ইসলামের সবচেয়ে বড় এবং মৌলিক একটি মূলনীতি হল ‘তাওহীদ’। কোরআন ও সুন্নাহর রূহ এবং সকল পয়গাম্বরের আগমণের উদ্দেশ্যও হল তাওহীদ। ইসলামের তাওহীদের চিন্তা ও এর দৃষ্টিভঙ্গী অন্যান্য সকল বিশ্বাস ও ধর্ম থেকে আলাদা করার সবচেয়ে বড় বিষয়। এই তাওহীদ নামক মূলনীতি থেকে তিনটি মৌলিক নীতির বহিঃপ্রকাশ ঘটে, সেগুলো হল,
- সালাম (শান্তি)
- আমান (নিরাপত্তা)
- ওয়াহদাত (ঐক্য)
ইসলাম ও সালাম এর মধ্যকার সম্পর্ক, ঈমান ও আমান এর মধ্যকার সম্পর্ক, তাওহীদ ও ওয়াহদাত এর মধ্যকার সম্পর্ক, আখলাক ও আদালতের মধ্যকার সম্পর্ক এবং আদালত ও মারহামাতের মধ্যকার সম্পর্ককে সঠিকভাবে নিরূপণ করা ব্যতীত একটি সমাজ কখনোই ইসলামী সমাজ হতে পারবে না।।
‘তাওহীদ’ মানুষের হৃদয়পটে ও মানসপটে শুধুমাত্র আল্লাহর একত্ববাদ ও অনন্যতার চিন্তাই অঙ্কন করেনা। একই সাথে ‘তাওহীদ’ এই মহাবিশ্বের বিভিন্নতা ও বৈচিত্র্য থাকার পরেও এই মহাবিশ্ব কীভাবে নিখুঁত এক ঐকতানের মধ্যে সামগ্রিকভাবে চলছে সেই দিকেও দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ফলশ্রুতিতে তাওহীদের এই চিন্তা ‘ঐক্য’ বা ‘একতা’ র মত বহুত্ব ও ভিন্নতা নামক পরিভাষাকে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করতে শিক্ষা দেয়। এই চিন্তাধারাটি আমাদের ইরফানী ধারায়, الوحدة في الكثرة والكثرة في الوحدة অর্থাৎ একতার মধ্যে বিভিন্নতা, বিভিন্নতার মধ্যে একতা নামে অবিহিত হয়েছে। ‘তাওহীদ’ শুধুমাত্র একটি বিশ্বাস ও চিন্তাপদ্ধতির নাম নয়, একই সাথে এটি একটি জীবনধারা এবং জীবন ব্যবস্থার নাম। তাওহীদি চিন্তাধারা যখন সামাজিক জীবনে একটি চিন্তায় রূপ নেয় তখন তার নাম হয় ‘ওয়াহদাত’ বা ‘একতা’। আর ওয়াহদেত বা একতার চেতনাকে সামাজিক জীবনে বাস্তবায়ন করার পন্থা হল, সামাজিক আদালত ও আখলাকের চিন্তাকে সমাজের প্রতিটি মানুষের হৃদয়পটে অঙ্কন করে দেওয়া।
ভ্রাতৃত্ব, বন্ধুত্ব, ভালোবাসা, সহমর্মিতা এবং সহযোগিতার নাম হল ওয়াহদাত (একতা) । একত্রে বসবাস করা, পারস্পারিক সহযোগিতা, অভিন্ন মূল্যবোধের অধিকারী হওয়া এবং অভিন্ন আদর্শকে ধারণ করা। তাওহীদের পতাকাতলে সমবেত হওয়া এবং আল্লাহর পথে সংগ্রাম করতে গিয়ে সকল প্রকার দুনিয়াবী স্বার্থকে দূরে ঠেলে ফেলা। আজ মুসলিম উম্মাহর সমস্যাকে যেন আমাদের নিজেদের সমস্যা মনে করি, আমাদের দোয়া যেন হয় অভিন্ন এবং মুসলমানদের কল্যাণে। যেভাবেই হোক, মুসলমানদের মধ্যে রক্তপাতকে বন্ধ করতে হবে। আজ এমন কোন স্ট্র্যাটেজি নেই যা মুসলমানদের রক্তপাত বন্ধ করার চেয়ে বেশী প্রাধান্য পেতে পারে। এখন আমাদের সকল স্ট্র্যাটেজি হওয়া উচিত মুসলমানদের মধ্যকার ভ্রাতৃসংঘাতকে বন্ধ করার জন্য। মুসলমানদের মধ্যকার বিভাজন এবং শত্রুর মত একে অপরের ইজ্জত নিয়ে ছিনিমিনি খেলাকে যে ভাবেই হোক রুখতে হবে। মুসলমানদের মধ্যকার ঐক্যকে সুসংহত করা এবং তাদের ইজ্জত আব্রুকে রক্ষা করার চেয়ে কোন রাজনীতি আজ বেশী গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে না। আমাদের রাজনীতি যেন হয় ভ্রাতৃসংঘাতকে বন্ধ করার জন্য। মুসলিম উম্মাহ সুদীর্ঘ চৌদ্দশত বছর ধরে এক অসাধারণ সভ্যতা গড়ে তুলেছে, এবং এই সভ্যতা সমগ্র মানবতাকে অনেক বড় বড় মূল্যবোধ ও অভিজ্ঞতা উপহার দিয়েছে, আজ আমাদেরকে সেই সকল মূল্যবোধকে রক্ষা করার জন্য শপথ গ্রহণ করতে হবে।
আমাদের একথা ভুলে গেলে চলবে না যে দুনিয়ার সকল নির্যাতিত-নিপীড়িত, অভাবী ও বঞ্চিত মানুষের জন্য শান্তি ও কল্যাণ বয়ে আনবে কেবলমাত্র ইসলাম। শুধুমাত্র ইসলামই পারে সমগ্র মানবতাকে আজকের এই ভয়াবহ দুর্দশা থেকে মুক্ত করতে। তাই সমগ্র মানবতাকে মুক্ত করার জন্য ইসলামী সভ্যতার বিজয়ের কোন বিকল্প নেই। তবে এর জন্য মুসলমানদের উচিত হবে তাওহীদ ও ওয়াহদাতকে সঠিকভাবে বুঝা ও উপলব্ধি করা। মুসলিম উম্মাহর আলেমদের, নেতাদের এবং স্কলারদের দায়িত্ব প্রধানতম কর্তব্য হলো মুসলমানদের ঐক্য, ভ্রাতৃত্ব এবং মাসলাহাতকে সব কিছুর উপরে স্থান দেওয়া এবং এই লক্ষ্যে সকল প্রকারের রিস্ক গ্রহণ করে সব সময় হক, হাকিকত, আদালত এবং আখলাককে ডিফেন্ড করা।
বিভিন্ন মুসলিম দেশে অব্যাহত যুদ্ধ এবং ভায়োলেন্সের কারণে এক ধরণের বিশৃঙ্খল থিওলজির জন্ম দেওয়া হয়েছে। আর এই সকল বিশৃঙ্খল বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে নতুন নতুন ধর্মীয় গোষ্ঠীর সৃষ্টি হয়েছে। কেউ যদি আমাকে প্রশ্ন করে এই সকল ধর্মীয় গোষ্ঠীসমূহ মুসলমানদের এবং ইসলামের কোন ধরণের ক্ষতি করেছে এবং এই সকল ক্ষতির মধ্যে সবচেয়ে বড় ক্ষতি কি? এর জবাবে আমি বলব, এই সকল গোষ্ঠী সমূহ সবচেয়ে বড় যে ক্ষতিটি করেছে তা হল ‘তাওহীদ’ এর সঠিক চিন্তা থেকে বিচ্যুতি ঘটিয়েছে। কেননা তাওহীদ; সৃষ্টিজগত, মানুষ, সমাজ, ইতিহাস, মহাবিশ্ব এবং সভ্যতাকে বিশ্লেষণকারী একটি মূলনীতি। কিন্তু বিশৃঙ্খল একটি থিওলজির কোলে জন্ম নেওয়া এই সকল গোষ্ঠী সমূহ তাওহীদকে শুধুমাত্র একটি বিশ্বাসে (an abstract faith) এবং অন্যকে তাকফির করার একটি হাতিয়ারে পরিণত করেছে। আজ সমগ্র মুসলিম উম্মাহকে পরিগ্রহকারী সবচেয়ে বড় সমস্যা হল; তাওহীদকে সমগ্র মহাবিশ্ব, সমগ্র মানবতা, ইতিহাস, শিল্প, এবং সভ্যতাকে বিশ্লেষণকারী একটি মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ না করে অন্য মুসলমানকে তাকফির করার একটি হাতিয়ারে পরিণত করা।
অনুবাদঃ বুরহান উদ্দিন আজাদ