ইসলামের আলোকে বিপদ-মুসিবত বুঝার পন্থা

মহান আল্লাহর কাছে দোয়া করছি তিনি যেন আমাদেরকে এই মহামারি থেকে রক্ষা করেন। মহান আল্লাহ যেন তাঁর “শা’ফি” (আরোগ্যদানকারী) নামের ওসিলায় সমগ্র মানবতাকে শিফা দান করেন। মেডিসিন বিশেষজ্ঞদের হৃদয়ে মহান আল্লাহ যেন এই রোগ নিরাময়ের ইলহাম দেন, আল্লাহর কাছে এই দোয়া করি। তাঁর অশেষ রহমত ও নিয়ামতের মাধ্যমে আমাদের মত দুর্বল বান্দাদের হৃদয় থেকে যেন সকল ভয় ও দুঃশ্চিন্তা দূর করে দেন, এই দোয়া করি।

আজকে আমি ‘ইসলামে বিপদ-মুসিবত সমূহকে বুঝার পন্থা নিয়ে আলোচনা করবো।’ 

একজন মু’মিন হিসেবে এই ধরণের মুসিবত সমূহ কিভাবে বুঝা প্রয়োজন?

যেমনটা ধারণা করা হচ্ছে, সত্যি কি এটি একটি ইলাহী আযাব? নাকি কোনো রহমত যা আমরা জানি না? 

কেউ কেউ মাঝে মধ্যে নিজেদের সীমানাকে অতিক্রম করে এটাকে কিয়ামতের পূর্ব মুহুর্ত বলে আখ্যায়িত করছেন। সত্যিই কি তাই? নাকি কোনো ইলাহী নিদর্শন বা শিক্ষা? 

আমাদের চিরন্তন ও শ্বাশত গ্রন্থ আল-কোরআন এ ব্যাপারে কি বলে? এ সকল ব্যাপারে রাসূলে আকরাম (সাঃ) এর উপদেশ সমূহ কি? 

আমার স্বল্প জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার আলোকে এই বিষয় সমূহের জবাব দেয়ার চেষ্টা করবো।  

হ্যাঁ, বিশ্ব মানবতা এমন এক সমস্যার সম্মুখীন যা অতীতে আর কখনো দেখা যায়নি। সমগ্র মানবতা খুবই অল্প সময়ের ব্যবধানে নতুন একটি জগতে প্রবেশ করেছে। হয়তোবা এর পরের ইতিহাস করোনা ভাইরাস পূর্ব ও করোনা ভাইরাস পরবর্তী সময় এভাবে  লেখা হবে। মাত্র তিন মাস পূর্বে চীনের উহান শহরে উৎপত্তি হওয়া এই ভাইরাসটি সমগ্র মানবতাকে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করেছে। মানুষের জীবনযাত্রা একেবারে অচল হয়ে পড়েছে। 

দেশ সমূহ তাদের সীমানাকে বন্ধ করে দিয়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমূহ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে, এমনকি জামায়াতে ইবাদতেও বিরতি দেয়া হয়েছে। ইতিহাসে এই প্রথম খুব সম্ভবতঃ কাবা শরীফ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। যার ফলে তাওয়াফ ও সা’য়ী সকল কিছুই বন্ধ রয়েছে আপাতত। মদিনা ও মসজিদে আকসাও বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। সমগ্র মসজিদসমূহ আবিদ বান্দাদের জন্য বন্ধ করে দেয়া হয়েছে । রাস্তা-ঘাট, শহর-নগর একদমই ফাঁকা, সকল মানুষ আজ কার্যত গৃহবন্দী । 

এতে কোন সন্দেহ নেই যে, বিশ্ব মানবতা প্রথমবারের মতো এমন একটি মহামারিতে আক্রান্ত হয়নি। মানব জাতির ইতিহাস এই ধরণের মুসিবতে পরিপূর্ণ। এক অর্থে বলতে গেলে মানব জাতির ইতিহাস একই সাথে বালা-মুসিবত, বিপদাপদ, খরা, বন্যা ও দুর্যোগের ইতিহাস। কলেরা, ইনফ্লুয়েঞ্জা, SARS, এইচ.আই.ভি, টিফু ইত্যাদি ছোঁয়াচে রোগে ইতঃপূর্বেও  অনেক মানুষ মৃত্যুবরণ করেছে। 

ইসলামের ইতিহাসের শুরুতে হযরত উমর (রাঃ) এর শাসনামলে طاعون عمواس‎ (ṭāwiʿna ʻimwas) বা Plague of Emmaus-এ প্রায় ২৫ হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করে। এদের মধ্যে অনেক বড় বড় সাহাবীও ছিলেন। গত শতাব্দীর শুরুতেও প্রথম বিশ্ব যুদ্ধ শেষ হতে না হতেই ইউরোপের জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশ মহামারীতে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। 

আজকের এই ভাইরাসের সাথে আগের ঐ সকল মহামারীর পার্থক্য কি? 

প্রিয় ভাইয়েরা, আগের ঐ সকল প্লেগ বা মহামারীর কোনটিই আজকের বা বর্তমানের এই ভাইরাসের সাথে মিলে না। ইতিহাসের কোন মহামারী ই এই করোনা ভাইরাসের মতো বৈশ্বিক একটি মহামারীতে রূপ নেয়নি।  সমগ্র মানবতা আজ বৈশ্বিক একটি মহামারীর মুখোমুখী। সমগ্র মানবতা আজ একটি ভয় ও আতঙ্কের মধ্য দিয়ে দিনানিপাত করছে। এই মহামারীর সামনে সমগ্র বিশ্ব-মানবতা আজ নিরুপায়।   

আর এ মহামারী এমন এক সময়ে দেখা দিয়েছে, যে সময়ে মানুষ অতীতের যে কোন সময়ের চেয়ে অনেক বেশী শক্তিশালী। এ মহামারী সমগ্র মানবতাকে এমন এক সময়ে গ্রাস করেছে, যে সময়ে জ্ঞান-বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও যোগাযোগের ক্ষেত্রে মানুষ বিপ্লব ঘটিয়েছে এবং সমগ্র দুনিয়াকে ধ্বংস করতে সক্ষম এত বেশি পরিমাণে রাসায়নিক অস্ত্র উৎপাদন করেছে। ন্যানো টেকনোলজির মাধ্যমে যখন মানুষ নতুন এক যুগের সূচনা করার প্রস্তুতি নিচ্ছে সেই সময়ে এই মহামারী দেখা দিয়েছে। 

চিকিৎসাবিদ্যা এবং ওষুধ সেক্টর  যখন সর্বোচ্চ শৃঙ্গে অবস্থান করছে, মানুষ যখন মৃত্যুঞ্জয়ী হওয়ার জন্য গবেষণা করছে, মহাকাশে জীবনের সন্ধান করছে, সে সময়ে এই মহামারী এসেছে। মানুষ যখন তার আবিষ্কার নিয়ে অহংকার, আত্মম্ভরিতা ও হিংসায় লিপ্ত এ সময়ে এমন একটি ভাইরাস তাদেরকে গ্রাস করে ফেলেছে যা মাইক্রোস্কোপ ছাড়া দেখাও যায় না। আমরা সকলেই আজ কার্যত গৃহবন্দী, অজানা এক পরিণতির জন্য সকলেই প্রহর গুনছি।

এ মুহূর্তে আমাদের যেন ডাক্তার ও নার্সদের জন্য দোয়া করি, এ সময়ে সবচেয়ে বড় দায়িত্ব পালন করছেন তাঁরা। আল্লাহ তাদের উপর সন্তুষ্ট হোন এবং তাদেরকে ধৈর্যের সাথে সেবাদান করার তাওফিক দান করুন। 

গণমাধ্যম ও ডিজিটাল মিডিয়া সমূহ চীন থেকে ইতালি, ইরান থেকে যুক্তরাষ্ট্র পর্যন্ত কি হচ্ছে না হচ্ছে তা মুহূর্তের মধ্যে সবার সাথে শেয়ার করে জানিয়ে দিচ্ছে। 

কিন্তু একটি বিষয়কে সবাই ভুলে যাচ্ছে, আর এটাই হলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এই বিষয়ের মানবিক, সামাজিক দিক নিয়ে এখনো কেউ কথা বলছে না। এর পেছনের রুহী, আধ্যাত্মিক ও মেটাফিজিক্যাল দিক নিয়ে এখনো চিন্তা গবেষণা ও লেখালেখি শুরু হয়নি। অথচ এই বিষয়টি আর শুধুমাত্র স্বাস্থ্যগত একটি বিষয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, স্বাস্থ্যগত বিষয় ছাড়িয়ে অনেক আগেই বের হয়ে গেছে। 

অন্যান্য সকল বিষয়ের মত এই বিষয়েও মানুষজন মতভেদ করবে। বিজ্ঞানীগণ, দার্শনিকগণ, আলেম-উলামাগণসহ সকলেই তাদের নিজেদের অবস্থান থেকে এই বিষয়ে ব্যাখ্যা দাঁড় করাবেন। এই বিষয়টিকে শুধু একটি দৃষ্টিকোন থেকে নয়, বরং সামগ্রিক একটি দৃষ্টিকোন থেকে বিশ্লেষণ করলে একটি ফলাফলে পৌঁছাতে পারবো। 

বিজ্ঞান এই বিষয়টি ব্যাখ্যা করে তুলে ধরবে, দর্শন আমাদেরকে এই বিষয়ে চিন্তা করাবে আর দ্বীন এটাকে অর্থবহ করে তুলবে। দ্বীন বা ধর্মের দেয়া অর্থ বিজ্ঞানের ব্যাখ্যা এবং দর্শনের দেয়া চিন্তাকে পাশ কাটিয়ে যাবে না। কারণ বিজ্ঞান হলো মহান প্রভু কর্তৃক এই পৃথিবীতে স্থাপিত আয়াত সমূহের ব্যাখ্যা দেয়। আর আকল ও চিন্তা হলো মহান প্রভু কর্তৃক মানুষকে দেয়া সবচেয়ে বড় ইহসান।

আমরা যদি ইতিহাসের দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাই যে, দ্বীনের দেয়া উচ্চ অর্থবহতার বদৌলতেই মানুষ সকল প্রকার ভয়ভীতিকে পরাভূত করেছে, সকল সন্দেহ ও সংশয়কে দূরীভূত করেছে, মৃত্যুভয়কে পাশ কাটিয়েছে, এমনকি কবির ভাষায় বলতে গেলে- মৃত্যুকে জয় করেছে। আজকেও আমরা ইসলামের দেয়া অর্থের মাধ্যমে আমরা যে সংকটময় সময় অতিক্রম করছি এই অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে পারবো। তবে এই ক্ষেত্রে আকল ও বিজ্ঞানকে বাদ দিয়ে নয়। 

প্রিয় ভাইয়েরা, 

মানুষ যখন আল্লাহকে ভুলে গিয়ে শুধুমাত্র নিজেদের চিন্তা ভাবনার আলোকে চলতো তখন কোন বিপদ মুসিবত আসলে মাঝে মধ্যে শুধুমাত্র কুসংস্কার, মাঝে মধ্যে শুধুমাত্র জ্যোতির্বিদ্যা দ্বারা ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করতো। অধিকাংশ সময় এ সকল বিপদ-আপদকে অনেকগুলো স্রষ্টার মধ্যকার যুদ্ধ বলে অভিহিত করতো কিংবা মাঝে মধ্যে আযাব বা গজবের সাথে সম্পৃক্ত করতো। মাঝে মধ্যে অসৎ লোকদের কারণে এই সব বিষয় হচ্ছে বলে চালিয়ে দিতো। তাকভীন ও তানযিলকে একত্রিতকারী ওহী তথা ইসলাম, মানুষকে সকল প্রকার কুসংস্কার ও ভ্রান্ত ধারণা থেকে মুক্ত করে সঠিক পথের সন্ধান দিয়েছে। 

ইলাহী ওহীকে তথা মানুষ, মহাবিশ্ব ও ওহীকে যদি আমরা সামগ্রিকভাবে বিশ্লেষণ করি তাহলে দেখতে পাই যে, সব কিছুর পূর্বে এই সকল বালা-মুসিবতসমূহ ইলাহী আদত বা অভ্যাস নয়, এগুলো এক একটি হলো-  ইলাহী আয়াত বা নিদর্শন। 

অনেক সময় ক্রোধ ও রাগের বশবর্তী হয়ে অনেকেই এগুলোকে আযাব বলে অভিহিত করে থাকেন। এগুলো আসলে সেই অর্থে আযাব নয়। মহান আল্লাহ সূরা ফাতিরের ৪৫ নম্বর আয়াতে বলেন- 

 وَلَوْ يُؤَاخِذُ اللَّهُ النَّاسَ بِمَا كَسَبُوا مَا تَرَكَ عَلَىٰ ظَهْرِهَا مِن دَابَّةٍ وَلَٰكِن يُؤَخِّرُهُمْ إِلَىٰ أَجَلٍ مُّسَمًّى ۖ فَإِذَا جَاءَ أَجَلُهُمْ فَإِنَّ اللَّهَ كَانَ بِعِبَادِهِ بَصِيرًا

 অর্থাৎ, যদি কখনো তিনি লোকদেরকে তাদের কৃতকর্মের জন্য পাকড়াও করতেন তাহলে পৃথিবীতে কোন প্রাণসত্তাকে জীবিত ছাড়তেন না। কিন্তু একটি নির্ধারিত সময় পর্যন্ত তিনি তাদেরকে অবকাশ দিচ্ছেন ৷ তারপর যখন তাদের সময় পরিপূর্ণ হয়ে যাবে তখন আল্লাহ তাঁর বান্দাদেরকে দেখে নেবেন ৷ 

সূরা ফুস্সিলাতের ৪৬ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন-

      وَمَا رَبُّكَ بِظَلامٍ لِلْعَبِيدِ

 অর্থাৎ, তোমার রব তাঁর বান্দাদের উপর মোটেও জুলুম করেন না।

অনেকেই নিজেদের সীমা অতিক্রম করে একে কিয়ামতের পূর্বমুহুর্ত বলে অভিহিত করছে। এটা মোটেই কিয়ামতের পূর্বমুহুর্ত নয়। কেননা কিয়ামত কখন হবে কোন নবীকে পর্যন্ত বলা হয়নি। আলামতসমূহ জানিয়ে দেয়া, আর কিয়ামতের সময় বলে দেয়া এক কথা নয়।  

প্রিয় ভাইয়েরা, 

আমাদের উপর যে মুসিবত এসেছে, কোরআনে আলোকে এটি একটি আয়াত বা নিদর্শন। এই নিদর্শন বা আয়াত থেকে সকল মু’মিনই ভিন্ন ভিন্ন শিক্ষা বের করবে। নিদর্শন সমূহ ইবারত সমূহের উপর ভিত্তি করে নয়, শিক্ষা বা ইবরতের উপর পড়তে হয় বা বুঝতে হয়। মহান আল্লাহ বলেছেন- 

  فَاعْتَبِرُوا يَاأُولِي الأبْصَارِ

অর্থাৎ, হে দৃষ্টিশক্তির অধিকারী আকলওয়ালারা ! শিক্ষা গ্রহণ করো।

এই আয়াতটির আদেশ একদম এই সকল বিষয়েই। কোরআন নুহ (আঃ) এর তুফানের মতো একটি ঘটনাকেও মুসিবত হিসেবে নয়, মানুষের জন্য একটি আয়াত বা নিদর্শন বলে ঘোষণা করেছে। 

আল্লাহ বলেছেন-

 وَجَعَلْنَاهُمْ لِلنَّاسِ آيَةً 

অর্থাৎ, সারা দুনিয়ার লোকদের জন্য একটি শিক্ষণীয় বিষয়ে পরিণত করলাম। (ফুরকান-৩৭)

এই মুসিবতকে যখন একটি ইলাহী আয়াত হিসেবে পড়বে কেউ কেউ, এর কারণকে মানুষ কর্তৃক দুনিয়াকে যথেচ্ছাভাবে ব্যবহার করার সাথে সম্পৃক্ত করবে। কেউ কেউ বলবে, দুনিয়ার পক্ষে আর এত মানুষকে বহন করা সম্ভব হচ্ছে না বলেই এমন হচ্ছে। কেউ কেউ একে কাশ্মীর, আরাকান, ফিলিস্তিন, উইঘুর, সিরিয়া এবং ইয়েমেনের ট্রাজেডির সাথে সম্পৃক্ত করবে।

বিভিন্ন দেশের সীমানা বন্ধ করাকে কেউ কেউ সিরিয়ান মুহাজিরগণ যেন ঐ সকল দেশে প্রবেশ করতে না পারে এর সাথে সম্পৃক্ত করবে। কেউ কেউ ভূমধ্যসাগরে ডুবে মরা মাসুম শিশুদের লাশের মধ্যে এর কারণ খুঁজে দেখবে। কেউ কেউ এর কারণকে এই ডিজিটাল ও ভোগ-বিলাসের যুগে মানুষ কর্তৃক তার রূহকে, কালবকে, পরিবারকে এবং সর্বোপরি, তার রবকে ভুলে যাওয়ার মধ্যে খুঁজবে।

কেউ কেউ এই বন্দীদশার কারণকে মানুষ কর্তৃক তার পরিবার, সন্তান-সন্ততিকে সময় না দেয়ার মধ্যে খুঁজবে। কাবা শরীফ, মসজিদে নববী, মসজিদে আকসা এবং অন্যান্য মসজিদসমূহকে বন্ধ করে দেয়ার কারণকে আমরা মসজিদে যাই না বলে এবং এগুলোকে আবাদ করি না বলে আমাদেরকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য বন্ধ করা দেয়া হচ্ছে এই কথা বলবে। কেউ কেউ এই কথা বলবে যে, দেখো! তোমরা যারা এক হজ্জ থেকে আরেক হজ্জ, এক উমরা থেকে আরেক উমরা এবং এক জুমা থেকে অপর জুমাকে নিজেদের গুনাহ মাফের ওসিলা হিসেবে গ্রহণ করেছিলে, এখান থেকে শিক্ষা নাও। কেউ কেউ একে আফ্রিকা অঞ্চলের  বছরের পর বছর ধরে খাবারের অভাবে মৃত শিশুদের অভিশাপের সাথে সম্পৃক্ত করবে। কেউ কেউ বলবে গাজার মানুষ ১০ বছরের বেশী সময় ধরে অবরুদ্ধ, অবরুদ্ধ থাকলে কেমন লাগে এই শিক্ষা দেওয়ার জন্য আল্লাহ আমাদেরকে এই শিক্ষা দিচ্ছেন। কেউ কেউ আল্লাহ প্রদত্ত হালাল রিজিককে পরিত্যাগ করার মধ্যে এর কারণকে খুঁজে বের করবে। 

আমরা যদি আমাদের উপর আগত বিষয় সমূহকে একটি আয়াত বা নিদর্শন হিসেবে বিবেচনা করি তাহলে উপরের সবগুলো বিশ্লেষণই সঠিক। উপরে বর্ণিত বিষয়সমূহের উপর যদি মানুষ চিন্তা ভাবনা করে শিক্ষা গ্রহণ করে তাহলে মানুষ নতুন একটি রহমত পাবে। 

মানুষ যখন এইভাবে চিন্তা ভাবনা করবে তখন সে নিজের আত্মসমালোচনা করতে পারবে। মানুষ দুনিয়ার সাথে তার সম্পর্ককে নতুন করে চিন্তা করবে। স্ত্রী, সন্তান, বন্ধু-বান্ধব ও পরিবার পরিজনের সাথে সম্পর্ককে নতুন করে বিন্যস্ত করবে। 

যদি এই সকল বড় বড় অর্থবহ বিষয়কে পরিত্যাগ করে এই সকল বিপদ-মুসিবতকে কোন নির্দিষ্ট ব্যক্তি, গোষ্ঠী কিংবা ঘটনার সাথে সম্পৃক্ত করে এগুলোকে ইলাহী আযাব ও কিয়ামত বলে চালিয়ে দেয়া হয়,তাহলে বুঝতে হবে যে আমরা কোরআনের আয়াত সমূহকে ভালোভাবে বুঝতে পারিনি এবং আমাদেরকে ইবরত বা শিক্ষা থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে ইবারতের(লেখা) মধ্যে আবদ্ধ করে ফেলবো। এই সকল মুসিবত থেকে শিক্ষা না নিলে আমাদের সমস্যাসমূহের সমাধান তো হবেই না, বরং আমাদের সংকটসমূহ আরও গভীর থেকে গভীরতর হবে।  

এই ধরণের মুসিবত সমূহকে ওহীর আলোকে সঠিকভাবে না বুঝতে পারার অন্তরায়সমূহ হলো- 

প্রথমতঃ এই সকল ঘটনাবলীকে মানুষের দায়িত্ব ও কর্তব্যসমূহকে পাশ কাটিয়ে যাবে এমন ভাবে ব্যাখ্যা করা। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন সূরা রুমের ৪১ নম্বর আয়াতে বলেন-

 ظَهَرَ الْفَسَادُ فِي الْبَرِّ وَالْبَحْرِ بِمَا كَسَبَتْ أَيْدِي النَّاسِ لِيُذِيقَهُم بَعْضَ الَّذِي عَمِلُوا لَعَلَّهُمْ يَرْجِعُونَ

অর্থাৎ, মানুষের কৃতকর্মের দরূন জলে-স্থলে বিপর্যয় দেখা দিয়েছে, যার ফলে তাদেরকে তাদের কিছু কৃতকর্মের স্বাদ আস্বাদন করানো যায়, হয়তো তারা বিরত হবে। 

দ্বিতীয়তঃ এই ধরণের ঘটনাবলীসমূহকে বিশ্লেষণ করার সময় এই মহাবিশ্বের সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহকে বাদ দিয়ে ব্যাখ্যা করা। আল্লাহ রাব্বুল আলামীনকে বাদ দিয়ে, সুন্নাতুল্লাহকে বিবেচনায় না নিয়ে এই সকল ঘটনাকে ব্যাখ্যা করা হবে সবচেয়ে বড় ভুল। 

তৃতীয়তঃ মানুষকে আল্লাহর স্থলাভিষিক্ত করা (নাউযুবিল্লাহ)। আল্লাহর নামে কথা বলা। যেমন- এরূপ কথা বলা,   এই অপরাধের কারণে আল্লাহ এই সমাজকে এই ধরণের শাস্তি দিয়েছেন। এরকম করে কথা বলা মোটেও সঠিক নয়।  

চতুর্থতঃ আল্লাহ যে সকল কারণসমূহ সৃষ্টি করেছেন সেগুলোকে বিবেচনা না করা। তদবীরকে বাদ দেয়া। বিশেষ করে এই ধরণের মহামারির সময়ে স্বাস্থ্য বিভাগের আদেশ, নিষেধ ও উপদেশ সমূহ দ্বীনেরই আদেশ, নিষেধ ও উপদেশ। ইসলাম একজন মানুষের জীবন রক্ষা ও মানুষের জীবনের নিরাপত্তা বিধানকে সবচেয়ে বড় মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করেছে। 

আমাদের প্রিয় রাসূল ১৪০০ বছর পূর্বে তাঁর নিজের সময়ের জন্য মহামারি বা এই ধরণের রোগের বিপরীতে কোয়ারান্টাইনের মূলনীতি সমূহকে খুব সুন্দর ভাবে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন, অসুস্থ ব্যক্তিকে সুস্থ মানুষের কাছে নিয়ে যাবেনা। যদি কোথাও মহামারি দেখা দেয় তাহলে সেখানে প্রবেশ করবে না। তোমরা যেখানে অবস্থান করছো সেখানে যদি কোন ধরণের মহামারী দেখা দেয় তাহলে সেখান থেকে বেরও হবে না।

প্লেগ রোগের কারণে হযরত উমর (রাঃ) শামে প্রবেশ না করলে শামের গভর্নর ও শাম বিজেতা রাসূলের অন্যতম সাহাবী উবাইদা ইবনুল জাররাহ তাকে বলেন, أفرارا من قدر الله يا أمير المؤمنين؟ ‘হে আমিরুল মু’মিনিন ! আল্লাহর তাকদির থেকে কি পালিয়ে যাচ্ছেন?’ জবাবে উমর (রাঃ) বলেন, نعم نفر من قدر الله إلى قدر الله , ‘হ্যাঁ, আল্লাহর এক তাকদির থেকে পালিয়ে অন্য তাকদিরের দিকে যাচ্ছি।’

এই মহামারি থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য আমরা যে সকল তদবীরকে নিতে পারি তা তিন ভাগে ভাগ করা যেতে পারে- 

১। আমি একটু আগেও বলেছি এই ভাইরাস যেন আমাদেরকে স্পর্শ করতে না পারে এই জন্য সতর্ক থাকা আমাদের দ্বীনেরও নির্দেশ। আমাদের ঘরে অবস্থান করে আমাদের পারিবারিক সম্পর্ক ও ভালোবাসাকে পুনরায় জাগ্রত করতে পারি। মসজিদসমূহে যেতে না পারার কারণে আমাদের ঘর বাড়িকে ইবাদতগাহে পরিণত করতে পারি। 

২। যারা বিজ্ঞানী ও গবেষক তাদের উচিত হবে এই রোগের প্রতিষেধক ও চিকিৎসা বের করার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা চালানো। এরকম একটি রোগের ওষুধ কিংবা প্রতিষেধক আবিষ্কার করা অনেক বড় একটি মর্যাদার বিষয়। মানুষকে ধ্বংস করার জন্য অস্ত্র  উৎপাদনের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত না হয়ে মানুষকে বাঁচানোর জন্য চেষ্টা করা প্রয়োজন। 

৩। এই সকল মুহূর্তে সবচেয়ে বড় বিষয় হল দোয়া, দোয়া এবং দোয়া। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন সূরা আনআমের ৪২ ও ৪৩ নম্বর আয়াতে বলেন- 

  وَلَقَدْ أَرْسَلْنَا إِلَىٰ أُمَمٍ مِّن قَبْلِكَ فَأَخَذْنَاهُم بِالْبَأْسَاءِ وَالضَّرَّاءِ لَعَلَّهُمْ يَتَضَرَّعُونَ

অর্থাৎ, তোমার পূর্বে অনেক মানব গোষ্ঠীর কাছে আমি রাসূল পাঠিয়েছি এবং তাদেরকে বিপদ ও কষ্টের মুখে নিক্ষেপ করেছি, যাতে তারা বিনীতভাবে আমার সামনে মাথা নত করে ৷ 

  فَلَوْلَا إِذْ جَاءَهُم بَأْسُنَا تَضَرَّعُوا وَلَٰكِن قَسَتْ قُلُوبُهُمْ وَزَيَّنَ لَهُمُ الشَّيْطَانُ مَا كَانُوا يَعْمَلُونَ

অর্থাৎ, কাজেই যখন আমার পক্ষ থেকে তাদের প্রতি কঠোরতা আরোপিত হলো, তখন তারা বিনম্র হলো না কেন ? বরং তাদের মন আরো বেশী কঠিন হয়ে গিয়েছে এবং শয়তান তাদেরকে এ মর্মে নিশ্চয়তা বিধান করেছে যে, তোমরা যা কিছু করছো ভালই করছো ৷

প্রিয় বন্ধুগণ,

আমরা আমাদের দু’হাত তুলে মহান প্রভুর কাছে এই অবস্থা থেকে মুক্তির জন্য দোয়া করব। কেননা এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তবে আমাদের যেন এমন একটি সময় বরাদ্দ থাকে যখন আমরা আমাদের পরিবারের সবাইকে নিয়ে দু’হাত তুলে মহান রবের কাছে দোয়া করতে পারি।  

তবে সবচেয়ে বড় দোয়া হলো ফে’লি দোয়া বা প্রাক্টিক্যাল দোয়া। আসুন আজ থেকে আমরা আমাদের দোয়াকে ভালো কাজে রূপান্তর করার চেষ্টা করি।  সকলেই মানুষের কল্যাণে নেমে পরি। যারা তাদের বাসা ভাড়া পরিশোধ করতে পারছেন না তাদেরকে বাসা ভাড়া ব্যবস্থা করে দেয়া হলো সবচেয়ে বড় দোয়া। যে সকল কর্মচারীগণ এই কঠিন সময়ে কাজে যাচ্ছেন তাদের বস কিংবা মালিকের উচিত হবে তাদের বেতনে কোন ধরণের কমতি না করে তাদের বেতন দিয়ে দেয়া।

এটাই হবে তাদের জন্য বড় দোয়া। যারা কোন কারণে বাজার করতে পারেন না তাদেরকে বাজার করতে সাহায্য করাই হবে বড় দোয়া। আল্লাহর রহমত নিয়ে আসবে এবং মুসিবতসমূহ দুরীভূত করবে এমন দোয়া হল এই কঠিন সময়ে মানুষের কল্যাণের জন্য আন্দোলন শুরু করা। একে অপরের কল্যাণে এগিয়ে আসা এখন সবচেয়ে বড় দোয়া। আমরা হয়তো কোলাকুলি করতে পারছি না, কিন্তু একে অপরের সাহায্যে এগিয়ে এসে মানুষের হৃদয়কে স্পর্শ করতে পারব। আল্লাহ আমাদের দোয়াকে কবুল করুন, আল্লাহ আমাদের দোয়াকে কবুল করুন। 

আমি আমার আজকের এই আলোচনা অসুস্থতা ও নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত হয়ে ধৈর্যের পরীক্ষা দিয়ে বিখ্যাত হয়েছেন হযরত আইয়্যুব (আঃ), তার দোয়া দিয়ে শেষ করতে চাই-

 أَنِّي مَسَّنِيَ الضُّرُّ وَأَنتَ أَرْحَمُ الرَّاحِمِينَ

অর্থঃ আমি রোগগ্রস্ত হয়ে গেছি এবং তুমি করুণাকারীদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ করুণাকারী ৷

অনুবাদঃ বুরহান উদ্দিন আজাদ

২২৫২ বার পঠিত

শেয়ার করুন

Picture of প্রফেসর ড. মেহমেদ গরমেজ

প্রফেসর ড. মেহমেদ গরমেজ

প্রফেসর ড. মেহমেদ গরমেজ তুরস্কের একজন প্রথিতযশা আলেম। জীবন্ত কিংবদন্তি এ আলেমে দ্বীন ইসলামের মৌলিক বিষয়সমূহকে মানুষের সামনে তুলে ধরার ক্ষেত্রে নিরলসভাবে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
১৯৬২ সালে তুরস্কের গাজিআনতেপ শহরের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ছিলেন একজন প্রখ্যাত আলেম। তিনি তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা পিতার কাছেই সম্পন্ন করেন। প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করার পর উসমানী ধারার প্রখ্যাত আলেম, 'মেহমেদ আমীন আর' এর নিকট শিক্ষা লাভ করেন। ড. গরমেজ পূর্ব আনাতোলিয়ান অঞ্চলে অবস্থিত উসমানী খিলাফতের সময়কালে প্রতিষ্ঠিত মাদরাসা থেকে শিক্ষা লাভের সময় প্রখ্যাত আলেমে দ্বীন উস্তাদ 'মেহমেদ আমীন আর' এর তত্ত্বাবধানে ছিলেন। সেসময় তিনি একইসাথে গাজিআনতেপ মাদরাসায়ও পড়াশোনা করেন এবং সেখান থেকে কৃতিত্বের সাথে উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা শেষে আঙ্কারা বিশ্ববিদ্যালয়ে থিওলজি বিভাগে ভর্তি হন। আঙ্কারা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত অবস্থায় তিনি মসজিদে ইমামতি ও মাদরাসায় শিক্ষকতা করতেন। আঙ্কারা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স ডিগ্রী লাভ করার পর হাদীস বিভাগে মাস্টার্সে ভর্তি হন এবং খাতীব আল বাগদাদীর বিখ্যাত গ্রন্থ شرف أصحاب الحديث-এর মুহাক্কিক প্রখ্যাত হাদীস শাস্ত্রবিদ প্রফেসর ড. সাঈদ হাতীবওলুর অধীনে মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। তাঁর মাস্টার্সের থিসিস ছিল, 'মুসা জারুল্লাহ বিগিয়েফের চিন্তা ও দর্শন'।
মাস্টার্স করার সময়ে তিনি মিশরে গমন করেন এবং কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণা করেন। কায়রোতে অবস্থান কালে মিশরের স্বনামধন্য ফকীহ মুহাম্মদ সেলিম আল-আরওয়াহ এবং প্রখ্যাত মুহাদ্দিস রিফাত ফাওজীর কাছ থেকে শিক্ষা লাভ করেন। এক বছর কায়রোতে অবস্থান করার পর পুনরায় তুরস্কে ফিরে আসেন এবং পুনরায় আঙ্কারা বিশ্ববিদ্যালয়ে ডক্টরেট (PhD) শুরু করেন। ১৯৯৪ সালে কৃতিত্বের সাথে তিনি তাঁর PhD শেষ করেন। তার PhD-এর থিসিস ছিলো "সুন্নত ও হাদীস বুঝা এবং ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে পদ্ধতিগত সমস্যা।" PhD চলাকালীন সময়ে তিনি এক বছর লন্ডনে অবস্থান করেন এবং সেখানে 'স্কুল অফ অরিয়েন্টাল এন্ড আফ্রিকান স্টাডিজ' এ গবেষক হিসেবে কাজ করেন। তাঁর এ থিসিস ১৯৯৬ সালে তুরস্কের ইসলামিক ফাউন্ডেশন এর গবেষণা বিভাগে প্রথম স্থান অর্জন করে এবং সে বছর এ গবেষণার জন্য তুর্কী সরকার তাকে গবেষণা পুরস্কার প্রদান করে। তার এ থিসিসটি আরবী ও ইংরেজি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। এ থিসিসের কারণে তিনি তাঁর একাডেমিক জীবনের অধিকাংশ সময় 'উসূলে ফিকহ' অধ্যয়নে ব্যয় করেন এবং এ সময়ে তিনি একজন উসূলবিদ হয়ে উঠেন।
এযাবৎকাল পর্যন্ত তিনি পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের বড় বড় মুহাদ্দিস, উসূলবিদ, আলেমগণের সান্নিধ্য লাভ করেছেন ও বিভিন্ন গবেষণায় তাদের থেকে বহু জ্ঞান অর্জন করেন। এছাড়াও উসমানী ধারার বড় বড় দার্শনিকদের সান্নিধ্যে দীর্ঘসময় পড়াশোনা করেন।তিনি আহমেদ ইয়েসেভি বিশ্ববিদ্যালয়, হাজেত্তেপে বিশ্ববিদ্যালয় এবং আঙ্কারা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অনেক বিশ্ববিদ্যালয়, ইন্সটিটিউট ও গবেষণা কেন্দ্রে শিক্ষকতা করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করার পাশাপাশি তিনি অন্যান্য ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। যেমন-ইসলাম শিক্ষা গবেষণা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন এবং তুরস্কের ইসলামী আন্দোলনের মহান নেতা প্রফেসর ড. নাজমুদ্দিন এরবাকান-এর সাথে দীর্ঘদিন কাজ করেন।
২০০৩ সালে তিনি Presidency of the Republic of Turkey Presidency of Religious Affairs এর ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে যোগদান করেন। এ দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি শিক্ষকতাও জারি রাখেন এবং ২০০৬ সালে প্রফেসর হন। দীর্ঘ ৭ বছর এ Religious Affairs এর ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন কালে সমগ্র মুসলিম উম্মাহর সাথে যোগাযোগ স্থাপন করেন এবং মুসলিম উম্মাহকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ২০১০ সালে তিনি Religious Affairs- এর প্রেসিডেন্ট মনোনীত হন এবং ২০১৭ সাল পর্যন্ত এ দায়িত্ব পালন করেন। এ গুরু দায়িত্ব পালন কালেও তিনি তাঁর গবেষণা চালিয়ে যান এবং এক মুহূর্তের জন্যও জ্ঞান গবেষণায় বিরতি দেননি। এ সময়ে তিনি মুসলিম উম্মাহর গুরুত্বপূর্ণ আলেমদের সাথে সু-সম্পর্ক গড়ে তোলেন এবং তাদেরকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য কার্যকরী ভূমিকা পালন করেন। গাজা, আরাকান, সোমালিয়া, সুদান, মধ্য এশিয়া এবং বলকান অঞ্চলের মুসলমানদের সমস্যা সমাধান করার জন্য অনেক পরিকল্পনা গ্রহণ করেন এবং তা বাস্তবায়নের জন্য প্রচেষ্টা চালান। Religious Affairs-এর প্রেসিডেন্ট থাকা অবস্থায় অবরুদ্ধ গাজা সফর করেন এবং হামাস নেতা ইসমাইল হানিয়ার সাথে সাক্ষাৎ করে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষে সংহতি ঘোষণা করেন। গাজাতে অবস্থানকালে তিনি অবরুদ্ধ গাজাবাসীর খোঁজ-খবর নেন। এরপর তিনি বাইতুল মুকাদ্দাসে যান এবং ঐতিহাসিক এক খুতবা প্রদান করেন।
২০১৭ সালে Religious Affairs-এর দায়িত্ব থেকে অবসর গ্রহণ করেন এবং দুটি প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন। একটি হলো International Islamic Though: Foundation অপরটি হলো Institute of Islamic Thought. বর্তমানে তিনি এ প্রতিষ্ঠান দুটির প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
Picture of প্রফেসর ড. মেহমেদ গরমেজ

প্রফেসর ড. মেহমেদ গরমেজ

প্রফেসর ড. মেহমেদ গরমেজ তুরস্কের একজন প্রথিতযশা আলেম। জীবন্ত কিংবদন্তি এ আলেমে দ্বীন ইসলামের মৌলিক বিষয়সমূহকে মানুষের সামনে তুলে ধরার ক্ষেত্রে নিরলসভাবে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
১৯৬২ সালে তুরস্কের গাজিআনতেপ শহরের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ছিলেন একজন প্রখ্যাত আলেম। তিনি তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা পিতার কাছেই সম্পন্ন করেন। প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করার পর উসমানী ধারার প্রখ্যাত আলেম, 'মেহমেদ আমীন আর' এর নিকট শিক্ষা লাভ করেন। ড. গরমেজ পূর্ব আনাতোলিয়ান অঞ্চলে অবস্থিত উসমানী খিলাফতের সময়কালে প্রতিষ্ঠিত মাদরাসা থেকে শিক্ষা লাভের সময় প্রখ্যাত আলেমে দ্বীন উস্তাদ 'মেহমেদ আমীন আর' এর তত্ত্বাবধানে ছিলেন। সেসময় তিনি একইসাথে গাজিআনতেপ মাদরাসায়ও পড়াশোনা করেন এবং সেখান থেকে কৃতিত্বের সাথে উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা শেষে আঙ্কারা বিশ্ববিদ্যালয়ে থিওলজি বিভাগে ভর্তি হন। আঙ্কারা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত অবস্থায় তিনি মসজিদে ইমামতি ও মাদরাসায় শিক্ষকতা করতেন। আঙ্কারা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স ডিগ্রী লাভ করার পর হাদীস বিভাগে মাস্টার্সে ভর্তি হন এবং খাতীব আল বাগদাদীর বিখ্যাত গ্রন্থ شرف أصحاب الحديث-এর মুহাক্কিক প্রখ্যাত হাদীস শাস্ত্রবিদ প্রফেসর ড. সাঈদ হাতীবওলুর অধীনে মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। তাঁর মাস্টার্সের থিসিস ছিল, 'মুসা জারুল্লাহ বিগিয়েফের চিন্তা ও দর্শন'।
মাস্টার্স করার সময়ে তিনি মিশরে গমন করেন এবং কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণা করেন। কায়রোতে অবস্থান কালে মিশরের স্বনামধন্য ফকীহ মুহাম্মদ সেলিম আল-আরওয়াহ এবং প্রখ্যাত মুহাদ্দিস রিফাত ফাওজীর কাছ থেকে শিক্ষা লাভ করেন। এক বছর কায়রোতে অবস্থান করার পর পুনরায় তুরস্কে ফিরে আসেন এবং পুনরায় আঙ্কারা বিশ্ববিদ্যালয়ে ডক্টরেট (PhD) শুরু করেন। ১৯৯৪ সালে কৃতিত্বের সাথে তিনি তাঁর PhD শেষ করেন। তার PhD-এর থিসিস ছিলো "সুন্নত ও হাদীস বুঝা এবং ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে পদ্ধতিগত সমস্যা।" PhD চলাকালীন সময়ে তিনি এক বছর লন্ডনে অবস্থান করেন এবং সেখানে 'স্কুল অফ অরিয়েন্টাল এন্ড আফ্রিকান স্টাডিজ' এ গবেষক হিসেবে কাজ করেন। তাঁর এ থিসিস ১৯৯৬ সালে তুরস্কের ইসলামিক ফাউন্ডেশন এর গবেষণা বিভাগে প্রথম স্থান অর্জন করে এবং সে বছর এ গবেষণার জন্য তুর্কী সরকার তাকে গবেষণা পুরস্কার প্রদান করে। তার এ থিসিসটি আরবী ও ইংরেজি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। এ থিসিসের কারণে তিনি তাঁর একাডেমিক জীবনের অধিকাংশ সময় 'উসূলে ফিকহ' অধ্যয়নে ব্যয় করেন এবং এ সময়ে তিনি একজন উসূলবিদ হয়ে উঠেন।
এযাবৎকাল পর্যন্ত তিনি পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের বড় বড় মুহাদ্দিস, উসূলবিদ, আলেমগণের সান্নিধ্য লাভ করেছেন ও বিভিন্ন গবেষণায় তাদের থেকে বহু জ্ঞান অর্জন করেন। এছাড়াও উসমানী ধারার বড় বড় দার্শনিকদের সান্নিধ্যে দীর্ঘসময় পড়াশোনা করেন।তিনি আহমেদ ইয়েসেভি বিশ্ববিদ্যালয়, হাজেত্তেপে বিশ্ববিদ্যালয় এবং আঙ্কারা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অনেক বিশ্ববিদ্যালয়, ইন্সটিটিউট ও গবেষণা কেন্দ্রে শিক্ষকতা করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করার পাশাপাশি তিনি অন্যান্য ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। যেমন-ইসলাম শিক্ষা গবেষণা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন এবং তুরস্কের ইসলামী আন্দোলনের মহান নেতা প্রফেসর ড. নাজমুদ্দিন এরবাকান-এর সাথে দীর্ঘদিন কাজ করেন।
২০০৩ সালে তিনি Presidency of the Republic of Turkey Presidency of Religious Affairs এর ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে যোগদান করেন। এ দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি শিক্ষকতাও জারি রাখেন এবং ২০০৬ সালে প্রফেসর হন। দীর্ঘ ৭ বছর এ Religious Affairs এর ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন কালে সমগ্র মুসলিম উম্মাহর সাথে যোগাযোগ স্থাপন করেন এবং মুসলিম উম্মাহকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ২০১০ সালে তিনি Religious Affairs- এর প্রেসিডেন্ট মনোনীত হন এবং ২০১৭ সাল পর্যন্ত এ দায়িত্ব পালন করেন। এ গুরু দায়িত্ব পালন কালেও তিনি তাঁর গবেষণা চালিয়ে যান এবং এক মুহূর্তের জন্যও জ্ঞান গবেষণায় বিরতি দেননি। এ সময়ে তিনি মুসলিম উম্মাহর গুরুত্বপূর্ণ আলেমদের সাথে সু-সম্পর্ক গড়ে তোলেন এবং তাদেরকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য কার্যকরী ভূমিকা পালন করেন। গাজা, আরাকান, সোমালিয়া, সুদান, মধ্য এশিয়া এবং বলকান অঞ্চলের মুসলমানদের সমস্যা সমাধান করার জন্য অনেক পরিকল্পনা গ্রহণ করেন এবং তা বাস্তবায়নের জন্য প্রচেষ্টা চালান। Religious Affairs-এর প্রেসিডেন্ট থাকা অবস্থায় অবরুদ্ধ গাজা সফর করেন এবং হামাস নেতা ইসমাইল হানিয়ার সাথে সাক্ষাৎ করে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষে সংহতি ঘোষণা করেন। গাজাতে অবস্থানকালে তিনি অবরুদ্ধ গাজাবাসীর খোঁজ-খবর নেন। এরপর তিনি বাইতুল মুকাদ্দাসে যান এবং ঐতিহাসিক এক খুতবা প্রদান করেন।
২০১৭ সালে Religious Affairs-এর দায়িত্ব থেকে অবসর গ্রহণ করেন এবং দুটি প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন। একটি হলো International Islamic Though: Foundation অপরটি হলো Institute of Islamic Thought. বর্তমানে তিনি এ প্রতিষ্ঠান দুটির প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

মতামত প্রকাশ করুন

Scroll to Top