ইসলামের সবচেয়ে বড় এবং মৌলিক একটি মূলনীতি হল ‘তাওহীদ’। কোরআন ও সুন্নাহর রূহ এবং সকল পয়গাম্বরের আগমণের উদ্দেশ্যও হল তাওহীদ।  ইসলামের তাওহীদের চিন্তা ও এর দৃষ্টিভঙ্গী অন্যান্য সকল বিশ্বাস ও ধর্ম থেকে আলাদা করার সবচেয়ে বড় বিষয়। এই তাওহীদ নামক মূলনীতি থেকে তিনটি মৌলিক নীতির বহিঃপ্রকাশ ঘটে, সেগুলো হল,

  • সালাম (শান্তি)
  • আমান (নিরাপত্তা)
  • ওয়াহদাত (ঐক্য)

ইসলাম ও সালাম এর মধ্যকার সম্পর্ক, ঈমান ও আমান এর মধ্যকার সম্পর্ক, তাওহীদ ও ওয়াহদাত এর মধ্যকার সম্পর্ক, আখলাক ও আদালতের মধ্যকার সম্পর্ক এবং আদালত ও মারহামাতের মধ্যকার সম্পর্ককে সঠিকভাবে নিরূপণ করা ব্যতীত একটি সমাজ কখনোই ইসলামী সমাজ হতে পারবে না।। 

তাওহীদমানুষের হৃদয়পটে ও মানসপটে শুধুমাত্র আল্লাহর একত্ববাদ ও অনন্যতার চিন্তাই অঙ্কন করেনা। একই সাথে তাওহীদএই মহাবিশ্বের বিভিন্নতা ও বৈচিত্র্য থাকার পরেও এই মহাবিশ্ব কীভাবে নিখুঁত এক ঐকতানের মধ্যে সামগ্রিকভাবে চলছে সেই দিকেও দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ফলশ্রুতিতে তাওহীদের এই চিন্তা ঐক্যবা একতার মত বহুত্ব ও ভিন্নতা নামক পরিভাষাকে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করতে শিক্ষা দেয়। এই চিন্তাধারাটি আমাদের ইরফানী ধারায়, الوحدة في الكثرة والكثرة في الوحدة  অর্থাৎ একতার মধ্যে বিভিন্নতা, বিভিন্নতার মধ্যে একতা নামে অবিহিত হয়েছে। তাওহীদশুধুমাত্র একটি বিশ্বাস ও চিন্তাপদ্ধতির নাম নয়, একই সাথে এটি একটি জীবনধারা এবং জীবন ব্যবস্থার নাম। তাওহীদি চিন্তাধারা যখন সামাজিক জীবনে একটি চিন্তায় রূপ নেয় তখন তার নাম হয় ওয়াহদাতবা একতা। আর ওয়াহদেত বা একতার চেতনাকে সামাজিক জীবনে বাস্তবায়ন করার পন্থা হল, সামাজিক আদালত ও আখলাকের চিন্তাকে সমাজের প্রতিটি মানুষের হৃদয়পটে অঙ্কন করে দেওয়া। 

ভ্রাতৃত্ব, বন্ধুত্ব, ভালোবাসা, সহমর্মিতা এবং সহযোগিতার নাম হল ওয়াহদাত (একতা) । একত্রে বসবাস করা, পারস্পারিক সহযোগিতা, অভিন্ন মূল্যবোধের অধিকারী হওয়া এবং অভিন্ন আদর্শকে ধারণ করা। তাওহীদের পতাকাতলে সমবেত হওয়া এবং আল্লাহর পথে সংগ্রাম করতে গিয়ে সকল প্রকার দুনিয়াবী স্বার্থকে দূরে ঠেলে ফেলা। আজ মুসলিম উম্মাহর সমস্যাকে যেন আমাদের নিজেদের সমস্যা মনে করি, আমাদের দোয়া যেন হয় অভিন্ন এবং মুসলমানদের কল্যাণে। যেভাবেই হোক, মুসলমানদের মধ্যে রক্তপাতকে বন্ধ করতে হবে। আজ এমন কোন স্ট্র্যাটেজি নেই যা মুসলমানদের রক্তপাত বন্ধ করার চেয়ে বেশী প্রাধান্য পেতে পারে। এখন আমাদের সকল স্ট্র্যাটেজি হওয়া উচিত মুসলমানদের মধ্যকার ভ্রাতৃসংঘাতকে বন্ধ করার জন্য। মুসলমানদের মধ্যকার বিভাজন এবং শত্রুর মত একে অপরের ইজ্জত নিয়ে ছিনিমিনি খেলাকে যে ভাবেই হোক রুখতে হবে। মুসলমানদের মধ্যকার ঐক্যকে সুসংহত করা এবং তাদের ইজ্জত আব্রুকে রক্ষা করার চেয়ে কোন রাজনীতি আজ বেশী গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে না। আমাদের রাজনীতি যেন হয় ভ্রাতৃসংঘাতকে বন্ধ করার জন্য। মুসলিম উম্মাহ সুদীর্ঘ চৌদ্দশত বছর ধরে এক অসাধারণ সভ্যতা গড়ে তুলেছে, এবং এই সভ্যতা সমগ্র মানবতাকে অনেক বড় বড় মূল্যবোধ ও অভিজ্ঞতা উপহার দিয়েছে, আজ আমাদেরকে সেই সকল মূল্যবোধকে রক্ষা করার জন্য শপথ গ্রহণ করতে হবে। 

আমাদের একথা ভুলে গেলে চলবে না যে দুনিয়ার সকল নির্যাতিত-নিপীড়িত, অভাবী ও বঞ্চিত মানুষের জন্য শান্তি ও কল্যাণ বয়ে আনবে কেবলমাত্র ইসলাম। শুধুমাত্র ইসলামই পারে সমগ্র মানবতাকে আজকের এই ভয়াবহ দুর্দশা থেকে মুক্ত করতে। তাই সমগ্র মানবতাকে মুক্ত করার জন্য ইসলামী সভ্যতার বিজয়ের কোন বিকল্প নেই। তবে এর জন্য মুসলমানদের উচিত হবে তাওহীদ ও ওয়াহদাতকে সঠিকভাবে বুঝা ও উপলব্ধি করা। মুসলিম উম্মাহর আলেমদের, নেতাদের এবং স্কলারদের দায়িত্ব প্রধানতম কর্তব্য হলো মুসলমানদের ঐক্য, ভ্রাতৃত্ব এবং মাসলাহাতকে সব কিছুর উপরে স্থান দেওয়া এবং এই লক্ষ্যে সকল প্রকারের রিস্ক গ্রহণ করে সব সময় হক, হাকিকত, আদালত এবং আখলাককে ডিফেন্ড করা। 

বিভিন্ন মুসলিম দেশে অব্যাহত যুদ্ধ এবং ভায়োলেন্সের কারণে এক ধরণের বিশৃঙ্খল থিওলজির জন্ম দেওয়া হয়েছে। আর এই সকল বিশৃঙ্খল বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে নতুন নতুন ধর্মীয় গোষ্ঠীর সৃষ্টি হয়েছে। কেউ যদি আমাকে প্রশ্ন করে এই সকল ধর্মীয় গোষ্ঠীসমূহ মুসলমানদের এবং ইসলামের কোন ধরণের ক্ষতি করেছে এবং এই সকল ক্ষতির মধ্যে সবচেয়ে বড় ক্ষতি কি? এর জবাবে আমি বলব, এই সকল গোষ্ঠী সমূহ সবচেয়ে বড় যে ক্ষতিটি করেছে তা হল তাওহীদএর সঠিক চিন্তা থেকে বিচ্যুতি ঘটিয়েছে। কেননা তাওহীদ; সৃষ্টিজগত, মানুষ, সমাজ, ইতিহাস, মহাবিশ্ব এবং সভ্যতাকে বিশ্লেষণকারী একটি মূলনীতি। কিন্তু বিশৃঙ্খল একটি থিওলজির কোলে জন্ম নেওয়া এই সকল গোষ্ঠী সমূহ তাওহীদকে শুধুমাত্র একটি  বিশ্বাসে (an abstract faith) এবং অন্যকে তাকফির করার একটি হাতিয়ারে পরিণত করেছে। আজ সমগ্র মুসলিম উম্মাহকে  পরিগ্রহকারী সবচেয়ে বড় সমস্যা হল; তাওহীদকে সমগ্র মহাবিশ্ব, সমগ্র মানবতা, ইতিহাস, শিল্প, এবং সভ্যতাকে বিশ্লেষণকারী একটি মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ না করে অন্য মুসলমানকে তাকফির করার একটি হাতিয়ারে পরিণত করা। 

অনুবাদঃ বুরহান উদ্দিন আজাদ

১১৪৮ বার পঠিত

শেয়ার করুন

Picture of প্রফেসর ড. মেহমেদ গরমেজ

প্রফেসর ড. মেহমেদ গরমেজ

প্রফেসর ড. মেহমেদ গরমেজ তুরস্কের একজন প্রথিতযশা আলেম। জীবন্ত কিংবদন্তি এ আলেমে দ্বীন ইসলামের মৌলিক বিষয়সমূহকে মানুষের সামনে তুলে ধরার ক্ষেত্রে নিরলসভাবে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
১৯৬২ সালে তুরস্কের গাজিআনতেপ শহরের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ছিলেন একজন প্রখ্যাত আলেম। তিনি তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা পিতার কাছেই সম্পন্ন করেন। প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করার পর উসমানী ধারার প্রখ্যাত আলেম, 'মেহমেদ আমীন আর' এর নিকট শিক্ষা লাভ করেন। ড. গরমেজ পূর্ব আনাতোলিয়ান অঞ্চলে অবস্থিত উসমানী খিলাফতের সময়কালে প্রতিষ্ঠিত মাদরাসা থেকে শিক্ষা লাভের সময় প্রখ্যাত আলেমে দ্বীন উস্তাদ 'মেহমেদ আমীন আর' এর তত্ত্বাবধানে ছিলেন। সেসময় তিনি একইসাথে গাজিআনতেপ মাদরাসায়ও পড়াশোনা করেন এবং সেখান থেকে কৃতিত্বের সাথে উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা শেষে আঙ্কারা বিশ্ববিদ্যালয়ে থিওলজি বিভাগে ভর্তি হন। আঙ্কারা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত অবস্থায় তিনি মসজিদে ইমামতি ও মাদরাসায় শিক্ষকতা করতেন। আঙ্কারা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স ডিগ্রী লাভ করার পর হাদীস বিভাগে মাস্টার্সে ভর্তি হন এবং খাতীব আল বাগদাদীর বিখ্যাত গ্রন্থ شرف أصحاب الحديث-এর মুহাক্কিক প্রখ্যাত হাদীস শাস্ত্রবিদ প্রফেসর ড. সাঈদ হাতীবওলুর অধীনে মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। তাঁর মাস্টার্সের থিসিস ছিল, 'মুসা জারুল্লাহ বিগিয়েফের চিন্তা ও দর্শন'।
মাস্টার্স করার সময়ে তিনি মিশরে গমন করেন এবং কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণা করেন। কায়রোতে অবস্থান কালে মিশরের স্বনামধন্য ফকীহ মুহাম্মদ সেলিম আল-আরওয়াহ এবং প্রখ্যাত মুহাদ্দিস রিফাত ফাওজীর কাছ থেকে শিক্ষা লাভ করেন। এক বছর কায়রোতে অবস্থান করার পর পুনরায় তুরস্কে ফিরে আসেন এবং পুনরায় আঙ্কারা বিশ্ববিদ্যালয়ে ডক্টরেট (PhD) শুরু করেন। ১৯৯৪ সালে কৃতিত্বের সাথে তিনি তাঁর PhD শেষ করেন। তার PhD-এর থিসিস ছিলো "সুন্নত ও হাদীস বুঝা এবং ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে পদ্ধতিগত সমস্যা।" PhD চলাকালীন সময়ে তিনি এক বছর লন্ডনে অবস্থান করেন এবং সেখানে 'স্কুল অফ অরিয়েন্টাল এন্ড আফ্রিকান স্টাডিজ' এ গবেষক হিসেবে কাজ করেন। তাঁর এ থিসিস ১৯৯৬ সালে তুরস্কের ইসলামিক ফাউন্ডেশন এর গবেষণা বিভাগে প্রথম স্থান অর্জন করে এবং সে বছর এ গবেষণার জন্য তুর্কী সরকার তাকে গবেষণা পুরস্কার প্রদান করে। তার এ থিসিসটি আরবী ও ইংরেজি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। এ থিসিসের কারণে তিনি তাঁর একাডেমিক জীবনের অধিকাংশ সময় 'উসূলে ফিকহ' অধ্যয়নে ব্যয় করেন এবং এ সময়ে তিনি একজন উসূলবিদ হয়ে উঠেন।
এযাবৎকাল পর্যন্ত তিনি পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের বড় বড় মুহাদ্দিস, উসূলবিদ, আলেমগণের সান্নিধ্য লাভ করেছেন ও বিভিন্ন গবেষণায় তাদের থেকে বহু জ্ঞান অর্জন করেন। এছাড়াও উসমানী ধারার বড় বড় দার্শনিকদের সান্নিধ্যে দীর্ঘসময় পড়াশোনা করেন।তিনি আহমেদ ইয়েসেভি বিশ্ববিদ্যালয়, হাজেত্তেপে বিশ্ববিদ্যালয় এবং আঙ্কারা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অনেক বিশ্ববিদ্যালয়, ইন্সটিটিউট ও গবেষণা কেন্দ্রে শিক্ষকতা করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করার পাশাপাশি তিনি অন্যান্য ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। যেমন-ইসলাম শিক্ষা গবেষণা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন এবং তুরস্কের ইসলামী আন্দোলনের মহান নেতা প্রফেসর ড. নাজমুদ্দিন এরবাকান-এর সাথে দীর্ঘদিন কাজ করেন।
২০০৩ সালে তিনি Presidency of the Republic of Turkey Presidency of Religious Affairs এর ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে যোগদান করেন। এ দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি শিক্ষকতাও জারি রাখেন এবং ২০০৬ সালে প্রফেসর হন। দীর্ঘ ৭ বছর এ Religious Affairs এর ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন কালে সমগ্র মুসলিম উম্মাহর সাথে যোগাযোগ স্থাপন করেন এবং মুসলিম উম্মাহকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ২০১০ সালে তিনি Religious Affairs- এর প্রেসিডেন্ট মনোনীত হন এবং ২০১৭ সাল পর্যন্ত এ দায়িত্ব পালন করেন। এ গুরু দায়িত্ব পালন কালেও তিনি তাঁর গবেষণা চালিয়ে যান এবং এক মুহূর্তের জন্যও জ্ঞান গবেষণায় বিরতি দেননি। এ সময়ে তিনি মুসলিম উম্মাহর গুরুত্বপূর্ণ আলেমদের সাথে সু-সম্পর্ক গড়ে তোলেন এবং তাদেরকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য কার্যকরী ভূমিকা পালন করেন। গাজা, আরাকান, সোমালিয়া, সুদান, মধ্য এশিয়া এবং বলকান অঞ্চলের মুসলমানদের সমস্যা সমাধান করার জন্য অনেক পরিকল্পনা গ্রহণ করেন এবং তা বাস্তবায়নের জন্য প্রচেষ্টা চালান। Religious Affairs-এর প্রেসিডেন্ট থাকা অবস্থায় অবরুদ্ধ গাজা সফর করেন এবং হামাস নেতা ইসমাইল হানিয়ার সাথে সাক্ষাৎ করে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষে সংহতি ঘোষণা করেন। গাজাতে অবস্থানকালে তিনি অবরুদ্ধ গাজাবাসীর খোঁজ-খবর নেন। এরপর তিনি বাইতুল মুকাদ্দাসে যান এবং ঐতিহাসিক এক খুতবা প্রদান করেন।
২০১৭ সালে Religious Affairs-এর দায়িত্ব থেকে অবসর গ্রহণ করেন এবং দুটি প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন। একটি হলো International Islamic Though: Foundation অপরটি হলো Institute of Islamic Thought. বর্তমানে তিনি এ প্রতিষ্ঠান দুটির প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
Picture of প্রফেসর ড. মেহমেদ গরমেজ

প্রফেসর ড. মেহমেদ গরমেজ

প্রফেসর ড. মেহমেদ গরমেজ তুরস্কের একজন প্রথিতযশা আলেম। জীবন্ত কিংবদন্তি এ আলেমে দ্বীন ইসলামের মৌলিক বিষয়সমূহকে মানুষের সামনে তুলে ধরার ক্ষেত্রে নিরলসভাবে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
১৯৬২ সালে তুরস্কের গাজিআনতেপ শহরের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ছিলেন একজন প্রখ্যাত আলেম। তিনি তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা পিতার কাছেই সম্পন্ন করেন। প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করার পর উসমানী ধারার প্রখ্যাত আলেম, 'মেহমেদ আমীন আর' এর নিকট শিক্ষা লাভ করেন। ড. গরমেজ পূর্ব আনাতোলিয়ান অঞ্চলে অবস্থিত উসমানী খিলাফতের সময়কালে প্রতিষ্ঠিত মাদরাসা থেকে শিক্ষা লাভের সময় প্রখ্যাত আলেমে দ্বীন উস্তাদ 'মেহমেদ আমীন আর' এর তত্ত্বাবধানে ছিলেন। সেসময় তিনি একইসাথে গাজিআনতেপ মাদরাসায়ও পড়াশোনা করেন এবং সেখান থেকে কৃতিত্বের সাথে উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা শেষে আঙ্কারা বিশ্ববিদ্যালয়ে থিওলজি বিভাগে ভর্তি হন। আঙ্কারা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত অবস্থায় তিনি মসজিদে ইমামতি ও মাদরাসায় শিক্ষকতা করতেন। আঙ্কারা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স ডিগ্রী লাভ করার পর হাদীস বিভাগে মাস্টার্সে ভর্তি হন এবং খাতীব আল বাগদাদীর বিখ্যাত গ্রন্থ شرف أصحاب الحديث-এর মুহাক্কিক প্রখ্যাত হাদীস শাস্ত্রবিদ প্রফেসর ড. সাঈদ হাতীবওলুর অধীনে মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। তাঁর মাস্টার্সের থিসিস ছিল, 'মুসা জারুল্লাহ বিগিয়েফের চিন্তা ও দর্শন'।
মাস্টার্স করার সময়ে তিনি মিশরে গমন করেন এবং কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণা করেন। কায়রোতে অবস্থান কালে মিশরের স্বনামধন্য ফকীহ মুহাম্মদ সেলিম আল-আরওয়াহ এবং প্রখ্যাত মুহাদ্দিস রিফাত ফাওজীর কাছ থেকে শিক্ষা লাভ করেন। এক বছর কায়রোতে অবস্থান করার পর পুনরায় তুরস্কে ফিরে আসেন এবং পুনরায় আঙ্কারা বিশ্ববিদ্যালয়ে ডক্টরেট (PhD) শুরু করেন। ১৯৯৪ সালে কৃতিত্বের সাথে তিনি তাঁর PhD শেষ করেন। তার PhD-এর থিসিস ছিলো "সুন্নত ও হাদীস বুঝা এবং ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে পদ্ধতিগত সমস্যা।" PhD চলাকালীন সময়ে তিনি এক বছর লন্ডনে অবস্থান করেন এবং সেখানে 'স্কুল অফ অরিয়েন্টাল এন্ড আফ্রিকান স্টাডিজ' এ গবেষক হিসেবে কাজ করেন। তাঁর এ থিসিস ১৯৯৬ সালে তুরস্কের ইসলামিক ফাউন্ডেশন এর গবেষণা বিভাগে প্রথম স্থান অর্জন করে এবং সে বছর এ গবেষণার জন্য তুর্কী সরকার তাকে গবেষণা পুরস্কার প্রদান করে। তার এ থিসিসটি আরবী ও ইংরেজি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। এ থিসিসের কারণে তিনি তাঁর একাডেমিক জীবনের অধিকাংশ সময় 'উসূলে ফিকহ' অধ্যয়নে ব্যয় করেন এবং এ সময়ে তিনি একজন উসূলবিদ হয়ে উঠেন।
এযাবৎকাল পর্যন্ত তিনি পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের বড় বড় মুহাদ্দিস, উসূলবিদ, আলেমগণের সান্নিধ্য লাভ করেছেন ও বিভিন্ন গবেষণায় তাদের থেকে বহু জ্ঞান অর্জন করেন। এছাড়াও উসমানী ধারার বড় বড় দার্শনিকদের সান্নিধ্যে দীর্ঘসময় পড়াশোনা করেন।তিনি আহমেদ ইয়েসেভি বিশ্ববিদ্যালয়, হাজেত্তেপে বিশ্ববিদ্যালয় এবং আঙ্কারা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অনেক বিশ্ববিদ্যালয়, ইন্সটিটিউট ও গবেষণা কেন্দ্রে শিক্ষকতা করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করার পাশাপাশি তিনি অন্যান্য ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। যেমন-ইসলাম শিক্ষা গবেষণা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন এবং তুরস্কের ইসলামী আন্দোলনের মহান নেতা প্রফেসর ড. নাজমুদ্দিন এরবাকান-এর সাথে দীর্ঘদিন কাজ করেন।
২০০৩ সালে তিনি Presidency of the Republic of Turkey Presidency of Religious Affairs এর ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে যোগদান করেন। এ দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি শিক্ষকতাও জারি রাখেন এবং ২০০৬ সালে প্রফেসর হন। দীর্ঘ ৭ বছর এ Religious Affairs এর ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন কালে সমগ্র মুসলিম উম্মাহর সাথে যোগাযোগ স্থাপন করেন এবং মুসলিম উম্মাহকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ২০১০ সালে তিনি Religious Affairs- এর প্রেসিডেন্ট মনোনীত হন এবং ২০১৭ সাল পর্যন্ত এ দায়িত্ব পালন করেন। এ গুরু দায়িত্ব পালন কালেও তিনি তাঁর গবেষণা চালিয়ে যান এবং এক মুহূর্তের জন্যও জ্ঞান গবেষণায় বিরতি দেননি। এ সময়ে তিনি মুসলিম উম্মাহর গুরুত্বপূর্ণ আলেমদের সাথে সু-সম্পর্ক গড়ে তোলেন এবং তাদেরকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য কার্যকরী ভূমিকা পালন করেন। গাজা, আরাকান, সোমালিয়া, সুদান, মধ্য এশিয়া এবং বলকান অঞ্চলের মুসলমানদের সমস্যা সমাধান করার জন্য অনেক পরিকল্পনা গ্রহণ করেন এবং তা বাস্তবায়নের জন্য প্রচেষ্টা চালান। Religious Affairs-এর প্রেসিডেন্ট থাকা অবস্থায় অবরুদ্ধ গাজা সফর করেন এবং হামাস নেতা ইসমাইল হানিয়ার সাথে সাক্ষাৎ করে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষে সংহতি ঘোষণা করেন। গাজাতে অবস্থানকালে তিনি অবরুদ্ধ গাজাবাসীর খোঁজ-খবর নেন। এরপর তিনি বাইতুল মুকাদ্দাসে যান এবং ঐতিহাসিক এক খুতবা প্রদান করেন।
২০১৭ সালে Religious Affairs-এর দায়িত্ব থেকে অবসর গ্রহণ করেন এবং দুটি প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন। একটি হলো International Islamic Though: Foundation অপরটি হলো Institute of Islamic Thought. বর্তমানে তিনি এ প্রতিষ্ঠান দুটির প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

মতামত প্রকাশ করুন

Scroll to Top