বাংলা কবিতার আসরে আল্লামা ইকবাল

এক দেশের কাব্য অন্য দেশের ভাষায় রূপান্তরিত হয় বিবিধ কারণে। এক পরিবেশের নিসর্গলোক অন্য পরিবেশে অবশ্যই দীপ্তিমান হতে পারে না, এক নির্দিষ্ট সীমার সৌন্দর্য অন্য সীমায় হয়তো বা রূপ রহিত, একই সূর্য কোথাও খরপ্রভ, আবার কোথাও নির্বাণ উন্মুখ, কিন্তু তবুও যে কোনো ক্ষেত্র থেকে প্রতিটি অবস্থায় উপভোগ করা যায়। আমরা এই বিশ্ব সাহিত্যের বিচিত্র সৌন্দর্য উপভোগের জন্য অনুবাদের দ্বারস্থ হই। অনুবাদের একটি কারণ হচ্ছে, আপনার সাহিত্যকে বিচিত্র সম্ভারে পরিবৃদ্ধ ও সমৃদ্ধ করা। দ্বিতীয়ত, অনুবাদের মধ্যে সেই বস্তুকে আহরণ করা, যার সঙ্গে আমাদের ভাবগত ও আদর্শগত সম্পর্ক রয়েছে। দর্শন, বিজ্ঞান এবং অন্যবিধ জ্ঞান ভান্ডারের ক্ষেত্রে অনুবাদের দ্বারা আমাদের ভাণ্ডারের পরিপুষ্টি ও প্রসার ঘটে থাকে, কেননা এদের আবেদন সব ক্ষেত্রেই আমাদের বোধি ও মননের প্রতি। কিন্তু যে ক্ষেত্রে আবেদন হৃদয়ের প্রতি এবং হৃদয়জাত বৃত্তির প্রতি, সে ক্ষেত্রে অনুবাদের জন্য একটি প্রখর অনুশাসন রয়েছে। বিদেশের কাব্য পাঠে যেখানে আমার হৃদয় থেকে আনন্দ শতধারায় নিঃসৃত হয় না, যেখানে আবার গৃহবেষ্টিত মালঞ্চের লতাপল্লব বিদেশের বৃক্ষের ছায়ায় লজ্জিত ও বর্ণহীন হয়, যেখানে বিদেশের সৌভাগ্য আমার স্বাভাবিক জীবনধারার পরিপন্থী, সেখানে অনুবাদের মূল্য নেই, সেখানে রূপায়িত কাব্য Eliat- এর ভাষায় ভগ্ন পাষাণ ফলকের উপর নির্ণিমেষ সূর্যরশ্মির মতো আর নয়।

ইংল্যান্ডের রোমান্টিক যুগের বায়রনকে বিদেশীয়দের মধ্যে সর্বপ্রথম জার্মানরা প্রশস্তি জানায়। তাঁর আবেগ, দুর্বুদ্ধিতা, জীবনের প্রতি পরিহাস কুটিল দৃষ্টি তাকে জার্মানির মনন ও হৃদয়বৃত্তির সঙ্গে একাত্ম করেছে। তাই তাঁর কাব্যের অনুবাদও দেশে অত সহজে হতে পেরেছিলো। শেলীর তন্ময়তা, ভাবাবেগ যা দিগন্তের ক্রমশঃ অপসৃয়মান বর্ণ-বৈচিত্র্যের মতো মধুর অথচ সাধারণ বোধশক্তির আয়ত্তাতীত, অত্যন্ত সহজে ফরাসীদের অনুভূতিপ্রবণ মনে দোলা দিয়েছিল। তাই ফরাসী ভাষায় তাঁর কাব্যের প্রচুর অনুবাদ হয়েছে। আঁদ্রে মোরায়া তো তাঁকে দীর্ঘগ্রীব, প্রসারিত পক্ষ, নভোচারী বিহঙ্গের সঙ্গে তুলনা করেছেন।

বাংলা ভাষায় বিদেশী সাহিত্য অনূদিত হয়েছে প্রধাণত দুইটি কারণে। প্রথমত, এতদ্দেশীয় জনসাধারণের ধর্ম বোধের পোষকতার জন্যে।

দ্বিতীয়ত, সমপর্যায়ে ভাবাবেগ ও জীবনাদর্শের প্রশ্রয়ের জন্যে। মহাভারতকার কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাস লিখেছিলেন, সূর্যোদয়ে যেমন তমোরাশি বিনষ্ট হয়। মহাভারত শুনলে সেইরূপ কায়িক, বাচিক ও মানুসিক সকল পাপ দূর হয়। সুতরাং মহাভারতের অনুবাদ হয়েছে, এখনও হচ্ছে।

কোরআন শরীফের অনুবাদ কিন্তু মোসলমানেরা প্রথম করেনি। তার অবশ্য অন্য কারণ রয়েছে, কোরান শরীফের ভাষা এরূপ সংক্ষিপ্ত যার সারগর্ত যে, প্রকৃত তথ্যটি পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করতে হলে আয়াতের বহির্ভূত অনেক কথাই পাদ পূরণরূপে বলা অত্যাবশ্যক। কিন্তু আধিদৈনিক অভিশাপের ছাত্র কোনো মুসলমান এ কাজে প্রথম অগ্রসর হয়নি। হিন্দুর সে ভয় ছিলো না তাই কোরআনের প্রথম অনুবাদক হিসাবে তাই গিরীশচন্দ্র সেন। আত্ম এর রুদ্ধকপাট যখন অর্গলমুক্ত হলো তখন অনেকেই এ পথে এগিয়ে এলেন। এভাবে বাংলা ভাষায়  এমাম গাজ্জালির অনুবাদ হয়েছে। এমাম গাজ্জালি মহাসমুদ্রের মতো আকাশের ন্যায় অপার, কোথাও ক্রীড়াচঞ্চল, কোথাও পর্বতপ্রমাণ জলরাশিতে আবৃত। কিন্তু অনুবাদ সেইরূপ উজ্জ্বল হয়নি। কেননা, অনুবাদক লক্ষ্য করেছেন, নৈতিক প্রবচনের উপর। অথচ ভাষার শিথিলতা সেই নীতিকথাও মন্থর হয়েছে। সাদীর নীতিকথার সঙ্গে কাব্যভাব বিজড়িত, তাই সাদী আমাদের গ্রহাঙ্গনের মৈত্রী পেয়েছেন অত্যন্ত সহজে বাতকম্পিত বৃক্ষপত্রের মতো আমাদের মন নব নব আবেশে জ্বলে উঠে।

এরপর আমাদের হৃদয়বৃত্তির যোগসূত্রের সন্ধান করেছি হাফেজের দীওয়ানে, গজলে ওমরের রুবাইয়াতে। অন্তরদৃষ্টি খুঁজেছি, রহস্য খুজেছি। সাধারণ সৌন্দর্য নয় শুধু সৌন্দর্যের সুষমার অন্তরালে জীবনের যে নিগূঢ় বঞ্চনা রয়েছে, তাকে বুদ্ধির আয়ত্তে আনতে চেয়েছি। তাই তো হাফেজের গান আমাদের কানে নিত্যকালের জন্যে অনুরন রেখে গেছে-

“কা’তর হ’য়ো না, যে উদ্যানে তুমি এখন আছ সেখানে আরো একবার প্রাণের স্পন্দন দেখা দেবে: তোমার সামনে যে গোলাপের অবগুণ্ঠন আছে, হে রাত্রির গীতিকার, তা কি তুমি দেখতে পাচ্ছ না?”

“এ জীবনের রহস্য যদি না-ই জেনে থাকো তা হলেও মুহ্যমান হয়ো না। আগুণ্ঠনের মধ্যেও প্রচুর আনন্দ সংগুপ্ত আছে।”

“প্রাণ আমার দিনের ঘূর্ণিবায়ু যদি তোমায় এই ক্ষণভঙ্গুর গৃহখানি ধ্বংস করে দেয়, তা’হলে দুঃখ করো না, কারণ প্রলয় হ’তেও তোমাকে বাঁচাবার জন্য প্রেম সঞ্চিত আছে।”

“দীনহীনের মতো এক কোণে প’ড়ে আছে দারিদ্র তোমার সহচর, নির্জন রাত্রির গভীর অন্ধকারে তুমি একা, এসবের জন্য দুঃখ ক’রো না হাফেজ, দুঃখ ক’রো না, তোমার ভালবাসা, তোমার গান যে তোমারই।”

যিনি রাত্রিকে তমোময়, দিবসকে কর্মময়, পর্বতকে দ্বিধাহীন এবং সমুদ্রকে উচ্ছ্বসিত করেছেন, সেই পরম করুণাময় আল্লাহ তা’আলার নামে যে আরব্য উপন্যাস আরম্ভ হয়েছে, সেখানে অসম্ভব ও প্রতীতি জন্মায়, সেখানে বাস্তব অবাস্তবের মধ্যে কোনো সীমারেখা নেই, সে কাহিনী বিচিত্রভাবে আমাদের হৃদয় বৃত্তিতে শিহরণ আনে। শাহরিয়ারকে আমরা বহুবার অনুসরণ ক’রেছি, যিনি ক্ষণদ্যুতির মতো
উজ্জ্বলিত তলোয়ারের আঘাতে রিরংস জর্জরিত বহু রমণীর দেহকে দ্বিখণ্ডিত করেছেন।

ইকবালও বাংলাতে অনূদিত হয়েছেন উপরোক্ত দু’টি কারণেই।
প্রথমত, আমাদের হৃদয়বৃত্তির সঙ্গে যোগসূত্র নির্ণয়ের জন্য’ দ্বিতীয়ত, ধর্মবোধের পোষকতা ও তত্ত্বজিজ্ঞাসার মীমাংসার জন্য। বাংলাতে তাঁর প্রথম অনুদিত গ্রন্থ শেকোয়া, সে সময় বাঙালী মুসলমান নজরুল ইসলামকে পুরোভাগে রেখে আপন দুঃখ-দুর্দশার নিবৃত্তি খুঁজছে, স্বস্তিহীন মুহূর্তে সে আল্লার বিরুদ্ধেও অভিযোগ এনেছে, তখন ইকবালের শেকোয়ায় সে আপন মনের অনুরণন শুনেছিলো। চরম দারিদ্র্যে নিষ্পিষ্ট, দুঃখে জর্জরিত এবং তৎহেতু আত্মঘাতী কবি আশরাফ আলী খান শেকোয়া প্রথম তর্জমা করেছিলেন। আশ্চর্য আবেগ এবং গতির মধ্যে আশরাফ আলী শেকোয়ায়  আপন মনের প্রতিফলন দেখেছিলেন, তাই তাঁর অনুবাদ আক্ষরিক না হলেও আন্তরিকতায় উজ্জ্বল এবং কাব্য-সৌন্দর্য নবোদিত বর্ণবৈচিত্র্যের মতো আবেগ এবং গতির মধ্যে আশরাফ আলীর পর শেকোয়ার তর্জমা অনেক হয়েছে। মুহাম্মদ সুলতান, মীজানুর রহমান ও ডক্টর শহীদুল্লাহ এই তিনজনের নামই বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। মীজানুর রহমান ও ডক্টর শহীদুল্লাহ মূলকে যথাযথভাবে অনুসরণ করেছেন, তাই তাদের রূপায়ণে ইকবালের বক্তব্যের বিকৃতি ঘটেনি। কিন্তু কাব্যিক মাধুর্য ক্ষুণ্ন হয়েছে, একে তাঁরা দোষের মনে করেননি, কেননা তাঁদের উদ্দেশ্য ছিলো বাংলার পরিবেশে ইকবালকে যথাযথভাবে পরিদৃশ্যমান করা, সুদৃশ্যমান নয়। মুহাম্মদ সুলতানের অনুবাদ সুখপাঠ্য এবং তৃপ্তিসঞ্চারী।

আমাদের ধর্মবোধের পোষকতা এবং তত্ত্বজিজ্ঞাসার জন্য অনূদিত হয়েছে ইকবালের ‘আসরারে খুদী’ ও ‘রমুযে বেখুদী’। উভয়ই গ্রন্থই নিগূঢ় দার্শনিক তত্ত্বসমন্বিত, নিশ্চিন্তে বোধগম্য নয়। ‘আসরারে খুদী’র প্রথম বাংলা তর্জমা করেন সৈয়দ আবদুল মান্নান, অনুবাদ জনপ্রিয়ও হয়েছে। আবদুল মান্নান গদ্যে তর্জমা করেছেন। এরপর আমি সপ্তম অধ্যায় পর্যন্ত কাব্যানুবাদ করেছিলাম। আমি মূলকে যথাযথভাবে অনুসরণ করিনি, শুধু মূলীভূত তত্ত্ব এবং আদর্শকে অক্ষুণ্ণ রাখতে চেয়েছি। ফররুখ আহমদও কাব্যে অংশবিশেষ অনুবাদ করেছেন।

এভাবে বিচিত্রভাবে বাংলা কবিতার আসরে আমরা ইকবালকে পেয়েছি। বাংলার হাওয়ায় তাঁর গান ভেসেছে, বাংলার জলকল্লোলে তাঁর কণ্ঠ শুনেছি। তাঁর হৃদয়ের বিপুলতা দেখেছি বাংলার আকাশে। যেমন নবোদিত সূর্য সমুদ্রের কল্লোলের যেমন পরিমাপ হয় না অথচ তা দেখে বিহবল ও আনিন্দিত হওয়া যায়, তেমনি ইকবালের গভীরতা, ব্যাপকতা ও বিপুলতা আয়ত্তাতীত কিন্তু আমাদের জন্য সংবেদনশীল ও আনন্দদীপ্ত। তাঁর আত্মজিজ্ঞাসার বাণী আমাদের জন্য পরম অমোঘ-

“যদি তুমি কভু রাতের আঁধারে
একান্ত নিরালায়
নির্বাক মনে জেগে থাকো কোথা
জীবন প্রত্যাশায়
আদর্শ বাণী জীবন্ত করো তুমি-
উষার আলোতে উজ্জ্বল হোক মনের ধুসর ভূমি।
আল্লাহর কাছে সে আদর্শের বাতি হয়তো ম্লান
প্রকৃতির কাছে দীপ্ত তারারা আনিয়াছে কল্যাণ;
স্বর্গ থেকেও আলোকোজ্জ্বল রূপে
মানুষের মনে মোহন স্বপ্ন আনিয়াছে চুপে চুপে।
বিজিত হয়েছে মানুষ তাহার কাছে
বশীকরণের যাদু তার জানা আছে
আকর্ষণের ক্ষমতা তাহার একান্ত সঞ্চয়;
অতীত কালের জমানো মিথ্যা আর নয় আশায়
যে ভেঙ্গেছে সেই মিথ্যার কুহেলিকা
পৃথিবীতে সেই জ্বেলেছে এবার প্রাণের নবীন শিখা।
সংঘাতে তার মনের আবর্তন
শেষ বিচারের রুদ্র দিনের জানালো আমন্ত্রণ।” (আসরারে খুদী)

ঋণ স্বীকার: ইকবাল সংসদ-২০০৭।

১১১৯ বার পঠিত

শেয়ার করুন

মতামত প্রকাশ করুন

Scroll to Top