাতেই বাংলা ভাষা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে। বাংলার বৈচিত্র্যময় উপভাষা বাংলা ভাষাকে প্রাণবন্ত ও গতিশীলতা দান করেছে। একইসাথে বিভিন্ন অঞ্চলে বাংলা ভাষার এত বিস্তৃত পরিসর এর সমৃদ্ধি ও ও সর্বব্যাপী গুরুত্বের দিকেই ইঙ্গিত করে। পুরো পৃথিবীতে ৪৫ কোটিরও বেশি মানুষ বাংলায় কথা বলে এবং বাংলা বর্তমান দুনিয়ার অন্যতম একটি প্রভাবশালী ভাষা। তাই, বাংলা ভাষাভাষী হিসেবে অন্যান্য ভাষার সামনে হীনমন্যতায় ভোগার কোন সুযোগই নেই। অতীতের সোনালী প্রেরণাকে সামনে রেখে, বাংলা ভাষাকে ভিত্তি করে অগ্রসর হলে নতুনভাবে একটি সমৃদ্ধ অবস্থানে পৌঁছা সম্ভব। কেননা, বাংলা অঞ্চলের অধিবাসী হিসেবে বাংলা ভাষা আমাদের সবচেয়ে বড় শক্তি ও আত্মবিশ্বাসের জায়গা। একইসাথে তা আমাদের অগ্রসরতার সবচেয়ে বড় সোপানও বটে। মুসলমানিত্ব মজবুত করতে বাংলা ভাষাকে এড়িয়ে চলে নয়; বরং আঁকড়ে ধরাই যৌক্তিক।
যেহেতু ছোট্ট হিব্রু ভাষার গত ৬ হাজার বছরে কোন অস্তিত্ব ছিল না তারা নিজেদেরকে নতুন করে জাগরিত করে আন্তর্জাতিক ভাষাতে পরিণত করতে পেরেছে। আজ থেকে কয়েক শ বছর আগেও চাষীদের বা গ্রাম্যদের ভাষা ছিল উর্দু, তা এখন বড় দেশের রাষ্ট্র ভাষা। আজ থেকে দেড়শ বছর আগেও হিন্দি ভাষার কোনো অস্তিত্ব ছিল না, সেই হিন্দি ভাষা কি উপমহাদেশে নেতৃত্ব দিচ্ছে না? শেক্সপিয়ার একাই যেহেতু ইংরেজি ভাষাকে দাঁড় করাতে পেরেছেন। সুতরাং আমরাও পারব ইনশাআল্লাহ্।
যে বাংলা ভাষার সুবিস্তৃত, দিগন্তব্যাপী ঔজ্জ্বল্য, সুখ্যাতি ও সমৃদ্ধি প্রথিত আছে তারই শেকড়ে তথা সুলতানী আমলে। তাঁর উত্থান ও নব জাগরণ অবশ্যম্ভাবী। এজন্যই সতের শতকের মুসলিম কবি আব্দুল হাকিম বাংলা ভাষার কদর বুঝাতে বলেছেন-
“যেসব বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী
সেসব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।”
আমাদের ভাষাকে বিনির্মাণের মূল লক্ষ্য কি তবে?
একটি ভাষা দাঁড়ায় রাষ্ট্রের ভাষা হিসেবে, আদালতের ভাষা হিসেবে, প্রতিষ্ঠানের ভাষা হিসবে, শিক্ষাব্যবস্থার ভাষা হিসেবে, এই সবগুলোর মূলেই রয়েছে শিক্ষা ও গবেষণা। আর যখন ভাষাটি শিক্ষা ও গবেষণার ভাষা হয়, তখনই মূলতে সে ভাষাটি একটি শক্তিশালী ভাষা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। এই শক্তিশালী আত্মপ্রকাশ মূলত ঘটাতে সক্ষম হয়ে ঐ ভাষা থেকে উঠে আসা বড় বড় ব্যক্তিবর্গের প্রভাবের ফলশ্রুতিতে। কেননা তারা যখন সে ভাষায় মৌলিক জ্ঞান চর্চা করেন, শক্তিশালী চিন্তার বিকাশ ঘটান তার প্রভাব গিয়ে সরাসরি পরে ওই ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর উপরে। কেননা তখন তাদের উদ্ভাবিত পরিভাষাগুলোই হয়ে ওঠে ঐ জাতির শিক্ষা ও গবেষণার মূল হাতিয়ার। এভাবেই ঐ জাতির চিন্তা, মনস্তত্ব, আভিজাত্য, ব্যবহারিক সংস্কৃতি, রাষ্ট্রীয় ক্রিয়াকলাপ প্রভাবিত হয় এবং সে ভাষাটি আদালতের ভাষায় পরিণত হয়। সুতরাং এক্ষেত্রে ভাষাকে গড়ে তোলার মূল লক্ষ্য হচ্ছে সে ভাষায় জ্ঞান তৈরি, চিন্তা তৈরি এবং সে ভাষাভাষী শক্তিশালী ব্যক্তিত্ব উঠিয়ে নিয়ে আসা। কেননা এটাই হচ্ছে ভাষার মূল পরিচয়।
এক্ষেত্রে একটি ঐতিহাসিক ঘটনা স্মরণ করা যেতে পারে। ১৯৪৫ সালে ন্যুরেমবার্গ ট্রায়ালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সম্পূর্ণ দায়ভার যখন জার্মানির ওপর বর্তায়, তখন মিত্রশক্তি জার্মানির শাস্তি নির্ণয়ের জন্য আলোচনার টেবিলে বসে। আলোচনায় বসা মারমুখী যুদ্ধবাজ নেতারা প্রস্তাবনা দিতে থাকে যে জার্মানিকে মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়া হোক, কিংবা ইউরোপের শষ্য ক্ষেতে পরিণত করা হয়। তখন ঐ টেবিলে বসা একজন বলেন, মানলাম আপনারা জার্মানিকে মাটির সাথে মিশিয়ে দেবেন, কিন্তু কার্ল মার্ক্সকে কোথায় রাখবেন? ফ্রেডরিখ নিটশে-কে কোথায় রাখবেন? ফ্রেডরিখ এ্যাঙ্গেলসকে কোথায় রাখবেন? (অর্থাৎ জার্মানিকে ধূলিস্যাৎ করে দিলেও ওইসকল প্রভাবশালী চিন্তকদের চিন্তাভাবনাকে তো বিনাশ করতে পারবেন না। তাদের ভাষাকে নিশ্চিহ্ন করতে পারবেন না।)
তখন সবার বোধোদয় হয় এবং অপার সম্ভাবনাময় জার্মানিকে ধ্বংস না করে ইউরোপের করদ রাজ্য হিসেবে টিকিয়ে রাখা হয়। এখানে লক্ষ্যণীয় বিষয় হচ্ছে, হিটলারের নেতৃত্বে সমগ্র বিশ্বজয় করার বাসনা ও শক্তিমত্তা যখন পরাজিত হয়ে অস্তিত্ব সংকটে পড়ে যায়, তখন ঐ বিপন্ন দশা থেকে পরিত্রাণের উপায় হয়েছিল মৌলিক চিন্তা ও জ্ঞানের অধিকারী জার্মানভাষী দার্শনিকগণ। ঐতিহাসিক এ ঘটনার তাৎপর্য থেকে আমাদের কি কিছুই শিক্ষা নেবার মত নেই?
অবশ্যই এটি আমাদের সামনে অপার সম্ভাবনা এবং গৌরবোজ্জ্বল একটি ভবিষ্যতের লক্ষ্যে প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসের খোরাক জোগানের মত একটি উৎস। অতএব আমাদের দ্বারাও বাংলা ভাষাকে শক্তিশালী করা সম্ভব এবং তা দিয়ে নতুন একটি ভবিষ্যতের পানে অগ্রসর হওয়া সম্ভব। আমরা যদি এই আত্মবিশ্বাসের বলে বলীয়ান হয়ে, বাংলা ভাষায় গোটা মানবতার উৎকর্ষ ও মুক্তির ভাবনায় মুখরিত হয়ে উঠতে পারি, মানবতার কল্যাণে জ্ঞান ও চিন্তার সমৃদ্ধ ইমারত গড়ে তুলতে পারি- আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা, শিক্ষাঙ্গণের মধ্য দিয়ে আমাদের জাতীয় বিবেক, মন ও মানস একটি দায়িত্বশীল চরিত্র লাভ করবে, আমাদের শিল্প ও সংস্কৃতি অসাধারণ শক্তিমত্তার অধিকারী হয়ে উঠবে তখন গোটা মানবতার মুক্তির ইশতেহার বাংলা ভাষায়ই রচনা করে বিশ্ববাসীকে উপহার দেয়া সম্ভবপর হবে।
এজন্য পরিশেষে বলতে চাই,
আজ আমরা এমন এক ঐতিহাসিক যুগসন্ধিক্ষণে উপস্থিত হয়েছি, যখন আমাদের জাতীয়তা, আত্মপরিচয় নানাভাবে আঘাতপ্রাপ্ত। আমাদের ভাষা- সাহিত্য- সংস্কৃতি, সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধ এগুলো আমাদের জাতীয়তার মূল ভিত্তি ও আত্মপরিচয়ের গৌরবময় উপাদান। এজন্য এই সকল কিছুর বাহন বাংলা ভাষা। যদি আমরা এই ভাষার বিকাশ ও উৎকর্ষ সাধন করতে পারি তাহলে আমাদের জাতীয় গৌরব বৃদ্ধি পাবে, জাতির অস্তিত্ব দৃঢ় ভিত্তি ধারণ করবে। পরমুখাপেক্ষীতা, হীনমন্যতা ও পরনির্ভরতার দ্বারা যেমন কোনোদিন কেউ টিকতে পারে না, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকেও আমরা সেভাবে বেশিদূর এগিয়ে নিয়ে যেতে পারব না। এজন্য আমাদের অবদানের মধ্য দিয়ে তা পূর্ণাঙ্গ ও গৌরবদীপ্ত হয়ে উঠবে আবারো। বাংলা ভাষার গন্তব্য হিসেবে বাংলাদেশের আবির্ভাব শুধু সাহিত্য রচনা ও চিন্তা তৈরিতে নেতৃত্ব দেয়ার কারণে নয়। বরং এটা পারিপার্শ্বিক বহু ঘটনার সম্মিলিত প্রতিক্রিয়া। চিন্তায় ও সৃজনে বাংলাকে যত্নের সঙ্গে এগিয়ে নেয়ার এ দায়িত্ব আমাদের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে হাজির হয়েছে।
তার অন্যতম উদাহরণ হচ্ছে নজরুল, ফররুখ, আল মাহমুদের রচিত ভাষা ও সাহিত্যের দুর্জয় প্রকাশ। তাদের প্রদর্শিত পথেই আমাদের ভাষা সাহিত্যের গৌরব ও সমৃদ্ধি আগামীতে আরো বেশি এগিয়ে নিতে পারব।
আবারো আমরা সেই হারানো সভ্যতার মত করেই বাংলা সাহিত্যের গৌরব ও ঐতিহ্যকে ফিরিয়ে নিয়ে আসতে পারবো এবং আমাদের আত্মপ্রত্যয়ে বলীয়ান ঢাকা কেন্দ্রিক, মসজিদের শহরের রূহকেন্দ্রিক বাংলা ভাষা সাহিত্যের অগ্রযাত্রা নতুন আকারে দীপ্তমান হবে। কারণ আমরা সেই আত্মবিশ্বাসী ও আত্মজাগৃতির এক মহান জাতিসত্তা ধারণকারী মুসলিম উম্মাহ। এজন্য আমাদের এ লক্ষ্যকে সামনে রেখে বিশাল পথ পাড়ি দিতে হবে, এবং এ লক্ষ্যপানে যাত্রা শুরু করা এখন সময়ের সবচেয়ে বড় প্রয়োজন। যে যাত্রার মধ্য দিয়ে আমরা আমাদের পুনরুত্থান কাব্যের পরিভাষাগুলো বর্ণনা করবো। যে বর্ণনার মধ্যে দিয়ে কেবলমাত্র বাংলাদেশের বিস্তৃত জনপদেই নয়, সমগ্র বাংলাভাষী সকল মানুষ তাদের আন্তর্জাতিক দিগন্তরেখায় নতুন এক সূর্যকে উদিত করতে পারবে। এবং আমাদের এই জাগরণের মধ্য দিয়ে ভারতীয় উপমহাদেশ তথা নিখিল ভারত আবার সেই ইসলামি সভ্যতার, ইসলামী সংস্কৃতির দিকে নতুন করে এগিয়ে যাবে যার মধ্যে দিয়ে আমরা বলতে পারব, মুসলিম উম্মাহর দ্বিতীয় বৃহত্তম ভাষা ‘বাংলা ভাষার’ মধ্য দিয়ে আমরা আমাদের সভ্যতার পুনর্জাগরণের জয়গান রচনা করবো, ইনশাআল্লাহ।
তথ্যসূত্র:
১. বঙ্গ বাঙ্গালা বাঙ্গালী, ফাহমিদ উর রহমান, মক্তব প্রকাশন, নভেম্বর ২০২১।
২. বাংলার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস, ড. এম এ রহিম, অনুবাদ: মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান, বাংলা একাডেমি, জুন ২০০৮।
৩. প্রাচীন বাঙ্গালা সাহিত্যে মুসলমানের অবদান, দীনেশচন্দ্র সেন, দিব্যপ্রকাশ, ফেব্রুয়ারি ২০১৫।
৪. বাংলা সাহিত্যে মুসলিম ঐতিহ্য, মুহাম্মদ মতিউর রহমান, ইসলামিক সেন্টার, ফেব্রুয়ারি ২০০২।
৫. বাংলা ভাষার উপনিবেশায়ন ও রবীন্দ্রনাথ, মোহাম্মদ আজম, আদর্শ প্রকাশন, মে ২০১৪।
৭. বাংলা ভাষাকে এগিয়ে নেয়ার ভাবনা, ফয়েজ আহমেদ তৈয়ব।