হযরত রসূলে আকরাম (সাঃ) এর প্রিয়তম সাহাবী হযরত আবু যর গিফারীর (রাঃ) জীবনী সম্বন্ধে বাংলা ভাষায় ইতিপূর্বে দু’খানা পুস্তক প্রকাশিত হয়েছে। এ দু’টি পুস্তকে জীবনদর্শন সম্বন্ধে মাঝে মাঝে আলোচনা থাকলেও বিশ্বস্তভাবে কোন আলোচনা হয়নি। বর্তমানে বাংলা ভাষায় আবু যর গিফারী (রাঃ) অপরিচিত নাম না হলেও তাঁর জীবনদর্শনের সঙ্গে বাংলা ভাষাভাষী পাঠক-পাঠিকার সম্যক পরিচয় নেই। যে জীবনদর্শনের আলোকে তিনি তৃতীয় খলীফা হযরত উসমানকে আমীর মুয়াবিয়া (রাঃ), আমীর আমর বিন আস্ (রাঃ) ও মারওয়ানের কবল থেকে উদ্ধার করে সত্যিকারের ইসলামী শাসনব্যবস্থা করতে চেয়েছিলেন, তার বিস্তারিত আলোচনা বর্তমানে অত্যন্ত প্রয়োজনীয়; কেননা বর্তমানে ইসলামের নামে অনেক কিছুই প্রবর্তিত হচ্ছে।
কুরআন-উল-কারীমে আল্লাহকে ধারণা করা হয়েছে মালিক-উল-মুলক অর্থাৎ সমস্ত মুলকের মালিক হিসেবে। তিনি একমাত্র মালিক হলে চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ, নক্ষত্র, আকাশ, বাতাস অর্থাৎ এ বিশ্বজগতের সব কিছুরই মালিক তিনি। আল্লাহ্ সব কিছুরই মালিক হলে এ দুনিয়ায় মানুষের কি কোন সম্পদের উপর দাবি- দাওয়া নেই? তার উত্তর অতি স্পষ্ট ভাষায় দিয়েছেন সুপ্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস মাওলানা মাহমুদুল হাসান মরহুম মাগফুর। তিনি একটি প্রসিদ্ধ আয়াতের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বলেছেন যে, এ আয়াতে মানুষের অধিকারের সীমা নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে:
هُوَ الَّذِي خَلَقَ لَكُمْ مَا فِي الْأَرْضِ جَمِيعًا –
“আল্লাহ্ পৃথিবীর সবকিছুই মানুষের জন্য সৃষ্টি করেছেন।” অর্থাৎ সকল জিনিসই মানুষের প্রয়োজন মিটানোর জন্য তিনি সৃষ্টি করেছেন। কোন জিনিসই সৃষ্টিগতভাবে ব্যক্তিবিশেষের সম্পত্তি নয়। পক্ষান্তরে উহা সকলেরই সম্পত্তি বটে। যেহেতু সব জিনিসই মানুষের মঙ্গলার্থে সৃষ্টি করা হয়েছে, এ কারণে সকল জিনিসেই মানুষের ভোগ-দখলের অধিকার রয়েছে।
যখন কোনও জিনিস কারো ভোগ-দখলে থাকবে, তাকেই কেবল এ জিনিসের একমাত্র মালিক বলে গণ্য করা হবে, অন্য কেউ তার উপর আধিপত্য খাটাতে পারবে না। তবে, কোন জিনিসের ভোগ দখলকারীর এও জেনে রাখা উচিত যে, সে নিজ দরকারের অতিরিক্ত বস্তু অনর্থক নিজ কবলে না রেখে অন্যকে অবাধে ভোগ-দখল করতে দেবে। কেননা মানুষ হিসাবে সৃষ্টির ভোগাধিকার প্রত্যেক মানুষেরই প্রাপ্য। এ কারণেই রীতিমত যাকাত আদায় করা সত্ত্বেও প্রয়োজনের অতিরিক্ত মাল সঞ্চয় করা কারো উচিত নয়। নবীগণ ও ধর্মভীরু লোকগণ এ কারণেই ধন সঞ্চয় থেকে বিরত থেকেছেন। এমন কি হাদীস হতে পরিষ্কার বুঝা যায় যে, সাহাবাগণ ও তাবেঈগণ প্রয়োজনের অতিরিক্ত বস্তু রাখা বা ব্যবহার করা হারাম বলেছেন। মোটের উপর প্রয়োজনের অতিরিক্ত বস্তু সঞ্চয় বা ব্যবহার যে অনুচিত ও অসঙ্গত তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই। কারণ প্রয়োজনের অতিরিক্ত বস্তুতে সব সৃষ্টিই মানুষের জন্য নীতি অনযায়ী সকল মানুষের দাবি রয়েছে। তাই প্রয়োজনের অতিরিক্ত বস্তু ভোগ-দখলকারী তার নিজের প্রয়োজনীয় অংশের অতিরিক্ত ভোগ করার দরুন অন্যায় দখলকারী বলে গণ্য হবে।
যুদ্ধলব্ধ মালের ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার। যুদ্ধলব্ধ মালেও প্রয়োজনের অতিরিক্তটুকু একই পর্যায়ভুক্ত। যুদ্ধলব্ধ মালকে বণ্টনের পূর্বে সকল মুজাহিদেরই মাল বা সম্পত্তি বলা চলে। এ ক্ষেত্রেও প্রয়োজনের অতিরিক্ত মাল সকল মানুষেরই সম্পত্তি। যুদ্ধলব্ধ মাল প্রত্যেক মুজাহিদই প্রয়োজন অনুসারে খরচ করতে পারে। কেউ এ অর্থ প্রয়োজনের অতিরিক্ত অপব্যয় বা সঞ্চয় করলে সে আত্মসাৎকারী বলে অভিহিত হবে।
এ মতবাদের পোষকতায় নিম্নলিখিত দলিলাদি পেশ করা যায়-
সুপ্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস ইবনে হাজম জাহেরী (রহঃ) বলেছেন: হযরত আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) বর্ণনা করেছেনঃ
“জনাব রসূলে আকরাম (সা) বলেছেন যে, যে ব্যক্তির কাছে শক্তি ও সামর্থ্যে অর্জিত সরঞ্জাম নিজ প্রয়োজনের অতিরিক্ত আছে, তার উচিত ঐ অতিরিক্ত মাল দুর্বলকে দান করা। যে ব্যক্তির কাছে খাওয়া-পরার অতিরিক্ত উপাদান রয়েছে, তার পক্ষে উচিত অতিরিক্ত মাল দীন-দুঃখীকে দান করা।”
আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) বলেন: ‘নবী করীম এভাবে বিভিন্ন উক্তি করেছেন যাতে আমার এরূপ ধারণা জন্মেছে যে, আমাদের মধ্যে কারো কোন প্রকারের মালের উপর দাবি বা হক থাকতে পারে না।’
হযরত উমর বিন খাত্তাব (রাঃ) বলেন: “যে বিষয়ে আমার আজ ধারণা জন্মেছে সে সম্পর্কে যদি প্রথম থেকে অনুরূপ ধারণা জন্মাতো তাহলে আমি কখনও দেরী করতাম না; বরং নিঃসন্দেহে ধনীদের অতিরিক্ত ধন এনে গরীব মুহাজিরদের মধ্যে বণ্টন করে দিতাম।“
হযরত আবু ওবায়দা (রাঃ) ও তিনশত সাহাবা দ্বারা সত্য বলে গৃহীত বর্ণনা থেকে জানা যায়: কোন এক সময়ে যখন খাওয়া-পরার দ্রব্যাদি শেষ হওয়ার উপক্রম হয় তখন জনাব রসূলে আকরাম সাহাবা হযরত আবূ ওবায়দাকে হুকুম দেন, “যার যা কিছু আছে উপস্থিত করো।” তারপর সমস্ত দ্রব্য এক জায়গায় জড়ো করে সবকিছু তাদের মাঝে সমানভাবে বেটে দিয়ে তিনি সকলের জীবন ধারণের উপযুক্ত বন্দোবস্ত করে দেন।’
হযরত আলী (রাঃ) বলেনঃ “আল্লাহ তা’আলা ধনীদের উপর গরীবদের জীবিকা পরিপূর্ণভাবে সরবরাহ করা ফরয করেছেন। যদি তারা (গরীবেরা) ক্ষুধিত ও নগ্ন থাকে অথবা জীবিকার জন্য বিপদগ্রস্ত হয় তাহলে ধনীরা দায়িত্বশীল নয় বলেই গণ্য করতে হবে। এজন্য আল্লাহর কাছে কিয়ামতের দিন তাদের জবাবদিহি হতে হবে এবং সংকীর্ণতার জন্য শাস্তি ভোগ করতে হবে।“ এরকম আরও হাদীস ও কুরআন-উল করীমের দলিল দ্বারা ইমাম ইবনে হাজম (রহঃ) নিম্নরূপ অভিমত প্রকাশ করেছেনঃ-
‘প্রত্যেক মহল্লার ধনীদের উপর গরীব–দুঃখীদের জীবিকার জন্য জামিন (দায়ী) হওয়া ফরয (অবশ্য কর্তব্য)। যদি বায়তুল মালের আমদানি ঐ গরীবদের জীবিকা সরবরাহের জন্য যথেষ্ট না হয় তাহলে সুলতান বা আমীর ধনীদিগকে এজন্য বাধ্য করতে পারেন অর্থাৎ তাদের অতিরিক্ত মাল বলপূর্বক গরীবদের প্রয়োজনে গ্রহণ করতে পারেন। তাদের জীবিকা সংস্থানের জন্য এবং তাদের জরুরী চাহিদা অনুযায়ী ক্ষুধার অন্ন, পরিধানের বস্ত্র এবং ঝড়–বৃষ্টি রোধ ও প্লাবন থেকে রক্ষা করতে পারে এমন বাসগৃহের ব্যবস্থা করার জন্য এ অর্থ ব্যয় করতে হবে।‘
হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ)-এর রেওয়ায়েত (বর্ণনা) প্রসঙ্গে নানাবিধ তর্ক- বিতর্কের পর ইবনে হাজম (রহঃ) বলেন: সাহাবাদের (রাঃ) সার্বজনীন মত (ইজমা) এই যে, ‘যদি কেউ ক্ষুধিত অথবা নগ্ন থাকে, অথচ জরুরী সরবরাহ থেকে বঞ্চিত থাকে, তাহলে ধনীদের অতিরিক্ত মাল থেকে তাদের প্রয়োজন মিটানোর ব্যবস্থা করা ফরয।‘
হযরত আবু যর গিফারীও (রাঃ) উপরোক্ত অর্থনৈতিক মতবাদই প্রচার করেছিলেন। তিনি এ অর্থনীতি সংক্রান্ত মতবাদ খলীফা হযরত উসমান (রাঃ)-এর খিলাফতের সময় প্রচার করে নির্বাসিত হয়েছিলেন। এ মতবাদকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় ইসলামী অর্থনীতির মূলসূত্র বর্তমান কালের পুঁজিবাদ (Capitalism) বা সাম্যবাদ (Communism) থেকে সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী এক আদর্শমূলক নীতি। পুঁজিবাদে ব্যষ্টিকে কল্পনা করা হয় একক, স্বয়ংসম্পূর্ণ ও তার করায়ত্ত সবকিছুরই মালিক হিসাবে। সে যেমন তা ইচ্ছাধীন সবকিছুই উপার্জন করতে পারে, তেমনি সবকিছু ব্যয়ও করতে পারে। সুবিখ্যাত ইংরেজ অর্থনীতিবিদ এ্যাডাম স্মিথের মতবাদে (Laissez Faire) পাওয়া ব্যষ্টিকে অবাধ স্বাধীনতা দিতে হবে উপার্জনের ক্ষেত্রে। পুঁজিবাদের ক্ষেত্র রাজার অধীন রাজত্বও হতে পারে অথবা জনগণ পরিচালিত সার্বভৌম রাষ্ট্রও হতে পারে। মার্কসীয় মতবাদের ইতিহাস ব্যাখ্যার সূত্র অনুসারে ব্যষ্টির মালিকানার নীতি স্বীকৃত হলে এবং ব্যষ্টি মানসে এ মালিকানার দৈত্য চেপে বসলে সে যেমন তার প্রতিবেশী বা সর্বসাধারণ মানুষকে তার শরীক বলে স্বীকার করতে স্বীকৃত হয় না, তেমনি তার প্রয়োজনের অতিরিক্ত উদ্বৃত্ত সে রাষ্ট্রের হাতে ছেড়ে দিতেও সম্মত হয় না। সে তার গণ্ডির মধ্যে নিজেকে একক প্রভু বলেই গণ্য করে। এজন্যই সে যেমন তার সম্পদ থেকে অপর মানুষকে বঞ্চিত করতে চায় তেমনি রাষ্ট্রকেও সম্পূর্ণভাবে বঞ্চিত করতে চায়।
আমাদের এ কথা ভুললে চলবে না যে, কোন রাষ্ট্রের গঠনে ও তার পরিচালনায় মানব-মানসে থাকে এক বিশিষ্ট আদর্শ কার্যকরী। সে আদর্শের রূপায়ণের জন্য যেসব মানুষ নিয়োজিত হয়, তাদের মানসে সে আদর্শ প্রবল থাকলে তা অনায়াসেই ফলিত হতে পারে। আদর্শে আস্থাহীন লোকের দ্বারা তার রূপায়ণের কোন সম্ভাবনা নেই। এজন্য রাষ্ট্রের রূপায়ণের পূর্বে মানুষের প্রস্তুতি সর্বাধিক প্রয়োজনীয়। মানস গঠিত হলে অনায়াসেই রাষ্ট্র গঠিত হতে পারে। ইসলামী রাষ্ট্রের মৌলিক সূত্রের আলোকে ইসলামী ভূমি-নীতিরও সূত্র পাওয়া যায়। পূর্বেই বলা হয়েছে, হযরত আবু যর গিফারী (রাঃ) ইসলামের মূলনীতি আল্লাহর সার্বভৌমত্বের উপর গুরুত্ব আরোপ করে জীবনের সকল ক্ষেত্রেই তা আলোকে নানাবিধ প্রশ্নের মীমাংসা করার চেষ্টা করেছিলেন। এ নীতির আলোকে বিচার করলে আমরা তাঁর ভূমি-নীতিরও মূল্য নির্ণয় করতে সমর্থ হব।
একথা ইতিহাসবিদিত সত্য যে, আরবের মাটিতে জাহিলিয়াতেও রাজতন্ত্রের বা সমাজতন্ত্রের কোন প্রাধান্য ছিল না। আরবের মাটির মানুষ ছিল ত্রিবিধ পর্যায়ের। মক্কা বা অন্যান্য শহরে ছিল বণিক সমাজের প্রাধান্য। সমগ্র মরুভূমিতে ছিল পশুচারণকারী পর্যায়ের বেদুঈনদের বাস। তায়েফ বা অন্যান্য উর্বর ভূমিতে ছিল মুষ্টিমেয় কৃষক পর্যায়ের লোক। কাজেই সমগ্র দেশের লোক এক পর্যায়ে ছিল না।
জনাব রসূলে আকরাম (সাঃ) কর্তৃক ইসলাম প্রচারিত হলে এবং পরবর্তীকালে মিসর, সিরিয়া, ইরাক পারস্য প্রভৃতি দেশ বিজিত হলে সেসব দেশের সামস্ত সর্দারদের বিস্তৃত ভূসম্পত্তি খলীফা উমর (রাঃ) সেসব দেশের সর্বসাধারণের মধ্যে ভাগ করে বিলিয়ে দেন। আমর ইবনুল আস (রাঃ) প্রমুখ সাহাবাগণের শত অনুরোধ সত্ত্বেও তাঁদেরকে ঐসব ভূমির তিল পরিমাণ ভূমিও তিনি জায়গীরস্বরূপ দান করেননি। জনাব রসুলে আকরাম (সাঃ) ও সাহাবাগণের জীবনী পর্যালোচনা করলে এবং ইসলামের মূল লক্ষ্য শোষণবিহীন সমাজব্যবস্থার কথা বিবেচনা করলে সামন্ততান্ত্রিক ভূমি বিলি–ব্যবস্থাকে নাজায়েয বলে অভিহিত করা যায়। বাংলা ও পাক-ভারত উপমহাদেশে ইংরেজদের আগমনের পূর্বেও ইসলাম-বিরোধী জায়গীরদারী প্রথা চালু ছিল, সেসব প্রথা বিলোপ করে লর্ড কর্নওয়ালিস ১৭৮৩ সালে দশশালা বন্দোবস্ত প্রথার প্রবর্তন করেন এবং এ প্রথাই ১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রথারূপে স্থিরিকৃত হয়। এ প্রথা জায়গীরের মত না হলেও পরোক্ষে এদেশে এক সামন্ততন্ত্রের পরে দেখা দেয় পুঁজিবাদ। কাজেই রাজগীর শেষেই পুঁজিবাদের আবির্ভাব স্বাভাবিক। তবে ইংল্যান্ড প্রভৃতি দেশে সীমিত রাজগী (Limited Monarchy) থাকায় রাজগী থাকলেও পুঁজিবাদের ব্যাপক প্রসারে কোন বিপত্তি দেখা দেয়নি। সমগ্র উনবিংশ শতাব্দীতে ইংল্যান্ডের রাজার পতাকা যেমন দেশ-বিদেশে উড্ডীয়মান হয়েছে, তেমনি ইংরেজ বণিকদের আধিপত্যও দুনিয়া জুড়ে বিস্তৃত হয়েছে। পুঁজিবাদের গোড়ার কথা হচ্ছে, ব্যষ্টি উপার্জন ও বণ্টনের বেলায় সম্পূর্ণ স্বাধীন। তার ইচ্ছামতো যেমন সে উপার্জন করতে পারে, তেমনি সে বণ্টনও করতে পারে।
অপরদিকে মার্কস–প্রদর্শিত সাম্যবাদের মূলকথা হল, কোন বিশেষ দেশের সম্পদ রাষ্ট্রের করায়ত্ত করে ব্যষ্টিকে তার সাধ্যানুসারে রাষ্ট্রের বিভিন্ন বিভাগে শ্রম করার সুবিধা দিতে হবে এবং তা প্রয়োজনানুসারে তা যাবতীয় চাহিদা পূরণ করতে হবে। ব্যষ্টিকে যেমন তার ইচ্ছানুসারে উপার্জন করার ক্ষমতা দেওয়া যায় না, তেমনি বণ্টনের বেলায়ও তাকে কোন ক্ষমতা দেওয়া যায় না। প্রকৃতপক্ষে এ রাষ্ট্রে আদি সংখ্যা (unit) ব্যষ্টি নয়, সমষ্টি বা তার গঠিত রাষ্ট্র। এক্ষেত্রে ব্যষ্টির খাওয়া–পরা বা সর্ববিধ চাহিদা পরিপূরণে রাষ্ট্রের দায়িত্ব রয়েছে। এতে ব্যষ্টির কোন স্বাধীনতা নেই।
ইসলামী রাষ্ট্রে ব্যষ্টিকে এককভাবে বা যৌথ পদ্ধতিতে উপার্জন করার স্বাধীনতা দেওয়া হয় এবং তাকে ইসলামের আইন অনুসারে বণ্টন করার স্বাধীনতাও দেওয়া হয়, তবে কোন সময়ই তাকে এ উপার্জিত ধন–সম্পদের মালিক গণ্য করা হয় না। তাকে Custodian বা রক্ষক হিসাবে অনেকগুলো দায়িত্ব পালন করতে হয়। তাকে যাকাত আদায় করার পর আরও যেসব হক আদায় করতে হয়, তাতে তার পক্ষে পুঁজি সৃষ্টি করা সম্ভবপর হয় না।
প্রশ্ন উঠতে পারে, ইসলামী রাষ্ট্রে ব্যষ্টির স্বাধীনতা অক্ষুণ্ণ রেখে যদি ব্যষ্টির উপার্জিত সবকিছুই রাষ্ট্রের অপরাপর জনগণের কল্যাণে ব্যয় করা হয়, তা’হলে ব্যষ্টির অথবা রাষ্ট্রের পক্ষে বড় বড় কল-কারখানা প্রভৃতির প্রতিষ্ঠা করে দেশে শিল্পের অগ্রগতি কিসে সম্ভবপর হবে? তার উত্তরে বলা যায়, উৎপাদনে সক্ষম লোকেরা তাদের উপার্জিত ধন-সম্পদ রাষ্ট্রের হাতে তুলে দিলে রাষ্ট্র যেমন প্রয়োজন অনুসারে তা থেকে জনসাধারণের কল্যাণের জন্য ব্যয় করতে পারে, তেমনি উদ্বৃত্ত থেকে রাষ্ট্রের পরিচালনাধীনে নানাবিধ শিল্প প্রতিষ্ঠানেরও ব্যবস্থা করতে পারে। ইসলামী রাষ্ট্রে প্রত্যেক ব্যক্তিকেই তা সাধ্যানুসারে উপার্জন করার ক্ষমতা দেওয়া হয়। গ্রাসাচ্ছাদনের উপযুক্ত উপার্জনে অক্ষম ব্যক্তিদের জীবনযাত্রার নানাবিধ চাহিদা পূরণের জন্য উপার্জনে সক্ষম ব্যক্তিগণ যেমন দায়ী, রাষ্ট্রও তেমনি দায়ী। ধনী স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে তার উপার্জনের উদ্বৃত্ত রাষ্ট্রের হাতে তুলে দিলে রাষ্ট্র পঙ্গু, বিকলাঙ্গ, অন্ধ ও অসমর্থ লোকের খোরপোশের জন্য সম্পূর্ণ দায়ী হবে। ইসলামী রাষ্ট্রের সুবর্ণযুগে এ নীতিই অনুসৃত হয়েছিল। সে যুগে হযরত আবদুর রহমান (রাঃ) বিখ্যাত ধনী ছিলেন; কিন্তু তিনি প্রাত্যহিক জীবনযাত্রার ক্ষেত্রে অন্য দশজন মুসলিম থেকে পৃথক আড়ম্বরপূর্ণ জীবনযাপন করতেন না। রাষ্ট্রের তলবের সময় তিনি তাঁর ধনাগার উজাড় করে অকাতরে সবকিছুই বিতরণ করতেন। কাজেই ধনসম্পদ তাঁর ধনাগারে থাকা এবং বায়তুল মালে থাকা প্রায় সমানই ছিল। পার্থক্য শুধু এটুকুই ছিল যে বায়তুল মালের ধন রাষ্ট্র কেবলমাত্র রাষ্ট্রের কল্যাণের জন্য ব্যয় করতে পারতো। প্রকৃতপক্ষে ইসলামী অর্থনীতির মূলসূত্র ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গিরই ফলশ্রুতি। ইংরেজ বণিকেরা সামন্ত জমিদার শ্রেণির সৃষ্টি করেছিল এবং দেশের সর্বসাধারণ মানুষকে দাস শ্রেণিতে পরিণত করেছিল। বর্তমানে সে প্রথা রহিত হয়েছে বটে, তবে জোতদারী প্রথা রহিত হয় নাই। এক এক জন জোতদার স্বনামে ও বেনামীতে হাজার হাজার বিঘা জমির মালিক হয়ে পূর্বেকার জমিদার শ্রেণিতে পরিণত হয়েছে। অথচ দেশে ভূমিহীন লক্ষ লক্ষ লোকের অভাব অনটনের সীমা নেই। বর্তমানে জোতদারদের পক্ষে এত বিশাল ক্ষেত্রে চাষ- আবাদ করা সম্ভবপর নয় বলে তারা এসব জমিজমা ভাগে চাষ-আবাদ করেন। কোথাও ফসলের এক-তৃতীয়াংশ, কোথাও অর্ধেক চাষীকে দিতে হয়। এ সম্বন্ধে আমাদের ফিকাহ শাস্ত্রকার তথা সাহাবাগণের অভিমত কি ছিল তা স্পষ্ট ভাষায় উল্লিখিত রয়েছে।
হযরত আবু যর গিফারীর (রাঃ) মতে,
জমিকে লগ্নিতে বা ভাগে দেওয়া নাজায়েয: কারণ যার কাছে অতিরিক্ত জমি রয়েছে এবং সে এসব জমিতে চাষাবাদ করতে অসমর্থ, তার পক্ষে উচিত অপর মুসলিম ভাইকে জমি থেকে উপস্বত্ব ভোগ করতে দেওয়া। জমির মালিক খোদ আল্লাহ্ রক্ষক হিসাবে সে তার প্রয়োজন মতই ভোগ করবে। তার প্রয়োজনের অতিরিক্ত মতের পোষকতায় প্রথম শ্রেণির সাহাবাদের সমর্থন রয়েছে।
এ সম্বন্ধে হযরত আবু হোরায়রা (রাঃ) বলেছেন: “আল্লাহর রসূল (সাঃ) ফরমায়েছেন, যার কাছে জমি আছে সে নিজেই চাষাবাদ করবে বা অন্যকে বিনা লাভে (মুফত) সহানুভূতি প্রদর্শনপূর্বক চাষ করতে দেবে। যদি এ দু’য়ের মধ্যে কোনটাতেই সে রাযী না হয়, তাহলে নিজ জমিকে সে হস্তান্তর করবে।
হযরত জাবের (রাঃ) বলেন: আল্লাহ্র রসূল (সাঃ) জমির পরিবর্তে কোন কিছু গ্রহণ (Exchange) বা ইজারার দ্বারা উপকৃত হতে নিষেধ করেছেন। হযরত আবদুল্লাহ বিন উমর (রাঃ) নিজ জমিকে হযরত রসূলে আকরাম (সাঃ)-এর আমল থেকে মুয়াবিয়ার (রাঃ) আমলের প্রথম ভাগ পর্যন্ত চাষীদের (কর্ষণকারীদের) লগ্নিতে বন্দোবস্ত দিতেন; কিন্তু যখন তিনি হযরত রাফে (রাঃ)-এর হাদীস শুনতে পেলেন, তখন তিনি এ কাজ এ ভয়ে ছেড়ে দিলেন যে সম্ভবত হযরত (সাঃ) তাঁর শেষজীবনে এ সম্পর্কে মীমাংসা করেছেন। তবে এ মতবাদের বিরুদ্ধেও অপরাপর সাহাবাগণ মত প্রকাশ করেছেন। তাদের মতবাদের আলোচনাও এ ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক।
হানজালা বিন যায়েদ (রাঃ) বলেন: আমি রাফে বিন খাদিজকে (রাঃ) জমি ইজারা দান সম্পর্কে তাঁর মত অনুসন্ধান করলাম। এর উত্তরে তিনি বললেন, হযরত নবী করীম (সাঃ) এরূপ করতে নিষেধ করেছেন। তখন আমি জিজ্ঞাসা করলাম, রূপা ও সোনার বদলে অর্থাৎ নগদ টাকার পরিবর্তেও কি নিষিদ্ধ? তখন তিনি বললেন, এতে কোন আপত্তি নেই।
(বুখারী, মুসলিম, আবু দাউদ, নাসায়ী, কিতাবুল মুজারেয়া)
হযরত আবুল্লাহ বিন আব্বাস (রাঃ) বলেন: নবী করীমের নিষেধের অর্থ এ নয় যে, এ কাজ হারাম বা নাজায়েয; তবে ভ্রাতৃত্ব বা সৌহার্দ প্রদর্শনের জন্য জমি ইজারা বা মুজারেয়া না দেওয়াই উচিত। মুসলমানগণ নিজে নিজের জমি চাষ করবে, অথবা তা একে অন্যের মধ্যে সৌহার্দ ও বন্ধুত্ব স্থাপনের উদ্দেশ্যে অপরের প্রয়োজন অনুযায়ী অন্য ভাইকে বিনা লাভে দেওয়াই ভাল।
হযরত যায়েদ (রাঃ) বলেন: যেহেতু হযরতের সময়ে জমির ব্যাপারে বহু ঝগড়া-বিবাদের সৃষ্টি হতো, এজন্য নবী করীম নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত ইজারা ও মুজারেয়া মানুষের মঙ্গলার্থে নিষেধ করেছেন, মূলত একে রহিত করেন নি। এ বাধা মানুষের কল্যাণের জন্য কোনও নির্দিষ্ট সময়ে বলবত ছিল।
(হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা-২য় খণ্ড, পৃ. ১১৭)
ইমাম আবূ হানিফা (রহঃ) বলেন: নগদ লাগান (ইজারা) জায়েয, কিন্তু জমি ভাগে বা মুজারেয়াতে দেওয়া নাজায়েয।
তাউস (রহঃ) ও ইবনে হাজম (রহঃ) বলেন: জমি ভাগে বা মুজারেয়াতে দেওয়া জায়েয কিন্তু নগদ লগ্নি বা ইজারাতে দেওয়া নাজায়েয। কওমের অধিকাংশ আলিম বলেন যে, জমি নগদ টাকার পরিবর্তে বা ভাগে ইজারা দেওয়া উভয়ই জায়েয এ প্রথা সালফ ও খলফ অর্থাৎ সাহাবা ও তাবেয়ীনদের মধ্যে প্রচলিত ছিল। মোটামুটি এ সম্পর্কে বুদ্ধিমত্তার দিক থেকে সকল রকমের সিদ্ধান্তেরই সম্ভাবনা রয়েছে। কোন না কোন ফিকাহশাস্ত্রবিদের সঙ্গে যে কারো মতের মিল থাকতে পারে। নগদ লগ্নি জায়েয সম্পর্কে যেসব বর্ণনা হাদীসের কিতাবে আছে, ইমাম নাসায়ীর (রহঃ) মতে, সেসব বর্ণনায় পরিষ্কারভাবে বুঝা যায় নগদ লগ্নি ইজারা দেওয়া বলেই প্রমাণিত হয়। সাঈদ বিন্ মুসায়েবের (রহঃ) বর্ণনাতে বুঝা যায়, নগদ লগ্নি না দেওয়া নবী করীমের আদেশ নয়।
অনুরূপ যেসব ফকিহ্, জমি ভাগে দেওয়া জায়েয বলে খয়বরের ইয়াহুদী ও রসূলের (সাঃ) মধ্যকার ব্যাপারকে প্রমাণস্বরূপ উপস্থিত করেন, তাঁদের মতামত উল্লেখ করে ইমাম আবু হানিফা (রহঃ) উত্তর দেন যে, খয়বরের ইয়াহুদীদের জমির মালিক বলে গণ্য করা হয়েছিল একথা সত্য। এখানে সমস্যা হচ্ছে কওমের ব্যক্তিগণের মধ্যে জমিদারী (বর্তমান কালের জোতদারী) সম্পর্ক। হাদীস শরীফে এসব প্রথার সৃষ্টি সম্পর্কে পরিষ্কার নিষেধ রয়েছে।
এ সমস্ত বর্ণনার সারমর্ম এই যে, নবুয়তের সময় ও খুলাফায়ে রাশেদীন পর্যন্ত যদিও জমি নগদ লগ্নি বা ভাগে দেওয়া প্রচলিত ছিল, তবুও নবী করীম (সা) জমিদারীর (জোতদারী) এ সাধারণ ও সহজ–সরল পন্থা অপছন্দনীয় বলে এবং মরুয়ত বা সদ্ব্যবহারের দিক থেকে একে নিকৃষ্টতম পন্থা বলেই মনে করতেন। এর দরুন কওমের মধ্যে পরস্পর অধিক ঝগড়া–বিবাদ হওয়ার ফলে পরস্পর শত্রুতা, দ্বেষ, হিংসা বেড়ে গিয়ে মারামারি, ঝগড়াঝাটিতে পরিণত হতে পারে। অতএব ইমাম বা নেতাকে ইসলাম অনুমতি দেয় যে তিনি এ প্রথা (System) সার্বজনীন কল্যাণের খাতিরে রহিত করতে পারেন। যদি ইসলামের খলীফা সার্বজনীন কল্যাণের খাতিরে অথবা ইসলামের মঙ্গলের জন্য জমিগুলোর স্বহস্ত কর্ষণজনিত মালিকানা বাদ দিয়ে জমিদারী (জোতদারী) প্রথাকে রহিত করেন, তবুও রাষ্ট্রের অবশ্য কর্তব্য হবে খরিদ করা মালিকানাস্বত্বের জমির উচিত মূল্য বায়তুল–মাল থেকে মালিকদের প্রদান করা।
অতএব ইসলামের রাজনীতি ধারায় এরূপ জমিদারীর দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়, যেখানে জমির মালিক ও চাষী দু‘জনেই অংশীদার রূপে গণ্য হয়। পৃথিবীর প্রাচীন ও বর্তমানকালের বিরাট জমিদারী, তালুকদারী প্রভৃতিকে জবরদস্তি বন্দোবস্তের এক জীবন্ত দৃষ্টান্ত বলা যায়। এসবের সঙ্গে ইসলামের কোন সম্পর্ক নেই। বর্তমানকালে এক একজন জোতদারের অধীনে এতগুলো জমি থাকা এবং তাকে শোষণের অবকাশ দেওয়া ইসলামী নীতিসঙ্গত ব্যাপার নয়।
ইসলামের অভ্যুত্থান থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত মুসলিম সমাজে প্রচলিত ভূমি সম্বন্ধে আলোচনা করলে নিম্নলিখিত সত্যটিই প্রকটিত হয়। জনাব রসূলে আকরাম (সাঃ) ও খুলাফায়ে রাশেদীনের (রাঃ) আমলে আনসার ও মুহাজিরদের ভূসম্পত্তির মালিকানার অর্থ এই ছিল যে, যে জমি তারা জায়গীর স্বরূপ চেয়েছিলেন তা তাদের সহজ-সরল জীবনযাপনের পক্ষে ছিল পর্যাপ্ত। তারা অনাবাদী জমিকে আবাদ করে ফসল ফলানোর উপযোগী করে তুলতেন। এগুলো বর্তমানকালের জমিদারী বা জোতদারের মত বড় বড় বসতি এলাকা ছিল না, মাত্র কতক আবাদী জমির সমষ্টি ছিল। এসব জমি কোন কোন সাহাবা ইজারা দিতেন আবার কেউ কেউ নিজেও চাষাবাদ করতেন। তবে বিজিত দেশের সমূহ সম্পত্তি সরকারের অধীনে আদিম বাসিন্দাদের হাতে থাকতো এবং এর মালগুজারী বা খাজনা ব্যক্তিগত সম্পত্তি না হয়ে বায়তুল-মালে পরিণত হত। যে ব্যবস্থার ফলে মুষ্টিমেয় মানুষের হাতে জমিজমা এমনভাবে গিয়ে পড়ে যে চাষীরা পণ্যদ্রব্যে পরিণত হয়, এ প্রকার প্রথার কোন আভাস ইসলামী শাসনতন্ত্রে পাওয়া যায় না। হযরত উমর (রাঃ) রোমানদের এ প্রকার জমিদারীকে রহিত করেন। হযরত উমরের (রাঃ) খিলাফতের সময় ইরান, রোম, মিসর, সিরিয়া, ইরাক প্রভৃতি দেশ জয় করা হলে ইরানের বাদশাহের যে ব্যক্তিগত সম্পত্তি ছিল ও মুসলিমদের যে জমি জায়গীর দেওয়া হয়েছিল তাছাড়া সাধারণ জমি কৃষকদের হাতেই ছিল।
যখন হযরত উমর (রাঃ)-এর সময় ইরাক ও সিরিয়া বিজিত হয় তখন সাহাবীরা আবেদন করেন যে ঐ দেশসমূহের জমি যেন তাদের মধ্যে বণ্টন করে দিয়ে তাদের জমির মালিক বলে গণ্য করা হয়। হযরত বেলাল (রাঃ) ও হযরত যুবাইর (রাঃ) বিশেষভাবে এ সম্পর্কে বারবার আবেদন জানান। হযরত উমর এরূপ ব্যবস্থা করতে অস্বীকার করেন। এ প্রসঙ্গে তাঁর অভিমত বিশেষভাবে স্মরণীয়। তিনি বলেন, সমস্ত ভূমি সরকারের অধীন থাকবে এবং তার সকল আয় মুসলমানদের প্রয়োজন ও আবশ্যকীয় বিষয়াদির জন্য ওয়াক্ফ্ফ বলে গণ্য হবে।
ইমাম আবূ ইউসুফ (রহঃ) বলেন, হযরত উমর (রাঃ)-এর ফরমান অনুযায়ী মুজাহিদ ও বিজেতাদের মধ্যে জমি বণ্টন নিষিদ্ধ। (কিতাবুল খারাজ, পৃ. ২৪- ২৯) এ নীতি হযরত ফারুকে আজম (রাঃ) কেবল মুখেই প্রচার করেন নি, কার্যেও পরিণত করেছেন। পরবর্তী মালিকগণও এ নীতির অনুসরণ করেছিলেন। হযরত উমর ফারুক (রাঃ)-এর পরে এবং হযরত উসমান (রাঃ) ও হযরত আলী (রাঃ)-এর সময়ে যে সব দেশ বিজিত হয়েছিল সে সব দেশের অধিকাংশ জমিই সরকারের অধীন থাকতো এবং চাষীদের থেকে আদায়কৃত খাজনা বা লগ্নি সরকার কর্তৃক নানাবিধ প্রয়োজনে ব্যয় করা হত। মুজাহিদ ও বিজয়ীদের বারংবার আবেদন সত্ত্বেও ঐসব দেশের জমি জায়গীর বা বন্দোবস্ত দেওয়া হয়নি। হযরত উসমান (রাঃ) তাঁর খিলাফতের শেষের দিকে এ নীতি লঙ্ঘন করায় হযরত আবু যর গিফারী তাঁকে এ নীতির কথা বারবার স্মরণ করিয়ে দেন। কোন সময়ে হযরত ফারুকে আজম (রাঃ) মুসলমানদেরকে জমিদারী ও চাষাবাদ থেকে এই বলে বিরত রেখেছেন যে, মুসলমানদের নিজেদের ও তাদের পরিবার পরিজনদের বৃত্তি বায়তুলমাল থেকে দেওয়া যায়। তাহলে এমন কোন কারণই থাকতে পারে না যে, তাঁরা খিলাফতের বা সরকারের কাজকর্মের অংশীদার না হয়ে, জিহাদ ও আল্লাহর বাণীর সহায়ক না হয়ে বলদের লেজের পিছনে ঘোরাফিরা করতে যাবেন।
এ দীর্ঘ আলোচনার ফলে বোঝা যায়, দ্বিবিধ কারণে জমিদারী বা ভাগে চাষাবাদ করা ইসলামের দৃষ্টিতে নিতান্ত গর্হিত ব্যবস্থা। আল্লাহর সার্বভৌমত্ব ও মানুষের প্রতিনিধিত্বের নীতি অনুসরণ করে হযরত আবু যর গিফারী (রাঃ) একে নিষিদ্ধ করতে চেয়েছেন। কেননা এ দুনিয়ার ধন সম্পদ ও ভূমি সবকিছুরই মালিক আল্লাহ্ তা’আলা হলে মানুষের কোন মালিকানা থাকতে পারে না। তার কাছে গচ্ছিত সম্পদ সে নিজে উপভোগ করবে, তার প্রয়োজনের অতিরিক্ত সবকিছুই সে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে তার অপর ভাইকে ভোগ করতে দেবে। খলীফা উমর (রাঃ) মুসলিমদের দখলে থাকার দরুন, তারা কোন পরিশ্রম না করেও উপস্বত্ব পাওয়ার দরুন, অলস ও বিলাসী মানব গোষ্ঠীতে পরিণত না হয়, সে জন্য ভাগে চাষাবাদ দেওয়া দূরের কথা, কৃষিকার্য থেকেও তাদের বিরত করেছেন। তাই দেখা যায়, উভয়ের দৃষ্টিকোণ ভিন্ন হলেও লক্ষ্য ছিল একই। অর্থাৎ মানবতার কল্যাণের জন্যই তারা উভয়ে জমি থেকে প্রয়োজনের অতিরিক্ত উপস্বত্ব লাভ করাকে নিষিদ্ধ করেছেন।